“নাফরমানি করিওনা, খোদার উপর তোয়াক্কেল রাখো!” লাল সালু উপন্যাসে মজিদের এই উক্তিটি মনে আছে? মর্মার্থ হচ্ছে “মেনে নাও, সুখী হবে”। কিন্তু মুক্তমনাদের সমস্যা এখানেই, এরা মেনে নিতে অভ্যস্ত নয়, মনে নিতে চায়। যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য সত্যকে মনে নেয় যুক্তিবাদীরা, অন্যদিকে উদ্ভট মিথকেও মেনে নিয়ে শান্তির কোল খোঁজে ধার্মিকরা। নিজের অজান্তেই আক্রান্ত হয় প্যারাসাইটের, ভাইরাসের। বস্তু গতিশীল আর গতি মানেই দ্বন্দ্ব, বস্তুবাদীর আচরণ হচ্ছে বস্তু- দ্বন্দ্ব -গতি আর ভাববাদীরা বস্তুতেই স্থির, দ্বন্দ্ব কিংবা গতি তাঁরা খোঁজেনও না, পানও না। কারণ ‘প্রিডিটারমাইন্ড মাইন্ডসেট’। তাদের রচিত মহাবিশ্ব একেবারেই স্থবির। তাদের বিশ্বাসের মহাকাশে সূর্য ‘পঙ্কিল জলাশয়ে’ ডোবে, কিংবা রাতের বেলা লুকিয়ে থাকে ‘খোদার আরসের’ নীচে। তাদের মতবাদে প্রথম নারীর জন্ম হয় প্রথম পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে। মানব জাতির পৃথিবীতে পদার্পণ ঘটে শয়তানের কুমন্ত্রণায় জ্ঞান-বৃক্ষের ফল আস্বাদনের ‘পাপে’ স্বর্গ-চ্যুত হয়ে। তাদের মানসপটে বিবর্তনের কোন স্থান নেই, নেই কোন পরিবর্তন কিংবা প্রগতিশীলতার ছাপ। তাদের বিশ্বাসের অচলায়তনে খেলা করে যায় কেবল প্রাচীন রূপকথা আর কূপমন্ডুকতা। যে কারণে ডারউইন, গ্যালিলিও কিংবা ব্রুনো তাঁদের কাছে ভিত কাঁপিয়ে দেয়া কতকগুলো নাম, যাঁরা ‘খোদার আরস নাড়িয়ে’ দিয়েছে যেন। আপনি জাগতিক সবকিছুকে দ্বন্দ্ব এবং গতির আওতায় বিশ্লেষণ না করলে তত্ত্বের লোহায় মরিচা পড়বেই, সৃষ্টি হবে ভাইরাসের, ঘটবে চিন্তার বৈকল্য। শুঁয়োপোকার দেহকে হোস্ট বানিয়ে ইকনিউমেন প্রজাতির প্যারাসিটোয়েড বোলতা যেমন প্রজন্ম তৈরি করে, ঠিক তেমনি আপনার মস্তিষ্কও হয়ে উঠবে ভাইরাসের আবাসস্থল। অদৃশ্য কিন্তু প্রাণসংহারী ভাইরাস। কিভাবে এটা মানব মস্তিষ্কের মতো সুপার কম্পিউটারকে গ্রাস করে, কিভাবে ছড়ায়, কিভাবে টিকে থাকে তার বিবর্তনীয় বিশ্লেষণ অনবদ্যভাবে তুলে এনেছেন এই সময়কার প্রথিতযশা বিজ্ঞান লেখক ড. অভিজিৎ রায় তাঁর ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটিতে। জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত চমৎকার মালাটের ২১৫ পৃষ্ঠার এই বইয়ে মোট আটটি অধ্যায়। বইটি পড়ার পর তাৎক্ষনিক একটা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম ফেইসবুকে, সেটির সূত্র ধরেই এই বিস্তারিত পাঠ প্রতিক্রিয়া। শুরুতেই বলে রাখি বইটি পড়তে হবে মুক্তমনে, যুক্তির বিচারে, তথ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে তবেই ধরতে পারবেন ভাইরাসের অস্তিত্ব। বুঝতে পারবেন কিভাবে সমাজের অস্থি মজ্জা খুবলে খাচ্ছে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’, বাধাগ্রস্ত করছে সমাজ প্রগতির সংগ্রামকে।

প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অধ্যায়ে সমসাময়িক কয়েকটি ঘটনার চমৎকার বিশ্লেষণ আছে। যেমন, কাজী মোহাম্মদ রেজোয়ানুল আহসান নাফিস নামের যে তরুণটি বিস্ফোরকের মাধ্যমে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ উড়িয়ে দিতে গিয়েছিলো সেই প্রসঙ্গ। নির্মোহ দৃষ্টিতে বিষয়টিকে বিবেচনা করলে আপনার কি মনে হয় নাফিস তার স্বকীয়তা ভরা তারুণ্যের মর্যাদা রেখেছে? যতোই বলা হোক না কেন এফ বি আই- এর পাতানো ফাঁদে এই তরুণ জড়িয়ে পড়েছে, কিংবা আমেরিকাই তাকে এই পথে আসতে প্ররোচিত করেছে, তারপরেও কথা থেকে যায়। আপনাকে উৎসাহ কিংবা খোঁচা দিলেই আপনি অন্যের বাড়া ভাতে ছাই মেশাতে যাবেননা ততক্ষণ, যতক্ষণ না সেটা আপনাকে বিকৃত আনন্দ দিচ্ছে। বিকৃত আনন্দ আপনি তখনই পাবেন যখন আপনার মননের সুস্থ বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবে, মুক্তচিন্তা বাধাগ্রস্ত হবে। কখন সেটা ঘটবে তার বাস্তব এবং বিবর্তনীয় বিশ্লেষণ এই অধ্যায়টিতে করেছেন ড.রায়। ল্যাংসেট ফ্লুক কিংবা নেমাটোমর্ফ হেয়ার ওয়ার্ম নামক প্যারাসাইটের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে দুর্দান্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আছে সমসাময়িক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ কিংবা প্রবন্ধের চমৎকার সমন্বয়, যা যুক্তির বিচারে দ্বন্দ্বকে বুঝতে সহায়তা করবে নির্ঘাত। ইতিহাসের আলোকে ধর্মের নৃশংসতম দিকগুলোও উঠে এসেছে সুন্দরভাবে। অথচ বিশ্বাসের ভাইরাস আক্রান্ত মনন এই একই ঘটনার ভিন্ন রূপ দেখে, বিবেচনা করে। একই ঘটনাগুলো পড়ে কিংবা জেনে জিহাদ কিংবা কত্ল-এ উজ্জীবিত হয়। নাফিস তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে ছোট্ট একটি তথ্যের উল্লেখ না করে পারছিনা। নাফিসের বাবা জনাব আহসানউল্লাহ কর্মরত ছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের একটি শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে, ঘটনার পরপরই তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। একই ঘটনা ঘটে ব্লগার রাসেল পারভেজের ক্ষেত্রেও। তাঁকেও মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় যখন সরকার ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে চার ব্লগারকে গ্রেফতার করে চোরাকারবারির মতো ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ করে ভাইরাস প্রজননের সূতিকাগার কাঠমোল্লাদের খুশি করতে এবং ভাইরাসের বদলে এন্টিভাইরাসের টুঁটি চেপে ধরতে। এই পদক্ষেপ গুলোও কোন যুক্তিবাদী আচরণের মধ্যে পড়েনা।

নাফিসের প্রাক্তন পাঠশালা বাংলাদেশের নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির আরো কিছু রুদ্ধ মনন ‘খোদা অর্পিত ঈমানী দায়িত্ব’ পালন করে উদীয়মান তরুণ ব্লগার রাজীব হায়দার (থাবা বাবা)-কে রাতের আঁধারে কুপিয়ে হত্যার মাধ্যমে। এবং সদম্ভে সেটি স্বীকার করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। কারণ তাদের সেটা অন্যায় মনে হয়নি, তাদের মস্তিষ্ক সেটা সমর্থন করে, কারণ বিশ্বাসের ভাইরাস ঐ মস্তিস্কগুলোর স্বকীয়তা গ্রাস করে ফেলেছে। বিষয়গুলোর বিভিন্ন বিশ্লেষণ পাবেন দ্বিতীয় অধ্যায়ে। এই অধ্যায়ের আরেকটি অভিনব দিক হচ্ছে লেখক এখানে পাঠককে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেকগুলো যুক্তিবাদী সংগঠনের সাথে যত্নের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন প্রাসঙ্গিক আলোচনার মাধ্যমে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজীবকে হত্যা করে ঈমানী দায়িত্ব পালন করে যারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলো, তাদের মনে এই বিকৃত ভাইরাসের সংক্রমণ কিভাবে ঘটেছিল? সেটা বুঝতে গেলে আপনাকে কবি আবু আফাক কিংবা কবি আসমা বিন্তে মারোয়ানের হত্যাকাণ্ডটা পড়তে হবে ৪৯-৫০ পৃষ্ঠায়, যা ঘটেছিলো আসলে মহানবীর নির্দেশেই। লেখকের অভিমত, রাজীব হত্যার পেছনে ধর্মের প্যারাসাইটিক ধারণাই দায়ী। এটা কেবল তথাকথিত ‘ইসলামবিদ্বেষী’দের প্রচারণা ভাবলে ভুল হবে। লেখক উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, রাজীব হত্যার পর পরই আল-কায়েদা ভাবধারার জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পক্ষ থেকে একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। সে ভিডিওতে খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল, নবী মুহম্মদ যেভাবে কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিন্তে মারওয়ানের মত কবিদের হত্যা করেছিলেন ইসলামের আর নবীর বিষেদগার করার শাস্তি হিসেবে, ঠিক একইভাবে থাবা বাবাকে মেরে ফেলাও জায়েজ হয়েছে। বিশ্বাসের ভাইরাস কাজ করে এভাবেই। প্রাচীন কালের ধর্মাবতারদের বাণী এবং কাজকর্ম মাথায় ধারণ করে একটা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কিছু ছাত্র যেভাবে রাজীব হত্যায় উজ্জীবিত হয়েছে এ থেকে বোঝা যায় ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ কতটা শক্তিশালী এবং একইসাথে কতটা প্রাণসংহারক।

বইটির চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সংস্কৃতির বিবর্তনের ধারাটি দুর্দান্ত ব্যাখ্যা করেছেন অভিজিৎ রায়। অনেকটা জৈববিবর্তনের মতোই রেপ্লিকেশন, মিউটেশন, কম্পিটিশন, সিলেকশন, একিউমুলেশন প্রভৃতি স্তর পার হয়ে বিভিন্ন ধারনার বা বিশ্বাসের বিস্তার কিভাবে ঘটে তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এখানে আছে। সাথে বিবর্তনের ধারায় কিভাবে এটা টিকে যায় তারও ব্যবচ্ছেদ পাবেন আগ্রহীরা। আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের চালানো গবেষণার চমকপ্রদ উদাহরণ আছে ৯২ পৃষ্ঠায়। সাথে ৯৬,৯৭ পৃষ্ঠায় বিশ্বাস ভাইরাসের অর্থনৈতিক ইফেক্টের বিশ্লেষণ আছে, যা অধ্যাপক ভিক্টর স্টেঙ্গারের নিউ এথিজম ও নিউইয়র্ক টাইমসের প্রবন্ধের আলোকে করা। ষাটাধিক ঘটনার উদাহরণ টেনে অন্ধবিশ্বাস নামক ভাইরাসগুলো কীভাবে সন্ত্রাসবাদী তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয় তার চমৎকার ব্যাখ্যা আছে ভাইরাস আক্রান্ত মনন অংশে। রিচার্ড ডকিন্সের বিভিন্ন গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে খুবই সহজ ভাবে জিনের পুনরাবৃত্তির সাথে বিশ্বাসের পুনরাবৃত্তির সাদৃশ্যতা দেখিয়েছেন বিবর্তনীয় বিশ্লেষণে। যেমন ডিএনএ’র তথ্য অর্থাৎ রাসায়নিক নির্দেশাবলী উপযুক্ত পরিবেশে যেভাবে শরীরে প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরির মাধ্যমে তার বৈশিষ্ট্যের পুনরাবৃত্তি ঘটায়, ঠিক একই প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চম অধ্যায়ে নৈতিকতার উৎস হিসেবে জাহির করা ধর্মের সফল ব্যবচ্ছেদ করেছেন অভিজিৎ রায়। দুর্দান্ত কিছু রেফারেন্স দিয়েছেন কোরান, মনুসংহিতা, বাইবেল প্রভৃতি “পবিত্র” ধর্ম গ্রন্থ থেকে। নৈতিকতার নামে যেগুলো সমাজে তৈরি করছে বিভাজন। যেমন সুরা আল ইমরান (৩:২৮) এর কথা ধরা যাক। আমার এক বন্ধু আছে যে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতো। সে নাকি মাদ্রাসা ক্লাসের নাইনে পড়ার সময় ঈমান খুইয়েছে পুরাপুরি, তাও আবার ধর্ম গ্রন্থ পড়ে! মিশকাত শরীফের একটা হাদিস সে প্রায়ই রেফারেন্স দিত। সেটা এরকম- “তোমরা যদি কাফির, মুশরিক (পৌত্তলিক)দের রাস্তায় দেখো, তবে রাস্তাকে এমনভাবে জুড়ে হাঁটবে যাতে তাঁরা রাস্তার একপাশ দিয়ে যেতে বাধ্য হয়।“ এই হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা। পাকিস্তানতো এ তে আলিফ, বি তে বন্দুক নিয়েই আছে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বিভাজনটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন ছিলো সেটাকে অনুশাসনের আওতায় নিয়ে আসা। ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে সেটাকে প্রথম বৈধতা দেয় মনুসংহিতা। শ্রেণী বিভাজনটা উৎপাদন প্রণালীর সাথে সম্পৃক্ত, কিন্তু এই উৎপাদন প্রণালীর স্থায়িত্বের জন্য দরকার ছিলো ধর্মীয় বৈধতা। এই বিষয়ে আগ্রহী পাঠকদের চোখ এড়াবেনা ১২০ পৃষ্ঠার চমৎকার আলোচনাটুকু। যেখানে রামায়ণ, মনুসংহিতা, মহাভারতের উদাহরণ দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন কিভাবে শ্রেণী বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। শান্তির প্রতিভূ “প্রভু যিশু”র অমিয় বানী থেকেও আমরা “চরম নৈতিক শিক্ষা” পাই ১২৩ পৃষ্ঠায় –

‘আমি পৃথিবীতে শান্তি দিতে এসেছি এই কথা মনে করো না। আমি শান্তি দিতে আসি নাই, এসেছি তলোয়ারের আইন প্রতিষ্ঠা করতে। আমি এসেছি মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড় করাতে; ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, বৌকে শাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি’ (মথি, ১০: ৩৪-৩৫)।

তাহলে কি বলা যায়না যে, শোষণ-ব্যবস্থা কায়েম রাখতে, অবৈজ্ঞানিকতা, কুসংস্কার আর ভোগের উৎপাদন প্রণালী টিকিয়ে রাখতেই ধর্মের উৎপত্তি? মানবকল্যাণে নয়? ধর্ম যে নৈতিকতা শেখায় সেটা আরোপিত। মেনে নেয়া। মনে নেয়ার নয়। এখানে পাপ পুণ্য, লাভ, ক্ষতি, নরক ভীতি থেকে উৎসারিত ধর্ম ভীতি। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটি উক্তি এখানে না আনলেই নয়। তিনি বিজ্ঞান ও যুক্তির আলো থেকে ধর্মের ক্রমাগত পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাবকে সমালোচনা করেছিলেন এভাবে-

“… কিন্তু আমি বুঝি যে, ধর্মীয় প্রতিনিধিদের তরফ থেকে এমন ব্যবহার শুধু যে অপদার্থতা তা নয়, উপরন্তু মারাত্মক। কারণ মতবাদ যা নিজেকে পরিষ্কার আলোর মধ্যে বাঁচাতে না পেরে কেবলই অন্ধকারে গিয়ে লুকায়, তা নিশ্চিতভাবেই মানব প্রগতির গণনাতীত ক্ষতি করে।“

আইনস্টাইন আরো বলেন-

“একজন মানুষের নৈতিক আচার ব্যবহারের ভিত্তি হওয়া উচিৎ মানুষের প্রতি সহানুভূতি, শিক্ষা এবং সামাজিক বন্ধন বা সামাজিক দায়বদ্ধতা; কোন ধর্মীয় ভিত্তির প্রয়োজন নেই। মানুষকে সংযত করার জন্য যদি তাঁকে শাস্তির ভয় দেখাতে হয়, বা মৃত্যুর পরের পুরস্কারের লোভ দেখাতে হয়, তাহলে মানুষের কাছে তা হবে চরম লজ্জার ও অপমানের”।

নৈতিক শিক্ষার ধারাপাত হিসেবে যেসব ধর্ম গ্রন্থকে “পবিত্র” বলে মাথায় তুলে রাখি, এসব গ্রন্থেই আবার আমরা পাই সতীদাহ, বর্ণভেদ সৃষ্টি, ক্রুসেড সহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ, যেগুলো ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে বা টিকিয়ে রাখতে হাজির করা হয়েছে অহরহ। ধর্ম মানতে গেলে ধর্মের এই অধর্মের ইতিহাসকে ছেঁটে ফেলার সুযোগ নেই। ‘ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন’ -এই টাইপের ধোঁকাবাজির দিন শেষ, ‘অনেকটা বাকীর দিন শেষ, ঠকার দিন খতম’ টাইপের! অভিজিৎ রায়ের মতো সাহসী বিজ্ঞান লেখকরা এখন কবিতা, কোটেশন, কৌতুক, রেফারেন্স ইত্যাদির সফল সমন্বয় ঘটিয়ে বিজ্ঞানকে আনন্দে পাঠযোগ্য যায়গায় নিয়ে গেছেন। মানুষ এখন বিশ্লেষণের পদ্ধতি শিখছে নিয়মিত।

বিশ্বাসের ভাইরাস বইটির ষষ্ঠ অধ্যায় নারী। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর “নারীর মূল্য” প্রবন্ধে চমৎকার ভাবে বলেছিলেন সমাজে নারীর মূল্য নির্ধারিত হয় সে কি পরিমাণ সেবাপরায়ন, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে-কষ্টে মৌনা সেটি বিবেচনায় নিয়ে অর্থাৎ তাঁকে নিয়ে পুরুষ কী পরিমাণ সুখী হবে, পুরুষের লালসাকে কতোটা তৃপ্ত করতে পারবে সেই হিসাবেই নারীর মূল্য নির্ধারণ করে সমাজ। নারীকে ধর্মীয় ভাইরাসেও এর বাইরে স্থান দেয়া হয়নি। “মুমিন’দের জন্য হুররূপী চির যৌবনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মৃত্যু পরবর্তী কল্পিত জীবনে এবং “পাক কোরানে” ইচ্ছে মতো চাষ করার, গমন করার, যৌন বাসনা পূর্ণ করার যথেচ্ছ অধিকার দেয়া হয়েছে। ভোগ্যপণ্য ছাড়া অন্য কোনরূপে নারীর কোন স্থান নেই ধর্ম গ্রন্থে। বিষয়গুলো চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন অভিজিৎ রায় তাঁর এই আলোচনায়। ধর্ম গ্রন্থগুলোর প্রধান চরিত্রের চরিত্রহীনতায় অনুপ্রাণিত হয়ে শফী মোল্লা তাঁর অমৃতবাণী ঝেড়েছেন অধুনা বিখ্যাত ‘তেঁতুল তত্ত্বের’ মারফত। তাঁর আরাধ্য ধর্মের পাঞ্জেরীর ২২ রমণী গমনসহ কৃষ্ণলীলার পাশাপাশি ইন্দ্রলীলারও একটা অনবদ্য বায়োগ্রাফি পাবেন এই অধ্যায়ে। কামুক এই চরিত্র গুলো পড়লে শফী সাহেবের মনে হতেই পারে “নারী হচ্ছে তেঁতুলের মতো, তাঁদের দেখলে ছেলেদের লালা ঝরে”। এখানেও চমৎকার সব তথ্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন লেখক। ধর্ম নামক ভাইরাস এবং এই ভাইরাসে আক্রান্তরা কোন দৃষ্টিতে নারীকে দেখে বা দেখতে প্ররোচিত হয় এবং করে তার ব্যাখ্যা এসেছে চমৎকার ভাবে।

বইটির সপ্তম অধ্যায়ে একটি জনপ্রিয় ধাঁধা নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন। সাধারণভাবে অনেকেই প্রশ্ন করে বসেন, ‘ধর্ম ব্যাপারটা যদি এতো ক্ষতিকারক হয় তাহলে সেটা পৃথিবীতে টিকে আছে কীভাবে?’। ধর্ম ক্ষতিকারক হলে তা বিবর্তনের নিয়মেই একসময় বাতিল হয়ে যাবার কথা ছিল না? এই অধ্যায়ে এই বহুল প্রচারিত ধাঁধাটির অন্ততঃ পাঁচটি সমাধান আমরা পাই:

১) বিবর্তন কাজ করে ব্যক্তির জিনের উপর, সমষ্টির উপরে নয়। ফলে সমষ্টির জন্য আপাত ক্ষতিকারক অনেক বৈশিষ্ট্যই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বাতিল না হয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা দিতে গিয়ে টিকে থাকতে পারে।
২) প্যারাসাইটগুলো মস্তিষ্ক এবং দেহের জৈবিক প্রক্রিয়ার দখল নিয়ে নিতে পারে, যদিও তাদের উদ্ভব হয়তো একটা সময় ঘটেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রয়োজনে।
৩) জিন কিংবা মিমের বহির্সংক্রমণ ঘটতে পারে এবং যে কোন সময় আঞ্চলিক পরিবেশের ধংসসাধন ঘটতে পারে।
৪) জিন কিংবা মিমের ভাল কিংবা মন্দ বৈশিষ্ট্য পরিস্থিতিভেদে বিলুপ্ত হতে পারে কিংবা সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার মতো টিকে থাকতে পারে।
এবং সর্বোপরি –
৫) ধর্মীয় বিশ্বাস বিলুপ্ত না হয়ে টিকে থাকে, কারণ এগুলো আসলে ভাইরাস।

অর্থাৎ, অনেকটা ভাইরাসের মতোই ‘বিপজ্জনক মিমগুলো’ দেহকোষ কিংবা মস্তিষ্কের দখল নিতে পারে, এবং পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এক হোস্ট থেকে অন্য হোস্টে। লেখক দেখিয়েছেন, একটি ভাইরাস যখন কোথাও সংক্রমণ ঘটায় তখন যেমন কখনো চিন্তা করে না একটি দেহের জৈব রাসায়নিক উপাদান কত সুষম বা সুন্দর, কিংবা কখনোই ভেবে দেখে না সে মোটা দাগে জীবদেহের, সমাজের কিংবা পরিবেশের ক্ষতি করছে না উপকার, সে কেবল ওটাকে ব্যবহার করে যেতে থাকে। মানব মনে প্রোথিত বিশ্বাসগুলোও তেমনি। যদিও ধর্ম বর্তমান এবং আগামী সভ্যতার জন্য এক ধরণের বোঝা কিংবা অভিশাপের মতো হয়ে উঠেছে, কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য ক্ষতিকর হলেও এটা টিকে থাকতে পারে চিরায়ত বিবর্তনের নিয়ম মেনেই। লেখক এ প্রসঙ্গে, ইকনিউমেন প্রজাতির একধরনের প্যারাসিটোয়েড বোলতার সাথে দুর্দান্ত সমন্বয় ঘটিয়েছেন ধর্ম বিশ্বাসে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের মনের। আক্ষরিক অর্থেই ধর্মবিশ্বাস মানব মননকে প্যারালাইসড করে ফেলে, এককেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বেরুবার পথগুলো রুদ্ধ করে দেয়। ফলে নিজের অজান্তেই এক একটা মৌলবাদী হয়ে উঠে এক একটা ‘সাইকো পেসেন্টে’। মৌলিক বা ভিন্ন চিন্তা তখন আর তার মাথা থেকে বেরোয়না। বুদ্ধি জড় হিসেবে থেমে থাকলে তবু মানা যেতো, কিন্তু সে তার এই প্যারালাইজড মস্তিষ্ক নিয়ে ক্রমাগত ভাবে আশপাশের অন্য মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, জোর খাটানোর চেষ্টা করে, জিহাদ কিংবা কাতল্-এ উদ্বুদ্ধ হয়, কামনা করে “শহীদি” মৃত্যু। ঠিক যেমনটা ল্যাংসেট ফ্লুক আক্রান্ত পিঁপড়ে পশু খাদ্যের সাথে গবাদি পশুর পাকস্থলীতে প্রবেশের অবিরাম চেষ্টা করে। অধ্যায়টিতে বিবর্তনীয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে কেন এবং কিভাবে ক্ষতিকর এই বিশ্বাসের ভাইরাস সমাজে টিকে আছে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে সমস্যার অন্ত নেই। ফলে বিশ্বাসের-ভাইরাসের সারভাইভাল সমাজ ব্যবস্থাই তাকে করে দিচ্ছে। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো হাজারো সমস্যার চাপে মানুষ আশ্রয় খোঁজে আশপাশের পরিবেশে। যেহেতু রাষ্ট্র কাঠামো মানবিক নয়, আমাদের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, জীবনযাপন – অনেক কিছুই মানবতাবিবর্জিত, তাই সে আক্রান্ত হয়, আটকে পড়ে ভাইরাসের ফাঁদে। যেটা তাকে আপাত শান্তি দিচ্ছে বলে মনে করলেও মূলতঃ ব্যবহৃত হচ্ছে ভাইরাসের হোস্ট হিসেবে। এই বিষয়গুলোর চমৎকার বিবর্তনীয় বিশ্লেষণ আছে ১৬৯ পৃষ্ঠায়।

পাশাপাশি বইটির কিছু দুর্বলতার কথাও আমি উল্লেখ করব। বইয়ের ভূমিকায় এক জায়গায় লেখক লিখেছেন –

‘বইয়ের কথা মাথায় আসলেও সেটা যে এ বছরের মধ্যেই ঘটবে ঘুণাক্ষরেও মাথায় ছিল না। বইমেলা শুরুর দু’মাস আগে কেউ বইয়ের কাজ শুরু করে সেটা আবার শেষও করতে পারে নাকি? কিন্তু সেই অসম্ভব কাজই সম্ভব করে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর তরুণ প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। তিনি যেভাবে তাগাদা দিয়ে আমার কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিলেন, বই আকারে পাঠকদের সামনে তুলে ধরলেন, সেটাও ভাইরাসের চেয়ে কম আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। তিনি এতো কম সময়ের মধ্যে শুধু বইয়ের লেখা আদায়ই করেননি, মনোরম একটি প্রচ্ছদ করে মেলা শুরুর বহু আগেই ফেসবুকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তার এহেন অবদান এবং নিরন্তর চাপাচাপি ছাড়া বইটি আলোর মুখ দেখতো না, তা হলফ করেই বলা যায়’।

কম সময়ে বই প্রকাশের কিছু সমস্যা তো থাকেই। সেক্ষেত্রে বইটির দুর্বল দিক হচ্ছে মুদ্রণ প্রমাদ। প্রথমদিকের চ্যাপ্টার গুলোতে ভুল বানানের পরিমাণ বেশি, পরে কমে এসেছে। বিশেষ করে “র” এবং “ড়” এর বিভ্রান্তি বেশি ভুগিয়েছে। এছাড়াও কিছু জায়গায় বাক্যের মাঝখানে একটা শব্দ বাদ পড়ায় অর্থ পাল্টে গেছে। যেমন ৭৭ পৃষ্ঠায় একটি বাক্য “মন মানসিকতা না বনলে প্রকৃতি পাত্তা দেবে মোটেই”। এখানে পাত্তা দেবেনা মোটেই হবে। ১২৯ পৃষ্ঠায় ‘লেখক’ হবার কথা। ফন্ট কনভার্সন কিংবা প্রকাশকের দ্রুত প্রকাশ করার চেষ্টা হয়তো পিছনের কারণ। তারপরও বলতে হয় প্রকাশক বইটিকে ঝকঝকে ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নিরন্তর।বইটি প্রকাশের তাড়াহুড়া থাকলেও বিশ্লেষণে কোন ঘাটতি নেই, নেই কোন ফাঁক ফোকর, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

আলোচনার শেষে এসে বলতে চাই আমাদের প্রিয় অভিজিৎ দা’ যেভাবে অসীম ধৈর্য নিয়ে শত শত বইয়ের চুম্বক অংশগুলো আত্মস্থ করে আমাদের “বিশ্বাসের ভাইরাস” উপহার দিয়েছেন, যেভাবে অনিয়মিত পাঠকের জন্য তুলে এনেছেন বিভিন্ন ব্লগের-পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলগুলো, যেভাবে পাঠককে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মুক্তমনা সংগঠনের সাথে, যেভাবে পরম মমতায় বিভিন্ন ব্লগের প্রতিভাবান লেখকদের টেনে এনেছেন প্রাসঙ্গিক আলোচনায়, বিশ্লেষণ করেছেন তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগুলোকে, পাঠককে যেভাবে ভার্চুয়াল জগতের প্রতিবাদী ভুবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সেটা কেবল মুক্তমনা আলোর পথযাত্রীর পক্ষেই সম্ভব। এই অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের জন্য তাঁকে আমার টুপি খোলা অভিনন্দন।

সবশেষে, ভাইরাস থেকে মুক্তি অধ্যায়ের মতো আমিও রায়হান আবীরের “মানুষিকতা”র আলোকে বলতে চাই যেদিন নিশ্চিতভাবে সমাজের বড় অংশ বুঝতে পারবে চারপাশের সবকিছুই প্রাকৃতিক, সকল দেবতা, অপদেবতা কিংবা ঈশ্বর মানুষের সৃষ্ট পৌরাণিক চরিত্র ব্যতীত কিছুই নন, সেদিন সত্যিকারের স্বাধীনতার তীব্র আনন্দে মাতোয়ারা হবে আমাদের মন, শরীরের প্রতিটি কণা, রক্তবিন্দু, ইন্দ্রিয়। সার্থক হবে অভিজিৎ রায়ের পরিশ্রম। শেষ করতে চাই ২১৫ পৃষ্ঠার অনন্য উক্তি দিয়ে-

“ভাইরাসমুক্ত জীবনের আস্বাদন কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্য নয়, বরং একটি চলমান যাত্রাপথের নাম। আমরা সবাই এই ভাইরাস দিয়ে কোন না কোন ভাবে আক্রান্ত এবং আমরা নিজেদের অজান্তেই বয়ে নিয়ে যাই অসুস্থ বিশ্বাস, মতামত কিংবা ধারণা। আমাদের অনেকের মাথাই আক্রান্ত করে ফেলা হয়েছে আমাদের শিশু বয়সেই আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পানপাত্র হাতে তুলে দিয়ে। আক্রান্ত মননকে প্রতিষেধক দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে ফেলাই হবে আমাদের যাত্রাপথের লক্ষ্য। আমরা যদি বিশ্বাসের ভাইরাসের কুফলগুলো বুঝতে পারি, এ সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন থাকতে পারি, তবেই আমরা ভাইরাস মুক্ত সমাজ প্রত্যাশা করতে পারি’।