মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থা এবং অবস্থান নিয়ে ধারাবাহিক
(৮)

শ্রেনীশত্রু খতমের নামে কলকাতায় তখন এক ভয়ের পরিবেশ| নকশাল আন্দোলনের পুরোধা চারু মজুমদার তখনও পালিয়ে| শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সামরিক বাহিনী দিয়ে নকশাল দমনের পরিকল্পনা করলেন|

একদিন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশা মেজর জেনারেল জ্যাকবকে তাঁর রুমে ডেকে পাঠালেন| আগে থেকেই মেজর জেনারেল জ্যাকব আঁচ করতে পেরেছিলেন| তার অনুমানই সত্য প্রমানিত হলো| ইন্দিরা গান্ধীর সরাসরি নির্দেশ, জ্যাকবকে পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে পশ্চিমবংগের নকশাল দমনে কাজে লাগাতে চান|

জাতিতে ইহুদি মেজর জেনারেল জ্যাকবের পুরানাম জ্যাকব ফারজ রাফায়েল জ্যাকব| জন্ম কলকাতায়| বাবা বনেদি ব্যবসায়ী| পূর্ব পুরুষ ইরাক থেকে ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় বসতি গেড়েছেন| জন্ম কলকাতায় হলেও লেখাপড়া করেছেন দার্জিলিংয়ের কাছে কার্সিয়াং-এ| তাই পশ্চিমবংগ বিশেষত উত্তরবংগ সম্পর্কে তাঁর ভালই জানাশুনা আছে| সে ভেবেই হয়ত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী এ গুরু দায়িত্ব মেজর জেনারেল জ্যাকবকেই দিতে ইচ্ছুক|

মেজর জেনারেল জ্যাকবের সামনে তখন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানিকশা বসে আছেন| পাশে সামরিক সচিব গোবিন্দ নারায়ন| কিঞ্চিত ভেবে মেজর জেনারেল জ্যাকব বললেন, তিনি দায়িত্ব নিতে রাজি কিন্তু তাঁকে আরও কয়েক ডিভিশন সেনা দিতে হবে| এককথায় রাজি হলেন জেনারেল মানেকশা|

বিশ ডিভিশন তখনই উত্তরবংগে নিয়োজিত ছিল অশান্ত পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের আশঙ্কায়| সেই সাথে যোগ হলো আরও দুই ডিভিশন| উপরি আরও পঞ্চাশ প্যারা-ব্রিগেড নিয়োগ দেয়া হলো নকশাল দমনের জন্য মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকবের অধীনে|

মেজর জেনারেল জ্যাকব তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে নিরাশ করেননি| নকশাল দমন তো হচ্ছেই, সেই সাথে অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ব-সীমান্তে স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলে এক সফল যুদ্ধ পরিচালনা করলেন| পাকিস্তানের ৯০ হাজার সুসংগঠিত বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করিয়ে এক স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ে সহায়তা করলেন|

এবার আরও এক বাড়তি দায়িত্ব পড়ল পূর্বাঞ্চলের কমান্ডারের হাতে| নকশাল আন্দোলনের ফলে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদে বিভক্ত এই প্রদেশে একটি প্রাদেশিক নির্বাচনে আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বও দেয়া হলো সেনাবাহিনীকে| মার্চ মাসেই একরকম বিনে ঝামেলায় শান্তিপূর্ণভাবে বিধানসভার নির্বাচন সম্পন্ন হলো| জাতীয় কংগ্রেস একাই পেল ২১৬ টি| ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি বা সিপিআই জাতীয় কংগ্রেসের সাথে নির্বাচন করে পেল ৩৫টি আসন| সিপিএম-এর মাত্র ১৪টি আসন|

নকশাল দমনের নামে কলকাতা তখন এক নিত্য হানাহানির শহর| একদিকে পুলিশ, সাথে কংগ্রেসের গুন্ডাবাহিনী| অন্যদিকে নকশাল আন্দোলনের মরিয়া কর্মীবাহিনী| কলকাতার পাড়া-মহল্লায় তখন বোমাগুলি আর পড়ে থাকা লাশ| কোনদিন বোমাগুলি না হলে একজন অন্যকে বলে, দাদা কি হলো আজ? আজকে যে এখনো ধূঁপ-ধোনা পড়ল না?

বাল্যবন্ধু অমলের সাথে আরও দিন দুই কলকাতায় থেকে বাবা এবার তারকনগরের দিকে রওনা হয়ে গেলেন| নদীয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম এই তারকনগর| ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি| দাদু ৬৫-এর দাংগায় পুরানো ঢাকা থেকে এক রাতে পালিয়ে এসে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন|

শিয়ালদা স্টেশন থেকে রাণাঘাটের ট্রেনে চাপলেন প্রথমে| শিয়ালদা-বনগাঁ ট্রেনের মতো শিয়ালদা-রাণাঘাটের ট্রেনে অতটা ভিড় নেই| অধিকাংশই ধোপদূরস্ত ভদ্রলোকের পোষাকের যাত্রী ট্রেনের কামরায়| কিন্তু ট্রেনের বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে শীর্ণ চেহারার বস্তি ঘর| সকালের রান্নার ধোঁয়া| এপ্রিল মাসের বৃষ্টি ভেজা সকালে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা যেন ম্লান হয় গেছে ঘিঞ্জি বস্তির কারণে| ট্রেনের ভিতর আর বাহিরের বৈসাদৃশ্যতা সংগে করেই এক সময় ট্রেন রাণাঘাট স্টেশনে থামলো|

রাণাঘাটে নেমেই বাবা টের পেলেন গেদের লোকাল ট্রেনটি ভরে যাবে পূর্ববংগের শরনার্থীতে| ট্রেন স্টেশনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শরনার্থীদের গিজ গিজে ভিড়| প্রায় বছর খানিকের এ শরনার্থী সময়ে কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে হলেও তো জমেছিল অনেক কিছু| তাই এক অনিশ্চয়তা থেকে আরেক অনিশ্চয়তার দিকে যাত্রার সময়ে সেই সব খুঁটে পাওয়া সঞ্চয়টুকুও কেউ ফেলে যেতে রাজী নয়|

প্রায় প্রত্যেকের হাতে তাই হাঁড়ি-পাতিল ভরা চটের বস্তা| ইউনিসেফের কম্বল| কেউ কেউ মোটা দড়িতে বেধে খাঁটিয়ে থাকা তাঁবুটিও নিয়েছে| জীর্ণ-শীর্ণ পোষাক প্রায় সকলেরই| কেউ ধুতি-লুংগি| অনেকেই আবার ময়লা প্যান্ট কিংবা পায়জামা| মহিলাদের শরীরেও ছেঁড়া কাপড়| জামা ও ব্লাউজহীন শরীর ফেটে যেন বেরিয়ে আসছে খুজলি-পাঁচড়ার দগদগে ঘা| সংগে থাকা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চিতকার চেঁচামেচিতে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ রাণাঘাটের ট্রেন স্টেশনে|

প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর রাণাঘাট-গেদের লোকাল ট্রেনটি প্লাটফরমে এসে থামল|

(৯)

দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়তে তখনও অনেক বাকী| প্লাটফরমে দাঁড়ানো লোকাল ট্রেনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে অপেক্ষমান যাত্রীরা| অধিকাংশই সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া শরনার্থী| শরনার্থী জীবনের এ বছরাধিক সময় দয়াদাক্ষিণ্য ও অন্যের কৃপায় বেঁচেবর্তে থাকতে হয়েছে এদের অনেককেই|

জন্ম নেয়া দেশ, সংসার, ব্যবসাবানিজ্যে সব কিছু ফেলে শুধু প্রানটা নিয়ে চলে আসতে হয়েছে এদের| তাই প্রায় প্রত্যেকেই যেন ডাংগা থেকে অথই জলে পড়েছে শরনার্থী হয়ে| বাসস্থান নেই| খাবার নেই| পরিধেয় বস্ত্র নেই| অন্যের কাছে হাত পাততে প্রথম প্রথম একটু সঙ্কোচ হলেও পরে আর লজ্জা-শরমের বালাই ছিল না বেঁচে থাকার প্রয়োজনে| রিলিফের লাইনে শৃংখলা মেনে দেখা গেছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পর আর কোন রিলিফই মেলেনি ভাগ্যে| শৃংখলা ব্যাপারটাই পলাতক এদের অনেকের কাছেই|

লাইন ভাংগার সে অভ্যেসটুকু এদের এখনো তেমনি আছে, লক্ষ্য করলেন বাবা| ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে যে যার মতো ট্রেনে উঠে পড়ছে| সেই সাথে জানালা দিয়ে যে যার মতো জিনিস পত্র ছুঁড়ে দিচ্ছে| প্রথমে চরম বিরক্তি লাগলেও মুহুর্তেই এক অজানা আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠলো বাবার মন| এই লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্যই তো এত কষ্ট, এত রক্তপাত, এত যুদ্ধ| নিজে একটু হলেও সে যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে পারার আনন্দ বাবা আজ বাস্তবিকই অনুভব করতে পেরেছেন, এটা ভেবেই সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন|

কোন রকমে একটা কামরায় উঠে পড়লেন শেষমেষ| ধোপদূরস্ত প্যান্ট-শার্ট পড়া এক ভদ্রলোককে দেখে একজন সমীহ নিয়ে একটু জায়গা দিলেন বাবাকে| কোন রকমে ট্রেনের বেঞ্চে ঠেসাঠেসি করে বসলেন| মুখোমুখি বেঞ্চের মাঝখানের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল আরও জনাপাঁচেক মানুষ| ভিতরের এক ভ্যাঁপসা গরমে দম আটকে যাবার অবস্থা|

একটু পরে ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠলো| পাশে বসা লোকটি তার পরিবারের সবাই উঠেছে কিনা নিশ্চিত হ’তে শেষবারের মতো স্ত্রীর দিকে সজোরে হাঁক দিল, হ্যাগো শুনছো নিমাইয়ের মা, পুলাপান সব উঠতি পেরেছে তো? না তুমি তোমার পোটলার দিকেই নজর রেখেছো?

বাবা বুঝতে পারলেন ভদ্রলোক নিশ্চয় কুষ্টিয়া কিংবা রাজবাড়ীর লোক| কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে ইন্টারমেডিয়েট পড়েছেন দুই বছর| তাই এ অঞ্চলের ভাষা শুনেই বোঝা যায়| নিমাইয়ের মা মাথাগুনতি করে নিশ্চিত হয়ে নিমাইয়ের বাবাকে নিশ্চিত করলেন| চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে মানুষের ভিড় ঠেলে এক পশলা মিহি বাতাস পরিবেশকে একটু শীতল করেছে তখন|

বাবা পাশের ভদ্রলোককে বললেন, দাদা তো ফেরত যাইতাছেন, তা রাজবাড়ী, না কুষ্টিয়া?

ইচ্ছে করেই পুর্ব্বংগের ভাষা বললেন| নিমাইয়ের বাবাও পূর্ববঙ্গের ভাষা শুনে আলাপ শুরু করলেন, আমার বাড়ি ছিল গোয়ালন্দ, কানাইপুর| তা বাড়ি যাইতেছি আর বলি কী করে? বাড়ি কি আর আছে? মুছলমানে দখল কইরা নিছে কিনা কে জানে? তবু যাইতাছি নিজের বাপের ভিটা| জন্মভূমি| এই শরনার্থী জীবন থ্যাইকা তো ভালো? তা দাদার সাথে ফ্যামিলি দেখতাছি না?

বাবা বললেন, আসলে আমি জয়বাংলা থেকে এলাম এই সপ্তাহখানেক আগেই| কলকাতায় উঠেছিলাম বন্ধুর বাড়িতে| এখন তারকনগর যাচ্ছি আত্মীয় বাড়িতে|

জয়বাংলা মানে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে এসেছে শুনে নিমাইয়ের বাবা আরও একটু ঘেষে বসলেন| সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোও যেন এদিকে মুখ ফিরে তাকালেন| সবাই জয়বাংলার খবর জানতে চায়|

দাদা,আপনি কোথায় থাকেন? বাড়ি কোথায়? যুদ্ধের সময় কিভাবে বেঁচে থাকলেন? জয়বাংলার খবর কী? শেখ সা’ব কি ক্ষমতা বুঝে নিয়েছেন? রাজাকার আলবদরেরা এখনো বেঁচে আছে? ইন্ডিয়ান আর্মি কি চলে এসেছে জয়বাংলা থেকে? এক সাথে হাজারটা প্রশ্ন চারদিক থেকে|

মুহুর্তের মধ্যেই প্রচন্ড ভীড়ে ঠাসা ট্রেনের কামরায় সবার মধ্যমনি হয়ে উঠলেন বাবা| অনেক দিন পর যেন একান্ত আপনজনকে কাছে পাবার আনন্দ সবার চোখে মুখে| মুক্তিযুদ্ধের গল্পকথায় রাণাঘাট-গেদের লোকাল ট্রেনের কামরা তখন যেন বুদ হয়ে আছে|

অত্যন্ত ধীর গতিতে চলা ট্রেনটি এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশন পার করতেই অনেক সময় পেরিয়ে যাচ্ছে| মুক্তিযুদ্ধের গল্পের মৌতাত শেষ হতেই বাবা একটু বাইরে তাকালেন| বনগাঁ বেনাপোলের গ্রামের চেয়ে অনেক পার্থক্য নদীয়া জেলার এ গ্রামগুলোর| অনেকটা পূর্ববংগের মতোই| টিনের চালা ঘর| কাঠ কিংবা পাটখড়ির বেড়া| কোথাও কোথাও টালির ঘর| গাছপালা, মাটির রঙ সে সবেও এক আশ্চর্য মিল|

ট্রেনের ভিড়ের মধ্যেই টুকটাক গল্প করছেন বাবা| কানাইপুরের নিমাইয়ের বাবাও তার সুখ-দুঃখের নানা কথা বাবাকে অকপটে বলে একটু হালকা হচ্ছেন| গোয়ালন্দ ঘাটে পাটের আড়ত ছিল ভদ্রলোকের| মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই পাকিস্তানী মিলিটারিরা সে গুদাম ঘর পুড়িয়ে দেয়| তবুও আশায় বুক বেঁধে ছিলেন| সব কিছু হয়ত এক সময় ঠিক হয়ে যাবে|

কিন্তু পরের মাসেই রাজাকার-আলবদরেরা কানাইপুরের বাড়ি লুট করল এক রাতে| কোন রকমে নিজের বাড়ির মেয়ে-বউদের ইজ্জত রক্ষা করতে পারলেও পাশের বাড়ির যুবতী মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেল গ্রামেরই রাজাকারেরা| পরের দিন সকালে গোয়ালন্দ-ফরিদপুর সড়কের পাশে খাদের মধ্যে মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেল| সেদিন রাতেই গেদে বর্ডার দিয়ে রাণাঘাট শরনার্থী শিবিরে চলে এলেন তিনি|

কানাইপুরের ভদ্রলোকের দীর্ঘশ্বাসে ছেদ পড়ল চলতি ট্রেনের ব্রেকের শব্দে|
-দাদা, মনে হয় বাগুলি এসে পৌঁছলাম এতক্ষণে| আপনার তারকনগর আরও কয়েকটা স্টেশন| বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন ভদ্রলোক|

বাবা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন, দিন থাকতে পৌঁছতে পারলেই হলো| শুনেছি স্টেশন থেকে বেশী দূর নয়| তাছাড়া শ্বশুর মশাই ইস্কুলের টিচার| সবাই চেনেন তাঁকে| জ়িজ্ঞেস করলেও হয়ত বলে দেবে সবাই|

একথা বলতেই সামনে দাঁড়িয়ে খাকি পোশাকের এক মিলিটারি জওয়ান বাংলায় জিজ্ঞেস করছে বাবাকে, এই যে, তুমি কি কলকাতা থেকে এলে?

হঠাৎ করে অপরিচিত কাউকে তুমি করে সম্বোধনে বাবা একটু হকচকিয়ে গেলেন| বিরক্তও হলেন খানিকটা| তবুও ইন্ডিয়ান আর্মির লোক দেখে একটু সমীহ সহকারে উত্তর দিলেন, জ্বী, কলকাতা থেকেই তো|

একটু মাঝবয়সী জওয়ান বাবার উত্তর শুনে হঠাত করে পেছন ঘুরে দাঁড়াল| কামরা ভর্তি প্যাসেঞ্জারের মধ্যে দিয়ে দূ্রে দাঁড়ানো কাউকে হিন্দিতে এদিকে আসতে বললেন তাড়াতাড়ি|

আরও কয়েকজন জওয়ান মুহুর্তের মধ্যেই অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে বাবার সামনে এসে দাঁড়াল| কামরার অন্যান্য যাত্রীদের থেকে একেবারে পৃথক করে ফেলল এদিকের মুখোমুখি অবস্থিত বেঞ্চ দু’টিকে|

মুহুর্তের মধ্যেই পরিবেশটা কেমন এক ভয়াবহ আকার ধারণ করল| হঠাৎ করে বাবার মাথায় এলো বন্ধু অমলের সাবধান বাণী| এখন তো নকশালীদের খতম চলছে সারা পশ্চিমবংগে| তবে তাকেও কি নকশাল ভেবেই এতসব করছে মিলিটারি জওয়ানেরা?

এরপর হিন্দি আর বাংলায় শুরু হলো জেরা| বাবা প্রথমে শুদ্ধ বাংলায় উত্তর দিলেও পরে ঢাকাইয়া ভাষায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন| হিন্দি একদমই বলতে অভ্যস্ত নন| কিন্তু হিন্দিটা বোঝা যায় পুরোটাই| বাবা বুঝলেন, অফিসার মতো দেখতে বাঙালী লোকটা বাবাকে পরীক্ষা করছেন আসলেই তিনি পূর্ববংগের, নাকি উত্তরবংগের ছদ্মবেশী নকশাল?

কিছুতেই মিলিটারি জওয়ানদের বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না যে, বাবা সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে এসেছেন আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিতে| প্রায় মিনিট কুঁড়ি জেরার পরও যখন ওরা সন্তুষ্ট হচ্ছে না, তখন বাবা আসলেই ভয় পেয়ে গেলেন| যদি নামিয়ে নিয়ে যায় তাঁকে, তবে কে তাকে রক্ষা করবে? হয়ত পরে প্রমানিত হবে তিনি আসলে নকশাল আন্দোলনের কেউ নন| কিন্তু তার আগেই তো বেঘরে প্রানটা চলে যাবে|

দূরে দাঁড়িয়ে জওয়ানেরা নিচুস্বরে হিন্দিতে শলাপরামর্শ করতে লাগলেন| তারপর কাছে এসে অফিসার মতো দেখতে বাঙালী ভদ্রলোক হাত ইশারা দিয়ে বললেন, এই তোকে আমাদের সাথে যেতে হবে| নেমে আয়?

এতক্ষণের সে আশঙ্কাই যে বাস্তব প্রমানিত হবে, তা দেখে বাবা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন| বললেন, দেখেন আমি তো আপনাদের বারবার বলতাছি, আমি জয়বাংলার মানুষ| এপারে আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ নিতে আইছি|

-হ্যা তোকে আত্মীয় বাড়িতেই পৌঁছে দেব| বললি না শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস| তোকে জামাই আদরে শ্বশূরবাড়ি পাঠাব| নেমে আয়, চটজলদি|

হঠাৎ করে পাশে বসা কানাইপুরের ভদ্রলোক তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বলতে লাগলেন, আরে কি হইতাছে এতক্ষণ? কি পাইছোস তোরা? ইচ্ছা হইলেই যে কাউরে নকশাল বানাইয়া খতম কইরা দিবি? ও তো আমাগো গ্রামের পোলা| আমাগো লইতে আইছে| ওরে নামাইয়া নিলে আমরাও নাইম্যা যামু ট্রেন থনে| ওই নিমাই, ও বলাই তোর কাকারে ওরা নামিয়া নিব| নামতো দেহি কোথায় নিতে চায়?

মুহুর্তের মধ্যেই কামরাশুদ্ধ জ়য়বাংলার শরনার্থীরা প্রতিবাদ করে উঠলো| বাবা তখনও বেঞ্চিতে বসে আছেন| সবার সমস্বরে প্রতিবাদ দেখে ইণ্ডিয়ান মিলিটারির জওয়ানেরা একটু পিছু হটলো মনে হলো| আবার নিজেরা হিন্দিতে কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ করে ভিড় ঠেলে ট্রেন থেকে জওয়ানেরা যখন নেমে গেল, ট্রেন তখনি চলতে আরম্ভ করেছে|

এক ঘোরতর বিপদের মুখে পড়েও অলৌলিকভাবে রক্ষা পেয়ে বাবা পাথরের মতো নিশ্চল বসে আছেন| কানাইপুরের ভদ্রলোক বাবার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, দাদা দিনকাল এখানে খুউব খারাপ| শালারা মানুষ মারছে পাখির মতো| আপনাদের মতো যুবক দেখলে তো রক্ষা নেই| নকশাল মনে করে কত নিরীহ মেধাবী ছেলেগুলোকে যে মারছে এখন| সামনের কয়েক স্টেশন পরেই মনে হয় তারকনগর|

বাবা শক্ত করে ভদ্রলোকের হাত ধরে আছেন অনেকক্ষণ| হঠাৎ মুখে এক নোনতা স্বাদ পেতেই বুঝলেন চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে|
(চলবে)

আগের পর্বের লিঙ্কঃ