র‍্যালির সামনে
বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের বিভিন্ন বাংলাভাষী অঞ্চলে সংহতি জানাতে নানা অনুষ্ঠান সভা-সমাবেশ শুরু হয়। পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরার আগরতলায় সংহতি অনুষ্ঠান হলেও এই অনুষ্ঠানগুলি ছিল নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণীর মধ্যে সীমিত। কিন্তু ত্রিপুরার কমলপুরের জনগণ নির্দিষ্ট কোন সংগঠন বা রাজনৈতিক গণ্ডির মধ্যে না থেকে যেভাবে শাহবাগে সংহতি জানালেন তা অতুলনীয়।

গত দুইদিন আগে এই সমাবেশের প্রধান উদ্যোক্তা দুলাল দা (মানে দুলাল ঘোষ, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি কমলপুর শাখার সম্পাদক) উনার মাধ্যমে খবর পেলাম কমলপুর মহকুমার বিভিন্ন মহলের জনগণ শাহবাগ আন্দোলনে সংহতি জানাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সভা-সমাবেশের আয়োজন করেছেন ২২শে মার্চবিকাল ৪ ঘটিকায়, তিনি আরও জানালেন যে এই সমাবেশ অনুষ্ঠানের কোন রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক রং নেই।

অনুরুধ করলেন যদি বাংলাদেশের কোন যুক্তিবাদী, মুক্তমনা অতিথি হিসাবে উপস্থিত হন তাহলে আরও ভাল হয়, সেই হিসাবে আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেই এবং ফেসবুক ম্যাসেজে জানালে অনেকেই বলেন যে এত তাড়াতাড়ি ভিসা পাওয়া কষ্টকর তবে সবাই সমাবেশকে সমর্থন করেন। যাক নিজে তো সমাবেশে যোগ দেওয়ার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না, আবার অন্যদিকে ২৮ মার্চ থেকে আমার পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত বললাম যে আমিও সমাবেশে আসছি। সেইমত ২২ তারিখ দুপুর ১২টার ট্রেনে ধর্মনগর থেকে আমবাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ত্রিপুরার কচ্ছপ গতির ট্রেনের জন্য আধঘণ্টা দেরীতে ২:৩০মি. আমবাসা পৌঁছে ছোট গাড়ি ম্যাক্স ধরলাম সেই যাত্রী উঠানো-নামানোর যন্ত্রণায় ভোগে বিকাল ৪:১৫ দিকে আসলাম কমলপুর। কমলপুর ঢোকার পর পুলিশ আমাদের গাড়ি আটকে দিলো এই বলে যে সামনে র‍্যালী আছে।

আমার আর বোঝতে বাকী রইল না র‍্যালীটা কিসের। এক লম্বা দৌড় দিলাম একটু এগিয়ে দেখলাম অগণিত মানুষের বিশাল র‍্যালী। শেষে র‍্যালির শেষ লাইনে যোগ দিতে আমাকে ধরিয়ে দেওয়া হলো ভারত বাংলার যৌথ পতাকা। আমার কি আর শান্তি আছে, আমার ডিজিটাল ক্যামেরাতে ভিড়িও মোড অন্য করে অগ্রসর হতে থাকি সামনের দিকে। ধীরে ধীরে লক্ষ্য করলাম এখানে সামিল হয়েছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্র-ছাত্রী, শিল্প সাহিত্যিক থেকে শুরু করে শ্রমজীবী নারী-পুরুষ এমন কি ক্রিকেট ব্যাট হাতে শামিল হয়েছেন প্যাকটিস রত খেলোয়াড়রা। আছেন ক্যামেরা হাতে পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরার টিভি সাংবাদিকরা।
তাদের সবার হাতেই আছে প্লে-কার্ড এবং আকাশ বাতাস কাপিয়ে শ্লোগান দিচ্ছেন।
১)তোমার আমার ঠিকানা ——শাহবাগ মোহনা———————।
২)মৌলবাদ হানায় নিহত রাজীব হায়দার অমর রহে—–অমর রহে————।
৩)শিরা ফুলিয়ে তুলুন আওয়াজ—-মৌলবাদ, সাম্রাজ্যবাদ,সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাক——।
৪)মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদ হুশিয়ার।—————
৫)ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শহীদ জননী জাহানারা ইমাম অমর রহে—- অমর রহে—-।
৬)ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রাস করা চলবে না।—————–
৭)রাষ্ট্র তুমি পক্ষ ছাড়ো———-ধর্ম নিরপেক্ষতার পথ ধরো।—————–
৮)শাহবাগের বীর শহীদ অমর রহে—–অমর রহে।——————
৯)এগিয়ে চল শাহবাগ আমরা তোমাদের পাশে আছি—————————-
১০)দুনিয়ার জনগন।——এক হও।——————————
ইত্যাদি।
র‍্যালির শেষ প্রান্তে একটি গাড়ী সেটিতে মাইকে ভেসে আসছে – ৭১এ আমরা ত্রিপুরা বাংলাদেশের পাশে ছিলাম এখনও মুক্তিকামী মানুষদের পাশে আছি। হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার সহ মৌলবাদীদের দ্বারা যারা নিহত হয়েছেন তাদের কথা বলা হচ্ছে এবং হত্যাকারীদের নিন্দা জানানো হচ্ছে। ৭১এ পাকিস্তানের ত্রিপুরার উপর হামলার কথা বলা হচেছ।

ধীরে ধীরে আমরা এগিয়ে আসলাম কমলপুর বাস টামিন্যালসে যেখানে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। একটু দূর থেকে শুনতে পেলাম স্থানীয় সঙ্গীত শিল্পীরা গাইছেন ও আমার সোনার বাংলা….. আমি তোমায় ভালবাসি…………………., ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা……….., সাত সাগর রক্তের বিনিময়ে…. বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা….. আমরা তোমাদের ভুলবো না………।

সেখানে পৌছার পর আরও মানুষ যোগ দিল, অসংখ্য মানুষের ঢল। বোঝতে পারছিলাম না শাহবাগে আছি না ত্রিপুরার কমলপুরে। এরপর বিশিষ্ট জনেরা শাহবাগে নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহিদ বেদীতে পুষ্পাঘ অর্পণ করেন। নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট দাড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। শাহবাগ আন্দোলন সংহতি মঞ্চে বীরেন্দ্র পালকে সভাপতি করে বসে একটা আলোচনা চক্র। আলোচনা চক্রে বিশিষ্ট-জনেরা বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে উঠে আসে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদীদের কার্যকলাপ, শাহবাগের প্রেক্ষাপট, মৌলবাদের দ্বারা বিশ্ব সংকট, ধর্মান্ধতার বিষবাস্প, ভারতও মৌলবাদ থেকে মুক্ত নয়, কেন আমাদের বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ? শাহবাগের উদ্দেশ্যে কবিতা পাঠ সহ অনেক বিষয়।

আলোচনা শেষে চললো গণস্বাক্ষর নেওয়ার পালা। সবাই সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করে সাক্ষর দিচ্ছেন দেখে ভাল লাগলো। বুঝলাম আমাদের দেশেও মুক্তচিন্তা করার মানুষের অভাব নেই। শাহবাগকে যে আমরা শুধু সমর্থন দিচ্ছি তা না আমরাও শাহবাগের দৌলতে এক হয়েছি, শাহবাগ আমাদের সচেতন করেছে কিভাবে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়।

গণস্বাক্ষর শেষে এইদিনের অনুষ্ঠান শেষ হয় কিন্তু পরেরদিন থাকবে ছবি আকা সহ অন্যান্য অনুষ্ঠান। কিন্তু পরীক্ষার জন্য আর একটা দিন নষ্ট করতে পারছি না বলে অনিচ্ছা সত্বেও ধর্মনগরের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠলাম।