বই প্রিভিউঃ
অসমাপ্ত আত্মজীবনী
লেখকঃ- শেখ মুজিবুর রহমান
(পুরো লেখাটাতে আমি একবারও জাতির জনক বা বঙ্গবন্ধু সম্ভাষণ ব্যবহার না করার চেষ্টা করব.. কারন পুরো লেখাটাতেই আমি তাকে শুধুমাত্র এ বইয়ের লেখক হিসেবেই দেখতে চাই)
এ বইটা মুলত ১৯৩৮/৩৯ -১৯৫৫ পর্যন্ত সময়কালের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে লেখা। এছাড়া শুরুতে লেখকের গ্রামের বাড়ি, জন্মবৃত্তান্ত, বংশ, ও তরুন কালের কিছু ঘটনা পাঠকের সুবিধার্থে লেখক দিয়েছেন। বইটা ঠিক ডায়েরী না। ১৯৬৭ সালে কারাগারে থাকাকালীন তিনি এই বই লেখা শুরু করেন। তাই এটিকে লেখকের প্রত্যক্ষ স্মৃতিচারনমূলক আত্মজীবনীই বলা যায়। বইটি শ্রুতি লিখন বা অনুলিখনের মাধ্যমে অন্য কারো হাতে লিপিবদ্ধ নয় বরং লেখক নিজেই জেলখানায় বসে নিজের স্মৃতি থেকে বইটি রচনা করেন। তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা শুধুমাত্র প্রকাশের আগে কিছু ভাষাগত সম্পাদনা করেন। এছাড়া তথ্যগত কোন সম্পাদনা করা হয়নি বলেই উল্লেখিত রয়েছে।
১৯৩৮/৩৯-১৯৫৫ এর সময়কার রাজনীতি সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানিনে বলে বইটির রিভিউ করতে গিয়ে আমি ঐ সময়কার সরাসরি মাঠ পর্যায়ের রাজনীতির অংশটুকু নিয়ে খুব বেশি কিছু লিখব না। এরচে বরং লেখকের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা, দেশভাবনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে লেখকের চিন্তাভাবনা মতামত ও ছোটখাট কিছু বিতর্ক নিয়ে লেখার চেষ্টা করব। যেহেতু বইয়ের প্রধানতম অংশটুকুই আমি অনেক খানি উহ্য রাখার চেষ্টা করব বলতেসি (যেটা প্রায় অসম্ভব!) তাই এই লেখাটাকে সরাসরি রিভিউ হিসাবে না দেখাই ভালো। তারচে বরং এটাকে আমরা পাঠকের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা হিসাবেই দেখি!
আর লেখার ক্ষেত্রে আমি টানা এক প্যরাগ্রাফে বা গদ্য আকারে লিখে যাওয়ার চেয়ে পয়েন্ট আকারে লিখে যাওয়াটাকে প্রাধান্য দিব। কারন গদ্য আকারে লিখতে গেলে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। সে তুলনায় পয়েন্ট আকারে লিখলে আমি যেকোন পয়েন্টেই বইয়ের যেকোন বিষয় তুলে আনতে পারব। তাই সেক্ষেত্রে আরেকটা গুরুত্বপুর্ন কথা বলে দিতে চাই যে, পয়েন্ট গুলাকে আলাদা গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। শুধু মাত্র চিহ্নিত করার জন্যই সংখ্যা গুলো ব্যবহার করব। সংখ্যা গুলোর আলাদা কোন গুরুত্ব থাকবে না।
যাহোক! এবার শুরু করি!
১- প্রথমেই বইটার লেখনি নিয়ে কিছু বলা যাক। খুব জটিল কিছু সময়ের রাজনৈতিক পরিক্রমা আর রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে এক নিবেদিত প্রাণ রাজনীতিবিদের লেখা এই বই। কিন্তু মজার ব্যপার হচ্ছে পুরো বইটা অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় লেখা। কোন ভারী ভারী কথাবার্তা বা উপদেশমূলক বাণী দেয়ার চেষ্টা করেন নাই। অত্যন্ত সহজ ভাষায়, বলা যায় একরকম নির্লিপ্ত আবেগ বর্জিত ভাষায় পুরো ঘটনা প্রবাহ লিখে গেছেন। কিছু জায়গায় ঘটনার প্রয়োজনে কিছু আবেগতাড়িত কথাবার্তা এসেছে। কিন্তু সেটার পরিমান খুব বেশি নয়। আর ভাষা অত্যন্ত সাবলীল, পড়তে কোন অসুবিধা হয় না, বিরক্তও লাগে না।
২- এবার লেখকের বংশ পরিচয় নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলা যাক। কোথায় কবে কিভাবে জন্ম সেসব বিস্তারিত ব্যপারে না যাই। যে কথা বলতে চাই সেটা হচ্ছে এ বই পড়ার আগ পর্যন্ত আমার একটা ভ্রান্ত ধারনা ছিল। সেটা বেশ অনেকদিন আগে কোথায় যেন একটা লেখা পড়ে হয়েছিল। ধারনাটা হলো এই যে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার বংশগত ভাবে পাঠান ছিল। তার পূর্বপুরুষগণ এ দেশের অধিবাসী ছিলেন না বরং দেশবিভাগের পর তারা পুর্ববাংলায় এসে থাকতে শুরু করেন, এবং এটা নাকি দেশ বিভাগের একটা প্লাস পয়েন্ট (এই অদ্ভুত কথাটা ঠিক কোথায় পড়সিলাম মনে পড়তেসে না!! :/ )! কিন্তু এ বই পড়ার পর জানতে পারলাম এই যে লেখকের বংশের গোড়াপত্তনকারী শেখ বোরহানউদ্দিন কবে থেকে পুর্ববাংলায় লেখকের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় এসে বসবাস করতে থাকেন তার কোন আদি ইতিহাস পাওয়া যায় না… যে টুকু স্মৃতি অবশিষ্ট ছিল তা হচ্ছে প্রায় দুইশত বছরের (লেখকের লেখনির সময় থেকে) পুরাতন কিছু দালান। অর্থাৎ ইংরেজ আমলেরও বহু পূর্ব থেকেই তার বংশের বাংলায় বসবাস এবং এর সাথে দেশ বিভাগের কোন সম্পর্ক নাই!
৩- এই বইয়ে সবচেয়ে বেশি বার যার কথা এসেছে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। প্রায় পুরো বইয়েই লেখক তাকে শহীদ সাহেব বলে সম্বোধন করে গেছেন। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একাধারে লেখকের রাজনীতিতে আসার প্রেরণা, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা এবং পরম শ্রদ্ধার পাত্র। এ বই পড়ার আগে আমার সোহরাওয়ার্দীকে নিয়েও বেশ ভ্রান্ত ধারনা ছিল যে তিনি পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিবিদ ছিলেন, সাধারন মানুষের সাথে তার দূরত্ব ছিল, তিনি চান নাই যে পাকিস্তান ভাঙুক এবং তিনি ছিলেন একজন বিতর্কিত রাজনীতিবিদ। এ বই পড়ে সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে বেশ অনেকখানি ধারনা পাওয়া যায়। এবং সেটা পজেটিভ ধারনাই। তবে লেখক যেহেতু রাজনৈতিক ভাবে সোহরাওয়ার্দীর দ্বারা অনুপ্রাণীত, তাই লেখায় ঋণাত্নক কথা বার্তা আসবেনা সেটাই স্বাভাবিক। আর যেহেতু শুধুমাত্র ১৯৫৫ পর্যন্তই এই বইয়ের ব্যপ্তিকাল তাই পরের ঘটনা প্রবাহ এবং তাতে সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকাও আর জানা যায় না। শুধু উনাকে নিয়ে লিখেই এ বইয়ের রিভিউ শেষ করে দেয়া যায়! তাই উনাকে নিয়ে বেশি দূর লিখব না……
৪- লেখকের রাজনৈতিক জীবনের শুরু মোটামুটি ১৯৩৮ সালের দিকে (১৮ বছর বয়স) যখন সোহরাওয়ার্দী তাদের স্কুল পরিদর্শনে আসেন তখন থেকে। তবে সরাসরি তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন ১৯৪১ সালে তার মেট্রিক পরীক্ষার পর থেকে। ৪৩ এর দূর্ভিক্ষের সময় লেখক পুরোপুরি মাঠ পর্যায়ের কর্মী হিসাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। রাজনীতি করতে গিয়ে পরিবার থেকে কখনোই বাধাপ্রাপ্ত হন নাই। বরং তার বাবা তাকে সবসময় উৎসাহ যোগাতেন এবং স্ত্রীর কাছ থেকেও কখনো পিছুটান পেতে হয় নি। তার বাবা তাকে বলেছিলেন,
“বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ,’ sincerity of purpose and honesty of purpose’থাকলে জীবনে পরাজিত হবানা।”
৫- এরপর বলতে হয় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কথা। পুরো বইয়ে লেখক তাকে হক সাহেব বলে সম্বোধন করে গেছেন। আরো অনেকবার ফজলুল হকের কথা এ লেখায় আসবে। তবে তৎকালীন সময়ে শেরে বাংলার জনপ্রিয়তা কিরুপ ছিল সেটা বোঝাতে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়।
একদিনের কথা মনে আচ্ছে, আব্বা ও আমি রাত দুইটা পর্যন্ত রাজনীতির আলোচনা করি। আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে। একদিন আমার মা-ও আমাকে বলেছিলেন,”বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না।” শেরে বাংলা মিছি মিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চাননা এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়েই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন- দাঁড়িয়ে বললেন,”যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব।” এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতেই হবে তাই বুঝালাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, মার খেয়ে।
এ ছিল পুর্ব বাংলায় এ.কে. ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা।
৬- এ ফাঁকে আরেকটা কথা বলে নেই। লেখক পুরো বইতেই এরকম অমায়িক আচরণ বজায় রেখেছেন। তার সাথে অনেক সময়ই অনেকের মতের মিল হয় নাই, অনেকের সাথেই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কিন্তু কারো নামেই তিনি পুরো বইয়ে বাজে কথা বলেননি। কোন নেগেটিভ কথা বলতে হলেও আগে যথাযোগ্য শ্রদ্ধা আর সম্মান দেখিয়ে যথেষ্ট পরিমান ব্যখ্যা করে তবেই বলেছেন। যেমন উপরের পয়েন্টের কাহিনীটুকু লেখকের না দিলেও চলত! পাবলিকের কাছে দাবড়ানি দৌড়ানি খাইসেন সে কথা এভাবে না বললেও কোন ক্ষতি ছিল না। কিন্তু তিনি হক সাহেবের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার যায়গাটুকু বোঝানোর জন্যই এই কাহিনীটুকু লিখে দিয়েছেন।
৭- একটা মজার ব্যপার এই যে পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে লেখক ওতপ্রত ভাবে জড়িত ছিলেন, পাকিস্তান গড়ার লক্ষ্য নিয়েই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু কিন্তু পুরা বইয়ের কোথাও পাকিস্তানের জনক, পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে কোন কথা নাই! অল্প যা-ও কিছু আছে তা-ও সরাসরি লেখকের কথা না এবং পজেটিভ কিছু না। যেমন শেরে বাংলা মুসলিম লীগ ছেড়ে দেয়ার পর মুজিব নিজে একবার উনার কাছে গিয়েছিলেন উনাকে মুসলিম লীগে ফেরত আসার জন্য। তখন শেরে বাংলা মুজিব সহ আরো যে কয়জন সাথে গিয়েছিল তাদের নিয়ে খেতে বসে বলেন,” আমি কি লীগ ত্যাগ করেছি? না, আমাকে বের করে দেয়া হয়েছে? জিন্নাহ সাহেব আমাকে ও আমার জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারেন না। আমি বাঙালি মুসলমানদের জন্য যা করেছি জিন্নাহ সাহেব সারা জীবনে তা করতে পারবেন না। বাঙালিদের স্থান কোথাও নাই, আমাকে বাদ দিয়ে নাজিমুদ্দীনকে নেতা করার ষড়যন্ত্র।” কথায় কথায় তিনি আরো বলেন,”১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব কে করেছিল, আমিই তো করেছিলাম! জিন্নাহকে চিনত কে?” এতে বোঝা যায় যে জনসাধারনের সাথে জিন্নাহের তেমন কোন সংযোগ ছিল না। এমনকি মুজিব নিজেও পাকিস্তান দাবীর প্রেক্ষিতে সোহরাওয়ার্দীকে নেতা মেনেই আন্দোলন করে গেছেন, জিন্নাহকে নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল বলে পুরো বইয়ে একবারও মনে হয় নাই!
৮- সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে লেখকের আরেকটা ভালো উক্তি তুলে দেই…
শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিলনা, দল মত দেখতেন না, কোটারি করতে জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ, তার আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তার সাধুতা,নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এ জন্য তাকে বারবার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।
৯- বাঙালির স্বভাব নিয়ে লেখকের একখানা কড়া উক্তি শেয়ার না করে পারছি না…
আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আরেকটা হল, আমরা বাঙালি।’ পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না,’পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয় তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না অনেক সময় দেখা গেছে,একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়,সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামী। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারন।
১০- লেখক খুব সুন্দর করে তার ভ্রমন কাহিনী লিখে গেছেন। পুরো বইয়ে তিন চারবার তার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমনের বিবরন এসেছে। উনি খুব গুছিয়ে বেশ কিছু খুটিনাটি সহ ভ্রমন কাহিনী গুলো লিখেছেন। এক দুটোর কথা পরের দিকে বলা যেতে পারে…
১১- ভাষা আন্দোলনের সময়ে প্রবেশ করছি আমরা। সরাসরি লেখকের লেখনি থেকে তুলে দেই,
বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হল উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না।
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরষ্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়শিয়ার লোকেরা মালয় ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপুর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই।
১২- এই ঘটনা প্রবাহে এবার দৃশ্যপটে মাওলানা ভাসানীর আগমন। সম্ভবত ১৯৪৮ এ মাওলানা ভাসানী আসাম ছেড়ে বাংলায় চলে আসেন (বইয়ে কোন নির্দিস্ট সময় বলা নেই)।
১৩- আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন ঘটনা। ১৯৪৯ সালের সম্ভবত জুন-জুলাইয়ের দিকের ঘটনা। লেখক তখন জেলে। এর মধ্যেই মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ বেড়ে গেছে। নতুন বিরোধী রাজনৈতিক দল সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তখন ২৩ জুন ঢাকায় পুরানো লীগ কর্মী ও অন্য অনেক নেতা কর্মীদের সম্মেলন ডাকা হয়। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, ভাসানী, আল্লামা মাওলানা রাগীব আহসান, এমএলএ দের ভিতর থেকে জনাব খয়রাত হোসেন, বেগম আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান ও হাবিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে ধনু মিয়া এবং বিভিন্ন জেলার অনেক প্রবীণ নেতাও যোগ দিয়েছিলেন এ সম্মেলনে। তাদের সকলের সম্মতিক্রমে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয় যার নাম দেয়া হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। এই প্রতিষ্ঠার কাহিনী বলার আমার কোন দরকার নাই। তবে যে কথার অবতারনা করার জন্য এ পয়েন্ট সেটাতে আসি। জেলে বসে দল প্রতিষ্ঠার খবর পেয়ে লেখকের মানসিক প্রতিক্রিয়া ছিল এমন,
আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছেসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, এখনো সময় আসে নাই, তাই বাইরে যারা আছেন তারা চিন্তা ভাবনা করেই করেছেন।
১৪- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর খন্দকার মোশতাক আহমেদ এর কথা পুরো বইয়ে এসেছে আলাদা ভাবে একবার কি দুবার। যার অর্থ দাঁড়ায় এই বইয়ের সময়কাল পর্যন্ত (১৯৫৫) এই কজনের সাথে লেখকের সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। উনারা লেখকের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হন আরো পরে। আমি পুরো বইয়ে আকুপাকু করে তাজউদ্দীনের নাম খুঁজে গেছি। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে লেখকের সাথে তিনি ছিলেন না বলে বইয়েও তাঁর কথা খুব একটা আসেনি। পুরো বইয়ের মধ্যে শুধু এই ব্যপারটাই আমার জন্য খানিক হতাশাজনক ছিল!! তবে যে একটা ঘটনা এসেছে তা-ই অন্যদের তুলনায় আলাদা এবং স্পেশাল ছিল।
১৫- এইটুকু একটা বইয়ের প্রায় অর্ধেক অংশ লেখক জেলে পার করেছেন! এই বই লিখেছেনও জেলে বসে! পুরো বইয়ে কয়বার তার জেলে যাবার কথা আছে তা মনে রাখার দুঃসাহস করতে পারিনি! এই জেল জীবন ও রাজনৈতিক জীবনের কারনে পরিবারকে সময় দিতে পেরেছেন খুব অল্পই। এ প্রেক্ষিতে একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই না। বইয়ের ব্যাক কভারে এ ঘটনাটা আলাদা ভাবে দেয়া আছে,
একদিন সকালে আমি ও রেণু (লেখকের স্ত্রী) বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু(হাসিনা) ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে,”হাচু আপা হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দুজনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম,”আমি তো তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস।
১৬- লেখকের ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চীনে শান্তি সম্মেলনে যোগদান এবং পুরো চীন ভ্রমন নিয়ে খুব সুন্দর ভ্রমন কাহিনী লেখক লিখে গেছেন। লিখতে গেলে পুরোটাই তুলে দিতে হয়… শুধু একটা ছোট ঘটনা তুলে দেই। ২রা অক্টোবর শান্তি সম্মেলনের দিনে। ৩৭৮জন সদস্য সাইত্রিশটা দেশ থেকে এসেছে। বিভিন্ন দেশের নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে লেখক এবং আতাউর রহমান খান বক্তব্য দিলেন। লেখক বাংলায় বক্তৃতা করলেন। আতাউর রহমান খান সেটা ইংরেজি করে দিলেন। এ নিয়ে লেখক বলছেন,
… ইংরেজি থেকে চীনা,রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।
এই সম্মেলনেই লেখকের সাথে দেখা হয় রুশ লেখক অ্যাসিমভের (যা মনে হল আইজাক অ্যাসিমভের কথাই লেখক বলসেন! ) আরো দেখা হয় তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের সাথে।
১৭- চীন আর চীন ভ্রমন নিয়ে লেখার শেষ পর্যায়ে লেখকের সমাজতন্ত্রের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। লেখক বলেন,
আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধ পরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্ব শান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল , সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে- তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
১৮- এরপরেই আসে ১৯৫৪ এর নির্বাচন ও যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৩তে এ কে ফজলুল হক সরাসরি আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। আওয়ামীলীগে থাকা এক পক্ষ তখন যুক্তফ্রন্ট করার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকল। ভাসানী স্পষ্ট ভাষায় লেখক কে জানিয়ে দেন যে হক সাহেব সরাসরি আওয়ামীলীগে আসলে তবেই তাকে গ্রহন করা হবে, অন্য দল করলে তার সাথে যুক্তফ্রণ্ট করা চলবে না। এ ঘটনার পরবর্তী প্রবাহ বর্ননা করতে গিয়ে লেখক বেশ কয়েকবার ভাসানীর কিছু কাজের উপর বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। প্রথমে যুক্তফ্রন্টের তীব্র বিরোধিতা করলেও পরে ভাসানী সোহরাওয়ার্দী বা লেখকের মতামত না নিয়েই যুক্তফ্রন্ট করার জন্য ফজলুল হকের সাথে একমত হয়ে দস্তখত করে ফেলেন। এরপর কিছু অযাচিত অদ্ভুৎ ও পরগাছা ধরনের দলের উদ্ভব ঘটে… যারা বিভিন্ন ভাবে যুক্তফ্রন্টের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।
১৯- সেই পাকিস্তান আমল থেকেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একই ধুয়া চলে আসছে! তখন ধুয়া তুলত মুসলিম লীগ! সে বেলায় দলের নামের সাথে মুসলিম যুক্ত থাকলেও আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘ভারতের চর’, হিন্দুদের দালাল এসব অপবাদ থেকে মুক্তি পায় নাই! যদিও শেষমেশ এ ধুয়াতে খুব বেশি লাভ হতো না!
২০- যাহোক… যুক্ত ফ্রন্ট হবার পর থেকে আরো নানাবিধ কিছু গন্ডগোলের ভেতর দিয়ে কাহিনী প্রবাহ আগাতে গিয়ে হঠাৎ করেই লেখা শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ হয় লেখক এর পরে আর লেখার সুযোগ পাননি অথবা তার লেখার খাতা পরে হারিয়ে গেছে। … আমার লেখাও বইয়ের মতই হঠাৎ করেই শেষ হতে চলল!!
পুরোটা আবার পড়ে বেশ ভালো বুঝতে পারছি যে এটা মোটেও রিভিউ গোত্রের কিছু হয় নাই! হয়ত এটা বইটা পড়ার জন্যে পাঠককে আগ্রহীও করে তুলবে না। কিন্তু এই বইয়ের রিভিউ কিভাবে করা সম্ভব তা আমার জানা নাই! রিভিউ করতে গেলে বাংলা রচনার মত সোজা সোজা কিছু কথা বার্তা চলে আসবে যে, লেখক অতি মহান নেতা ছিলেন, আজীবন মানুষের তরে কাজ করে গেছেন, জেল খেটেছেন বহুবার… তার এই বইটা পরে আমরা অনুপ্রানিত হব, ইত্যাদি ইত্যাদি!! তাই ও ধরনের কিছু লেখার থেকে বই থেকে সরাসরি কিছু ঘটনা বা লেখকের উক্তি তুলে দেয়াটা বেশি কাজের বলে মনে করেছি।
তবে বইটা পড়ে ব্যক্তি মুজিবকে হয়তো অনেকখানিই উদ্ধার করা যায়। তার রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা, সংগ্রাম সবকিছুরই অনেক ধারনা পাওয়া যায়। যে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য যেই মুসলিম লীগে সমর্থন করে আন্দোলন করেছিলেন পরে সেই মুসলিম লীগের অত্যাচার এবং দুঃশাষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিরোধী দল গঠন করলেন এবং হয়ে গেলেন মুসলিম লীগ আর পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শত্রু!
বইটি পড়ে কিছু জায়গায় খটকা লাগছে-
১-চীন সফরে তিনি দেখেছিলেন কিভাবে একটি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের জনগণকে কাজে লাগানো যায় এবং পাকিস্তানের শাসকরা কিভাবে তাদের জনগণকে হতাশায় নিমজ্জিত করেছিল তাও উল্লেখ করেন। তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি জনগণের উদ্যমকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলেন কেন?
২-তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি কমিউনিস্টদের পছন্দ করতেন না। এটা কি স্ববিরোধিতা নয়?
৩-পাকিস্তানি শাসকেরা যখন আওয়ামী লীগকে দমন করতে উঠে-পড়ে লাগে তখন তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করতেন,স্বাধীনতার পর ‘বাকশাল’ গঠনের চিন্তা তাঁর পরিপন্থী নয় কি?
৪-দলের মধ্যে কোটারি করা,ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করা-এসব তো তিনি জানতেন ও বেশ ভালোভাবেই বোঝতেন। পরে কি এসব ভুলে গেলেন?
তবে বইটি পড়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল। সেই সাথে তাঁর আদর্শ-চেতনার বিকৃতির স্বরূপটাও বেশ ভালোভাবেই চোখে পড়ল। যেমন-
১-বইয়ে তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে মনোভাব পোষণ করেছেন তা অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হয়েছে বইয়ের শেষে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড-১৯৭২ সালে ‘মদ,জুয়া,ঘোড়দৌড়সহ সমস্ত ইসলামবিরোধী কর্মকান্ড নিষিদ্ধকরণ’-এভাবে প্রকাশ করে
২-বইটি পড়ার আগে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর উগ্র মনোভাব সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না
৩-
বর্তমান আ’লীগ কি মুসলিম লীগের চেয়ে ভিন্নধর্মী?
@সাকিব,
আপনার মন্তব্যের জবাব অনেক ভাবে অনেক কিছু লিখেই আসলে দেয়া যায়…… অনেক তর্ক বিতর্কও হতে পারে…… বিতর্কে যাবো না… অল্প কিছু কথা বলি… আপনার পছন্দ নাও হতে পারে…
এ বইয়ের লেখক এবং বাংলাদেশ উভয়েরই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে লেখক সরাসরি যুদ্ধটা দেখতে পান নি…… পরিস্থিতি তৈরি করা এবং পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সময় পার করা দুটো পুরোই ভিন্ন ঘটনা…… বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতিটা তৈরি করে দিয়েছিলেন… পরিস্থিতিটুকুর মধ্যে দিয়ে জাননি… এই যুদ্ধের সময়টুকু এবং যুদ্ধের সময়ে তাজউদ্দিনের নেয়া অসম সাহসী এবং ঔদ্ধত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত যখন যুদ্ধের পরে অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধুর কানে তোলা হয় তখন তার মধ্যে সন্দেহের বীজ দিয়ে দেয়া হয়… যে কারনে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধকালীন সময়ের মানুষজনকে ধীরে ধীরে দূরে ঠেলে দেন…… এখন পড়ছি “মূলধারা ৭১”… কোন দিন যদি এটা নিয়ে রিভিউ লিখি তাইলে তাজউদ্দিন ও মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দিনের অদ্ভুত ভয়াবহ সাহসী সব সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখতে পারব।
লেখক যখন কিউবা সফর করেন তখন ফিদেল কাস্ত্রো তাকে বলেছিলেন যেন তিনি দেশ পরিচালনায় যুদ্ধকালীন যুদ্ধে থাকা মানুষদের দিয়ে মন্ত্রীপরিষদ গঠন করেন… কিন্তু তিনি তা করেন নি……
আর বাকশাল নিয়ে বলব এই যে, বাকশাল উনি ক্ষমতা দখলের জন্য করেন নি… উনার ক্ষমতা দখলের প্রয়োজনীয়তা ছিল না… উনি এমনিতেই ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী… বাকশাল নিয়ে দেয়া বঙ্গবন্ধুর শেষ ভাষণটুকু পড়ে এবং শুনে দেইখেন… তাহলে হয়ত কিছুটা ধারনা আপনার পরিস্কার হবে……
বঙ্গবন্ধুর শেষ ভাষণ
https://www.youtube.com/watch?v=y6owlOz6wwY
আর সমাজতন্ত্র (socialism) আর সাম্যবাদ (communism) দুটোর মধ্যে প্যাঁচ লাগায়ে ফেলাটা একটা খুব সাধারন ভুল… সমাজতন্ত্র একটা অর্থ ব্যবস্থা আর কমিউনিজম একটা গোটা সমাজ ব্যবস্থা যার অর্থ ব্যবস্থাটুকু সমাজতান্ত্রিক… তাই কমিউনিজম পছন্দ না হলে যে সমাজতন্ত্রকেও অপছন্দ করতে হবে এমন কিন্তু কোথাও নাই! তাজউদ্দিনও কিন্তু সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন… আমাদের ৭২ এর সংবিধানের মধ্যেও সমাজতন্ত্র একটা মূলনীতি ছিল…
বর্তমান আওয়ামীলীগ/ ৭২-৭৫ এর আওয়ামীলীগ/ স্বাধীনতা পূর্বের আওয়ামীলীগ এধরনের তুলনায় গিয়ে আসলে খুব একটা লাভ নেই……অর্থহীন…
(আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি না… এসব প্রশ্নের পরিস্কার জবাব হয় না… আসলে পলিটিকাল হিস্ট্রিরই কোন পরিস্কার কিছু নেই… সব সময়ই পলিটিক্স কুয়শাচ্ছন্ন একটা ব্যপার … আমি শুধু আপনার কথার পিঠে কিছু কথা বললাম)
@তানভী,
(Y) । আমার কাছেও সবসময় মনে হয়েছে-
অসাধারণ, বইটি পড়া শেষ হয়নি,
শুভ কামনা রইলো
আমার এ বিশ্বাস ছিল বাংলার ইতিহাস দলিত মথিত হয়ে যে সার টুকু থাকবে সেখানে শেখ মুজিব থাকবেন , এ থাকা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্বচ্ছ হবে। মুজিবকে খলনায়ক বানানোর চেষ্টা আছে,থাকবে , এই থাকা না থাকার মাঝেই মুজিব কষ্টি পাথরে যাচাই হয়ে শেষ পর্যন্ত যে স্থান পাবে তা বাঙালির ধারন করার ক্ষমতা থাকলে ভালো, না থাকলেও ক্ষতি নেই।
সম্ভবত নিজের জীবন দিয়েই শেষবারের মত এই সত্যটির দেখা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু!
লেখাটি খুব সুন্দর হয়েছে তানভী ভাই! আপনি আরো নিয়মিত হোন, পাঠকদের জন্য একটু কস্ট না হয় করলেনই, দেখবেন পাঠকদের ভালবাসায় সব কস্ট বিলীন হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু আমার কাছে একটা মিথের মত একজন মানুষ…… গ্রীক দেবতাদের মত… একজন মানুষ যাকে একই সাথে আমরা বাঙালিরা পুজোর আসনে বসিয়েছি, আবার ছুড়েও ফেলেছি। একটা সময় উনি আমার ধরা ছোয়ার বাইরের একজন ছিলেন (এখনো অনেক খানি আছেন)। উনার ব্যক্তিত্ব, গম গমে কণ্ঠস্বর, ৭ মার্চের ভাষণ, জাতি সংঘের ভাষণ, বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা………… মন্ত্রমুগ্ধের মত করে রাখে…… শুধু পুজো করতেই মন চায়… এত গমগমে স্বরের ভক্তি জাগানিয়া কন্ঠের নেতা বিশ্বে কয়জন আছেন জানিনা…
কিন্তু কাউকে দেবত্ব দিয়ে ফেললে মানুষ তাকে শুধু পরিস্কার দেখতে চায়! যেন শ্বেতশুভ্র পোষাক পড়ে দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে ঘুরে বেরাচ্ছেন… একজন মানুষ হিসেবে যে তার জীবনেও ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে,তিনিও একাকিত্বের মাঝে বন্দি হয়ে যেতে পারেন, তার চারপাশেও শত্রুরা গিজগিজ করতে পারে, তিনিও আর সবার মতই কাঁদেন হাসেন, কষ্ট পান, তারও পরিবার আছে, তারও সব কিছুর বাইরেও নিজের একটা জীবন ছিল-আছে-থাকবে… একথা আমরা সাধারনেরা ভুলে যাই, আসলে ভুলে যেতে চাই!! কারন তিনি দেবতা যে! আমি তাকে পুজো করছি,আমার পুজোর ফল কই? স্বর্গের দেবতাদের কাছে পুজো করে কিছু না পেলে তো গালি দেয়া যায় না, কারন তারা ধরা ছোয়ার বাইরে অনেক উপরে মহিমান্বিত সত্তা!! কিন্তু মর্তের দেবতারা তো আমাদের পাশের বাড়ির লোক! তাই মর্তের দেবতারা দাবি পুরন করতে না পারলেই তাদের ছুড়ে ফেলি আমরা আস্তাকুঁড়ে…… হোক সে অন্যায় আবদার! তবুও যেন সব দাবিই পুরন করা লাগবে! না হলে কি ছাই দেবতা !!
তাজউদ্দীন আমার কাছে অনেক বেশি মানবীয়। উনারও দেবতার আসন হয়তো পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওনার সৌভাগ্যই বলতে হবে যে বাঙালিরা তাকে খুব বেশি মনে রাখে নাই (সৌভাগ্য বলছি এজন্যই যে উনি নিজেও এ-ই চাইতেন। উনি বলতেন- “আমরা এমন ভাবে কাজ করব যেন এদেশের ইতিহাস লেখার সময় সবাই এ দেশটাকেই খুঁজে পায়, কিন্তু আমাদের হারিয়ে ফেলে।” দেবতার আসন থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়ার চে দেবতার আসন না পাওয়াই ভাল। উনার কাজটুকুই আজীবন উনার হয়ে কথা বলবে।)
এজন্য আমি বঙ্গবন্ধুকে দেবত্বের আসন ছাড়িয়ে মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। একজন মানুষ যিনি কিনা তার সর্বস্বটুকু দিয়ে দিয়েছেন অন্যের জন্যে…… মানুষ হিসেবে দেখলে কষ্ট করে আকাশে তুলে রাখার ভারও সইতে হয় না, আবার ছুড়ে ফেলেও দিতে হয় না…
@তানভী,
অসাধারণ আপনার এই মন্তব্য (Y)
আমার ভাবতে খুব ভালো লাগছে যে আপনার মতো নতুন প্রজন্ম এরূপ চিন্তা এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী। লিখতে থাকুন।
@তানভী,
বেশ বলেছেন তানভী (D)
@তানভী,
কি অপূর্ব একটা কথা বললেন, তানভী ভাই! আপনার এই মন্তব্যটি ছাড়িয়ে গেছে মূল পোস্টকে, এমনকি সহজেই ঢুকে পড়বে মুক্তমনার সেরা মন্তব্যগুলোর তালিকায়!
তানভী ভাই, আপনার আরো অনেক কিছু দেয়ার আছে মুক্তমনার পাঠকদের, এত চমৎকার সব কথা নিজের মধ্যে রেখে দিলে চলবে না। আপনাকে নিয়মিত লিখতে হবে।
পাঠকের দাবী নিয়েই কিন্তু কথাগুলো বললাম। দুর্বিনীত মনে হলে মাফ করে দিয়েন।
সুন্দর হয়েছে লেখাটা। শুভেচ্ছা রইল।
বহুদিন পরে আসলেন, একেবারে প্রায় সেই ক্ষণে, যখন দু-দিন পরে একটি জাতি (জাতি নয়, কিছু মানুষ) শেখ মুজিবকে স্মরণ করে অশ্রু ঝরাবে। মানুষটাকে ছোটবেলা থেকে প্রচুর শ্রদ্ধা করি। আমি তার মাঝে দেখেছিলাম এক মহানুভবতা, স্বজাতির প্রতি নিস্বার্থ ভালবাসা আর নিখাদ দেশপ্রেম। এই শ্রদ্ধাটুকু দেখানোর জন্যে কিছু জ্ঞানীজন সর্বদাই ভর্তসনা করেছেন আমাকে, অন্ধভক্ত আর পুজারী বলে। এবছর তাকে নিয়ে কিছু লেখা হয় নি, আর লিখবো কি না জানিওনা। ঠিক সময় মত আপনি একটা ভাল কাজ করেছেন। সে জন্যে আপনাকে- (Y) (F) । প্রাসঙ্গীক মনে করে এখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেল বছরের আমার লেখাটির লিংক দিয়ে দিলাম। লেখাটিতে জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা কিছু চিঠির স্ক্যান-কপি আছে।
হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু-
@আকাশ মালিক,
ছোট বেলায় এই মানুষটিকে ঘৃণা আর ভয় করতে শিখানো হয়েছিল।বলা হয়েছিল যে এই লোক এখন থাকলে দেশ টা হত ইন্ডিয়ার অংশ, আর ওরা মুসলিম হিসাবে তোমার গলা কেটে ফেলত।
বড় হবার পর যখন দেখি যে ইন্ডিয়াতে ১৭% লোক মুসলিম এবং কিছু সাম্প্রদায়িক ঘটনা ছাড়া এরা ইন্ডিয়াতে ভাল জীবনজাপন করছে তখন ছেলেবেলায় শোনা বুলি যেন খেলো হয়ে যায়।
মুজিবের উপর শ্রদ্ধা বাড়তে থাকে( বিভিন্ন ইতিহাস বইপত্র পড়ে), আর ধীরে ধীরে তিনি আমার মহান নেতায় পরিনত হন।
( যদিও আমি দেশে বর্তমান লীগ যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছে, তার পুরাই বিরুদ্ধে কারন এতে শেখ সাহেবের ইমেজ আসলে নষ্ট করা হচ্ছে, তিনি আমাদের নেতা, আমাদের কাছের মানুষ, তাঁর পুজাপ্রথা চালু কর মানে তাকে মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া।আর ভুলত্রুটি তার অনেক ছিল থাকাটাই স্বাভাবিক কারন তিনি তো মানুষ!!)
ভয়ে ভয়ে অনেকদিন পর একটা লেখা দিয়ে দিলাম! জানি খুব ভালো কিছু হয় নাই… তবে আবার রেগুলার হবারও তেমন কোন আশা নাই! এই পোস্ট লিখতেই আমার সাহসে আর ধৈর্যে কুলোচ্ছিল না! আবার হয়ত বছর খানেকের জন্য হাওয়ায় মিলায়ে যাব…
@তানভী,
খালি ভয় পাও কেন? আমরা তো আশেপাশে আছিই। 🙂 যাই হোক, অনেক দিন পর তুমাকে দেখে ভীষণ ভাল লাগল। এই রিভিউ (বা নিজস্ব চিন্তা ভাবনা, যাই বল) আমার ভাল লেগেছে, এর দরকার ছিল।
বইটি অনলাইনে থাকা জরুরী ছিল।
@সৈকত চৌধুরী,
বইটি এখানে দেখুন, ভাল ভার্সন পেলে জানাবো।