[ব্যাক্তিগত ব্যাস্ততার কারনে বেশী সময় দিতে পারি না। লেখা বড় হয়ে যায়, কমাতে পারি না, কন্টিনিউটি নষ্ট করতে আমি রাজী নই। এদিকে এক সাথে একাধিক পর্বও নামানো যায় না, ব্লগের নীতি বিরোধী, তাই ব্লগের নীতিমালাকে কিঞ্চিত কলা দেখিয়ে একটু চালাকি করতে হল। বিশাল লেখা যার দরকার মনে হবে পড়বে, বড় মনে হল নয়, সরল সমাধান। আবার কবে সময় নিয়ে বসতে পারি ঠিক নেই।]

শাহবাগ আন্দোলন কেন্দ্রিক পরবর্তি নানান নাটকীয় ঘটনায় বর্তমান গতিধারা আবারো দেশে দুই ভিন্ন মূল্যবোধের বিভাজন প্রকটভাবে দেখিয়েছে যা আমরা ইচ্ছেকৃতভাবে ভুলে থাকতে চাইলেও বারে বারেই তাড়া করে ফেরে। এ বিভাজন স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি বনাম বিরোধী শক্তি এমনকি আস্তিক নাস্তিক জাতীয় সরল সমীকরনও নয়। এই বিভাজন প্রথমত যুদ্ধপরাধী বিচার কেন্দ্র করে শুরু হলেও চুড়ান্তভাবে দাঁড়িয়ে গেছে ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ধর্মীয় ব্যাবস্থার সমর্থক এই দুই মেরুতে; যুদ্ধপরাধী ইস্যু চলে গেছে অনেকটা সাইড লাইনে। ধর্মভিত্তিক ব্যাবস্থার সমর্থক দলে আছেন যারা ধর্মকে সব কিছুর ওপর দেখতে চান বা বা দেখেন বলে দাবী করেন, এ দলের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হল ইসলামের পক্ষ/বিপক্ষ এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মীয় পরিচয়। ধর্মনিরপেক্ষ দল ধর্মকে ব্যাক্তিগত গন্ডিতে রাখার পক্ষপাতি, এই দলে আস্তিক নাস্তিক…হিন্দু, মুসলমান…সব ধর্মের সদস্য অবস্থান করলেও ধর্মীয় পরিচয়ের তেমন গুরুত্ব এখানে পায় না, যদিও ব্যাক্তি জীবনে এই দলের অনেকেই সনাতন চোখে ধার্মিক বলতে যা বোঝায় তাই। ব্লগার রাজীবের মৃত্যুর পর আন্দোলন নানান জটিলতায় বর্তমানে যে অবস্থায় পৌঁছেছে তাতে এই দুই ধারার পরিষ্কার বিভাজন দেখা গেছে প্রকট ভাবে।

মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ধর্মভিত্তিক ব্যাবস্থার সমর্থকদের একটি বড় অভিযোগ হল মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা হয়, শাহবাগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এসেছে। দূঃখজনক সত্য হল সাধারন ভাবে দেশের সব ধর্মানুসারীই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে থাকলেও ধর্ম নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন কিছু লোকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকেই ইসলাম ধর্মকেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করে আসছে (পরে কিছু উদাহরন আসছে), উল্টোটা নয়। এই কুপ্রবনতা মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকে আজকের গনজাগরন মঞ্চ পর্যন্তই লক্ষ্য করা যায়। মুক্তিযুদ্ধকে কোনদিন ইসলামের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়নি, মুক্তিযুদ্ধের সময়েও কোন ঘোর নাস্তিকও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ঘোষনা দেয়নি। বরং ততকালীন সরকার প্রধানরাও আল্লাহর বানী উদ্ধৃত করে নানান নির্দেশনা পাঠ করতেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যাত্রা শুরু করেছিল কোরানের বানী উদ্ধৃত করে, সেখান থেকে নিয়মিত অধ্যাপক আলী আহসানের ইসলামী অনুষ্ঠানও প্রচার হত। সে সময় নানান ধর্মবিশ্বাসী/অবিশ্বাসী কারোই এসবে সমস্যা হয়নি। তেমনি আজকের গনজাগরন মঞ্চ থেকেও কেউ কোন ধর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনি। তারপরেও ’৭১ সালে যেমন ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছিল তেমনি আজকের দিনেও ইসলামকে আরো সফল ভাবে গণজাগরন মঞ্চের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দল সংখ্যানুপাতে লঘু হলেও এই দলে অন্তর্ভুক্ত ছিল সামগ্রিকভাবে দেশের প্রায় সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, সাথে আলেম সমাজ, ডানপন্থী বুদ্ধিজীবিগণ, মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক এই শ্রেনীর লোকেরা। বলে রাখা ভাল যে এরা সকলেই ঘাতক দালাল রাজাকার এমন নয় – তবে সামগ্রিকভাবে এরাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি এবং তাদের সেই অবস্থান ছিল ধর্মীয় কারনেই, সেই অবস্থান কতটা ইসলাম সম্মত তার আলোচনা বাদ রেখেও এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও একই ধরনের প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বিষয়ক আলোচনা করতে গেলে তাই ধর্মীয় প্রভাবের আলোচনা কম বেশী এসে পড়েই এবং সেটার দায় অবশ্যই উল্লেখিত শ্রেনীর লোকদের, আলোচকদের নয়। যেমন আল বদরদের ট্রেনিং এর অংশ হিসেবে বাধ্যতামূলক দরসে কোরান ছিল, কোরান ছুঁয়ে টুপি দাঁড়িওয়ালা মাদ্রাসার ছাত্ররা শান্তি কমিটিতে যোগদানের শপথ নিচ্ছে, পাক জান্তার সাথে হাসিমুখে খোশালাপ করছে এসব কথা বা ছবি তো ইতিহাসের দলিল থেকে মুছে ফেলা যায় না। এর সাথে টুপি দাঁড়ির অপমান বা ধর্মবিদ্বেষের সম্পর্ক নেই।

ধর্ম সব সময়ই আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে খুব গুরুত্বপূর্ন ছিল, ’৭১ সালেও ছিল। আজকের দিনে সেই গুরুত্ব নানান আভ্যন্তরীন এবং কিছুটা আন্তর্জাতিক প্রভাবে আরো গুরুত্বপূর্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম কেন্দ্র করে মূল্যবোধ জনিত মতপার্থক্যও সমানুপাতিকভাবে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান আমলে ভিন দেশী শোষন এবং আক্রান্ত বাংগালী জাতীয়তাবোধ ছিল সর্বসাধারনের ঐক্যবদ্ধ মূল্যবোধের অন্যতম ভিত্তি, ধর্মের সাথে বাংগালী জাতীয়তাবোধ কিংবা সংস্কৃতির বিরোধ সন্ধান করার প্রবনতা ছিল মূলত পাকিস্তানী সরকার এবং তাদের এদেশীয় কিছু দালাল এবং উগ্র ধর্মীয় চেতনার মুষ্টিমেয় কিছু লোকের মাঝেই সীমাবদ্ধ। জনসাধারনের মাঝে সেসব প্রচারনা একেবারেই সুবিধে করতে পারেনি। উগ্র সাম্প্রদায়িক জযবা তুলে আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের চেষ্টা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টা হয়েছে; বাংগালী পালটা জবাব হিসেবে ’৬৭ সাল থেকে আড়ম্বরের সাথে রবীন্দ্র সংগীত সহযোগে পহেলা বৈশাখ পালন শুরু করেছে। পাকিস্তানী জান্তা ও উগ্রবাদীরা এসব সাংস্কৃতিক আক্রমন ইসলামের নামে চালালেও বাংগালী কোনদিন বলেনি যে ইসলাম হঠাতে তারা রবীন্দ্রনাথ ভক্ত হয়েছে বা পহেলা বৈশাখ পালন শুরু করেছে। সোজা কথায় বাংগালী পাকিস্তান আমলেও ছিল ধর্মপ্রিয়, তবে সংস্কৃতির ব্যাপারে ছিল উদার, যা ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বাস্তব প্রতিফলন।

পাকিস্তানী আমলের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলির ধর্মের নামে ভয়াবহ নৃশংসতা স্বচক্ষে অবলোকনের পর ’৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। সে সময় আওয়ামী সরকারের ব্যাপক সমালোচনা নানান ইস্যুতে হলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মানে কারনে দেশ থেকে ইসলাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র এমন কুটিল সন্দেহ তেমন কারো মাথায় আসেনি। তেমন সন্দেহ জেগেছে পরবর্তিকালে। বংগবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ’৭২ সালেও মুসলমানই ছিলেন, অন্য কোন ধর্মাবলম্বী বা নাস্তিক ছিলেন এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের সাথে নানান কারনে ওনার তিক্ততা হলেও বংগবন্ধুর প্রতি তার ভক্তি শ্রদ্ধায় এখনো কোন ঘাটতি দেখা যায়নি, ওনার নিজের কথাতেই বংগবন্ধু এখনো ওনার রাজনৈতিক পিতা। সেই কাদের সিদ্দিকী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দাবীতে বুঝেছেন যে এর মানে হল দেশে মুসলমানদের রাজনীতি করার অধিকার বানচালের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি অতি নগন্য ব্লগার, কাদের সিদ্দিকীর ধারে কাছে যাবার সাধ্য আমার নেই, নইলে সুযোগ পেলে ওনাকে জিজ্ঞাসা করতাম যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মত ভয়াবহ ইসলাম বিদ্বেষী অপকর্ম যেই বংগবন্ধু করে গেছিলেন তাকে কিভাবে উনি এখনো পিতাভ্রমে শ্রদ্ধা করেন? বংগবন্ধু তাজউদ্দিন গংদের তো ইতিহাসে ভয়াবহ ইসলাম বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত (বস্তুত এক শ্রেনীর লোকে তাইই করে)। কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে নানান কথা প্রচলিত আছে, তাই বলে ওনার এই ধর্মীয় রাজনৈতিক দর্শনকে বিরাট ব্যাতিক্রম মনে করার কোন কারন নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবী ইসলাম বিদ্বেষ হলে ’৭২ সালের সংবিধানের সাথে যারা জড়িত তারা কেন ইসলাম বিদ্বেষী নন এই কথা কেউ আমাকে বোঝাতে পারেন?

এটাই হল মূল্যবোধ জনিত বিভাজনের প্রকাশ, একই ব্যাক্তির মূল্যবোধ কিভাবে সময়ের সাথে বদলে যেতে পারে তার উদাহরন কাদে সিদ্দীকি। যেহেতু শাহবাগ আন্দোলন শুরু করেছিল ধরমনিরপেক্ষ ধারার লোকেরা তাই শাহবাগ আন্দোলন অনেকের কাছে এ কারনেই শুরু থেকেই ‘রাম বাম’দের ষড়যন্ত্র হিসেবে পরিচিত হয়েছে, আর অনেকে যারা রাম বাম তত্ত্বে কিছুটা সংশয়ে ছিলেন তাদের সংশয় কাটাতে নিহত ব্লগার রাজীবের নানান ধর্মবিদ্বেষী লেখালেখি টনিকের মত কাজ করেছে। মুল্যবোধজনিত বিভাজনের কারনেই দেশের এক অংশের মানুষের কাছে যুদ্ধপরাধীদের বিচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন, আরেক অংশের কাছে ধর্মবিরোধীদের (ধর্মপ্রিয়/ধর্মবিরোধী যদিও অত্যন্ত ধোঁয়াটে বিষয়) শায়েস্তা করা অধিক গুরুত্বপূর্ন। এটা মোটামুটি প্রমান হয়েছে যে দেশের এক বড় সংখ্যক নাগরিকের কাছে কে রাজাকার কে মুক্তিযোদ্ধা তার চাইতে তার চাইতে কে আস্তিক কে নাস্তিক সে প্রশ্ন বেশী গুরুত্বপূর্ন।

ধর্মীয় মূল্যবোধ জনিত এই বিভাজন (ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ধর্মভিত্তিক) দৃশ্যত ’৭৫ পরবর্তি সময় থেকে প্রতীয়মান হলেও মনে হয় না সেটা সম্পূর্ন সঠিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান তার এক গবেষনাপত্রে উল্লেখ করেছিলেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা এই দেশের সামাজিক সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন নয়। যদিও তার গবেষনাপত্রে উল্লেখিত ইংরেজী secularism ও ’৭২ সালের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা এক নয়। ’৭২ সালের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি পরবর্তিকালে বাদ দেওয়ার অজুহাত হিসেবে নানান অপব্যাখ্যা করা হয়ে আসছে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা এভাবে অপপ্রচার চালিয়ে সহজেই ধর্মপ্রান জনসাধারনের মগজ ধোলাই করা হয়েছে, আজো সে কাজ যত্নের সাথে করা হয়ে আসছে। সে কাজটি যে কতটা সফল ভাবে করা হয়েছে তার প্রমান শাহবাগ আন্দোলনের ছন্দপতন।

ততকালীন সরকার সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যেন ভুল বশতঃ ধর্মহীনতা করা না হয় সে জন্য সে সময়ই পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছিল। এই ধর্মনিরপেক্ষতা ইংরেজীতে secularism লেখা হলেও উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে এর অর্থ ধর্মহীনতা নয়, বরং বলা যায় এর অর্থ সকল ধর্মের সমাধিকার। বংগবন্ধুর নিজ ভাষায়; “Secularism does not mean the absence of religion. Hindus will observe their religion; Muslims will observe their own; Christians and Buddhists will observe their religions. No one will be allowed to interfere in others’ religions. The people of Bengal do not want any interference in religious matters. Religion cannot be used for political ends…”[১]. বলাই বাহুল্য যে কোন সূস্থ বিবেচনা বোধ সম্পন্ন মানুষের এই ব্যাখ্যার পর ’৭২ এর সংবিধান ধর্মহীন ব্যাবস্থা কায়েমের ষড়যন্ত্র এমন ভাবনা মনে আসার কথা নয়। সে সময় গণমানসে এই চিন্তা কারো সেভাবে এসেছিল বলে জানা যায় না। পরিষ্কারভাবেই ’৭২ সালের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ধারা কোন ধর্মের মর্যাদাই বিন্দুমাত্র হেয় করেনি, রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন ধর্মকেই অস্বীকার করেনি, বরং ধর্ম দেশের সংস্কৃতিতে আবহমান কাল থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই মূল্যবোধের স্বীকৃতি দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থায়, রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশের তিক্ত বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকেই সে সময় ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহন করা হয়েছিল; কোন ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে নয় এটা স্ফটিক স্বচ্ছ।

বলাই বাহুল্য যে পাক আমলের সাথে দেশের আইন ব্যাবস্থার মৌলিক কোন তফাত ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহনের ফলে ঘটেনি। পাক আমলেও দেশে ইসলামী ব্যাবস্থা বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু ছিল না, পাক জান্তারা তীব্র সাম্প্রদায়িক মানসিকতার হলেও পারিবারিক আইন ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালিত হত ধর্মনিরপেক্ষ ধারার নীতিতেই, শরিয়া আইনে নয়। স্বাধীন বাংলা ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সরকারী ভাবে স্বীকৃতি দেবার পরেও একইভাবে পরিচালিত হত। ধর্মীয় মূল্যবোধে পরিচালিত পারিবারিক আইন বদল করার নীতি সরকার চিন্তা করেনি। বরং ’৬১ সালে আইয়ুব খান মুসলমান পারিবারিক আইনের যেমন সংস্কার করেছিলেন সেটা ছিল বেশ বিপ্লবাত্মক। তেমন সংস্কার আজকের শায়খ, মাশায়েখ, আলেম ওলামা সর্বোপরি তোহিদী জনতাপূর্ন বাংলাদেশে চিন্তা করা অসম্ভবের মত।

আধুনিক কালের অধিকাংশ রাষ্ট্রই মূলত এ নীতিতেই পরিচালিত হয়। এতে কারো ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্ন করা হয় না, সবাই নিজ নিজ ধর্মাধিকার পালন করেও শান্তিপূর্ন সহাবস্থান করতে পারে। যেসব দেশ ধর্মীয় ব্যাবস্থায় চলে বা চলার দাবী করে সেসব দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থান কেমন তা খুব বিতর্কের বিষয় নয়। তুলনামূলক বিচারে মুসলমানদের মধ্যেই এখনো ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশী। ধর্মনিরপেক্ষ আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়ায় মুসলমানদের ধর্মাধিকার ক্ষুন্ন হলে নিশ্চয়ই সে সব দেশে মুসলমানদের ইমিগ্রেট করার প্রবনতা দেখা তো যেতই না, উল্টো দেখা যেত সেসব দেশ থেকে দলে দলে মুসলমানদের দেশত্যাগ করে ধর্মভিত্তিক দেশগুলির দিকে গমনের হিড়িক। তেমন কোন প্রবনতা কি দেখা যায়? বাস্তব কি বলে? ধর্ম বা ধর্মীয় পরিচয় কেন ব্যাক্তিগত গন্ডির বাইরে টেনে আনতে হবে আমি সম্ভবত জ্ঞানের অভাবেই বুঝি না। আদালতের জজ সাহেব কি বাদী ফরিয়াদীর ধর্ম হিসেব করে রায় দেন, একজন ডাক্তার কি তার রোগীর ধর্ম চিন্তা করে, নাকি একজন শিক্ষক তার নিজ ধর্মের ছাত্রদের বেশী নম্বর দেবেন?

এই ব্যাবস্থায় একমাত্র আপত্তি থাকলে থাকবে তাদের যারা নিজ ধর্মকে বাকি সব ধর্মের ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখতে চান তাদের। ’৭৫ এর আগেই সেই আলামত দেখা গেছিল। যেমন সে সময় রেডিও টিভিতে অনুষ্ঠান শুরু করার সময় কোরানের সাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠের নীতি এবং হিন্দু ধর্মীয় উতসবের প্রচারনার বিরুদ্ধে অনেকেই সরব হয়েছিলেন [১]। ততকালীন সরকার নিজেও সব ধর্মের প্রতি সমদৃষ্টির নীতি বজায় রাখতে পারেনি, সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের প্রতি সরকারী পর্যায়ে পক্ষপাতিত্ব দেখানোর শুরু তখন থেকেই। কাজেই অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের তত্ত্ব খুব ভুল বলা যায় না। দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের জন্মের সময়কাল থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মীয় ধারার বিভ্রান্তি ছিল, যা উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে হয়ত সেভাবে প্রকাশিত হতে পারেনি। ’৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর সরকারী মদদে কেবল দিনে দিনে এই দুই ধারার পার্থক্য বেড়েছে, বর্তমানে এসে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে চরম মাত্রায়।

পাকিস্তান আমল থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মীসহ ধর্মনিরপেক্ষ ধারার লোকেরাই মূলতঃ সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ধর্মীয় চেতনায় উদ্ধুদ্ধ ডানপন্থী বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবি মহল এবং ধর্মীয় বা আলেম সমাজের ভূমিকা ছিল দূঃখজনক ভাবে অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক। স্বাধীন বাংলাদেশেও দূঃখজনকভাবে ওনাদের ভূমিকার তেমন পরিবর্তন হয়নি। প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদ এবং রাজাকারবাদ অনেকটাই সমার্থক। ’৭৫ পরবর্তি স্বৈরাচারী আমলে মৌলবাদকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইন্ধন দেবার অপসংস্কৃতি চালু হয়, এর পথ ধরে এই চক্র হয়ে ওঠে কালে ক্রমে প্রবল পরাক্রমশালী। ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি শুনলেও এই চক্রের ঘটে চরম গাত্রদাহ। জনতাও মোটামুটি ধর্মের প্রতি দূর্বলতাবশতঃ সেসব আষ্ফালন নীরবে হজম করে এই চক্রকে করে তুলেছে মোটামুটি অপ্রতিরোধ্য – মৌলবাদ বিকাশের মূল কারন এখানেই। যা কিছু সামান্য প্রতিবাদ আসে সেই ধর্মনিরপেক্ষ অংশের তরফ থেকেই। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু বড় আলেম এবং ডানপন্থী বুদ্ধিজীবিদের কিছু উক্তির উদাহরন দেই, বলাই বাহুল্য যে ওনারা ‘অজামাতি’। শেষের কথাটা কিছুটা শ্লেষের সাথেই বলতে হচ্ছে এ কারনে যে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বলতে মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরাই অনেকে ইচ্ছে করে ভুল বিশ্লেষন করেন, জামাতি ভিন্ন আর কেউ সে আমলে কিংবা আজকের দিনেও স্বাধীনতা বিরোধী নেই এভাবে সমস্যাটিকে হালকা করে দেখান। এসব উদাহরনে বোঝা যাবে আসলে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ইসলামকে দাঁড়া করায়।

‘৯৪ সালে সরকারী বেতনভোগী বায়তুল মোকারম মসজিদের খতিব মরহুম ওবায়দুল হক সাহেব বলে বসলেন, “পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একদল লোক গাদ্দারি করে পাকিস্তান ভেঙ্গেছিল। এখন আবার গাদ্দারি শুরু করেছে”। এই শীর্ষ আলেমের মতে মুক্তিযোদ্ধারা হল গাদ্দার বা বিশ্বাসঘাতক, সেই গাদ্দারির চালিকা শক্তি হল পশ্চীমের শিক্ষা। এই ইস্যু নিয়ে সেসময় দেশে তেমন কোন আলোড়ন হয়নি, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির এই ধরনের কিছু ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবিই কেবল প্রতিবাদ করেছিলেন, আর কিছু আওয়ামী নেতা যারা আবার পরবর্তি সরকারে এসে বিলকুল সব ভুলে গেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি আম জনতা মোটামুটি নীরবেই হজম করে গেছে। ভদ্রলোক দাপটের সাথেই আমৃত্যু স্বপদে বহাল ছিলেন, পুরো জাতির সবচেয়ে গর্বের অর্জন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় চরম অপমানকর বক্তব্য জাতির কাছে খুব বড় মনে হয়নি। ঊল্টো পরবর্তিকালে তার নিকট হাতজোড় করে প্রথম আলো সম্পাদকের মাফ চাওয়া মৌলবাদের কাছে মুক্তচিন্তার পরাজয়ের প্রতীক হিসেবেই চিরকাল রয়ে যাবে। একই সভায় চরমোনাই পীরের ঘোষনা; “যারা মৌলবাদী নয় তারা মুসলমানের জারজ সন্তান……এ সংবিধান মানা যায় না”।

দেশের এবং উপমহাদেশের একজন অন্যতম বিশিষ্ট আলেম মরহুম আল্লামা আজিজুল হক (বুখারি হাদীস শরিফ বাংলায় প্রথম অনুবাদ করেন, সুগভীর ইসলামী পান্ডিত্যের কারনে শায়খুল হাদীস হিসেবে এক নামে পরিচিত) সাহেবের অকপট মূল্যায়ন, “৭১ এ আমাগো অবস্থান ছিল নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। আমরা কখনোই চাই নাই পাকিস্তান ভাইঙ্গা বাংলাদেশ স্বাধীন হোক”। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকার জন্য অনুশোচনা হয় কিনা এ প্রশ্নে ওনার সাফ জবাব ছিল, “না। আমরা তো ইসলামের পক্ষেই ছিলাম। আমরা তখনো যা করেছি সেটাকে ঠিক মনে করেছি। এখনো যা করছি এটাই ঠিক”। স্বাধীন বাংলায় এই ভদ্রলোকেরও সীমিত আকারে হলেও ভোট তৈরী হয়েছিল ’৭৫ পরবর্তি রাজনীতির ধারায়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের নের্তৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকেও এই ভদ্রলোকের দলের সাথে ২০০৬ সালে জোট বাধতে দেখা গেছিল, নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।

বর্তমান সময়ে যুদ্ধপরাধীদের বিচার কেন্দ্র করেও ‘অজামাতি’ আরো বহু আলেম মাওলানা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন যেগুলি কোট করতে গেলে বিশাল কাহিনী হবে। তার চাইতে দেখা যাক আলেম সমাজের বাইরের ধর্মীয় চেতনায় উদ্ধুদ্ধ ডানপন্থী বুদ্ধিজীবিগণের স্বাধীনতা পরবর্তি কিছু উক্তি।

’৯১ কি ’৯২ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধূরী – “পৃথিবীর কোথাও মুসলমানদের পরাজয়ের চিহ্ন নাই। ছিল শুধু এই দেশে। সেই চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য রাষ্ট্রপতি জিয়া এখানে শিশু পার্ক তৈরীর নির্দেশ দিয়েছিলেন”। উনি আরো অভিমত ব্যাক্ত করেন যে “এটাই বিএনপির মূল অন্তর্নিহিত শক্তি। এ জন্যই বিএনপি তিনবার নির্বাচিত হতে পেরেছিল”। এককালের তুখোড় বামধারার নেতা, মুক্তিযোদ্ধা; পরবর্তিকালে ডানপন্থী বনে যাওয়া মরহুম অধ্যাপক আফতাব আহমেদ ‘২০০০ সালে, “জাতীয় সংগীত কি ঐশ্বীবানী যে পালটানো যাবে না……হিন্দু রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সংগীত”।

একটি ভিডিও দেখেছি যেখানে এককালের মুক্তিযোদ্ধা আফতাব আহমেদ মাওলানা সাঈদীর সাথে এক মঞ্চে ওঠার মত সৌভাগ্য অর্জন করায় সজোরে আল্লাহু আকবর রব ছেড়ে শুকরিয়া আদায় করছেন। সেখানে আরেক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি তাঁর এককালের কমরেড কবি আল মাহমুদ এককালের র‍্যাডিকেল সমাজতন্ত্রী মতবাদ ছেড়ে আজ তারা ইসলামী আন্দোলনে শরিক হতে পারায় অসীম অলৌলিক মোজেজার সন্ধান পেয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হচ্ছেন। এই ধরনের মানসিকতার ব্যাক্তিরাই মুক্তিযুদ্ধকে ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারনার কাজে ব্যাবহারের অভিযোগ তোলেন।

আরেক এককালের বিশিষ্ট বামনেতা, বর্তমানে ঘোর ডানপন্থী বনে যাওয়া জামাতি নয়া দিগন্তের কলামিষ্ট সাদেক খান (রাশেদ খান মেনন, এনায়েত উল্লাহর বড় ভাই) ’০৭ সালে; “একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধপরাধ করেছে, বিচার করতে হলে দুই পক্ষেরই করতে হবে”। আরো বহু উক্তি আছে এ জাতীয় ডানপন্থী ব্যাক্তিত্বদের। বিএনপি জামাতের সাথে সরাসরি জড়িতদের কথা কোট করছি না (যেমন অধ্যাপক এমাজউদ্দিনের ভাষা সৈনিক গোলাম আজমের মুক্তি দাবী)। বর্তমানে ইসলামী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ সম্প্রতি আলোচনার শীর্ষে থাকা এককালের বাম সৈনিক ফরহাদ মাজহারও অতীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রাসীদের সাথে তূলনা করে সাড়া ফেলেছিলেন। এ সমস্ত বুদ্ধিজীবিরা হাজার হলেও উচ্চশিক্ষিত, তাই মাঝে মাঝে তারা মনের কথা, জেহাদী জোশ গোপন করে কিছুটা ঘুরিয়ে বলেন, নইলে আমিনী হুজুর বা শায়খুল হাদীসের সাথে তাদের চেতনাগত তফাত তেমন নেই। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির খুব বড় ব্যার্থতা এই দলের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষন ছাড়া কেবল ছাগু, রাজাকার রাজাকারই থাকে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা থাকে না জাতীয় লঘু সিদ্ধান্ত টেনে বিষয় হালকা করা। এরা সকলে টাকা খেয়েছে, জামাতি প্রতিষ্ঠানে চাকরির লোভে এ জাতীয় কথাবার্তা বলে ভাবা আত্মপ্রতারনের সামিল।

এটাও মনে রাখতে হবে যে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধীতা মানে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা নয়, ধর্মভিত্তিক ব্যাবস্থার সমর্থনকারী অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। কাদের সিদ্দীকীর কথা আগে বলেছি, ওনার বর্তমান অনেক কথাবার্তার নানান রকমের ব্যাখ্যা হলেও ওনার বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় মিথ্যা হয়ে যায় না। কাদের সিদ্দিকীর বহু আগে একই ধারার আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মেজর জলিল; উনিও পরবর্তি জীবনে ইসলামী আদর্শে গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে ইসলামী আন্দোলন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতা বিরোধী হাফেজ্জী হুজুরের খেলাফত মজলিশ দলের সাথে ঐক্য গড়েছিলেন। একই রকমের উদাহরন আরো বেশ ক’জনার আছে। ’৭৫ এর পর এ ধারার বিকাশ ঘটেছে বেশ ভালভাবে, তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ন হল যে শায়খুল হাদীস, আমিনী হুজুরদের ভোট ব্যাংক মূলতঃ আঞ্চলিক মাদ্রাসা ভিত্তিক হলেও তাদের সমর্থক গোষ্ঠির মধ্যে আছে শহুরে উচ্চশিক্ষিত শ্রেনীরও বড় অংশ যারা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাবস্থাকে ঘৃনা করেন, ধর্মভিত্তিক ব্যাবস্থা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেন। এই শ্রেনীর অনেকেই জামাতকে ঘৃনা করেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরই শক্তি; তবে প্রান্তিক বিচারে ধর্মনিরপেক্ষ ধারার চাইতে এই ধারার সাহচার্য অধিক পছন্দীয় মনে করেন যেহেতু এই ধারার ব্যাক্তিবর্গ ধর্মভিত্তিক সমাজ গড়ার আশাবাদ দেখায়। রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা এখানে গৌণ, ইসলামী আন্দোলনের সৈনিক কিনা সেটাই বড় –মেরুকরন এভাবেই ঘটেছে। এ কারনেই আলেম/বুদ্ধিজীবিদের রাজাকারি কথাবার্তা, মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি অপমান এই শ্রেনীর কাছে গৌন। মূল্যবোধগত বিভাজনের এটাই বৈশিষ্ট্য, জনমানসে এভাবে গড়ে উঠেছে এক দ্বৈতসত্তার। ছোট উদাহরন হতে পারে একই ব্যাক্তি জামাত শিবিরের নিষিদ্ধকরন/বিচার অন্তর থেকেই চান, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সম্পূর্ন জামাতি দৃষ্টিভংগী সম্পন্ন লোক যিনি মুক্তিযুদ্ধকে প্রকাশ্যে অপমান করেন তাকেই আবার বড় আলেম হিসেবে অশেষ সম্মান করেন (ব্লগ জগতে্র দেখা উদাহরন, বাস্তবেও ভুরি ভূরি আছে)। বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদের প্রভাব দিনে দিনে বাড়ার মূল কারন এখানেই।

এই দলের সমর্থক সংখ্যা কেমন হবে? আমার পরিষ্কার ধারনা না থাকলেও চোখ বন্ধ করেই বলতে পারি বেশ বড় সংখ্যকই হবে। হেজাফতে ইসলাম এই দলের অকুন্ঠ সমর্থনের কারনেই তাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ/বিপক্ষ শক্তির সহাবস্থান সম্ভব হয়ে মেরুকরন ঘটেছে। মুল্যবোধ জনিত বিভাজনের কারনেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির ভেতরেই এক ধারার নুতন প্রজন্মের কাছে জাহানারা ইমাম, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, জাফর ইকবালরা নমস্য; আরেক ধারার নুতন প্রজন্মের কাছে জাকির নায়েক, আল্লামা শাফি, কাদের সিদ্দিকী, মেজর জলিলরা নায়ক। এই দুই ধারার ভেতর মেলবন্ধন কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব না হলে ভবিষ্যত পরিনতি খুব ভাল কিছু দেখি না।

প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদের বিকাশ এবং রাজাকারবাদের বিকাশের মেকানিজম মোটামুটি একই, দুয়ের মাঝে বড় ধরনের আদর্শিক মেলবন্ধন আছে। প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদের চরম প্রকাশ্য রূপই হল রাজাকারবাদ। মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ সরাসরি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী, এমনকি কোন রকম রিলিজিয়াস সুপ্রীমিটিরও (যা পরোক্ষভাবে হলেও সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়) বিরোধী; তাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সাথে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদের সঙ্ঘাত অনিবার্য; অন্য কথায় প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদে বিশ্বাসীরা মুখে যাইই বলুক আদর্শিক ভাবে রাজাকারবাদের সাথেই বেশী এলাইন্ড। যে লোক আড়ালেও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে মালাউন গাল দিয়ে আত্মতৃপ্তি পায়, মহিলা বিদ্যালয় বন্ধ করার ফতোয়া দেয় তার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী হওয়া কতটা সম্ভব? সাম্প্রদায়িকতামুক্ত রাজাকার কয়জন থাকতে পারে, কিংবা রাজাকারি মন ওয়ালা অসাম্প্রদায়িক চরিত্র?

দেশে এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সমর্থকই অনেক বেশী, তাই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলে তেমন বিপদে পড়তে না হলেও স্বপক্ষে জনবল তৈরী করা সম্ভব নয়। এই সমস্যা মেটাতে দারুন ভাবে সাহায্য করে ধর্ম ব্যাবহার করে মৌলবাদী চিন্তা চেতনার প্রচারনা। রাজাকারি দর্শন যদি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বিরুদ্ধ কথাবার্তা না বলে ধর্ম ব্যাবহার করেই হাসিল করা যায় তবে তার চাইতে উত্তম আর কি হতে পারে? এরই প্রমান দেশের ইসলাম ভিত্তিক নানান সংগঠন সময়ে সময়ে রেখে এসেছে টেষ্ট কেস হিসেবে, জাতীয় রাজনীতি কিংবা সংসদে এরা নগন্য হলেও বলা যায় প্রতি ক্ষেত্রেই তাদেরই জয় হয়েছে। এর মূল কারন এইসব দলের নেতারা সমাজে বিশিষ্ট আলেম হিসেবে পরিচিত। যার ধর্মকর্ম নিয়ে তেমন কোন চিন্তাভাবনা নেই, হয়ত জুমার নামাজেও মসজিদে যায় না সেও এই দলের প্রতি এক ধরনের গোষ্ঠিগত আনুগত্য বোধ করে। সামান্য কিছু যা ওজর আপত্তি ওঠে সেই চিহ্নিত কিছু ধর্মনিরপেক্ষ (মতান্তরে ‘রাম বাম’ ঘেঁষা) বুদ্ধিজীবি মহল থেকে যাদের সহজেই নাস্তিক মুরতাদ ফতোয়া কিংবা সময়ে সময়ে হত্যা তালিকাও প্রস্তুত করে সাইজ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারনের ভাবনা যাইই হোক এটাই মোটামুটি বাস্তব চিত্র। এই দল মাঝে মাঝে অনেকটাই দেশের প্রচলিত আইন আদালতেরও ঊর্ধ্বে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রধানমন্ত্রীকেও সতর্ক করে দিতে পারেন, সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমদেকেও ২ লাইনের নিতান্ত এলেবেলে কথার কারনে নাকানি চোবানি খাওয়াতে পারেন, কিন্তু সরাসরি আদালত/বিচারকদের হুমকি দেওয়া ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া যায় না।

বর্তমানে হেফাজতের নারী নীতি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এমন দাবী নুতন কিছু নয়, কিংবা আমাদের দেশেই ইউনিক নয়। নারীর ক্ষমতায়ন, এমনকি নারীশিক্ষা, আয় উপার্জনের পথ বন্ধ করার জন্য বহু আগ থেকেই দেশের নানান অঞ্চলে ইসলামপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক দল নানান কায়দায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বহু তান্ডব করেছে, আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ মোটামুটি নীরবে সেসব অবলোকন করেছে। কারন এ তান্ডবগুলি ঘটানো হয়েছে ইসলামের নামে এবং ইসলামের ধারক বাহক রক্ষক দাবীদারদের দ্বারা। কাজেই স্বাধীন বিচার বুদ্ধি বিবেকের ঘরে তালা। পশ্চীমের খৃষ্টান ইহুদীদের মদদপুষ্ট এনজিও সমূহ নারী শিক্ষা/স্বনির্ভরতার নামে ইসলাম ধ্বংস করে যাচ্ছে এমন প্রচারনা চালালে কিভাবে আর জোর প্রতিবাদ করা যায়? প্রচারনাকারীদের প্রতিই উলটা সহানুভুতি জাগে। এসব নিয়ে যারা লেখালেখি করে তাদেরই ইসলাম বিদ্বেষী, নাস্তিক মুরতাদ এমন সব নানানবিধ উপাধি দিতে হয়। তাণ্ডবের মাত্রা কোনভাবেই অগ্রাহ্য করা না গেলে এসব ইসলাম সম্মত নয়, ইসলামে নারী শিক্ষা স্বনির্ভরতা বিরোধী কিছু নেই বলে দায় সারার সহজ রাস্তা তো খোলাই আছে।

মধ্য ’৯০ এর আগেই দেশের বহু যায়গায় মহিলা বিদ্যালয় ফতোয়া দিয়ে স্থানীয় মোল্লা আলেমগন বন্ধ করে দিয়েছেন, কোথাও আগুন লাগানো হয়েছে, কর্মজীবি মহিলাদের ওপর হয়েছে শারীরিক হামলা, মহিলাদের লাগানো হাজার হাজার গাছের চারা ধ্বংস করা হয়েছে (খোদাই নিয়ামত গাছপালার ওপর এদের সর্বদাই এত ঘৃনা কেন কে জানে), কমের ওপর হয়েছে সামাজিক ভাবে একঘরে করা। এনজিও সমূহের বিরুদ্ধে চালানো হয়েছে নানান কায়দায় মৌখিক হুমকি থেকে হামলা। এসবের দীর্ঘ বর্ননা দিয়ে লেখা বড় করছি না। শুধু ’৯৪ সালে এনজিও সমূহের বিরুদ্ধে ১,৭৫০টি ফতোয়া দেওয়া হয় (হিসেবের বাইরে আরো কত আছে কে বলতে পারে)। [এসবের কিছু বিস্তারিত বিবরন অধ্যাপক আলী রিয়াজের GOD Willing: The Politics of Islamism in Bangladesh বইতে কম্পাইল করা আছে]

এর চরম রূপ দেখা যায় ব্রাক্ষনবাড়িয়ায় আমিনী হুজুরের নেতৃত্বে, সেখানে ’৯৮ সালে মাসের পর মাস প্রশিকার কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়, আমিনী হুজুর তার স্যাংগাতদের উদ্দেশ্যে প্রশিকা প্রধান কাজী ফারুককে দেখা মাত্র হত্যার উদাত্ত আহবান জানান। এরপর ফতোয়া নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় কেন্দ্র করে ২০০১ সালে আমিনীর দলবল ঘটায় চরম সন্ত্রাস যাতে ব্রাক্ষনবাড়িয়ায় ৭জন নিহত হয়, ঢাকায় এক পুলিশকে মসজিদের ভেতর “ধর ধর নাস্তিক ধর” শ্লোগান সহযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয় শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেবের উপস্থিতিতে। সেই হতভাগ্য বাদশাহ মিয়া নিয়মিত সে মসজিদেই নামাজ আদায় করতেন, তার স্ত্রী সে সময় বলেছিলেন যে যারা মসজিদে মানুষ হত্যা করে তারা মুসলমান নয়, তারা পশু। আমিনী হুজুরের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যাবস্থা সেসময় নেওয়া যায়নি, তিনি তার এলাকায় আইনের তোয়াক্কা না করে এনজিও নিষিদ্ধ করতে পারেন, মানুষ খুন করার আহবান জানালেও তার সাথে আপোষের টেবিলে ততকালীন আইনমন্ত্রীকে বসতে হয়েছিল, কারন ওনারা ধর্মীয় নেতা, ওনাদের খেপালে লোকে ভোট দেবে নাকি? উলটো উনি পরবর্তিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে নানান ইস্যুতে হুমকি ধামকি দিয়ে গেছেন, আদালতের রায় ওনার মন মত না হলে দেশময় আগুন জ্বালাবার দৃপ্ত শপথ নিয়েছেন।

এরপর ২০০৭ সালেও এই দল দেখিয়েছে তাদের শক্তি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নির্দোষ রম্য কার্টুন কেন্দ্র করে, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের জারজ উপাধি দানকারী বায়তুল মোকারম মসজিদের খতিবের কাছে হাত জোড় করে মাফ চেয়ে দেশে আরেকবার ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে পিছিয়ে দিয়েছেন বহু যোজন। এর পরের বছরও প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী চক্র আবারো তাদের শক্তি প্রদর্শন করে বিজয়ের হাসি হেসেছে। সেবার ইস্যু ছিল ততকালীন জিয়া আন্তর্জাতি বিমান বন্দরে বলাকার মূর্তি নির্মান। তখন রাত বিরেতে দেখা গেছে একদল মাদ্রাসা ছাত্র ঢাকা শহরেরও বিভিন্ন যায়গায় মূর্তি ভাংগার চেষ্টা করছে। তাদের দাবী মূর্তি ইসলাম বিরোধী, তাদের দাবীর মুখে বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষকে সরে আসতে হয়েছিল। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েও বর্তমানে সফল ভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মরনে মা ও সন্তানের ভাষ্কর্য নির্মান বন্ধ করা হয়েছে, এই নিষিদ্ধকারী লোকজন যে শুধু গ্রাম্য মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক তা নয়, উচ্চ শিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকগনও আছেন যারা মনে করেন এই মূর্তি নির্মান তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবে। ওপরে বর্নিত যাবতীয় কার্যকলাপ কেবলমাত্র কিছু ‘জামাতি’র কর্মকান্ড হিসেবে চালানো মূল সমস্যা এড়িয়ে যাবারই নামান্তর। আমিনী হুজুর, মাওলানা ওবায়দুল হক, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, বর্তমানে বিখ্যাত হয়ে ওঠা আল্লামা শাফি ওনারা সকলেই আদর্শগত ভাবে জামাত বিরোধী। এতে কতটা উপকার হচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি কোন এক অদ্ভূত কারনে সাম্প্রদায়িকতা রাজাকারবাদ এসবের জন্য জামাত শিবির ছাড়া আর কিছু বোঝেন না।

হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে লেখার স্থান এখানে তেমন নেই, প্রচলিত ধারনানুযায়ী তারা যে ব্লগার রাজীবের মৃত্যুর পর মৃত রাজীব ও ব্লগে অন্যান্য নানান ধর্মকেন্দ্রিক লেখা দেখে আচমকা বেজায় গোস্ম্যা করে মাঠে নেমেছে এই ধারনা যে বিরাট ভুল তা আগের একটি লেখায় বলেছি। তারা শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধীতা রাজীব হত্যার আগ থেকেই করে এসেছে ইসলাম বিরোধী ছূতোয়, সোজা কথায় ইসলামকে দাঁড় করিয়েছিল শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে। আল্লামা শাফি যুদ্ধপরাধীদের বিচার কিভাবে মূল্যায়ন করেন তা ওনার নিজের কথাতেই শুনুন, “যারা দীন-ঈমানের হেফাজতের কথা বলছে, তাদের নির্দয়, নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে। তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে এদেশের আলেম সমাজ মানবে না।।“ সোজা কথায় ওনার মতে যুদ্ধপরাধীদের বিচার মানে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র যা আলেম সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ওনার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, যা কাজেও তিনি দেখিয়েছেন। (এই বানী যেদিন তিনি দেন রাজীব তখনো জীবিত, ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগার ইস্যু মিডিয়ায় আসে আরো ৪/৫ দিন পর)। এর সাথে ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগার তত্ত্বের কোন সম্পর্ক আছে? এই তত্ত্বের সাথে জামাত শিবিরের প্রচারনার তফাত কোথায়?

তবে রাজীব হত্যার পর বিভিন্ন ডানপন্থী মিডিয়ায় প্রকাশিত সত্য/অসত্য নানান ধর্মবিরোধী উক্তির ভূমিকা অবশ্যই আছে। এসব উক্তি উগ্ররূপে এবং একই সাথে গ্রহনযোগ্য রূপে হেফাজতকে মাঠে নামার চমৎকার সুযোগ করে দিয়েছে। আরো বড় কথা সমাজের উচ্চশিক্ষিত অংশ যারা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রতিপক্ষ হিসেবে আমিনী হুজুর, শায়খুল হাদীস কিংবা আল্লামা শাফিদের সমর্থন করতে চান কিন্তু সংকোচ বশতঃ হয়ত সবসময় সেটা সম্ভব হয় না তাদের প্রকাশ্যে হেফাজতকে সমর্থন দানের দারুন সুযোগ করে দিয়েছে। এর কারন এই দলের আলেম মোল্লাগন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রতিপক্ষ, এদের মাধ্যমেই সম্ভব হবে ধর্মনিরপেক্ষ ধারাকে হটিয়ে ধর্মভিত্তিক সমাজ কায়েম। এদের সমর্থন না করে কি পারা যায়? যুদ্ধপরাধীদের বিচার বিরোধী উক্তিকারী আল্লামা শাফিকে সমর্থন দেওয়ার মাঝে কিছুটা চক্ষুলজ্জার ব্যাপার অবশ্যই আসে, কিন্তু নবী রসূলের অবমাননাকারীদের শাস্তি দাবীদারদের সমর্থন করাতে তো কোন সমস্যা নেই। তারা যুদ্ধপরাধীদের বিচার সরাসরি বিরোধীতা করলেও সেটা হয় গৌণ, ‘সরলমনা’ আলেমের কথা। আমি নিশ্চিত যে ওপরের রেফারেন্স দেখার পরেও এই দলের বোধকরি শতকরা ৯০% লোকেও বিশ্বাস করবেন না (বলা ভাল যে বিশ্বাস করতে চাইবেন না) যে হেফাজত শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধীতা ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগারদের কারনেই হঠাত শুরু করেনি, তারা নীতিগতভাবেই যুদ্ধপরাধীদের বিচার বিরোধী, মুখে যাইই বলুন।

(২)

‘আলেমে দ্বিন’ আল্লামা শাফি সাহেবের নানান যায়গায় পরিচয় দেখি দেশের এক নম্বর আলেম। এক নম্বর কিনা জানি না, উনি যে অন্তত অন্যতম শীর্ষ আলেম তাতে কোন সন্দেহ নেই, তার প্রমান বর্তমানের ঘটনাবলীর আগেও প্রধানমন্ত্রী তার সাথে অতীতে একাধিকবার আলোচনায় বসেছেন। আওয়ামী সমর্থক ধারার মুক্তিযুদ্ধের তীব্র সমর্থক অনেককেও দেখি ওনার গুনে গদগদ হতে, যদিও তাদের বক্তব্য বেচারা সরলমনা জ্ঞানী আলেম সাহেবকে তার অজান্তেই জামাত শিবির ব্যাবহার করছে। এমনকি উনি বা ওনার দলবল ক্ষমতায় আসতে পারেন এমন সম্ভাবনাও শোনা যাচ্ছিল, সত্য বলতে আশেপাশে ওনাদের বিপুল সমর্থন লক্ষ্য করে তেমন সম্ভাবনা খুব একটা সুদুর পরাহত বলেও মনে হয়নি। তাই দেশের সম্ভাব্য ভবিষ্যত কান্ডারির ভিশন কেমন জানতে কিছুটা কৌতূহল বশতঃ যুদ্ধপরাধী/জামাত শিবির ইস্যু বাদ দিয়ে ভদ্রলোকের পুরনো কিছু ওয়াজ মাহফিলের বক্তব্য শোনার চেষ্টা করেছি।

উনি মহিলাদের ঘরের বাইরে বেরুতে দেওয়ারই ঘোর বিরোধী [সূত্র-২, ৩২ মিনিট থেকে)। মহিলারা কেন মার্কেটিং এ যাবে, তাদের স্বামী ভাইরা যা দরকার এনে দেবে……তারা কেন কাজ করতে যাবে যেখানে স্বামী বাবাজিই কাজ করে খাওয়াতে পারে। ওনার মতে মহিলাদের পড়াশুনা ততটুকুই হওয়া উচিত (ক্লাস ৪/৫) যতটুকু তাদের স্বামীর সম্পদ হিসেব কিতেবের কাজে লাগবে। মহিলাদের এর চেয়ে বেশী পড়াশুনা শেখালে তারা নিজের পছন্দমত বিবাহ করে বসবে! তেতুল খেতে দেখলে যেমন জিভে পানি আসবেই, ওনার ভাষায় মহিলারা তেতুলের থেকেও খারাপ, মহিলাদের দেখলেই পুরুষের দিলে পানি আসবে (সূত্র-২, ৩৮ মিঃ) মহিলাদের সাথে সহশিক্ষায় পড়াশুনা হওয়া সম্ভব নয়, অনেক কিছু করতে পুরুষের ইচ্ছে জাগবেই… ইত্যাদী। এর কারনও অবশ্য আছে, ওনার মতে মহিলারা ‘বাইশ তাল’ জানে (সূত্র-৩,৩২মিঃ)। কারন ওনার কাছে নারী কর্তৃক নির্যাতিত পুরুষের ফরিয়াদ পূর্ন চিঠি আসে, “হুজুর, আমার ক্লাশফ্রেন্ড মহিলার থেকে বাইচতে পারি নাই, কুকাজ কইরতে হয়েছে, আমি একটু আইসতে চাই, আমাকে তওবা করাইবেন”। ভদ্রলোকের মতে নাসারা ইহুদীদের ভাষায় পড়াশুনা অর্থহীন; বার এট ল্য বা পিএইচডি ডিগ্রী (পিএইচডি শব্দটা উনি বেশ শ্লেষের সংগে উচ্চারন করেন) কোনই কাজে আসবে না (সূত্র-৩, ২৩ মিঃ থেকে)। একের পর এক এ জাতীয় নানান রকমের তথাকথিত ডিগ্রী অর্জন ওনার ভাষায় ‘যত পাশ তত নাশ’। আসল পড়াশুনা হয় মাদ্রাসায় যেখানে আলেম বানানো হয়, কারন সেই আলেম সাহেব নামাজ পড়ান। উনি নাস্তিকদের বেকুব পাগল সাব্যস্ত করছেন (সূত্র-৩, ১৩ মিঃ থেকে) (গুরুত্বপূর্ন কথা উনি আবার ৩/৪ বার করে বলেন – যেমন নাস্তিকেরা পাগল পাগল পাগল)। নাস্তিকদের দেশে কোন ঠাই নেই ঘোষনা করছেন, উল্লসিত ভক্তকূলকে নির্দেশনা দিচ্ছেন নাস্তিকদের আল্লাহর দেশ থেকে তাড়াইয়া দিতে, দুনিয়ার চন্দ্র, সূর্য, আগুন, পানি নাস্তিকদের জন্য বন্ধ করে দিতে। এ জাতীয় নির্দেশ প্রচার কতটা আইন সম্মত তা করার অধিকার নিশ্চয়ই আমার নেই। ওনার সূত্রে জানতে পেরেছি দেশে এখন স্কুল কলেজে হিন্দু মহিলারা ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দেয় (সূত্র-৩, ১৮ মিঃ)। উনি ইসলামের ইতিহাসের প্রসিদ্ধ নানান ইমামের রেফারেন্স দিয়ে ইচ্ছেকৃত ভাবে এক ওয়াক্ত নামাজ কাজাকারির শাস্তি মৃত্যুদন্ড (সূত্র-৩, ২০ মিঃ), আরেক ইমামের মতে জেল এসব শিক্ষা দিচ্ছেন, গুনমুগ্ধ ভক্তকূলও মূল্যবান জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। এই ভদ্রলোকের নেতৃত্বে ইসলামের মহাজাগরন ঘটছে বলে অনেকে অত্যন্ত উল্লসিত। জাগরনের সংজ্ঞা অবশ্যই আপেক্ষিক, সন্দেহ নেই।

আমি জানি না আমি আমার লেখায় মূল চিন্তার কারনটি কোথায় তা কতটা সঠিকভাবে বর্ননা করতে পারছি। আমিনী হুজুর, শায়খুল হাদীস, আল্লামা শাফি জাতীয় চিন্তাধারার ধর্মীয় নেতা বোধকরি সব সমাজেই কয়েকজন করে থাকে, এরা এদের মত থাকলে, মসজিদ গীর্জা মন্দিরে ধর্মচর্চার নামে এ ধরনের বয়ান ব্যাক্তিগত পর্যায়ে দিলে দিতে পারেন, এমন কিছু ব্যাপার নয়, কতজনেই কত রকমের কথা বলে। সমস্যার কারনটি সেখানেই যেখানে এ জাতীয় চিন্তাধারা এরা শিক্ষাকারে ছড়াতে পারেন, এদের বিপুল সংখ্যক সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে উঠে, যাদের মাঝে সমাজের উচ্চশিক্ষিত ব্যাক্তিবর্গও থাকেন। প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদের পক্ষে সাধারনের মাঝে যখন সমর্থন বাড়ে তখন চিন্তিত হতেই হয়। মূল কারন এ ধরনের সমর্থকরা মনেপ্রানে চান দেশে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাবস্থা বাতিল করে ইসলামী ব্যাবস্থা কায়েম হবে (সম্ভবত খিলাফত, খিলাফতের পতন ওনাদের মতে বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের যাবতীয় সমস্যার কারন), যেখানে আল্লামা শাফি, জুনায়েদ বাবুনগরী এই জাতীয় আলেমগন সরাসরি সরকারে না বসলেও অন্তত এডভাইজার হিসেবে থাকবেন।

প্রকৃতপক্ষে এই মূল্যবোধ বিভাজন জনিত সমস্যা আমাদের দেশেরই ইউনিক নয়, বলতে গেলে গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ আছে এমন সব দেশের মুসলমান সমাজেই কম বেশী আছে, এমনকি পশ্চীমা বিশ্বেও আছে। দিনে দিনে এই সমস্যা আরো বাড়বে বই কমবে না, খুব সহজবোধ্য কারনে। এই ভিডিওতে দেখুন তিউনেশিয়ার একটি সাম্প্রতিক ঘটনা। ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার চিত্রশিল্পীদের উগ্রবাদী গোষ্ঠীর হত্যার হুমকি (আমাদের দেশে যেমন ভাষ্কর্যের বিরুদ্ধে আষ্ফালন, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্কর্যের বিরুদ্ধে ডবল হুমকি)। সেখানেও শীর্ষ ইমাম সাহেব কোরানের দোহাই পেড়ে তার ভাষায় ধর্মত্যাগীদের হত্যার ফতোয়া বীরদর্পে জাষ্টিফাই করেন, সেই মোল্লার পক্ষেও ঈমান্দার বান্দাদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাওয়া বোঝায় যে উগ্রবাদী বলা হোক (কারো ভাষায় হয়তবা ভুল ইসলাম প্রচারকারী) আর যাইই হোক এই জাতীয় আলেম মোল্লাগনের সাপোর্ট বেজ সেখানেও ভালই আছে। যুগের সাথে সকলে ধর্মের যাবতীয় বিধি বিধান মানা থেকে কিছু না কিছু মাত্রায় সরে আসবেই, তারা সরাসরি ঘোষনা দিয়ে নাস্তিক মুরতাদ হলে তো কথাই নেই, আর তেমন ঘোষনা না দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করলেও রেহাই নেই। ধর্ম যাদের কাছে অতি প্রিয় তারা এই জাতীয় প্রান্তিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে যাবে কট্টরবাদী মোল্লাচক্রের পেছনেই। বাংলাদেশও ব্যাতিক্রম কিছু নয়, হয়ত প্রকাশ ভংগিতে এখনো কিছুটা তফাত থাকতে পারে। অতীতে কবি শামসুর রহমানের ওপর হামলা হয়েছে, হুমায়ুন আজাদ মরে বেঁচেছেন, সময়ে সময়ে নিরন্তর ফতোয়া (হত্যার ফতোয়াও আছে) আসে এবং আসবে জাফর ইকবাল, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, অধ্যাপক এমএম আকাশ, সুলতানা কামাল এই জাতীয় বুদ্ধিজীবিদের নামে, কারন তারা ধর্মনিরপেক্ষ ধারার। মুনতাসীর মামুন কোরান হাদীসের প্রসংশা করলেও লাভ নেই, কারন উনি রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি বা রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থায় ধর্ম জড়ানো সমর্থন করেন না, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লেখেন। দেশের কয়টি মসজিদ মাদ্রাসা থেকে এ জাতীয় কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করা হয় কেউ জানাতে পারবেন কি? ইসলাম তো এসব উগ্রবাদ মোটেই সমর্থন করে না আমরা জানি।

হেফাজতের উত্থানে দেশের অনেকে বেজায় খুশী। হেফাজতের সমর্থন যারা করেন তাদের হেফাজতের ১৩ দফা দাবীদাওয়ার ব্যাপারে তেমন আপত্তি করতে দেখা যায় না। কারন আল্লামা শাফির নের্তৃত্বে হেফাজতের উথানের সাথে তারা ইসলামের পূণঃজাগরনের সন্ধান পাচ্ছেন। লক্ষনীয় যে আল্লামা শাফির বক্তব্য যা আগে কোট করেছি সেসব পয়েন্ট ধরেই অনেকে ইসলাম সমালোচনা করে (যেমন ইসলাম নারী স্বাধীনতা পরিপন্থী)। এর বিপরীতে যারা ইসলাম ডিফেন্ড করেন তারা প্রমান করেন যে ইসলামে নারী বিদ্বেষী কিছুই নেই, যেমন মেয়েদের কাজ করার পূর্ন অধিকার আছে, পড়াশুনার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা নেই। ইসলামে যা নেই বলে ওনারা সর্বদা দাবী করেন সেসব শিক্ষা মাদ্রাসায় ওয়াজ মাহফিলে বিতরন করে আসলেও সেসবের বিরুদ্ধে কোন কথাই ওনারা কোনদিন বলেন না। এই অদ্ভূত আয়রনি সব সময়ই আমাকে ভাবায় নানান ইস্যুতে। ধর্ম যেসব সাইটে গুরুত্ব পায় সেসব সাইটে কোন লেখক আল্লামা শাফি, চরমোনাইর পীরের এই জাতীয় নানান ওয়াজের সমালোচনা করে কয়টি লেখা আজ পর্যন্ত দিয়েছেন? তাদের কেউ কি আল্লামা শাফির ইসলামী জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করার সতসাহস দেখাবেন? এই দ্বৈত মানসিকতার প্রকাশ নানান ক্ষেত্রেই দেখা যায়। যেমন শিবিরের কিশোরকন্ঠ মোহাম্মদ কদু কৌতূক ছাপালে তাতে তৌহিদী জনতার ধর্মানুভূতির কোন সমস্যা হয় না কারন জামাত শিবির রাজাকার বদর যাইই হোক তারা হল ধর্ম রক্ষক দলের, প্রথম আলো বিড়াল মোহাম্মদ ছাপালে বিরাট অপরাধ হয় কারন প্রথম আলো ধর্মনিরপেক্ষ ধারার বলে পরিচিত, এই পাজীদের দূরস্ত করার সুযোগ তো ছাড়া যায় না।

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নাস্তিক মুরতাদ ব্লগারদের মত ইসলাম বিদ্বেষী লেখালেখি কবে করেছে কে জানে, তাদের ওপর যুদ্ধপরাধী বিচার সমর্থনকারী হেফাজতের বেজায় রাগ। শাহরিয়ার কবিরের ওপরও শান্তিপূর্ন হেফাজতের এত ক্ষোভ কেন যে তাকে শারীরিক ভাবে হামলা করতে হয়? মুনতাসীর মামুন নাস্তিক মুরতাদ তো দূরের কথা, ওনার নানান লেখায় মাঝে মাঝে দেখি কোরান হাদীসের নানান বানীর গুনগান। ওনার ওপরেও হেফাজতের এত ক্ষোভ কেন? জাফর ইকবাল স্যার কোনদিন কবে ইসলাম বিদ্বেষী কথাবার্তা বলেছেন? এরা সকলে কেন হেফাজতের টার্গেট (এনাদের সহ আরো বেশ ক’জনার নামে গত ২০শে ফেব্রুয়ারী হেফাজত কিছু পত্রিকার প্রথম পাতায় আধা পৃষ্ঠাব্যাপী নানানবিধ অভিযোগ করেছে যার মূল কথা ওনারা ইসলাম বিদ্বেষী)? মূল কারন শুধু যুদ্ধপরাধীদের বিচার নয়, এই দলের সদস্যরা ধর্মনিরপেক্ষ ধারার বুদ্ধীজীবি বলে পরিচিত। সে কারনেই হেফাজতের সমর্থক যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী তারাও এসব ফতোয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। কারন ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী হওয়া মানেই তো এক অপরাধের সামিল। এসব বুদ্ধিজীবির প্রতি তাই তাদের তেমন সহানুভূতি নেই। একেবারে গলায় কোপ পড়লে তখন বড়জোর ‘আমরা তীব্র নিন্দা জানাই- ইসলাম কোনভাবেই এসব সমর্থন করে না’ জাতীয় দুয়েক কথা বলে দেবেন। অতীতেও জামাত শিবিরের লোকজন জাফর ইকবালের নামে বিভিন্ন সময়ে ব্লগ ব্লগে অপ্রপ্রচার চালালেও ধর্মপ্রিয় লোকজনকে দেখেছি এক ধরনের নীরবতা পালন করতে। এই ধরনের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির ভাইদের কলম থেকে রাজীবকে নিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের সমর্থকদের লেখার মিথ্যাচারের চুলচেরা বিশ্লেষনাত্মক প্রমান পাওয়া যায়, কিন্তু আমার দেশের সাম্প্রদায়ি উষ্কানি, মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে একটি অক্ষরও সরে না, জাফর ইকবালদের নাস্তিক মুরতাদ বলা হলেও (যা ধর্মমতেই অন্যায়) কোনদিন তার প্রতিবাদে একটি লেখাও বার হয় না। জাহানারা ইমামসহ অনেককে যখন অতীতে এই চক্র নাস্তিক মুরতাদ ঘোষনা করেছিল তখনো তৌহিদী জনতার তেমন কোন সাড়া শব্দ লক্ষ্য করা যায়নি। ব্লগ তো বাস্তব জীবনেরই ক্ষুদ্র স্যাম্পল। এদেশে উগ্র মৌলবাদ, রাজাকারবাদের প্রসার দিনে দিনে আরো বাড়বে এতে আর অবাক হবার কি আছে।

আমিনী হুজুর বা হেফাজতে ইসলামের অন্যতম মূল শক্তি হল মাদ্রাসার সরলপ্রান কোমলমতি ছাত্র যাদের সত্য বলতে এক রকমের লাইভ জোম্বি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ধর্মপ্রান মানুষ সোয়াব অর্জনের আশায় অসংখ্য মাদ্রাসা খুলে যাচ্ছেন, দান সদকা করছেন, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী ভ্রাতারাও হাত খুলে সাহায্য করেছেন, তার সুফলও দেখা যাচ্ছে। হুজুররা শুধু বলার অপেক্ষা ইসলাম বিপন্ন, ব্যাস বিপুল সংখ্যক তৌহিদী জনতা অদ্ভূত কিছু দাবী দাওয়া কায়েমের নামে নেমে আসবে রাস্তায়। এক পর্যায়ে তান্ডব থামাতে সরকারকেও কঠোর ব্যাবস্থা নিতে হবে, তাতে শহীদও হয়ে যাবে কয়েকজন; যেমন অতীতে ব্রাক্ষনবাড়িয়ায় হয়েছে, এবার হেফাজতের আন্দোলনে দেশের নানান যায়গায়ও হয়েছে, অন্যান্য দেশেও হয়েছে, হচ্ছে। আমাদের দেশের পুলিশ রাস্তায় সব সময়ই অতি কঠোর, ন্যূনতম মানবতারও ধার অনেক সময় ধারে না। ফলে বাড়বে এদের প্রতি আরো সহানুভূতি। মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যাবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই, ভবিষ্যতে লেখার আশা রাখি। কওমী মাদ্রাসাগুলিতে কিছু হিসেব অনুসারে ২৫-৩৫ লাখ ছাত্রছাত্রীও পড়াশুনা করে। কিছু সূত্র দেখায় যে কওমী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষগুলি সনাতনভাবেই সরকারী অনুদান দিতে চাইলেও গ্রহন করে না, কারন তাহলে সরকারী নিয়ন্ত্রনে চলে আসতে হবে; অন্য কথায় সিলেবাস আধুনিক করতে হবে যাতে ছাত্রদের জোম্বি বানানোর প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও কঠিন হয়ে পড়বে। এই বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর পাঠক্রমের ওপর সরকাররের কোন নিয়ন্ত্রন থাকবে না এটা খুবই বিপদজনক। এই হারে দিনে দিনে মাদ্রাসার সংখ্যা আরো বাড়বে, তেমন শক্তিশালী হবে এই প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী দলগুলির পেশীশক্তি, পরিনতি খুবই অনিবার্য। ওনারা গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসতে পারলে কোন আপত্তি নেই, গনতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সম্মান জানাতেই হবে। তার চাইতে বড় আশংকার বিষয় আছে দিনে দিনে দুই ধারার মাঝে সঙ্ঘাত বাড়বে যা সহিংসতায় রূপ নেওয়া খুবই স্বাভাবিক।

আল্লামা শাফির উদাহরন এবং ওপরের কথাগুলি বলার বলার কারন কয়েকটি। প্রথমত এই মাননীয় বিশিষ্ট আলেম যাকে অনেকে দেশের শীর্ষ আলেম বলে চেনেন তিনি দেশের অন্যতম সেরা বলে পরিচিত এক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান। স্বাভাবিকভাবেই মনে করার কারন আছে সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি ধরনের বিদ্যাবুদ্ধির চর্চা হয়, হাজার হাজার ছাত্র সেখানকে কি ধরনের শিক্ষা পায়? এসব শিক্ষার হালকা প্রকাশ বিচ্ছিন্নভাবে হলেও দেখা গেছে হেফাজতের ঢাকা অভিযানের সময় রাস্তাঘাটে ‘বেপর্দা’ মহিলা ঘটিত কিছু ঘটনায়, শুধু ‘মাথায় কাপড় দেন’ জাতীয় হুমকি/চোখ রাংগানীই নয়, এক সাংবাদিকের ওপর নজির বিহীন ভাবে দল বেঁধে হামলা হয়েছে শুধু মহিলা হবার অপরাধে। দিনের পর দিন নারী বিদ্বেষী ওয়াজ শুনিয়ে ঘটনা ঘটার পর দূঃখ প্রকাশে খুব বেশী অর্থবহ হয় না। দ্বিতীয়তঃ হেফাজতের উত্থানে যারা ইসলামের পূনঃজাগরন ঘটেছে ভেবে আত্মতৃপ্তি পাচ্ছেন তারা কি আদৌ জানেন বা চিন্তা করেন কিসের উত্থান আসলে ঘটতে যাচ্ছে? নাকি তারা ভালই জানেন এবং এ ধরনের ব্যাক্তিবর্গের প্রভাবে দেশ চলবে সেটাই চান? সেটা চাইলে আমার বলার কিছু নেই, যার যেমন মত। আল্লামা শাফি একাই এই জাতীয় কথাবার্তা বলেন মনে করার কোন কারন নেই। আল্লামা শাফির ডেপুটি আরেক আলেমে দ্বীন মাওলানা বাবুনগরীরও কৌতূহলপোদ্দীপক লেকচার আছে। আরেকজন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা কাম ইসলমাপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতা চরমোনাই পীর মুফতি ফজলুল করিম সাহেব হেফাজতের সম্মেলনে পাশ্চাত্য ধারার কুফরি সংবিধান পালটে কোরান হাদীসিয় আইন কানুন প্রতিষ্ঠা প্রত্যেকের জন্য ‘ফর্যে আইন’ জেহাদ বলে ঘোষনা করছেন (সূত্র-৪, ২৬ মিঃ)। দেশের প্রচলিত সংবিধান ওনার মতে বেঈমানদের বিজয়ের চিহ্ন, সেটার অপসারন না হওয়া পর্যন্ত জেহাদ চালাতে হবে। আমার ছোট প্রশ্ন হল সেই জেহাদে যারা সংবিধান রক্ষা করতে চাইবে তাদের ব্যাপারে কি বন্দোবস্ত?

তৃতীয় আরেকটি কারন হল অভিযোগ আছে যে ধর্মনিরপেক্ষ ধারার লোকজনে ধর্ম, মাদ্রাসার ছাত্র, আলেম সমাজের ব্যাক্তিবর্গদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হাসি ঠাট্টা করে। অভিযোগ একেবারে মিথ্যা নয় স্বীকার করতে হয়। তবে তার কারন বোঝা কি খুব কঠিন? এ জাতীয় অদ্ভূত, যুগের সাথে অচল, সরাসরি সংবিধানের প্রতি হুমকি, কখনো বা হাস্যকর তত্ত্বের প্রচারনা চালালে শুধু ধর্মীয় চরিত্র কিংবা ধর্মের নামে চালানো হচ্ছে বলে কেউ প্রতিক্রিয়া দেখাবে না আশা করা যায়? এভাবে ধর্মকে বাস্তব জীবনের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক পর্যায়ে নিয়ে যায় আসলে কারা? ধর্মের পেছনে কি লোকে শখ করে লাগে? আল্লামা শাফি বয়োবৃদ্ধ মানুষ, ওনাকে দেখলে ভক্তি শ্রদ্ধা হয় শুধু বয়সের কারনেই। উনি এসব কথাবার্তা নিজের মত ব্যাক্তিগত গন্ডিতে বলে বেড়ালে তার পিছে নষ্ট করার মত সময় আমার নেই, যে বিদ্যাবুদ্ধির চর্চা সারা জীবন করেছেন তাতে এ জাতীয় মূল্যবোধের জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক। আশা করা যায় ওনাদের জেনারেশন শেষ হলে এ জাতীয় তত্ত্বের চর্চা বন্ধ হবে। ওনারা তো সেটা যাতে না হয় সেজন্য বদ্ধপরিকর; আপত্তির কারন এখানেই। রীতিমত বিশাল বিশাল বিদ্যালয় খুলে, ওয়াজ মাহফিলের নামে এসব শিক্ষা বিলিয়ে চলেছেন, ভক্তরা অসীম জ্ঞানের সন্ধান লাভ করে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। জীবনে যে কয়টা ওয়াজ মাহফিল শোনার সৌভাগ্য হয়েছে সেগুলিতে এসব প্রসংগে একই ধরনের কথাবার্তাই কম বেশী শুনেছি। মওদুদীবাদি আল্লামা সাঈদী, কওমী ধারার আল্লামা শাফি, চরের পীর… ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই জিনিস; আধুনিক শিক্ষার বিরোধীতা কারন সেটা কুফুরি পশ্চীমি ধারার, সামাজিক বিষুদ্ধতা রক্ষার্থের নামে নারী বিদ্বেষ, ইসলাম কায়েমের নামে জেহাদের প্রনোদনা… কেবল হয়ত ভাষা ভিন্ন। আরো বিস্ময়কর অনেকে এ জাতীয় মূল্যবোধের ব্যাক্তিবর্গের হাত ধরে দেশে ইসলামী জাগরনের স্বপ্ন দেখছেন। প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীদের পক্ষে এ রকম ব্যাপক জন সমর্থনের ফল হল দেশের প্রধানমন্ত্রীকে মিডিয়ায় মোমবাতি জ্বালানো নিষিদ্ধ করার দাবী কেন মানা যায় না তা সিরিয়াস মুখে ব্যাখ্যা করতে হয়। দেশের ইন্টেলেক্ট লেভেল সম্পর্কে কেমন ধারনা করা যায়?

এই মূল্যবোধ বিভাজনের সমস্যা কোথায়? সমস্যা ছোট থেকে শুরু করে অনেক ব্যাপক হতে পারে। প্রত্যক মানুষই স্বতন্ত্র, মতের অমিল তাই খুবই স্বাভাবিক, ভিন্ন মত উতসাহিত করা ছাড়া কোন সমাজ আগায় না। মতের অমিল মূল্যবোধের ওপরও অবশ্যই প্রভাব ফেলে, কিন্তু তাই বলে কোন সমাজে মূল্যবোধে বড় ধরনের মৌলিক পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক নয়। এর পথ ধরে জন্ম নেবে চিরস্থায়ী দ্বন্দ্বের যার আবর্ত থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভবের মত। দু’জন ধার্মিক আমেরিকানের মাঝে রিপাললিকান পার্টি ডেমোক্র্যাট পার্টি নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে, মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি নিয়েও তীব্র মতভেদ হতে পারে, কিন্তু গান শোনা যাবে কিনা, নারী শিক্ষার প্রয়োযন আছে কিনা, মূর্তি স্থাপন করা যাবে কিনা বা দেশের সংবিধান পালটে ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিতে সংবিধান কায়েম করা হবে কিনা এসব বিষয় নিয়ে মতভেদ হবার চিন্তা অচিন্তনীয়। মূল্যবোধের এই ন্যূনতম ইউনিফর্মিটি তাদের সমাজেও কোনদিন আসত না ধর্মকে জীবন যাপন নিয়ন্ত্রনের একমাত্র উপায় রূপে ব্যাবহারের দর্শন থেকে মুক্ত হতে না পারলে। কেঊ নিজে কোন কারনে ইংরেজী শিক্ষা খারাপ, গান শোনা হারাম, পর্দা করা উচিত মনে করে এসব নিয়ম পালন করলে সমস্যা নেই, সেটা ব্যাক্তি স্বাধীনতার পর্যায়ে পড়ে। মূল্যবোধের এই মাত্রায় তফাত সহনীয়। মুশকিল হয় সে যদি প্রচার করা শুরু করে এসব যারা পালন করে না তারা মহাপাপী এবং যাবতীয় সর্বনাশের কারন, তাদের এসব ব্যাক্তি স্বাধীনতা হরন করতে হবে তবে সেটা রূপ নেয় সঙ্ঘাতের দিকে।

সমস্যার ছোট উদাহরন হতে পারে আমাদের দেশে এক ধরনের লোকে পহেলা বৈশাখ পালন করে, আরেক ধরনের লোকে মনে করেন সেটা পালন করা তাদের ধর্ম বিরুদ্ধ, শুধু তাতেও থেমে থাকলে হত। তারা সেটাকে ভিত্তি করে নানান সাম্প্রদায়িক প্রচারনা চালান, বৈশাখ মাসের আগ থেকেই শুরু হয় ধর্মীয় সাইটগুলিতে নানান ফতোয়া। অন্য ধারার লোকে সেসবের জবাব দেবে না? সঙ্ঘাত এক পর্যায়ে হবেই, ঠেকানো যাবে না। এ জাতীয় নানান ঘটনার সূত্র ধরে মেরুকরন চলবে। বৃহত্তর চিত্রে সরকার নির্বাচনের জন্য মূল বিবেচ্যগুলি চলে যাবে আড়ালে; যেমন সামনের নির্বাচনে দুটি বিষয় ভোটারদের প্রবল ভাবে প্রভাবিত করবে। একদলের কাছে রাজাকারদের বিচারকারী আওয়ামী লীগই হবে একমাত্র গ্রহনযোগ্য দল, এই দলের গত ৫ বছরের নানান ব্যার্থতা/দূর্নীতি এসবের কোন প্রভাব থাকবে না। আরেক দলের কাছে প্রধান হবে আওয়ামী লীগের ইসলাম বিদ্বেষী কার্যক্রম কিংবা ইসলামপন্থীদের ওপর অত্যাচার নীপিড়ন যার ফলে তারা আওয়ামী বিরোধী শিবিরের দিকে ঝুঁকবে, তাদের অতীত রেকর্ড যতই কলংকিত হোক কিংবা যুদ্ধপরাধীদের সাথে গলাগলি করুক এসব কিছুই আসবে যাবে না। কোন দলেরই অবস্থান স্বাভাবিক নয় বলাই বাহুল্য।

আমেরিকায় সম্প্রতি অস্ত্র নিয়ন্ত্রন আইন নিয়ে বিতর্কে এক অদ্ভূত জিনিস দেখা গেছে। প্রায় ৯০% লোকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রন আইন চাইলেও দেখা গেছে বিপক্ষ শক্তি মাইনরিটি হয়েও জিতে যাচ্ছে। এর সরল ব্যাখ্যা হল যে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ মত প্রকাশ করাই দাবী আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়, সেই দাবী আদায়ের জন্য তারা কতটা সক্রিয় সেটাও বড় ফ্যাক্টর। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিশ্চয়ই যুদ্ধপরাধীদের বিচার চায়, কিন্তু দৃঢ়ভাবে চেয়েছে কী? বিচার সমর্থক এক বড় অংশই ‘কিন্তু’ ‘বাট’ পরিমন্ডল থেকে বেরুতে পারেনি। এই কিন্তু বাটের মূলে আছে বড় মাত্রায় সেই ধর্মীয় চেতনার প্রভাব। আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুটা লেখালেখির চেষ্টা করলেও যুদ্ধপরাধী ইস্যু সযত্নে এড়িয়ে যেতে চেয়েছি, কারন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আমি যা বুঝি তাতে কোনদিন মনে হয়নি এ প্রচেষ্টা তেমন সফল হবে বলে। আমাদের দেশের লোকে যুদ্ধপরাধীদের বিচার চাইলেও বড় এক অংশ চুড়ান্তভাবে সেটা গ্রহন করতে পারবে না, বিশেষ করে রিলিজিয়াস ইনস্টিটিউট বলতে যা বোঝায় তাদের সিংহভাগ কোনদিন এই বিচার প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে গ্রহন করতে পারবে না, এক সময় এরা মাঠে নামবেই (যেমন ‘অজামাতি’ আল্লামা শাফির মূল্যায়ন আগেই দিয়েছি)। এই মহলকে অখুশী করা যে কোন রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ। সাথে থাকবে আন্তর্জাতিক চাপ, এখন পর্যন্ত ২/৩ টি মুসলমান প্রধান দেশে থেকে চাপ দেওয়া হয়েছে। সময়ের সাথে আরো বাড়বে। ’৭১ এর ইতিহাস হুবহু একই রকমের কথাই বলে। যত যাইই বলা হোক, এর পেছনে রয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধ, ব্রাদারহুড এসবের ভূমিকা।

বলা ভাল যে আমি যুদ্ধপরাধীদের বিচার বলতে শুধু ৮/১০ জন লোকের বিচার বুঝি না। শুধু ৮/১০ জনকে জেল ফাঁসী দিলে হয়ত বিচারের প্রতিহিংসার অংশ চরিতার্থ হবে কিন্তু ভবিষ্যতে এই ধারা প্রতিরোধের তেমন কিছু হবে না। আধুনিক কালের বিচারের মূল লক্ষ্য প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চাইতে এ জাতীয় অপরাধ যেন ভবিষ্যতে না হয় সেটা নিশ্চিত করা। যুদ্ধপরাধী বিচার ইস্যুতে কেন আমি আশাবাদী নই তা দুটি উদাহরন দিলে হয়ত বোঝা যেতে পারে।

এক সময় ইনকিলাব ছিল দেশের শীর্ষ সার্কুলেটেড পত্রিকা যার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিল কুখ্যাত রাজাকার মালানা মান্নান। আমাদের ছাত্রজীবনে অনেককে দেখেছি ইনকিলাব ছাড়া অন্য পত্রিকা না পড়তে, মূল কারন সে পত্রিকায় নানান ইসলামী বিষয় লেখা হত। ইসলাম বিষয়ক লেখালেখির প্রতি মায়ার কাছে মান্নান মাওলানার রাজাকারি ব্যাকগ্রাউন্ড পরাজিত, ফলে সে হয়ে গেছিল সমাজের এক বিশিষ্ট ব্যাক্তি। এই মান্নান মাওলানা মারা যাবার পর ছুটে গেছিলেন একাধিক পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। ব্লগের এক ঘটনা বলি। একজন শ্রদ্ধ্বেয় বড় ভাই যাকে আমরা সকলে ছাগু ফাইটার হিসেবে চিনি, এক ব্লগে একজন জামাতি সমর্থকের সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তুমুল তর্ক করছেন। সেখানে আরেকজন তাদের উভয়কেই পরামর্শ দিচ্ছেন ইসলামের রজ্জু ধরে মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে। এই তৃতীয় ভদ্রলোক জামাতি হলে বলার কিছু ছিল না, তিনি জামাতি নন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী একজন সাধারন ব্যাক্তি আর কাছে ধর্ম খুব গুরুত্বপূর্ন। (সংগত কারনেই তাদের নাম বা লিংক দিচ্ছি না, তবে তারা কেউ চাইলে অবশ্যই দেব)। ওপরের ঘটনাগুলি অনেকে ব্যাতিক্রম বলতে পারেন, আমি পারি না। হয়ত আমিই দূর্ভাগ্যক্রমে সারা জীবন আশে পাশে এই ধরনের ঘটনা অজস্র দেখেছি। জামাতি কয়েকজনকে সাজা দিয়ে (আদৌ যদি দেওয়া যায়) স্বাধীনতা বিরোধী চেতনার লোকজনের সাথে ভ্রার্তৃত্ববোধের বন্ধন কাটাতে না পারলে লাভটা হল কোথায়? স্বাধীনতা বিরোধী চেতনা সমাজে থেকেই যাবে এবং তার পরিষ্ফুটন এভাবেই অপ্রতিরোধ্যে ভাবেই ঘটবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসীদের হাতেই। মুক্তিযোদ্ধাদের গাদ্দার বলে গালি দেওয়া মাওলানা ওবায়দুল হকও একই কারনেই বড় আলেম হিসেবেই দাপটের সাথে দিন কাটিয়ে গেছেন। এদের সামাজিক ভাবে বর্জন না করতে পারলে কয়েকজনকে শুধু জেল ফাঁসী দিয়ে কি হবে?

মূল্যবোধ বিভাজনের এই প্রক্রিয়াতেই স্বাভাবিকভাবে আমরা যাদের প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী বলি তাদের সমর্থনের পাল্লা বাড়বে, যার প্রমান এবারের হেফাজতের উত্থানে বিপুল সমর্থনে প্রমান পাওয়া গেছে। কারন যতই এসব মৌলবাদীদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই জাতীয় দাবী করা হোক এই মৌলবাদী দলেই আলেম মোল্লাগনের অবস্থান। ধর্মভিত্তিক ব্যাবস্থার স্বপ্ন যারা দেখেন তাদের পক্ষে এদের পক্ষে দাঁড়ানোটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধপরাধী ইস্যুতে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সুবিধে পাবে জামাত। যুদ্ধপরাধী আইনী প্রক্রিয়ায় শাস্তি পেলে তো কথাই নেই, কিংবা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিদেয় হোক, এরপর এই দলের যুদ্ধপরাধীদের দল অপবাদ থেকে মুক্তি পাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। স্বাধীনতার ১০ বছর পর যেই নেতার জন্ম তাকে নিশ্চয়ই রাজাকার বদর বলা যাবে না। হেফাজতের ব্যাপক জনসমর্থন দেখা গেলেও একই সাথে রাজনৈতিকভাবে তাদের দূর্বলতাও অত্যন্ত প্রকটভাবে দেখা গেছে। অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলির অবস্থা আরো করুন। দেশে ইসলামী বিপ্লব জাতীয় কিছু করার চিন্তা করতে হলে জামাত ছাড়া আর তেমন বিকল্প নেই। যুদ্ধপরাধীদের মিলন মেলা জামাতের বর্তমানে (৫-৬)% ভোট ব্যাংক থেকে থাকলে যুদ্ধপরাধী মুক্ত জামাতের ভোট ব্যাংক নিঃসন্দেহে আরো অনেক বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যেই যুদ্ধপরাধীদের বিচার চান এমন লোকজনকেই বলতে শুনি যুদ্ধপরাধীমুক্ত জামাতে তাদের কোন অসুবিধে নেই। জামাত এক সময় নানান জাতীয় দিবসে অনেকটাই নীরব থাকতো, গত ১০/১২ বছর তারা নানান জাতীয় দিবস পালন করে, এমনকি বুদ্ধিজীবি হত্যা দিবসও পালন করে। মূল কারন তারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী নয় সেটা প্রমান করে গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা। ইসলামী আদর্শ কায়েম করার ব্যাপারে দায়বদ্ধ, যুদ্ধপরাধীমুক্ত, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক জামাত শিবির যাদের দলের বেশীরভাগ সদস্যের জন্ম ’৭১ এর পর তাদের জনপ্রিয়তা দেশে বাড়বেই এতে সন্দেহ করার তেমন কারন নেই। ধর্মভিত্তিক ব্যাবস্থার সমর্থকরা এক সময় হয়ত এই দলের অধীনেই ঐক্যবদ্ধ হবে। গনতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলে এটা মেনে নিতেই হবে।

দেশে বড় দুই রাজনৈতিক দলই মোটাদাগে ব্যার্থ, নানান অভিযোগে অভিযুক্ত। মানুষ এক সময়ে বিকল্প খুঁজবেই। মুসলমান প্রধান যেসব দেশে রাজতন্ত্র নেই সেসব দেশেই মোটামুটি দেখা যায় একই চিত্র। দূর্নীতি, কুশাসন, নাগরিকদের এক সময় বিরক্ত হয়ে আন্দোলনের পথে বিকল্প অনুসন্ধান এবং সেই বিকল্প হল ধর্মীয় ব্যাবস্থা কিংবা ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসা। কাজেই সামনের ৫/১০ বছরে না হলেও আরেকটু ধৈর্য্য ধরলে জামাতের ভবিষ্যত আমি উজ্জ্বলই দেখি। বিএনপির সাথে লেগে থেকে ক্ষমতার ভাগীদায় তারা আবারো হবে, সেটা সামনের বার না হলে হয়ত তার পরের বার, এরপর তারা এগিয়ে যাবে আরো অনেক দূর, এরপর বিএনপির ওপরও আর নির্ভর করার দরকার হবে না। শুধু জামাত নিষিদ্ধ করা সাময়িক স্বস্থি ছাড়া তেমন কোন ফল দেবে না, জামাত নিষিদ্ধ করলেই তাদের ভোট ব্যাংক এবং সহানুভূতিশীলরা নৌকা মার্কায় ভোট দেবে না। শতকরা হিসেবে কম মনে হলেও যে বিপুল পরিমান সমর্থক/অর্থ বিত্ত তাদের আছে তাতে আরেকটি দল নুতন নামে খোলা কোন ব্যাপারই নয়। শতকরা হিসেবও বা কম কিভাবে বলি? জামাতের নিজের ভোট ব্যাংক (৫-৬)% এর বাইরেও তাদের নীরব ও সরব বহু সমর্থক আছে তাদের কেউ কেন জানি গণনায় নেয় না। এটা খুব বড় ধরনের ভুল, যার মাশুল কতটা বড় হতে পারে এবার নিশ্চয়ই বোঝা গেছে, প্রতিপক্ষের শক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ফল ভাল হয় না। বিশেষ করে বিএনপির ভোট ব্যাংকের সম্ভবত অর্ধেকই জামাতের প্রতি সহানুভূতিশীল। বিএনপির পক্ষ থেকে সরাসরি জামাতের পক্ষে, যুদ্ধপরাধীদের পক্ষে ওকালতি করা হয়েছে, হচ্ছে। তাতে কি বিএনপির সাধারন সমর্থক থেকে শুরু করে নেতা কর্মী, বুদ্ধিজীবি মহল থেকে তেমন কোন প্রতিবাদ এসেছে? ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ মৌলবাদী শায়খুল হাদীসের দলের সাথে নির্বাচনী জোট বাধার পর দলের সাধারন সমর্থক থেকে শুরু করে গাফফার চৌধূরীর মত দলকানা বুদ্ধিজীবি পর্যন্ত গর্জে উঠেছিলেন। বিএনপির ক্ষেত্রে হয় আরো উলটো, দলীয় বুদ্ধিজীবিরা জামাতের সাথে জোট বাধায় উল্লসিত হন। মূল কারন শুধু আওয়ামী ঠেকাও নয়, কারন নীতিগতভাবে এই দল জামাতের প্রতি সহানুভূতিশীল। দলের মুক্তিযোদ্ধা অংশের বর্তমান মনোভাব অনেকটা কাদের সিদ্দীকি, মেজর জলিল বা হামিদুজ্জামান, কিংবা আফতাব আহমেদের মত। ধর্মীয় মূল্যবোধের মেরুকরনের ঢেউ মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝেও আসবে না হতে পারে না। এ সত্য আমার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিও হজম করতে চায় না, সম্ভবত আত্মসম্মানে লাগে। সামান্য কিছু লোকে টাকা পয়সা খেয়ে জামাত সমর্থক হয়েছে এবং বাকবাকি সকলে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক এভাবে চিন্তা করার মাঝে আত্মপ্রসাদ আছে। তাই প্রথম আলোর জরিপে জামাত নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে জনমতের পরিমান দেখলে বিস্মিত হতে হয়।

প্রকৃত পক্ষে দেশে মৌলবাদের প্রতি যে রকম সমর্থন আছে তাতে এখন এমনকি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করাও এমন কিছু ফল দেবে না, এবং সেটা গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে বিরোধপূর্নও বটে। যদিও মজার ব্যাপার হল দেশে ইসলামপন্থী দলগুলি মিলিয়ে ৮% এর বেশী ভোট পায় না, কিন্তু তাও এদের নিষিদ্ধ ঘোষনার দাবীতে লোকে গর্জে ওঠে, আমাদের গনতান্ত্রিক চেতনা খুবই প্রসংসনীয়। বর্তমান আর্থ সামাজিক অবস্থায় ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করার সাথে জন্ম দেবে নুতন নুতন জটিলতার। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বলতে ঠিক কি বোঝায় তা কিভাবে নির্ধারন করা যাবে? ’৭৫ এর পর ধর্মের ব্যাবহার জনমানসে যে প্রবল গতিতে হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগকেও অনেক সময় ধর্মভিত্তিক দল মনে হতে পারে। তারাও কোরান হাদীসের নামে নানান ওয়াদা করে। ’৯১ এর নির্বাচনে দেখা গেছিল সেক্যুলার আওয়ামী লীগও ‘নৌকার মালিক তুই আল্লাহ” শ্লোগান নিয়ে “ধানের শীষে বিসমিল্লাহ” আর “ভোট দিলে পাল্লায় খুশী হবে আল্লায়” শ্লোগানের মোকাবেলায় নেমেছিল। রাজনৈতিক দল ভোট পেতে যা দরকার তাইই করবে, তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ইসলমাপন্থী দলগুলির সুবিধে হল প্রচলিত অর্থে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ছাড়াও তারা অনায়াসে রাজনীতি করতে পারে নানান ধর্মীয় মোড়কে; যেমন জামাত ’৭১ এর পর নিষিদ্ধ হলেও তাদের কিছু নেতা নানান ওয়াজ মাহফিলের আড়ালে দল সঙ্ঘবদ্ধ করার কাজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছিল। অতি সম্প্রতি দেখা গেছে অরাজনৈতিক ভাবে একই কায়দায় নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরও ততপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের দলের সদস্য হচ্ছে মূলতঃ সমাজের উচ্চশিক্ষিত শ্রেনীর সদস্যরাই। মৌলবাদ আগে যেমন ধারনা করা হত কেবল গন্ডগ্রামের মাদ্রাসা মক্তব্যে সীমাবদ্ধ সে ধারনা বদলে যাচ্ছে দ্রুত। চেতনাগত পরিবর্তন আনা না গেলে নিষিদ্ধ করাকরির ফল শূন্য।

অনেকে দাবী করেন যে ইসলামে রাজনীতির কোন ব্যাপার নেই, বা ইসলাম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল করতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কথাটা যারা বলেন তারা হয় ইসলামের অতি বেসিকও জানেন না আর নয়ত ইচ্ছেকৃতভাবে কোন কারনে সত্য গোপন করেন। মুসলমানদের জন্য ইসলাম কেবল বর্তমান কালে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মত স্রেফ ধর্মই নয়, ইসলাম পূর্নাংগ জীবন ব্যাবস্থা, যেটা কায়েম করা অতি জরুরী। জীবনের প্রতি পদই ইসলাম মেনে চালাতে হবে; সে আইন আদালত, নারী নীতি, শিক্ষা নীতি, পররাষ্ট্র নীতি, অর্থনীতি যাইই বলেন। সেটা ইসলামী হুকুমত কায়েম করা ব্যাতিত কিভাবে সম্ভব? কাজেই ইসলাম পূর্নভাবে মানার দাবী করলে রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থা থেকে ইসলামকে পৃথক করার অবকাশ নেই। চরমোনাই পীরের রাজনৈতিক তত্ত্ব আগে বলেছি (সেক্যুলার সংবিধান বাতিল করে কোরান হাদীসিয় সংবিধান কায়েমের জেহাদ)। উনি দাবী করতেই পারেন এমন তত্ত্ব প্রচারনা ওনার ধর্মীয় অধিকার, ইসলামে পূর্ন বিশ্বাসী কারো পক্ষে তার বিপক্ষে ঠিক কি যুক্তি দেওয়া সম্ভব? ওনার দাবীর বিরোধীতা প্রকারান্তে ইসলাম অস্বীকার। ধর্মনিরপেক্ষ ধারার মুসলমানদের এ কারনে ধর্মভিত্তিক ধারার লোকজনের রোষের মুখে পড়তে হয় যার প্রমান ব্লগে বাস্তব জীবনে ভুরি ভুরি দেখা যায়, আওয়ামী কর্মী/সমর্থকরা এই তোপে পড়ার শীর্ষে। ইসলামে পূর্ন বিশ্বাসী দাবীদার কারো পক্ষে বলা সম্ভব যে তিনি কোরান সুন্নাহ ভিত্তিক সংবিধান মানেন না? সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই ’৬৯ সালে বাংগালী জাতীয়তাবোধের চরম উত্থানের সময়ও বংগবন্ধুকে বলতে হয়েছিল যে তিনি নির্বাচিত হলে কোরান সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করবেন না। একই ওয়াদা আজকের দিনেও সব রাজনৈতিক দলকেই কবুল করে ক্ষমতায় আসতে হয়।

এখানে একটি শব্দের কৌশল লক্ষ্য করার মত। ধার্মিক মনকে শান্ত করার জন্য বলতে হয় যে আমরা কোরান সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করব না; ‘কোরান সুন্নাহ অনুযায়ী আইন করব’ এমন ওয়াদা কিন্তু কেউই করে না, কারন অত্যন্ত পরিষ্কার। দুটি কথা কিন্তু এক নয়। দুই কুল রক্ষার এরকম কৌশল খুব বেশীদিন কাজে দেবে না। হেফাজতের উত্থান অনেকেই হঠাতই ঘটেছে বললেও এদের উত্থান আসলে আগেই ঘটেছিল, তাদের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আগে থেকেই মূল অভিযোগ ছিল যে তেমন ওয়াদা করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসলেও একের পর এক কোরান সুনাহ বিরোধী আইন করে চলেছে।

আগেই বলেছি যে মূল্যবোধের এ বিরোধ শুধু আমাদের দেশেই ইউনিক নয়। পাকিস্তানের কথা বাদই থাক। আফগানিস্তানে মৌলবাদের জন্য আমেরিকা দায়ী এমন দাবী অনেকে করে আসলেও সেখানেও এই ধরনের সমস্যার সহিংস প্রকাশ আগেও দেখা গেছে। মৌলবাদীরা সনাতন ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিবর্তন কোথাও সহজভাবে নেয়নি, নেবেও না। সেখানে ’৫৩ সালে দাউদ খান প্রধানমন্ত্রী হবার পর ’৩১ সালের শরিয়া ভিত্তিক ব্যাবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেন। ধর্মনিরপেক্ষ ধাঁচের শিক্ষা নীতি, নারী নীতি (মহিলাদের কাজ করার অধিকার) গ্রহন করেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয় সনাতন ধারার সমর্থক বা মৌলবাদীরা, ’৫৯ সালে কান্দাহারে এরা ব্যাপক দাংগা বাধায়, হামলা করে সিনেমা হলে, মেয়েদের বিদ্যালয়ে। আলজিরিয়ায় তো ঘটেছিল ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। মিশরেও প্রেসিডেন্ট নাসেরের আমলে ইসলামী আন্দোলনের সৈনিক মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সরকারের ব্যাপক সঙ্ঘর্ষ ঘটে, তাদের আধ্ম্যাতিক নেতা সাঈদ কুতুবকে ফাঁসী দেওয়া হয়। তিউনেশিয়ার একটি উদাহরন আগেই দিয়েছি, সেখানেও মহিলা বিদ্যালয় পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। মনে রাখা ভাল যে আমি প্রতি ক্ষেত্রেই ইসলামিষ্টরাই দায়ী কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ শাসকরা সকলে অতি সজ্জন এমন কিছু প্রমানের চেষ্টা করছি না। শুধু বলার চেষ্টা করছি মূল্যবোধ বিভাজনের ফলাফল কেমন হতে পারে। চুড়ান্ত বিচারে কোন ব্যাবস্থা ভাল খারাপ সেটা শুধু ব্যাবস্থার ধরনের নির্ভর করে না, বেশীর নির্ভর করে কারা কিভাবে সেটা চালাচ্ছে তার ওপর।

মিশরেও এক সময়ের নিষিদ্ধ বিতাড়িত মুসলিম ব্রাদারহুড এখন গনতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছে, ইরানেও এক সময়ের বহিষ্কৃত ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বেই ইসলামী বিপ্লব হয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই সে দায় মূলতঃ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ধারার শাসকদেরই, যাদের অপশাসনে লোকে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বিকল্প সন্ধান করেছে। ইসলামী ব্যাবস্থাতেই সব সমাধান আছে আজন্ম লালিত এই বিশ্বাস তাদের তেমন অবস্থায় ইসলাম ভিত্তিক ব্যাবস্থার দিকে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহী করেছে। বাংলাদেশেও বড় রাজনৈতিক দলগুলির অব্যাহত অপশাসনে লোকে বিরক্ত হয়ে এক সময় বিকল্পের সন্ধান করবেই। সেটা জামাত হবে কিনা এই মুহুর্তে বলা না গেলেও সম্ভাবনা ভালই আছে, এই মুহুর্তে হয়ত বেশ অবাস্তব শোনাচ্ছে।

ইসলামপন্থী কোন দল ক্ষমতায় আসলেই মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে এমন কিছু আমি বলছি না। ইসলামপন্থী দলগুলির মধ্যেও মাত্রাগত বিভেদ আছে। যেমন তুরষ্কের ক্ষমতায় থাকা দল মিশরের ব্রাদারহূড থেকে অনেক আধুনিক। বাংলাদেশের ইসলামের নামে রাজনীতি করা দলগুলির মধ্যে মাঝে মনে হয় না এই লেভেলের কোন দল আছে বলে। সে যাইই হোক, গনতান্ত্রিকভাবে যেইই নির্বাচিত হোক মেনে নিতে হবে। আশংকা শুধু মূল্যবোধের বিভাজন যেন অন্যান্য কিছু দেশের মত সঙ্ঘাতের পথে না যায়। বাংলাদেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে কোন ধরনের মূল্যবোধের ব্যাক্তিবর্গদের তারা এসেট এবং কাদের লায়াবিলিটি মনে করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার, পরিষ্কার করে নির্ধারন করতে হবে ঠিক কোন ধরনের ব্যাবস্থা তারা চায়? ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মীয় ব্যাবস্থার সমান্তরাল সহাবস্থান দিনে দিনে বিপদ জনক দিকে মোড় নিচ্ছে।

ধার্মিক গোষ্ঠির ভেতরেও বিভাজন আছে যা আমাদের দেশে এতদিন অনেকটা অশ্রুত হলেও এবার সেটাও প্রকাশ হয়েছে (হেফাজত বনাম আহলে সুন্নত), সেটাও আরেক বিপদের কথা, আপাতত এখন বাদ থাক। সাথে আলোচনা করতে হবে আওয়ামী বিএনপি বড় দুই দলের ওপর মৌলবাদের প্রভাব, কিংবা বড় দুই দলের মৌলবাদের প্রতি প্রতিক্রিয়া।

সূত্রঃ

১।Religion, Politics and Security: The Case of Bangladesh – AMENA A. MOHSIN

২।ALLAMA SHAH AHAMMED SHUFI DB Top class Ahalem of Bangladesh (LATEST 2011 TAFSEER MAHFIL)-01

৩। Allama Shah Ahmad Shafi Hefajote Islam Sommelon 2011

৪।Mufti Faizul Karim – Hefajote Islam Sommelon 2011

[এ ছাড়াও আরো বেস কিছু তথ্যসূত্র আছে, সময়াভাবে সব দেওয়া এখনই সম্ভব হচ্ছে না। কারো কোনটার প্রয়োযন হলে উল্লখ করলে দেওয়া হবে।]