প্রথম পর্ব

এদিকে সারা শহরে সত্যাগ্রহীদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করা হয় । সকাল ১১ টার মধ্যে প্রায় ২ হাজার সত্যাগ্রহীকে জেলে পুরা হয় । একদলকে গ্রেফতার করা হলে নেতৃত্বের নির্দেশ মতো অন্যদল সে স্থান সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করে নেয় । আন্দোলনকারী অনেককে পুলিশ ট্রাকে তুলে দূরে ফেলে আসে । সত্যাগ্রহীদের ট্রাক সঙ্গে সঙ্গে তাদের তুলে শহরে নিয়ে আসে । বিকেল চারটা পর্যন্ত সত্যাগ্রহের সময়সীমা ছিল । কোন বড় অঘটন ছাড়া কেটে যায় বেলা আড়াইটা পর্যন্ত । সত্যাগ্রহীদের সতর্ক-সাবধানের কারনে পুলিশ অঘটন ঘটানোর কোন সুযোগ পায়নি । বেলা আড়াইটার দিকে গ্রেফতার করা সত্যাগ্রহী ভর্তি একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের কাছে পৌঁছে । লোকজনের ভীরের চাপে ট্রাকটি আগাতে পারছিলো না । এক সময় ট্রাকটি আটকে পড়ে । পরক্ষণেই দেখা যায় ট্রাকটি আগুনে পুড়ছে । বিএসএফ-এর জোয়ানরা ঘটনা বোঝার জন্য অপেক্ষা করল না । তারা নিরস্ত্র, অহিংস সত্যাগ্রহীদের উপর গুড়ুম গুড়ুম গুলি চালালো । তবুও সত্যাগ্রহীরা রেললাইন ছেড়ে পালালো না । ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তারা গুলির মুখে অটল থাকলো । রাইফেলের গর্জন থামলে পরে দেখা গেল স্টেশন চত্বরে ৯ টি তরতাজা লাশ পড়ে আছে । এর মধ্যে একটি লাশ একজন ছাত্রীর । জনতার সহায়তায় লাশ এবং আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । তখন সারা শহরের মানুষ হাসপাতালমুখী । এর মধ্যে আচমকা ঘোষিত হয় বিকেল পাঁচটা থেকে সান্ধ্য আইন বলবৎ হবে । সিভিল সার্জন জানালেন লাশের পোস্টমর্টেম শেষে পরদিন সব মরদেহ ফেরত দেওয়া হবে ।সত্যাগ্রহীরা ঘোষনা দিলেন লাশ নিয়ে পরদিন শোক মিছিল বের হবে টাউন ক্লাব মাঠ থেকে । সান্ধ্য আইনের সুযোগে বিএসএফ হাসপাতাল থেকে লাশগুলো গুম করে নিতে চেয়েছিল । সত্যাগ্রহীদের সতর্ক প্রতিরোধ ও সিভিল সার্জন আশুতোষ মুখার্জীর সাহসী ভূমিকার জন্য তাদের সে চক্রান্ত সফল হয়নি ।

১৯ মে গুলিবর্ষণের পর স্টেশন চত্বরে ৯ টি লাশ পাওয়া গিয়েছিল । পরদিন ২০ মে এই লাশ কাঁধে বহন করে বিরাট শোক মিছিল সারা শিলচর শহর প্রদক্ষিণ করে । গুলি বর্ষণের পরদিন আরো দুটি লাশ পাওয়া যায় । এই নিয়ে লাশের সংখ্যা দাঁড়ায় এগারোতে । এই লাশও কাঁধে বহন করে ২১ মে শহরে শোক মিছিল হয় । ২৯ মে বরাক উপত্যকার সর্বত্র একাদশ আত্মোৎসর্গী বীরদের স্মরনে শোক দিবস পালন করা হয় । সে সঙ্গে একটি ব্যতিক্রমী কর্মসূচিও নেয়া হয়েছিল । এ দিন সর্বত্র ঘরে ঘরে অরন্ধন কর্মসূচি পালিত হয় । বেলা ২ টা পর্যন্ত সকল সরকারি অফিসে সত্যাগ্রহীদের পিকেটিং চলে । বেলা ঠিক ২টা ৩৫ মিনিটে শহরে-গ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষ নীরবতা পালন করে । ১৯মে এ সময়ই পুলিশ গুলি বর্ষন করেছিল । এ সময় বেসরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল । জেলের বন্দিরাও জেলের ভিতরে শোক দিবস পালন করে । ১৯ মে পুলিশ গুলিবর্ষন করে ১১ জন ভাষাপ্রেমিককে হত্যার প্রতিবাদে, নিহতদের স্মরণে ও বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় । গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে লোকসভা ও বিধান সভার সদস্যবৃন্দ, মহকুমা পরিষদ, পঞ্চায়েত ও অন্যান্য স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণও পদত্যাগ করেন ।

১৯ মে গুলি বর্ষণ এবং ১১টি তরুন প্রাণের আত্মাহুতির পর আন্দোলনের নেতৃত্ব সত্যাগ্রহের গতানুগতিক ধরন পালটিয়ে অন্যরকম কর্মসূচি হাতে নেন । তাঁরা এ পর্যায়ে অফিস সমূহের গেইটে বা বারান্দায় সত্যাগ্রহ পালন না করে, সত্যাগ্রহীরা সকালে অফিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকে অফিসে চেয়ারে বসে পড়তেন । অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ বসার জায়গা না পেয়ে ফিরে যেতেন । এমনিভাবে সমস্ত প্রশাসন একমাসব্যাপী অচল হয়ে পড়েছিল ।

অবশেষে সত্যাগ্রহীদের আন্দোলনের ঐক্য ও ব্যাপকতা লক্ষ্য করে সরকার পক্ষ আপসের উদ্যোগ নেয় । কাছাড় গণ-সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী দিল্লীতে এক বৈঠকে বসেন এবং বরাক উপত্যকার ভাষা সমস্যার সমাধানকল্পে আলোচনার প্রস্তাব দেন । আলোচনার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সকল রাজবন্দীর মুক্তিদান ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত করণের সিদ্ধান্ত হয় । সে অনুযায়ি বন্দীমুক্তির দিন ধার্য হয় ১৬ জুন । কিন্তু পুর্বাহ্নে জানা যায় সরকার সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিচ্ছে না । ফলে আন্দোলনের নেতৃত্বের নির্দেশে মুক্তিপ্রাপ্তরা সকল রাজবন্দির মুক্তি না দিলে জেল থেকে বের হতে অস্বীকৃতি জানান । সরকার বাধ্য হয়ে পরদিন ১৭ জুন সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেয় । পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনার জন্য ছুটে আসেন শিলচর শহরে । আলোচনার ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়- আসাম সরকার বরাক উপত্যকার জেলাপর্যায়ে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি দেয় । পরে সন্ধি অনুযায়ি ১৯৬০ সালের ভাষা আইন সংশোধন করা হয় । এভাবে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোল সাফল্যের শিখরে পৌঁছে ।

বরাক উপত্যকার সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙালি জনগনের মাতৃভাষা বাংলা বরাকবাসীর অহংকার । ভারতের আর কোথাও ভাষার জন্য এরকম রক্ত ঝরেনি ।বিশাল ভারতে বরাক উপত্যকা যা শিলচর-হাইলাকান্দি মহকুমার সমন্বয়ে গঠিত “সমতল কাছাড়” এবং বর্তমান করিমগঞ্জ জেলার পুরোটা নিয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ছিল এতদিন । ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও বরাক উপত্যকা পরিচিতি পেয়েছে । তবুও এই পরিচিতি অবিশ্বাস্যরূপে সীমিত । স্বয়ং ভারতের অন্যান্য এলাকা সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য । সিলেট-করিমগঞ্জ কাছাকাছি সীমান্ত-অঞ্চল হওয়ায় এবং প্রাক-পাকিস্তান আমলে করিমগঞ্জ সিলেট জেলার অন্তর্ভুক্ত থাকার কারনে বরাক উপত্যকার রাজনৈতিক, ভৌগলিক ও ভাষাগত অবস্থান সম্পর্কে সিলেট অঞ্চল সঙ্গত কারনেই ভালোভাবে অবহিত । কিন্তু অতীব দুঃখের ব্যাপার যে, বরাক উপত্যকাকে “বাংলা সাহিত্যের তৃতীয় ভুবন” বলা হলেও ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলে পর্যন্ত বরাক উপত্যকার ভাষা-সাহিত্য নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে । বরাক উপত্যকার শক্তিমান কবি দিলীপকান্তি লস্করের কবিতায় তা অতি নিপুণভাবে ব্যক্ত হয়েছে । দুঃখের জ্বালা নিয়ে তিনি লিখেছেনঃ

আমি কোত্থেকে এসেছি,
তার জবাবে যখন বললামঃ
করিমগঞ্জ, আসাম ।
তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেনঃ
বাঃ । বেশ সুন্দর বাংলা বলেছেন তো !
একজন শিক্ষিত তথা সাহিত্যিকের যখন
এই ধারণা,
তখন আমি আর কি বলতে পারিঃ
ওকে ঠিক জায়গাটা
ধরিয়ে দিতে গিয়ে বললাম-
বাংলাভাষার তের শহিদের
ভূমিতে আমার বাস;
তখন তিনি এক্কেবারে
আক্ষরিক অর্থে-ই
আমাকে ভির্মি
খাইয়ে দিয়ে বললেনঃ
ও ! বাংলাদেশ ? তাই বলুন ।
সম্প্রতি ‘দেশে’ সুনন্দ সান্যাল,
তাঁর মাতৃভাষা বিজ্ঞানের প্রবন্ধে বললেনঃ
আমাদের বঙ্গভাষী দেশে
রক্তমূল্যে মাতৃভাষা চেনার
ঘটনা ঘটেনি ।

( হায় ত্রয়োদশ শহিদ )

[ চলবে …]