ব্লাসফেমি আইন সংখ্যালঘূদের এক হাত দেখে নেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের কিছু রসালো প্রয়োগ দেখুন;
.
১৯৯১ সালের ১০ ডিসেম্বার পাঞ্জাবে পানির কল মেরামত সংক্রান্ত বিষয়ে দুই প্রতিবেশী সাজ্জাদ হোসেন ও গুল মাশীহের ঝগড়া হয়। এখানে সাজ্জাদ হোসেন মুসলান গুল মাশীহ খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী। ঝগড়ার পরে মিটমাট হয়, এমনকি দুইজন করমর্দন করে স্থান ত্যাগ করেন। কিন্তু স্থানীয় ইমামের প্ররোচনায় সাজ্জাদ হোসেন গুলের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে মামলা করে। তিনি দাবী করেন গুল ঝগড়ার সময় মহানবীকে কটূক্তি করে মন্তব্য করেছে। এই মামলায় তিনজন সাক্ষী ছিলো একজন ফরিয়াদি সাজ্জাদ হোসেন নিজে অপর দুইজন তাঁর প্রতিবেশী।

দুই প্রতিবেশীর একজন আদালতকে বলেন
“আমার উপস্থিতিতে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি”

আরেকজন বলেন
“গুল মাশীহ নবী সম্পর্কে কোন কটূক্তি করেনি”

এই অবস্থায় শুধু অভিযোগকারীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আদালত বলেন;
“সাজ্জাদ হোসেন ২১ বছরের যুবক, তার মুখে দাঁড়ি আছে এবং তাকে প্রকৃত মুসলমানের মত দেখায়। ফলে তাকে বিশ্বাস না করার কোন কারণ দেখি না।”

১৯৯২ সালের ২ নভেম্বর পাঞ্জাবের সারগোদা সেশন কোর্টে মাত্র একজন সাক্ষীর সাক্ষে (যে কিনা ফরিয়াদি নিজে) ৪২ বছর বয়স্ক গুল মাশীহকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে আদালত।
.
১৯৯৩ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি লন্ড্রি কর্মচারী খৃষ্টান ধর্মানুসারি আনোয়ারের সাথে তার মুসলিম বন্ধু মোহাম্মদ আলমের ঝগড়া হয়। দুজনই ধর্ম নিয়ে কটূক্তি ও বাদানুবাদে লিপ্ত হয়। ঘটনা শুনে মৌলবাদী সংগঠন “আঞ্জুমান সিপাহি সাহাবা”র নেতা হাজী মোহাম্মদ তৈয়ব ব্লাসফেমি আইনে মামলা করে।

আদালতে আনোয়ার তার অপরাধ স্বীকার করে কিন্তু সাথে সাথে এও জানায় মোহাম্মদ আলমও তার ধর্মের যীশু ও মেরীকে উদ্দেশ্য করে অনেক অশ্লীল কথা বলেছে। মুলত খৃষ্ট ধর্মকে গালিগালাজ করার পরেই আনোয়ার ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি করে। আনোয়ার মোহাম্মদ আলমেরও বিচার দাবী করে।

আদালত তাকে জানায়;
ব্লাসফেমি আইনে শুধু মহানবীকে উদ্দেশ্য করে কটূক্তিকে অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয়। কিন্তু অন্য ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা অন্য ধর্মের ঈশ্বর সম্পর্কে কটূক্তি অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয় না।
.
১৯৯৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের এক কোর্টে ব্লাসফেমি আইনে বিকৃত মস্তিষ্কের আরশাদ জাভেদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে আদালত। রায় শুনে সে আদালত জুড়ে নাচতে শুরু করে।

ঘটনা হচ্ছে কয়েক মাস আগে সালমান রুশদি লিখিত স্যাটানিক ভার্সেস বইয়ের বিরোধী ছাত্ররা মিছিল বের করে। সেই মিছিলের সামনে এসে জাভেদ নাচতে থাকে এবং দাবী করে সালমান যা লিখেছে ঠিক লিখেছে। ছাত্ররা তাকে মেরে থানায় সোপর্দ করে। দীর্ঘদিন আটক অবস্থায় তার চিকিৎসা হয় মানসিক হাসপাতালে। সরকার পক্ষের ডাক্তারও তাকে পরীক্ষা করে পাগল ঘোষণা করে।

কিন্তু আদালত বলে;
“ব্লাসফেমি আইনের কোথাও লেখা নেই যে একজন লোক পাগল হলে সে ধর্ম অবমাননা করতে পারবে”

এরকম অসংখ্য আছে। পারলে খুঁজে নিয়ে পড়তে পারেন এমিনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের প্রয়োগ বিষয়ক প্রতিবেদন গুলো পড়ে।

বাংলাদেশের ৫৭ ধারা ব্লাসফেমি আইনের অন্য নাম মাত্র।
একজন মানুষের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনলেই তাকে যাচাই না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্যালাটা আমাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা কি যৌক্তিক আলোচনা নাকি নিরর্থক ব্যাঙ সেটা যাচাই করার আগেই পকেটমারের মত মাইর শুরু। এই দেশে ব্লাসফেমি আইন হলে মুসলমানরাই মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এটাকে বেশী ব্যাবহার করবে।

পাকিস্তানেও একই ঘটনা হয়েছিলো
১৯৫৪ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর যুক্ত ফ্রন্ট যখন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ায় তখন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতারা একটি হাস্যকর ফতোয়া দেন,

“যুক্তফ্রন্ট নাস্তিকের দল, যুক্তফ্রন্টকে ভোট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটদাতার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে”

রঙ্গরসের দেশ পাকিস্তান এরকম হাস্যকর সব ফতোয়া দেবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর পরেও আমরা কেন পেছনের দিকে হাঁটছি ?

আজকেও দেখলাম সব মন্দির ভেঙে মসজিদ বানানোর ফতোয়া দিচ্ছে জামাত,
ওদিকে চট্রগ্রামে দুই কিশোরের ফেসবুক তন্ন তন্ন করেও একটা ধর্মদ্রোহী লেখা খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশ
আর টেস্টে এ প্লাস পাওয়া নিরীহ দুইটা ছেলেদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে জেল হাজতে বসে।

নজরুলের দুটো লাইন খুব মনে পড়ছে,

“বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন বসে,
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজি কোরান-হাদীস চষে।”

সাতান্ন ধারার জয়।