বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি কে? এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। কাজের প্রমাণ সাপেক্ষে চন্দ্রাবতীকেই ধরা যেতে পারে প্রথম নারী কবি। তাঁর অনেক কাজ রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে আমরা জানি। তবে, এর বাইরে আরেকজনের কথা এসে যায়। ইনি চন্দ্রাবতীরও আগে জন্ম নিয়েছেন। যদিও তাঁর বিষয়ে সব পণ্ডিত একমত না, তবুও তাঁকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ, তাঁরও কিছু কবিতা, ভণিতা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এই কবির নাম রামী। রামীর আগেও দুই একজন মহিলা কবির ভণিতা পাওয়া যায়, তবে সেগুলো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য নয়।

এই রামীকে আমরা জানি। অবাক হবার কিছু নেই। আসলেই তাঁর বিষয়ে অবগত আমরা। তবে, ভিন্নভাবে। রামীর সাথে চণ্ডীদাসের স্মৃতি জড়িত রয়েছে। চণ্ডীদাসরজকিনীর প্রেমের কাহিনি জানেন না, এমন লোক পাওয়াটা বিরলই বটে।প্রেমের মড়া জলে ডোবে না, এই গান শোনেন নি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার হবে। এই গানেই দুচরণ হচ্ছে, চণ্ডীদাস আর রজকিনী, তাঁরাই প্রেমের শিরোমণিগো। হ্যাঁ, এই রজকিনীই হচ্ছেন কবি রামী।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাসের ছড়াছড়ি। বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, এরকম বহু চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। ঠিক কোন চণ্ডীদাসের সাথে রজকিনী রামীর প্রলয়লীলা জড়িত রয়েছে, সেটা চিহ্নিত করাই মূল সমস্যা। এ বিষয়ে মীমাংসায় আসাটা বেশ কঠিন কাজই। ডক্টর বিমানবিহারী মজুমদার বলেছেন যে, ‘চণ্ডীদাস নামটি শুধু যে বহুলোকে ধারণ করতেন তাহা নহে, উহা অনেকটা উপাধির মতন ব্যবহৃত হইত, যেমন হয় প্রধান মহান্তের শংকরাচার্যনাম।

আহমদ শরীফ বাংলা সাহিত্যের এই চণ্ডীদাস সমস্যা নিয়ে বেশ মাথা ঘামিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত কাজ আছে তাঁর। তিনি পাঁচজন চণ্ডীদাসের কথা উল্লেখ করেছেন।

১। বড়ু চণ্ডীদাসঃ

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস কোন বিক্ষিপ্ত পদ রচনা করেন নি তা আমরা মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বড়ু চণ্ডীদাস ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের ফলে নিঃসংশয়ে জানতে পাই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা সাগর কন্যা, আর বাসুলী আদেশে যে দ্বিজ চণ্ডীদাস পদরচনা করেছেন, তাতে আমরা কহে, ভণে, বিনোদিনী রাধা, বৃষভানু রাজনন্দিনী, উপান্ত চরণে প্রভৃতি পাই, যা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহৃত হয়নি, বড় কখনো দ্বিজ বলে কিংবা উপান্ত চরণে ভণিতা দেননি, কাজেই পদাবলীর বাশুলী আদিষ্ট দ্বিজচণ্ডীদাস ভিন্ন ব্যক্তি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কবি আকস্মিকভাবে তো আর তার মত, রীতি ও পরিচয় বদলাতে পারেন না বিক্ষিপ্ত পদে।

অতএব এ ধরণের পদে কিংবা সহজিয়া পদে কোথাও বড়ুব্যবহৃত হলেও বড়ু চণ্ডীদাসের পদ বলে গ্রাহ্য হওয়া অযৌক্তিক। এগুলি স্পষ্টত জাল রচনা। বড়ু চণ্ডীদাস ছাতনার কবি। কেননা ছাতনার বাসুলী চণ্ডী। আর নান্নুরের বাসুলী সরস্বতী।

২। চণ্ডীদাসঃ

চৈতন্যচরিতামৃতসূত্রে জানতে পাই চৈতন্যদেব জয়দেবের গীতগোবিন্দ‘, বিদ্যাপতির পদ, রামানন্দের নাট্যগীতি ও বিল্বমঙ্গলের কৃষ্ণকর্ণামৃতশুনতেন, আস্বাদন করতেনঃ

. বিদ্যাপতি জয়দেব চণ্ডীদাসের গীত
আস্বাদয়ে রামানন্দ স্বরূপ সহিত।

. চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটকগীতি
কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ
স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রি দিনে
গায় শুনে পরম আনন্দ।

. বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস শ্রীগীতগোবিন্দ
এই তিন গীতে করায় প্রভুর আনন্দ।

. বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস শ্রীগীতগোবিন্দ
ভাবানুরূপে শ্লোক পড়ে রায় রামানন্দ।

কৃষ্ণলীলার কবি হিসেবে জয়ানন্দও চণ্ডীদাসের বন্দনা করেছেনঃ

জয়দেব বিদ্যাপতি আর চণ্ডীদাস
শ্রীকৃষ্ণচরিত তারা করিল প্রকাশ।

লক্ষনীয় ইনি সর্বত্র শুধু চণ্ডীদা‘- দ্বিজ, দীন, বড়ু বা আদি নন। এই বিশেষণবিহীন চণ্ডীদাসের পদই চৈতন্যদেব আস্বাদন করতেন। তিনি নিশ্চয়ই জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ পদসমূহের রচয়িতা। বিমানবিহারী মজুমদার বলেন, “বিশেষণহীন একজন চণ্ডীদাসছিলেন বলিয়াই পরবর্তীকালে বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, আদি চণ্ডীদাস প্রভৃতি চণ্ডীদাসকে চিহ্নিত করার প্রয়োজন হইয়াছিল। আমরা এই বিশেষণহীন চণ্ডীদাসকে আদি ও অকৃত্রিম চণ্ডীদাস বলিয়া ধরিয়া লইতে পারি। তাঁহার ভণিতার বৈশিষ্ট্য দেখিয়া এবং ভাব ও ভাষা বিচার করিয়া আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ হইতে প্রকাশিত গ্রন্থে ১১২টি পদ নির্বাচন করিয়াছি।” চণ্ডীদাসের রচিত অকৃত্রিম পদগুলো বেছে নেওয়া সহজ নয়। চৈতন্যচরিতামৃতধৃত পদ্যাংশ হা হা প্রাণপ্রিয় সখি কিনা হৈল মোরকিংবা নীল অতসীফুলের উল্লেখ সম্বলিত পদ চণ্ডীদাসের বলে মেনে নেওয়া যায় বলে কারো কার বিশ্বাস। এঁর আনুমানিক জীবৎকাল ১৪৫০১৫০০ খ্রীস্টাব্দ। এঁর বন্দনা করেছেন জয়ানন্দ, রাধামোহন ঠাকুর (পদামৃতসমুদ্র), নরহরি চক্রবর্তী ও বৈষ্ণব দাস।

. জয়দেব বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস
শ্রীকৃষ্ণচরিত তারা করিল প্রকাশ।
(
জয়ানন্দ, চৈতন্যমঙ্গল)

. চণ্ডীদাস চরণ/চিন্তামণীগণ/শিরে করি ভূষণ। (গোবিন্দদাস কবিরাজ, পদ,

. বিদ্যাপতিঃ চণ্ডিদাসো জয়দেবঃ কবীশ্বরঃ। (রাধামোহন, ঠাকুর, পদামৃতসমুদ্র)

. জয় জয় চণ্ডীদাস দয়াময় মণ্ডিত সকল গণে। (নরহরি, চক্রবর্তী, পদ, ভক্তিরত্নাকর)

. জয় জয় চণ্ডীদাস রসশেখইর অখিল ভূবনে অনুপাম। (বৈষ্ণবদাস, পদকল্পতরু)

. দীন চণ্ডীদাসঃ

দীন চণ্ডীদাসের একখানা আখ্যান কাব্য এবং তার খণ্ডাংশ কপালী মিলন পালার পুথি আবিষ্কৃত হওয়ায়, এখন দীন চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব কেউ অস্বীকার করেন না। মণীন্দ্র মোহন বসু দীন চণ্ডীদাসের পদাবলীদীর্ঘ ভূমিকা যোগে প্রকাশিত করেছেন। সবাই মোটামুটি স্বীকার করেছেন যে, দীন চণ্ডীদাসের রচনা নিকৃষ্ট শ্রেণীর। তাঁর আখ্যান কাব্যে মাত্র সাতটি দ্বিজ চণ্ডীদাসভণিতা মিলেছে, – আর দীন চণ্ডীদাসভণিতা মিলেছে ৮৮টি। এতে মনে হয় লিপিকর প্রমাদে দীনঐ সাতটি ভণিতায় দ্বিজহয়েছে। অনবধানতা বশে দীনকে দ্বিজলেখা স্বাভাবিক। কাজেই দীন চণ্ডীদাসএক স্বতন্ত্র কবি।হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বলেনঃ “এখন হইতে কম বেশী দুই শত বৎসরের মধ্যেই দীন চণ্ডীদাসের আবির্ভাব ও তিরোধান স্বীকার করিতে হয়।”

. দ্বিজ চণ্ডীদাসের

এই দ্বিজ চণ্ডীদাস বাসলীর সেবক। হয়তো নান্নুনের সরস্বতী দেবী বাশুলীরই সেবক। এই বাশুলো বিশালাক্ষি। তাই তিনি বাসলীর আদেশে, কৃপায়, সহায়, ‘কহে, ভণেক্রিয়াপদ যোগে এবং বৃষভানুনন্দিনী‘, ‘বিনোদিনীরাধার পদ রচনা করেছেন। সতেরো শতকে রচিত মুকুন্দরাম গোস্বামীর সহজিয়াগ্রন্থ সিদ্ধান্তচন্দ্রোদয়েএই দ্বিজ চণ্ডীদাসেরই উল্লেখ রয়েছেঃ তাঁরাখ্যরজকীসঙ্গী চণ্ডীদাসো দ্বিজোত্তমঃএই সাধনসঙ্গিনী রজকী তারার কানুদাসের পদে পুরো নাম রামতারা। তার থেকে চণ্ডীদাসরজকিনী রামী তত্ত্বের ও পদের উদ্ভব। এ কবি নিশ্চয়ই সহজিয়া বৈষ্ণব। এই দ্বিজ চণ্ডীদাসের পদে বহু আরবিফার্সি শব্দের ব্যবহার রয়েছে যথা কারিগর, বনালো, খুশি, দাগ, দোকান, মহল, তকল্লবী, বানাইয়া, দরিয়া, বিদায়, বালিস, বদল। ইনি উপান্ত চরণে ভণিতা দেন। এ৬র বন্দনা করেছেন সহজিয়া পদকার প্রসাদ দাস, কানু দাস, নরহরি দাস ৯?) প্রভৃতি।

. চট্টগ্রামের দ্বিজ চণ্ডীদাস

এক দ্বিজ চণ্ডীদাসের কলঙ্কভঞ্জননামের এক পুথি চট্টগ্রামে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ আবিষ্কার করেছিলেন। অধ্যাপক জনার্দন এই পুথির অনুলিপি সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায়‘ (১৩৪০ সনে) প্রকাশিতও করেছেন। এই পুথির লিপিকাল ১৮৮২ মঘীসন বা ১৮২০ খ্রীস্টাব্দ। ইনি মনে হয় আঠারো শতকের শেষার্ধের চট্টগ্রামবাসী কবি। পুথির দুটো ভণিতা এরূপঃ

. ‘চণ্ডীদাস বোলে সার কৃষ্ণপতি সভাকচিলেন
. ‘রাধাকৃষ্ণের পানে চাহি চণ্ডীদাস বোলে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, দ্বিজ চণ্ডীদাসের সাথেই রজকিনী রামীর প্রেম ছিলো। তরণীরমণ বা তরুণীরমণ নামের এক কবি ছিলেন আঠারো শতকের গোড়ার দিকে। তাঁর সহজ সাধনাতত্ত্বনামে একটি ছোট গ্রন্থ আছে। তাতে চণ্ডীদাস ও রামীর প্রেম কাহিনির কথাও রয়েছে।

চণ্ডীদাস যৌবনে উদাস প্রকৃতির লোক ছিলেন। সংসারের দিকে খুব একটা তার খেয়াল ছিলো না। আপন মনে চলতে। সুমধুর কণ্ঠে গান গাইতেন। গান গেয়ে মানুষকে মুগ্ধ করে রাখতেন তিনি।

পিতার মৃত্যুর পরে চণ্ডীদাস বাশুলী দেবীর পূজক নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই দেবমন্দিরের সেবিকা ছিলেন রামমণি। কারো কারো মতে আসলে ছিলেন রজকিনী বা শজ বাংলায় ধোপানি। এই রজকিনীই কবির হৃদয়ে প্রেমের প্রদীপ জ্বেলে দেয়। চণ্ডীদাস পূজারীর কাজে নিযুক্ত হয়ে প্রতিদিন দেবীর পূজা করতেন, ভোগ রাধতেন। তারপর গ্রামের প্রান্তভাগে এক নির্জনস্থানে এক পত্র কুটিরে থেকে নিত্য ভজন করতেন।

নান্নুরের মাঠে, পত্রের কুটির
নিরজন স্থান অতি।
বাশুলী আদেশে
, চণ্ডীদাস তথা
ভজন করয়ে নিতি।।

রামমণি এই গ্রামেরই বাসিন্দা। এই সময়ে তিনি অসহায় অবস্থার মধ্যে দিনযাপন করছিলো। আর্থিক দৈন্য তাঁর নিত্য সঙ্গী। পেটের ভাতের জন্য এদিক ওদিক করেন বেড়াতেন তিনি। গ্রামের লোকেরা দয়া করে তাঁকে দেবীর শ্রীমন্দিরে মার্জনা করার কাজে নিযুক্ত করে দিলো। রামমণি প্রতিদিন শ্রীমন্দির মার্জনা করতেন এবং দেবীর প্রসাদ পেতেন। দেবীর প্রসাদের মহিমায় দিন দিন রামমণির রূপ যৌবন খোলতাই হতে থাকে। শশীকলার মতো বেড়ে উঠতে থাকেন তিনি।

অল্প বয়সে, দুঃখিনী রামিনী
সেবাতে নিযুক্ত হোল।
চণ্ডীদাস কহে
, শশীকলার ন্যায়
ক্রমে বাড়িতে লাগিল।

রূপ যৌবন বাড়লেও মন্দিরে থাকার কারণে শুদ্ধমতি হয়ে উঠলেন তিনি। দিন দিন হৃদয়ে দেবীর প্রতি ভক্তি বেড়ে চললো। গ্রামের সবাই তাঁর এই ভক্তিময়তায় প্রীত।

রামিনী কামিনী, কাজেতে নিপুণা,
সকলের প্রিয়তমা।

সবার প্রিয়তমা হলেও কোনো একক ব্যক্তির প্রিয়তমা হবার বাসনা রামীর ছিলো না। বিয়ে করা বা পতি গ্রহণের ইচ্ছা উবে গেলো তাঁর দেবীর প্রতি প্রেমে। কিন্তু, দৈবের কী বিচিত্র লীলা। চণ্ডীদাসের সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। তবে, এই প্রেমে কোনো দৈহিক কামনাবাসনা ছিলো না। এ এক কামগন্ধহীন প্রেম। শুধু রামমণির দিক থেকেই নয়, চণ্ডীদাসের তরফ থেকেও এটি ছিলো নিষ্কাম প্রেম। তিনি রামমণিকে কখনো মাতা, কখনো গুরু বলে সম্বোধন করতেন। রামীর চরণে আশ্রয় নিলেন চণ্ডীদাস।

শুন রজকিনী রামি!
ও দুটি চরণে
, শীতল জানিয়া
শরণ লইনু আমি।

চণ্ডীদাস আর রজকিনীর প্রেম যতই নিষ্পাপ, কামগন্ধহীন, অশরীরি হোক না কেন, রক্ষণশীল সমাজে তা ঠিকই বিরাট আলোড়ন তুলে ফেললো। কলংক রটে গেলো চারিধারে বাতাসের বেগে। এই কলংকে চণ্ডীদাস হলেন সমাজচ্যুত। তাঁর এই হীন কাজে যে সমাজের জন্য বড় ধরণের সর্বনাশ ডেকে আনছে, এটা বলতে দ্বিধা করে নি তাঁর এক জ্ঞাতিবর্গ।

শুন শুন চণ্ডীদাস।
তোমা লাগিয়া আমরা
, সকলে ক্রিয়াকাণ্ডে সর্ব্বনাশ।।
তোমার পিরীতে আমরা পতিত
, নকুল ডাকিয়া বলে।
ঘরে ঘরে সব কুটুম্ব ভোজন করিঞা উঠা কুলে।।

চণ্ডীদাসের শুধু একারই সমস্যা হলো না। বিপদ চণ্ডীদাসকে ছুঁয়ে, তীব্র বেগে নেমে এলো রামমণির ঘাড়েও। বাশুলী দেবীর প্রসাদান্নে বঞ্চিত হলেন তিনি। কলংকের কালো দাগ তাঁর ললাটেও লেপে গেলো। দিকে দিকে রাষ্ট্র করে দেওয়া হলো তাঁর কলংকের কাহিনি। এই কলংকে ম্রিয়মান হয়ে তিনি চণ্ডীদাসকে বললেন,

কি কহিব বঁধু হে বলিতে না জুয়ায়।
কাঁদিয়া কহিতে পোড়া মুখে হাসি পায়।।
অনামুখ মিনসে গুলোয় কিবা বুকের পাটা।
দেবীপূজা বন্দ করে কুলে দেয় বাটা।।
দুঃখের কথা কৈতে গেলে প্রাণ কাঁদি উঠে।
মুখ ফুটে না বলতে পারি মরি বুক ফেটে।।
ঢাক পিটিয়ে সহজবাদ গ্রামে গ্রামে দেয় হে
?
চক্ষে না দেখিয়ে মিছে কলঙ্ক রটায় হে
?
ঢাক ঢোলে যে জন সুজন নিন্দা করে।
ঝঞ্ঝনা পড়ুক তার মস্তক উপরে।।
অবিচারী পুরী দেশে আর না রহিব।
যে দেশে পাষণ্ড নাই সেই দেশে যাব।।
বাশুলী দেবীর যদি কৃপাদৃষ্টি হয়।
মিছে কথা সেঁচা জল কতক্ষণ রয়।।
আপনার নাক কাটি পরে বলে বোঁচা।
সে ভয় করে না রামী নিজে আছে সাঁচা।।

চণ্ডীদাসের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিলো, সে সম্বন্ধে রামীর রচিত একটি গীতিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ সম্বন্ধে দীনেশ্চন্দ্র সেন বলেন, চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্বন্ধে প্রায় দুইশত বৎসরের প্রাচীন হস্তলিপি সম্বলিত একটি প্রমাণ বসন্ত বাবু আবিষ্কার করিয়াছেন। তাহা রামীর রচিত একটি গীতিকা।

এতে জানা যায় যে, চণ্ডীদাস গৌড়ের নবাবের রাজসভায় গান গাইতে অনুরুদ্ধ হয়েছিলেন। সেখানে গান গাইতে যান তিনি। তাঁর গান শুনে বেগম মুগ্ধ হয়ে যান এবং চণ্ডীদাসের অনুরাগিনী হয়ে ওঠেন। তিনি নবাবকে বলেন যে, যাঁহার সুস্বরে ভুবন মুগ্ধযিনি প্রেমের মূর্ত্তিমান বিগ্রহস্বরূপ, তাঁহাকে সামান্য মানুষ মনে করিও না। নবাবের পক্ষে এক রাস্তার গায়কের প্রতি বেগমের এই অনুরাগ সহ্য করা কঠিন ছিলো। তিনি চণ্ডীদাসের মৃত্যুদণ্ড দেন। হাতির পিঠে বেঁধে তাঁকে অনবরত কষাঘাত করা হয়। এই নিদারুণ কষাঘাতে তিনি প্রাণত্যাগ করেন। এই হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিলো প্রকাশ্যে। রামী এবং বেগম, দুজনেই এই নিষ্ঠুর, নির্মম দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। চণ্ডীদাস মৃত্যুর সময়েও দুটি নিশ্চল চোখে বুকভরা প্রেম নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন রামীর দিকে। বেগম সহ্য করতে পারেন নি এই নির্মমতা। তিনি মূর্চ্ছা যান। সেই মূর্চ্ছা আর ভঙ্গ হয় না তাঁর। চিরবিদায় নেন তিনি। চণ্ডীদাসের চেয়েও বেগমের মৃত্যু রামীকে বেশি স্পর্শ করে। বেগমের মৃত্যুতে তাঁর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় নত হয়ে যান রামী। তিনি বেগমের মৃতদেহ স্পর্শ করে শোক প্রকাশ করতে থাকেন। এই অপূর্ব শোক গীতিকা থেকে জানা যায় যে, চণ্ডীদাসও বেগমের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। রামী অভিযোগ করে বলেছেন যে, বাশুলী তোমায় শুধু আমাকে ভালবাসতে বলিয়াছিলেন, তুমি তাহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিলে কেন?

কোঁথা যাও ওহে, প্রাণ বঁধু মোর, দাসীরে উপেক্ষা করি।
না দেখিয়া মুখ
, ফাটে মোর বুক ধৈরয ধরিতে নারি।।
বাল্যকাল হতে
, এ দেহ সঁপিনু, মনে আন নাহি জানি।
কি দোষ পাইয়া
, মথুরা যাইবে, বল হে সে কথা শুনি।।
তোমার এ সারথি
, ক্রুর অতিশয়, বোধ বিচার নাই।
বোধ থাকিলে
, দুঃখ সিন্ধুনীরে, অবলা ভাসাইতে নাই।।
পিরীতি জ্বালিয়া
, যদি বা যাইবা, কবে বা আসিবে নাথ।
রামীর বচন
, করহ শ্রবণ, দাসীরে করহ সাথ।।
তুমি দিবাভাগে
, লীলা অনুরাগে, ভ্রম সদা বনে বনে।
তাহে তব মুখ
, না দেখিয়া দুঃখ, পাই বহু ক্ষণে ক্ষণে।।
ত্রুটী সমকাল
, মানি সুজঞ্জাল, যুগ তুল্য হয় জ্ঞান।
তোমার বিরহে
, মন স্থির নহে, ব্যাকুলিত হয় প্রাণ।।
কুটিল কুন্তল
, কত সুনির্ম্মল, শ্রীমুখমণ্ডল শোভা।
হেরি হয় মনে
, এ দুই নয়নে, নিষেধ দিয়াছে কেবা।।
যাহে সর্ব্বক্ষণ
, হয় দরশন, নিবারণ সেহ করে।
ওহে প্রাণাধিক
, কি কব অধিক, দোষ দিয়ে বিধাতারে।।
তুমি সে আমার
, আমি সে তোমার, সুহৃৎ কে আছে আর।
খেদে রামী কয়
, চণ্ডীদাস বিনা; জগৎ দেখি আঁধার।।

দ্বিজ চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই সন্দিহান ছিলেন আহমদ শরীফ। তাঁর মতে, এই লোক ছিলো সহজিয়াদের বানানো চণ্ডীদাস। তাঁর এই তত্ত্ব মানলে রামীর অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যায়। কারণ, এই চণ্ডীদাসের সাথেই জড়িয়ে রয়েছেন তিনি। আহমদ শরীফের ভাষ্য থেকেই দেখা যাক এ বিষয়ে কী বলেছিলেন তিনি।

আঠারো শতকেও কবিখ্যাতি সম্পন্ন একজন দ্বিজ চণ্ডীদাস ছিলেন, কীর্নাহারে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি বিশালাক্ষির (বাশুলীর) পূজক ছিলেন। অতএব আমরা মেনে নিই যে সতেরো শতকের শেষ পাদে ও আঠারো শতকের গোড়ার দিকে একজন সহজিয়া বৈষ্ণব কবি দ্বিজ চণ্ডীদাস ছিলেন। অথবা সহজিয়ারা নামধাম ঠিক করে ঐ নামে এক কবি দাঁড় করিয়েছিলেন। সুখময় মুখোপাধ্যায়ও এমনি ধারণা পোষণ করেনঃ সহজিয়ারা যেমন প্রাচীন কালের বিখ্যাত সাধক ও কবিদের নিজের দলে টানবার চেষ্টা করেছে, তেমনি নিজেরাই সহজিয়াপদ ও নিবন্ধরচনা করে তা প্রাচীন কবি ও গ্রন্থকারদের নামে চালিয়েছে। চণ্ডীদাসনামাঙ্কিত সহজিয়া পদগুলি আসলে এই রকম সহজিয়া সম্প্রদায়ে বিভিন্ন লোকদেরই রচনা। ঠিক এই ভাবে সহজিয়ারা বিদ্যাপতি, নরোত্তম দাস, নরহরি সরকার, লোচন দাস, রায় শেখর ভণিতা দিয়ে বহুপদ রচনা করেছে এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজ ও নরোত্তম দাসের নামে অসংখ্য সহজিয়া নিবন্ধ রচনা করেছেযেগুলি কিছুতেই ঐ নামের মূল গ্রন্থকারদের লেখা হতে পারে না।

ডক্টর বিমানবিহারী মজুমদার একটি মূল্যবান তথ্য প্রকাশ করেছেন। “চণ্ডীদাস নামটি শুধু যে বহুলোকে ধারণ করতেন তাহা নহে, উহা অনেকটা উপাধির মতন ব্যবহৃত হইত, যেমন হয় প্রধান মহান্তের শঙ্করাচার্যনাম। … সহজিয়ারা তাঁহাকে (চণ্ডীদাসকে) নিজের দলে টানিবার চেষ্টা করিয়া আদি চণ্ডীদাসভণিতা দিয়া পদ রচনা করিয়াছেন … চণ্ডীদাস নামটি যে সহজিয়া সম্প্রদায়ের গুরু পরম্পরাক্রমে চলিয়া আসিতেছে তাহা আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। পঞ্চাশ বছর পূর্বে, নবদ্বীপের বনচারির ডাঙায় এক চণ্ডীদাস ও রজকিনী দেখিতে পাইতাম। …ঐ চণ্ডীদাস পদও রচনা করিতেন। আমরা চারি আনা দিয়া তাহার পদের বইও কিনিয়াছিলাম। এখন অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁহার বাঙলার বাউল ও বাউল গানগন্থে এই চণ্ডীদাসের পদ উদ্ধৃত করিয়াছেন।”

এগুলো দেখেই আহমদ শরীফ দ্বিজ চণ্ডীদাসের বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। তিনি বলেন যে, অতেব আমাদের বাশুলী পূজক দ্বিজ চণ্ডীদাস সহজিয়াদের বানানো দ্বিজ চণ্ডীদাস বলে আমাদের যে সন্দেহ তা দৃঢ়তর হল।

অন্যদিকে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রামীর অস্তিত্ব সম্পর্কে এক রকম নিশ্চিতই ছিলেন। তিনি তাঁর বঙ্গের মহিলা কবি গ্রন্থে বলেছেন,

একটি দেশব্যাপী জনশ্রুতি যখন দুই শত বৎসরের প্রাচীন হস্তলিপি সম্বলিত প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত হইতেছে, তখন তাহা আমরা ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে বাধা দেখিতেছি না। রাণী বাদসাহকে বলিয়াছিলেন – যাঁহার সুস্বরে ভূবন মুগ্ধ যিনি প্রেমের মূর্ত্তিমান বিগ্রহস্বরূপ, তাঁহাকে সামান্য মানুষ মনে করিও না। রামী বলিয়াছেন – যে ব্যক্তি রাজপাটে বসিয়াও প্রেমের আস্বাদ পায় নাই, তাহার জীবন নিরর্থক।

যে পর্যন্ত অন্য কোনও মহিলা কবির পরিচয় না পাওয়া যায়, সে পর্য্যন্ত আমরা অনায়াসেই রামী ধোপানীকেই বঙ্গদেশের সর্ব্বপ্রথম স্ত্রী কবি বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি। চণ্ডীদাস চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, কাজেই আমরাও রামীকে চতুর্দ্দশ শতাব্দীর বলিয়া উল্লেখ করিতে দ্বিধার কোনও কারণ দেখিতে পাইতেছি না। যদিও বর্ত্তমান সময়ে রামীর অস্তিত্ব সম্বন্ধেই অনেকে সন্দেহ করিয়া আসিতেছেন।

————————————

চণ্ডীদাসের মৃত্যু নিয়ে  রামীর  পদ।
কাঁহা গেয়ো বন্ধু চণ্ডীদাস।
চাতকী পিয়াসীগণ
, না পাই বরিষণ
না আনের নাগরে নিয়াস।।
কি করিল রাজা গৌড়েশ্বর।
না জানিঞা প্রেম লেহ
, ব্রেথাই ধরিস দেহ
বধ কৈলে প্রাণের দোসর।।
কেনে বা সভাতে কৈলে গান।
স্বর্গ মঞ্চ পাতালপুর
, আবির্ভুত পশু নর
মানিনীর না রহিল মান।।
গান শুনি পাৎসার বেগম
রাজারে কহে জানিঞা মরম।।
রাণি মনঃ কথা রাখিতে নারিল।
চণ্ডীদাস মনে প্রিত
, করিতে হইল চিত
তার প্রিতে আপন খুয়াল্যা।।
রাজা কহে মন্ত্রিরে ডাকিয়া।
তরার্ণিত হস্থি আনি
, পিষ্টে পেলি বান্ধ টানি
পিষঠ খুদে বৈরী ছাড় গিয়া।
আমি অনাথিনী নারী
, মাধবির ভালে ধরি
উচ্চস্বরে ডাকি প্রাণনাথ।
হস্থি চলে অতি জোরে
, ভালস্তে না দেখি তোরে
মাথা এ পড়িল বজ্রাঘাত।
রাণি কহে
, ছাড়িয়া না জায়
কহিতে কহিতে প্রাণ
, আর দেহ সমাধান
দুঁহু পরাণ একত্রে মিলায়।।
স্বন প্রিয় রজকিনী
, আসকে হারালঙ প্রাণী
এবার তরাবে তুমি মোরে।
বেগমের সহিত লেহ
, হা নাথ খুয়ালে দেহ
প্রাণে মাল্য এ রাজা গুঁয়ারে।
আসকে লভিতে প্রাণ
, তখনি করিলে গান
কেমনে জানিব হেন হবে।
বৈরি শত ডংসে গায়
, চেতন পাই এ তার
তোমারে ডাকি এ আত্মাভাবে।
এই করি আস মনে
, উধবারিত পতিত জনে
তবে সে দুর্ল্লভ মানি প্রীত।
নতুবা ফুরাল্য দায়
, বৈরী চোটে প্রাণ যায়
কে য়ার করিবে মোর হীত।
কান্দি কহে চণ্ডিদাস
, দশ দসার আস
পুনু কর রকজক কুমারি।
নহিলে একলা জাই
, সঙ্গে মোর কেহ নাই
কাছে য়াস্য তবে প্রাণে মরি।।
সুন বন্ধু চণ্ডিদাস দুখিনিরে সঙ্গে করি লেহ।।ধ্রু।।
চঞ্চল স্বভাব তোর চিত
সভাতে গাইলে গীত
মনের মরম করি সার।
অনুরাগে কি না করিল ফুতকার।
পাতি হাট বসাত্যে না দিলে।
আসক আনলে পড়াইলে।।
বৈরি কাটে তোমা গায়
তুমি সে আনন্দ বাস তায়।।
মোর অঙ্গ সব দ্যেতি হেল।
রুধিরে বসন ভিজ্যা গেল।।
পরাসিত এ জনার মন।
কতেক করাহ কদর্থন।।
রামি কহে যদি সঙ্গে নিবে
,
তুরিতে পরাণ তেজ তবে।।
সুন প্রাণনাথ চণ্ডীদাস তার নির্বন্ধন।
দৈবের কর্ম্মফাঁস না হয় খণ্ডণ।।
ছাড়ি পরিবার
, মোর সঙ্গ কর
সভারে কহিলে সত্য।
বাসুলি বচন
, না কৈলে সঙরণ
তাহাতে মজালে চিত্ত
আমা মুখ চাঞা গজপিষ্টে সুঞা
রয়াছ বন্ধন পাকে।
রাজা গৌড়েশ্বর
, দুষ্ট কলেবর
কেহনা বুঝাল তাকে।।
নাথ আমি সে রজক বালা
আমার বচন
, না শুনে রাজন
বুঝিল কৃষ্ণের লীলা
মুগ্ধ কলেবর
, হইল জর্জ্জর
দারুণ সঞ্জান ঘাতে
এ দুঙ্ঘ দেখিয়া
, বিদরএ হিয়া
অভাগিরে লেহ সাথে।।
কহেন রামিনী
, সুন গুণমণি
জানিলাঙ তোমার রীতি।
বাশুলি বচন
, করিলে লংঘন
সুনহ রসিক
পতি।।
পাৎসার বেগম কয়
সুন মহিনাথ মহাশয়
তুমি অবলার বচন রাখ।
রসিক মণ্ডল দেখ।।
আমি সে অবলা নারি।
তোমারে কহি এ বিনয় করি।।
যোড় করে কহে রামি।
সুন নৃপ চূড়ামণি।
সুন রসের স্বরূপ সে
কেহ বিনাশ করহ তাহার দে।
সে সামান্য মানুষ নহে।
রতি স্থিতি তার দেহে
যাহার সুস্বর গানে।
বিন্ধিল আমার প্রাণে।।
কেন কৈলে এমন কাজ
ভুবনে রাখিলে লাজ
রাজা হে যবন জাতি।
কি জানে রসের গতি।
চণ্ডিদাস করি ধ্যান।
বেগমে তেজিল প্রাণ।
সুনি শ্রস্তা ধাবিনি ধায়
পড়িল বেগম পায়।।