লিখেছেন –  সন্দীপন দাশ

“দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে –
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে”

কবির এই উক্তি স্রেফ রোমান্টিক কপোল কল্পনা নয়। এই উক্তির মধ্যেই রয়ে গেছে কবির বিশেষ এক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। শুধু তাই নয়, এই উক্তিটিকে কে কীভাবে ব্যবহার করবেন তার মধ্যেও অর্থাৎ সেই ব্যবহারের মধ্যেও থেকে যায় উক্ত ব্যক্তির বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ। বহু ব্যবহৃত, বহু প্রচলিত, প্রায় ক্লিশে হয়ে যাওয়া এই উক্তি দিয়েই সেই কারণে এই প্রবন্ধের শুরু করলাম। কে কোন পক্ষে থাকবেন আর কেই বা নিরপেক্ষ থাকবেন তা ঐ উক্তি পড়েই ঠিক করে নিতে পারবেন।

নিজের নিজের স্থান বা পরিসর তৈরি করে নেওয়ার সুযোগ বা সুবিধা একমাত্র গণতন্ত্রই দিতে পারে। একটা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তি সেই চেতনের স্তরে পৌঁছায় যেখানে সে নিজেকে ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত করতে পারে। অবশ্যই এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে আলোকপ্রাপ্তির দর্শনের। মার্ক্সবাদীরা যাকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র বলে থাকেন, সকলেরই জানা আজকের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা হলো মোটামুটিভাবে সেটাই। এই গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আজ পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটা দেশেই প্রতিষ্ঠিত। স্পষ্টতই এই ব্যবস্থা যে মানুষের মঙ্গল সাধন করছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা(যার জন্য এই লেখাটা লেখা সম্ভব হচ্ছে), উন্নয়ন তথা সেবামূলক কাজের ক্রমপ্রসারতা – এসব কিছুই প্রমাণ করছে এই ব্যবস্থার অনস্বীকার্য গুরুত্বকে। কিন্তু এত কিছু হওয়া সত্ত্বেও আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা থেকে বুঝতে পারছি, এই অনেক কিছু করেও উঠতে পারছে না। কোথায় যেন একটা বিরাট ফাঁক থেকে যাচ্ছে। থেকে যাচ্ছে ফাঁকিবাজিও।

প্রত্যেকটা ব্যক্তির নিজের মতো করে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী, অন্যের ক্ষতি না করে, চলার অধিকার আছে। এই কথা কটি সন্দেহাতীতভাবে ভালো কিন্তু এই কথাগুলোর মধ্যে কতগুলো প্রশ্নও নিহিত রয়ে গেছে, যে প্রশ্নগুলোর দিকে তাকালেই(উত্তর খোঁজারও কোনো প্রয়োজন হয় না!) বোঝা যায় আসলে এই ব্যবস্থা, এই নীতির মধ্যেই রয়ে গেছে একটা বিরাট বড় ফাঁদ।

প্রথমে প্রশ্নগুলোর দিকে তাকানো যাক। অন্যের ক্ষতি না করে যে চলার কথা বলা হয়, সে চলার উদ্দেশ্য কী? নিজের মতো করে বা নিজের মতে চলার মানে কী ব্যক্তির সমাজের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখা? তা না হলে, সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কেমন? এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব একটা শক্ত নয়। এসব নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায়। কিন্তু আমাদের এই আলোচনায় এর উত্তর নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবার দরকার নেই(তার অর্থ এই নয় যে এগুলো নিয়ে কখনওই কোনো অবস্থাতেই ভাববার প্রয়োজন নেই)। আপাত প্রশ্নগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা যাক। নিজের মতে চললে, অন্যের মতকে অগ্রাহ্য করতে হবে। অন্যের মত গ্রহণ করলে আর নিজের মত বলে তো কিছু থাকে না! অর্থাৎ নিজের মতো হতে গেলে বিচ্ছিন্নতা তথা বিচ্ছিন্ন হওয়াটা জরুরি। আর ক্রমে এটাই হচ্ছি। জেনে, না জেনে, বুঝে, না বুঝে আমরা প্রত্যেকেই এই ফাঁদে পা দিচ্ছি। কিন্তু এই ফাঁদকে যদি আমরা একটা প্রাকৃতিক ফাঁদ ভাবি, তাহলে আমাদের এই ফাঁদ থেকে বেরনোরও আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। এটা স্বীকার করে নিতেই হবে যে এই ফাঁদ কিছু মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই তৈরি করেছে এবং হয়তো আমরাও সেই বিশেষ মানুষদেরই অন্তর্ভূক্ত।

বিচ্ছিন্নতার ফাঁদ বা বিচ্ছিন্নতার রাজনীতিই আজকের সমাজের রাজনৈতিক অবস্থান। পরস্পরের থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাওয়া, যে যার নিজের মতো করে থাকাই আজকের মানুষের জীবনযাপনের লক্ষ্য হয়ে উঠছে ক্রমশ। তাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে একইসঙ্গে সফটওয়্যার, কম্পিউটার, ‘বাবা’, ‘গুরুজি’, তাবিজ, গ্রহরত্ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, উন্নয়ন, ইনফরমেশন, ভাববাদ, বস্তুবাদ সবই একই সঙ্গে একটা জায়গাতেই আছে কিন্তু কারোর সঙ্গে কারোর কোনো সম্পর্ক নেই, যোগ নেই, আদান-প্রদান তো দূরের কথা! অনেক অতিশিক্ষিত একে আবার ‘Deconstruction’ বলছেন(হায় দেরিদা, তুমি বোধহয় এদেশে দেরিতে এলেই ভালো হত)। অতিদ্রুত কমিউনিকেশনের যুগে সবই সহজলোভ্য, সহজপ্রাপ্য কিন্তু ঐটুকুই, ওর বেশি এগনো সম্ভব নয়, তাহলেই গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়ে যাবে! তাই যোগাযোগের এই উন্নততম যুগেও আমরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন, একাকীত্বে ভুগছি, আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছি, সংযোগের অভাবে ভুগছি। তবু আমরা মধ্যবিত্ত স্বভাবের সুবিধাবাদ চরিতার্থ করতে গিয়ে জেনে, না জেনে মেনে নিচ্ছি, আস্কারা দিচ্ছি এই বিচ্ছিন্নতাবাদের রাজনীতিকে।

মধ্যবিত্তের চাহিদাপূরণে বিচ্ছিন্নতার রাজনীতি বিশেষ উপযোগী। মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদার যেসব পণ্যদ্রব্য তা কখনওই নিজের মর্জি মত ক্রয় করা হয় না। কিন্তু কৃত্রিম চাহিদার যেসব পণ্যদ্রব্য, তা ক্রয় করার জন্য নিজের মর্জি বা ইচ্ছাটা থাকা জরুরি। এবং এই ধরনের কৃত্রিম চাহিদা সাধারণত মধ্যবিত্তদেরই থাকে। আর যেহেতু প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের বাজারবৃদ্ধির সম্ভাবনা আর নেই আজকের এই পৃথিবীতে(ঔপ্নিবেশিকবাদ এবং নয়াঔপনিবেশিকবাদের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য এই যে পূর্বেরটা বাজার খুঁজে বেড়াত, পরেরটা বাজার তথা কৃত্রিম বাজার তৈরি করে)। তাই প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের চাহিদা নিয়ে বা সেই চাহিদার বৃদ্ধি নিয়ে বিশেষ এক শ্রেণীর কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু বিশেষ সেই শ্রেণীটির টিকে থাকা কখনওই সম্ভব নয়, যদি না বাজারে পণ্যদ্রব্যের কোনো চাহিদা না থাকে। আর সেই বিশেষ শ্রেণীটির আধিপত্য করা কখনওই সম্ভব নয়, যদি না বাজারে পণ্যদ্রব্যের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর আজকের পৃথিবীতে কৃত্রিম চাহিদারই বৃদ্ধি সম্ভব, কারণ নতুন করে প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের আর কোনো বাজার খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, এক যদি না পৃথিবীর বাইরে বাজার খোঁজা হয়।

শ্রেণী ও বাজারের প্রসঙ্গ যখন চলেই এল, তখন আমাদের একবার মার্ক্সের কাছে আসতেই হবে। কারণ, এই মানুষটাই প্রথম এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক এবং বিস্তৃত আলোচনা করেন। মার্ক্স যে রাজনীতির জন্য, যে রাজনীতির হয়ে তাঁর জীবনব্যাপী তত্ত্বগত ও প্রয়োগগত লড়াই চালিয়েছিলেন, তার সঙ্গে সংযোগের রাজনীতির কিয়দংশে হলেও মিল আছে। একটা সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র, জাতি বা শ্রেণী – এসব কিছুই থাকতে পারে না। আর এটা তখনই সম্ভব যখন মানুষের মধ্যে সংযোগ সম্ভব। কিন্তু এই সংযোগ কখনওই একটা নিরীহ, নির্ভেজাল ব্যাপার নয়! আপনা থেকে ঘটে যাওয়া স্বতঃস্ফূর্ত কোনো ব্যাপারও নয়! সংযোগ মান সংঘাতও বটে। সংঘাত, সংঘর্ষ, দ্বন্দ্ব – এসব ছাড়া সংযোগের চিন্তা এক নিছক বাতুলতা। মার্ক্স এটাকেই তত্ত্বগত ভাবে বলেছিলেন, thesis × antithesis= synthesis। সংযোগের ফলে যে দ্বন্দ্ব তার থেকেই নতুন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা, অন্য সমাজে পৌঁছানোর সম্ভাবনা। আর বিচ্ছিন্নতা আনবে শুধু স্থিতিশীলতা, কোনো নতুন সম্ভাবনা তৈরি না হওয়া, একই জায়গায় বদ্ধ থাকার রাজনীতিই বিচ্ছিন্নতার রাজনীতি।

বিচ্ছিন্নতার রাজনীতি অনেক কিছু না করেও যে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকছে, তার কারণ এই রাজনীতির তৈরি আরো একটি ফাঁদ। যে ফাঁদ দেখায়(বা বিভ্রম সৃষ্টি করে) যখন আমরা আমাদের মতানুসারে চলতে পারি তখন আমাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্ভাবনা অবশ্যই বেশি হয়। সংঘর্ষ সংঘাতের থেকে অনেক দূরে আমরা থাকি এবং আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও সাফল্যের দিকে বেশি মনোযোগী তথা সক্রিয় হতে পারি। কিন্তু সমস্যাটা হলো কোনো ব্যক্তিগত মত চাহিদা বা মতাদর্শ খাঁটি অর্থে এক এবং অদ্বিতীয় নয়। তা সবসময় প্রভাবিত এবং অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্রিয়। শোপিসকে শোকেসে স্থিতিশীল অপরিবর্তনীয় অবস্থায় রেখে দেওয়া যায় কিন্তু মতাদর্শ চাহিদা বা চিন্তার মত মননশীল ব্যাপারগুলোকে এই ভাবে অপরিবর্তনীয় স্থিতিশীল অবস্থায় রেখে দেওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। তাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্ভাবনাও কোনো ভাবেই তৈরি হয় না। আর যেহেতু ব্যক্তির মত বা ইচ্ছার গুরুত্ব ও প্রাধান্য বেশি তাই ব্যক্তির মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাবের সম্ভাবনাও বেশি। এবং সেই সঙ্গে সংঘাত বা সংঘর্ষেরও বর্বরতায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।

সহিষ্ণুতা ধৈর্য – এই মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলো সংযোগের রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিচ্ছিন্নতার রাজনীতি যে ধারণাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে তা হলো ‘ব্যক্তিগতের’ ধারণা। এই ধারণার ইতিহাস প্রায় দশ হাজার বছরের। অথচ সংযোগের রাজনীতিকে মতাদর্শগত ভাবে মূলত এই ধারণার বিরুদ্ধেই লড়তে হবে। তাই ধৈর্য সহিষ্ণুতা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু সংঘাত এবং সহিষ্ণুতা – দুটোকে একই সঙ্গে বজায় রাখা কী সম্ভব? কোনো একটা নির্দিষ্ট মূহুর্তে দুটোকে একইসঙ্গে বজায় রাখা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। কিন্তু পৃথক পৃথক ভাবে বজায় রাখা সম্ভব। অর্থাৎ সংঘাতের মুহূর্তে অসহিষ্ণুতা হঠকারিতা প্রকাশ হয়ে পড়তেই পারে কিন্তু সংঘাতের পূর্বে ও পরে(বিশেষত পরাজয়ের পরে) যেন সেই অসহিষ্ণুতা না থাকে। সহজ কথায় গোঁয়ার্তুমি করে জয়ী মানসিকতা বর্জন করতে হবে। তা না করলে আবার সেই বিচ্ছিন্নতার রাজনীতির জালেই জড়াতে হবে। তাছাড়া ইচ্ছাকৃত সংঘাতের পথে কোনোভাবেই যাওয়া ঠিক হবে না। তবে সংঘাতের সময় তাকে এড়িয়ে যাওয়াও ঠিক হবে না। আর আজ যা পরিস্থিতি তাতে এরকম একটা রাজনৈতিক আন্দোলন আরম্ভ হলে সংঘাত হতে বাধ্য। কিন্তু কেন সংঘাত অবশ্যম্ভাবি সে বিষয় এ লেখার শেষাংশে কথা বলব।

সংযোগের রাজনীতির এই সংঘাতে পরাজয়ের সম্ভাবনাই বেশি। কারণ ‘এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার’ এই ধারণা এত প্রাচীন, মানুষের মনে এতদূর পর্যন্ত গেঁথে আছে যে এর শিকড় উপড়ে ফেলা মাত্র একটা সংঘাতেই সম্ভব নয়। রাজনৈতিক আন্দোলন কোনো ম্যাজিক নয়। এরকম বলা কখনওই সম্ভব নয় যে আমার কথা মতো এক বছর আন্দোলন করলেই আন্দোলন সফল হবে। আর এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য তো বৈষয়িক নয়, এর উদ্দেশ্য মূলত মতাদর্শগত, ধারণাগত। তাই উদ্দেশ্য সফল হওয়াটা কখনওই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে না, যতক্ষণ না তা সামগ্রিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। আর সেই কারণেই পরাজিত হলেই এই রাজনীতি যে ব্যর্থ তা ভেবে হাল ছেড়ে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। আর এখানেই সংঘাতের পরবর্তী পর্যায় সহিষ্ণুতার পরীক্ষা। পরাজয়কে বিশ্লেষ করে নতুন ভাবে সংশ্লেষিত হবার সম্ভাবনা। নতুন করে সংঘাতের পথে যাওয়ার সম্ভাবনা। ভুললে চলবে না, প্রত্যেকটি সংঘাতের মধ্যেই সংশ্লেষের সম্ভাবনা রয়েছে।

আমরা এখানে সংযোগের রাজনীতির আন্দোলনের রূপরেখা কেমন হবে তার বিস্তারিত বিবরণ লিখতে বসিনি। সংযোগের রাজনীতি কেন প্রয়োজন সেই সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আন্দোলনটা কেমন ভাবে হতে পারে সেই প্রসঙ্গেও কিছু কথা বলে ফেলা গেল। অবশ্যই এগুলো কোনো ধ্রুব সত্য নয়। একটা আন্দোলন চলতে চলতেই তার রূপরেখা তৈরি হয়, বদল হয়; আন্দোলনের দাবীতেই ইস্তাহার তৈরি হয়, আবার সেই আন্দোলনের দাবীতেই ইস্তাহার নবরূপে নির্মিত হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে ইস্তাহার বাতিল হয়ে যাওয়া বা বাতিল করে দেওয়া। তার গঠনগত বা চরিত্রগত পরিবর্তন অবশ্য হতেই পারে। একটা ইস্তাহার তখনই বাতিল যোগ্য যখন তার পরিবর্তে আরেকটা ইস্তাহার তৈরি হয়। কথাগুলো আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও ইদানিং কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোকে যে অপ্রাসঙ্গিক বলে দাবী উঠেছে সেই জায়গা থেকেই সংযোগের রাজনীতিকে বুঝে নেওয়ার একটা প্রয়াস। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর প্রয়োগগত পার্থক্য নিশ্চয়ই হতে পারে; এঙ্গেলস বারবার কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর জন্য নতুন ভূমিকা লিখে তার চেষ্টাও করে গেছেন। কিন্তু কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোকে বাতিল করার বা সম্পূর্ণ নতুন ভাবে লেখার প্রাসঙ্গিকতা এখনও আসেনি। কারণ কতিপয় লোকের ইচ্ছানুসারে একটা ইস্তাহার রচিত হয় না। ইস্তাহার নিশ্চয়ই একটা সচেতন রচনা কিন্তু সেই সচেতনতা ব্যক্তির সমষ্টির বা সমগ্রের। সামগ্রিক চেতনার ফলশ্রুতিতেই ইস্তাহার রচিত হয়।

সংযোগের রাজনীতি ও তৎসম্পর্কিত আন্দোলন এখনও অপরিণত। কিন্তু এর শক্তিশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা যে আছে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে বর্তমানে আন্দোলনটা কেমন হতে পারে সে একটা তাত্ত্বিক ও দার্শনিক একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। আর যেহেতু সংযোগের রাজনীতি বিচ্ছিন্নতার রাজনীতির প্রতিপক্ষ রূপে আন্দোলনে ও রাজনীতিতে এসেছে, তাই এই একটা অন্যতম কাজ বিচ্ছিন্নতার রাজনীতির তৈরি মতাদর্শগুলোকে খণ্ডন করা। যেমন, রাজনীতিহীন রাজনীতি, যে কোনো তত্ত্ব বা মতাদর্শকে অবহেলা করার রাজনীতি, আত্মকেন্দ্রিকতার রাজনীতি – এই ধরণের মতাদর্শগুলোকে চিহ্নিত করা ও তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। আর যেহেতু মতাদর্শহীন মতাদর্শ সুবিধাবাদের পরাকাষ্ঠা সেহেতু এর বিরুদ্ধাচরণ যে মুহূর্তে শুরু সেই মুহূর্তেই সংঘাত বাধবে। আবার মতাদর্শগত এই আন্দোলন থেকে এই অর্থ বার করার চেষ্টা(বিচ্ছিন্নতার রাজনীতি যেটা করবেই) কোনো কারণ নেই যে, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দাবী নিয়ে সাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত যে আন্দোলন চলছে তার আমরা বিরোধিতা করি।

প্রকৃতপক্ষে এই লেখাটাও কোনো বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা নয়। গত কয়েক বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনগুলো হয়েছে, সেগুলো না হলে এই লেখাটারও কোনো অস্তিত্ব থাকত না। আমরা ক্রমে বুঝছি রাজনীতি থেকে সর্বার্থক ভাবে সরে থেকে জীবনযাপন করা যায় না। শুদ্ধুমাত্র নিজের জন্য এবং নিজের আত্মীয়-পরিজনদের জন্য জীবন ধারণ করা যায় না। কিন্তু আমাদের এই বোধোদয় সত্ত্বেও রাজনৈতিক ভাবে আমাদের অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়। তত্ত্বগতভাবেও আমাদের আন্দোলন কোনো সুদৃঢ় ভিত্তি পায়নি। অথচ তাত্ত্বিক দার্শনিক ও রাজনৈতিক কোনো ভিত্তি না থাকলে কোনো আন্দোলনই দানা বেঁধে উঠতে পারে না। আর সেই দানা বেঁধে তুলতে যদি কোনো সাহায্য করে উপরের কথাগুলো সেই উদ্দেশ্যেই এই লেখাটা লেখা হলো।