কবি আব্দুল কাদির, কমরেড মোজাফ্ফর, মাস্টার দা সূর্য সেন, প্রীতিলতার চট্টগ্রাম সেই ব্রিটিশ আমল হতে সকল পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত বাঙালীর অধিকার আদায়ের সকল সংগ্রামে চট্টগ্রামবাসীর বীরদীপ্ত অংশগ্রহণ, অতুলনীয় দেশপ্রেম ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে। চট্টগ্রামের বীর জনগণের একাত্তরে অগ্রণী ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে অসীম সাহস ও দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত।
একাত্তরের মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলি নিয়ে চট্টগ্রামের ধারাবাহিক একটি দিনলিপি করার ইচ্ছে ছিল অনেক আগে থেকেই। বই তো ছিলই, সাথে বেশ কিছু ডায়েরী জোগাড় করেছি এ বিষয়ে। সেই সাথে একাত্তরের প্রজন্মের নায়কদের কয়েকজনের সাথে কথা বলার, আগুনঝরা সেসব দিনের কথা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এসব মিলিয়ে একাত্তরের উত্তাল মার্চের একটি দিনলিপি করার চেষ্টা করলাম।
০১ মার্চ, ১৯৭১:
পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষনা করে। সাথে সাথে ফুঁসে উঠে চট্টগ্রামবাসী। রেডিওতে খবরটি প্রচারের পর পর চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম পলিটেকিনিকাল কলেজ, চট্টগ্রাম কর্মাস কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন শাখা ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান বিরোধী মিছিল বের করে। সেদিনের একটি মিছিল অন্য সকল মিছিল থেকে একটু আলাদা ছিল। সেটি ছিল পূর্ব মাদারবাড়ী রেলগেইটের পাশ্ববর্তী মেথরপট্টি হতে মেথর কালীচরণের নেতৃত্বে বের হওয়া মিছিল। একাত্তরের সংগ্রাম ছিল বাংলার গণমানুষের সংগ্রাম। এই মিছিল তার অন্যতম স্বাক্ষর।
০২ মার্চ, ১৯৭১:
চট্টগ্রাম শহরে হরতাল পালিত হয়। বিকেলে লালদীঘিতে আওয়ামীলীগের জনসমাবেশ হয়। এই সমাবেশে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হয়। সমাবেশ শেষে সারা শহরে মিছিল করা হয়। স্বাধীনতাকামীদের হুংকারে দ্যুলোক-ভ্যূলোক কেঁপে উঠে।
০৩ মার্চ, ১৯৭১:
রক্তাক্ত একটি দিন। একাত্তরে পাকিস্তানী আর্মিদের দ্বারা বাংলাদেশে আজ প্রথম গণহত্যা করা হয়।
সকাল ০৯ টার দিকে পাহাড়তলীর ওয়ারলেস কলোনীতে ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান বিরোধী মিছিলকে কেন্দ্র করে বাঙালী-বিহারী সংঘর্ষ শুরু হয়। ওয়ারলেস কলোনীতে বিহারীরা সংখ্যায় বেশি ছিল। বিহারীরা কলোনীর বাঙালীদের ঘর-দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুটপাট করা হয় বাঙালীদের ঘরবাড়ি-দোকাটপাট-সম্পত্তি। গরু জবাইয়ের মত জবাই করা হয় বাঙালীদের। মেয়েদের ধরে নিয়ে গ্যাং রেপ করে বিহারীরা। বাঙালীর রক্তে রন্জিত হয় পুরো কলোনী। এদিন প্রায় ২৫০ জন বাঙালীকে হত্যা করা হয়। আহত হয় প্রায় পাঁচ শতাধিক বাঙালী।
পাহাড়তলীর ওয়ারলেস কলোনীর বাঙালী নিধনের খবর পুরো চট্টগ্রাম শহরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিশোধের নেশায় ফুঁসে উঠে বাঙালীরা। দুপুরে লালদীঘিতে শোকসভা করা হয়। শোকসভায় আওয়ামীলীগ নেতা এম, এ, হান্নান, এম, এ, মান্নান, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সবাইকে ধৈর্য ধরার আহবান জানান। কিন্তু সংগ্রামের আগুন লেগে গেছে সারা শহরে। দেওয়ানহাট, ঈদগাঁ, হালিশহর, পাহাড়তলীতে কয়েকটি বাঙালী-বিহারী সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়।
এসময় আরো একটি খবর সবাইকে বিচলিত করে দেয়, পাহাড়তলীর ওয়ারলেস কলোনীর সংঘর্ষের সময় পাকিস্তান আর্মীর কিছু সৈন্য বেসামরিক পোশাকে বাঙালী হত্যায় অংশ নিয়েছিল।
০৪ মার্চ, ১৯৭১:
আগের দিনের বিহারী-বাঙালী সংঘর্ষের রেশ সারা শহরে বিরাজ করছিল। থমথমে হয়ে আছে পরিবেশ। এরমাঝে, সকাল ১১ টায় লালদীঘিতে পাহাড়তলীতে শহীদ হওয়া বাঙালীদের গায়েবী জানাজা পড়া হয়। হাজার হাজার মানুষ এ জানাজায় অংশগ্রহণ করে। জানাযার পর পাহাড়তলীতে শহীদ হওয়া কয়েকজন বাঙালীর রক্তমাখা কাপড় নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে জানাজায় অংশগ্রহণকারী মানুষরা। মৌলভী সৈয়দ আহমেদ আরেকটি আইয়ামে জাহিলিয়াতের যুগ এসেছে বলে রক্তমাখা কাপড়গুলো জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন।
বিকেলে, আওয়ামীলীগ নেতারা পুলিশী প্রহরায় পাহাড়তলীর ওয়ারলেসে ক্ষতিগ্রস্থ বাঙালীদের দেখতে যান।
রাতে, বিহারীরা বেশ কয়েক জায়গায় বাঙালীদের উপর অতর্কিত আক্রমন করে। হালিশহরে আর্মি ক্যাম্পের কাছে ছয়-সাতজন বাঙালীকে সবার সামনে জবাই করে বিহারীরা।
০৫ মার্চ, ১৯৭১:
আজ অর্ধদিবস হরতাল পালন করা হয়। বিকেলে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ক্রমেই বাড়তে থাকা বাঙালী-বিহারী সংঘর্ষ নিয়ে একটি বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা এম, এ, হান্নান, এম, এ, মান্নান, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইদ্রিস আলম , এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ সভায় এম, আর, সিদ্দিকীকে প্রধান করে একটি শান্তি কমিটি করা হয়। কিন্তু বিহারী-বাঙালী দাঙ্গায় পাকি প্রশাসনের একতরফা বিহারীদের প্রতি সহানুভূতির কারনে এম, এ, হান্নান এ কমিটির বিরোধিতা করেন।
রাতে পোর্টের (পতেঙ্গা) ওইদিকে পাকি আর্মির গাড়ি থেকে নিরীহ বাঙালীদের উপর গুলি ছোঁড়ার খবর পাওয়া যায়।
০৬ মার্চ, ১৯৭১:
আগের দিন বিহারী-বাঙালী শান্তি কমিটি গঠন হবার পরও আজ পাকি আর্মির সহায়তায় বিহারীরা ও পাকিবন্ধু কিছু বাঙালী হিন্দুদের কৈবল্যধাম মন্দির লুন্ঠন করে। লুন্ঠনের সময় স্থানীয় হিন্দু ও পুরোহিতদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
এই ঘটনা বিহারী-বাঙালী সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢালে। রেলওয়ে কলোনী, হালিশহর, আগ্রবাদ ও নিউমার্কেট এলাকায় বাঙালী-বিহারীর সংঘর্ষ হয়। আন্দরকিল্লা, ফিরিঙ্গী বাজার, আসাদগন্জ, চকবাজারে সাধারণ বাঙালী ও হিন্দুদের সাথে বিহারী-জামাতে ইসলামী-ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়।
কৈবল্যধাম মন্দির লুন্ঠনের সাথে জড়িত বাঙালীরা জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য বলে জানান আওয়ামীলীগ নেতারা। এম, এ, মান্নান বাঙালীদের জাতীয় স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান করেন।
০৭ মার্চ, ১৯৭১:
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর মিছিলে মিছিলে পুরো শহরের সব রাস্তা লোকারন্য হয়ে যায়। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে থাকে চারপাশ। চট্টগ্রামবাসী বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ডা: মাহফুজুর রহমান, ডা: গোফরানুল হক, জাকারিয়া চৌধুরী, রাখাল চন্দ্র বণিক, আবদুল্লাহ-আল-হারুন, সাবের আহমেদ আজগরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে শুরু হয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ফাহিম উদ্দিন আহমেদ(ইনি পরবর্তীতে ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।)।
০৮ মার্চ, ১৯৭১:
জহুর আহমেদের নেতৃত্বে এম, আর, সিদ্দিকীর বাসায় চট্টগ্রামের সব গণ্যমান্য ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ এক সভাঙ যোগ দেন। বিষয়বস্তু ছিল: চট্টগ্রামবাসীকে সংগঠিত করে আসন্ন সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ। বিকেলে চট্টগ্রাম রেস্ট হাউজের ২৩ নম্বর কক্ষে আরেকটি সভা হয়। এই সভায় চট্টগ্রামে পাক আর্মির তৎপরতা ও আসন্ন সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ নিয়ে আলোচনা করা হয়। আসন্ন যেকোন ধরনের পরিস্থিতির সামলানোর সব প্রস্তুতি গ্রহণকল্পে এক সপ্তাহের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচীর অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেলে, আগ্রাবাদ কলোনী স্কুল মাঠে ও আগ্রাবাদ জাতিতাত্বিক যাদুঘরের সামনে স্বেচ্চাসেবকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এদিকে, সাহিত্যিক আবুল ফজলের বাসায় ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুর রবের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্যিকদের নিয়ে গঠিত হয় “শিল্প সাহিত্যিক প্রতিরোধ সংঘ”।
০৯ মার্চ, ১৯৭১:
হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন জোরেশোরে পালন করছিল চট্টগ্রামবাসী। দুপুরের দিকে রেলওয়ে কলোনী ও এ.কে.খান রোডে বাঙালী-বিহারী সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়।
বিকেলে হালিশহর হতে দেওয়ান হাট হয়ে আগ্রাবাদ পর্যন্ত বিহারীরা ভারী অস্ত্র নিয়ে শোডাউন দেয়। পাকিস্তান আর্মি গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করছিল বিহারীদের। পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছিল।
অন্যদিকে, আজ চট্টেশ্বরী রোডে ‘চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদ’-এর অফিসে গণসঙ্গীতের মহড়া শুরু হয়।
১০ মার্চ, ১৯৭১:
আজ জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম.আর.সিদ্দিকী, এম.এ.হান্নান, এম.এ.মান্নান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আসা যেকোন সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামে বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ। স্বাধীনতার চুড়ান্ত সংগ্রামের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে থাকে চট্টগ্রামবাসী।
আজ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন লিখিত ‘এবারের সংগ্রাম’ নাটকের মহড়া দেয় ‘চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদ’-এর শিল্পীরা।
১১ মার্চ, ১৯৭১:
আজ পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর হিসেবে টিক্কা খানের শপথ নেবার কথা থাকলেও বিচারপতি বি.এ.সিদ্দিকী শপথ বাক্য পাঠ করাননি। এ নিয়ে চট্টগ্রামে আনন্দ মিছিল বের হয়। এরকম একটি মিছিল দেওয়ানহাট হয়ে হালিশহরের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ পথে বিহারী জল্লাদরা তলোয়ার আর গুলি নিয়ে মিছিলরত নিরীহ নিরস্ত্র্ বাঙালীদের আক্রমন করে। পনেরো-বিশজন বাঙালী নিহত ও অর্ধ শতাধিক আহত হবার খবর আসে। প্রত্যুত্তরে কিছু বাঙালী যুবক টাইগার-পাসে দুজন বিহারীকে গুলি করে। এ ঘটনার পর সন্ধ্যায় আর্মি সারা শহরে টহল দেয়। থমথমে হয়ে যায় পুরো শহর। আর্মির গাড়িতে বিহারী জল্লাদরাও ছিল। আগ্রাবাদ মোড় হতে পাচ-ছয়জন বাঙালী যুবককে তুলে নেয়ার খবর পাওয়া যায়। এঁদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১২ মার্চ, ১৯৭১:
বাঙালীদের উপর বিহারীদের হামলা ও আর্মিদের একতরফাভাবে বিহারীদের পক্ষ অবলম্বনের প্রতিবাদে সারা চট্টগ্রাম শহরে মিছিল বের হয়। চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের জরুরী সভা ঢাকা হয়। সভায়, সবাইকে সংযম রক্ষা করার আহবান জানানো হয়।
বিকেলে সাহিত্যিক আবুল ফজলের নেতৃত্বে শান্তি মিছিল বের হয়।
১৩ মার্চ, ১৯৭১:
পাকিস্তান সরকার এক ফরমান জারি করে। এতে, ১৫ মার্চের মধ্যে সকল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্ব স্ব কর্মস্থলে যোগদানের আদেশ দেয়া হয়; অন্যথায় চাকুরী চ্যুতিসহ দশ বছরের কারাদন্ড প্রদানের হুমকি দেয়া হয়।
এ নিয়ে বিকেলে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ লালদীঘিতে জনসভা করে। জনসভায় নেতারা সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পাকিস্তানের সাথে অসহযোগ করতে আহবান জানান। চট্টগ্রামবাসীকে আসন্ন যেকোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার আহবান জানানো হয়। সভায় পাকি আর্মিদের বিরুদ্ধে বিহারীদের অস্ত্র সরবরাহের কথা বলা হয়।
শেরশাহ, ফিরোজ শাহ কলোনী, পতেঙ্গা, রেলওয়ে কলোনী, হালিশহর, পাহাড়তলীর বিহারী কলোনীগুলোতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করছিল পাকি আর্মিরা।
১৪ মার্চ, ১৯৭১:
আজ চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ সারা শহরে মিছিল করে। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ এই মিছিলে অংশগ্রহণ করে। জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় সারা চট্টগ্রাম শহর।
বিকেলে চকবাজারের উর্দুগলিতে মিছিলে হানা দেয় বিহারী ও জামাতীরা। সাতজন বাঙালী গুরুতর আহত হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেয়ার পথে দুজন মারা যায়। রাতে উত্তেজিত মুক্তিকামী মানুষরা উর্দুগলিতে আক্রমন করে। বিহারী-জামাতীদের সাথে বাঙালীদের বেশ মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পুলিশের মধ্যস্থতায় সংঘর্ষ শেষ হয়। এ ঘটনায় কারো নিহত হবার খবর পাওয়া যায়নি।
পরে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পাক আর্মির একটি ট্রাক এসে চকবাজারের মোড়ে প্রায় পনেরোজন বাঙালী যুবককে তুলে নিয়ে যায়। সারারাত টর্চার করে ভোররাতে কোতোয়ালীর সামনে এঁদের ফেলে দেয়া হয়।
১৫ মার্চ, ১৯৭১:
পাকি আর্মির গতকালকের ঘটনার নিন্দা জানায় চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। সেই সাথে বিহারী-বাঙালীদের ধৈর্যধারণের আহবান করা হয়। জহুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যারাকের বাসিন্দাদের ব্যারাকের মাঝেই থাকা দরকার।
বিকেলে লালদীঘিতে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন- জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম.এ.আজিজ, এম.এ.হান্নান, এম.এ.মান্নান, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইদ্রিস আলম, এম.আর.সিদ্দিকী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান, ড: আনিসুজ্জামান, আবুল ফজল, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন। সভায় পাকিদের সামরিক তৎপরতার কথা বলা হয়। সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানানো হয়। সেদিন লক্ষ মানুষের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় লালদীঘি ময়দান। সন্ধ্যায় ‘চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদ’-এর শিল্পীরা মঞ্চস্থ করে অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন লিখিত নাটক ‘এবারের সংগ্রাম’।
এদিন রাতে ঘটে মর্মান্তিক এক ঘটনা। হালিশহরের চুনা ফ্যাক্টরীর মোড়ে (বর্তমানে আর্টিলারির মোড় বলা হয়) কয়েকজন জল্লাদ বিহারী চকবাজারের উর্দুগলির ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে তিনজন বাঙালী যুবককে প্রকাশ্যে জবাই করে। চট্টগ্রামের মাটি রক্তাক্ত হল মুক্তিকামী বাঙালীদের রক্তে।
(চলবে)
তথ্যসূত্র:
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একাত্তরের ডাইরী।
মুক্তিযোদ্ধা রবিউল হোসেন সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ আমার সাধনার দেশ’।
ড: এ, আর, মল্লিকের মুক্তিযুদ্ধের সৃত্মিকথা।
ক্যাপ্টেন শমসের মুবিন চৌধুরীর একাত্তরের ডাইরী।
‘রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক’, সাখাওয়াত হোসনে মজনু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, ৯ম খন্ড।
.
আবারও একটা তথ্যভরপুর লেখা, রাজা ভাই। অনেক ভাল কাজ এই সময়ের জন্য। চলুক।