একটা বিস্ময়কর তথ্য দিয়ে শুরু করা যাক। বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্নাঙ্গ আত্মজীবনী কোনো পুরুষ সাহিত্যিকের হাত দিয়ে রচিত হয় নি। রচিত হয়েছে একজন নারীর মাধ্যমে। আরো বিস্ময় হচ্ছে যে, এই নারী শহরবাসিনী বিখ্যাত কেউ ছিলেন না, ছিলেন না প্রতিষ্ঠিত কোনো সাহিত্যিকও। আটপৌরে এক গ্রাম্য নারী ছিলেন তিনি। পূর্ব বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়ে বিশাল সংসারের ঘানি টেনেছেন তিনি সারাজীবন। কোনো বিদ্যালয়ে তিনি যান নি, কেউ তাঁকে বাড়িতেও বিদ্যাশিক্ষা দেয় নি। নিজ আগ্রহে বহু কষ্টে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজে নিজে পড়া শিখেছেন তিনি, পূর্ণ বয়সে লেখাও শিখেছেন। তারপর ষাট বছর বয়সে অত্যন্ত ঝরঝরে, সহজ সাবলীল এবং সতেজ ভাষায় লিখে ফেলেছেন তাঁর আত্মজীবনী। আর এর মাধ্যমেই তিনি জড়িয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে। কারণ, এটাই বাংলা ভাষার প্রথম আত্মজীবনী। তাঁর এই আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের গ্রাম বাংলার কুসংস্কারসমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা, গৃহে আবদ্ধ বিদ্যাশিক্ষা বঞ্চিত নারীর নিগৃহীত জীবনের সকরুণ বিবরণী। এটা শুধু একজন নারীর জীবনবৃত্তান্তই নয়, হয়ে উঠেছে ইতিহাসের এক প্রামাণ্য দলিলও।
এই নারীর নাম রাসসুন্দরী দেবী। যদিও রাসসুন্দরী দাসী নাম নিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ নামে। গ্রন্থটির প্রথম অংশ তিনি লিখেছেন ষাট বছর বয়সে, পরবর্তীতে অষ্টাশি বছর বয়সে এর দ্বিতীয় অংশ সংযোজন করেছেন গ্রন্থের সাথে। বইটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৮ সালে। পরবর্তীতে এর সংগে দ্বিতীয় অংশ সংযোজন করে প্রকাশ করা হয় ১৮৯৭ সালে। এই বইটার প্রতিটা অধ্যায় শুরু হয়েছে তাঁর নিজের লেখা কবিতা বা ভক্তি গান দিয়ে।
কখনও কখনও সরল, আটপৌরে ভাষায় লেখা গ্রন্থই পরবর্তীতে ইতিহাসে অসামান্য দলিল হয়ে উঠে। গুলবদন যখন হুমায়ূননামা লিখেছিলেন, তেমন কোনো আগ্রহ তিনি সৃষ্টি করতে পারেন নি, কিন্তু এখনকার ইতিহাসবিদদের কাছে গুলবদনের সেই গ্রন্থ অমূল্য হয়ে উঠেছে। কারণ, কোনো আলংকরিক ভাষার সুবিধা নিয়ে, কৃত্রিম জাকজমকপূর্ণ ইতিহাস তিনি লিখেন নি। যা দেখেছেন, যা শুনেছেন তাই সততার সাথে তুলে ধরেছেন। রাসসুন্দরীর গ্রন্থটি একই ধারার। তিনি যা দেখেছেন, যার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই ঘটনাগুলোকেই নিজের ভাষায় সৎভাবে পরিবেশন করেছেন। আর সেকারণেই এই জীবনীগন্থটি সমাজদর্পনের অসামান্য এক দালিলিক প্রমাণ হিসাবে আজ এতদিন পরে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়ে গিয়েছে। এই বইটি পড়ে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর সেই মুগ্ধতার কথা তিনি লিখেছিলেন এভাবেঃ
“এ গ্রন্থখানি একজন রমণীর লেখা। শুধু তাহা নহে, ৮৮ বৎসরের একজন বর্ষীয়সী প্রাচীনা রমণীর লেখা। তাই বিশেষ কৌতুহলী হইয়া আমি এই গ্রন্থপাঠে প্রবৃত্ত হই। মনে করিয়াছিলাম যেখানে কোন ভাল কথা পাইব সেইখানে পেনসিলের দাগ দিব। পড়িতে পড়িতে দেখি, পেনসিলের দাগে গ্রন্থকলেবর ভরিয়া গেল। বস্তুতঃ ইহার জীবনের ঘটনাবলী এমন বিস্ময়জনক এবং ইহার লেখায় এমন একটি অকৃত্রিম সরল মাধুর্য আছে যে, গ্রন্থখানি পড়িতে বসিয়া শেষ না করিয়া থাকা যায় না।
ইহার আত্মজীবনী পড়িয়া মনে হয় ইনি একজন আদর্শ-রমণী। যেমন গৃহকর্মে নিপুণা, তেমনি ধর্মপ্রাণ ও ভগবদভক্ত। শৈশবে ইনি অতিশয় ভীরুস্বভাব ছিলেন। সেই সময়ে জননী ইহার ভয় নিবারণার্থে ইহাকে একটি অভয়মন্ত্র প্রদান করেন। সেই অবধি, সেই অভয় মন্ত্রটি অক্ষয় কবচ্রূপে তাঁহাকে চিরজীবন রক্ষা করিয়াছে। তাঁহার মা বলিয়াছিলেন, -“ভয় হইলেই দয়ামাধবকে ডাকিও।“ শোকে, তাপ্ ভয়ে, এই মন্ত্রটি তাঁহাকে সান্ত্বনা দান করিয়াছে। আজকাল ‘ধর্মশিক্ষা করিয়া খুব একটা হৈ-চৈ উঠিয়াছে, আসল কথা, মা শিশুর সুকুমার হৃদয়ে শৈশবে ধর্মের বীজ রোপণ করিলে যেরূপ সুফল হয়, পরে শত শত ধর্মগ্রন্থ পাঠেও তাহা হয় না। ইহার জীবনের আর একটি বিশেষত্ব – লেখাপড়া শিখিবার জন্য ঐকান্তিক আগ্রহ।
লেখাপড়া শিখিবার তাঁহার কোন সুবিধা ঘটে নাই। তখনকার কালে স্ত্রীলোকের লেখাপড়া শেখা দোষের মধ্যে গণ্য হইত। তিনি আপনার যত্নে, বহু কষ্টে লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। তাঁহার ধর্মপিপাসাই তাঁহাকে লেখাপড়া শিখিতে উত্তেজিত করে। নভেল নাটক পড়িতে পারিবেন বলিয়া নহে – পুঁথি পড়িতে পারিবেন বলিয়াই – “চৈতন্য ভাগবত” পড়িতে পারিবেন বলিয়াই লেখাপড়া শিখিবার জন্য তাঁহার এত আগ্রহ।“
রাসসুন্দরী তাঁর অকপট জীবন চিত্রের বর্ণনার মধ্য দিয়ে যে সেই সমাজের সমাজের চিত্রকে নিজের অজান্তেই নিপুণভাবে এঁকে গিয়েছেন, সে বিষয়ে দীনেশচন্দ্রও সেনের কোনো দ্বিমত ছিল না। শুধু সমাজচিত্রই না, এই লেখা না হলে বাংলা সাহিত্যের একটা অধ্যায় অসমাপ্ত থেকে যেতো বলেই তাঁর বিশ্বাস ছিল। রাসসুন্দরীর বর্ণনার মধ্য দিয়েই জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে, সেই সময়কার রমণীচরিত্রের ভয়, দ্বিধা, সংকোচ, লজ্জা, তাঁদের প্রতি সমাজের নিষ্ঠুর অবহেলা, নির্যাতন আর মানবেতর জীবন যাপনের প্রণালী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি এই গ্রন্থে আরেকটি ভূমিকা লিখেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। তিনি বলেনঃ
“এই জীবনখানি ব্যক্তিগত কথা বলিয়া উপেক্ষা করা চলে না। ইহা প্রাচীন হিন্দু রমণীর একটি খাঁটি নক্সা। যিনি নিজের কথা সরল ভাবে কহিয়া থাকেন, তিনি অলক্ষিতে সামাজিক চিত্র অংকন করিয়া যান। “আমার জীবন” পুস্তকখানি শুধু রাসসুন্দরীর কথা নহে, উহা সেকেলে হিন্দু রমণীগণের সকলের কথা; এই চিত্রের মত যথাযথ ও অকপট মহিলা-চিত্র আমাদের বাঙ্গালা সাহিত্যে আর নাই। এখন মনে হয় এই পুস্তকখানি লিখিত না হইলে বাঙ্গালা সাহিত্যের একটি অধ্যায় অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইত।
হিন্দু সমাজে পুরমহিলারা যেখানে অবস্থিত ছিলেন, এখন আর তিনি সেখানে নাই – এই হিসাবে এই চিত্রখানি অমূল্য। রাসসুন্দরী বা তাঁহার মত আর কেহ জীবনের শেষ সীমান্তে দাঁড়াইয়া একথা না বলিয়া গেলে যাহা আর বলা হইত না। সেকেলের রমণীচরিত্র ভয়, লজ্জা, গ্রাম্য সংস্কারের মধ্যে কি ভাবে বিকাশ পাইত, তাহার এমন সুস্পষ্ট ও জীবন্ত ছবি আমরা আর দেখি নাই। পল্লী রমণীর একহস্ত পরিমিত অবগুণ্ঠন কিরূপে পৌঢ়-বয়সে সীমন্তের সিন্দুর স্পর্শ করিয়া তাঁহার অন্নপূর্ণা মূর্তি উন্মোচন করিয়া দেখাইত, কন্যা হইতে বধূ, বধূ হইতে গৃহিণী ও জননীরূপে তিনি কিরূপে বিকাশ পাইতেন তাহা এমন বিশ্বস্তসূত্রে আমাদের আর জানিবার উপায় ছিল না।“
রাসসুন্দরীর দেবীর জন্ম ১৮০৯ সালে পাবনার পোতাজিয়া গ্রামে। ছোটবেলায় অত্যন্ত ভীরু এবং কোমল স্বভাবের মেয়ে ছিলেন তিনি। তিনি যে সময়ে জন্মেছিলেন, সেই সময়ে নারী শিক্ষা বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। সমাজ ছিল প্রচণ্ড রকমের কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং ভয়াবহ ধরণের পুরুষতান্ত্রিক। শিক্ষা গ্রহণ করলে মেয়েরা বিধবা হবে, সংসারের অকল্যাণ নেমে আসবে, সতী-সাধ্বী মেয়েরা সব চরিত্রহীন হবে, স্বামীর অবাধ্য হবে, ঘর সংসারের কাজ করবে না, ইত্যাদি নানান ধরণের ধারণাই তখন চালু ছিলো। মেয়েরা বুদ্ধিতে পুরুষদের তুলনায় হীন এবং সে কারণে তারা শিক্ষা লাভের যোগ্য নয়, এই ধারণা পুরষতন্ত্র পুরুষদের মাথার মধ্যে বেশ ভালভাবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিল। এই ধারণার বিরুদ্ধ স্রোতে গিয়ে রাজা রামমোহন গর্জে উঠেছিলেন এই বলে যে,
“স্ত্রীলোকের শারীরিক পরাক্রম পুরুষ হইতে প্রায় ন্যুন হয়, ইহাতে পুরুষেরা তাহাদিগকে আপনা হইতে দুর্ব্বল জানিয়া যে যে উত্তম পদবীর প্রাপ্তিতে তাহারা স্বভাবতঃ যোগ্যা ছিল, তাহা হইতে উহারদিগকে পূর্ব্বাপর বঞ্চিত করিয়া আসিতেছেন; পরে কহেন যে, স্বভাবতঃ তাহারা সেই পদ প্রাপ্তির যোগ্যা নহে।
স্ত্রীলোকদিগের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইয়াছেন যে তাহাদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যাশিক্ষা এবং জ্ঞানশিক্ষা দিলে পরে, ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে, তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হইতে পারে; আপনারা বিদ্যাশিক্ষা, জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায়ই দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয়, ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন? বরঞ্চ লীলাবতী, ভানুমতী, কর্ণাট রাজপত্নী, কালিদাসের পত্নী প্রভৃতি যাহাকে যাহাকে বিদ্যাভাস করাইয়াছিলেন, তাহারা সর্ব্বশাস্ত্রপরায়ণা রূপে বিখ্যাতা আছেন।“
রাজা রামমোহনের নারী শিক্ষার প্রতিপোষক এই প্রকাশ্য উক্তির আগেও খৃস্টান মিশনারিরা এ দেশে নারী শিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা করছিলেন। তবে দেশীয় লোকজনের মধ্যে নারী শিক্ষার সমর্থনে এরকম প্রকাশ্য উক্তি রামমোহনের আগে কেউ করে নি। এর কিছুদিন পরেই রাজা রাধাকান্ত দেবের পৃষ্ঠপোষকতায় স্কুল অব বুক সোসাইটির ও হেয়ার সাহেবের স্কুলের পণ্ডিত গৌরমোহন বিদ্যালংকার “স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক” একটি গ্রন্থ রচনা করেন। রাজা রাধাকান্ত এই বই মুদ্রণ এবং প্রচার করেন। বাড়িতে এই বই পড়ে কোনো বালিকা যদি পরীক্ষা দিতে চাইতো, তবে স্কুল সোসাইটি বালকদের পরীক্ষা গ্রহণের সময় বালিকাদের নিজ নিজ বাড়িতেই পরীক্ষা দেবার সুযোগ থাকতো। রাজা রাধাকান্ত নারী শিক্ষার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু শুরুতেই তিনি নারীদের স্কুলে যাবার বিরোধী ছিলেন। পরে বেথুন সাহেব মেয়েদের স্কুল খুললে, তিনিও নিজের বাড়িতে একটা স্কুল খোলেন।
হেয়ার সাহেবের স্কুল সোসাইটির স্কুলে মেয়েরা পড়তে পারতো। কিন্তু এ বিষয়ে কমিটির মতভেদ হওয়াতে ১৮১৯ সালে Female Juvenile Society নামে একটা নতুন সমিতি গঠন করে সেই সমিতির হাতে বালিকা বিদ্যালয়ের ভার দেওয়া হয়।এ সময় British and Foreign School Society-র উদ্যোগে মিস কুক নামের একজন মহিলা নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য আসেন। ১৮২১ সালে তিনি এদেশে আসেন। ১৮২৪ সালের মধ্যে তাঁর মাধ্যমে ২৪টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়,। কিন্তু এ সব স্কুলে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য। ১৮২৬ সালে নেটিভ সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন নামে একটা সভা স্থাপন করা হয়। এই সভার হাতে মিস কুকের প্রতিইষ্ঠিত স্কুলগুলিকে পরিচালনার ভার দেওয়া হয়। এই সব স্কুলে সাধারণতঃ বাগদী, মুচি, নঃশুদ্র, জেলে এই ধরণের সমাজের নিম্ন স্তরের শ্রেণীর নারীরাই পড়তে আসতো। নারী শিক্ষার এই করুণ দশা এবং রাসসুন্দরী প্রসঙ্গে গোলাম মুরশিদ তাঁর হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বইতে বলেন,
“ব্যতিক্রমধর্মী যে-মহিলারা সেকালে লেখাপড়া শিখেছিলেন, তাঁরা তা শিখেছিলেন আত্মীয়স্বজন অথবা পণ্ডিতদের কাছ থেকে। কারণ, মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তখন ছিলো না। এমন কি, লেখাপড়া শেখার মতো মননশক্তি তাঁদের আছে কিনা, সে সম্পর্কেও বেশির ভাগ পুরুষ সন্দেহ পোষণ করতেন। রামমোহন রায় সে জন্যে ১৮১৯ সালে পুরুষদের চ্যালেঞ্জ করে লিখেছিলেন যে, পুরুষরা কি কখনো মহিলাদের মননশক্তি আছে কিনা, তার পরীক্ষা নিয়েছেন? তিনি যখন এ কথা লেখেন, রাসসুন্দরী দেবীর বয়স তখন ন-দশ বছর। যাতে খেলার সঙ্গিনীদের কাছে লাঞ্ছিত না হন, তার জন্যে তাঁর খুড়ো তাঁকে বাড়ির পাঠশালায় রেখে আসতেন। সেখানে ছেলেরা লেখাপড়া শিখতো, কিন্তু তাঁকে লেখাপড়া শেখানোর কথা শিক্ষক-সহ কেউই চিন্তাও করেননি। তাঁরা এমনও মনে করেননি যে, তিনি লেখাপড়া শিখতে পারবেন। তা সত্ত্বেও তিনি ছেলেদের দেখাদেখি নীরবে পড়া শিখে ফেলেছিলেন। কেবল তাই নয়, অনেক বছর পরে তিনি লিখতে শেখার পর প্রথম বাংলা আত্মজীবনীর লেখিকা হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন।“
শহরে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এই প্রাথমিক এবং সীমিত উদ্যোগের কোনো স্পর্শই লাগে নি রাসসুন্দরীদের অজ পাড়াগাঁয়ে। নারী শিক্ষা সেখানে ভিন্ন গ্রহের বিষয়। ছেলেদের জন্যও যে খুব একটা ভাল ব্যবস্থা ছিল, তা নয়। তবে, ভাল না হলেও, ছিল যে, সেটাই বড় কথা।
রাসসুন্দরীদের বাড়িতেই স্কুল বসতো। একজন মেমসাহেব ছাত্রদের পড়াতেন। রামসুন্দরীকে সেই মেম সাহেবের কাছে বসিয়ে রাখা হতো। অন্য বাচ্চারা যখন পড়াশোনা করতো, তার সবকিছুই নীরবে অবলোকন করতেন তিনি। এর ফলে কিছুটা হলে বর্ণপরিচয় তাঁর হয়ে যায়। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন,
“আমি সকল দিবস সেই স্কুলেই থাকিতাম। মেয়েছেলের মত আমাকে বাটীর মধ্যে রাখা হইত না। তখন ছেলেরা ক খ চৌত্রিশ অক্ষর মাটিতে লিখিত, পরে এক নড়ি হাতে লইয়া ঐ সকল লেখা উচ্চৈঃস্বরে পড়িত। আমি সকল সময়ই থাকিতাম। আমি মনে মনে ঐ সকল পড়াই শিখিলাম। সেকালে পারসী পড়ার প্রাদুর্ভাব ছিল। আমি মনে মনে তাহাও শিখিয়াছি, তাহা আর কেহ জানিত না।“
বারো বছর বয়সে, বিয়ে কী সেটা বোঝার আগেই রাসসুন্দরীর বিয়ে হয়ে যায়। পাত্রের বাড়ি ফরিদপুরের (বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা) রামদিয়া গ্রামে। পাবনা থেকে তখন ফরিদপুরে যেতে সময় লাগতো তিন দিন। বিয়ের আনন্দ-অনুষ্ঠান, গান-বাজনা, ধুমধাম, শাড়ি-অলংকার ইত্যাদিতে রাসসুন্দরী নিজেও বিমোহিত হয়ে ছিল। তাঁর মাথায় কোনোক্রমেই ঢোকে নি যে, এই সব আয়োজন প্রতিমা বিসর্জনের জন্য। আর এই প্রতিমা অন্য কেউ নয়, তিনি নিজেই। যখন টের পেলেন, তখন মাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর তাঁর কিছুই করার ছিল না। তাঁকে পালকিতে তুলে নিয়ে যখন শ্বশুরবাড়ির দিকে বেহারারা রওনা দিল, তখন সেই সময়ে তাঁর মনের অবস্থা কীরকম ছিল, তিনি প্রকাশ করেছেন এভাবে,
“যখন দুর্গোৎসবে কি শ্যামা পূজায় পাঁঠা বলি দিতে লইয়া যায়, সে সময়ে পাঁঠা যেমন প্রাণের আশা ত্যাগ করিয়া হতজ্ঞান হইয়া মা মা মা বলিয়া ডাকিতে থাকে, আমার মনের ভাবও তখন ঠিক সেই প্রকার হইয়াছিল। আমি আমার পরিবারগণকে না দেখিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া মা মা বলিয়া কাঁদিতে লাগিলাম, আর মনের মধ্যে একান্তমনে কেবল পরমেশ্বরকে ডাকিতে লাগিলাম।“
বিয়ে যে একজন স্বাধীন বালিকাকে, একজন মুক্ত বিহঙ্গকে, অবারিত আকাশ থেকে টেনে এনে তার পায়ে সোনার শিকল পরিয়ে, নিঠুরভাবে ডানা ভেঙে দিয়ে খাঁচায় বন্দী করে ফেলে, এটা বুঝতে সময় লাগে নি তাঁর। খেলার বয়সে মা, ভাইবোন সব ছেড়ে দিয়ে তাঁকে চলে যেতে হচ্ছে বহু দূরের এক অদেখা দেশে, অচেনা মানুষের খবরদারীতে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কুৎসিত রূপের দেখা পেয়ে কম্পমান তিনি, ভয়ে মৃতপ্রায়। যে আঁধার রাজ্যে তিনি বন্দী হতে চলেছেন, সেখান থেকে আর কোনোদিনই মুক্তি পাবেন না। সে কারণেই তাঁর মুখ দিয়ে হাহাকার বেরিয়েছে এই বলে যে,
“লোকে আমোদ করিয়া পাখী পিঞ্জরে বন্ধ করিয়া রাখিয়া থাকে, আমার যেন সেই দশা ঘটিয়াছে। আমি ঐ পিঞ্জরে জন্মের মত বন্দী হইলাম, আমার জীবদ্দশাতে আর মুক্তি নাই।“
সে সময়ে বালিকাদের জন্য শ্বশুরবাড়ি ছিল যমপুরী। এর ব্যতিক্রম ছিল দুর্লভ। শ্বশুর-শাশুড়ী, দেবর-ননদদের নিষ্ঠুর অত্যচারের শিকার হতে হতে নতুন বউকে প্রায়শ। এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন রাসসুন্দরী দেবী। তার কোনো দেবর ছিল না। তিনটি ননদ ছিল। কিন্তু রাসসুন্দরী কখনই অভিযোগ করেন নি যে, এরা তাঁর উপরে কোনো অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে। তাঁর শ্বাশুড়ী মায়ের মমতায় এই অসহায় বালিকাটি, যে কিনা মাকে ছেড়ে আসার শোকে ম্যুহমান, তাকে নিজের কোলে টেনে নিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেনঃ
“তাঁহার সেই কোল যেন আমার মায়ের কোলের মত বোধ হইতে লাগিল, তিনি যেরূপ স্নেহের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন, তাহাতে আমার বোধ হইতে লাগিল, যেন তিনি আমারি মা। অথচ তিনি আমার মায়ের আকৃতি নহেন। আমার মা বড় সুন্দরী ছিলেন। আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী শ্যামবর্ণা; এবং আমার মা’র সহিত অন্য সাদৃশ্যও ছিল না। তথাপি তিনি কোলে লইলে আমি মা জ্ঞান করিয়া চক্ষু বুজিয়া থাকিতাম। আমার কান্না এবং ভয়ের কোন কারণ ছিল না। আমার বাপের বাটীতে সকলে আমাকে যে প্রকার স্নেহ ও যত্ন করিতেন, এখানে তাহার অধিক স্নেহ ও যত্ন হইতে লাগিল। আমাকে এক তিলও মাটিতে নামান হইত না, সকল দিবস আমাকে কোলেই রাখা হইত। তথাপি আমার এত ভয় ছিল, দিবারাত্রি ভয়ে আমার কলেবর কম্পিত হইত। সর্বদা আমার চক্ষের জলে বুক ভাসিয়া যাইত। আর আমি মনে মনে অহরহঃ কেবল পরমেশ্বরকে ডাকিতাম।“
তাঁর শাশুড়ী এই কন্যাসম বধুটির মন যাতে ভাল থাকে সে জন্য তার খেলার জন্য নানা ধরণের জিনিস এনে দিতেন। গ্রামের সকল বালিকাদের ডেকে এনে ছেলের বউয়ের কাছে নিয়ে আসতেন। বালিকারা খেলা করতো, রাসসুন্দরী বসে বসে দেখতেন। শাশুড়ীর এত আদরের পরেও প্রথা বিচ্যুতি হবার কোনো সুযোগ রাসসুন্দরীর ছিল না। ওই সময়ে বউদের কঠোরভাবে পর্দা মেনে চলতে হতো। এ ই পর্দা শুধু পুরুষদের সামনেই প্রযোজ্য ছিল না, বাড়ির অন্য নারীদের কাছ থেকেও পর্দা করতে হতো। কারো সাথে কথা বলা যেতো না, কারো দিকে তাকানো যেতো না, মোটা কাপড়ের ঘোমটার আড়ালে নির্বাক হয়ে বউদের জীবন কাটাতে হতো। রাসসুন্দরী লিখেছেন,
“তখন মেয়েছেলেরা লেখাপড়া শিখিত না, সংসারে খাওয়াদাওয়ার কর্ম সারিয়া যে কিঞ্চিৎ অবকাশ থাকিত, তখন কর্তা ব্যক্তি যিনি থাকিতেন তাঁহার নিকট অতিশয় নম্রভাবে দণ্ডায়মান থাকিতে হইত। যেন মেয়েছেলের গৃহকর্মে বৈ আর কোন কর্ম নাই। তখনকার লোকের মনের ভাব এইরূপ ছিল। বিশেষতঃ তখন মেয়েছেলের এই প্রকার নিয়ম ছিল, যে বৌ হইবে, সে হাতখানেক ঘোমটা দিয়া ঘরের মধ্যে কাজ করিবে, আর কাহারও সঙ্গে কথা কহিবে না, তাহা হইলেই বড় ভাল বৌ হইল। সেকালে এখনকার মত চিকণ কাপড় ছিল না, মোটা মোটা কাপড় ছিল। আমি সেই কাপড় পরিয়া বুক পর্যন্ত ঘোমটা দিয়া ঐ সকল কাজ করিতাম। আর যে সকল লোক ছিল, কাহারও সঙ্গেই কথা কহিতাম না। যেন কলুর বলদের মত দুইটি চক্ষু ঢাকা থাকিত। আপনার পায়ের পাতা ভিন্ন অন্য কোন দিকে দৃষ্টি চলিত না। এই প্রকার সকল বিষয়ে বৌদিগের কর্মের রীতি ছিল। আমি ঐ রীতিমতেই চলিতাম।“
শুধুমাত্র বাড়ির অন্য লোকজনের সাথেই নয়, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, নিজের স্বামীর সঙ্গেও পর্দা করে চলতে হতো তখন নারীদের। রাতের বেলা ছাড়া স্বামী স্ত্রীর দেখা সাক্ষাত কদাচিতই ঘটতো। পর্দা প্রথার এই কঠোর অনুশাসন যে শুধুমাত্র গ্রাম্য সমাজে প্রচলিত ছিল তা নয়। শহরের শিক্ষিত সমাজেও এই প্রথা জাঁক বেধেছিল সেই সময়ে। বাঙালি হিন্দু সমাজে পর্দা প্রথাকে তখন দেখা হতো সভ্যতা ও ভব্যতার অংশ হিসাবে। গোলাম মুরশিদ তাঁর হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃত বইতে লিখেছেন,
“রাসসুন্দরী দেবীর বিয়ে হয় বারো বছর বয়সে। তা সত্ত্বেও বিয়ের পরে লম্বা ঘোমটা টেনে তিনি শাশুড়ী এবং তাঁর দুই ননদের সঙ্গে নিজের পর্দা রক্ষা করতেন। আর স্বামীকে তিনি চিরদিনই দারুণ ভয় এবং লজ্জা করতেন। এই লজ্জা এতো বেশি ছিলো যে, স্বামীর ঘোড়ার সামনে যেতেও তিনি লজ্জা পেতেন। একবার তাঁর স্বামীর ঘোড়া উঠোনে মেলে দেওয়া ধান খেয়ে ফেলছিলো। তিনি এই ঘোড়াকে তাড়িয়ে দিতে চাইছিলেন, কিন্তু স্বামীর ঘোড়ার সামনে লজ্জায় কি করে যাবেন – এ জন্যে ব্যস্ত হলেও তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেন নি।
রাসসুন্দরী গ্রামের মহিলা। সেখানে পর্দার প্রকোপ বেশি ছিল – এমনটা মনে করা অসম্ভব নয়। কিন্তু সে ধারণা সঠিক নয়। গ্রামে বরং পর্দার কড়াকড়ি খানিকটা কম ছিলো। অপরপক্ষে, আমরা দেখতে পাই, কলকাতার সবচেয়ে শিক্ষিত, বিদগ্ধ এবং অভিজাত পরিবার – জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে আরও অর্ধশতাব্দী পরেও পর্দা কী কঠোরভাবে পালন করা হতো। রবীন্দ্রনাথের মা গঙ্গাস্নান করতে চাইলে তাঁকে পাল্কিতে করে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু পালকি থেকে তিনি কখনো বের হতেন না। পাল্কি বেহারারা তাঁকে পুরো পাল্কিসুদ্ধ গঙ্গার পানিতে চুবিয়ে তুলতেন।
সত্যি বলতে কি , সেকালে নিজের বাড়ির বাইরে যাওয়ার কোনো অনুমতি মেয়েদের ছিলো না। তাঁরা কালেভদ্রে যেতে পারতেন বাপের বাড়িতে। কেশব সেনের জীবনী থেকেই এর একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের একজন অত্যুৎসাহী সদস্য। তাঁর আগ্রহ এবং ক্ষমতা দেখে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ষাটের দশকের গোড়ায় বাহ্ম সমাজের আচার্য পদে বসান। অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে কেশব সেন তাঁর স্ত্রীকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে আসতে চান। কিন্তু পর্দা প্রথা ভেঙে কেশবের স্ত্রী অন্যের বাড়িতে যাবেন, আত্মীয়রা এটা কিছুতেই অনুমোদন করতে পারছিলেন না। তাঁরা তাঁকে নিষেধ করেন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে যেতে। কিন্তু তিনি সে নিষেধ অমান্য করার চেষ্টা করলে আত্মীয়রা তাঁকে দারোয়ান দিয়ে বাধা দিতেও কুণ্ঠিত হননি। শেষ পর্যন্ত কেশব অবশ্য পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে স্ত্রীকে নিয়ে ঠাকুরবাড়িতে আসেন।
১৮৬০-এর দশকে লেখা দীনবন্ধু মিত্রের নাটক জামাই বারিকে যে দৃশ্য এঁকেছেন, তা থেকে জানা যায় যে, সে বাড়ির জামাইরা বাইরের বারিক অর্থাৎ ব্যারাকে থাকতো। দিনের বেলা তারা তাদের স্ত্রীদের দেখতে পেতো না। রাতের বেলা এক-একদিন অন্দরমহল থেকে তাঁদের ডাক পড়তো। ঠাকুরপরিবারেও স্বামীরা সব অন্তঃপুরে ঢুকতেন রাতের বেলায়। রবীন্দ্রনাথের বোন সৌদামিনী দেবী ও সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী – উভয়ই এটা উল্লেখ করেছেন। এমন কি, স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি রাত দশটায় অন্দরমহলে ঢুকতেন এবং তার আগে থেকে সারদা দেবী সেজেগুঁজে, সুগন্ধী মেখে বসে থাকতেন।
সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নারীদের অধিকার এবং স্বামী-স্ত্রীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিষয়ে সবচেয়ে সচেতন এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তি। তা সত্ত্বেও তিনিও রাতের বেলাতেই তাঁর ‘গেনু’র সঙ্গে মিলিত হতে পারতেন, তাঁর আগে নয়। একবার তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনমোহন ঘোষের সঙ্গে জ্ঞানদা দেবীর পরিচয় করিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কাজটা অতো সহজ ছিলো না। প্রথম বাধা হচ্ছে, জ্ঞানদানন্দিনীর পকশে অন্তঃপুরের বাইরে আসা অথবা মনমোহনের পক্ষে অন্তঃপুরে ঢোকা – পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী এর কোনোটাই সম্ভব ছিলো না ।সে জন্যে, একদিন রাতের বেলা সত্যেন্দ্রনাথা তাঁর বন্ধুর গলা ধরে তালে তালে পা ফেলে অন্তঃপুরে ঢোকেন – যাতে কে উ বুঝতে না পারে যে, দুজন লোক ঢুকছেন। তারপর জ্ঞানদার ঘরে গিয়েই সত্যেন্দ্রনাথ বন্ধুকে জ্ঞানদার সঙ্গে মশারীর মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু সে যুগে নারী-পুরুষের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ অথবা কথাবার্তার কোনো রীতি না থাকায় দুজনের মধ্যে কোনো আলাপ হতে পারেনি। বস্তুত, লজ্জায় মরে গিয়ে জ্ঞানদা মনমোহনের সঙ্গে কোনো কথাই বলতে পারেননি। কিছুক্ষণ পরে সত্যেন্দ্রনাথ আবার বন্ধুকে নিয়ে মার্চ করে বাইরে আসেন। এর কয়েক বছর পরে – ১৮৬৪ সালে – যখ ন্স্বামীর সঙ্গে বোম্বাইতে যান, তখনো জ্ঞানদা লজ্জায় অনেক অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলেন। কিন্তু ১৮৬৬ সালে তিনি যখন কলকাতায় ফিরে আসেন, তখন তিনি রীতিমত পর্দামুক্ত সপ্রতিভ মহিলায় পরিণত হয়েছিলেন। তিনি এ সময়ে স্বামীর সঙ্গ ছাড়া একাই গভর্নর-জেনারেলের একটি পার্টিতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান।
দিনের বেলা স্বামীর সঙ্গে দেখা না-হয়ায় এবং অন্য সময়েও বিশেষ কোনো বাক্য বিনিময় না-হওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক সময়ে স্বামী-স্ত্রীসুলভ স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠতো না। নীরদ চৌধুরী এরকম একটি প্রায় অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। তিন সন্তানের জননী হয়েও এক মহিলা তাঁর স্বামীর চেহারা ঠিক কেমন তা জানতেন না। একদিন দিনের বেলা তাঁকে দেখে তিনি তাই চিনতে পারেননি। তাঁদের যা কিছু সম্পর্ক ছিলো, তা রাতের বেলায় শোবার পর। তখন স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর যে-যৌনসঙ্গম হতো, নীরদ চৌধুরীর মতে, তাতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের যোগাযোগ ঘটতো এবং বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের সুখও হতো, কিন্তু দর্শন ইন্দ্রিয়ের কোনো তৃপ্তি হতো না। কারণ, অন্ধকারে স্বামী-স্ত্রী কেউ কারো চেহারা দেখতে পেতেন না।“
এই যদি হয় উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের অবস্থা, তবে আরো পঞ্চাশ বছর আগে রাসসুন্দরীর অবস্থা কী ছিলো তা অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। একবার রাসসুন্দরী দেবী অসুস্থ হয়ে প্রায় মরতে বসেছিলেন। খবর পেয়ে স্বামী আসেন, কিন্তু স্ত্রীর কাছাকাছি এসে, বা তাঁর শরীরে হাতের ছোঁয়া দিয়ে উত্তাপ অনুভবের কোনো চেষ্টাই তিনি করেন না। স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা কী, সেটা কাছে এসে না বোঝার চেষ্টা করে বরং দূর থেকে ‘মলো নাকি!’ বলে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থেকেছেন।
এরকম ভয়াবহ এক পরিস্থিতিতে নারী শিক্ষার কী দশা হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। নারী শিক্ষাকে মনে করা হতো ভদ্রলোকদের জন্য জাতি না থাকার সামিল। নারী শিক্ষার প্রসঙ্গ আসলে সে সময়ে মানূষ কী ধরণের উস্মা প্রকাশ করতো তার ধারণাও দিয়েছেন রাসসুন্দরী আমাদের।
“তখনকার লোক বলিত, বুঝি কলিকাল উপস্থিত হইয়াছে দেখিতে পাই। এখন বুঝি মেয়েছেলেতেও পুরুষের কাজ করিবেক। এতকাল ইহা ছিল না, একালে হইয়াছে। এখন মাগের নামডাক, মিনসে জড়ভরত, আমাদের কালে এত আপদ ছিল না। এখন মেয়ে রাজার কাল হইয়াছে। দিনে দিনে বা আর কত দেখিব! এখন যেমত হইয়াছে, ইহাতে আর ভদ্রলোকের জাতি থাকিবে না। এখন বুঝি সকল মাগীরা একত্র হইয়া লেখাপড়া শিখিবে।“ (সময়ে শব্দের অর্থ কীভাবে পালটে যায়, তার জ্বলন্ত উদারণ হচ্ছে মাগী শব্দটি। একসময় এটি নারী শব্দের প্রচলিত গ্রাম্য নির্দোষ শব্দ বা স্ল্যাং ছিল, এখন এটি পরিণত হয়েছে নারীদের জন্য চরম অবমাননাকর গালিতে।)
এরকম এক বৈরী সামাজিক কাঠামোতে শিক্ষার কথা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে এই গ্রাম্য বধুটির মনের কোণে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ জন্মে উঠে। পুঁথি পড়ার জন্য তাঁর প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠে। কিন্তু একথা প্রকাশ করার মতো সাহসও তাঁর ছিলো না। ফলে একমাত্র উপায় ছিল পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা।
“আমার মনের কথা প্রকাশ করা দূরে থাকুক, কেহ জানিবে বলিয়া ভয়ে প্রাণ কাঁপিত। এমনকি, যদি একখানি লেখা কাগজ দেখিতাম, তাহাও লোকের সম্মুখে তাকাইয়া দেখিতাম না। পাছে কেহ বলে যে, লেখাপড়া শিখিবার জন্যই দেখিতেছি। কিন্তু আমার মনের সহিত সর্বদা পরমেশ্বরের নিকট এই বলিয়া প্রার্থনা করিতাম, হে পরমেশ্বর! তুমি আমাকে লেখাপড়া শিখাও, আমি লেখাপড়া শিখিয়া পুঁথি পড়িব!
এইটি ভারি আক্ষেপের বিষয় ছিল যে, মেয়েছেলে বলিয়া লিখিতে পড়িতে পারিতাম না। এখনকার মেয়েছেলেদিগের কি সুন্দর কপাল। এখন মেয়ে জন্মিলে অনেকেই বিদ্যাশিক্ষার চেষ্টা করেন।“
পুঁথি পাঠের এই বাসনা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে রাসসুন্দরী দেবীর। শুধু পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেই ক্ষান্ত থাকেন না তিনি। এর জন্য প্রাণপাত করতেও দ্বিধা করেন না। তাঁকে পড়া শেখানোর কেউ ছিলো না। শুধু যে কেউ ছিলো না তা নয়, তিনি যে পড়া শিখতে চান, এটা মুখ ফুটে বলার মতো সাহস তাঁর ছিলো না। বিদ্যা শিক্ষা নারীদের জন্য তখন ঘোরতর নিন্দনীয় কাজ। তিনি মনের মধ্যে ইচ্ছা এনেছেন শুধু এটুকু জানলেই আকাশ ভেঙ্গে পড়বে অনেকের মাথার উপরে। এই পরিস্থিতিতে এখানেই ইতি হয়ে যাবার কথা ছিলো সবকিছুর। এমন স্বপ্ন হয়তো আরো অনেক নারীর মধ্যেই জেগেছে তখন, কিন্তু সেই স্বপ্নের বীজ চারা হয়ে মাটি ভেদ করে আলোর মুখ দেখে নি বৈরী এবং বন্ধা পরিবেশের কারণে। কিন্তু রাসসুন্দরী থেমে থাকেন নি। কারো সাহায্যের অপেক্ষায় বসে থাকেন নি। এই গ্রাম্য নারীটি অদ্ভুত এক উপায়ে নিজেকে নিজে পড়ালেখা শেখা্নোর দায়িত্ব নেন। অদ্ভুত, আয়েসবিবর্জিত এবং সময়সাপেক্ষ এক পন্থা ছিলো সেটি। সেই সময়ে তিনি বেশ কয়েক সন্তানের জননী হয়ে গেছেন, বিরাট এক সংসারের বউ তিনি। তিন ননদই ততদিনে বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে বাপের বাড়িতে। তাঁর ঘাড়েই সংসার সামাল দেবার সমস্ত বোঝা। তারপরেও এই সব হাজারো ঝামেলা সামলে এই অসাধারণ মহিলাটি কীভাবে পড়া শিখলেন তা তাঁর নিজের মুখ থেকেই শোনা যাক।
‘অনন্তর আমার মনের বাসনা প্রবল হইয়া উঠিল যে, আমি পুঁথি পড়িব। তখন আমি মনে মনে মনের উপর রাগ করিতে লাগিলাম। কি জ্বালা হইল, কোন মেয়ে লেখাপড়া শিখে না, আমি কেমন করিয়া লেখাপড়া শিখিব, একি দায় উপস্থিত হইল। আমি কি করিব ভাবিতে লাগিলাম। তখন আমাদিগের দেশের সকল আচার-ব্যবহারই বড় মন্দ ছিল না, কিন্তু এই বিষয়টি ভারি মন্দ ছিল। সকলেই মেয়েছেলেকে বিদ্যায় বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। তখনকার মেয়েছেলেগুলা নিতান্তই হতভাগা, প্রকৃতি পশুর মধ্যে গণনা করিতে হইবেক। এ বিষয়ে অন্যের প্রতি অনুযোগ করা নিরর্থক, আমাদের নিজের অদৃষ্ট ক্রমেই এ প্রকার দুর্দশা ঘটিয়াছে। বাস্তবিক মেয়েছেলের হাতে কাগজ দেখিলে সেটি ভারি বিরুদ্ধ কর্ম জ্ঞান করিয়া, বৃদ্ধা ঠাকুরাণীরা অতিশয় অসন্তোষ প্রকাশ করিতেন, অতএব আমি কেমন করিয়া লেখাপড়া শিখিব। আমার মনও তাহা মানে না, লেখাপড়া শিখিব বলিয়া সতত ব্যাকুল থাকে। আমি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, যখন আমি ছেলেবেলায় স্কুলে বসিয়া থাকিতাম, তখন যত ছাত্র লেখাপড়া করিত, আমিতো তাহা শুনিতে শুনিতে কতক কতক মনে মনে শিখিয়াছিলাম, তাহার কিছুই কি আমার স্মরণ নাই? এই প্রকার ভাবিতে ভাবিতে ঐ চৌত্রিশ অক্ষর, ফলা বানান সহিত আমার মনে হইল। তাহাও কেবল পড়িতে পারি, লিখিতে পারি না। কি করিব, ভাবিতে লাগিলাম। বস্তুতঃ একজন না শিখাইলে, কেহ লেখাপড়া শিখিতে পারে না। বিশেষতঃ আমি মেয়ে, তাহাতে আবার বউ মানুষ, কাহার সঙ্গে কথা কহি না, অধিকন্তু আমাকে যদি কেহ দুটা কটু বাক্য বলে, তাহা হইলে আমি মৃতপ্রায় হইব; এই ভয়ে আমি কাহার নিকটও কথা কহিতাম না। কেবল দিবারাত্র পরমেশ্বরকে ডাকিয়া বলিতাম, পরমেশ্বর! তুমি আমাকে লেখাপড়া শিখাও, আমি নিতান্তই শিখিব। তুমি যদি না শিখাও, তবে আর কে শিখাইবে। এইরূপে মনে মনে সর্বদা বলিতাম। এই প্রকারে কতক দিবস যায়।
এক দিবসে আমি নিদ্রাবেশে স্বপ্ন দেখিতেছি, – আমি যেন চৈতন্য ভাগবত পুস্তকখানি পাঠ করিতেছি। আমি এই স্বপ্ন দেখিয়া জাগিয়া উঠিলাম। তখন আমার শরীর মন এককালে আনন্দরসে পরিপূর্ণ হইল। আমি জাগিয়াও চোখ বুজিয়া বার বার ঐ স্বপ্নের কথা মনে করিতে লাগিলাম, আর আমার জ্ঞান হইতে লাগিল, আমি যেন কত অমূল্য রত্নই প্রাপ্ত হইলাম। এই প্রকার আহ্লাদে আমার শরির মন পরিতুষ্ট হইল। আমি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, কি আশ্চর্য! এ চৈতন্যভাগবত পুস্তক আমি কখনও দেখি নাই এবং আমি ইহা চিনিও না, তথাপি স্বপ্নাবেশে সেই পুস্তক আমি পাঠ করিলাম। আমি মোটে কিছুই লিখিতে পড়িতে জানি না, তাহাতে ইহা ভারী পুস্তক। এ পুস্তক যে আমি পড়িব, ইহা কোনমতেই সম্ভব নহে। যাহা হউক, আমি যে স্বপ্নে এ পুস্তক পড়িলাম, ইহাতে আমি কৃতকৃতার্থ হইলাম। আমার জীবন সফল হইল। আমি পরমেশ্বরের নিকটে সমস্ত দিনই বলিয়া থাকি, আমাকে লেখাপড়া শিখাও, পুঁথি পড়িব। সেইজন্য পরমেশ্বর লেখাপড়া না শিখাইয়াই স্বপ্নে পুঁথি পড়িতে ক্ষমতা দিয়াছেন। ইহা আমার বড় আহ্লাদের বিষয়, পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ। আমার জন্ম ধন্য, পরমেশ্বর আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়াছেন। আমি এই প্রকার ভাবিয়া ভারি প্রফুল্ল চিত্তে থাকিলাম।
আমি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, শুনিয়াছি, এই বাটীতে অনেক পুস্তক আছে, তাহার মধ্যে চৈতন্যভাগবত পুস্তকও থাকিলে থাকিতে পারে। কিন্তু থাকা না থাকা আমার পক্ষে সমান কথা। আমি কিছু লেখাপড়া জানি না, সুতরাং পুঁথি চিনিতে পারিব না, এই ভাবিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলাম, হে দীননাথ! আমি কল্য স্বপ্নে যে, পুস্তকখানি পড়িয়াছি, তুমি ঐ পুস্তকখানি আমাকে চিনাইয়া দাও। ঐ চৈতন্য-ভাগবত পুস্তকখানি আমাকে দিতেই হইবে, তুমি না দিলে আর কাহাকে বলিব। আমি এই প্রকার মনে মনে বলিতেছি, আর পরমেশ্বরকে ডাকিতেছি।
আহা কি আশ্চর্য! দয়াময়ের কি অপরূপ দয়ার প্রভাব! আমি যেমন মনে মনে এই সকল চিন্তা করিতেছিলাম, অমনি তিনি শুনিয়া আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলেন। তখন আমার বড় ছেলেটি আট বৎসর বয়ষ্ক। আমি পাকের ঘরে পাক করিতেছি, ইতিমধ্যে কর্তা আসিয়া ঐ ছেলেটিকে ডাকিয়া বলিলেন, বিপিন! আমার চৈতন্য-ভাগবত পুস্তকখানি এখানে থাকিল, আমি যখন তোমাকে লইয়া যাইতে বলিব, তখন তুমি লইয়া যাইও। এই বলিয়া ঐ চৈতন্য-ভাগবত পুস্তকখানি অখানে রাখিয়া, তিনি বাহির বাটীতে গেলেন।
আমি পাকের ঘরে থাকিয়া ঐ কথাটি শুনিলাম। তখন আমার মনে যে কি পর্যন্ত আহ্লাদ হইল, তাহা বলা যায় না। আমি অতিশয় পুলকিত মনে তাড়াতাড়ি গিয়া দেখিলাম, সেই চৈতন্যভাগবত পুস্তকখানি বিদ্যমান। আমি ভারি সন্তুষ্ট হইয়া মনে মনে বলিতে লাগিলাম, পরমেশ্বর! তুমি আমার মস্কামনা সিদ্ধ করিয়াছ। এই বলিয়া আমি ঐ পুস্তক খুলিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া বেশ করিয়া দেখিলাম। এখনকার পুস্তক সকল যে প্রকার, সে কালে এ প্রকার পুস্তক ছিল না। সে সকল পুস্তকে কাঠের আড়িয়া লাগান থাকিত। তাহাতে নানাপ্রকার চিত্র-বিচিত্র ছবি আঁকাইয়া রাখিত। আমি তো লিখিতে পড়িতে জানি না, কিরূপে ওই পুস্তক চিনিব? আমি কেবল ঐ চিত্র পুত্তলিকা দেখিয়া ঠিক করিয়া রাখিলাম।
পরে পুস্তকখানি ঘরের মধ্যে রাখিলে আমি ওই পুস্তক খুলিয়া একটি পাত লুকাইয়া রাখিলাম। সে পাতটি কোথা রাখিব, কেহ দেখিবে বলিয়া ভারি ভয় হইল। আমি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, এই পুস্তকের পাত যদি আমার হাতে কেহ দেখে, তাহা হইলে নিন্দার একশেষ হইবেক। অধিকন্তু কটুবাক্য বলিলেও বলার সম্ভব আছে। লোকের নিকট নিন্দিত কর্ম করা, কিম্বা কটুবাক্য সহ্য করা সাধারণ ব্যাপার নহে। এ সকল বিষয়ে আমার ভারি আশঙ্কা। বিশেষতঃ সে সময় এখনকার মত আচার ব্যবহার ছিল না। সে এক কাল গিয়াছে। সম্পূর্ণরূপে পরাধীনতার কাল যাপন হইত। বিশেষতঃ আমার অতিশয় ভয় ছিল। তখন ঐ পুস্তকের পাতটি লইয়া আমি মুস্কিলে পড়িলাম। হাতে করিয়া ভাবিতে লাগিলাম, কি করিব, কোথায় রাখিব, কোথায় থুইলে কে দেখিবে। এ প্রকার ভাবিয়া মনে মনে স্থির করিলাম, যে স্থানে থাকিলে আমি সতত দেখিতে পাইব অথচ অন্য কেহ না দেখে, এমন স্থানে রাখা উচিত। আর কোথা রাখিব, রান্নাঘরের হেঁশেলের মধ্যে খোড়ীর নীচে লুকাইয়া রাখিলাম। কি করিব, সকল দিবস সংসারের কাজে অবকাশ পাওয়া যায় না। সেই পাতাটি যে কখন দেখিব, তাহার সময় নাই। রাত্রে পাক-সাক করাতেই ভারি রাত্রি হইয়া পড়ে। তখন ঐ সকল কাজ মিটিতে না মিটিতেই ছেলেপিলেগুলি জাগিয়া উঠিয়া বসে। তখন কি আর অন্য কথা! তখন কেহ বলে মা মুতিব, কেহ বলে মা ক্ষিদে লেগেছে, কেহ বলে মা কোলে নে, কেহ বা জাগিয়া কান্না আরম্ভ করে। তখন তো ঐ সকলকে সান্ত্বনা করিতে হয়। ইহার পরে রাত্রিও অধিক হয়, নিদ্রা আসিয়া চাপে, তখন লেখাপড়া করিবার আর সময় থাকে না। কি প্রকারে আমি শিখিব তাহার কোন উপায় দেখি না। লেখাপড়া একজন না শিখাইলে কেহ শিখিতে পারে না। আমি যে দুই চারিটা অক্ষর মনে মনে পড়িতে পারি, তাহাও লিখিতে জানি না। লিখিতে না জানিলে জিতাক্ষর হওয়া দুঃসাধ্য। সুতরাং ঐ লেখা পাতটি আমি কেমন করিয়া পড়িব? আমি ভাবিয়া কোন উপায় দেখি না। অধিকন্তু কেহ দেখিবে বলিয়া সর্বদাই ভয়।
আমি এককালে নিরুপায় হইয়া একান্ত মনে কেবল দিবারাত্র পরমেশ্বরকে ডাকিয়া বলিতাম, হে পরমেশ্বর! আমি এই পুস্তক যাহাতে পড়িতে পারি, আমাকে এরূপ কিঞ্চিৎ লিখিতে শিখাও, তুমি যদি না শিখাও, তবে আর কে শিখাইবে! আমি এই প্রকার পরমেশ্বরের নিকটে দিবারাত্র প্রার্থনা করিতাম। আর একবার মনে ভাবিতাম, লেখাপড়া আমার শিখা হইবে না। যদিও চেষ্টা করিলে এবং কেহ শিখাইলে এক আধটি বিষয় শিখা যায়, তাহারও সময় পাওয়া যায় না। আমার কিছু হবে না, মিথ্যা বাসনা মাত্র। আবার মনে মনে বলি, কেন হবে না, পরমেশ্বর যখন আমার মনে এতখানি আশা দিয়াছেন, তখন তিনি কখনই নিরাশা করিবেন না! আমি এই প্রকার সাহস করিয়া ঐ পাতটি রাখিলাম। কিন্তু দেখিতে সময় পাই না। যখন পাক করি, ঐ সময়ে সেই পুস্তকের পাতটি বাঁ হাতের মধ্যে রাখি, আর একবার ঘোমটার মধ্যে লইয়া দেখি। দেখিলেই বা কি হইতে পারে, আমি মোটে কোন অক্ষর চিনিতে পারি না।
তখন আমার বড় ছেলেটি তালপাতাতে লিখিত। আমি তাহার একটি তালের পাতাও লুকাইয়া রাখিলাম। ওই তাল পাতাটি একবার দেখি, আবার ঐ পুস্তকের পাতটিও দেখি, আর আমার মনের অক্ষরের সঙ্গে যোগ করিয়া দেখি, আবার সকল লোকের কথার সঙ্গে যোগ করিয়া মিলাইয়া মিলাইয়া দেখি। এই প্রকার করিয়াই কতক দিবস গত হইল, সেই পুস্তকের পাতটি একবার বাহির করিয়া দেখিতাম, আবার কেহ দেখিবে বলিয়া অমনি খোড়ীর নীচে লুকাইয়া রাখিতাম।
আহা কি আক্ষেপের বিষয়! মেয়েছেলে বলিয়া কি এতই দুর্দশা! চোরের মত যেন বন্দী হইয়া থাকি, তাই বলিয়া কি বিদ্যা শিক্ষাতেও দোষ? সে যাহা হউক, এখনকার মেয়েছেলেগুলা যে নিষ্কণ্টকে স্বাধীনতায় আছে, তাহা দেখিয়াও মন সন্তুষ্ট হয়। এখন যাহার একটি মেয়েছেলে আছে, সে কত যত্ন করিয়া লেখাপড়া শিখায়।
আমি যে ছেলেবেলায় স্কুলে বসিয়া থাকিতাম, তাহাতে আমার অনেক উপকার হইয়াছে। আমি সেই পুস্তকের পাতটি ঐ তালের পাতটি লইয়া মনের অক্ষরের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতাম। আমি এই প্রকার করিয়া সকল দিবস মনে মনে পড়িতাম। আমি অনেক দিবসে, অনেক পরিশ্রমে, অনেক যত্নে এবং অনেক কষ্ট করিয়া ঐ চৈতন্যভাগবত পুস্তকখানি গোঙ্গাইয়া পড়িতে শিখিলাম।“
রাসসুন্দরী দেবী গোঙ্গাইয়া পড়তে শিখলেন ঠিকই, কিন্তু সমাজের চোখ রাঙানিতো আর বন্ধ হয় নি তাতে। পুস্তক পড়া শিখেছেন, কিন্তু সংসার সামলাতে গিয়ে তা পড়ার সময় নেই। সময় যেটুকু পান, সেখানেও নিরন্তর এক ভয়ের রাজ্যের বসবাস তাঁর। কেউ দেখে ফেললেই যে সর্বনাশ! এ আবার কি? মেয়েছেলে লেখাপড়া করিতেছে? মেয়েছেলে লেখাপড়া করা বড় দোষ। মেয়েছেলে লেখাপড়া শিখিলে সর্বনাশ হয়, মেয়েছেলে কাগজ কলম হাতে করিতে নাই। এরকম কঠিন পরিস্থিতেও পুঁথি পড়ার আগ্রহে তাঁর কোনো ভাটা নেই।
“আমি পুস্তক যে একটু একটু পড়িতে পারি, তাহাও পড়িবার সময় পাই না। বিশেষ কেহ দেখিয়া কি বলিবে, এই ভয় অতিশয় হয়। মনও কোন মতে বুঝে না, ভাবিয়াও উপায় দেখি না। কি করিব, মনে মনে এক উপায় স্থির করিলাম। আমার ননদ তিনটি আছেন, তাঁহারা যদি আমাকে পুঁথি পড়িতে দেখেন, তবে আর রক্ষাও নাই। তাঁহাদিগের যে সময়ে আহ্নিক পূজা আহারাদি হয়, ঐ সময় আমি পুঁথি পড়িব। এই বলিয়া আমার মনকে স্থির করিলাম। পরে আমার নিকট যে সকল প্রতিবাসিনী সতত থাকিতেন, তাঁহাদিগকে সঙ্গে লইয়া এক নির্জন স্থানে বসিয়া ঐ চৈতন্যভাগবত পুস্তকখানি পড়িতে আরম্ভ করিতাম। আমি যতক্ষণ ঐ পুস্তকখানি পড়িতাম, কেহ আসিয়া দেখিবে বলিয়া সেই পথে একজন লোকপ্রহরী রাখা হইত। আমি অতি ছোট ছোট করিয়া পুঁথি পড়িতাম, তথাপি আমার প্রাণ ভয়ে এক একবার চমকে চমকে উঠিত, মনে ভাবিতাম কেহ বুঝি শুনিল। বাস্তবিক ভয়টি আমার প্রধান শত্রু ছিল। সকল বিষয়েই বড় ভয় হইত, আমি ভয়েই মরিতাম। কিন্তু যাঁহারা আমার সঙ্গিনী ছিলেন, তাঁহারা উত্তম লোক ছিলেন। তাঁহাদিগের সহায়ে আমি গোপনে গোপনে গানও করিতাম। বাস্তবিক সেকালের লোক এখন পর্যন্ত যাঁহারা আছেন, তাঁহাদিগের নিকট মেয়েছেলের বিদ্যাশিক্ষা ভারি মন্দ কর্ম বলিয়া বোধ হয়। তাঁহারা বলিয়া থাকেন, মেয়েছেলে ঘরের মধ্যে কাজকর্ম করিবে, রান্না-বান্না করিবে, লজ্জা সরম করিবে, আমরা ইহাই জানি। আমাদের কালে আর এত বালাই ছিল না। শুনিতে পাই বলে, লেখাপড়া শিখিলেই ভাল হয়। আমরা যে লেখাপড়া জানি না, তবে আর আমরা মানুষ নই। আমাদের আর দিন গেল না। তাঁহারা এই প্রকার বলিয়া থাকেন। সে সকল লোকের মনের ভাবে বুঝা যায়, যেন বিদ্যার আর কোন গুণ নাই, বিদ্যায় কেবল টাকা উপার্জন হয়। ঐ সমুদয় দেখিয়া শুনিয়া আমার অতিশয় ভয় হইত, কিন্তু পুঁথি পড়া আমি ছাড়িতাম না, গোপনে গোপনে বসিয়া পড়িতাম।“
আগেই উল্লেখ করেছি যে ,সেই সময়ের পুরবধুদের পর্দাপ্রথা শুধুমাত্র পুরুষদের সাথেই করা হতো না, বাড়ির নারীদের সাথেও করা হতো। শুধু পর্দা করাই না, কথাবার্তাও হতো না কারো সাথে। রাসসুন্দরীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। বাড়িতে তিনটি ননদ আছে, কিন্তু তাঁদের কারো সাথে তাঁর কথা হতো না। এই পঙ্কিল পর্দাপ্রথা ভাঙার উদ্যোগ নেন তিনি। অচলায়তনের ভিত নাড়ানোর প্রাথমিক কাজগুলো এভাবেই করে গেছেন রাসসুন্দরীদের মত নারীরা নীরবে নিভৃতে। তিন ননদের সাথে কথা বলায় বিরাট এক উপকার হলো রাসসুন্দরীর। তাঁর তিন ননদই সেই যুগের প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট উদার মনের ছিলেন। মেয়েদের লেখাপড়া শেখার বিষয়ে সমাজের যে নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা ছিল, তা গ্রাস করেনি অশিক্ষিত এই গ্রাম্য নারীদের। তাঁরা বরং তাঁদের বৌদির এই অসাধারণ ক্ষমতা আছে জানতে পেরে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন। ঘরের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে পুঁথি পড়ার দুর্বিসহ জীবন থেকে মুক্তি পান রাসসুন্দরী।
“পরে ঐ তিনটি ননদের সঙ্গে আমি কথা কহিতে আরম্ভ করিলাম, তাহাতে তাঁহারা ভারি সন্তুষ্ট হইলেন। তখন তাঁহাদিগের সঙ্গে কথাবার্তায় বেশ মিল হইল। তখন তাঁহারা জানিতে পারিলেন, আমি পুঁথি পড়িতে পারি। তাহা শুনিয়া ভারি আহ্লাদিত হইয়া আমাকে বলিতে লাগিলেন, আহা! তুমি লেখাপড়া জান, ইহা আমরা এত দিবস কিছুই জানি না। এই বলিয়া তাঁহারা দুই ভগিনীতে আমার নিকটে লেখাপড়া শিখিতে আরম্ভ করিলেন। আমার সেই দুটি নন্দ অল্প দিন পড়ালেখা করিয়াই ক্ষান্ত দিলেন, শিখিতে পারিলেন না। তখন ঐ পুস্তক পড়ার জন্য আমার সেই ননদেরা আমাকে বিশেষ যত্ন করিতেন। সেই অবধি আমি আর গোপনে পুঁথি পড়িতাম না। আমার ননদদিগের সম্মুখে সদর হইয়া পুঁথি পড়িতে লাগিলাম। তখন আমার মনে আনন্দের আর সীমা থাকিল না। আহা কি আহ্লাদের বিষয়! আমার বহু দিবসের বাঞ্ছা জগদীশ্বর পূর্ণ করিলেন। আমি প্রতিবাসিনী সমজুটিদের সঙ্গে কখন কখন গোপনে গোপনে গানও করিতাম।“
পড়াটা শিখলেও লেখা শেখাটা তখনও হয়ে উঠে নি তাঁর। পড়াটা যতখানি গোপনে করা যায়, সে সময়ে লেখাটা অতখানি গোপনে করা সম্ভবপর ছিলো না। নানান ধরণের আয়োজন করে তখন লিখতে হতো। এগুলো করার মত সঙ্গতি তাঁর ছিলো না।
“আমি এত কষ্ট করিয়া পড়িতে শিখিয়াও তাহা লিখিতে শিখিলাম না। বিশেষতঃ লিখিতে বসিলে তাহার জন্যে আয়োজন লাগে, কাগজ, কলম, দোয়াত চাহি। তাহা লইয়া ঘটা করিয়া সাজাইয়া বসিতে হয়। আমি একে তো মেয়ে, তাহাতে বউ মানুষ, মেয়েমানুষকে লেখাপড়া শিখিতেই নাই। এটি স্ত্রীজাতির পক্ষে প্রধান দোষ বলিয়া সকলেই সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছেন । সে স্থলে আমি এ প্রকার সাজিয়া লিখিতে বসিলে লোকে আমাকে দেখিয়া কি বলিবে?”
লিখতে না পারার জন্যও তাঁর মনে আক্ষেপের অন্ত ছিল না। পরমেশ্বরের কাছে দিবারাত্র তিনি কেঁদেছেন তাঁকে লেখা শিখানোর জন্য। সেই লেখা তিনি শিখেছেন অনেক পরে। তাঁর সপ্তম ছেলে কিশোরীলাল তখন কোলকাতায় থেকে পড়াশোনা করে। সে একদিন মাকে বলে যে, মা, আমরা যে পত্র লিখিয়া থাকি, তাহার উত্তর পাই না কেন? তিনি তখন উত্তর করেন যে, তিনি লিখতে পারেন না বলেই পত্রের উত্তর দেন না। তখন ছেলেই মায়ের চিঠি পাবার আশায় মাকে কাগজ কলম, দোয়াত, কালি সব যোগাড় করে দিয়ে যায়। এর পর তিনি অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার জন্য তাঁর পঞ্চম পুত্র দ্বারকানাথের বাড়ি কাঁঠালপোতায় ছয় মাসের মত থাকেন। সেখানেই ছেলের সহযোগিতায় লেখা শিখে ফেলেন তিনি।
বারো বছর বয়সে বালিকা বধু হয়ে স্বামীর সংসারে এসেছিলেন তিনি। আঠারো বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম দেন। একচল্লিশ বছর বয়সে শেষ সন্তানের। মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে বারোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। একজন নারীর জীবন এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই ভয়াবহ নির্যাতনের পরে একজন নারীর জীবনীশক্তি বলতে আর কিছু থাকার কথা নয়। পুরুষদের শারীরিক সুখ দেওয়া, অকাতরে সন্তান বিয়োনো আর তাদের সংসারের হেঁশেল ঠেলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছু করার প্রয়োজন মেয়েদের যেনো নেই। পুরুষের সেবাদাসী হওয়াটাই তাদের নিয়তি যেনো। (সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, রাসসুন্দরীর সময়ের দেড়শো বছর পরেও একই ঘটনা ঘটেছে। এখনো হয়তো ঘটে চলেছে কোথাও কোথাও। আমার সদ্যমৃত আম্মাই এর জ্বলন্ত উদাহরণ। আম্মার বিয়ে হয়েছিল মাত্র পনেরো বছর বয়সে। ষোলো বছর থেকেই সন্তান জন্ম দেওয়া শুরু করেন তিনি। মাত্র ঊনিশ বছরের ব্যবধানে নয়টি সন্তানের জন্ম দিয়ে ফুটফুটে সুন্দর একটি কিশোরী মাত্র পয়ত্রিশ বছর বয়সে অনাদর, অবহেলা আর অযত্নে ভগ্নস্বাস্থ্যের, পক্ককেশী পয়ষট্টি বছরের এক বৃদ্ধার রূপ ধারণ করেছিলেন।)
এতগুলো সন্তান হওয়ায় এবং তিনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার কারণে অসংখ্য মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। তাঁর সাতটি সন্তানের মৃত্যু হয় চোখের সামনে। এছাড়া স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি, হারিয়েছেন নাতি-নাতনিদেরও। এই সব প্রিয়জনদের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা কতখানি দুঃসহ শোকের তা ফুটে উঠেছে তাঁর বক্তব্যে।
“আমার দশটি পুত্র, দুইটি কন্যা। এই বারটি সন্তান হইয়াছিল। তাহার মধ্যে যে কয়েকটি সন্তানের মৃত্যু হইয়াছিল, তাহা আমি বিশেষ করিয়া বলি। মধ্যম পুত্র পুলিন-বিহারীর অন্নপ্রাশনের সময় মৃত্যু হয়। পরে প্যারীলাল নামক আর একটি পুত্র একুশ বৎসরের হইয়াছিল। সে ছেলেটি বহরমপুর কলেজে পড়িত। সেই বহরমপুর জেলাতেই তাহার মৃত্যু হয়। রাধানাথ নামে একটি পুত্র ১৩ বৎসর বয়;ক্রমে মৃত্যুগ্রাসে পতিত হয়। আর একটি পুত্রের ৩ বৎসরের সময়েই মৃত্যু হয়, তাহার নাম চন্দ্রনাথ। কনিষ্ঠ পুত্রটির ৪ বৎসরের সময় মৃত্যু হয়, তাহার নাম মুকুন্দলাল। আমার বড় কন্যাটির ১৭ বৎসর বয়সে একটি পুত্রসন্তান জন্মে, ১৩ দিবস পরে সূতিকা ঘরেই তাহার মৃত্যু হয়। ঐ সুতিকা ঘরেই তাহার ছেলেটিরও মৃত্যু হয়। আমার একটি পুত্র গর্ভবাসে ছমাস থাকিয়া গত হইয়াছে। আমার বড় পুত্র বিপিনবিহারীর দুটি পুত্রসন্তান হয়, ৩ বৎসর এবং ৪ বৎসরের হইয়া সে দুটি সন্তানই মরিয়াছে।
আমি যদি এই সকলের মৃত্যুর কথা একবার মনে করিয়া দেখি, তাহা হইলে আমার শোক বড় অল্প হয় না, শোকসাগর উথলিয়া উঠে। আমার পৌত্র, দৌহিত্র এবং ছয়টি পুত্র, আর একটি কন্যা, এই সমুদয় পরলোকগতপ্রাপ্ত হইয়াছে। অবশিষ্ট এখন আমার চারিটি পুত্র, আর একটিকন্যা, এই মাত্র।
লোকে বলে অস্ত্রের প্রহার আর পুত্রশোক এ দুইটি সমান কথা। বাস্তবিক বিবেচনা করিয়া দেখিলে, অস্ত্রের প্রহার ও পুত্রশোক কখন সমান হইতে পারে না। অস্ত্রাঘাত মনুষ্যের শরীরে যদি অধিক পরিমাণে হয়, তাহা হইলে তাহার মৃত্যু হইতে পারে। আর যদি কিছু অল্প পরিমাণে হয়, তাহা হইলে যে পর্যন্ত শরীরের অস্ত্রের ঘা থাকে, সেই পর্যন্ত কষ্ট ভোগ করিতে হয়। ঐ ঘা যখন শুকাইয়া যায়, তখন আর শরীরের জ্বালা যন্ত্রণা কিছুই থাকে না। কিন্তু শোকাঘাত যাবজ্জীবন পর্যন্ত থাকে। যদিও অনেক কষ্টে বাহিরে কিঞ্চিৎ ধৈর্য ধরিয়া অন্যমনা হইয়া থাকা যায়, তাহা হইলেও শোকানল প্রবল বেগে অহরহঃ হৃদয় দগ্ধ করে। শোকে লোকের যেরূপ দুর্দশা হয়, এরূপ আর কিছুতেই হয় না। শোকে লোক জ্ঞানহারা হইয়া উন্মত্তপ্রায় হইয়া যায়। শোকে মনুষ্যের মনুষ্যত্ব থাকে না, আর কত প্রকার যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়, তাহা বলা যায় না। শোক হইলে লোক মৃত্যু ইচ্ছা করে বটে, কিন্তু মৃত্যু হয় না, মৃত্যুর অধিক ফল হয়।“
শোক-তাপের কথা থাক। রাসসুন্দরী যে রসিক একটা মন ছিলো ,সেটা বোঝা যায় তাঁর বই পড়লেই। যদিও তিনি লজ্জার কারণে তাঁর জীবনের প্রেমময় অংশটি উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন, কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় ঢাকতে পারেন নি তাঁর রসে সিক্ত মনটিকে। বালিকা বধু হয়ে তিনি গিয়েছিলেন স্বামীর কাছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাঁর মনের রঙ বদল হয়েছে, শরীর ভরাট হয়েছে, রমণীয় থেকে রমণীয়তর হয়েছে, আকর্ষণীয় হয়েছে, বাঁকশোভিত হয়েছে। তাঁর শরীরের এই রূপান্তরিত সৌন্দর্যকে অদ্ভুত সুন্দর কাব্যিকভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি।
“ইতিমধ্যে পরমেশ্বর আমার শরীরে যে প্রকার প্রয়োজনীয় বস্তু লাগিবে, তাহার সমুদয় সরঞ্জাম দিয়া, আমার শরীরতরণী সাজাইয়া দিয়াছেন। আহা কি আশ্চর্য! কৌশলের বালাই লইয়া মরি! আমার শরীর হইতে এত গুলা ঘটনা হইতেছে, আমি তাহার কারণ কিছুই জানি না। হায়! একি ভেল্কীবাজী না কি, না আমি স্বপ্ন দেখিতেছি; এই প্রকার আমার মনের ভাব হইল, বাস্তবিক আপনার শরীর নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলে পরমেশ্বরের প্রতি বিলক্ষণ প্রতীতি জন্মে, তাঁহাকে আর দূরে অন্বেষণের আবশ্যক হয় না।“
অনেক ভাল কিছুই বলা হলো তাঁর বই সম্পর্কে। খারাপ কিছু কি নেই? হ্যাঁ, আছে। তিনি যে নিগুঢ় কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছেন, সম্পূর্নো নিজের চেষ্টায়, নিজস্ব গভীর মনোবলের প্রভাবে, এটাকে বার বার তিনি পরমেশ্বরের উপহার বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তাঁর বইতে তিনি কিছু অলৌকিক ঘটনার কথা বলেছেন। তাঁর সন্তানদের কিছু কিছু ঘটনা, যেগুলো তাঁর চোখের সামনে ঘটে নি, কিন্তু তিনি আগেই তা দেখতে পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এবং তাঁর দেখা ঘটনার হুবহু অনুরূপই বাস্তবে ঘটেছে বলে বলেছেন। এমনকি তিনি তাঁর নিজের মৃত্যুদৃশ্যও আগেভাগেই অলৌকিক উপায়ে দেখে ফেলেছেন, এবং মৃত্যুতে যে কিছুমাত্র ভয় নাই, এটা তিনি বিলক্ষণরূপে প্রত্যক্ষ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
রাসসুন্দরী যে প্রাচীন সময়ে জন্মেছেন, যে কুসংস্কারাচ্ছন ধর্মীয় সমাজে বড় হয়ে উঠেছেন, সেই পরিবেশের প্রভাব তাঁর উপরে পরেছে। তাঁর নিরন্তর পড়ালেখার প্রতি আগ্রহের পরেও, সেই সমাজচিন্তাকে পুরোপুরি নিজের ভিতর থেকে বের করতে পারেন নি তিনি। পারা সম্ভবও ছিলো না আসলে। অন্য সকলের মত তিনিও প্রবলভাবে ধার্মিক ছিলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কুসংস্কারাচ্ছন্নও ছিলেন। এই ধার্মিকতার কারণেই আসলে তাঁর পড়ার সূত্রপাত। এই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে, তাঁর অলৌকিক দর্শনকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখা যেতে পারেই।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নারীর অবস্থা কী রকম ছিলো, তাঁর প্রামান্য দলিল রাসসুন্দরীর আমার জীবন। অকপটে সহজ সরল ভাষায় তিনি বর্ণনা করেছেন নিজের কথা। সেই নিজের কথাই আজ হয়ে উঠেছে সেই সময়কার সমাজে নারীর অবস্থানের সমাজচিত্র। এ লেখা যে শুধুমাত্র আজকের নারীদের শিক্ষার বিষয়ে অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দেবে, তাই নয় বরং ঊনবিংশ শতাব্দীর নারীর সামাজিক অবস্থানের চিত্র অংকনে সমাজতাত্ত্বিকদেরও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। এর থেকে নির্ভরযোগ্য দলিল আর কী হতে পারে? দীনেশ্চন্দ্র সেন বলেছেন,
“সেকেলে রমণী সমাজের সম্পুর্ণ বশ্য ছিলেন। কে কি বলিবে, এই ভয় তাঁহার চিত্তে যেরূপ প্রবল ছিল, এই স্বেচ্ছাতন্ত্রযুগে তাঁহার একটা পরিমাণ করা যায় না। শুধু কে কি বলিবে তাহা নহে, কে তাহার মুখখানি দেখিয়া ফেলিবে – নিন্দুকের জিহ্বা নাচিয়া উঠিবে, এই লজ্জায় তিনি অবগুণ্ঠনবতী হইয়া যেভাবে লুকাইয়া থাকিতেন, তাহা এখন কল্পনা করা সহজ নহে। তিনি লেখাপড়ার চর্চা করেন, এ কথা শুনিলে গুরুজনের গণ্ড লজ্জায় রক্তিমাভ হইয়া উঠিত, ক্ষুধিত হইলে তিনি চাহিয়া খাইতে পারিতেন না – বধুবেশী হিন্দু রমণী সহিষ্ণুতা ও ত্যাগশীলতার একখানি মৌন ছবিবিশেষ ছিলেন। এই প্রকার অবস্থা সমূহ অতিক্রম করিয়া বার্ধ্যকে উপনীত একজন হিন্দু-রমণী কি ভাবে চিন্তা করিয়াছেন, তাঁহার ধর্মভাব কি প্রকার, তাঁহার মন কি ছন্দে গড়া – ইহা জানিতে স্বভাবতই কৌতুহল জন্মিবার কথা, এই কৌতুহলে রাসসুন্দরী অপর্যাপ্তরূপে চরিতার্থ করিয়াছেন।“
———————————————————-
পাদটীকাঃ
একঃ
দিন কয়েক আগে ঝুমুর কাছ থেকে একটা বার্তা পাই। সেটা এরকম, ‘দাদা, তুমি কি রাসসুন্দরীর আত্মজীবনীটা পড়েছো? এটা বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনী। বইটা কি তোমার কাছে আছে? বইটা পড়তে আমার খুউউউব ইচ্ছা করছে।‘
বইটা আমার পড়া ছিলো না, এমনকি আমার কাছে ছিলোও না। কিন্তু ওর ওই দীর্ঘ উ সমৃদ্ধ আকুতিটা আমাকে স্পর্শ করে যায়। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকি, বাংলা বই আমার কাছে দুর্লভ জিনিস। প্রয়োজনীয় বইটা অনেক কষ্টে জোগাড় করে লাগে আমার। এর জন্য আমার কিছু কষ্টসাধ্য উপায় আছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে ভারত মহাসাগরের নীচে ডুব দেওয়া। ঝুমুর কারণেই আমি ডুবুরির সরঞ্জাম গায়ে জড়িয়ে ডুব দেই ভারত মহাসাগরে। রাসসুন্দরীর এই মুক্তো যে ঝিনুক পেটে করে বসেছিল, তাকে পেয়ে যাই খুব দ্রুতই। কিন্তু, সমস্যা হয় উত্তোলনে। তিনি আটকে আছেন পাথরের চাতাইয়ের কঠিন চিপায়। সেখান থেকে উদ্ধার করতে ঘাম ছুটে যায় আমার। প্রায় এক ঘন্টা ধস্তা-ধস্তির পরে আয়ত্বে আসেন তিনি। ঝুমুকে পাঠিয়ে দেই বইটা আমি।
ঝুমুকে পাঠিয়ে দিলেও একটা কপি থেকে যায় আমার কাছে। কী এমন মহার্ঘ বই, যার জন্যে ঝুমু এটা খুঁজে খুঁজে হয়রান, সেটা জানতে গিয়েই কৌতুহল বশে রাত জেগে পড়ে ফেলি বইটা। আর সেই পড়ে ফেলার প্রতিক্রিয়াতেই এই লেখা। ঝুমু না চাইলে এই বই পড়া হতো না আমার, এ ই লেখাটা প্রস্তুত করা করা হতো না। সে কারণেই , এই লেখাটি অত্যন্ত আনন্দ চিত্তে উৎসর্গ করছি ঝুমুকে।
ঝুমুকে উৎসর্গ করা এটা দ্বিতীয়বার। এর আগেও আরেকটি লেখা উৎসর্গ করেছি আমি তাকে। আমার লেখা একটা গল্প, নাম ইলেক্ট্রা। তবে সেখানে তার তেমন কোনো কৃতিত্ব ছিলো না। তার দেওয়া বিপুল পরিমাণ তেলে গলে গিয়ে তার গলায় মালা পরিয়ে ছিলাম আমি তখন। এবার অবশ্য ভিন্ন। এই লেখার পুরো কৃতিত্বই তার, আর সে কারণেও উৎসর্গটাও তারই প্রাপ্য।
দুইঃ
এই লেখায় আমি খুব বড় বড় উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি। এটা ইচ্ছাকৃত, সচেতন প্রয়াস। রাসসুন্দরীর বইটা সুলভ নয়, বরং দুর্লভ। এখন খুঁজে পাওয়াটা অসম্ভবই বলা চলে। ইচ্ছা থাকলেও অনেকের পক্ষেই এটিকে যোগাড় করে পড়া সম্ভব হবে না। রাসসুন্দরীকে তাঁর লেখা দিয়েই যাতে পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন, সেই কারণেই বড় বড় উদ্ধৃতি দিয়েছি আমি।
তিনঃ
প্রচলিত অর্থে গ্রন্থ-সমালোচনা বলতে যা বোঝায়, এটি তা নয়। গ্রন্থ সমালোচনা অনেক কঠিন একটা কাজ। এর জন্য যে ধরণের জানাশোনা দরকার, পড়ালেখা করা প্রয়োজন, তা আমার নেই। এটিকে সে কারণে গ্রন্থ-সমালোনা না ধরে পাঠ প্রতিক্রিয়া বা গ্রন্থের আলোচনা হিসাবে ধরলেই বেশি খুশি হবো আমি।
চারঃ
প্রাচীন গ্রন্থের প্রতি যাঁরা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্তরের টান অনুভব করেন, তাঁরা অনেকদিন আগে আমার লেখা বিলায়েতনামাটা পড়ে দেখতে পারেন।
পাঁচঃ
রাসসুন্দরী সাহিত্যচর্চাও করতেন। কবিতা ও ভক্তিগান লিখতেন তিনি। এরকম দুটো এখানে তুলে দিলাম।
সংসারযাত্রা
রক্ষ হে পুণ্ডরীকাক্ষ রাক্ষসের রিপু।
নরসিংহরূপে বধ হিরণ্যকশিপু।।
নম প্রভু রামচন্দ্র রাজীব লোচন।
বামেতে জানকী দেবী দক্ষিণে লক্ষণ।।
দয়ার সাগর দীন দয়াময় নাম।
রঘুকুলোদ্ভব নব দুর্বাদল শ্যাম।।
না জানি ভকতি স্তুতি আমি নারী ছায়।
তব গুণ বর্ণিবার কি শক্তি আমার।।
তুমি যে দেবের দেব, দেব নারায়ণ।
তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি পঞ্চানন।।
তুমি ইন্দ্র, তুমি চন্দ্র, তুমি দিবাকর।
বাঞ্ছার বরণ তুমি, তুমি ধনেশ্বর।।
তপসীর তপ তুমি, মুনিগণের সিদ্ধি।
প্রলয় পালন তুমি, তুমি জলনিধি।।
তুমি সৃষ্টি তুমি স্থিতি তোমাতে প্রলয়।
সত্ত্ব রজঃতম গুণে তুমি বিশ্বময়।।
তোমার সৃজন প্রভু এ তিন ভূবন।
তোমা পরে রক্ষা হেতু আছে কোন জন?
থাকিতে তুমি হে নাথ ডাকিব কাহারে?
কাহারি বা সাধ্য আছে রক্ষা করিবারে?
মহিমা গভীর বীরমিহির তৎসজ্জ।
রাসসুন্দরীকেও দেও হে ঐ পদপঙ্কজ।।
গান
আজি আমি কি অপরূপ দেখেছি স্বপন।
আজি যেন গিয়াছি সেই বৃন্দাবন।।
দেখিলাম সেই কৃষ্ণ নিকুঞ্জ কাননে।
চতুর্দিকে ঘিরিয়াছে সব সখীগণে।।
ধড়া-চুড়া ব্রজের বেশ বাঁধা রয়েছে।
বনফুলের মোহনমালা গলে দুলিছে।।
নবীন নীরদ জিনি শরীরের শোভা।
কোটি পূর্ণচন্দ্র জিনি প্রভা মনোলোভা।।
মালতী মালাতে বদ্ধ চুড়া সমুজ্জ্বল।
কৌস্তভ মণিতে আলোক অরে বৃক্ষস্থল।।
প্রফুল্ল পঙ্কজ জিনি যুগল নয়ন।
চন্দন চর্চিত অঙ্গে রত্ন বিভূষণ।।
রূপেতে গন্ধর্ব দর্প করিয়াছে জয়।
ভূবন মোহন রূপ রূপেরি আলয়।।
কিসেতে তুলনা দিব নাহি সমতুল।
চরণ কমল দলে কত চাঁদের ফুল।।
ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিম রূপ বামেতে কিশোরী।
ভক্ত মনোবাঞ্ছা পূর্ণ রূপ মনোহারী।।
যুগল কিশোর রূপ হেরিয়া নয়নে।
চন্দন তুলসী পুষ্প দিতেছি চরণে।।
স্বপনে এরূপ হেরি প্রফুল্ল হৃদয়।
রাসসুন্দরীর বাঞ্ছা পূর্ণ কর দয়াময়।।
আপনার লেখা পড়ে রাসসুন্দরী দেবী সৰ্ম্পকে অনেক কিছু জানলাম আর রাসসুন্দরী দেবীর লেখাপড়া শেখার আগ্রহ দেখে অভিভূত হইলাম ।
@তারিক,
ধন্যবাদ তারেক আপনাকে। (F)
রাসসুন্দরীর আত্মজীবনীটা পড়তে চাইলে আমাকে একটা ইমেইল করেন ([email protected]). পাঠিয়ে দেবো আপনাকে।
@ফরিদ ভাই, বইটা পাঠানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। (F)
আজকে রাতেই বইটা পড়ে শেষ করবো … (H)
@তারিক,
একটা পাঠ-প্রতিক্রিয়া বা পাঠ-অনুভূতি লিখে ফেলুন এখানে, ছোট করে হলেও। (F)
@ফরিদ ভাই, আমি শুধুই পাঠক; বড় লেখা আমাকে দিয়ে সম্ভব না। তারপরও অল্প একটু বলি, বইটি পড়ে রাসসুন্দরীদেবীর জীবন ও ঐ সময়ের সামাজিক অবস্থা সৰ্ম্পকে ভাল ধারনা পাই। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন নারীদের অধিকার বলতে কিছুই ছিল না, তখন শ্রীমতী রাসসুন্দরী দেবী গোপনে পড়াশোনা করে বাঙালি সমাজে মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারে না বলে যে কুপ্র্রথা ছিল তা ভেঙেছিলেন । পঁচিশ বছর বয়সে রাসসুন্দরী দেবী হাতাখুন্তির আড়ালে লুকিয়ে রেখে বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ পুথির একটি পাতা একটু একটু করে পড়ে ফেলেছিলেন । তাঁর বিয়ে হয়েছিল বারো বছরে। সেখানেই সংসারের সব কাজ সামলে, ছেলেমেয়েদের দেখে পড়তে শেখার একান্ত চেষ্টা ছিল ব্যতিক্রমী এই গৃহবধূর। মধ্য উনিশ শতকে কলকাতায় পড়তে এসেছিলেন রাসসুন্দরী দেবীর ছেলে কিশোরীলাল। কিশোরীলালের আক্ষেপ ছিল যে, তার চিঠির উত্তর দেয় না মা। কিশোরীলাল পরে এক দিন দেশের বাড়ি গিয়ে মাকে কাগজ, কলম, দোয়াত, কালি দিয়ে এলেন । মাকে বলে এলেন, পত্রের উত্তর দিতেই হবে। রাসসুন্দরী লিখছেন,
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর আরেক ছেলে দ্বারকানাথ এর সহযোগিতায় সে সঙ্কট কেটেছিল। কিশোরীলালকে চিঠি তো বটেই, ১৮৭৬-এ একটি গোটা আত্মজীবনীই লিখে ফেলেছিলেন রাসসুন্দরী দেবী। সহজ সরল ভাষায় লেখা রাসসুন্দরী দেবীর এই বইটিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে মধ্য উনিশ শতকের সমাজে নারীদের প্র্রকৃত অবস্থা আর তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি ধাপ ও তার মনের অকৃত্তিম ভাব সাবলীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
@তারিক,
এই তো বাহ! কত সুন্দর লিখেছেন!! এরকম লিখতে লিখতেই হাত খুলে যাবে একদিন। (F)
সোমবার রাতেই লেখাটা গোগ্রাসে গিলেছি| বলা বাহুল্য যে, দারুন লেগেছে| এই ধরনের বই আজও খুবই প্রাসঙ্গিক কারণ সমাজের বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটলেও, রাসসুন্দরীর আমল থেকে আজকের সমাজের খুব বেশি আন্তরিক পরিবর্তন ঘটেনি| লেখক যেমন নিজের মায়ের ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তেমন উদাহরণ ঘরে বাইরে সর্বত্র| ভারত, বাংলাদেশই শুধু নয়, প্রবাসী ভারতীয় বা বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা বিলেত আমেরিকাতে বহু বছর ধরে সংসার পাতিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও এই মানসিকতার কোনো অভাব নেই| অনেক পরিবারেই আদপে নারীর মূল্য সেবাদাসীর থেকে কিছু বেশি নয়| আজকের আধুনিক সমাজে এই ধরনের মানসিকতা সোচ্চারে প্রকাশ না করা গেলেও, সমাজ ব্যবস্থা নিভৃতে এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে চালান করে|
যে সমস্ত ‘শিক্ষিত’, উচ্চ-মধ্যবিত্ত লোকেদের সাথে দৈনিক ওঠাবসা করি, তাদের অনেককেই সগর্বে বলতে শুনি -“বিয়ের পর বৌকে বললাম চাকরি ছেড়ে দিতে| তুমি সংসার সামলাও, আমি বাকি সব দেখে নেব| অত টাকা রোজগার করার দরকার নেই| বরং আমাদের বাচ্চা যাতে মানুষ হয় দেখতে হবে|”
আমার ঠাকুরদা অত্যন্ত প্রগতিশীল লোক ছিলেন| প্রায় তিরিশ বছর চাকরি করার পর আমার মা আগামী বছর ব্যাঙ্ক থেকে অবসর নেবে| বিয়ের পরে স্বাভাবিক ভাবেই মার উপরে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার চাপ শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছিল|অবস্থাপন্ন ঘরের গৃহবধু বাস-ট্রাম চড়ে ব্যাঙ্কের চাকরি করবে, এ কি অনাসৃষ্টি কথা বাপু! আমার ঠাকুরদার সাফ কথা ছিল, সর্বভারতীয় পরীক্ষা দিয়ে, নিজের যোগ্যতা প্রমান করে যখন চাকরি পেয়েছে, তখন তাঁর বৌমা যতদিন খুশি চাকরি করবে| কারুর সুপারিশে যে চাকরি পায়নি, সে কারুর কাছে জবাবদিহি করতে চাকরি ছাড়বেনা! আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমার ঠাকুরদা(যিনি কিনা দেশভাগের ঝড়-ঝাপটায় ইস্কুলের গন্ডি পেরোননি) বুঝতে পেরেছিলেন যে মেয়েদের লেখাপড়া বা চাকরি শুধু পয়সা রোজগার বা সন্তান প্রতিপালনের জন্যে নয়- তার একটা বৃহত্তর প্রয়োজন আছে|
চরম দুখের এবং লজ্জার বিষয়, এমন প্রগতিশীল ও উদারমনস্ক মানুষের পৌত্র হয়েও, একবার আমার বান্ধবীর সামনে আমি ইয়ার্কি মেরে বলেছিলাম, মেয়েদের পড়াশোনা করার চাপ অনেক কম| কারণ যেমন তেমন পড়াশোনা করলেও, পাত্রী যদি সুন্দরী ও অবস্থাপন্ন ঘরের হয়, সুপাত্রে পাত্রস্থ হয়ে তার একটা গতি হয়ে যাবে| ছেলেদের সেই ছাড় নেই| নিজের পায়ে না দাঁড়ালে, যতই লাল টুকটুকে দেখতে হোক না কেন, তার মেয়ে বা মান সম্মান জুটবেনা|
সুখের বিষয় তখন আমার মা উপস্থিত ছিল এবং দুইজনে মিলে যৌথ ভাবে এই মন্ত্যবের জন্যে আমাকে তিরস্কার ও ভর্ত্সনা করে| ভেবে দেখবার বিষয় আমাদের আপাত নিরীহ মন্তব্য বা ভাবনা চিন্তাগুলোর মধ্যেও, সমাজের অপ্রগতিশীল দিকটা কিভাবে সঙ্গোপনে লুকিয়ে থাকে!
@অনামী,
এই মানসিকতা থেকে মুক্তি পাওয়াটা খুব সোজা কাজ নয়। বহু নারীবাদী পুরুষকেই নারীদের পক্ষ নিয়ে গলাবাজি করতে দেখেছি আমি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দেখেছি একটু টোকা দিলে সেইসব নারীবাদী্দের শুভ্র চাদরের আড়াল থেকে তাদের পুরুষতান্ত্রিক পশু চেহারা বের হয়ে যায়।
পিঞ্জরাবদ্ধ বিহঙ্গীর হৃদয় নিংড়ানো কাহিনি মুক্তমনার মুক্ত বাতাসে নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ ফরিদ ভাই। আশ্চর্য লাগে রাসসুন্দরী দেবীর লেখাপড়া শেখার আগ্রহ দেখে। রাসসুন্দরী দেবীর জীবন থেকে বর্তমানের দিকে চোখ ফেরালে মনে হয় কত এগিয়েছি আমরা – এখন বাংলাদেশে মেয়েদের শিক্ষা মাধ্যমিক পর্যন্ত অবৈতনিক। পড়ালেখা করলে এখন উপবৃত্তিও পাওয়া যায়। অথচ সেরকম সত্যিকারের শিক্ষার্জনের আন্তরিক আগ্রহ আছে কি সবার?
@প্রদীপ দেব,
আসলেই আশ্চর্য লাগে। যে পরিস্থিতিতে তিনি পড়ালেখা শিখতে চেয়েছেন, সেই পরিস্থিতিটা কল্পনা করলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আর লেখাপড়া এমন একটা জিনিস, যা নিজে নিজে শেখা যায় না, কারো না কারো সাহায্য লাগেই। তিনিই মনে হয় বিরলতম মানুষ, যিনি পড়া শিখেছেন নিজে নিজে। একজন গ্রাম্য নারীর মধ্যে কতখানি অমিত শক্তি, স্থির সংকল্প আর তেজের আগুন থাকলে এটা সম্ভব?
পোতাজিয়া গ্রামটা আগের বা বৃহত্তর পাবনা জেলায়। বর্তমানে এটা সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলায় অবস্থিত। তবে চৌহালী ও বেলকুচি উপজেলার সীমানার কাছাকাছি। শাহজাদপুর রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি থেকে সম্ভবত পাঁচ মাইলের মধ্যে হবে। এই গ্রামটা আমার গ্রামের বাড়ি থেকে পাঁচ মাইলের মধ্যে। এখানে অনেক ঘোষ পরিবারের বাস ছিলো। এখনও সম্ভবত আছে। এখানে অনুমানটা হলো দুটো একই প্রাম।
সুযোগ পেলে রাসসুন্দরী দেবীরাও ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে। এটা প্রমাণিত সত্য।
@সুকমল মোদক,
রাসসুন্দরীর শ্বশুরবাড়ি রামদিয়া যে রাজবাড়ি জেলায়, ফরিদপুরে আর নয়, সেটা উল্লেখ করেছি আমি, কিন্তু কিন্তু তাঁর নিজের বাড়ি পোতাজিয়া গ্রামের ক্ষেত্রে এটা করতে ভুলে গিয়েছি আমি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ তথ্যটা জানানোর জন্য।
সুযোগ না পেয়েই তিনি যা করেছেন, তাতে আপনার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই।
দাদা,
এই বইটি পড়ার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তোমাকে আমার ইচ্ছের কথা বলা মাত্রই অনেক আন্তরিকতার সাথে খোঁজাখুঁজি করে, সময় ব্যয় করে, এই দুষ্প্রাপ্য অমূল্য বইটি আমার জন্য জোগাড় করে পাঠিয়ে দিয়েছ। আমি এ জন্য কৃতার্থ। প’ড়ে শেষ করেছিলাম সাথে সাথেই। রাত জেগে। ঢুলু ঢুলু চোখে। সত্যি বলতে কি, বইটি প’ড়ে আমার যতটুকু ভালো লেগেছে তার চেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তোমার লেখাটি প’ড়ে। কারণ রাসসুন্দরীর জীবনের সময়কাল, পরিস্থিতি, তাঁর অনুভূতি ও বক্তব্যগুলো তুমি অন্তর দিয়ে অনুভব করেই লেখাটি লিখেছ।
তেল কি তোমায় শুধু শুধুই দেই দাদা? এতো সুন্দর লিখো ব’লেই, তেলটুকু তোমার প্রাপ্য বলেই তো দেই।
আমার একজন প্রিয় লেখক তাঁর অত্যন্ত মূল্যবান ও যত্নের একটি লেখা আমায় উৎসর্গ করেছেন। এ জন্য আনন্দ সীমাহীন। ধন্যবাদ দেবো না। কারণ এই শব্দটি সব সময় কৃতার্থতা জ্ঞাপনের জন্য আমার কাছে যথার্থ মনে হয় না।
@তামান্না ঝুমু,
তো, এই বই পড়ার ভাবনাটাই না হয় শেয়ার করো সবার সাথে। একটা মেয়ে এই অনুভূতি ব্যক্ত করলে আরো জীবন্ত হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
ডালপুরি আর সিঙ্গারার একটা দোকান দিয়ে দেবো ভাবছি। বাজার থেকে আর তেল কিনতে হবে না আমার। 🙂
এনিওয়ে, তুমি না বললে এই বই পড়া হতো না আমার। শুধু আমার নয়, তোমার কল্যাণে অনেক মানুষই বইটা পড়ছেন এখন। গত দুদিনে আমি অসংখ্য জনের অনুরোধ পেয়েছি বইটা পাঠানোর জন্য। এর সব কৃতিত্বই তোমার। মুচো গ্রাসিয়াস।
আমার কাছে বইটার পিডিএফ কপি আছে। যাঁরা বইটা পড়ার বিষয়ে আগ্রহী, দয়া করে আমাকে একটা মেইল দিয়েন ([email protected])। আমি পাঠিয়ে দেবো বইটা।
১। ভেবেছিলাম মন্তব্য করব এই রকম: ‘ফরিদ আহমেদ আবার প্যাঁচে ফেলে জোর করে পড়িয়ে নিলো এক অদ্ভুত সুন্দর ইতিহাস’। ব্যাস।
২। ফাজলামো করতে চাইলেও রাসসুন্দরীকে নিয়ে এমন স্পর্শী লেখায় হাল্কা কোন মন্তব্য করবার সাহস হল না।
৩। মোটেও জানতাম না এমন সুন্দর এক রমনীর ইতিহাস।
৪। বেশ কয়েকবার রাসসুন্দরীর কষ্ট চেষ্টার অনুভবের গভীরতা মাপতে চেয়েছি; পারিনি। সম্ভব নয়। এমন মহিয়সীর ভাবনা মাপা যায়না।
৫। পড়তে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়েছি বারেবার।
৬। আলোচকরা বারবার হিন্দু রমনী/নারী বলা হয়েছে, বাঙালি শব্দটার অভাব বোধ করেছি। কারণ বুঝি কিন্তু থাক না’হয়। আসল কথা হোল সেকালেও এই জঘন্য নারী বিদ্বেষী মৌলবাদ এত তীব্র ছিলো তা জানতাম না।
৭। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, রাজা রামমোহন, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এদের সময় মানে জন্ম মৃত্যকাল একটু উল্লেখ করে দিলে ভালো হত মনে হয়। সেই সাথে সামান্য কিছু তথ্যসূত্র মন্দ হত না।
খেটেখুটে সহজপাঠ্য করে লিখেছে ফরিদ আহমেদ, সেজন্য অনেক শুভেচ্ছা আর ধন্যবাদ।
রাসসুন্দরীর জন্য অজস্র (F)
@কাজী রহমান,
মুক্তমনার পাঠকরা যথেষ্ট জ্ঞানী। টাইমফ্রেমটা ধরে নিতে পারবেন, এই আত্মবিশ্বাস আছে আমার।
এই লেখাটার জন্য মূল বইতো অবশ্যই রাসসুন্দরী দেবীর ‘আমার জীবন’। তবে এর বাইরে আরো তিনটি বইয়ের সাহায্য নিয়েছি আমি। এর মধ্যে দুটোই গোলাম মুরশিদের। ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ এবং ‘নারী ধর্ম ইত্যাদি’। আর তৃতীয় বইটা হচ্ছে, প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বাংলার নারী-জাগরণ’।
শুধু শুভেচ্ছা আর ধন্যবাদে খাটাখাটুনির পয়সা উসুল হয় না কবি, ফাটাফাটি একটা ডিনারে দাওয়াত দিতে হয় সপরিবারে।
@ফরিদ আহমেদ,
দিলাম দাওয়াত; তবে ঝালও কিন্তু হবে ফাটাফাটি :))
অদূর অতীতের বাঙালি কৃতি সন্তানদের নিয়ে আরো আরো আরো লেখা চাই কিন্তু। এগুলোর খুব অভাব।
@কাজী রহমান,
মাল ( (B) ) খেয়ে সারাক্ষণ টাল হয়ে থাকলে ঝালতো বেশি হবেই।
নিকট ভবিষ্যতে আরো আরো বেশি দাওয়াত পেলেই লেখা বের হবে। আজকাল নেমতন্নের খুব অভাব। 🙂
@ফরিদ আহমেদ,
গঞ্জিকা কত টেনেছিলে কাল;
ঝালের কারণ মাল!
হাটেঘাটে এই হাঁড়ি ভেঙে ভেঙে;
করছো এ কোন তাল?
কাউকে বলেছি?
বলেছি কাউকে?
কল্কি প্রেমের কথা?
হাটে হাঁড়ি ভাঙো?
বলে দেবো সব,
দেখবে ক্যামন ব্যথা।
ঝালকে বলছে মাল।
কতটা টেনেছো কাল?
নেমতন্ন ভেবেছিলো যারা,
ভাগবে পেড়ে ফাল,
কে চায় অমন টাল?
কুমির ডাকার খাল?
গঞ্জিকা
কত টেনেছিলে বলো,
একটু না হয় টেনে টেনে বল;
ঝা লে র কা র ণ মা ল! :-[
@কাজী রহমান,
ভালোই বাঁশ দিলেন দেখি। 🙁
এনিওয়ে, বাঁশ খেয়েও বলছি, এটা আপনার অন্যতম সেরা ছড়া। যেভাবে শব্দ আর ছন্দ নিয়ে মেসির মত খেললেন, সেটা তুলনাহীন।
মদ্যপানের সাথে পদ্য লেখার যে একটা অভেদ্য সম্পর্ক আছে তা অদ্য আবারো প্রতিপাদ্য হইলো।
@ফরিদ আহমেদ,
কইলো, চিপায় পইড়া কইলো,
যাক, কি আর এমন হইলো;
গান্জু পাট্টি মনের সুখে;
একটা কিছু কইলো :))
@কাজী রহমান,
ঝালের উপর মাল
মালের উপর ঝাল
মালে ঝালে
ঝালে মালে
অবস্থা যে পুরাই ঝালমাল মালঝাল টালমাটাল!
@তামান্না ঝুমু,
হ! দয়াল কাজী পুরাই বেসামাল!!
@ফরিদ আহমেদ,
হ, এল্যা হুগ্ণা থামাও তো বোলচাল
@তামান্না ঝুমু,
দাওয়াত দিয়ে একোন বিপদ
বিপদ বিপদ ক্যামন আপদ;
এবার থামার কাল,
বন্ধ সব গোলমাল।
পাঠ প্রতিক্রিয়া মূল বইটি পড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল। পাদটিকা পড়ে এ আগ্রহ আরও ঘনিভূত হল। লিংকটা বলা যায় না?
@গীতা দাস,
আপনার ইমেইলে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি বইটা দিদি।
লেখাটা পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
@ফরিদ আহমেদ,
বইটা ডাউনলোড করেছি। এই না হলে ভাই।