ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী ছিল শৃঙ্খল ভাঙার ক্রান্তিকাল। এই ভারতীয় উপমহাদেশের বহু রাষ্ট্র এই সময়ে সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। এর পরেই এইসব স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিতে সময়ে সময়ে নানা হুজ্জুতি নেমে এসেছে। কার প্ররোচনায় কিংবা কিভাবে সংগঠিত হয়েছে তার আলোচনা আপাতত বৃথা। মোদ্দা কথা হল দেশগুলির মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করেছে কিছু প্রতিক্রিয়াশীলেরা। এই প্রতিক্রিয়াকে কখনো ধর্মের নামে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, কখনো জাতীয়তাবাদের নামে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং সেগুলির উপর একটা ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে : দাঙ্গা বা Riot…

আসলে দাঙ্গা কখন হয়? রায়ট তখনই হয় যখন দুই পক্ষ একে অপরের উপর প্রায় সমভাবে ঝাঁপিয়ে পরে। যেমন এমনই একটি কুৎসিত দাঙ্গা হয়েছিল বিংশ শতকের চল্লিশের দশকে। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে ”১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট তদনীন্তন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের রাজধানী কলকাতায় সংঘটিত একটি বহুবিস্তৃত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নরহত্যার ঘটনা”–সেটা দাঙ্গা ছিল। কিন্তু এর পরবর্তী পর্যায়ে এই উপমহাদেশে যে সমস্ত তথাকথিত ‘দাঙ্গা’ হয়েছে সেগুলি আদতে দাঙ্গাই নয়। কারণ সেই ট্যাগ দেয়া দাঙ্গায় একপক্ষই বলি হয়েছে। কোথায়ও উগ্র হিন্দুরা মুসলিম কুপিয়ে ভগবানের আস্থা রক্ষা করেছে, আবার কোথায়ও মুসলিমেরা হিন্দু কুপিয়ে আল্লাহর সোয়াব হাসিল করার কাজে ব্রতী হয়েছে। আসল ব্যাপারটা হল সেগুলি দাঙ্গা-ফাঙ্গা কিছুই না, যা হয়েছে সবটাই পরিকল্পিত ও ঠান্ডা মাথায় ‘সংখ্যালঘু’ নিধন, খুন ও নিপিড়ন

ভারত ও বাংলাদেশ নামে দুইটি পাশাপাশি দেশে এমনই কিছু ঘটনা ঘটেছে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে। ৪৭-এর পরবর্তী ভারত; ৭১, ৯২ এর পরবর্তী বাংলাদেশ, কিংবা ২০০২ এর গুজরাট, আবার সেই শুন্য দুই-এর পরবর্তী বাংলাদেশ। দুই দিকেই সংখ্যালঘুর রক্ত বয়ে গেছে। সেগুলি দাঙ্গা ছিল না মোটেই। সেগুলি ছিল পরিকল্পিত ঘৃণ্য হত্যযজ্ঞ

বিংশ শতাব্দীর শূন্যের দশক পেরিয়ে যখন আমরা এই মুহূর্তে সভ্যতার সুউচ্চ স্থানে পৌঁছে যাচ্ছি, ঠিক এই সময়েও এই ধরণের ঘটনা বা পরিস্থিতি যখন সৃষ্টি হয় তখন বুঝে নেয়া উচিত আমাদের মানবিক বোধ কোন যায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। মানুষ হিসেবে আমাদের অবস্থানটা ঠিক কোথায়। দুই হাজার তেরো সালে পৌঁছেও আমরা দেখি ভারতে অমৃত-কুম্ভ মেলায় মিলিত সাধুবাবারা মুসলিম কমিউনিটি নিয়ে উস্কানি দেয়, বাংলাদেশে দেখি মোল্লারা হিন্দুর ঘরে মুহুর্মুহু আগুন দেয়। এটাই আমাদের প্রগতি…

রক্ত, রক্ত, … পৃথিবী জুড়ে শুধু রক্ত। আমি ঘরে বসে আছি। গতকাল সকালে শুধু এক দফা ভূমিকম্প হয়েছিল। বিছানাটা তীব্রভাবে কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু আমার রক্ত ঝড়েনি। তারপর অকাজের ছুটি গায়ে মেখে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি। দূরে কোথাও গ্রাম্য জীবনে বিশ্বাস এর রক্তজবা তুলে মহিলারা উলুধ্বনি দেয় ভূমির আরোগ্যে। … তবুও কোথাও না কোথাও রক্ত ঝড়ছে অফুরন্ত। একটা সময় আসে যখন আমি তার টাটকা তাজা গন্ধ পাই। আক্রোশে ভেতরটা ফালাফালা হয়ে যায়। মনে হয় এই বুঝি কিছু করে উঠব। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমি ঝিমাই। আকাশকুসুম বোধগুলি বাস্তবিক জীবনে অনেক ঠুনকো, কোনকোন সময় প্রেমিকা সেটাই আমাকে মনে করিয়ে দেয়। আমি ওর সুরে সুর মিলিয়ে সংসারী হবার স্বপ্ন দেখি, ভুলে যাই সব। দূরে যাক সমাজ দূরে যাক সভ্যতা, দূরে থাকুক সব — আমি তখন ভীষণ স্বার্থপর। একটু সময় আমি চনমনে হয়ে উঠি। প্রেমিকাকে আদর করি। … সূর্য ডুবে গিয়ে যেভাবে চোখের পাতায় আঁধার নামে, সেভাবেই আমার চোখে আবার আঁধার নামতে শুরু করে। আমি আবারও ছটফট করি। সময় আমাকে একহাতে নিয়ে দেখায় ঘণ্টার হিসেবে রক্তের বৃষ্টি কিভাবে পৃথিবী শীতল করে দেয়। সেই শীতল অনুভূতিতে আমার মাথায় রক্ত উঠে। আবারও ছটফট করি। উন্মাদনার করিডোরে বসে আমি বিপ্লব এর ঘুড়ি উড়াই। এই দেখ – আমি… এই তো আমি … কিন্তু আবেগ স্তিমিত হয়ে এলে সেই আমিকেই খুঁজে পাই না। সুতরাং আবার ঝিমাই, ঝিমাতে ঝিমাতে এদিক সেদিক তাকাতে চেষ্টা করি

আজ চুপ থাকছেন আপনারা কারণ হামলাটা আপনার পাশের ঘরে আপনার বিপরীত ধর্মের উপর হচ্ছে তাই আপনি নিরাপদ এবং আপনি চুপ, তাই তো? একদিকে সব মুসলমান শেষ হবে আর অন্যদিকে শেষ হবে হিন্দু। বাহ, এরপর আপনারা ‘রামলালা’ আর ‘রাসুলের’ অপার মহিমায় বাঁচবেন সুখে শান্তিতে, তাই না? যদি তাই মনে করেন তাহলে বলি, মশাই আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কারণ এই সমস্ত উগ্র ধর্মের ঝান্ডাধারীরা না ভগবানের না আল্লাহর না কোন কমিউনিটির। এরা হল মৌলকুত্তা। আর এই যে আপনার পাশের বাড়িতই খালি হয়ে যাচ্ছে, এরপর সেই কুত্তাদের ভুখ মেটানোর খোরাক কোত্থেকে আসবে? নো চিন্তা মশাই, আপনি আছেন কি জন্যে? নেক্সট আইটেম হলেন আপনি। কি আপনি রেডি তো?

এই বার বুঝেন আস্তিকতার নিরিখে মৌলবাদীদের তান্ডবকে বৈধতা দেবেন আপনি? গান্ধী বলেছিলেন, চোখের বদলে চোখ..তাহলে পুরো দুনিয়াটা অন্ধ হয়ে যাবে। তাই নয় কি? তাহলে বুঝেন আস্তিক’দের কেন নাস্তিকরা কোপায় না… যদি ‘যুক্তিবাদ’ নামে কোন শব্দ বুঝে থাকেন তাহলে এটা বুঝেন যে ধর্ম/অধর্ম ( বা ধার্মিক/ অধার্মিক ) আর মৌলবাদ এক জিনিষ না… মৌলবাদীরা আস্তিক কিংবা নাস্তিক কিছুই হয় না। এরা স্রেফ মৌলবাদী.. মৌলবাদ আর ধর্মের পার্থক্য বুঝেন দয়া করে। মৌলবাদ ধর্মকে পুঁজি করে ধর্ম ব্যাবসা চালায়। ধর্ম ধর্মের জায়গায় আর ধর্মকে না মানা অন্য যায়গায় জায়গায় এবং মৌলবাদ হল স্থুল হিংসার হাতিয়ার। ধার্মিকেরা এইবার নিজেকে প্রশ্ন করেন আপনার ঈশ্বর বিশ্বাস কি মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে?..জাস্ট একটা কথা মনে রাখুন, মৌলবাদীরা না কারোর ছিল, না আছে, না থাকবে। এরা না আস্তিক, না নাস্তিক, না মানুষ। যদি নেক্সট খোরাক না হতে চান তাহলে আজই প্রতিবাদ করুন। ধর্ম আর মৌলবাদের মধ্যে প্রভেদটা করতে শিখুন। মনে রাখবেন আপনার পাশের ঘরটা আজ অক্ষত থাকলে আগামীকাল আপনার ঘরটা অক্ষত থাকবে..

তাই একটু মাথা তোলে দাঁড়াতে চেষ্টা করি…হয়তো এভাবেই কোন একদিন পলাতক স্বপ্নগুলি বিপ্লবী চেতনার জন্য তৈরি হয়েছিল। এই মুহূর্তে স্ফিত ক্লিষ্ট জর্জরিত ষ্টুপিড সাদামাটা স্বপ্নগুলি বিস্ফোরিত হচ্ছে দুর্বার অদম্য নিরেট কালবেলার আঁধার বেয়ে। ভাবছি কি আর হবে; কিই বা আর হয়ে যাবে; কুকুরেও শুঁকবে না আমার লাশ। তাই তো ? তোদের আওয়াজ নেই, তোরাই চোরাগুপ্তা উত্থিত শ্রেণীবেশ্যা, অক্ষমতার দোসর বেওয়ারিশ মৌলবাদী শুয়োর শালা। এই দ্যাখ, তাকিয়ে দ্যাখ আমার দিকে, বুকের মধ্যে একদল সুপ্ত লাভা বইছে, বিস্ফোরণ হলে সহ্য করতে পারবি শুয়োরের বাচ্চারা… পারবি ?

এবং পুরনো সঙ্গী কবীর সুমন লোকটা বলে উঠেন – ‘সব পাল্টানো যায় বন্ধু সব পাল্টানো যায় কমরেড’…

—————-
মার্চ । ০১ । ২০১৩

…………………………………………………………