১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহবান জানান। দেশজুড়ে সে সময় চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। সবার মুখে কেবল একটিই স্লোগান ‘পদ্মা যমুনা মেঘনা, তোমার আমার ঠিকানা’ এবং ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যখন সারাদেশের জনগণ স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক সে সময় ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কাপুরুষের মতন রাতের অন্ধকারে বর্বরের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জনগণের উপর। “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে চলে গণহত্যা। তাই অন্য যে কোন দিনের চেয়ে এই দিনটি আমাদের কাছে একটু আলাদা। ঐ দিন শুধু আমাদের হত্যা-ই শুধু করতে চায় নি আমাদের বাঙালিত্ত্বও নষ্ট করার ব্রত নিয়ে তারা অপারেশনে নেমেছিল। বালুচ কসাই হিসেবে খ্যাত ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পশ্চিম পাকিস্তানে থেকে এখানে নিয়ে আসা হয় এবং অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নের জন্য তাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর নিযুক্ত করা হয়। পৃথিবীর জখন্যতম এই গণহত্যার যেন কোন সাক্ষী না থাকে সেজন্য বিদেশী সাংবাদিকদের ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে বের করে দেয়া হয়। সাংবাদিকদের সকল আলোকচিত্র, প্রতিবেদন ও নোট বই আটক করে একটি বিমানে তুলে দেয়া হয়। তারপরও সাইমন ড্রীং নামে এক সাংবাদিক ঢাকায় লুকিয়ে থেকে গোপনে ছবি ও প্রতিবেদন বিদেশে প্রেরণ করলে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানুষ এই গণহত্যার সর্ম্পকে জানতে পারে। হৈ চৈ পরে যায় বিশ্বব্যাপী। কিন্তু পাকিস্তান সামরিক জান্তার অপর্কম আড়াল করার জন্য দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাবলে; এগুলো কোন গণহত্যার ছবি নয়,’ ৭০ এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের যে অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয় ঘটেছিল এগুলো তারই ছবি। পাকিস্তানিরা যে আমাদের বাঙালিত্ব নষ্ট করতে চেয়েছিল তার প্রমাণ; লেঃ জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী’র উক্তিতেই-

“ম্যায় ইস হারামজাদী কওম কি নাসল বদল দুঙ্গা (আমি এই জারজ জাতির বংশগতি বদলে দেব। ”

২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার পর পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে। সরকারি পত্রিকা এবং রাজাকার আলবদর কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ হয়। পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পরও তৎকালীন সময়েও মিডিয়ার একটি ভূমিকা ছিল। মিডিয়া যে সবসময় স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে ছিল তাও না। পক্ষে বিপক্ষে মিলিয়ে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল। আমাদের দেশের পত্রিকার ও পত্রিকার সাংবাদিকরা স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্মথন দিয়েছিল এবং জীবনের ঝুঁকি নয়ে তারা আমাদের জন্য কলমযুদ্ধ করে গিয়েছিলেন। যে সময় বাঙলার বীর সাংবাদিকরা কলম যুদ্ধ করেছিল ঠিক সেই মুহূর্তে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা স্বাধীনতাকামী মানুষের বিপক্ষে, পাকিস্তানীদের পক্ষে মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তমূলক খবর ছাপে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। সে সময়ে দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক ছিলেন-আখতার ফারুক। সাংবাদিকতার নামে দৈনিক সংগ্রামে বীভৎস কুৎসা, মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ২৫ র্মাচের গণহত্যার প্রতিবাদে সারা বাঙলাদেশে ২৭ মার্চ সর্বত্মক ধর্মঘটের ডাক দেয় বাঙলার জন্যগণ- খবর দৈনিক ইত্তেফাক।

আলী আকবর টবী “২৫শে মার্চ ১৯৭১, মধ্যরাত সম্পর্কে বলেন-

“ঘুমন্ত ঢাকাবাসী। হিটলার মুসোলিনি চেঙিস খানের উত্তরসুরী ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের নায়ক ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাক বর্বর বাহিনী নিরস্ত্র নরনারীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল আদিম হিংস্রতায়…ফুটপাতে, রাজপথে, বাসে, ট্রাকে, রিক্সায় জমে উঠল মৃত মানুষের লাশ..চারিদিকে শোকের ছায়া…শোকার্ত মানুষ কাজ ভুলে গেল…ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ অফিস তখনও পুড়ছে..এই শাষরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে কোন সংবাদ বের হতে পারল না। এমনকি সরকারী সংবাদপত্রও নয়। কিন্তু এই অস্বাভাবিকতার মাঝও একটি পত্রিকা বের হল। তার নাম দৈনিক সংগ্রাম। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র আখতার ফারুক সম্পাদিত পত্রিকাতে গতরাতের নারকীয় হত্যাকান্ড, ধ্বংসযজ্ঞ, ধর্ষন ও লুটপাটের কোন খবরই ছাপা হলো না।”

২৫শে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল ও জহরুল হক হল সহ সারা ঢাকা শহরে তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়। এক রাতের মধ্যেই ঢাকা শহরকে মৃত্যুকুপ বানিয়ে ফেলে। দৈনিক ইত্তেফাকে গণহত্যা বন্ধ কর নামে হেড লাইনে সংবাদ প্রকাশিত হয়ে এবং ২৭ মার্চে সমগ্র বাঙলাদেশে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। অথচ তৎকালীন পাকিস্তানপন্থী ও জামাতী পত্রিকা “দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা”টি র্নিলজ্জভেবে একের পর এক মিথ্যাচার করেছিল। এমন কী বর্বর হত্যাযজ্ঞকেও তারা সাধুবাদ জানাতে ছাড়ে নি।

১৯৭১ সালের সেই কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে পাকিস্তানি বাহিনী ভয়াল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাদের নারকীয় তাণ্ডবের শিকার হন ওই হলের ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারী-কর্মকর্তারা। “দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ” থেকে জানা যায় সে রাতে রোকেয়া হলে আগুন ধরানো হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হবার সময় মেশিন গান দিয়ে গুলি করা হয়। ২৬ মার্চ সকালের দিকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম ও ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকোথন হয় তা থেকে জানা যায় ক্যাম্পাসে প্রায় ৩০০ ছাত্র নিহত হয়। এছাড়াও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নূরুল্লার ধারণকৃত ভিডিওটি ওয়েব সাইটে আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশবিকতার সাক্ষী হয়ে আছে। ভিডিও লিংক এখানে

ভিডিও চিত্রে দেখা যায় ছাত্রদের দিয়েই জগন্নাথ হলের সামনে গর্ত খোড়া হচ্ছে আবার সেই গর্তেই ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেয়া হচ্ছে। রোকেয়া হল সর্ম্পকে সুইপার ইন্সপেক্টর সাহেব আলী সাক্ষাৎকারে বলেন-

২৮ মার্চ সকালে রেডিওতে সকল কর্মচারীকে কাজে যোগদানের চরম নির্দেশ দিলে আমি পৌরসভায় যাই। পৌরসভার কনজারভেন্সি অফিসার ইদ্রিয় মিঞা আমাকে ডোম দিয়ে অবিলম্বে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা লাশ সরিয়ে ফেলতে বলেন।…

৩০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাদ থেকে ১৮ বছরের এক ছাত্রীর লাশ তুলেছি। তার গায়ে কোন গুলির চিহ্ন ছিল না। দেখলাম তার মাথঅর চুল ছিড়ে ফেলা হয়েছে, লজ্জাস্থান থেকে পেট ফুলে অনেক উপরে উঠে আছে, যোনি পথও রক্তাক্ত। আমি একটি চাদর দিয়ে লাশটি ঢেকে নিচে নামিয়ে আনলাম।”

স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল অষ্টম খণ্ডে আছে –

২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে সুইপার রাবেয়া খাতুন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এস এফক্যান্টিনে ছিলেন।পুলিশদের প্রতিরোধ ব্যর্থ হবার পরে ধর্ষিত হন রাবেয়া খাতুন। সুইপার বলে প্রাণে বেঁচে যান কারণ রক্ত ও লাশ পরিস্কার করার জন্য তাকে দরকার ছিল সেনাবাহিনীর। এরপরের ঘটনার তিনি যে বিবরণ দিয়েছেন তা এইরকম :

“২৬ মার্চ ১৯৭১,বিভিন্ন স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েদের ধরে আনা হয়।আসা মাত্রই সৈনিকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে।তারা ব্যারাকে ঢুকে প্রতিটি যুবতী,মহিলা এবং বালিকার পরনের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে ধর্ষণে লিপ্ত হতে থাকে।রাবেয়া খাতুন ড্রেন পরিস্কার করতে করতে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।পাকসেনারা ধর্ষন করেই থেকে থাকেনি,সেই মেয়েদের বুকের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দেয়,মাংস তুলে নেয়।মেয়েদের গাল,পেট,ঘাড়,বুক,পিঠ ও কোমরের অংশ তাদের কামড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়।এভাবে চলতে থাকে প্রতিদিন।যেসব মেয়েরা প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ করত তাদের স্তন ছিড়ে ফেলা হত,যোনি ও গুহ্যদ্বা্রের মধ্যে বন্দুকের নল,বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢূকিয়ে হত্যা করা হত।বহু অল্প বয়স্ক বালিকা উপুর্যুপুরি ধর্ষণে নিহত হয়।এর পরে লাশগুলো ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভরে বাইরে ফেলে দেয়া হত।হেড কোয়ার্টারের দুই,তিন এবং চারতলায় এই্ মেয়েদের রাখা হত,মোটা রডের সাথে চুল বেঁধে।এইসব ঝুলন্ত মেয়েদের কোমরে ব্যাটন দিয়ে আঘাত করা হত প্রায় নিয়মিত,কারো কারো স্তন কেটে নেয়া হত,হাসতে হাসতে যোনিপথে ঢুকিয়ে দেওয়া হত লাঠি এবং রাইফেলের নল।কোন কোন সৈনিক উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ মেয়েদের বুকে দাঁত লাগিয়ে মাংস ছিড়ে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ত,কোন মেয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে তখনই হত্যা করা হত।কোন কোন মেয়ের সামনের দাঁত ছিল না,ঠোঁটের দু’দিকের মাংস কামড়ে ছিড়ে নেয়া হয়েছিল,প্রতিটি মেয়ের হাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে থেতলে গিয়েছিল লাঠি আর রডের পিটুনিতে।কোন অবস্থাতেই তাঁদের হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হত না,অনেকেই মারা গেছে ঝুলন্ত অবস্থায়।”

সামু ব্লগের এস্কিমো তার কেইস স্টাডিঃ জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ – পর্ব ৩ (নির্বিচারে নারী হত্যা ও নির্যাতন) তে উল্লেখ করেন- এই বিষয়ে Aubrey Menen নামক এক রিপোর্টার কয়েকটি উদাহরন দিয়েছে। তারমধ্যে সদ্যবিবাহিতা এক তরুনীর নির্যাতনে ঘটনা এইরকম –

“দুইজন পাকিস্তানী সৈন্য বাসরঘরে ঢুকে পড়লো। অন্যজন বাইরে বন্দুক নিয়ে পাহারায় দাড়িয়ে থাকলো। বাইরের মানুষরা ভিতরে সৈন্যদের ধমকের সুর আর স্বামীটিরর প্রতিবাদ শুনতে পাচ্ছিলো। সেই চিৎকার একসময় থেমে গেল – শুধু শুনা গেল তরুনীর কাতর আর্তনাদ। কয়েক মিনিট পর একটা সৈন্য অবিন্যস্ত সামরিক পোশাকে বেড়িয়ে এলো বাইরের থেকে আরেকটা সৈন্য ভিতরে গেল। এভাবে চলতে থাকলো – যতক্ষন না ছয়টা সৈন্য দ্রুত সেই বাড়ী ত্যাগ করলো। তারপর বাবা ভিতরে গিয়ে দেখতে পেল তার মেয়ে দড়ির বিছানায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর তার স্বামী মেঝেতে করে ফেলা নিজের বমির উপর উপুর (?) হয়ে পড়ে আছে।“ (Brownmiller, Against Our Will, p. 82) ”

অথচ দৈনিক সংগ্রাম ৮ এপ্রিল সম্পাদকীয় পাতায় মিথ্যাচার করে লিখলো, রোকেয়া হলে কিছুই হয় নি, অন্য হল থেকে দু’চারটা ছেলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল মাত্র।……..
উপরে বর্ণিত জলজ্যান্ত হত্যাকাণ্ডকে ভারতীয় মিথ্যা অপপ্রচার বলে উল্লেখ করে দৈনিক সংগ্রাম ভারতীয় অপপ্রাচারের ব্যর্থতা শিরোনাম দিয়ে সম্পাদকীয় পাতায় লিখলো-

পূর্ব পাকিস্তানের সব গুরুত্বপূর্ণ শহর সামরিকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থেকে স্বাভাবিকতার দিকে ফিরে এলেও ভারতীয় বেতারে এখনও সেগুলোয় যুদ্ধ চলছে।

….এমন কি রোকেয়া হলে কিছু হওয়া তো দূরের কথা অন্য হলের দু’চারটা ছেলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বলে জানা যায়।
….ভাতৃদ্বন্দ্বে উদ্যত জাতি শক্রর বিরুদ্ধে গলা মিলিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। নুতন করে জাতীয় মীর জাফরদের (মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আতীয় নেতৃবৃদ্দ-লেখক) তারা চিনবার সুযোগ পেয়েছে। ভারত ও তার এজেন্টদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে যে কোন মূল্যে তারা স্বদেশ ও জাতি রক্ষার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছে।”

২ মে, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা ২৫ মার্চ সর্ম্পকে লেখে-পাক সেনাবাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করেছে

২৫ মার্চের পর থেকে পাকসেনারা যে অঞ্চলেই অনুপ্রবেশ করেছে, সেখানেই ধ্বংসের তাণ্ডব চালিয়েছে। তাই পাকবাহিনীর আগমণের বার্তা পেলেই জনগণ জীবন বাঁচানোর জন্য ঘরবাড়ি সহায়-সম্পদ ছেড়ে পালাতে শুরু করতো। অথচ সেই পাকবাহিনীকেই জনগণের ভাগ্য বিধাতা বানিয়ে দৈনিক সংগ্রাম ২ মে “হিন্দুস্তানী সৈন্যের বর্বরতা” শীর্ষক সম্প্রাদকীয়তে উল্লেখ করলো-

যেখানে যে অঞ্চলেই ভারতীয় সৈন্যেরা অনুপ্রবেশ করেছে, সেখানকার জনগণ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আমাদের পাক সেনাবাহিনীর আগমণের অপেক্ষার করেছে। পাকবাহিনীর আগমণে শান্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।

৩ মে, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা পত্রিকাটি বাঙালি জাতির কালো রাত্রিটিকে পাকিস্তানিদের মুক্তি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কন্যা রইসী বেগম পাকিস্তান সামরিক জান্তার পক্ষে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিটি দৈনিক সংগ্রাম ৩ এপ্রিল প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানিদের জন্য মুক্তি দিবস শিরোনাম দিয়ে রইসী বেগমের বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়-
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ আমাদের সাত কোটি পাকিস্তানিদের জন্য মুক্তি দিবস

শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুচরেরা চিরদিনের জন্য মঞ্চ থেকে অপসারিত হয়েছে। শয়তানী শক্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার শক্তি যেন আমাদের অজেয় সশস্ত্র বাহিনীকে আল্লাহ দান করেন।

৮ মে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা সম্পাদকীয়তে ছাপে যে; পাকিস্তান সেনা বাহিনী পাকিস্তান ধ্বংসের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করেছে।

পাক সামরিক জান্তার ২৫ মার্চ রাতে আদিম উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতির ওপর। তাদের হিংস্র নখরে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হয় বাঙলার জনপদ। পাক হানাদারদের বর্বর গণহত্যা ও দানবীয় হত্যাযজ্ঞে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিশ্ববিবেক। তাদের এই বিবেববর্জিত ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে বিশ্বজনমত। পক্ষান্তরে দৈনিক সংগ্রাম সামরিক জান্তা কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সর্মথন করে এবং খুনি পাক সেনাবাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে। পত্রিকাটি পাক সামরিক সরকারের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সর্মথনে নানা খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করায় এবং তাদের নিন্দনীয় কাজে গর্ববোধ করে ৮ মে “সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা” শিরোনাম দিয়ে সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করে-

অবৈধ আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গত ২৬শে মার্চ সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীন বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এঁটে সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন। সামরিক সরকার তা জানতে পেরেই পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাতে আকস্মিক হামলা চালিয়ে তাঁর সে পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন এবং পাকিস্তানকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন।

আরও প্রকাশ করে, এ পরিকল্পনার পেছনে ভরতের সক্রিয় সহযোগীতা ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র থেকেই….জাতির পিতা কায়েদে আজমের নাম নিশানা মুছে নতুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠা অভিযান চলেছিল। পাকিস্তানের জাতীয় সংঙ্গীতের বদলে বাঙলাদেশের জাতীয় সংঙ্গীত চালু করা হয়েছিল। অবশেষে তেইশে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পুড়ে বাঙলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে শুধু মুখেই ঘোষণাটি বাকি রাখা হয়েছিল ২৫শে মার্চের জন্য।

এরূপ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রশ্নাতীত সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর উপরই ন্যস্ত।.. আমাদের বীর পাকসেনারা পঁয়ষট্টির ভারতীয় প্রত্যক্ষ হামলা ও একাত্তরের ভারতীয় পরোক্ষ হামলা যেরূপ অলৌকিককভাবে প্রতিহত ও বিধ্বস্ত করলো তাতে সত্যিই আমরা গর্ববোধ করছি। “

৬ জুন দৈনিক সংগ্রাম ২৫শে মার্চ গণহত্যার জন্য পাকিস্তানিদের অভিনন্দন জানায়।

২৫ মার্চ কালরাতে পাক সেনাবাহিনী আধুনিক সমরাস্ত্রে নিয়ে ঘুমস্ত ঢাকাবাসীর উপর আদিম হিংস্রতায় ঝাপিয়ে পড়ে। রাইফেল, মেশিনগান, কামান ও মর্টারের হিংস্র গর্জনে রাতের নিস্তবন্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল। হাহাকার, আর্তচিৎকার ও ক্রন্দনে ২৫ মার্চের রাতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। ফুটপাত, রাজপথ ও রিকশায় জড়ে উঠল মৃত মানুষের লাশ। নিমিষেই লাশের শহরে পরিণত হলো ঢাকা। পাকবাহিনীর উদগ্র বর্বরতায় ভূলুণ্ঠিত হলো শহিদ মিনার, আক্রান্ত হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল ও জহরুল হক হল (তৎকালীন- ইকবাল হল), অগ্নি সংযোগে ভষ্মিভূত হলো ইত্তেফাক, সংবাদ ও দি পিপল অফিস। ২৫ মার্চ নারকীয় গণহত্যার খবরে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিশ্ববিবেক।

দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটি শুধু স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় নয় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও এই পত্রিকার চরিত্র ও ষড়যন্ত্রের ভূমিকা একই ছিল। এই স্বাধীন বাঙলাদেশে এই পত্রিকাটি জামাতের মতন আজো টিকে আছে। পত্রিকার সম্পাদক বদল হলেও পত্রিকার আদর্শ ও দালালি আজো বদলায় নি। জামাত যেমন যুদ্ধাপরাধী দল ঠিক তেমনি তাদের এই মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটি যুদ্ধাপরাধীর দায়ে সমান ভাবে দুষ্টু। তাই যুদ্ধারাধী দলের সাথে সাথে এই পত্রিকারও বিচার হওয়া উচিত।

এভাবেই একের পর এক কুৎসা, মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র করে প্রতিনিয়ত বাঙালি জনগণের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল এই পত্রিকাটি। কিন্তু বাঙালির সাহস ও সততার কাছে এদের মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র অচিরেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং জন্ম নেয় একটি স্বাধীন দেশ যার নাম “বাঙলাদেশ”। সকল শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিরাঙ্গনাদের প্রতি শ্রদ্ধা যাদের ত্যাগের বিনীময়ে একটি স্বাধীন দেশ আমরা পেয়েছি।
–জয় বাঙলা

তথ্যসূত্র- দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা- আলী আকবর টাবী, ব্লগ ও উইকিপিডিয়া থেকে।