মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি
(শূন্য থেকে মহাবিশ্ব বইয়ের একটি সম্ভাব্য অধ্যায়)
‘এই মহাবিশ্বটা পরমাণু দিয়ে তৈরি নয়, গল্প দিয়ে তৈরি’। উক্তিটি প্রয়াত কবি এবং রাজনৈতিক কর্মী মুরিয়েল রুকেসারের। রুকেসার উক্তিটি কী ভেবে করেছিলেন, তা এখন আর আমার মনে নেই, কিন্তু আজ এই অধ্যায়টা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে তিনি হয়তো ভুল বলেননি। আমরা ছোটবেলায় পদার্থবিজ্ঞানের বই খুললে দেখতাম, আমাদের চেনা জানা বস্তু জগত অণু পরমাণু দিয়ে তৈরি। কিন্তু আজকের দিনের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মহাবিশ্বের একটা বড় অংশ, সত্য বলতে কি – মহাবিশ্বের প্রায় পুরোটাই – আমাদের চেনা জানা কোন পদার্থের অণু পরমাণু নয়, বরং অজ্ঞাত পদার্থ আর অজ্ঞাত শক্তিতে পরিপূর্ণ। আর বিজ্ঞানীদের এই নতুন আবিস্কারগুলো জন্ম দিয়েছে নানা আকর্ষণীয় সব গল্প কাহিনির। সেই কাহিনির একটা বড় অংশ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতিকে ঘিরে। আজকে আমরা সেই কাহিনিগুলোই শুনব।
এক সময়কার ডাকসাইটে আইনবিদ থেকে পরবর্তীতে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদে পরিণত হওয়া এডুইন হাবলের ১৯২৯ সালের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পর থেকেই বিজ্ঞানীরা জানেন যে এই মহাবিশ্ব আসলে প্রতি মুহূর্তেই প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এই মহাবিশ্ব কি ক্রমাগত এমনিভাবে প্রসারিত হতে থাকবে? নাকি মহাকর্ষের টান একসময় গ্যালাক্সিগুলির মধ্যকার প্রসারণের গতিকে মন্থর করে দেবে – যার ফলে এই প্রসারণ থেমে গিয়ে একদিন শুরু হবে সঙ্কোচন? এই প্রশ্নের উপরই কিন্তু আমাদের এই মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নির্ভর করছে। প্রসারণ চলতেই থাকবে নাকি একসময় তা থেমে যাবে – এই ব্যাপারটি যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির উপর নির্ভর করছে তা হল মহাবিশ্বের ‘ক্রান্তি ঘনত্ব’ (critical density); একে ‘সন্ধি-ঘনত্ব’ও বলতে পারি। এই সন্ধি বা ক্রান্তি ঘনত্বের বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা যাক।
ধরা যাক, ভূপৃষ্ঠ থেকে একটি টেনিস বল মহাশূন্যে ছোঁড়া হল। এর পরিণতি কি হতে পারে? এক্ষেত্রে সম্ভাবনা দুটি। যদি ইনক্রিডিবল হাল্ক কিংবা বাঁটুল দি গ্রেটের মত কেউ বলটা ছোঁড়েন, আর বলের বেগ যদি কোনভাবে পৃথিবীর নিষ্ক্রমণ বা মুক্তি বেগেকে (escape velocity) ছাড়িয়ে যেতে পারে, তবে বলটা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। বলটার গতিপথ হবে অনেকটা পাশের নীচের প্রথম ছবির মত উন্মুক্ত ও সীমাহীন (unbounded) হবে। আর আমার মত কমজোরি কেউ যদি বলটা ছোঁড়েন, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় যে বলটার বেগ নিষ্ক্রমণ বেগের চেয়ে অনেক কম হবে। সেক্ষেত্রে বলটা উপরে উঠতে উঠতে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে মাধ্যাকর্ষণের টানে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এবারে কিন্তু প্রক্ষেপণ-পথটি আগের বারের মত উন্মুক্ত হবে না; বরং হবে বদ্ধ বা সংবৃত (bounded)।
চিত্র: একটি প্রাসের দু রকমের গতিপথ। (ক) পৃথিবীর অভিকর্ষের মায়া কাটিয়ে বলটা উন্মুক্ত পথে ছুটছে। (খ) বলটা কিছুদূর উঠে আবার পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসছে।
মহাবিশ্বের অবস্থাও আমাদের উদাহরণের ওই বলের মতন। এর কাছেও এখন দুটি পথ খোলা। এক হচ্ছে পালোয়ান হাল্ক বা বাঁটুলের ছুঁড়ে দেয়া বলের মতন সারা জীবন ধরে এমনিভাবে প্রসারিত হতে থাকা; এ ধরণের মহাবিশ্বের মডেলকে বলা হয় উন্মুক্ত বা সীমাহীন মহাবিশ্ব (unbounded universe or Open Universe)। অথবা আরেকটি সম্ভাবনা হল- মহাবিশ্বের প্রসারণ একসময় থেমে গিয়ে সঙ্কোচনে রূপ নেওয়া – এ ধরণের মহাবিশ্বকে বলে সংবৃত বা বদ্ধ মহাবিশ্ব (bounded universe or Closed Universe)।
এই ব্যাপারগুলো আজকের দিনে খুব সাধারণ মনে হয়। কিন্তু একটা সময় বিজ্ঞানীদের এগুলো গণনা করে বের করতে গিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে মহাবিশ্বের পরিণতির ব্যাপারটা গণনা করা যায়? আমরা আগে ফ্রিডম্যানের যে মডেলের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম (পরে দেখা গিয়েছিল ডি সিটার এবং আইনস্টাইনের সমাধানগুলো আসলে ফ্রিডম্যানের মডেলেরই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার সমাধান), সেখান থেকেই মহাবিশ্বের পরিণতির চলকগুলো সম্বন্ধে পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কি মহাবিশ্বের পরিণতির উপর প্রভাব বিস্তার করা গুরুত্বপূর্ণ চলক আছে সর্বসাকুল্যে তিনটি[1] –
ক. হাবলের ধ্রুবক (H): এ থেকে আমরা মহাবিশ্বের প্রসারণের হার সম্বন্ধে জানতে পারি।
খ. ওমেগা (Ω):এ থেকে আমরা মহাবিশ্বের পদার্থের গড় ঘনত্ব সম্বন্ধে ধারণা পাই।
গ. ল্যামডা (Λ): এটা শূন্যতার মধ্যে থাকা বিকর্ষণ শক্তি (কিংবা যা মহাবিশ্বকে ত্বরমাণ করে তুলছে।
বহু বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ তাদের জীবনের পুরো সময়টাই কাটিয়ে দেন তিনটি চলকের নিখুঁত মান এবং এদের মধ্যে সম্পর্ক বের করতে। এ ব্যাপারটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলোর সঠিক মান জানা না থাকলে আমরা পরিণতি সম্বন্ধে সঠিক অভিমত হাজির করতে পারব না। এ নিয়ে প্রাথমিক কাজের জন্য আমরা যার কাছে ঋণী তিনি ছিলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম। তিনি ১৯৭৭ সালের দিকে প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত গবেষণা প্রবন্ধ ‘Possible Ultimate Fate of the Universe’। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় বিলেতের রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির বিখ্যাত জার্নালে[2]। একই বিষয়ে তার আরেকটি বিখ্যাত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল বছর দুয়েক পরে ভিস্তাস ইন অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে[3]। তার প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হবার পর সেগুলো অনেক বিদগ্ধজনেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে । জ্যোতির্বিদ্যার বিখ্যাত সাময়িকী স্কাই এন্ড টেলিস্কোপ ম্যাগাজিন থেকে অনুরোধ করা হয় অধ্যাপক ইসলাম যেন তার গবেষণা প্রবন্ধটির একটা ‘জনপ্রিয় ভাষ্য’ তৈরি করেন। তাদের অনুরোধে জামাল নজরুল ইসলাম একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ (The Ultimate Fate of the Universe) নামে, যেটা ম্যাগাজিনটিতে প্রকাশিত হয়েছিল সত্তরের দশকের একদম শেষ দিকে[4]। তাঁর কাজ আরেক প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল সে সময়। তিনি ফ্রিম্যান ডাইসন। ডাইসন একটি গুরুত্বপূর্ণ পেপার প্রকাশ করেন ‘সীমাহীন সময়: পদার্থবিদ্যা এবং জীববিদ্যা উন্মুক্ত মহাবিশ্বে’ শিরোনামে[5]। পেপারটিতে একটা বড় অংশ জুড়ে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের কাজের উল্লেখ ছিল। ফ্রিম্যান ডাইসন কেবল তার পেপারে অধ্যাপক জামাল নজরুলের রেফারেন্স দিয়েই ক্ষান্ত হননি, পরবর্তীতে অধ্যাপক ইসলামকে এ বিষয়টি নিয়ে একটি জনপ্রিয় ধারার বই লিখতেও উৎসাহিত করেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ (The Ultimate Fate of the Universe)। অধ্যাপক ইসলামের বইটি যখন বেরোয় তখন মূলধারার জ্যোতির্পদার্থবিদদের লেখা বই বাজারে দুর্লভ। স্টিফেন হকিং, পল ডেভিস, শন ক্যারল, ব্রায়ান গ্রিনরা তখনো জনপ্রিয় ধারার বই লেখায় হাত দেননি। মহাবিশ্বের রহস্য নিয়ে সবে ধন নীলমণি ছিল স্টিভেন ওয়েনবার্গের লেখা ‘প্রথম তিন মিনিট’[6]। তবে সেটা মহাবিশ্বের শুরুর দিককার রহস্য নিয়ে। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের লেখা বই বাজারে ছিলই না বলা যায়। সেই অভাব প্রথমবারের মত পূর্ণ করেছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম তার এই গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের মাধ্যমে। বইটির তথ্য, বিষয়বস্তু, জনবোধ্যতা এবং সাবলীলতার প্রেক্ষিতে বইটি সাথে সাথেই পাঠকসমাজে দারুণভাবে সমাদৃত হয়, এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফরাসি,ইতালীয়, জার্মান,পর্তুগিজ,সার্ব,ক্রোয়েট সহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে যায় বইটি। বলা বাহুল্য, তাঁর এ বইটি কেবল সাধারণ মানুষদেরই আকৃষ্ট করেনি, ভাবনার খোরাক যুগিয়েছিল বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদেরও। তার বইয়ের পাণ্ডুলিপি পড়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছিলেন স্টিফেন হকিং, জয়ন্ত নারলিকার, সায়মন মিটন, জি সি টেলর এবং মার্টিন রীসের মত লব্ধ প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরা। তাদের অবদানের কথা অধ্যাপক ইসলাম তার বইয়ের ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছেন। আর বইটির পেছনে মূল অনুপ্রেরণা দাতা হিসেবে বিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের উল্লেখ তো ছিলই।
বস্তুত অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম এবং ফ্রিম্যান ডাইসনের প্রথমদিককার কাজগুলোই যে পরবর্তী বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্বের পরিণতি নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করার খোরাক যুগিয়েছিল তার উল্লেখ পাওয়া যায় সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনের ১৯৯৯ সালের নভেম্বর সংখ্যায়। ‘মহাবিশ্বে জীবনের পরিণতি’ শীর্ষক এই রচনায় বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস এবং গ্লেন স্টার্কম্যান বলেন[7],
‘বিগত শতকের সময়গুলোতে বিজ্ঞানীদের দার্শনিক অভিব্যক্তি আশাবাদ আর নৈরাশ্যবাদের দোলাচলে দুলছিল। ডারউইনের আত্মবিশ্বাসী ভবিষ্যদ্বাণীর খুব বেশিদিন পরে নয় – ভিক্টোরিয়ান যুগের বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের ‘তাপীয় মৃত্যু’ (heat death) নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করেছিলেন – যখন তারা বুঝতে শুরু করেছিলেন যে সমগ্র মহাবিশ্ব একটা সময় সাধারণ তাপমাত্রায় এসে পৌঁছুবে, যার পর কোনকিছুরই আর পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু বিশের দশকে মহাবিশ্বের প্রসারণের ব্যাপারটা আবিষ্কৃত হবার পর থেকে বিজ্ঞানীদের উদ্বিগ্নতা একটু কমে আসে কারণ মহাবিশ্বের প্রসারণ সেই সাম্যাবস্থায় পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে। সে সময় খুব কম সংখ্যক জ্যোতির্বিজ্ঞানীই প্রসারণশীল মহাবিশ্বে প্রাণের অন্যান্য ধারা নিয়ে চিন্তা করছিলেন, যতদিন পর্যন্ত না পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসনের ১৯৭৯ সালে লেখা ক্লাসিক পেপারটা [‘সীমাহীন সময়: পদার্থবিদ্যা এবং জীববিদ্যা উন্মুক্ত মহাবিশ্বে’] প্রকাশিত হয়েছিল। ফ্রিম্যান ডাইসনের কাজ আবার প্রভাবিত হয়েছিল তার পূর্ববর্তী জামাল ইসলামের কাজ দিয়ে যিনি এখন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন।’
লরেন্স ক্রাউস এবং গ্লেন স্টার্কম্যান যখন নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকার জন্য উপরের প্রবন্ধটি লিখেছিলেন, তখন জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন বটে, তবে আজ আমরা জানি, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন এ বছরের (২০১৩) ১৬ই মার্চ। কিন্তু মারা গেলেও তিনি তার উত্তরসূরিদের জন্য রেখে গেছেন বিশাল মণিমাণিক্য, যার ঠিকানা পাওয়া যায় সমসাময়িক অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কাজে। যেমন, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে প্রকাশিত হয় আরেক প্রতিভাধর বিজ্ঞানী পল ডেভিসের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘শেষ তিন মিনিট’[8]। ওয়েনবার্গের পূর্ববর্তী ক্লাসিক ‘প্রথম তিন মিনিট’ এর শিরোনামের আদলে লেখা এ গ্রন্থে জামাল নজরুল ইসলামের কাজের উল্লেখ রয়েছে। পল ডেভিসের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক গ্রন্থেও অধ্যাপক ইসলামের কাজের উল্লেখ পাওয়া যায়[9]।
মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নির্ভর করছে মহাবিশ্বের প্রকৃতি কি রকমের তার উপর। মহাবিশ্ব বদ্ধ হলে এর পরিণতি হবে এক রকমের, আর উন্মুক্ত হলে সেটা হবে আরেক রকমের। জামাল নজরুল ইসলাম তার গবেষণাপত্র এবং বইয়ে বিস্তৃতভাবে নানা দিক থেকে আলোচনা করেছেন আমাদের এই মহাবিশ্ব ‘বদ্ধ’ নাকি ‘উন্মুক্ত’। তার বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনামই ছিল – ‘মহাবিশ্ব কি উন্মুক্ত নাকি বদ্ধ?’ তিনি এই অধ্যায়ে উন্মুক্ত এবং বদ্ধ মহাবিশ্বের মডেলের যে রেখচিত্র উপস্থাপন করেন তা এরকমের:
চিত্র: অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ বইয়ে ব্যবহৃত বদ্ধ এবং উন্মুক্ত মহাবিশ্বের রেখচিত্র।
আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা অবশ্য এ দুই সম্ভাবনার মাঝামাঝি আরেকটি সম্ভাবনাকেও হাতে রেখেছেন। এর নাম দেওয়া যাক- ‘বদ্ধ-প্রায় মহাবিশ্ব’ (marginally bounded universe)। চলতি কথায় একে সামতলিক মহাবিশ্ব বা ‘ফ্ল্যাট ইউনিভার্স’ নামেও অভিহিত করা হয়। স্ফীতি তত্ত্ব থেকে পাওয়া আধুনিক অনুসিদ্ধান্তগুলো এই সমতল মহাবিশ্বকে সমর্থন করে বলে পদার্থবিদদের বড় একটা অংশই এখন এই মহাবিশ্বের উপরই আস্থাশীল হয়ে উঠছেন। এই সমতল ধরণের মহাবিশ্ব সবসময়ই প্রসারিত হতে থাকবে ঠিকই, কিন্তু এক্কেবারে দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে- অনেকটা পাশ-নম্বর পেয়ে কোন রকমে পাশ করে যেতে থাকা ছাত্রদের মতন। আমাদের বলের উদাহরণে ঠিক নিষ্ক্রমণ বেগের সমান (এর বেশীও নয়, কমও নয়) বেগ দিয়ে বলটিকে উৎক্ষেপণ করলে যে রকম অবস্থা হত, অনেকটা সেরকম। মহাবিশ্বের পরিণতির এই তিন ধরণের সম্ভাবনাকে নীচের ছবিতে দেখানো হয়েছে।
চিত্র: মহাবিশ্বের পরিণতির সম্ভাবনা : বদ্ধ মহাবিশ্ব, উন্মুক্ত মহাবিশ্ব এবং সামতলিক মহাবিশ্ব।
জামাল নজরুল ইসলাম তার বইয়ে সমতল মহাবিশ্বের জন্য কোন আলাদা রেখা বরাদ্দ না করলেও তিনি জানতেন সমতল মহাবিশ্বের প্রকৃতি কিরকম হতে পারে। আমরা এই বইয়ের আগের অধ্যায় থেকে জেনেছি যে, সামতলিক মহাবিশ্বের প্রকৃতি হয় ইউক্লেডিয়ান। সামতলিক জ্যামিতির মহাবিশ্বে দুটি সমান্তরাল রেখা সবসময় সমান্তরাল ভাবেই চলতে থাকে। আর সেখানে ত্রিভুজের তিন কোনের সমষ্টি হয় ঠিক ১৮০ ডিগ্রি। বদ্ধ মহাবিশ্বে আবার ত্রিভুজের তিন কোনের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রিকে ছাড়িয়ে যায়, আর সমান্তরাল আলোর রেখা পরস্পরকে ছেদ করে। আবার উন্মুক্ত কিংবা পরাবৃত্তাকার (hyperbolic) মহাবিশ্বে ত্রিভুজের তিন কোনের সমষ্টি হয় ১৮০ ডিগ্রির চেয়ে কম। সেখানে সমান্তরাল আলোর রেখাগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়। জামাল নজরুল ইসলাম একই ব্যাপার আমাদের জন্য ব্যাখ্যা করেছেন, তবে ত্রিভুজের বদলে বৃত্ত দিয়ে। সমতল মহাবিশ্বে বৃত্তের ক্ষেত্রফল হয় $latex A=\pi r^2 $, এবং পরিধি $latex C=2\pi r $। কিন্তু উন্মুক্ত পরাবৃত্তাকার মহাবিশ্বে বৃত্তের ক্ষেত্রফল এর চেয়ে বড় হবে আর পরিধি মাপলে পাওয়া যাবে এর চেয়ে বেশি। আর বদ্ধ মহাবিশ্বে এই দুটো মান সবসময়ই কম পাওয়া যাবে। অধ্যাপক ইসলাম ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে –
চিত্র: অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম তার ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ বইয়ে মহাবিশ্বের জ্যামিতি বুঝিয়েছেন বৃত্তের ক্ষেত্রফল এবং পরিধির সাহায্যে।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে কোন্ ধরণের পরিণতি ঘটতে যাচ্ছে তা বোঝা যাবে কি ভাবে? এই অধ্যায়ের শুরুতে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটারের উল্লেখ করেছিলাম তার মধ্যে একটি হল ওমেগা (Ω), যা থেকে আমরা মহাবিশ্বের পদার্থের ঘনত্ব সম্বন্ধে ধারণা পাই। মহাবিশ্বের ঘনত্ব বলতে সমগ্র মহাবিশ্ব যে জড়পদার্থ দিয়ে তৈরি তার ঘনত্বের কথাই বলছি। পদার্থের পরিমাণ যত বেশী হবে মহাবিশ্বও তত ঘন হবে, আর সেই সাথে বাড়বে প্রসারণকে থামিয়ে দেওয়ার মত মহাকর্ষের শক্তিশালী টান। জিনিসটি বুঝতে আবার আমাদের আগেকার বলের উদাহরণে ফেরত যেতে হবে। বলের ওজন যত বেশী হবে মাধ্যাকর্ষণ পেরিয়ে নিষ্ক্রমণ বেগ অর্জন করতে তাকে তত বেশী কষ্ট করতে হবে। সেজন্যই টেনিস বলের বদলে শট পুটের বলকে একই উচ্চতায় তুলতে আমাদের গলদঘর্ম হয়ে যেতে হয়। ঠিক তেমনি ভাবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্ব উচ্চ ঘনত্ব বিশিষ্ট হলে প্রসারণকে থামিয়ে দিয়ে সঙ্কোচনের দিকে ঠেলে দেওয়ার মত যথেষ্ট পদার্থ এতে থাকবে -ফলে মহাবিশ্ব হবে বদ্ধ (closed)। আর কম ঘনত্ব বিশিষ্ট মহাবিশ্ব সঙ্গত কারণেই হবে মুক্ত (Open)- যা প্রসারিত হতে থাকবে অনন্ত কাল ধরে। তাহলে এর মাঝামাঝি এমন একটা ঘনত্ব নিশ্চয়ই আছে যার উপরে গেলে মহাবিশ্ব একসময় আর প্রসারিত হবে না। সন্ধি বা ক্রান্তি ঘনত্ব (critical density) হচ্ছে সেই ঘনত্ব যার চেয়ে বেশি হলেই মহাবিশ্বের প্রসারণ থেমে গিয়ে তৈরি করবে সংকোচনের ক্ষেত্র। বিজ্ঞানীদের ধারণা এর মান প্রতি কিউবিক সেন্টিমিটারে ৪.৫ x ১০-৩০ গ্রাম থেকে ১৮ x ১০-২৯ গ্রামের মধ্যে বিচরণ করছে[10]। মহাবিশ্বের প্রকৃত ঘনত্ব (actual density) আর ক্রান্তি ঘনত্বের (critical density) অনুপাতটিই হচ্ছে সেই ওমেগা (Ω), যাকে বিজ্ঞানীরা খুব গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করেন। এই ওমেগার মান ১ এর কম (Ω < ১) হলে মহাবিশ্ব হবে উন্মুক্ত। আর ওমেগার মান ১ এর বেশী (Ω > ১)হলে মহাবিশ্ব হবে বদ্ধ বা সংবৃত। আর ওমেগার মান পুরোপুরি ১ (Ω = ১) হলে সেটা হবে সামতলিক মহাবিশ্ব। এখানে প্রসারণের হার ধীরে ধীরে কমে যেতে যেতেও টায়ে টায়ে প্রসারিত হতে থাকবে শেষ পর্যন্ত, অনেকটা সেই কোন রকমে পাস মার্ক পেয়ে পাস করে যাওয়া ছাত্রের মতোই। কাজেই ১ হল ওমেগার সীমান্তিক মান।
সম্ভাবনাগুলোর কথা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু মহাবিশ্বের আসল ঘনত্ব না জানলে তো হলফ করে বলা যাচ্ছে না ভবিষ্যতে আমাদের মহাবিশ্বের জন্য আসলে ঠিক কী অপেক্ষা করছে! তাহলে তো মহাবিশ্বের প্রকৃত ঘনত্ব জানতেই হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ঘনত্ব বের করার উপায় কি? একটা উপায় হল মহাশূন্যের সকল দৃশ্যমান গ্যালাক্সির ভর যোগ করে তাকে পর্যবেক্ষিত স্থানের আয়তন দিয়ে ভাগ করা। মহাবিশ্বের একটা গড় ঘনত্ব এভাবে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মুশকিল হল, এভাবে হিসেব করে ঘনত্বের যে মান পাওয়া গেছে তা খুব কম; সন্ধি ঘনত্বের শতকরা ১ ভাগ মাত্র। এর বাইরে গ্যাস ট্যাস মিলিয়ে অন্যান্য চেনা জানা পদার্থ গোনায় নিয়ে হিসেব করেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সেটা শকরা ৪ ভাগের বেশি হয় না। অর্থাৎ আমাদের দৃশ্যমান যে জগত আমরা দেখি সেটা মহাবিশ্বের সামগ্রিক ভরের মাত্র ৪ ভাগ। তার মানে ঠিক কি দাঁড়ালো? দাঁড়ালো এই যে এই মান সঠিক হলে ওমেগার মান দাড়ায় ১ এর অনেক অনেক কম। তাহলে আমাদের সামনে চলে আসলো সেই উন্মুক্ত বা অনন্ত মহাবিশ্বের মডেল। তার মানে কি এই যে, মহাশূন্য কেবল প্রসারিত হতেই থাকবে?
না, তা নিশ্চিতভাবে এখনই বলা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা এত সহজ নয়। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ পেয়েছেন যে, আমাদের দৃশ্যমান পদার্থের বাইরেও মহাশূন্যে এক ধরণের রহস্যময় জড় পদার্থ রয়েছে যাকে বলা হয় গুপ্ত পদার্থ (Dark Matter)। এই অদৃশ্য জড়ের অস্তিত্ব শুধুমাত্র গ্যালাক্সির মধ্যে মহাকর্ষের প্রভাব থেকেই জানা গিয়েছে, কোন প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে নয়। বিজ্ঞানের জগতে এমন অনেক কিছুই আছে যা প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গৃহীত হয় নি, হয়েছে পরবর্তীকালে পরোক্ষ প্রমাণ, অনুসিদ্ধান্ত কিংবা ফলাফল থেকে। তবে তাই বলে সেগুলি বিজ্ঞান-বিরোধীও নয়। যেমন, মহাবিস্ফোরণ বা বিগ-ব্যাং এর ধারণা। কেউ চোখের সামনে এটি ঘটতে দেখেনি। কিন্তু মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণ বা কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনসহ অন্যান্য অসংখ্য পরোক্ষ প্রমাণ কিন্তু ঠিকই মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বকে বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনি আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে বিবর্তনবাদ – যার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব হলেও অসংখ্য পরোক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতেই বিভিন্ন ধরণের বিশ্বাস-নির্ভর সৃষ্টিতত্ত্বকে হটিয়ে তা বিজ্ঞানের জগতে জায়গা করে নিয়েছে।
আবার আমরা অন্ধকারময় গুপ্ত পদার্থের জগতে ফিরে যাই। কি ভাবে জানা গিয়েছিল এই অদৃশ্য জড়ের অস্তিত্ব? এই বিষয়ে কথা বলতে হলে ভেরা রুবিনের প্রসঙ্গ টানতে হবে। যদিও সেই ত্রিশের দশকেই ক্যালটেকের প্রতিভাবান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিৎস জুইস্কির প্রাথমিক কিছু কাজ থেকে ডার্ক ম্যাটারের আলামত বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু রুবিনই সর্বপ্রথম আমাদের ছায়াপথ আর অন্যান্য সর্পিলাকার গ্যালাক্সিগুলিতে অন্ধকার অর্থাৎ লুকিয়ে থাকা জড়ের বা ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বকে অত্যন্ত জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত: রুবিনের কাজই পরবর্তীতে টনি টাইসনের মত জ্যোতির্বিদদের গুপ্ত পদার্থ সম্পর্কে গবেষণায় আগ্রহী করে তোলে। ব্যাপারটি একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
আমাদের গ্যালাক্সি কেন্দ্র থেকে অনেক দূরবর্তী নক্ষত্ররাজির গতিবেগ কেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থিত নক্ষত্ররাজির বেগের তুলনায় কম হওয়ার কথা; ঠিক যেমনটা ঘটে আমাদের সৌরজগতের ক্ষেত্রে। সূর্য থেকে যত দূরে যাওয়া যায়- গ্রহগুলোর গতিবেগও সেই হারে কমতে থাকে। কারণটা খুবই সোজা। নিউটনের সূত্র থেকে আমরা জেনেছি যে, মাধ্যাকর্ষণ বলের মান দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ দূরত্ব বাড়লে আকর্ষণ বলের মান কমবে তার বর্গের অনুপাতে। টান কম হওয়ার জন্য দূরবর্তী গ্রহগুলো আস্তে চলে। আমাদের ছায়াপথের ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটবার কথা। কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী নক্ষত্রগুলো তাদের কক্ষপথে কেন্দ্রের কাছাকাছি নক্ষত্রগুলোর চেয়ে আস্তে ঘুরবার কথা। কিন্তু রুবিন যে ফলাফল পেলেন তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। দূরবর্তী নক্ষত্রগুলির ক্ষেত্রে গতিবেগ কম পাওয়া তো গেলই না বরং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের পর সকল নক্ষত্রের বেগ প্রায় একই সমান পাওয়া গেল। অন্যান্য সর্পিলাকার গ্যালাক্সিগুলি (যেমন অ্যাণ্ডোমিডা) পর্যবেক্ষণ করেও রুবিন সেই একই ধরণের ফলাফল পেলেন। তার এই পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিদদের ভাবনায় ফেলল। হয় রুবিন কোথাও ভুল করেছেন, অথবা এই গ্যালাক্সির প্রায় পুরোটাই এক অজ্ঞাত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জড়পদার্থে পূর্ণ। রুবিন যে ভুল করছেন না এই ব্যাপারটা আরও ভালোভাবে বুঝা গেল অ্যাড্রোমিণ্ডা গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করে। দেখা গেল ২২ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের এই গ্যালাক্সিটি ঘণ্টায় প্রায় ২ লক্ষ মাইল বেগে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। এই অস্বাভাবিক গতিবেগকে মহাকর্ষ জনিত আকর্ষণ দিয়েই কেবলমাত্র ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু দৃশ্যমান জড়পদার্থ তো পরিমাণে অনেক কম ফলে মহাকর্ষের টান তো এত ব্যাপক হবার কথা নয়! তাহলে? তাহলে কোথাও নিশ্চয়ই বিশাল আকারের অদৃশ্য জড়পদার্থ এই দুই গ্যালাক্সির মাঝে লুকিয়ে আছে। বিশাল আকার বললাম বটে, তবে সেটা যে কতটা বিশাল তা বোধ হয় অনুমান করা যাচ্ছে না। এই অদৃশ্য পদার্থের আকার আমাদের যে ছায়াপথ সেই ‘মিল্কিওয়ে’-এর মোটামুটি দশ গুণ! আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা বহুভাবে ফ্রিৎস জুইস্কি কিংবা ভেরা রুবিনের কাজের সত্যতা নির্ণয় করেছেন। ছায়াপথের ঘূর্ণন কার্ভ, ক্লাস্টার নিয়ে গবেষণা, মহাজাগতিক কাঠামোর সিমুলেশন, মহাকর্ষীয় লেন্সিং সহ বহু ক্ষেত্রেই এই গুপ্ত পদার্থের হদিসের ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের কাছে প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে।
অদৃশ্য গুপ্ত জড়পদার্থ আছে – তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু কেমনতর এই জড়পদার্থ গুলো? এদের বৈশিষ্ট্যই বা কি রকম? সত্যি বলতে কি – আমরা এখনও তা বুঝে উঠতে পারিনি। গুপ্ত পদার্থে নিশ্চিতভাবে কোন ঝলমলে নক্ষত্র নেই – থাকলে তো আর তারা অদৃশ্য থাকত না। এতে ধূলি কণাও থাকতে পারে না – কেন না এই ধূলি কণাগুলি দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত আলো’কে আটকে দেবার জন্য এবং সেই সাথে আমাদের চোখে ধরা পড়বার জন্য যথেষ্টই বড়। তা হলে কি আছে এতে? আসলে বিজ্ঞানীরা যে তত্ত্ব দিয়েছেন তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, গুপ্ত জড় বস্তুসমূহ আমাদের চেনা জানা কোন পদার্থ দিয়েই তৈরি হওয়ার কথা নয়। সে জন্যই তারা রহস্যময় এবং গুপ্ত। অনেকে বলছেন এরা তৈরি হয়েছে নিউট্রিনো কণিকাপুঞ্জ দিয়ে। কিন্তু সম্প্রতি মেক্সিকান পদার্থবিজ্ঞানী কার্লোস ফ্র্যাঙ্ক কম্পিউটারে সিমুলেশন করে দেখিয়েছেন যে শুধুমাত্র নিউট্রিনোকে ধরে হিসেব করলে আসলে এই অন্ধকার জড়ের সঠিক ব্যাখ্যা মেলে না[11]। কাজেই এই সব নিউট্রিনোর বাইরেও বিশাল ভরের অজানা কণিকার অস্তিত্ব আছে যেগুলো মহাবিশ্বের সামগ্রিক গঠনে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে ডার্ক ম্যাটারকে ব্যাখ্যার জন্য বেশ কিছু নতুন ধারণা প্রস্তাব করা হয়েছে। এদের মধ্যে অগ্রগামী প্রার্থী হচ্ছে WIMPs – এরা দুর্বল মিথস্ক্রিয়াসম্পন্ন (কল্পিত) ভারী কণা[12]। এদের নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনেক তত্ত্ব আছে। ধারণা করা হয় এদের উদ্ভব ঘটেছিল বিশেষ ধরণের প্রতিসাম্যতার ভাঙ্গনের মধ্যে দিয়ে, এবং এদের ভর প্রায় ১০০ জিইভির কাছাকাছি। এর বাইরেও বিজ্ঞানীদের তালিকায় আছে নিউট্রালিনো, হিগসিনো, স্টেরাইল নিউট্রিনো এবং এক্সিয়ন[13]। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন যতদূর সম্ভব এদের সম্বন্ধে জেনে সঠিক ধারণায় পৌঁছুতে কারণ মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থার সাথে ডার্ক ম্যাটারের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। আরেকটি কারণেও ডার্ক ম্যাটার গুরুত্বপূর্ণ। সেই ওমেগার ব্যাপারটি। যদিও বর্তমানে বিজ্ঞানীদের ধারনা গুপ্ত পদার্থ মহাবিশ্বের মোট ভরের ২৩ ভাগের বেশি নয়; কিন্তু মহাবিশ্বের উদ্ভবের সময়গুলোতে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ পদার্থই ছিল এ ধরণের অদৃশ্য জড়। সেরকম কিছু অদৃশ্য পদার্থ যদি এখনো থেকে থাকে, তবে মহাশূন্যের বিশাল এলাকা যাদের আমরা শূন্য বলে ভাবছি, সেগুলো সেই অর্থে ‘শূন্য’ নয়; মহাবিশ্ব আসলে হতে পারে এই অদৃশ্য গুপ্ত জড়পদার্থের এক অথই মহাসমুদ্র – আর দৃশ্যমান জড়পিণ্ড গুলি হচ্ছে তার মাঝে নগণ্য কয়েকটি বিচ্ছিন্ন আলোকিত ‘দ্বীপপুঞ্জ’। এই ব্যাপারটা সত্য হলে কিন্তু ওমেগার মান ১ এর চেয়ে বড় হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এক সময় মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ হয়ে শুরু হয়ে যেতে পারে সঙ্কোচনের পালা বদল।
মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হতে থাকলে কি হবে? যখন সঙ্কোচনের পালা আসবে, আশেপাশের গ্যালাক্সির দিকে তাকালে তখন আর লোহিত ভ্রংশ (Red Shift) দেখা যাবে না, তার বদলে দেখা যাবে নীলাভ ভ্রংশ (Blue Shift)। নিজেদের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়তে থাকায় পদার্থের ঘনত্ব, আর তাপমাত্রা ক্রমশ: বাড়তে থাকবে। তারপর যে সময় ধরে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছিল, সেই একই কিংবা কাছাকাছি সময় ধরে মহাবিশ্ব সংকুচিত হয়ে আবারো সেই প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে যাবে, যেখান থেকে এক সময় বিগ ব্যাং এর সূচনা হয়েছিল! মহাবিশ্বের এই অন্তিম পতনের নাম দেওয়া হয়েছে মহাশাব্দিক সঙ্কোচন (Big Crunch)। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন মহা বিস্ফোরণ আর মহা সঙ্কোচনের মাঝে আজীবন দুলতে থাকাও মহাবিশ্বের পক্ষে অসম্ভব নয়। বরং এই মহাবিশ্ব হতে পারে দোদুল্যমান (Oscillating)। যেমন, এ কালের খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং একটা সময় এমন একটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন- এই দোদুল্যমান মহাবিশ্বকে (Oscillating universe) যে অদ্বৈত বিন্দু থেকেই শুরু করতে বা এতে গিয়ে শেষ হতে হবে -এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। সঙ্কুচিত হতে হতে অন্তিম পতনের আগ মুহূর্তে কোন এক ভাবে যথেষ্ট পরিমাণ চাপ সৃষ্টি হয়ে মহাকর্ষের টানকে অতিক্রম করবার মত যথেষ্ট শক্তি অর্জিত হবে- যা ধাক্কা দিয়ে মহাবিশ্বকে আরেকটি প্রসারণের চক্রে ঠেলে দিতে পারে। এর তাৎপর্য হল মহাবিশ্বের চরম পতন জাতীয় অদ্বৈত বিন্দুতে পরিসমাপ্তি ঘটবে না – বরং প্রবলভাবে ’প্রত্যাবৃত্ত’ হবে অর্থাৎ ইংরাজিতে যাকে বলে ‘বাউন্স’ করবে (চিত্র দ্রষ্টব্য)। সৃষ্টি ও ধ্বংসের এই দুটি অদ্বৈত বিন্দুর মধ্যে মহাবিশ্বের এ ধরণের সৃষ্টি-লয়ের ‘স্পন্দনময় গমনাগমন’ হয়ত চলতে থাকবে অন্তহীনভাবে।
চিত্র: মহাবিশ্বের সম্ভাব্য পরিণতি:(ক) উচ্চ ঘনত্ব বিশিষ্ট মহাবিশ্বের রয়েছে একটি প্রারম্ভ, একটি সমাপ্তি, এবং তাই একটি সীমিত আয়ুষ্কাল। এই চিত্রের গ্রাফের নীচের বাক্সে এর বিস্ফোরণ থেকে সর্বোচ্চ আয়তনে পৌঁছানো এবং পুনরায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবার বিবর্তন দেখানো হচ্ছে। (খ) একটি স্পন্দনশীল মহাবিশ্বের আরম্ভ নেই, আর সমাপ্তিও নেই। প্রতিটি সম্প্রসারণ-সংকোচন দশা একটি ‘প্রবল প্রত্যাবৃত্ত’ বা বাউন্সে এসে উপনীত হয়, যা তৈরি করে পরবর্তী ‘বিগ ব্যাং’ – এর ক্ষেত্র। (গ) স্বল্প ঘনত্ব বিশিষ্ট মহাবিশ্ব বিগ ব্যাং এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে প্রসারিত হতে থাকবে।
এই ‘বাউন্সিং ইউনিভার্স’ মডেল ত্রিশের দশকের দিকে পদার্থবিদদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করলেও ক্রমশ মূল ধারা থেকে পরিত্যক্ত হয়। এর একটা বড় কারণ তাপগতিবিদ্যার ২য় সূত্রের আপাতঃ লঙ্ঘন[14]। তাপগতিবিদ্যার ২য় সূত্র বলছে, এন্ট্রপি, যেটাকে আমরা মোটা দাগে বিশৃঙ্খলার পরিমাপ হিসেবে জানি, সময়ের সাথে সাথে বাড়ে। কাজেই দোদুল্যমান মহাবিশ্বেও মহাজাগতিক বিবর্তনের প্রতিটি চক্রে এন্ট্রপি বাড়বে বলে ধরে নেয়া হয়। এখন আমাদের মহাবিশ্ব যদি বিস্ফোরণ এবং সংকোচনের অসীম চক্রের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছায়, তবে তার ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ এন্ট্রপিতে পৌঁছিয়ে গিয়ে তাগতীয় সাম্যাবস্থায় পৌঁছে যাবার কথা ছিল। এ ধরনের মহাবিশ্বের অনিবার্য নিয়তি ‘তাপগতীয় মৃত্যু’। কিন্তু বলাই বাহুল্য, মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করে আমরা তার সাথে মিল পাই না। কাজেই এই মডেল কাজ করে না বলেই অধিকাংশ বিজ্ঞানী ধরে নিয়েছেন।
এই দোদুল্যমান মহাবিশ্ব নিয়ে আজকে আর কথা বলার প্রয়োজন পড়ত না যদি না, সেই ‘একদা পরিত্যক্ত’ এই তত্ত্ব আবার নতুনভাবে স্ট্রিং তত্ত্বের মাধ্যমে রঙ্গমঞ্চে ফিরে না আসতো। ২০০২ সালের দিকে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পল স্টেইনহার্ট এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেইল টুরক সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে প্রস্তাব করেন যে, মহাবিশ্বের উদ্ভব হয়েছে স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের কথিত দুটো ব্রেনের সংঘর্ষের (collision of branes) ফলশ্রুতিতে[15]। ‘স্ফীতিতত্ত্বের বিকল্প’ হিসেবে দাবী করা তাঁদের এ তত্ত্বে ‘বিগ ব্যাং’ দিয়ে স্থান-কালের শুরু নয়, বিগ ব্যাং-কে তারা দেখিয়েছেন কেবল চোদ্দশ কোটি বছর আগেকার ব্রেনীয় সাংঘর্ষিক একটি ঘটনা হিসেব। আর কেবলমাত্র একবারই এই মহাবিস্ফোরণ ঘটবে বা ঘটেছে তাও নয়, বরং এ মহাবিশ্ব প্রাকৃতিক বিবর্তনের চক্রে চির চলমান। মহাবিশ্বের যাত্রাপথের প্রতিটি চক্রে বিগ ব্যাং উদ্ভব ঘটায় উত্তপ্ত পদার্থ এবং শক্তির। কালের পরিক্রমায় ক্রমশ শীতল হয়ে এর থেকে তৈরি হয় গ্যালাক্সি আর তারকারাজি। আজ থেকে ট্রিলিয়ন বছর পরে আবারো হয়তো এ ধরণের বিগ ব্যাং ঘটবে এবং তৈরি করবে নতুন চক্রের। পল স্টেইনহার্ট এবং নেইল টুরক তাদের প্রস্তাবিত মডেলকে সাধারণ পাঠকদের কাছে নিয়ে এসেছেন সম্প্রতি ‘অফুরন্ত মহাবিশ্ব’ (Endless Universe) শীর্ষক একটি বইয়ের মাধ্যমে[16]।
চিত্র: পল স্টেইনহার্ট এবং নেইল টুরক তাদের প্রস্তাবিত এই চক্রাকার মহাবিশ্ব বা ‘সাইক্লিক মডেলে’ দাবী করেছেন মহাবিশ্বের উদ্ভব হয়েছে দুটো ব্রেনের সংঘর্ষের ফলশ্রুতিতে,এবং এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে চক্রাকার পথে অনন্তকাল ধরে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল, মহাবিশ্বের ‘তাপীয় মৃত্যুর’ ব্যাপারটা স্টেইনহার্ট এবং টুরকের চক্রাকার মডেলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। কারণ এই মডেলে প্রতিটি চক্রে প্রসারণের পরিমাণ সংকোচনের পরিমাণের চেয়ে বড় হয়, ফলে প্রতিটি চক্র শেষে মহাবিশ্ব আয়তনে বিবর্ধিত হয়। যত সময় যাবে মহাবিশ্বও তত প্রসারিত হবে, এবং সেই সাথে বাড়বে এন্ট্রপি। কিন্তু সর্বোচ্চ এন্ট্রপিতে কখনোই পৌঁছাবে না, কারণ এই মডেলে সর্বোচ্চ এন্ট্রপি বলে কিছু নেই[17]। তবে বলা বাহুল্য প্রান্তিক এ ধারণাগুলো বাহ্যত তত্ত্ব কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জোরালো কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
চক্রাকার মহাবিশ্ব তো পরের কথা, মহাসংকোচন ব্যাপারটা এখনো স্রেফ ধারণা হিসেবেই কেবল বিজ্ঞানীরা বিবেচনা করছেন। মহাবিস্ফোরণের পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে অনেক আগেই – কিন্তু মহা সঙ্কোচনের ব্যাপারটা অনেকটাই অনিশ্চিত; মহা সঙ্কোচন এখনও একটি অনুকল্প বা হাইপোথিসিস মাত্র – আর সেই হাইপোথিসিসকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য (অর্থাৎ Ω > ১ হতে হলে) যে পরিমাণ জড়পদার্থ মহাবিশ্বে থাকা প্রয়োজন তার মাত্র একশ ভাগের তিন থেকে চার ভাগ পদার্থের এ পর্যন্ত ‘দেখা’ মিলেছে। অধিকাংশ বিজ্ঞানীই আজ তাই মনে করেন এই ‘বাউন্স’ কিংবা মহাসংকোচনের ব্যাপারটা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। তারা মনে করেন মহাবিশ্ব হয়তো প্রসারিত হতে থাকবে অবিরামভাবে এবং এর সমাপ্তি ঘটবে ‘বিগ ফ্রিজ’ কিংবা ‘তাপীয় মৃত্যুর’ মধ্যে দিয়ে। বিজ্ঞানীদের এহেন চিন্তা ভাবনার পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে পরের অনুচ্ছেদ গুলোতে।
এর মধ্যে আরেকটি ব্যাপার হল। বিজ্ঞানীরা জানতেন যে, মহাবিশ্বের উপর মহাকর্ষ বল যদি ক্রিয়াশীল থাকে, তবে আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের প্রসারণ ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়া উচিৎ। মহাবিশ্বের মোট শক্তি তার মহাকর্ষের বদৌলতে ক্রমশ প্রসারণকে স্তিমিত করে আনবে এটাই স্বাভাবিক। একটা পাথরকে উপরের দিকে ছুড়ে দিলে যত উপরে উঠে ততই এর বেগ কমতে থাকে মাধ্যাকর্ষণের টানে। সেরকমই ব্যাপার অনেকটা। এ পর্যন্ত সব কিছু ঠিক-ঠাকই ছিল। কিন্তু গোল বাঁধালো ১৯৯৮ সালের একটি ঘটনা। সুপারনোভা বিস্ফোরণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের ভিন্ন ভিন্ন দুটি গ্রুপ যে ফলাফল পেলেন তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। বিজ্ঞানীদের ধারণা উল্টে দিয়ে দেখা গেল মহাবিশ্বের প্রসারণ আসলে হ্রাস পাচ্ছে না, বরং দ্রুত হারে বাড়ছে। ১৯৯৮ সালের এই পর্যবেক্ষণটিকে পদার্থবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলির অন্যতম বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যাপারটা সে সময় বিজ্ঞানী সমাজে এত আলোড়ন তুলেছিল যে এ বিষয়টি ‘ত্বরমাণ মহাবিশ্ব’ (Accelerating Universe) শিরোনামে বেশ কিছুদিন ধরে পত্র-পত্রিকায় প্রথম পাতার খবর হয়েছিল। বিখ্যাত সায়েন্স ম্যাগাজিন হতবাক আইনস্টাইনের কল্পিত ছবি সম্বলিত ‘কভার পেজ’ তৈরি করেছিল সে সময়:
চিত্র: ১৯৯৮ সালে ‘ত্বরমাণ মহাবিশ্ব’ আবিস্কৃত হবার পর সায়েন্স পত্রিকার প্রচ্ছদ।
মহাবিশ্বের এই ত্বরণের পিছনে রয়েছে মহাকর্ষ-বিরোধী এক ধরণের ‘অদৃশ্য বা গুপ্ত শক্তি’ (Dark Energy), অন্তত বিজ্ঞানীদের তাই ধারণা। এই গুপ্ত শক্তির ধরণ-ধারণ গুপ্ত জড়ের চেয়েও বেশী রহস্যজনক। এই শক্তির বৈশিষ্ট্য এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা – যা ইতোমধ্যে বোঝা গেছে তাহলো গুপ্ত শক্তি আমাদের মহাবিশ্বের এক প্রধানতম উপাদান। আমরা আগের অধ্যায় থেকে জেনেছি, আসলে বিশ শতকের শুরুতেই আপেক্ষিক তত্ত্বের মাধ্যমে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রতি-মহাকর্ষ বলের (antigravitational force) একটা ধারণা দিয়েছিলেন। মহাকর্ষের প্রভাবে বস্তুসমূহের অবশ্যম্ভাবী পতন এড়াতে আর সেই সাথে মহাবিশ্বকে একটা স্থিতিশীল রূপ দিতেই আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণগুলিতে মহাবৈশ্বিক ধ্রুবক (Cosmological constant) নামে একটা কাল্পনিক ধ্রুবক যোগ করেছিলেন। কিন্তু হাবলের আবিষ্কারে যখন প্রমাণিত হল যে এই মহাবিশ্ব স্থিতিশীল নয় -বরং প্রসারণশীল, তখন আইনস্টাইন নিজেই ঘোষণা করেছিলেন যে, মহাবৈশ্বিক ধ্রুবক সংক্রান্ত ধারণাটি ছিল তার জীবনের ‘সবচেয়ে বড় ভুল’।
চিত্র: গুপ্ত শক্তির বিবিধ সাক্ষ্য। এই সমস্ত সাক্ষ্যের কারণেই বিজ্ঞানীরা মনে করেন গুপ্ত শক্তি মহাবিশ্বের পরিণতি নির্ধারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এখন দেখা যাচ্ছে, আইনস্টাইনের সেই ‘মহা ভুলের’ও ভুল ধরিয়ে দিয়ে এই একুশ শতকে প্রতি-মহাকর্ষ বা অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি আবার নতুন উদ্যমে ফিরে এসেছে এই গুপ্ত শক্তির মাধ্যমে। কিন্তু এই গুপ্ত শক্তি জিনিসটা লুকিয়ে আছে কোথায়? অবিশ্বাস্য মনে হবে শুনতে, কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন এই গুপ্ত শক্তি লুকিয়ে আছে আমাদের চেনা জানা শূন্যস্থানে। আমরা আগের অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করেছি যে, আসলে আধুনিক পদার্থবিদ্যায় শূন্যতাকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। যেখানে কোন পদার্থ নেই সেখানেও কিছু পরিমাণ শক্তি থাকতে পারে। যে শূন্য দেশকে আপাতদৃষ্টিতে শান্ত, সমাহিত ভাবা হচ্ছে, তার মধ্যেও সূক্ষ্মস্তরে ঘটে চলেছে নানা প্রক্রিয়া। শূন্যতার মাঝে জড়কণা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সৃষ্ট হচ্ছে আবার তারা নিজেদেরকে ধ্বংস করে শক্তিতে বিলীন হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা শূন্যস্থানে লুকানো শক্তির নাম দিয়েছেন ‘ভ্যাকুয়াম এনার্জি’। কিন্তু মুশকিল হল, এই ভ্যাকুয়াম শক্তির পর্যবেক্ষণ আর গণনায় বিস্তর ফারাক পাচ্ছেন তারা। মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করে যে শক্তির হদিস তারা পাচ্ছেন, গণিতের গণনার ফলাফল তার থেকে ১০১২০ গুন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। যদি পর্যবেক্ষণের ফলাফল সত্যি হয়ে থাকে তবে পৃথিবীর সমান আয়তনের মধ্যে লুকানো গুপ্ত শক্তির পরিমাণ সর্বসাকুল্যে আমেরিকার বার্ষিক বিদ্যুৎ খরচের সমান। আর যদি গণিত সঠিক হয়ে থাকে, তবে এক কিউবিক সেন্টিমিটার ভ্যাকুয়াম এনার্জি দিয়ে সারা আমেরিকা ১০৮৫ বছর চলবে[18]। বোঝাই যাচ্ছে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’।
চিত্র: মহাবিশ্বের শুরুতে গুপ্ত পদার্থ রাজত্ব করলেও এখন রাজত্ব করছে গুপ্ত শক্তি
‘মহাজাগতিক ধ্রুবক সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত এই বিদঘুটে সমস্যাটির কথা আমরা অবশ্য আগের একটি অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। পদার্থবিদদের জন্য এটা বড় ধরণের সমস্যা অনেকদিন ধরেই। তবে সম্প্রতি হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপাল, সুপার সিমেট্রি এবং স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রার নিরিখে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করেছেন বলে দাবী করা হয়েছে। যেমন, হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপালের কথা আমরা আগের অধ্যায়ে কিছুটা আলোচনা করেছি। দেখেছি যে এই নীতি গোনায় ধরে গণনা ধরলে মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান পর্যবেক্ষণের অনেক কাছাকাছি চলে আসে। তারপরেও এটা সম্ভাব্য সমাধান কিনা বিজ্ঞানীরা একেবারেই নিশ্চিত নন। এর বাইরে ‘সুপার সিমেট্রি’ বা পরম-প্রতিসাম্যতার ধারণা ব্যবহার করে এবং স্থান কালের অতিরিক্ত মাত্রার ধারণা ব্যবহার করেও সমাধান খুঁজছেন তারা। তাদের গণনা থেকে যে বিশাল মানের শক্তির হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, তার কিছু অতিরিক্ত মাত্রার ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে কিনা কিংবা মাত্রাগুলো বেশিরভাগ শক্তি শুষে নিচ্ছে কিনা সেটাও পরখ করে দেখছেন তারা। তবে এ সমাধানগুলোর বেশিরভাগই তাত্ত্বিক এবং অনেক ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ মডেলও অনুপস্থিত।
এর ফলে কিছু বিজ্ঞানী একটু ভিন্ন ভাবে সমস্যাটি দেখার চেষ্টা করছেন বর্তমানে। তারা ভাবছেন এই গুপ্তশক্তির ব্যাপারটা হয়তো একেবারেই ভ্যাকুয়াম এনার্জি বা মহাজাগতিক ধ্রুবকের সাথে সম্পর্কিত নয়। হতে পারে যে, এই গুপ্ত শক্তি একেবারেই ভিন্ন একটা ক্ষেত্র (তাড়িতচুম্বক বা মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মতো কিছু) থেকে উঠে এসেছে। এই ক্ষেত্র স্থির নয়, বরং গতিময়। মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে সাথে এর ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটে। এর নাম দেয়া হয়েছে কুইন্টেসেন্স (quintessence)। এই কুইন্টেসেন্স সহ গুপ্তশক্তির নানামুখী বিবর্তন বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা নানা ধরণের গণিতের রাশি তৈরি করেছেন। এরকমের একটি রাশি হচ্ছে ‘অবস্থা-সমীকরণ চলক’ (equation-of-state parameter)। এটা মূলত গুপ্ত শক্তির চাপ এবং এর শক্তি ঘনত্বের অনুপাত। এই অনুপাতকে প্রকাশ করা হয় w এর মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে এই অনুপাতটির তারতম্য এবং হের ফেরের মাধ্যমে আমাদের জন্য মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতির একটি সফল ছবি তৈরির চেষ্টারত আছেন বলা যায়।
চিত্র: প্রসারণশীল মহাবিশ্বের মডেল। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে ‘অবস্থা-সমীকরণ চলক’ নামের অনুপাতটির তারতম্য এবং হের ফেরের মাধ্যমে আমাদের জন্য মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতির একটি সফল ছবি তৈরির চেষ্টারত আছেন
তাহলে বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণগুলির সারমর্ম হল, মহাবিশ্বে এক ধরণের শক্তি আছে যার উৎস ‘এখনও অজানা’। এটার উৎস হতে পারে স্রেফ ভ্যাকুয়াম শক্তি, কিংবা হতে পারে কুইন্টেসেন্সের মত কিছু। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটা বড় কাজ এই মুহূর্তে এই গুপ্ত শক্তির সঠিক প্রকৃতি কিরকমের তা নির্ণয় করা – এটা কি কুইন্টেসেন্স এর মত ‘গতিময়’ নাকি ভ্যাকুয়াম শক্তির মত ‘স্থির’? এ ব্যাপারটা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। কিন্তু যেটা তারা জানেন তা হল – এই শক্তি বিকর্ষণমূলক । ফলে এই শক্তি মহাবিশ্বকে সীমিত রাখতে সহায়তা করছে না, বরং প্রসারণের হার ক্রমশঃ বাড়িয়ে তুলছে। প্রসারণের হার যদি এমনভাবে বাড়তে থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বের পরিণতি কি হবে? প্রসারণ যদি বাড়তেই থাকে তাহলে গ্যালাক্সিগুলি পরস্পর থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাবে- আর আলোর উৎসগুলো (বিপুল নক্ষত্ররাজি) শক্তিক্ষয় করে একসময় অন্ধকারে ডুবে যাবে; অর্থাৎ মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকার! আমরা উপরে ‘অবস্থা-সমীকরণ চলক’ এর যে হিসেব দিয়েছি, সেখানে w এর মান -১ এর কাছাকাছি (অর্থাৎ গুপ্তশক্তির পুরোটাই অপরিবর্ত ভ্যাকুয়াম শক্তিবিশিষ্ট) হলে এমন অবস্থা হবে। আমাদের আজকের যে মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণ তা এ ধরণের পরিণতির দিকেই রায় দেয়। এই পরিণতি সত্য হলে, আজ থেকে এক থেকে দুই ট্রিলিয়ন বছরের মধ্যে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ ছাড়া আর কোন ছায়াপথ পর্যবেক্ষণ করতে পারব না। আর শেষ পর্যন্ত সমস্ত মহাবিশ্বের নক্ষত্ররাজি পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। মহাশূন্য চলে যাবে অন্ধকার আর শৈত্যময় এক নির্জীব অবস্থায়[19]। বিজ্ঞানীরা এই পরিণতির নাম দিয়েছেন মহাশৈত্য বা ‘বিগ চিল’ (Big Chill) ।
সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে বছর কয়েক আগে উঠে এসেছে আরেকটি নতুন মতবাদ। যদি w এর মান -১ এর চেয়ে আরো কম হয়, মানে অধিকতর ঋণাত্মক (যেমন w = – 1.15), তাহলে তা তৈরি করবে আরেক ধরণের চরম পরিণতির ক্ষেত্র। গুপ্তশক্তির প্রভাব সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকবে। প্রসারণ বাড়তে থাকবে অচিন্তনীয় ভাবে। ডার্টমাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কাল্ডওয়েল মনে করেন যে, দুই হাজার কোটি বছরের মধ্যে প্রসারণ এতই বেড়ে যাবে যে, এই বহির্মুখী প্রসারণ-চাপ আক্ষরিক অর্থেই গ্যালাক্সিগুলিকে একসময় ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে; ছিঁড়ে ফেলবে নক্ষত্রকে, ছিঁড়ে ফেলবে গ্রহদের, ছিঁড়ে ফেলবে আমাদের সৌরজগৎকে আর শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলবে সকল শ্রেণীর জড় পদার্থকে। এমনকি পরমাণু পর্যন্ত ছিঁড়ে যাবে অন্তিম সময়ের ১০-১৯ সেকেন্ড আগে[20]। এই মতবাদকে নামাঙ্কিত করা হয়েছে বিগ রিপ (Big Rip) বা ‘মহাচ্ছেদন’ অভিধায়। তবে এই মহাচ্ছেদন সত্যই ঘটবে কিনা -শুধুমাত্র ভবিষ্যৎ গবেষণা থেকেই তা সঠিকভাবে জানা সম্ভব। অনেকেই মনে করেন, এখনকার পর্যবেক্ষণ যা থেকে গুপ্ত শক্তি আইনস্টাইনের মহাজাগতিক ধ্রুবকের সমতুল মনে মনে করা হচ্ছে, সেটা সঠিক হলে বিজ্ঞানীদের ‘বিগ রিপ’ নিয়ে এতটা চিন্তিত না হলেও চলবে।
চিত্র: মহাবিশ্বের সম্ভাব্য তিন পরিণতি – মহাসংকোচন, মহাশৈত্য অথবা মহাচ্ছেদন
‘বিগ চিল’ আর ‘বিগ রিপের’ বাইরেও আরেকটি সম্ভাবনা আছে। এটার কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। সেই ‘বিগ ক্রাঞ্চ’ বা মহাসঙ্কোচন। যদিও এই মুহূর্তে গুপ্ত শক্তির যে হাল হকিকত, তাতে করে মহাসংকোচন বা বিগ ক্রাঞ্চ ঘটার সম্ভাবনা খুব কম বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করেন। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে গুপ্তশক্তি পাওয়া যাবার আগ পর্যন্ত মহাসংকোচনের ব্যাপারটা একটা জোরালো সম্ভাবনা হিসেবেই বিজ্ঞানীদের তালিকায় ছিল। কিন্তু বিকর্ষণমূলক গুপ্ত শক্তির আগমনে দাবার ছক মোটামুটি উল্টে গেছে। গুপ্ত শক্তি ব্যাপারটা এখন এতোটাই প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছে যে, সবাই এখন মহাবিশ্বের প্রসারণ জনিত মৃত্যু দূত মহাশৈত্য আর মহাচ্ছেদন নিয়েই ভাবিত। মহাসংকোচন ক্রমশঃ হারিয়েই যাচ্ছে বিস্মৃতির অন্তরালে। তারপরেও কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে সেটার সম্ভাবনা ফিরেও আসতে পারে। যদি w এর মান -১ এর চেয়ে বেশি হয়, মানে কম ঋণাত্মক (যেমন w = – 0.85 বা এ ধরণের কিছু),তাহলে মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে হতে একসময় হয়তো আগের মতোই মহাশৈত্য বা ‘বিগ চিল’ -এ এসে শেষ হবে। কিন্তু এমনও হতে পারে একটা সময় পর এই গুপ্ত শক্তিজনিত প্রসারণ ধীর হয়ে থেমে গেল, আর পুনরায় শুরু হল চিরচেনা পদার্থের রাজত্ব। আর এই প্রেক্ষিতে মহাবিশ্বের জ্যামিতির প্রকৃতি, গুপ্তশক্তির হত দরিদ্র অবস্থা এবং পদার্থের প্রাচুর্য, আর মাধ্যাকর্ষণ জনিত আকর্ষণ বলের প্রভাব সব মিলিয়ে মহাসংকোচন সদম্ভে আবার রঙ্গমঞ্চে ফিরে আসতে পারে, অনেকটা নীচের ছবির একদম তলার রেখাটির মতো।
চিত্র: গুপ্ত শক্তি ব্যাপারটা এখন এতোটাই প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছে যে, সবাই এখন মহাবিশ্বের প্রসারণ জনিত মৃত্যু দূত মহাশৈত্য আর মহাচ্ছেদন নিয়েই ভাবিত। মহাসংকোচন ক্রমশঃ হারিয়েই যাচ্ছে বিস্মৃতির অন্তরালে। তারপরেও কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে সেটার সম্ভাবনা ফিরেও আসতে পারে।
হয়তো বিজ্ঞানী পল ডেভিসের ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যে পরিণত হবে, যার উল্লেখ তিনি করেছিলেন তাঁর ‘শেষ তিন মিনিট’ গ্রন্থে[21], ‘মহাবিশ্ব শূন্য থেকে এসেছে বিগ ব্যাং এর পথ ধরে। এক সময় শূন্যে মিলিয়ে যাবে মহাসংকোচনের পথ ধরে। মাঝখানের দ্যুতিময় কয়েক জিলিয়ান বছরের অস্তিত্ব কারো স্মৃতিতেও রইবে না’।
জ্যোতির্বিদ্যার মৃত্যু?
আমরা জানলাম মহাবিশ্বের মৃত্যু ঘটতে পারে তিন ভাবে। মহাসংকোচন, মহাচ্ছেদন কিংবা মহাশৈত্য। কিন্তু সব পরিণতির সম্ভাবনা সমান নয়। বিজ্ঞানীদের এই মুহূর্তের হিসেব নিকেশ বলছে মহাবিশ্বের পরিণতির পাল্লা মহাশৈত্যের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে বেশি। তবে সেখানে যাওয়ার আগে আরো কিছু ব্যাপার আকর্ষণীয় ব্যাপার ঘটবে যা নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করব।
গুপ্তশক্তির প্রভাবে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, সেটা আমরা আগেই জেনেছি। আমরা যখন মহাবিশ্বের প্রসারণের কথা বলি তখন মহাবিশ্বের সবকিছুর প্রসারণের কথা বলি না। বলি কেবল স্থানের প্রসারণের কথা। মহাবিশ্বের সবকিছু যদি প্রসারিত হত, তাহলে আমাদের দেহের অণু পরমাণুগুলো একটা আরেকটা থেকে দূরে চলে যেত। আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখতেন, আপনার বাসার ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা মোটর সাইকেল কিংবা গাড়িটাও আয়তনে বেড়ে গেছে। তা কিন্তু আমরা দেখি না। এমনকি আমরা দেখিনা সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বও ক্রমশঃ বেড়ে যেতে। আমরা প্রসারণ বলতে মূলত বুঝি আমাদের ছায়াপথের সাথে অন্য ছায়াপথের মধ্যবর্তী স্থানের বিস্তারের কথা। ২৯২৯ সালে বিজ্ঞানী এডুইন হাবল দূরবীন দিয়ে যে দেখেছিলেন চারপাশের গ্যালাক্সিগুলো আমাদের আকাশগঙ্গা থেকে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সেখান থেকেই কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন মহাবিশ্বের প্রসারণের ইঙ্গিত। হাবল যে মহাজাগতিক সত্যটা প্রায় চুরাশি বছর আগে আবিষ্কার করেছিলেন, সেটা এখনো একইভাবে সত্য। এর সাথে অবশ্য এখন যুক্ত হয়েছে গুপ্তশক্তি জনিত ত্বরণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে ত্বরণে মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়ে চলেছে তাতে করে একদিন সকল গ্যালাক্সি আমাদের ছায়াপথের ‘দৃষ্টিসীমা’র বাইরে চলে যাবে।
দৃষ্টিসীমার ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা যাক। এখানে দৃষ্টিসীমা বলতে কেবল আমাদের চোখের দৃষ্টির কথা বলা হচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক বস্তুদের পর্যবেক্ষণ করেন খুব সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দিয়ে। আর তারা মহাজাগতিক বস্তুসমূহ পর্যবেক্ষণ করেন কেবল চোখের দৃষ্টির উপর নির্ভর করে নয়, বরং অবলোহিত (infrared), অণুতরঙ্গ (microwave), বেতার তরঙ্গ (radio wave) প্রভৃতি নানা তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে। যদি কোন আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু আমাদের থেকে যত দূরে সরে যেতে থাকে, বস্তুকণা থেকে প্রক্ষেপিত আলোর তত লোহিত সরণ ঘটতে থাকে। ফলে প্রক্ষিপ্ত তরঙ্গ অবলোহিত, অণুতরঙ্গ, বেতার তরঙ্গের পথ পাড়ি দিয়ে এতই দীর্ঘ তরঙ্গে রূপ নিবে যে, মহাবিশ্বের আকারকেও ছাড়িয়ে যাবে। এই অবস্থায় তারা চলে যাবে ‘অফিশিয়ালি’ অদৃশ্য স্ট্যাটাসে ।
বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বের করতে পারেন ঠিক কত সময় পরে এটা ঘটবে। তারা হিসেব করে দেখেছেন প্রায় ১৫ হাজার কোটি বছর পরে, যখন মহাবিশ্বের বয়স হবে আজকের বয়সের দশগুণ, তখন কাছাকাছি গ্যালাক্সির তারাদের থেকে আগত সকল আলোকরশ্মির প্রায় ৫০০০ গুণ লোহিত সরণ ঘটবে। আর ২০০ হাজার কোটি (অর্থাৎ দুই ট্রিলিয়ন) বছরের মধ্যে তাদের আলো লালাভ সরণের মাধ্যমে পৃথিবীর আকৃতিতে পৌঁছিয়ে যাবে। আর মহাবিশ্বের বাকি অংশ চলে যাবে রীতিমত ‘অদৃশ্য’ হয়ে।
দুই ট্রিলিয়ন বা ২০০ হাজার কোটি বছর শুনতে অনেক মনে হয়, কিন্তু মহাজাগতিক বয়সের ক্ষেত্রে এটা মোটেই বেশি নয়। মহাকাশে বহু তারাই আছে যাদের আয়ু এরকম দুই ট্রিলিয়ন বছরের মতো। এমনকি আমাদের চির পরিচিত সূর্যও অন্ততঃ পাঁচশ কোটি বছর বেঁচে থাকবে বলে আমরা জানি। আজ আমরা টেলিস্কোপে চোখ রেখে আমাদের চারপাশে অন্ততঃ ৪০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সির খোঁজ দিতে পারি। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন টেলিস্কোপে চোখ রাখলে এগুলো কিছুই দেখা যাবে না।
চিত্র: আজকের প্রসারমাণ মহাবিশ্ব কি ভবিষ্যতের অধিবাসীদের জন্য জ্ঞানের মৃত্যুর পদধ্বনি?
পরিস্থিতিটা হবে অনেকটা ১৯০৮ সালের সময়কার কিংবা তারও আগেকার মানুষজনের মহাকাশ সম্বন্ধে জ্ঞান বুদ্ধির মত। সেসময় সাধারণ লোকজন শুধু নয়, বড় বড় বিজ্ঞানীরাও ভাবতেন, মহাকাশে মহাজাগতিক বস্তু বলতে আছে আমাদের এই গ্যালাক্সি। এর চারপাশে আর কিছুর হদিস তারা জানতেন না। তাদের চোখে মহাবিশ্ব ছিল ‘স্থির’ (static) এবং ‘চিরন্তন’ (eternal)। হয়তো বহু কোটি বছর পরের অধিবাসীরাও হয়তো এভাবেই চিন্তা করতে বাধ্য হবে, কারণ তারা পর্যবেক্ষণ করেও নিজেদের ‘সুপারগ্যালাক্সি’ (ধারনা করা হয়, আমাদের আকাশগঙ্গা, এন্ড্রোমিডা, আর M33 গ্যালাক্সি মিলে এই সুপার গ্যালাক্সি তৈরি হবে) ছাড়া চারপাশে আর কিছু খুঁজে পাবে না। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যায় ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণের প্রমাণ হিসেবে যে তিনিটি প্রধান স্তম্ভের কথা আমরা এখন জানি – হাবলের প্রসারণ, মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ এবং হাল্কা কণার প্রাচুর্য –এগুলোর সবগুলোর আলামত যাবে হারিয়ে। তারপরেও সেসময়ের বড় কোন বিজ্ঞানী হয়তো পরোক্ষভাবে কিংবা গণিত সমাধান করে ‘বিপ্লবাত্মক’ উপসংহারে পৌঁছাবেন, সুপারগ্যালাক্সির বাইরেও মহাকাশে আরো অনেক গ্যালাক্সি আছে, আর মহাবিশ্বের প্রসারণ এত বেশি হয়েছে যে আমরা তাদের দেখতে পাই না। কে জানে হয়তো সেই বিজ্ঞানীটির দশা আমাদের পূর্বসূরি কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও কিংবা ব্রুনোর মতোই হবে। হয়তো তাকে পাগল ঠাওরানো হবে, কিংবা করে রাখা হবে অন্তরীণ। পর্যবেক্ষণ ছাড়া তার গণিতের ফলাফল অনেকেই মানতে চাইবেন না, যেমন আমাদের অনেকেই মানতে চাই না যে, এই মহাবিশ্বের বাইরেও আরো মহাবিশ্বের অর্থাৎ মাল্টিভার্সের অস্তিত্ব থাকতে পারে! আজকের এই লেখাগুলো যদি ততদিন পর্যন্ত টিকে থাকে, তবে হয়তো পাগল বিজ্ঞানীটির কোন সমর্থক এই তথ্যগুলো পেশ করে বলবে কয়েকশ হাজার কোটি বছর আগেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, দৃশ্যমান গ্যলাক্সির বাইরেও অন্য অনেক গ্যালাক্সি আছে। কিন্তু বিরোধী পক্ষ হয় এই যুক্তিগুলো উড়িয়ে দিয়ে বলবে, ‘আরে সেসময়ের জ্ঞান বিজ্ঞান এত উন্নত ছিল না। তারা সেসময় কি বুঝতে কি বুঝেছে কে জানে’। আসলে আমরা বোধহয় এখন, মানে এই বর্তমান সময়ে – জ্যোতির্বিদ্যা, মানব অনুসন্ধিৎসা এবং আমাদের কারিগরি দক্ষতার প্রেক্ষাপটে খুব প্রাঞ্জল একটা সময় অতিক্রম করছি, যে সময়টাতে আমরা মহাকাশের দিকে তাকিয়ে এর বিবিধ আলামতের ভিত্তিতে সঠিক উপসংহারে পৌঁছাতে পারছি। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে অন্য চলকগুলো ঠিক থাকলেও জ্যোতির্বিদ্যার আলামতগুলো থাকবে অনুপস্থিত। এই অবস্থা আমাদের জ্ঞানের মৃত্যুর নির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। এই সমস্ত দুর্ভাবনা থেকেই বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস তার সহকর্মী রবার্ট জে. শেরারের সাথে মিলে ২০০৭ সালে একটি ব্যতিক্রম ধর্মী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন একটি জার্নালে, শিরোনাম – ‘স্থির মহাবিশ্বের পুনরাগমন এবং জ্যোতির্বিদ্যার বিদায়’ শিরোনামে[22]। গবেষণাটির জনপ্রিয় সংস্করণ পাওয়া যাবে সায়েন্টিফিক আমেরিকানের ২০০৮ সালের একটি সংখ্যায়[23] কিংবা ক্রাউসের ২০১২ সালে লেখা ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইয়ের একটি অধ্যায়ে[24]।
হিগস – মৃত্যুর শীতল ছায়া?
মহাশৈত্য, মহাসংকোচন কিংবা মহাচ্ছেদনের বাইরেও মহাবিশ্বের ভিন্ন একটি মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে। এই সম্ভাবনাটি এসেছে হিগস ক্ষেত্রের বিদ্যমান প্রকৃতি থেকে। হ্যা, হিগস কণার সাম্প্রতিক আবিষ্কারের অমিত সম্ভাবনায় আমরা সবাই উল্লসিত, কিন্তু সেই সম্ভাবনাময় উল্লাস আবার সাথে করে নিয়ে এসেছে যেন সেই কাল কেউটের ফনার করাল ছায়া!
আমরা জানি শূন্যতার মধ্যেও হিগস ক্ষেত্রের একটা মান থাকে। অন্য ক্ষেত্রগুলো সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে যেখানে শূন্য মান ধারণ করে সেখানে হিগসের মান আমরা পাই ২৪৬ জিইভি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে হিগসের কি এই একটামাত্র মানে এসেই থেমে যাবার কথা? একটা বল পাহাড়ের শীর্ষ থেকে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকলে সরাসরি মাটিতেই নেমে আসবে এমন কোন কথা নেই, মাটিতে পৌঁছানোর আগে পাহাড়ের খাদে যে কোন জায়গায় আটকে যেতে পারে। আমাদের মহাবিশ্বটাও যদি সেরকম খাদে আটকানো অস্থায়ী অবস্থা হয়? বহু বছর পরে হয়তো সেই খাদ থেকে গড়িয়ে মাটিতে গিয়ে পড়বে, যেখানে হিগস ক্ষেত্রের মান সত্য সত্যই ‘শূন্য’ হবে। শুধু হিগস নয়, স্ট্রিং তত্ত্বের কিছু গণনা থেকেও আন্দাজ করা হচ্ছে যে, আমরা আমাদের মহাবিশ্বকে যে ‘ট্রু ভ্যাকুয়াম’ বা প্রকৃত শূন্যতায় অবস্থান করছে বলে ঢালাওভাবে ভেবে নিচ্ছি, সেটা সঠিক নাও হতে পারে। আমরা হয়তো আরেকটি আপাত শূন্যতার স্তরে বিরাজ করছি অনেকটা পাহাড়ের খাদে আটকানো অবস্থায়। বহু বছর পরে তা হয়তো আপাত শূন্যতার স্তর থেকে গড়িয়ে প্রকৃত শূন্যতায় এসে থামবে।
চিত্র: হিগস কণার সাম্প্রতিক আবিষ্কারের অমিত সম্ভাবনার দ্বার যেমন উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি সেখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে বিভীষিকাময় ধ্বংসের ছায়াও!আমাদের মহাবিশ্ব প্রকৃত শূন্যতায় আছে বলে মনে করা হলেও, হিগসের যে মান আমরা পেয়েছি তাতে করে আমাদের মহাবিশ্বটা আসলে সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে নেই। হয়তো পুরো মহাবিশ্বই অস্থায়ী একটা স্তরে আটকে আছে। হয়তো বহু বছর পরে হয়তো সেই খাদ থেকে গড়িয়ে সর্বনিম্ন শক্তিস্তরের জায়গায় (প্রকৃত শূন্যতায়) চলে আসবে।
সেটা ঘটলে আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্য বিপদ। কারণ পাহাড়ের উদাহরণের মত কেবল গড়িয়ে পড়ার মত এত সরল হবে না ব্যাপারটা, বরং এটা হবে সত্য সত্যই এক মহাবিপর্যয়, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘ক্যাটাস্ট্রফি’। এই মহাবিশ্বকে ধ্বংস করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত আরেকটি ভিন্ন মহাবিশ্বে গিয়ে পৌঁছাবে যেখানে এর অবস্থা শক্তিস্তরের প্রেক্ষাপটে অধিকতর স্থায়ী। ফার্মি ল্যাবের জোসেফ লেকিন এবং ওহাইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার হিল সহ কিছু বিজ্ঞানী গণনা করে দেখেছেন কখন আর কিভাবে এই মহাবিপর্যয় ঘটতে পারে। তাদের গণনা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে এখনই এত চিন্তিত হবার কিছু নেই। এটা ঘটলেও হাজার কোটি বছরের আগে তো নয়[25]।
হিগস ক্ষেত্রের অশূন্য মানের পাশাপাশি হিগসের ভরের ব্যাপারটাও এখানে প্রাসঙ্গিক। সার্নের বিজ্ঞানীরা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে সম্প্রতি যে হিগস কণার সন্ধান পেয়েছেন তার ভর ১২৫ জিইভি। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, হিগসের ভর যদি আরেকটু বেশি হত তাহলে আমরা আরেকটু নিরাপদ থাকতাম, কারণ আমাদের মহাবিশ্ব থাকত সর্বনিম্ন শক্তিস্তরের কাছাকাছি। আর হিগসের ভর যদি আরেকটু হাল্কা হত, তবে অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতো[26]। আমদের খাদের পাশে আরেকটা খাদ হয়তো থাকতো যেটার গভীরতা হত বিশাল। সেখানে মহাবিশ্বের পতন হত প্রায় অবশ্যম্ভাবী। একটা ছোট খাদের পাশে যদি একটা বিরাট বড় খাদ থাকে, তবে ছোট খাদে থাকা বল যে কোন সময়ই গড়িয়ে চলে যেতে পারে বড় খাদের মধ্যে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এসে সেই দুর্যোগ বাড়িয়ে দিয়েছে পুরোমাত্রায়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী, শূন্যস্থানের মধ্যে অনবরত ‘ফ্লাকচুয়েশন’ চলতে থাকে। ফলে যে কোন সময়ই বলের পক্ষে কোয়ান্টাম টানেলিং-এর ফাঁক গলে উচ্চশক্তিস্তরের অবস্থান থেকে নিম্নশক্তিস্তরের জায়গায় চলে যেতে পারে। হিগসের ভর কম হলে সেটা ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যেত অনেক। তার তুলনায় হিগসের মান সমেত যে মহাবিশ্বে আমরা বাস করছি, তা অনেক নিরাপদ, তারপরেও একেবারে শঙ্কামুক্ত তা বলে যাবে না।
বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার জীবদ্দশায় মহাবিশ্বের মহাশৈত্য কিংবা হিগসের শীতল মৃত্যুর সাথে পরিচিত হতে পারেননি। কিন্তু বিবর্তন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তখনই ডারউইন বুঝেছিলেন যেখানে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে শতকরা নিরানব্বই ভাগ প্রজাতিই কোন না কোন সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়, সেখানে মানুষের ভবিষ্যৎও খুব বেশি আশাব্যঞ্জক কিছু নয়। তাই তিনি তার একটি রচনায় বলেছিলেন[27],
‘ভবিষ্যতের মানুষ অনেক বেশি নিখুঁত হয়ে উঠবে, এটা হয়ত বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু পাশাপাশি এক অসহনীয় চিন্তাও মনের আঙ্গিনায় উঁকি দিতে শুরু করে যে, সে এবং ভবিষ্যতের অন্যান্য সংবেদনশীল প্রজাতিরা একটা মহাজাগতিক ধীর প্রক্রিয়ায় ক্রমশঃ বিলীন হয়ে যাবে’।
দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিক ডব্লিউ ম্যাপ থেকে পাওয়া সাম্প্রতিক মহাজাগতিক উপাত্তগুলো যেন ডারউইনের সেই ভয়াল দুঃস্বপ্নকে সত্যতা দিতে চলেছে। যে ডব্লিউ ম্যাপ ডেটা থেকে আমরা বিগ ব্যাং এর আলামত পাই, সেই ডেটা থেকেই আবার আমরা আলামত পেতে শুরু করেছি – এই মহাবিশ্ব ধীর প্রক্রিয়ায় একটা সময় বিলীন হয়ে যাবে। শূন্য থেকে জন্ম হওয়া এই মহাবিশ্ব একসময় হারিয়ে যাবে শূন্যতারই গহীন গহ্বরে। বিখ্যাত মুক্তমনা লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স সেজন্যই বলতেন, ‘আহ … যারা এই মহাবিশ্বের মধ্যে বাস করে ভাবছেন আমরা ‘বিশাল কিছু’র মধ্যে আছি… তারা একটু অপেক্ষা করেন; শূন্যতার সংঘাত আমাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে’।
মহাবিশ্বের এই অন্তিম পরিণতির ধারণাগুলো হয়তো আমাদের নৈরাশ্যবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের কাজ কেবল মিথ্যা প্রবোধ বা সান্ত্বনা দেয়া নয়। সত্যনিষ্ঠ ভাবে বাস্তবতার মুখোমুখি করানোও বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব। বাস্তবতা রূঢ় বা কঠিন হলে সেটাকে মিথ্যার ‘সান্ত্বনার প্রলেপ’ না লাগিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ভাবেই সেটাকে বর্ণনা করেন তারা। আমাদের প্রকৃতি, আমাদের মহাবিশ্ব যেমন, ঠিক তেমনিভাবেই একে ব্যাখ্যা করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সত্য যে কঠিন,কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা’।
হাইপারস্পেসে পাড়ি
বিজ্ঞানীরা ‘কঠিনেরে ভালবাসেন’ বটে কিন্তু দিনশেষে তারাও রক্তমাংসেরই মানুষ। আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো তারাও রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ দুর্দশা আর আবেগে কম বেশি আক্রান্ত হন। মহাবিশ্বের নৈরাশ্যকর পরিণতি, সেটা যত কোটি বছর পরেই ঘটুক না কেন, তা তাদের আলোড়িত করে। কিছু বিজ্ঞানী এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের কোন পন্থা পাওয়া যায় কিনা সেটা খুঁজে দেখতে।
কিছু আশাবাদী সমাধান সত্যই পাওয়া গেছে, যদিও সেগুলো এখনো তত্ত্বকথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নিউইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিচিও কাকু তার জনপ্রিয় বই ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ডাস’[28] এবং ‘ফিজিক্স অব দ্য ইমপসিবল’[29] গ্রন্থ দুটিতে অন্তিম পরিণতি থেকে মুক্তির কিছু আকর্ষণীয় সমাধানের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন।
মিচিও কাকু মনে করেন, যতদিনে মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি ঘটার সম্ভাবনা আসবে, অর্থাৎ হাজার কোটি বছর পরে – ততদিনে মানব সভ্যতা জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং কারিগরি দক্ষতায় এগিয়ে থাকবে অনেকদূর। আমাদের সভ্যতা যদি কারিগরি দক্ষতায় ‘পর্যায় ১’ ধরনের হয়, তবে, সে সময়কার অধিবাসীরা হবে অন্তত ‘পর্যায় ৩’ ধরনের। সে সময়ের অধিবাসীরা চোখের সামনে মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি ঘটতে দেখেও হয়তো চোখ বুজে বসে থাকবে না। তারা তখন কারিগরি দক্ষতায় এতোই উন্নত থাকবে যে, হয়তো প্রায় আলোর বেগে মহাকাশযানে চলাচল করবে, সময় পরিভ্রমণের উপায় বাতলে ফেলবে, কৃষ্ণগহবর কিংবা গুপ্তশক্তি থেকে শক্তি আহরণ করবে, আর ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে ‘হাইপারডাইভ’ দিয়ে ভিন্ন মহাবিশ্বে পৌঁছিয়ে যাবে।
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, ‘ওয়ার্মহোল যদি থেকে থাকে তবে, সেটা হবে স্থান এবং সময় পরিভ্রমণের জন্য আদর্শ’। ভবিষ্যতের অধিবাসীরা হয়তো ওয়ার্মহোলকে ব্যবহার করে মৃত্যুন্মুখ মৃতপ্রায় মহাবিশ্বকে ফেলে আস্তানা গাড়বে কোন ‘সজীব’ মহাবিশ্বে। কিংবা হয়তো স্টারট্রেকের ক্যাপ্টেন কার্কের মতোই নিজেকে ‘টেলিপোর্টেশন’ করে চলে যাবে আমাদের মহাবিশ্বের বাইরের কোন পৃথিবীতে।
আজকের সময় ব্যাপারগুলো ‘অসম্ভব’ কিংবা ‘আজগুবি’ মনে হলেও হয়ত ভবিষ্যতের পৃথিবীতে সেগুলো আর সেরকমের কিছু থাকবে না। আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকেই অবশ্য আমরা এর কিছুটা আঁচ পাই। একটা সময় যে ব্যাপারগুলো অসম্ভব বলে ভাবা হত, তার অনেক কিছুই বর্তমানে খুব স্বাভাবিক’ হিসেবে আমরা গ্রহণ করছি, সেসব প্রযুক্তির সুফলও ভোগ করছি পুরোদমে। শুধু আমাদের মতো ছাপোষা সাধারণেরা ‘অসম্ভব’ বলে বাতিল করলে না হয় মানা যেত, অনেক রথী মহারথীরাই কালের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারেননি। অনেক কিছুই তারা ঢালাওভাবে অবাস্তব কিংবা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, যেগুলো পরবর্তী পৃথিবীতে হাজির হয়েছিল খুব সাধারণ বাস্তবতা হিসেবে। যেমন, ভিক্টরিয় যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ উইলিয়াম থমসনের কথা আমরা সাবাই জানি। পদার্থবিজ্ঞানে তার অসামান্য অবদানের কারণে তাঁকে ‘লর্ড কেলভিন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিলো। তিনি ভবিষ্যতে উড়োজাহাজ আবিষ্কারের সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়ে ১৮৯৫ সালে বলেছিলেন, “বাতাসের চেয়ে ভারী বস্তু উড়বে না”। ১৮৯৭ সালে তিনি বলেছিলেন “রেডিওর কোন ভবিষ্যৎ নেই”। আর ১৯০০ সালে বলেছিলেন, “পদার্থবিজ্ঞানে যা আবিষ্কার করার সব কিছুই আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, নতুন কিছু আর আবিষ্কার করার কিছু নেই”। ‘এক্সরে’ ছিলো কেলভিনের মতে ‘হোক্স’। বিজ্ঞানী লর্ড রাদারফোর্ড যিনি নিউক্লিয়াসের চারিদিকে ইলেকট্রনের পরিভ্রমণের সেই ‘পরমাণুর রাদারফোর্ড’ মডেলের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন, তিনি আণবিক বোমা বানানোকে অসম্ভব বলে মনে করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন পরমাণু ভেঙে যে শক্তি পাওয়া যাবে তা এতই দুর্বল হবে যে সেটা চাঁদের আলোর চেয়ে বেশি কিছু নয়। এমনকি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও ১৯৩০ সালে পর্যন্ত ঢালাওভাবে ভাবতেন, আণবিক বোমা কখনোই বানানো যাবে না। তিনি কৃষ্ণগহবরের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও সন্দিহান ছিলেন সারা জীবন ধরে। আজ আমরা জানি তাদের কালে এব্যাপারগুলো অসম্ভব মনে হলেও, আজকের পৃথিবীতে তা নয়। বরং তাদের এইসব ‘অপরিণামদর্শী’ উক্তিগুলো এখন হাসির খোরাক।
আমি বছর খানেক আগে মুক্তমনায় ‘অসম্ভবের বিজ্ঞান’ নামে একটা সিরিজ লিখতে শুরু করেছিলাম[30]। সেখানে বলেছিলাম, মাত্র বছর কয়েক আগেও যে বিষয়গুলোকে ‘অসম্ভব’ বলে ভাবা হত, ধরে নেওয়া হত স্রেফ আধি-ভৌতিক ফ্যান্টাসি হিসবে, তার অনেকগুলোই আমাদের চোখের সামনেই বাস্তবতা পেতে চলেছে। হ্যারি পটারের ‘ইনভিজিবল ক্লোক’ও আর বিজ্ঞানীদের জন্য আজ আর আকাশ কুসুম কল্পনার বিষয় নয়, মেটা-পদার্থ নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার অগ্রগতি কল্পকাহিনীকে নিয়ে এসেছে বাস্তবতার খুব কাছাকাছি[31]। এই টেলিপোর্টেশনের কথাই ধরা যাক। এটাকে কেবল স্টারট্রেকের মত সিনেমায় দেখানো সায়েন্স ফিকশন বলেই এতদিন মনে করতেন সবাই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আজ নিশ্চিত করে বলছেন – টেলিপোর্টেশন সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ কাউন্সিলের কোয়ান্টাম- অ্যাটম অপটিক্স ল্যাবের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আণবিক স্কেলে সফলভাবে টেলিপোর্ট করে দেখিয়েছেন। আরেক বিজ্ঞানীর দল ফোটনকে ‘টেলিপোর্ট’ করে পাঠাতে পেরেছেন দানিয়ুব নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন কয়েক দশকের মধ্যেই ভাইরাসের মত ‘জটিল’ অণু কিংবা আমাদের ডিএনএ টেলিপোর্ট করা সম্ভব হবে। কিন্তু স্টারট্রেকে যেরকম দেখানো হয়েছে সেরকম পূর্ণ অবয়বের টেলিপোর্ট যন্ত্র বানাতে হয়ত বিজ্ঞানীদের লেগে যাবে শ’খানেক বছর। তা লাগুক। অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবে যে টেলিপোর্টেশন আর ‘অসম্ভব’ কোন বিষয় না তা কিন্তু বুঝতে পারা যাচ্ছে এখনই। আশা করতে কোন দোষ নেই লক্ষ কোটি বছর পরে আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের মানুষেরা টেলিপোর্টেশন প্রযুক্তির স্বর্ণ শিখরে পৌছিয়ে যাবে, নিশ্চয়তা দেবে কেবল গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে পরিভ্রমণের নয়, এক মহাবিশ্ব থেকে অন্য মহাবিশ্বে পরিভ্রমণেরও।
যে ভাবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা দু লাখ বছর আগে একটা সময় আফ্রিকার গহীন বনে উদ্ভূত হয়ে ধীরে ধীরে সাড়া পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল আহার আর বাসস্থানের তাগিদে, ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের উত্তরসূরিরাও হয়তো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে একটা সময় পা রাখবে আন্তঃনাক্ষত্রিক পরিমণ্ডলে, এবং এক সময় হয়তো এই মহাবিশ্বেরও মায়া কাটিয়ে পাড়ি দেবে ভিন্ন কোন মহাবিশ্বে। খুঁজে নেবে হাজারো মাল্টিভার্সের মাঝে লুকিয়ে থাকা কোন এক ‘দ্বিতীয় পৃথিবী’। মহাজাগতিক উপনিবেশের জন্য নয়, হয়তো অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই। এভাবেই হয়তো পূর্ণতা পাবে কোপার্নিকাস এবং ডারউইনের ‘অসমাপ্ত বিপ্লবের’। কবে সেটা? হাজার বছর, লক্ষ বছর নাকি কোটি বছর পরে? আমরা কেউ তা জানি না। আমি বা আপনি কেউ বেঁচে থাকব না সে সময়, ‘বেঁচে রবে আমাদের স্বপ্ন তখন’। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় –
‘তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে
পৃথিবীর সব গল্প ফুরাবে যখন,
মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন।…’
:line:
তথ্যসূত্র:
[1] Michio Kaku, Parallel Worlds: A Journey Through Creation, Higher Dimensions, and the Future of the Cosmos, 2006
[2] J. N. Islam, Possible Ultimate Fate of the Universe, Quarterly Journal of the Royal Astronomical Society, Vol. 18 (3), 1977.
[3] J. N. Islam, The long-term future of the Universe, Vistas in Astronomy, Vol. 23 (265), 1979
[4] J. N. Islam, The Ultimate Fate of the Universe,, Sky & Telescope 57, 1979.
[5] Freeman J. Dyson, Time without End: Physics and Biology in an Open Universe. Reviews of Modern Physics, Vol. 51, No. 3, pages 447–460; July 1979.
[6] Steven Weinberg, The First Three Minutes: A Modern View Of The Origin Of The Universe, Basic Books, 1993
[7] “…But few cosmologists thought through the other implications for life in an ever expanding universe, until a classic paper in 1979 by physicist Freeman Dyson of the Institute for Advanced Study in Princeton, N.J., itself motivated by earlier work by Jamal Islam, now at the University of Chittagong in Bangladesh” [Lawrence M. Krauss and Glenn D. Starkman, The Fate of Life in the Universe, Scientific American, November 1999].
[8] Paul Davies, The Last Three Minutes: Conjectures About The Ultimate Fate Of The Universe, New York, New York, Basic Books, 1994
[9] উদাহরণ হিসেবে দেখুন, Paul Davies, God and the New Physics, Simon & Schuster; First Edition edition, 1983
[10] Alan H Guth, The Inflationary Universe. New York: Addison Wesley, 1997: pp 22.
[11] অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫ (পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ ২০০৬)
[12] Guido D’Amico, Marc Kamionkowski and Kris Sigurdson, “Dark Matter Astrophysics”, in Dark Matter and Dark Energy: A Challenge for Modern Cosmology, ed. Sabino Matarrese, Monica Colpi, Vittorio Gorini and Ugo Moschella, Springer, 2011
[13] Victor J. Stenger, God and the Atom, Prometheus Books, 2013
[14] Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang, 2007
[15] Paul J. Steinhardt and Neil Turok, A Cyclic Model of the Universe, Science, Vol. 296, No. 5572, May 24, 2002.
[16] Paul J. Steinhardt and Neil Turok, Endless Universe: Beyond the Big Bang, Doubleday, 2007
[17] Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang, 2007
[18] Sean Carroll (California Institute of Technology), What is Dark Energy?, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
[19] Mario Livio (Space Telescope Science Institute), What is the Fate of Our Universe?, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
[20] Chris Impey, How It Ends: From You to the Universe, W. W. Norton & Company; Reprint edition, 2011
[21] Paul Davies, The Last Three Minutes: Conjectures About The Ultimate Fate Of The Universe, New York, New York, Basic Books, 1994
[22] Lawrence M. Krauss and Robert J. Scherrer, The Return of a Static Universe and the End of Cosmology. Journal of General Relativity, and Gravitation, Vol. 39, No. 10,pp 1545–1550, 2007.
[23] Lawrence M. Krauss and Robert J. Scherrer, The End of Cosmology?, Scientific American, February 25, 2008
[24] Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Atria Books, 2012
[25] “This calculation tells you that many tens of billions of years from now there’ll be a catastrophe,” Joseph Lykken, a theoretical physicist at the Fermi National Accelerator Laboratory in Batavia, Ill., said Monday (Feb. 18,2013) here at the annual meeting of the American Association for the Advancement of Science. [Clara Moskowitz,
Higgs Boson Particle May Spell Doom For the Universe, LiveScience Senior Writer, February 19, 2013]
[26] Sean Carroll, The Particle at the End of the Universe: How the Hunt for the Higgs Boson Leads Us to the Edge of a New World [Paperback ed., with a new epilogue], Plume, 2013
[27] Charles Darwin, Religion, volume I, chapter VIII, pp 312.
[28] Michio Kaku, Parallel Worlds: A Journey Through Creation, Higher Dimensions, and the Future of the Cosmos, Anchor, 2006
[29] Physics of the Impossible: A Scientific Exploration into the World of Phasers, Force Fields, Teleportation, and Time Travel, Anchor, 2009
[30] অভিজিৎ রায়, অসম্ভবের বিজ্ঞান, মুক্তমনা, অক্টোবর ১৫, ২০০৮
[31] Cavan Sieczkowsk, ‘Perfect’ Invisibility Cloak Uses Metamaterials To Bend Light, The Huffington Post, Posted: 11/12/2012.
অামার লেখা এই গবেষণামূলক প্রবন্ধটি যদি অাপনাদের ভাল লেগে থাকে তাহলে এটি অাপনাদের ব্লগে প্রকাশ করুন। ধন্যবাদ।
পদার্থ সৃষ্টির উদ্দেশ্য
লেখক: রাকিব হাসান
রাতের অাকাশের দিকে তাকালেই লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের হাতছানি চোখে পড়ে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নক্ষত্র সজ্জিত সুবিশাল এই অাকাশের প্রতি অাকৃষ্ট হয়েছে, চেষ্টা করেছে রাতের রহস্যময় এই অাকাশের রহস্যগুলোকে উন্মোচিত করতে। প্রাচীনকালে মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ছিল অত্যন্ত সীমিত। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মহাবিশ্বের অনেক নতুন রহস্য সম্পর্কে মানুষ জানতে পেরেছে, সেই সাথে প্রচলিত অনেক ভুল ধারণারও অবসান ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ- অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবীই অামাদের সৌরজগতের কেন্দ্র এবং সূর্য ও অন্যান্য গ্রহগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে বিজ্ঞানী টলেমী পৃথিবী কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের একটি প্রতিরূপ গঠন করেন। খ্রিষ্টীয় চার্চ টলেমীর এই প্রতিরূপটিকে স্বীকৃতি দেয়, ফলে পৃথিবী কেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই ধারণাটি এতটাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল যে পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে এই ধারণার বিরোধী কোন মতবাদ উপস্থাপিত হয়নি। ষষ্টদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস গ্রহ ও নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের সময় বুঝতে পারেন, পৃথিবী নয় বরং সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্র এবং পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। তিনি তার এই মতবাদ ১৫৪৩ সালে “অন দ্য রেভ্যুলেশনস অব দ্য হেভেনলি স্ফিয়ারস” নামক বইয়ে প্রকাশ করেন। কিন্তু পাদ্রীদের বিরোধীতায় বইটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এবং বিজ্ঞানী কেপলার দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে গ্রহ ও উপগ্রহগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে কোপার্নিকাসের ধারণায় সঠিক ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতেই পৃথিবী কেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণার বিলুপ্তি ঘটে। সূর্যের চারিদিকে গ্রহগুলোর গতিবেগ ব্যাখ্যার জন্য কেপলার তিনটি সূত্র প্রদান করেছিলেন। এর মধ্যে প্রথম সূত্র দুটি ১৬০৯ সালে এবং তৃতীয় সূত্রটি ১৬১৯ সালে প্রকাশিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে অারেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর অাবির্ভাব ঘটে, তিনি অাইজ্যাক নিউটন। বিজ্ঞানী নিউটন তার বিখ্যাত “ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা” গ্রন্থে “মহাকর্ষ সূত্র” ব্যাখ্যা করেন যা ১৬৮৭ সালে প্রকাশিত হয়। মহাকর্ষ সূত্র অাবিষ্কৃত হওয়ার ফলে মহাবিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে। বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে মহাবিশ্ব সম্পর্কে অারও অনেক তথ্য অাবিষ্কৃত হয়। তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে মহাকাশ বিজ্ঞানের বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধিত হয়। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে ধারণা করা হত মহাবিশ্বটি স্থিরাবস্থায় রয়েছে, এর সূচনা সম্পর্কেও উল্লেখযোগ্য কোন মতবাদ প্রচলিত ছিল না। ধারণা করা হত মহাবিশ্বটি অাগে থেকেই এরকম অবস্থাতেই ছিল এবং অনন্তকাল ধরে এই অবস্থাতেই থাকবে। কিন্তু ১৯১৫ সালে বিজ্ঞানী অাইনস্টাইন তার বিখ্যাত “ব্যাপক অপেক্ষবাদ” অাবিষ্কার করেন। ব্যাপক অপেক্ষবাদে কোন কিছুই স্থির নয়। এই অাবিষ্কার মহাবিশ্ব সম্পর্কে সেসময় প্রচলিত ধারণাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়। ফলে বিজ্ঞানী অাইনস্টাইনের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৯ সালে বিজ্ঞানী হাবলের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় যে মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। তিনি লক্ষ্য করেন যে পৃথিবী থেকে যেই ছায়াপথ যত বেশি দূরত্বে অবস্থিত তা তত অধিক বেগে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। হাবলের পূর্বেও অনেক বিজ্ঞানী সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন কিন্তু হাবলই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এর স্বপক্ষে একটি পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ উপস্থাপন করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর অারেকজন অালোচিত বিজ্ঞানী ছিলেন জর্জ লেমাইট্রি। তিনি প্রস্তাব করেন, যেহেতু মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং ছায়াপথগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তাই অতীতে কোন এক সময় এরা একত্রিত ছিল। তার মতে ছায়াপথগুলোর এই অাদি একত্রিত অবস্থা ছিল মূলত একটি অাদি পরমানু। এই অাদি পরমানু থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। জর্জ লেমাইট্রির এই ধারণায় অাধুনিক মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের মূল ভিত্তি। এই তত্ত্ব অনুসারে অানুমানিক ১৩৭৭ কোটি বছর পূর্বে মহাবিশ্বটি অতি উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল, তখন এর অায়তন ছিল প্রায় শূন্য এবং ঘনত্ব ছিল প্রায় অসীম। অাদি এই অবস্থাটিকে বলা হয় অনন্যতা। অনন্যতায় পদার্থবিজ্ঞানের সকল সূত্র ভেঙে পড়ে। তাই অাজও এটিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে শুধু শক্তিই মুক্ত হয়নি, বরং এখান থেকেই স্থান ও কালেরও সৃষ্টি হয়েছিল। মহাবিস্ফোরণের পর মূহূর্ত্ব থেকেই মহাবিশ্বটি সম্প্রসারিত হতে শুরু করে যা অাজও অব্যাহত অাছে। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে শুরু করলে এর তাপমাত্রাও হ্রাস পেতে থাকে, ফলে শক্তি কণিকা ও কোয়ার্ক এ রূপান্তরিত হতে শুরু করে। কোয়ার্ক হলো পরমানুর সবচেয়ে ক্ষুদ্র গাঠনিক উপাদান। প্রোটন ও নিউট্রনের মত মৌলিক কণিকাগুলো তিনটি কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে প্রোটন দুটি অাপ- কোয়ার্ক ও একটি ডাউন-কোয়ার্ক এবং নিউট্রন একটি অাপ-কোয়ার্ক ও দুটি ডাউন- কোয়ার্ক নিয়ে গঠিত। তবে ইলেকট্রন নিজেই পরমানুর ক্ষুদ্রতম গাঠনিক উপাদান, এটি কোন কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত নয়। পরবর্তীতে মৌলিক কণিকাগুলো একত্রিত হয়ে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমানু গঠন করে। এরপর এই হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমানুগুলো একত্রিত হয়ে ধূলিমেঘ গঠন করে। ধূলিমেঘের ভর যত বাড়তে থাকে, এর মহাকর্ষ বলও ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় ধূলিমেঘগুলো তাদের নিজের মহাকর্ষ বলের প্রভাবেই সংকুচিত হতে শুরু করে। সংকোচনের ফলে ধূলিমেঘের পরমাণুগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের হার বেড়ে যায়, ফলশ্রুতিতে তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে। একসময় তাপমাত্রা এতটা বেড়ে যায় যে হাইড্রোজেন পরমানুগুলোর মধ্যে নিউক্লিয় ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয়। অার এভাবেই জন্ম হয় নক্ষত্রের। অগণিত নক্ষত্র তাদের মহাকর্ষ বল দ্বারা একত্রিত হয়ে গঠন করে ছায়াপথ। অামাদের মহাবিশ্বে ছায়াপথের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার কোটি থেকে বিশ হাজার কোটি। তাদের মধ্যে একটি ছায়াপথ হলো অামাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথ যা অাকাশগঙ্গা নামেও পরিচিত। এটি অানুমানিক ১৩০০ কোটি বছর পূর্বে গঠিত হয়েছিল। শুধু মিল্কিওয়ে ছায়াপথেই প্রায় বিশ হাজার কোটি নক্ষত্র রয়েছে। যদি একটি ছায়াপথেই এতগুলো নক্ষত্র থেকে থাকে, তাহলে সমগ্র মহাবিশ্বে মোট কতগুলো নক্ষত্র অাছে তা অামাদের কল্পনারও বাইরে। এই নক্ষত্রগুলোর অায়ুষ্কাল কয়েক লক্ষ থেকে কয়েক হাজার কোটি বছর পর্যন্ত হতে পারে। অপেক্ষাকৃত বড় ও উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর অায়ুষ্কাল তুলনামূলকভাবে কম। ভরের পার্থক্যের ভিত্তিতে নক্ষত্রের পরিণতিও বিভিন্ন। অায়ুষ্কাল শেষে যেসব নক্ষত্রের ভর ১.৪ সৌরভরের চেয়ে কম থাকে তারা সাধারনত শ্বেত বামনে পরিণত হয়। অার যেসব নক্ষত্রের ভর ১.৪ সৌরভরের চেয়ে বেশি থাকে তারা সুপারনোভার মাধ্যমে নিউট্রন তারকায় পরিণত হয়। ১.৪ সৌর ভরকে বলা হয় চন্দ্রশেখর সীমা। ১৯৩১ সালে বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর দেখান যে, একটি শ্বেত বামন নক্ষত্রের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ভর ১.৪ সৌর ভরের সমান। অর্থাৎ কোন নক্ষত্রের ভর ১.৪ সৌরভরের চেয়ে বেশি হলে তা কখনোই শ্বেত বামনে পরিণত হবে না। অাবার যেসব নক্ষত্রের ভর ৩ সৌরভরের চেয়ে বেশি, অায়ুষ্কাল শেষে এসব নক্ষত্রের মহাকর্ষ বল এতটাই শক্তিশালী হবে যে তারা নিজেদের মহাকর্ষ বলের প্রভাবেই সংকুচিত হয়ে এমন একটি অঞ্চলে পরিণত হবে, যেখান থেকে অালোক রশ্মিও বেরিয়ে অাসতে পারে না। নক্ষত্রের এরূপ পরিণতিকে বলা হয় কৃষ্ণবিবর। অাইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ থেকেই কৃষ্ণবিবর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কৃষ্ণবিবরের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকে যেই সীমার ভেতরে মহাকর্ষীয় বল এতটাই শক্তিশালী যে এই সীমার ভেতরে অবস্থিত কোন কিছুই সীমাটিকে অতিক্রম করে বাইরে বেরিয়ে অাসতে পারে না, এমনকি তড়িৎচৌম্বকীয় বিকিরণও নয়। এই সীমাটিকে বলা হয় “ঘটনা দিগন্ত”। কিন্তু ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং গাণিতিকভাবে দেখান যে, কৃষ্ণবিবর থেকেও বিকিরণ সম্ভব এবং তা নিয়মিত হচ্ছে। এর অাগে বিজ্ঞানী বেকেনস্টাইন দীর্ঘদিন কৃষ্ণবিবর নিয়ে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে অাসেন যে কৃষ্ণবিবরেরও একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও এনট্রপি অাছে। অধিকাংশ ছায়াপথের কেন্দ্রেই একটি বিশালাকৃতির কৃষ্ণবিবর রয়েছে। যাই হোক, মহাবিশ্বের উপাদানগুলোকে মোট পাচটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে-১) অনন্যতা ২) স্থান ৩) কাল ৪) শক্তি এবং ৫) পদার্থ। অনন্যতা মহাবিশ্বের প্রথম উপাদান যেখান থেকেই মহাবিশ্বের সূচনা ঘটেছিল। বর্তমান মহাবিশ্বে যেসব কৃষ্ণবিবর রয়েছে তাদের কেন্দ্রেও অনন্যতার অস্তিত্ব থাকতে পারে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে অপেক্ষবাদ অনুসারে কৃষ্ণবিবরের কেন্দ্রে অসীম ঘনত্ব বিশিষ্ট অনন্যতা থাকতেই হবে। মহাবিশ্বের দ্বিতীয় উপাদানটি হল স্থান। মহাবিস্ফোরণ থেকেই স্থান সৃষ্টি হয়েছিল এবং এটি তখন থেকেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। স্থান ত্রিমাত্রিক এবং এটি মহাবিশ্বের অন্যান্য উপাদানগুলোকে ধারণ করে অাছে। কাল মহাবিশ্বের একটি বিতর্কিত উপাদান। কাল বলতে অাদৌ কোন উপাদানের অস্তিত্ব অাছে কি নেই, তা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। তবে ব্যাপক অপেক্ষবাদে স্থান ও কালকে সম্মিলিতভাবে একটি চতুর্মাত্রিক কাঠামো হিসেবে অাখ্যায়িত করা হয়েছে। মহাবিস্ফোরণের পূর্বে কালের কোন অস্তিত্ব ছিল না। শক্তি মহাবিশ্বের চতুর্থ ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শক্তি থেকেই পদার্থ সৃষ্টি হয়েছিল। এছাড়া মহাবিশ্বের প্রায় ৭০% ই ডার্ক এন্যার্জি বা অদৃশ্য শক্তি। ধারণা করা হয় যে এই শক্তিই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হারকে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করছে। মহাবিশ্বের সর্বশেষ উপাদানটি হলো পদার্থ। মহাবিশ্বের প্রায় ৩০% পদার্থ, যার মধ্যে দৃশ্যমান পদার্থ মাত্র ৫% এবং বাকি ২৫% ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য পদার্থ। মহাবিশ্বের প্রথম চারটি উপাদান মহাবিস্ফোরণের সাথে সম্পর্কিত হলেও পদার্থ মহাবিস্ফোরণের অনেক পরে সৃষ্টি হয়েছিল। এই পদার্থগুলো উদ্দেশ্যহীন ভাবে সৃষ্টি হয়নি, বরং এদের সৃষ্টি হওয়ার পেছনে ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। হাবলের পর্যবেক্ষণ থেকে অামরা জানতে পেরেছি যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু এই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বলতে অাসলে কি বুঝায়? মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বলতে মূলত স্থানের সম্প্রসারণকেই বুঝানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- একটি বেলুনের সম্প্রসারণের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। ধরা যাক, একটি বেলুনকে ফুলানো হচ্ছে এবং এর পৃষ্টতলের দুটি বিন্দু/ক্ষুদ্র দাগ যা পরস্পরের খুব নিকটে অবস্থিত, পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখন বেলুনটিকে যত ফুলানো হবে, বিন্দু দুটি পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবে। ঠিক এই ঘটনায় ঘটে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও। অাগেই বলেছি যে স্থান মহাবিশ্বের এমন একটি উপাদান যা অন্যান্য উপাদানগুলোকে ধারণ করে অাছে। স্থানের মধ্যে পদার্থগুলো ছড়িয়ে- ছিটিয়ে অাছে। তাই স্থানের সম্প্রসারণের সাথে সাথে পদার্থগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সেজন্যই অামাদের কাছে মনে হয় ছায়াপথগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তবে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে এই সম্প্রসারণের কোন প্রভাব নেই। তাই স্থান সম্প্রসারিত হলেও পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। অামরা জানি অনন্যতায় স্থানের ঘনত্ব প্রায় অসীম। মহাবিস্ফোরণের পর থেকেই স্থান সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এই সম্প্রসারণের হার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এসব ঘটনা থেকে অামরা স্থানের একটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। যেই উপাদানটি প্রায় অসীম ঘনত্ব লাভ করতে পারে, অতঃপর সেই অবস্থা থেকে সম্প্রসারিত হতে পারে, এমনকি পদার্থও যাতে বক্রতা সৃষ্টি করতে পারে, নিশ্চয় সেই উপাদানের স্থিতিস্থাপকতা ধর্ম অাছে। যেমন একটি বেলুনকে সংকুচিত করে এর ঘনত্ব বাড়ানো যায়, একে টেনে প্রসারিত করা যায়, অাবার এর পৃষ্ঠতলে কোন বিন্দুতে চাপ প্রয়োগ করে এতে বক্রতাও সৃষ্টি করা যায়। যদিও স্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি উপাদান, তবুও এসব ঘটনা স্থানের স্থিতিস্থাপকতাকেই নির্দেশ করছে। অার তাই স্থান যখন সম্প্রসারিত হচ্ছে, নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্রানুসারে, এর বিরোধী একটি সংকোচনধর্মী প্রতিক্রিয়া বল সৃষ্টি হবে, যা স্থানকে সংকুচিত করতে চাইবে। এই অবস্থায় স্থানকে অারও অধিক বেগে সম্প্রসারিত করার জন্য বিপুল পরিমান “অদৃশ্য শক্তির” প্রয়োজন। কিন্তু মহাবিশ্বে অদৃশ্য শক্তির পরিমাণ ৭০% যা অপরিবর্তিত রয়েছে। এই অবস্থায় স্থান কেবলমাত্র তখনই অারও অধিক বেগে সম্প্রসারিত হতে পারবে যদি এর সংকোচনধর্মী প্রতিক্রিয়া বলকে প্রশমিত করা যায়। অার পদার্থগুলো ঠিক এই কাজটিই করছে। পদার্থগুলো স্থানের এই সংকোচনধর্মী প্রতিক্রিয়া বলকে প্রশমিত করছে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, স্থানের তুলনায় পদার্থের পরিমাণ নগন্য হওয়া সত্ত্বেও কি করে এই বিশাল স্থানের সংকোচনধর্মী প্রতিক্রিয়া বলকে প্রশমিত করছে? এর স্বপক্ষে দুটি যুক্তি উপস্থাপন করা যেতে পারে। প্রথমত, পদার্থের পরিমাণ মোটেও নগন্য নয়। মহাবিশ্বের প্রায় ৩০%ই পদার্থ। এর মধ্যে দৃশ্যমান পদার্থ প্রায় ৫% অার অদৃশ্য পদার্থ প্রায় ২৫%। এই পরিমাণ পদার্থ স্থানের সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাই মহাবিশ্বের সর্বত্রই স্থানের সংকোচনধর্মী প্রতিক্রিয়া বলকে প্রশমিত করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পদার্থ থাকার সম্ভাবনাই বেশি। দ্বিতীয়ত, এই বিশাল স্থান যে পরিমাণ সংকোচনধর্মী প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করবে তাকে প্রশমিত করা পদার্থের পক্ষে অসম্ভব কিছু না। অামাদের মনে রাখা উচিত যে স্থানের সম্প্রসারণের হার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। অথচ এই সম্প্রসারণ মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রকে তেমন প্রভাবিতই করতে পারে না। তাহলে এর প্রতিক্রিয়া বলও মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করতে পারবে না, বরং মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে বাধা পেয়ে বলটি প্রশমিত হয়ে যাবে, যা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। স্থানের এই “সংকোচনধর্মী প্রতিক্রিয়া বল” বলতে অাদৌ কোন কিছুর অস্তিত্ব অাছে কি না, তার জন্য একটি পর্যবেক্ষণমূলক পরীক্ষা করা যেতে পারে। অামরা যদি ছায়াপথের পরিধির দিকের কোন নক্ষত্রের কক্ষপথ পর্যবেক্ষণ করি অথবা কোন সর্পিলাকার ছায়াপথের বাহুর প্রান্তের কোন নক্ষত্রের কক্ষপথ পর্যবেক্ষণ করি, যেখানে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র অতটা শক্তিশালী নয়, তাহলে দেখা যাবে এই বল নক্ষত্রটির কক্ষপথকে প্রভাবিত করছে। অর্থাৎ নক্ষত্রটির কক্ষপথ স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা ভিন্নতর হবে। যদি কোন বিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই ঘটনাটি অাবিষ্কার করতে পারে, তবে অামার ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক বলে প্রমাণিত হবে এবং হয়ত অামি বাংলাদেশের পক্ষে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরষ্কার জিততে সক্ষম হবো। অামার দৃঢ় বিশ্বাস পদার্থগুলো উদ্দেশ্যহীন ভাবে সৃষ্টি হয়নি। এরা স্থানের সংকোচনধর্মী প্রতিক্রিয়া বলকে প্রশমিত করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল, অার এটাই ছিল পদার্থ সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
মুগ্ধ হয়ে একটানা পড়ে গেলাম। সুন্দর লিখেছেন (F)
সত্যি কত অদ্ভুত এই মহাবিশ্ব। মহাবিশ্বের মধ্যবর্তী শূন্যস্থান নিয়ে আমার নিজের একটি চিন্তা আছে। আমার মতে এই শুন্যস্থান আসলে একধরণের কণাতে পূর্ণ, যার নাম STP ( space time particles) মাছ যেমন পানির অণুতে পূর্ণ পুকুরে বাস করে, আমরা তেমনি STP তে পূর্ণ এই মহাবিশ্বে বাস করি। সবেমাত্র আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া ছাত্র। ভবিষ্যতে এ নিয়ে গবেষণা আমার আকৈশোর স্বপ্ন। 😉
তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে
পৃথিবীর সব গল্প ফুরাবে যখন,
মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন।…’
অসাধারণ! অনেকদিন অভিজিতদার লেখার অপেক্ষায় ছিলাম। পেয়ে অনেকটা তৃষ্ণা দূর হল। ধন্যবাদ আবার। আপনার লেখার অপেক্ষায় কতটা তৃষ্ণার্ত থাকি বলে বোঝাতে পারবনা। মুক্ত-মনা যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই স্বপ্নের দিনের অপেক্ষায় আছি। আর সেটাই বেচে থাকার প্রেরণা যোগায়।
(Y) (Y) (Y)
অভিজিৎদা,
এতোক্ষন বিজ্ঞান পড়লাম নাকি অনিন্দ্যসুন্দর এক কাব্য পড়লাম তা ঠিক এখনো বুঝে উঠতে পারিনি! আপনার আঙ্গুলের আগা গুলো স্বপ্নের উচ্ছ্বাসে ভরা! তাও আবার যাতা নয়, একেবারে প্রশ্নাতীত তথ্যের মোড়কে তৃষ্ণার্ত চাতকের জন্যে এক এক ফোটা জল! একটা প্রশ্ন আছে কিন্তু…! “হিগস – মৃত্যুর শীতল ছাঁয়া” থেকে।
এখানে রেখাচিত্রের আনুভূমিক প্রবাহ যদি মহাবিশ্বের অগ্রসরমানতা (সময়) হয় আর বাঁয়ে উল্লম্ব রেখাটি যদি শক্তির পরিমান নির্দ্দেশ করে তবে বর্তমান আপাতঃ শূন্যতা থেকে পরবর্তী গভীর শূন্যতায় পৌঁছুবার আগে যে প্রতিযোজিত উচ্চশক্তিস্তর (Transitional Barrier) মহাবিশ্বকে (রেখাচিত্র অনুযায়ী)অতিক্রম করতে হবে, সেই অতিক্রমনের সময় মহাবিশ্বের কি হাল হবে? এ বিষয়টা কি উহ্যথেকে গেলোনা এখানে? নাকি আমি ভুল বুঝলাম, বুঝতে পারছিনা।
জামাল নজরুল ইসলাম স্যারকে নিয়ে আমাদের আসিফ “জামাল নজরুল ইসলাম: বাস্তবতা গল্পের চেয়ে অদ্ভুত” নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলা একাডেমি থেকে বের হওয়া মাসিক পত্রিকা “উত্তরাধিকার” এর বৈশাখ ১৪২০ সংখ্যায়। এটি লিখেছেন আসিফ ভাই।
“সৃষ্টিতত্ত্বের অসাধারণ দলিল:’দ্য অালটিমেট ফেট অব দ্য য়ুনিভার্স’-আলি হাসান” আর একটি চমৎকার লেখা।
@ডাইনোসর,
লিংকটা ভুল এসেছে।
অভিজিৎদা অসাধারন লিখেছেন। :guru:
ভীষন অহংকার হচ্ছে!
লরেন্স ক্রাউস, গ্লেন স্টার্কম্যান, বিজ্ঞানী পল ডেভিস এর বই যার উল্লেখ ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে না, সেই জামাল নজরুল কিনা নিরবে নিভৃতেই চলে গেলেন আমাদের মাঝ থেকে! যিনি বিশ্বের বাঘাবাঘা বিজ্ঞানিদের জন্য রেখে গেছেন মণিমাণিক্য, সেই মানিককে কিনা আমরাই চিনলাম না! কেবল চিনলাম চান্দে ভাসা সওদাগরদের!
যাহোক, পড়ছি, অভিজিৎদা! পুরোটা শেষ করে হয়ত জমানো প্রশ্নগুলো করব। তবে একটা কথা, অভিজিৎদা, আপনি যেন কোথায় হারিয়ে গেছেন! আপনার লেখাগুলো আপনার মনে হচ্ছে না, কেন জানি! অথবা, দোষটা আপনারই! জলবৎ বিজ্ঞান পড়িয়ে আমাদের স্বভাবটাই নষ্ট করে দিয়েছেন, সামান্যতম জটিলতার পাঁকেও পড়তে চাই না আমরা!
ধন্যবাদ অনেক পরিশ্রম করে এই প্রবন্ধ লেখার জন্য। বড়ই ইচ্ছা হচ্ছে মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি দেখে মরবার জন্য ।
অভিজিৎ দাদা, লেখাটা পুরা পড়িনি, ধীরে ধীরে পড়ব। বিজ্ঞান লেখায় আমার দাঁত বসাতে বেশ কষ্ট হয়, তাই সময় নিয়ে পড়ি, এবং বেশ কয়েকবার পড়ার পরে বুঝি কিছুটা! তবে এখানে একটু সমস্যা হচ্ছে আমার পড়তে প্রথম থেকেই। বেশ কিছু লাইন শুধু অনেক গুলি বক্সের মত দেখায়।কি সমস্যা।একটু সমাধান দিতে পারেন দয়া করে ? আগে তো এমন সমস্যা হত না।
গুগল ক্রোম ব্যবহারের পর থেকেই এই সমস্যা হচ্ছে। মজিলা দিয়ে হয় না। কিন্তু আমার নেট বেশ স্লো তাই মজিলার চেয়ে ক্রোম ব্যবহার করেই ভাল সুবিধা পাচ্ছি! তাছাড়াও আমার পিসি তে ফায়ারফক্সের ৩.৬ ভার্সনটি ব্যবহার করি, কারন নতুন ভার্সন ওপেন হতে খুব সমস্যা হয় স্লো নেটে।
@অর্ফিউস, অভিদা বা অন্য যে কোন মডারেটর আমাকে দয়া করে সমস্যাটার সমাধান দেবেন কি? আমি আসলেই গুগল ক্রোমে এই সমস্যা গুলি প্রায়শ ফেস করি, যার কারনে সেই অংশটুকু পড়া হয় না। অন্য লেখা হলে দুইয়ে দুইয়ে চা মিলিয়ে নেই, কিন্তু বিজ্ঞান লেখায় সেটি সম্ভব হয় না।
@অর্ফিউস,
“তবে এখানে একটু সমস্যা হচ্ছে আমার পড়তে প্রথম থেকেই। বেশ কিছু লাইন শুধু অনেক গুলি বক্সের মত দেখায়।”
আপনি বক্সের মত অংশটিকে সিলেক্ট করে রাইট ক্লিক করুন কিংবা ওটাকে কপি করে নোটপ্যাড এ পেস্ট করুন তাহলেই লেখাটা শো করবে । 🙂