লেখকঃ ফারুক ওয়াসিফ

সকালে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের উল্টা দিকের ফুটপাতে চার কিশোরকে দেখলাম। জোব্বা-টুপি সবই আছে, পা শুধু খালি। ওগুলো মতিঝিলে খোয়া গেছে, আর কিনতে পারে নাই। এখন চারজন হাত ধরাধরি করে হাটছে অচেনা শহরে। ওরা জেনে গেছে দেশের রাজধানী তাদের নয়।

আরেকদিন: রোজার সময়। কারওয়ানবাজারের সার্ক ফোয়ারা পার হচ্ছিল ১৫-২০ জন মাদ্রাসাপড়ুয়া কিশোর। সন্ধ্যার সোডিয়াম আলোয় ধবধবে সাদা পোশাক পরা বাচ্চাগুলোকে মনে হচ্ছিল এখানকার নয় ওরা, ইহজাগতিক নয়। আমরা আর ওরা এক বাস্তবতার বাসিন্দা নই। হুজুর তাদের নিয়ে গিয়েছিল সোনাগাঁ হোটেলে কোনো ইফতারের দাওয়াতে। এখন ফিরছে হুজুরের পেছনে হাত ধরাধরি করে, যাতে কেউ না হারায় বা গাড়ির তলায় না পড়ে। ওদের ওরা ছাড়া কেউ নাই।

এভাবে লাইন ধরেই লাখে লাখে তারা এসেছিল ঢাকা শহরে তাদের হুজুরদের সাথে। এই শহরকে তারা ঘৃণা কতটা করে জানি না; কিন্তু এই শহরের মালিকরা তাদের ঘৃণা করে এটা ওরা জেনে গেছে। এখানে তারা মুসাফির। সবই অচেনা। দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব আর স্বাধীন ইচ্ছা ভেঙ্গে দেওয়া মাদ্রাসা শিক্ষায় এরা ভীত হীনম্মন্য জনগোষ্ঠী। হুজুরের ভয়ে কানে হাত দেওয়ার অভ্যাস এতই গভীরে এদের, পুলিশ দেখলেও কান ধরে বসে পড়ে, হুজুর বলে তাদের পা জড়িয়ে অনুকম্পা চায়। এতিম হওয়ায় হুজুরদের এরা বাবার মতো ভয় পায়, আর মানে। আপনি ভালবাসা দিলে আপনারেও মানবে। তবে আপনার সেক্যুলার মনে ওদের ভালবাসা কঠিন। সমাজে জায়গা দেওয়া কঠিন। আপনার ছেলেমেয়েদের পাশে স্কুলের বেঞ্চে বসতে দেওয়া কঠিন। আর ওরা এতই মধ্যযুগীয়, আপনার বাচ্চাদের পাশে বসিয়ে টিভিতে রিয়েলিটি শোর নামে আইটেম গার্লের পোশাকপরা বাচ্চা মেয়েদের সেক্সি আইটেম সং সহ নাচ দেখালে ওরা ‌’নাউজিবিল্লা’ বলে পালাবে। যে জীবন দোয়েলের-ফড়িংয়ের আপনাদের সেই জীবনের সাথে ওদের হবেনাকো দেখা। আসলেই এটা এক সভ্যতার সংঘাত।

আমাদের বার্বি প্রগতি, প্রভুসুলভ আধুনিকতা আর সেক্সি কনজিউমারিজম টেকাতে এদের বরং মেরে ফেলাই ভাল। সমাজ সংস্কার করে মাদ্রাসা শিক্ষার আর্থিক ও সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে এদের আপনার ছেলেমেয়েদের পর্যায়ে উঠায়ে আনা বহুত কঠিন কাজ। তাতে আপনাদের অসুবিধাও। গরিবের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে আপনার চাকরি ধরে টান দেবে, সীমিত সম্পদের দেশে ওরা আপনার একচেটিয়া ভোগে ভাগ বসাবে। এদের উদ্ধারের ব্রত বিপ্লবীরা সাধুক। আপনাদের জন্য এদের বরং মেরে ফেলাই সহজ। নিজেরাই রাস্তাঘাটে পিটিয়ে মারতে পারেন, অথবা মার্কিন ড্রোন ডাকতেও পারেন। তাতেই আপনার শ্রেণীঘৃণা আরাম পাবে।

পৃথিবীটা গোল, আর অতি বাম ডানের হেফাজতকারি

কিন্তু এদের হুজুরদের কি করবেন? এদের আপনাদের দরকার হবে না? যখন সাভারের গণহত্যা নিয়ে রাগে-শোকে কাঁপছে দেশ, তখন হেফাজত না এলে কে বাঁচাত গার্মেন্ট মালিকদের? যখন বিএনপি বেকায়দায় তখন হেফাজত না হলে কিভাবে আলটিমেটাম দেবেন বেগম সাহেবা? যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আপসের বিরুদ্ধে মানুষ নেমে পড়ে শাহবাগে তখন মাহমুদুর রহমান নাস্তিক ইস্যু বানিয়ে জামাত-লীগ দোস্তির সেবা করবেন কীভাবে যদি শফি হুজুর না থাকে? আর লীগ যদি বিচার করতে না চায়, আমেরিকার কথা শুনে জামাত নিষিদ্ধ না করে, তাহলে হেফাজত ছাড়া দেখাবেন কোন জুজুর ভয়? নারীর সমানাধিকারের শত্রু কেবল ইসলামওয়ালারা না, এনজিওঅলা, গার্মেন্টঅলা, ক্ষুদ্রঋণঅলারাও। সামন্ত পুরুষতন্ত্রের চাইতে পুঁজিবাদী শ্রমদাসতান্ত্রিক পুরুষতন্ত্র কতটা ভাল? নারী নীতি যাতে বাস্তবায়ন করতে না হয়, তজ্জন্য ইসলামি রিঅ্যাকশন আপনারা ভাড়া করবেন, তাই না?

হিন্দুদের অগ্রদানী ব্রাহ্মণদের মতো একটা শ্রেণী এদেশের লুটেরা বড়লোকরা তৈরি করেছে। অগ্রদানী ব্রাহ্মণদের দিয়ে শ্মশানযাত্রা ইত্যাকার কাজ করানো হতো যা বনেদি ব্রাহ্মণরা করবেন না। বুর্জোয়া জীবনে ধর্ম যতই আত্মিক শুণ্যতা ঢাকার মখমলের ঝালর হচ্ছে, গ্রামগঞ্জে ততই মাদ্রাসা স্থাপন হচ্ছে। ততই গোরখনন, জানাজা পাঠ, কোরান খতম, মিলাদ, খতনা-আকিকার দরকারে হুজুরদের চাকরের মতো ব্যবহার করা চলে। কিন্তু দেশি-বিদেশি সাহায্যে এতদিনে তারা একটা শ্রেণী হয়ে উঠেছে। সেই শ্রেণী এতই অস্ফূট যে এখনো শ্রেণীগত হিস্যা দাবি শিখে নাই, ওদের লাগানো হয়েছে ইসলামের মধ্যে পুরোহিততন্ত্র বা চার্চতন্ত্র বানাবার কাজে। হেফাজত চেয়েছে মোল্লাতন্ত্র, লীগ-বিএনপি-জামাত ওদের বানিয়েছে ভারবহন আর মারভক্ষণের গাধা।

বিএনপি-জামাত-লীগ সবার জন্যই মওকা বানাল হেফাজত। হেফাজত দিয়ে গণজাগরণ ঠেকায় বিএনপি-জামাত, হেফাজত দিয়ে জামাতের বিকল্প গড়ে লীগ, হেফাজত দিয়ে কাদিয়ানি-শিয়া-সুন্নি-আহলে হাদিস-দেওবন্দি ভাগে ভাগ করানো যায় ইসলামী জনতাকে। হেফাজত দেখিয়ে বলা যায়, আমেরিকা-ভারত-ইইউ-আমাদের বাঁচাও তীতুমীরের ছানাপোনাদের হাত থেকে। কারা বলবে? বলবে তারাই যারা নাকি বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ!!! সেক্যুলারিজম যখন ইন্টালেকচুয়াল ও এলিট মাইনরিটির ভিউ তখন তাদের দরকার হয় অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। তুরস্কের মিলিটারি, মিসরের মোবারকরা সেই সেক্যুলারিজমের বাহন।

লীগও ব্যবহৃত হচ্ছে হেফাজতিরাও ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু দুই ব্যবহার এক না। লীগ-এনজিও-কর্পোরেট কোয়ালিশন রক্ষক হিসেবে পাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের। আর হেফাজতিদের উস্কে মাঠে নামিয়ে মধ্যবিত্তকে আশ্রয়ের হাতছানিতে কাছে টানছে সেই সাম্রাজ্যবাদী কোয়ালিশনই। এই গ্রামে ভাল খারাপ দুইই তো আমাগো মামুরা। হেফাজতিরা ব্যবহৃত হয়ে নি:শেষ হবে, তাদের হাত দিয়ে নি:শেষ করা হবে শ্রমিকনেতা, বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী, সত্যিকার বিপ্লবী নেতাকর্মী, সাহিত্যিকদের। আবার সেক্যুলারিজম রক্ষার নামে হত্যা করা হবে হেফাজতিদের। যতই তা করা হবে, ততই হেফাজতিরা নিম্নবর্গীয় পাবলিকের কাছে মুক্তিযোদ্ধা হবে আর শহুরে বিচ্ছিন্ন ভদ্রলোকেরা চিহ্নিত হবে রাজাকার বলে। আমরা অনেকেও উগ্র ইসলামের হাত থেকে বাঁচতে ডাকব এফবিআই, ডাকবো সামরিক শাসন। এভাবে উত্তর মেরুর (বাম) দিকে হাটতে হাটতে দিক না বদলালেও কখন যে মেরুবিন্দু পেরিয়ে আমরা দক্ষিণ মেরুর দিকে (ডানপন্থার দিকে) হাটা শুরু করবো, টেরই পাবো না। কারণ পৃথিবীটা গোল, আর অতি বাম ডানের হেফাজতকারি।

এই খেলাটা ভাল করে বুঝতে আবার চলুন সেরাতের মতিঝিলে

জামাতকে যখন আপস-লড়াইয়ের খেলায় ঠেকানো যাচ্ছে না তখন নামানো হলো শাহবাগ। মধ্যবিত্ত তরুণেরা অবদমিত একাত্তরের বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে ঐতিহাসিক দিশা পেল। কিন্তু অচিরেই মঞ্চসহ পুরো জমায়েত ছিনতাই হয়ে গেল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে। কিন্তু শাহবাগের নামেই সুন্দর দাঁড়িয়ে গেল নাস্তিক-আস্তিকের হাডুডু যুদ্ধ। হেফাজতকে যখন ঠেকানো যাচ্ছে না তখন বিএনপি-জামাতের দ্বারা তাদের ব্যবহৃত হতে দেয়া হলো, অনুমতি দেয়া হলে সমাবেশের। কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারলো কীভাবে জামাত-শিবির? ঠিক এভাবেই তো তারা বগুড়া, জয়পুরহাট, সাতক্ষীরায় গ্রামবাসীদের সামনে ঠেলে নাশকতা করেছে। এটাই তাদের এ যাবতকালের কৌশল। হেফাজতের ছাত্রদের শাপলা চত্বরে রেখে চারদিকে জামাত-শিবিরের কর্মীরা ব্যারিকেড গড়ে খালেদা জিয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নামল। তারা ভেবেছিল সাদা দেবে। কিন্তু জনগণ বোকা নয়, অন্যের লড়াই তারা লড়বে কেন? এর জন্য তো হেফাজতই আছে। হেফাজতের কর্মীদের দেখে ঢাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্তের ভয় লাগেনি। তারা গ্রামে এদের দেখে; এরা তাদের কাছে অচেনা নয়। অনেকে বরং ইসলামের জোশ দেখে মনে মনে ঈদের আনন্দ পেয়ে ভেবেছে পুরো শহরটাই বুঝি ঈদগাহ মাঠ। কিন্তু এটা যে কারবালা হয়ে উঠতে পারে, এই হুশ না ম্যধবিত্ত না নিচতলার জোশপাগল, কারুরই মাথায় আসেনি।

কিন্তু পরিকল্পনা মাথায় ছিল একদল লোকের। যে দক্ষতায় অল্পসময়ে মতিঝিলে প্রতিরোধ-ব্যারিকেড-আগুন ইত্যাদি করা হয়েছে সেটা প্রশিক্ষিত লোকের কাজ। তারা প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে যন্ত্রপাতিসহ। সেটা জামাত-শিবির হতে পারে, অথবা হতে পারে অন্য কোনো শক্তি। যখন ভোর হলো, এরা লুকিয়ে পড়লো মারা পড়লো ওইসব বাপমরা, সমাজছাড়া হীনম্মন্য কিছু ছাত্র। অচেনা শহরে মারামারি করবার সামর্থ্য এদের থাকে না সাধারণত। এরা বীর এদের মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে, নিজ লোকালয়ে, ঢাকায় এরা জুতা ফেলে পালায় বা বুলেটাহত হয়ে কান ধরে বসে পড়ে।

বিএনপি-জামাত বা লীগ কেউই হারলো না; জিতল ডার্ক নাইট

চলমান রাজনৈতিক সমীকরণে বিএনপি-জামাত বা লীগ কেউই হারলো না। অভ্যুত্থানে সরকার পতনের হুমকির মুখে সরকারের পক্ষে হয়তো বলপ্রয়োগ করা ছাড়া উপায় ছিল না। বিএনপি ‌‌একাত্তরের গণহত্যা ঢাকতে সবখানেই গণহত্যা দেখতে চাইছে, আর সরকারও তাদের চাওয়া পূরণ করিয়ে মানুষকে ভাবাতে চাইছে এটা একাত্তরের রণাঙ্গন: হয় তুমি আমার পক্ষে নয়তো রাজাকারদের পক্ষে। মতিঝিলে যে মহড়া হলো তাতে সরকার হেফাজতিদের ঠেলে দিল জামাতের ক্যাম্পে। জাতীয় পতাকা হাতে রাজধানীতে এসে যেভাবে মাদ্রাসার ছাত্ররা শিকার হলো, আত্মরক্ষা ও প্রতিশোধের স্বার্থে এরা জামাতের কাছেই ছুটবে। কৃষক ইসলাম এভাবে বুর্জোয়া ইসলামের অধীনতা মানবে। জনবিচ্ছিন্ন জামাত হয়তো এবারেই প্রথম মাদ্রাসাগুলোর মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা পাবে। অনেকে হয়তো জঙ্গিদের দলে নাম লেখাবে। মতিঝিলের অভিজ্ঞতা তাদের ভয় কাটিয়ে দেবে, মরিয়া করবে। এই দেশ তাদের নয় এমন ক্ষোভ থেকে দেশকে দখলে আনতে চাইবে। আইনত তা সম্ভব না হলে, অথবা আইনের নামে তাদের হত্যা-নির্যাতন করা হতে থাকলে বেআইনী পথ নেবে। জামাত আর জঙ্গি নেটওয়ার্ক তাদের গ্রহণে প্রস্তুত। প্রস্তুত ওয়ার অন টেররের সুপারম্যান আর ডার্ক জাস্টিসের ব্যাটম্যান। বাংলাদেশ যথেষ্ঠ জঙ্গিবাদী না হলে তারা যে ব্কোর হয়ে পড়বে! সেক্যুলার গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে বাংলাদেশিরা ছাড়া আর কাদের প্রয়োজন?

জামাত আর জঙ্গি নেটওয়ার্ক কারা? জামাত আমেরিকার প্রিয় দল বাংলাদেশে। জেএমবি তৈরি করেছিল মার্কিন মনোনীত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবর। মার্কিন দূতাবাসের লোকেরা বারেবারে বাংলা ভাইয়ের সাথে দেখা করেছিল। এবারেও খেলাফতের সঙ্গে আঁতাত রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্র মনোনীত মন্ত্রী হাছান মাহমুদ। মার্কিন দূতাবাসের লোকজন এবারও তাদের সঙ্গে বসেছে। বাবুনগরী আর লালবাগীদের ক্রয়বিক্রয় কোনো ব্যাপারই না। এদের দিয়ে মুসলিম রিঅ্যাকশন খাড়া করানোও সহজ। মার্কিন মুলুকের নাগরিকদের তাতিয়ে রেখে নিয়ন্ত্রণ আর জঙ্গি দমনের নামে দেশে দেশে জরুরি অবস্থা অথবা বিশ্বের সামরিকায়নের প্রক্রিয়ায় দখল-লুন্ঠন-নিয়ন্ত্রণের জন্য আমেরিকারো মুসলিম জঙ্গিবাদ প্রয়োজন। ভারতো ওয়ার অন টেররের সঙ্গি। সেদেশের শাসকশ্রেণীর হিন্দুত্ববাদীদেরো নিজেদের বৈধতার জন্য দেশে ও প্রতিবেশে মুসলিম জঙ্গিবাদ থাকলে মন্দ হয় না। কোথাও না থাকলে সেটা তারা পয়দা করে নেবে।

নতুন ‌‌’বঙ্গবন্ধু’ খুঁজছে বাংলাদেশ

ভবিষ্যতের জন্য এই ডিজাইনটা বাংলাদেশ বিরোধীদের দরকার। তথাকথিত সেক্যুলারদের এরা ফাঁদে ফেলে দলে টানবে। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া লীগ বাঁচবে না বলে ভাবছে, কিন্তু মাঠ তো বদলে গেছে। এদেশে দ্বিতীয় কোনো মুক্তিযুদ্ধ হলে হবে ভারতের বিরুদ্ধে। মৃত নদীগুলো, কাটাতারের বেড়াগুলো, ফেলানীদের লাশগুলো, ট্রানজিটের ট্রাক-জাহাজগুলো, গার্মেন্ট শিল্পগুলো ট্রানজিটের গন্তব্য আসাম-ত্রিপুরায় গমনের আশংকাসহ হাজারটা কারণ আছে ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদের। এটাই বাংলাদেশের জন্মের ঐতিহাসিক নিয়তি, হাজার বছর ধরে দিল্লির রাজা-বাদশাহদের খপ্পর এড়াতে এই লড়াই চলছে। এর মধ্যে ৪৭-এ পাকিস্তানে গমন ছিল হিন্দু জমিদারদের সাম্প্রদায়িক ও অথনৈতিক শোষণের প্রতিক্রিয়াজাত ভুল। সেই ভুল ২৪ বছরে কেটেছে। সঠিক রাস্তা পেতে হয়তো লাগবে আরো ৪৮ বছর।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হলেই জনগণ তার আসল সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরাবে (এজন্যই বিচারটা পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হওয়া দরকার ছিল)। বহুজাতিক কারাগার ভারত বনাম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের দ্বন্দ্বটা সামনে চলে আসবে। যখন তা আসবে, তখন যদি বাম অসাম্প্রদায়িক শক্তি এর নেতৃত্ব দিতে না পারে, তাহলে সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতবিরোধি শিবিরের নেতৃত্ব নেবে। এদের বিরুদ্ধে থাকবে ভারতপন্থী মুক্তিযুদ্ধব্যবসায়ীরা। কিন্তু তাঁরা ছোটোবেলায় পানিপড়ায় ভূতের ভয় কাটলেও বড়বেলায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে শত্রুর ভয় কাটাতে পারবেন না। একবার জিতেছেন বলে একাত্তরের স্লোগান হবহু সুরে দিলেই একাত্তরের মতো জয় পাবেন, তার ভরসা নাই। পাকিস্তান মৃত, ভারত উত্থিত, বাংলাদেশ তখন জাগ্রত হয়ে নতুন ‌‌’বঙ্গবন্ধু’ খুঁজবে। সেই ‘বঙ্গবন্ধু’ যদি সাম্প্রদায়িক ও জাতগর্বী না হন তাহলে তাকে সবার আগে দেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসি জনগণকে ভরসা দিতে হবে, ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের জমি ও সম্মান। ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে দেশ হারানো হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশকে পরিণত করতে হবে, বহুজাতিক, বহুধর্মীয়, বহুভাষিক গণতান্ত্রিক সমাজের আধার। পচানব্বইভাগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরোধীদলহীন সংসদের মতোই সমস্যাকর।

ধর্মরাষ্ট্র একটা না-রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রধর্ম একটা না-ধর্ম

সেই ‌’বঙ্গবন্ধু’কে ইনক্লুসিভ ধর্মসাপেক্ষ সেক্যুলারিজমের লাইনে যেতে হবে। অর্থাত রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হবে এই অর্থে যে, ধর্মকে সমাজে স্বাধীনভাবে থাকতে দেবে যাতে রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে সব নাগরিকের হয়ে কাজ করতে পারে। আমাদের বুঝতে হবে: ধর্ম যখন রাষ্ট্র হয়ে ওঠে তখন খারিজ হয় তার ধার্মিক পবিত্রতা, আর রাষ্ট্র যখন ধর্মের হাতিয়ার হয়, তখন রাষ্ট্র হারিয়ে ফেলে তার রাষ্ট্রিকতা। ধর্মরাষ্ট্র একটা না-রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রধর্ম একটা না-ধর্ম।

সেই বঙ্গবন্ধু তাই ইসলামপন্থিদের ভেতর থেকে আসবেন না। তাহলে রইল কে? কেউ রইল না। বর্তমানের রাজনৈতিক বিন্যাস ও মতাদর্শগুলো থেকে তাই কোনো ভরসা নাই। মধ্যবিত্তের বর্তমান জনবিচ্ছিন্ন ভোগবাদী সংস্কৃতির মধ্যেও আশা নাই। বুর্জোয়াশ্রেণীর মধ্যেকার লুটেরা আর সাম্রাজ্যবাদী লেজুড়রাও বাধা বৈ সহায় হবে না। বাওয়ামী (আওয়ামী বাম) আর বাওয়ানির (বিএনপিপন্থি বাম) বাইরে জনগণতান্ত্রিক দেশবন্ধু বামশক্তিই হতে পারে একমাত্র বিকল্প। সেটা থাকলে বিকশিত করতে হবে, নইলে গড়ে নিতে হবে। রাজনীতি কাজের জিনিস, গড়ে নিতে হয়। পুস্তক থেকে রাজনীতি গজায় না। রাজনীতি গজায় জনগণের ভেতর থেকে।

আমাদের একটা দারুণ জনগণ আছে। এই জনগণ গত একশ বছরে বড় ভুল করে নাই। জমিদারের দাস আর প্রকৃতির বিনাশ থেকে দিনে দিনে তারা একটা জাতি হয়ে উঠেছে একেবারে শূন্য থেকে। একটা উদ্দীপ্ত তরুণ কর্মীবাহিনী আছে। তাদের আমরা সাভারে উদ্ধার কাজে দেখেছি, শাহবাগ আর শাপলা চত্বরেও তারা হাজির হয়েছিল। বাংলাদেশে এখন শক্ত একটা পুঁজিবাদী ক্লাস আছে; যার অ্যাসপিরেশন পশ্চিমবঙ্গের মাড়োয়াড়িদের পাত্তা না দিয়ে খোদ ভারতীয় বুর্জোয়াদের সাথে প্রতিযোগিতা করার। তার জন্য আপস আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুটোই লাগবে। বিরাট শ্রমিক শ্রেণী গঠিত হচ্ছে দেশে ও বিদেশে। কৃষকরা ঘাতসহ, খাদ্য নিরাপত্তা তাদের অবদান। শহুরে তরুণরা মতাদর্শিক বাতিক থেকে বাইরে এলে তারাও অপার সম্ভাবনা ধরে। প্রবাসী এনআরবি দেশলগ্ন হলে অনেক কিছুর সহায় হবে। সবার আগে আমাদের দরকার ইসলাম বনাম মুক্তিযুদ্ধের এই সর্বনাশা খেলা থেকে সরা।

একাত্তরের অ্যান্টিথিসিস বনাম বাংলাদেশের আসল থিসিস

একাত্তরের থিসিস ছিল নিপীড়িত ইসলাম আর সেক্যুলার ম্যধবিত্ত রাজনীতির ঐক্যের মধ্যে দিয়ে নিপীড়ক ইসলাম আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মৈত্রীর বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করা। আগে ভারত-রাশিয়া মিত্র ছিল, এখন আমাদের শত্রু আছে মিত্র নাই। মিত্র বানাতে হবে। ভারতের জনগণ আর বিশ্ব জনমতকে আমরা জয় করতে পারি। কিন্তু তার জন্য থিসিসটা ঠিক করতে হবে অর্থাত লাইন ক্লিয়ার করতে হবে।

এখনো ইসলাম আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধের যে প্লটে দেশকে ঠেলা হচ্ছে, সেটা একাত্তরেরও বরখেলাপ বর্তমানেও হঠকারি। নিপীড়ক ইসলাম তথা সাম্রাজ্যবাদের পোষ্যপুত্র ইসলামকে রুখতে হলে ইসলামমনাদের জামাতি ক্যাম্পের বরাতে ওয়ার অন টেরর কমপ্লেক্সে ঠেলে দেবেন না। জামাতকে এদের থেকে বিচ্ছিন্ন করুন। একাত্তরের বিচার করুন, গত ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান জামাতি নাশকতা দমন করুন স্বচ্ছভাবে। কিন্তু তা করতে হলে আপনাকেও গণতান্ত্রিক থাকতে হবে, আইনের অধীনে কাজ করতে হবে, জনমতকে পাশে রাখতে হবে। মনে রাখবেন, এবার আপনি বিচারক আর ওরা ইনসার্জেন্ট-বিদ্রোহী। আপনার বিচারমূলক শাসনমূলক আর নেতামূলক কাজকর্ম ন্যায্য না হলে সবই বুমেরাং হবে। যারা বিভিন্ন জায়গায় মারা যাচ্ছে, তাদের বাড়ি মঙ্গলগ্রহে না। যেসব গ্রাম-মহল্লা-মাদ্রাসা-কলেজ থেকে এরা এসেছে, সেসব জায়গায় সমাজবদ্ধ মানুষ থাকে। তারা তাদের লাশের হদিস করবে, খুনীর বিচার চাইবে। তাদের উত্তর দিতে হবে।

তাতে যদি ব্যর্থ হন, তাহলে একাত্তরের অ্যান্টিথিসিসই আখেরে জয়ী হবে। দ্বিজাতিত্ত্ব সাংস্কৃতিকভাবে এখনো সক্রিয়। দেশে এখন বাঙালি আর মুসলমান নামে দুটি রাজনৈতিক শিবিরের হাতে দুই জাতির পয়দা করা হচ্ছে। এটা থামাতে হবে। এইসব ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদ যে আসলে রাষ্ট্রের আদর্শিক শূন্যতা আর শাসকশ্রেণীর গণবিরোধি চরিত্র ঢাকার ছল, তা মধ্যবিত্ত না বুঝলেও গরিব-মেহনতি মানুষ বোঝা শুরু করেছে। ওই যে, সাভারের রাস্তা অবরোধ করে তারা আবার বসে পড়েছে, কারণ তারা লাশ পায়নি, কারণ বিজেএমইএ তাদের বেতনের টাকা নাকি হেফাজতের পেছনে খরচা করে ফেলেছে। ওরা এখন বেতন চায়, লাশ চায়, বিচার চায়। শাহবাগ তাদের হত্যার বিচার চায়নি আর মতিঝিলে কেউই তাদের নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। এই দেশে কেবল বাঙালি আর মুসলমানের না, এই দেশ মানুষের। মানুষরা আর লাশ হতে রাজি না। একুশ শতকে দুনিয়ায় এত সুযোগ এত মুক্তি: বাংলাদেশিরা এই সুযোগ এই মুক্তির স্বাদের জন্য মরিয়া। জীবন সবারই একটা, দেশও আমাদের একটা। আমরা লুটের টাকায় বিদেশে নাগরিকত্ব কিনতে পারছি না।

ওয়েস্টফ্যালিয় শান্তিচুক্তি

যে ওয়েস্টফ্যালিয় শান্তিচুক্তির ভিত্তিতে ইউরোপে রাজায় রাজায়, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যুদ্ধবিগ্রহের অবসান হয়েছিল সেরকম শান্তিচুক্তি আজ দরকার। তাতে জাতীয় সার্বভৌমত্ব এসেছিল কিন্তু গণতন্ত্র আসেনি। স্বাধীনতা থাকলে গণতন্ত্র একদিন আসে। তবে আমাদের এখানে গণতন্ত্র থাকলে স্বাধীনতা বাঁচবে। আমাদের ওয়েস্টফ্যালিয় শান্তির প্রধান শর্ত হলো ন্যুনতম গণতন্ত্র অর্থাত নির্বাচিত শাসনের ধারাবাহিকতা।

দ্বিতীয়ত ইউরোপী সেক্যুলারিজম এসেছিল কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মের ভেতরকার বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলোর ভেতর নিরপেক্ষতার নীতি হিসেবে। তাদের রাষ্ট্রধর্ম বাতিল মানে ধর্ম বাতিল না। এর অর্থ ছিল রাষ্ট্র প্রটেস্ট্যান্ট বা ক্যাথলিক কোনোটাকেই প্রশ্রয় দেবে না; আর সমাজে ধর্ম থাকবে ধর্মের মতো। মনে রাখতে হবে, এই সেক্যুলারিজম কিন্তু ইউরোপকে ইহুদী ও মুসলিমমুক্ত করতে চেয়েছিল_এখনো চায়। ফ্রান্সে বিধর্মী বলে কিছুই ছিল না একসময়। বাংলাদেশে সেক্যুলার আর ইসলামপন্থি উভয়ই এমন দেশ চায়, যেখানে ভিন্নমত থাকবে না। উভয়ের দাপটের অস্থিতে ফ্যাসিবাদের মজ্জারস থকথক করে। এদের মধ্যেও শান্তি চাই এই শর্তে যে নাস্তিকও থাকবে, বামপন্থিও থাকবে, ইসলামপন্থিও থাকবে, মার্কিনপন্থিও থাকবে, ভারতপন্থিও থাকবে, আজবপন্থিও থাকবে। কেবল থাকতে পারবে না, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক অধিকার। ভিন্নতার মোকাবেলা হবে রাজনীতির ময়দানে, বলপ্রয়োগের ময়দানে না।

সেক্যুলার বনাম ইসলামের সমস্যা শেকড়হীন বুদ্ধিজীবীদের মতো করে দেখলে চলবে না। ধার্মিক ব্যক্তিও সেক্যুলার হতে পারেন, যদি তিনি ধর্মরাষ্ট্র না চান। এখন রাজনীতির প্রধান সংঘাত তত্ত্বাবধায়ক আর যুদ্ধাপরাধের বিচার। জনগণের সমস্যা বাঁচা-মরার। সরকার তত্ত্বাবধায়ক দিক, বিএনপি জামাত ছাড়ুক। সরকার তাহলে বলতে পারবে আমি রাষ্ট্রকে দিয়েছি গণতন্ত্রের সুযোগ আর দেশকে দিয়েছি একাত্তরের ন্যায়বিচার। জনগণ তাইলে বাঁচতে পারে। এখনো সময় আছে। এই একটা পথেই সরকারও বাঁচতে পারে, দেশও বাঁচতে পারে। ইসলামের সেক্যুলারকরণ আর সেক্যুলারিজমের ইসলামদীক্ষা আমরা পরেও করতে পারবো।

তার আগে আপাতত ওই চার কিশোরকে আমরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দিই…