মিল্লাত মিয়ার অনুপম ছায়াচিত্র

দু’টো ছায়া একসাথে কেঁপে উঠলেই শরীরটা ঝাঁকি দেয় মিল্লাত মিয়ার। দু’টো শরীরের ছায়া, ঘুটঘুটে অন্ধকারে অপার রহস্য। সারা পার্কময় চষে বেড়ায় মিল্লাতের কামার্ত পদযুগল। আবছা অন্ধকারে গাছের ছায়ায় দুটো শরীরের অবয়ব দেখলেই বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে মিল্লাত মিয়া ঘুরে দাড়িয়ে এভাবেই সতেরো বছর ধরে পান করে চলছে অপেয় সুধা। পকেটে কড়ির আকাল, ঘরে শরীরের আকাল আর চির আকালময় শহরের অলিতে গলিতে আকাল। নিজের ঠেলাগাড়ীর হাতল তিন পুত্রকে ধরিয়ে দিয়ে, সন্ধেবেলা নাসির গোল্ডে কড়া ফুক দিয়ে আর পার্কে মানব মানবীর অতৃপ্ত শরীরি লড়াই দেখে অপূর্ব কেটে যাচ্ছে জীবন। ঘরে নিয়ত তৃষ্ণা জুড়াতো যে রমনী সে এখন আগারগাওয়ের বস্তির আয়নাল রিক্সাওলার কঠোর পেশী সঞ্চালনে বেশ উন্মত্ত জীবন যাপন করে চলছে। দিনমান ঠেলা ঠেলে সুপুত্রগণ বাপের পকেটে যে কড়ি ঢেলে চলছে তাতে খরা না কাটলেও নাসির গোল্ডের শুকটান মিলছে দিব্যি। আজ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, তাই কপোত কপোতির দেখা মেলা দুষ্কর। তবে যে দুয়েকটা মিলছে সেগুলো মিল্লাত মিয়ার বুকে একেবারে মেঘনার ঢল বয়ে দিচ্ছে । ছাতার তলে সংসার পেতে যেন প্রকৃতি মাতার কোল এখনি নতুন বংশধর তুলে দেবে তারা। হঠাত ঘন নি:শ্বাসের শব্দে মিল্লাত মিয়ার ক্ষুধার্ত বাঘ নেড়েচেড়ে ওঠে। ঝোপের আড়ালে এক মায়াহরিনী যেন ক্লান্তির শ্বাস টানছে। বিজ্ঞ শিকারীর মত ওত পাতে মিল্লাত মিয়া। খচখচ খচখচ। যুগল ছায়া ছটফট করছে বড়। মিল্লাত মিয়া গলা খামচে ধরে নিজস্ব তীব্র দানবটার। ইচ্ছে করছে পুরুষ ছায়াটাকে রক্তাক্ত করে রমনী ছায়াটার অন্দরে অনুপ্রবেশিত হয়ে টান টান শ্বাসের আগুনে নাসির গোল্ড ধরাতে। ছায়ারা ঘেমে ওঠে, ঘেমে ওঠে মিল্লাত মিয়া।
পরে ঝকঝকে দিনের শেষে সন্ধ্যা নামে। একজন লাল টাই পরা ভদ্রলোক আসে ছায়ার মত। মিল্লাত মিয়ার দৃষ্টিতে দৃষ্টি পাতে লোকটা। চোখ চকচক করে তার। মিল্লাত মিয়া ঘাড় নেড়ে জানায়, পাইবেন না, ভিজা দিনে হুকনা পাইবেন না স্যার। ভদ্রলোক আহত হয়। মিল্লাত মিয়া জিগায়, স্যার, ব্ল্যাক লেবেলে ঘুম আসেনা? ভদ্রলোক না জানায়। মিল্লাত ভেংচি কাটে, কালা চিকচিকা ট্যাকার বালিশে ঘুম আসেনা স্যার? ভদ্রলোক না জানায়। মিল্লাত মিয়া লোকের কাধে হাত রেখে বলে, আসেন, আফনেরে ভিজা আন্দারে হুকনার মজা লওয়াই। ধোঁয়া ছাড়াই ধোঁয়ার মজা স্যার। তারপর দুজন কাধে কাধ মিলিয়ে যুগল ছায়ায় অনুপম চলচ্চিত্রে ধোঁয়ার সাধ মেটায়।
পরের রাতে ভদ্রলোকের মুখে শুনে কোতোয়াল আসে, পরের রাতে সিপাহসালার, তার পরের রাতে উজির, অত:পর মন্ত্রী আর শেষে স্বয়ং সম্রাট আসেন মিল্লাত মিয়ার অনুপম ছায়াছবি উপভোগে। সেদিন থেকে রাজারা রাতভর মিল্লাত মিয়ার অনুপম ছায়াচিত্রের উন্মাদ দৃশ্যকল্পে বৃষ্টি নামায় আর দিনভর ঘুমায় ফটক এটে। মিল্লাত মিয়ার পকেটে কড়ি আসে, কুড়েঘরে পরী আসে, শহরের অলিগলি ভরে ওঠে পান, নৃত্য, সংগীতে। তিনপুত্র ঠেলা ছেড়ে ইস্কুলের স্লেটে চকের স্তম্ভে বর্ণমালা ঠেলে। দুটো ছায়া কেঁপে ওঠে পার্কে, কেঁপে ওঠে মানুষের সমৃদ্ধি!








উল্টো হাওয়া

লাল আর হলুদের বুকের মধ্যে সবুজ ঝালর দেয়া চিলের মত ঘুড়িটা। ডানা আছে, লেজ আছে।স্থির ডানা দুটি মেলে, লেজ নাড়িয়ে মেঘ ছু’তে চায়।পেট ফুটো করে বেরিয়ে আসা সুতোটার ওমাথায় অস্থির দুটি চোখ চকচক করে। এই বুঝি আকাশ ছোঁয়, এই বুঝি মেঘ ধরে।নাটাই ঘুরে, সুতো বাড়ে।চিলটা বাতাস কেঁটে আকাশ ফুঁড়ার স্পর্ধা নিয়ে উচ্চতা বাড়ায়। চোখ দু’টোর উজ্জলতা বাড়ে। ছেলেটার হাতে ঘুরন্ত নাটাইয়ে তীব্র উচ্ছাস।ইস্, চিল থেমে যায়, গতি নয় উচ্চতার বৃদ্ধিতে।নাটাই ঘুরেনা আর। পেট ফুঁড়ানো সুতোটা টেনে ধরে উড়াল স্পর্ধাকে।খন্ডিত মেঘেদের আমোদে উড়াল তখন ছেলেটার চোখে বিদ্রুপ ঠেকে।আকাশ যেন মুখ ভেংচিয়ে জানান দেয়, আমি আকাশ হে, আমাকে ছোঁয়া আত সোজা!তখন চোখের উজ্জলতা কমে, নেমে আসে পুলক। উড়ন্ত চিলে-ঘুড়ি তখন সে চোখে প্রতিচ্ছবি ফেলে, ডানা মেলে লেজ নেড়ে বাতাস কেটে চলে।

বেলা বাড়ে।ধু ধু মাঠে ঘুড়ির ছায়া ঘোলা হয়ে আসে।আর সব পাখির মত চিলে-ঘুড়িরও নীড়ে ফেরার তাড়া হয়।এ পাখির নীড় দূর বনে নয়, ছেলেটার মাটির ঘরের নিঝঝুম আদরে। ও ছেলেটার সাথে মানুষের নীড়ে ফিরবে।হাতে নাটাই ঘুরে; এবার উল্টা দিকে।নীড়ের টানে নেমে আসে চিল।আকাশ ফছড়ে, খন্ড মেঘেদের মায়া ছেড়ে, একেবারে আলতো হাতের মুঠোয়।শেষে দিনের চিহ্ন মুছে যায়।

অস্থির রোদের ঝলকানিতে দিনজুড়ে মনটা উড়াল মারে যেন ছেলেটার।কখন বিকেল, কখন খন্ড মেঘ আর চিলের স্পর্ধার উড়াল। পরের বিকেলটা যেন একটু দেরিতে নামে। নাটাইয়ের ভার বেড়েছে,মেঘ আজ ধরাই চাই, আকাশ আজ ছোঁয়াই চাই।আকাশের অমন বিদ্রুপের জবাব ঠিক দেয়া চাই।আবার নাটাই ঘুড়ে, আবার ডানায় বাতাস কাটে, আবার লেজে নৃত্য উঠে। শো, শো,শেঅ,শো……….।নাহ্, নাটাই থেমে যায়। মেঘ বড় ছিনালী, আকাশ বড় প্রবঞ্চক।ছেলেটার অভিমান উছলে পড়ে ওদের উপর। একটু ধরা দিলে কি হয়?

অধরা মেঘ, আকাশ, না দিক ধরা।তবু তো নীলের পটে, টুকরো টুকরো মেঘেদের পটে ছেলেটাতে সুখ আনে, প্রাণের সুখ। উড়ুক, চিল উড়ুক; ওর কাগুজে চিল।

তখন বিকেলের রঙে ফিঁকে আলোর আভা।নীল পটে তুলো মেঘ অভিমানে কালচে হয়ে গেছে। থমকে যাওয়া আকাশের বুকে চিল তবু নিশ্চিত ভ্রমনে কাগুজে খেঁচর। ডানায় কেটে যাওয়া হাওয়ায় বাষ্পের ভার। উপলব্দি হল যখন তখন পেটে টান পড়লো বেশ। ও মাথায় আলতো হাতের রগগুলো জেগে ওঠল। চিল তুমি নেমে আস, মাটির নীড়ে ফিরি। চিলের ডানায় তখন নীড়ে ফেরার আকুলতা।বৈরী হাওয়া আচমকা পেটে খামচি দিয়ে কেঁড়ে নেয় মাটির বন্ধন। ছেলেটার হাতের রগগুলো মিলিয়ে যায়।দিগবিদিক ঠাওর নেই। চিল ছুটে পশ্চিমে যেখানে হাওয়ার লুন্ঠন সরণী।অবরুদ্ধ ডানায় তখন হাওয়ার দখল। ছেলেটার পা দুটো পশ্চিমে ছুটে।পঙ্খিরাজ নেই এ রাজপুত্তুরের যে রক্ষা করে লুনণ্ঠত রাজকুমারীকে। তবু পা ছুটে হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে।অঁকাবাঁকা খালের ধারটায় এসে থমকে দাঁড়ায় পা দুটো।ডাকু হাওয়া থামেনা।চিল ঘুড়ি পশ্চিমের দিগন্তে ছুটে।তারপর বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়।

অবোধ চোখের চিকচিকে জলে তখন বিকেলের ছায়া। স্থির নাটাইয়ে ঘূর্ণন নেই। কোলাহল থেমে গেছে, থেমে যায়।

বাঁ দিকটায় সিঁথি করা তেল চিটচিটে চলের ভাঁজ ভাঙে একটি পরিপক্ক হাত।পরিণত বাহুডোরে আবদ্ধ করে বয়েসী কণ্ঠে বলে উঠে, ‘ও ঘুড়ি আবার ফিরে আসবে’। ছেলেটা চোখ মুছে প্রশ্নাকূল চোখে তাকায় প্রবীনের দিকে। আবারও কণ্ঠ বাজে, ‘যখন আবার এ হাওয়া পশ্চিম থেকে পূবে ছুটবে, তখন তোমার চিল ঘুড়ি ঠিক ফিরে আসবে।’

নিথর নিভু বিকেলের খালপাড়ে ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে। কখন উল্টো হাওয়া বয়।






লেখকঃ প্লাবন ইমদাদ
প্রকাশিত গ্রন্থঃ শাখের করাত(রম্য)