মেঘের পরে মেঘ জমেছে...


আমরা যখন মায়াদ্বীপে পৌঁছাই, তখন দুপুর। মেঘনার ঘোলা জলের মতোই আকাশও কিছুটা ঘোলাটে। টানা বৃষ্টির পরও আকাশের মুখ গোমড়াভাব যেনো কাটছেই না। নদীর বাতাসও কেমন যেনো থমকে আছে বলে মনে হয়।

দুটি বিশাল ট্রলার প্রায় একশ ‘ঢাকার মানুষ’ নিয়ে কবি শাহেদ কায়েসের দ্বীপটিতে পৌঁছানোর পর আমাদের চোখে পড়ে চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। সামনে দিগন্তজোড়া মাঠ, একপাশে গ্রামের আভাষ। দূরে এক চিলতে মেঘনা, কি এক আশ্চর্য উপায়ে রোদ চুরি করে ঝলসে যাচ্ছে।

জল যাত্রা-০১

জলযাত্রা-০২

জলযাত্রা-০৩


আগত দলটিকে স্বাগত জানাতে চরের মানুষ প্রস্তুত। মাঠের একপাশে লাল-নীল ডোরাকাটা ছোট্ট শামিয়ানারা নীচে সারি সারি প্লাস্টিকের চেয়ার। ভসভসে শব্দের মাইকে ভেসে আসছে মোবাইল ফোনে বাজানো পল্লীগীতি। আমাদের দলের নারী-পুরুষেরা সাংবাদিক, লেখক, ব্লগার, কবি, শিক্ষক, ব্যংকারসহ নানান পেশার। দলে শিশুও রয়েছে আট-দশজন। তবে দল সদস্য, মায়াদ্বীপে জড়ো হওয়া আমাদের তখন একটাই পরিচয় — আমরা কবি শাহেদ কায়েসের বন্ধু।

ওইদ্বীপে ঈদের ছুটিতে আমরা সব কাজ ফেলে সেখানে জড়ো হয়েছি দ্বীপবাসীকে শুধুমাত্র এটিই জানান দিতে, আপনারা যারা চরের মানুষ, যারা প্রতিবাদ করে আসছিলেন অবৈধভাবে চরের বালু তুলে কোটিপতি, লাখপতি হওয়া মন্ত্রী-এমপিদের সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করে আসছেন, যাদের নেতা স্বেচ্ছাসেবী স্কুল শিক্ষক কবি শাহেদ, যিনি এখন বালু

সন্ত্রাসের ছুরিকাঘাতে মারাত্নক জখম হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন, তারা কেউই আর একা নন। একশ জন নানা পেশা ও বয়সের শুভবুদ্ধির মানুষ, আমরাও রয়েছি আপনাদের সঙ্গে।…

সংহতি-০১

সঙহতি-০২

সংহতি-০৩

এরই মধ্যে নারায়গঞ্জ থেকে, কুমিল্লা থেকে দ্বীপে এসে জড়ো হয়েছেন আরো সব সমমনা মানুষ। অমল আকাশ নারায়নগঞ্জ থেকে ‘সমগীত’ গানের দল নিয়ে এসেছেন । আলাপ-পরিচয় সারতে না সারতেই ডাক পড়ে খাবারের। শামিয়ানার একপাশে বিশাল কয়েকটি ডেক থেকে মাটির সানকিতে তুলে দেওয়া গরম গরম ল্যাটকা খিচুড়ি, ডিম ভুনা, আর পানির বোতল। নদীর পাড়ে ছোট ছোট দলে আমরা আহার কাম আড্ডার ফাঁকে সবুজ ঘাসে গোল হয়ে বসে শুনি চরের সংগ্রামী মানুষগুলোর প্রতিবাদের কাহিনী।

আমরা এসবের অনেকটাই অবগত মিডিয়া, আর স্যোশাল মিডিয়ার কল্যানে। তবু ইভেন্ট ম্যানেজার সাংবাদিক রাজিব নূর, সংগঠক ফিরোজ আহমেদ, শিল্পী অরূপ রাহির টুকরো টুকরো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংলাপ আমাদের কারো কারো কাছে রূপকথার মতো শোনায়।

আমরা জেনে কৌতুক বোধকরি, বন্ধুবরেষু শাহেদ কায়েস হাসপাতালের বেড থেকেই বার বার টেলিফোনে খোঁজ নিচ্ছেন, আচ্ছা, সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো? খাবার শর্টেজ নাই তো? কোথাও কোনো ঝামেলা?…ইত্যাদি।

চার অনুঘটক, বাঁ থেকে- ফিরোজ, রাজিব, অমল ও রাহি...

জলজ জীবন

ফিরতি পথে-০১

ফিরতি পথে-০২


আমরা নাগরিক মানুষজন গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছাই, চরের জেলেরা ‘বালু সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যনারে আসলে আক্ষরিক অর্থেই লড়ছেন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। কারণ টাকার লোভে ক্রমাগত চরের বালু তুলে ফেলার কারণে এরই মধ্যে ভাঙণের কবলে পড়েছে মায়াদ্বীপ। ভাঙতে ভাঙতে কেবলই ছোট হয়ে আসছে দ্বীপের আকৃতি। পুরো দ্বীপটির অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে।…

শামিয়ানার নীচের সেই উনভাষী মাইকটিতে আন্দোলনের স্থানীয় নেতারা শোনান তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা। অরূপ রাহি আর নুপুর সুলতানা গণসংগীত শোনান। ফিরোজ আহমেদ বলেন, সংগ্রাম আর এক নাম জীবনের।…

এরপর আমরা আবার ট্রলার ঘিরে জড়ো হই বাড়ি ফেরার পথে। নদীতে ঝুপঝাপ করে নেমে পড়া দলছুট নারী-পুরুষ-শিশুদের তাড়া দিয়ে যাত্রা ফেরতের দলে যোগকরতে কিছুটা সময় যায়।

সোনারগাঁর বৈদ্যর বাজার ঘাটে পৌঁছে চা-পুরি খেয়ে নির্িষ্ট বাস-মিনিবাস-মাইক্রোতে বাড়ি ফেরার কালেও আমাদের পথক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় ভাবনা জগত দখল করে বসা একজন কবির সংগ্রাম, আর তার আলোর স্কুল ‘মায়াদ্বীপ পাঠশালা’। যে গল্পের আসলে কোনো শেষ নেই।…


ছবি: লেখক।