আমাদের দেশে বিদ্যমান স্ববিরোধী রাজনৈতিক পরিস্থিতি গুরুতর কিছু স্ববিরোধী ও অসঙ্গত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি গণতন্ত্রের পরিপন্থী? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের প্রয়োজনে কি স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি-দু:শাসন, দলতন্ত্র, একদলীয় তামাসার নির্বাচন ও নিরঙ্কুশ পরিবারতন্ত্রকে মেনে নিতে হবে?

গতানুগতিক ধারার বৃহৎ রাজনৈতিক দল কিংবা জোটগুলো নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যে, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরোধীতা কিংবা যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাইতে হলে যেন বিগত দিনের আওয়ামী লীগের যত অপশাসন, অপকর্ম, দুর্নীতি-দু:শাসন, ব্যক্তিতন্ত্র ও নিরঙ্কুশ পরিবারতন্ত্রকে মেনে নিতে হবে। আর এসবের বিরোধীতা করলে মনে হবে, আপনি যেন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের আড়ালে বিএনপি-জামাত-শিবির পরিচালিত নৈরাজ্যকর আন্দোলনকে সমর্থন করে প্রকারান্তরে যুদ্বাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতা করছেন। আওয়ামী লীগ তো একথাকে রাজনৈতিক আপ্তবাক্যে পরিণত করেছে। অধিকন্তু যারা বিগত দিনের দু:শাসনের সমালোচনা করছেন, আওয়ামী লীগ তাদেরকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতাকারী হিসাবে চিহ্নিত করছেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাদের কোরাসে গলা মিলিয়েছেন দেশের কিছু প্রতীতযশা সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি। নাগরিক সমাজের মধ্যে যারা এ মত সমর্থন করছেন না, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে। এক অভূতপূর্ব কিংকর্তব্যবিমূঢ়করা পরিস্থিতি বৈকি। এ প্যারাডক্স থেকে জাতিকে অবশ্যই মুক্ত করে সত্যের সন্ধান দিতে হবে।
এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আমাদের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা এবং চুড়ান্ত পর্যায়ে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। সেদিনের আওয়ামী লীগ নামক দলের মূল নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জাতিগত শোষণ থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার চেতনায় উদ্বুদ্ধ নেতা-কর্মীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি আদর্শিক দল ছিল আওয়ামী লীগ। বলাবাহুল্য, উক্ত স্বাধিকার আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ-এ ধারাবাহিক লড়াইয়ের মাধ্যমে যে জাতীয়তাবোধ জাতির মানসে অঙ্কুরিত হয়েছিল, তারই চুড়ান্ত পরিণতিতে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের উদ্ভব। এতদ্ব্যতিতও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আরো কিছু চেতনা বা মূল্যবোধ-গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি-আমাদের জাতীয় মানসে সঞ্চারিত হয়েছিল। যেহেতু জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে আমাদের মুক্তির লড়াইটি ছিল সংখ্যালঘু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মুক্তির লড়াই, সেহেতু এ আন্দোলনের মর্মগত চেতনা ছিল গণতান্ত্রিক। একটি জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সে আন্দোলনের অপরিহার্য রণনীতি হবে শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ এবং নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ বিষয়গতভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ। বস্তুত: এ সকল চেতনা বা মূল্যবোধই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বলা বাহুল্য, সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সমকালীন প্রেক্ষাপটে এসকল চেতনা ছিল প্রগতিশীল ও আধুনিক। যারা সেদিন প্রত্যক্ষভাবে আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল, তারা এসব ভাবাদর্শের বিপরীতে মধ্যযুগীয় ভাবাদর্শে আচ্ছন্ন হয়ে ধর্মরাষ্ট্র কায়েম করার স্বপ্নে বিভোর ছিল। বস্তুত: তাদের এ চেতনা অবৈজ্ঞানিক ও পশ্চাৎপদ। কিন্তু সমাজ-সভ্যতার বিকাশের গতি গুণগত পরিবর্তনের দিকে । এটাই হল বৈজ্ঞানিক সত্য। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, চেতনা স্থবির নয়, সতত: বিকাশমান এবং এ বিকাশ স্বত:স্ফূর্ত ও উর্ধ্বমুখী। বস্তুর পরিবর্তনের সাথে চেতনারও পরিবর্তন ঘটে। সামাজিক সত্ত্বার পরিবর্তন সামাজিক চেতনারও পরিবর্তন ঘটায়। তাই তেতাল্লিশ বছর পর একাত্তুরের চেতনার বিকশিত রূপ আজ আমাদের খুঁজে নিতে হবে। তা না হলে, আমরাও আবার প্রতিক্রিয়াশীল বা রক্ষণশীলতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হব। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন।
আজ কিন্তু সবচেয়ে জরুরী যে বিষয়টি আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাহল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সত্যিকার ধারক-বাহক কারা তা চিহ্নিত করা। কেবল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলা কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা বা করাকে সমর্থন করা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক হওয়ার একমাত্র প্রমাণ ? নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে হলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্তর্নিহিত যে দর্শন, সে দর্শনকেও ধারণ করতে হবে।
কী সে দর্শন?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি হয় ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র, তাহলে আধুনিকতা ও বিজ্ঞান মনস্কতাই হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্তর্গত দর্শন। সুতরাং রাষ্ট্রধর্মে যারা বিশ্বাস করে, দেশের সংবিধানে যারা বিসমিল্লাহ সংযোজিত করে, ক্ষমতারোহনের পথকে মসৃণ করার জন্য ফতোয়া দেওয়ার অধিকার দিয়ে যারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সাথে চুক্তি করে, কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা স্বীকৃতি প্রদান সহ যারা ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের লিখিত অঙ্গীকার করে, যারা ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সাথে জোট করে, তারা আর যাই হউক, কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক হতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমরা আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার চারটি মুলনীতি হিসাবে সংযুক্ত করেছিলাম। কিন্তু কেবল এ ৪টি নীতিমালা দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মর্মবস্তু উপলব্ধি করা যাবে না। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে দর্শন, তা হল সমাজ প্রগতির দর্শন।যে কোন পশ্চাৎপদতা, ধর্মান্ধতা, মতান্ধতা, অতীতমুখীতা, স্মৃতিকাতরা, ঐতিহ্যপ্রীতিসহ সকল প্রকার গোঁড়ামী অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। ফলত: মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, যে কোন প্রকার শোষণ-নির্যাতন, বৈষম্য, স্বৈরতন্ত্র, দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ইত্যাকার বিষয়গুলোও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আমরা মোটা দাগে বিভাজন রেখা টেনে বলতে পারি, দেশের বৃহৎ বিরোধী দল ও তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোটের অন্তর্গত ইসলামী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার সাংগঠনিক ক্ষমতা বা যোগ্যতাও তাদের নেই।( এখানে আধার ও আধেয় এর দ্বান্দ্বিকতা স্মর্তব্য)
বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে তাদের পরিচালিত আন্দোলনের নামে সহিংসতা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। সরকার বিরোধী আন্দোলনের আড়ালে জামাত-শিবির চক্র আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে।
তার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মাহজোটের অন্তর্গত ধর্ম ভিত্তিক দল, পতিত স্বৈরাচারী দল ও তার অপভ্রংশ দলগুলোকে কোন অবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দল বলা যায় না।
বাকী থাকে কেবল আওয়ামী লীগ ও তার সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগীর রাজনীতিতে যোগ দেওয়া কতিপয় বাম দল। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ কি বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে?
দু:খজনক সত্য হল-না, বর্তমান আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে না। খেলাফতে মজলিসের সাথে আওয়ামী লীগের পাঁচ দফা চুক্তির কথা নিশ্চয় আমরা এত তাড়তাড়ি ভুলে যাই নি। সর্বশেষ দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে রচিত বাহাত্তুরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার পরও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম,সংবিধানে বিসমিল্লাহের সংযোজন করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করার পর আওয়ামী লীগ যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে, তার কি আর কোন প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে?
সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করতে হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকতে হবে এ ধারণা একটি চরম বিভ্রান্তি ও প্রতারণা। মৌলবাদী ধর্ম ভিত্তিক দলগুলো যেমন ইসলাম ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করছে এবং এটাই তাদের একমাত্র রাজনৈতিক পুঁজি, ঠিক তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে বর্তমান আওয়ামী লীগ তার আদর্শহীন দেউলিয়া রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন কি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মত বিষয়টিকে তারা তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের কাজে লাগাতে চাচ্ছে। কিন্তু তাদের এসব অপকৌশল চুড়ান্ত পর্যায়ে বুমেরাং হতে বাধ্য। তাদের দ্বারা আর যাই হউক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথ ধরে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন সমাজ হবে না।
তাই এ দুই জোট ও মহাজোটভূক্ত দলগুলোর বাইরে যে কয়টি দল-আপাতত: যত ছোটই তারা হউক না কেন-এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে-সে সকল বাম-উদারনৈতিক-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল বু্দ্ধিজীবি-পেশাজীবি, ঐক্যবদ্ধ হয়ে দ্রুত একটি বিকল্প জোট গঠন করে চলমান অতিশয় রুগ্ণ রাজনীতির বিপরীতে সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমজনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে বিকল্প ধারা সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নামলে পরিবর্তনের একটি গণজাগরণ সৃষ্ঠি হতে পারে। এ ছাড়া চলমান রাজনৈতিক সংকটের দুষ্ঠচক্র থেকে জাতিকে মুক্তি দেওয়ার আশু কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয়না।