কখনো মানুষ অদ্ভুতসব ভাবনার ঘোরে পড়ে যায়। কেমনভাবে তা জীবনের গভীর অনুভবের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। তখন অতীত ভবিষ্যত আর বর্তমানটা সেলুলয়েডের ফিতার মতো আগুপিছু হতে থাকে। নিজে যেন ভাসতে থাকি সময় নদীর ভিতর দিয়ে। সেই কিশোরবেলায় একাকি দাড়িয়ে বহমান নদীকে দেখতাম আর দিগন্তের পাড় থেকে শীতলক্ষ্যা ছাড়িয়ে মেঘনার উচ্ছাস ভেসে আসতো- পৌরাণিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে থাকা এক জগত। এটা একটা চিঠি হয়তো কাউকে লেখা অথবা নিজের কাছে নিজেকে….

নিসা
চন্দ্রালোকিত রাত। ৮টা ৩০ মিনিট। শীতলক্ষ্যার একরামপুর ঘাট। পাশেই কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার, গাছগুলো কেমন শান্তভাবে দাঁড়িয়ে। পুরো পরিবেশটিই যেন শীতের আগমন বার্তা ঘোষণা করছে। পারাপারের জন্য ৩-৪টি নৌকা ঘাটে; আরও ২-১টি নদীর এপার-ওপার করছে। কিন্তু প্রত্যেকটিতে কাচের চিমনি ঘেরা কুপির আলো। দেখলে উপকথার পিদিম জ্বলছে বলে ভাবতে ইচ্ছে করে। নিজেকে মনে হলো, রূপকাহিনীর কোনো বাঁকে। চাঁদের আলোছায়া মেখে একটা জাহাজ কোথায় যেন যাচ্ছে। হতে পারে তেলের ট্যাঙ্কার অথবা গম কিংবা সার বোঝাই কিছু। কেমন যেন আপন ভাবনার ঘোরে প্রবেশ করতে লাগলাম।

খেয়াল হলো না নদীর দু’কূল এবং দোকানপাটের আলো; খেয়াল হলো নদীর পানি। দেখলাম, শুধু অন্ধকারে অপসৃয়মান জাহাজের কালো অবয়ব আর জলের আলোড়নের ছাপ ফেলে যাওয়া পথরেখাকে। মনে হলো, নিজেকে প্রশান্ত মহাসাগরের লিটুয়ার উপকূলে, ঢেউয়ের শব্দে বিভোর এক কিশোর দাঁড়িয়ে। জলবেষ্টিত এক দ্বীপময় অঞ্চল। এ জায়গায় ছিল ইউকাটান নামে একটি দ্বীপ। যেখানে বাস করত টিলিঙ্গিট নামে প্রাচীন আদিবাসীরা। সপ্তদশ শতাব্দীর কথা। তারা পড়তে জানত না। মুখে মুখে ইতিহাসকে রক্ষা করত। তারা ছিল ইতিহাসের কথক। তাদের কয়েকশ’ বছরের মুখে মুখে ইতিহাস রক্ষার প্রমাণও আছে। এই টিলিঙ্গিটরা ফরাসি অভিযাত্রী লা-পেরুজের জাহাজকে দেখেছিল তাদের উপকথার পাখি হিসেবে। নৃতত্ত্ববিদ জিটি ইমনের কাছ থেকে এ ঘটনার সত্যতা জানা যায় প্রায় ১০০ বছর পর। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ফরাসি বিপ্লবের প্রাণপুরুষ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট লা-পেরুজের জাহাজে করে অভিযানে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যোগ্যতর বলে বিবেচিত হননি। হলে পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হতো। কারণ ওই জাহাজ কোনোদিনই আর ফিরে আসেনি। এটাও একটা বাঁক; তবে তা ইতিহাসের।

এখন ছোট নৌকাগুলোর একটিতে ওপারে যাচ্ছি। চাঁদের আলোর বন্যায় চারদিক প্লাবিত। নৌকাগুলো পিদিমের আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানো নিসা, চারদিকে এত আলোর পরও নক্ষত্রগুলো হীরার মতো জ্বলজ্বল করছিল_ যে রকম দেখেছিলাম হিরণ পয়েন্টে যাওয়ার সময় আমাদের হাইস্পিড যখন প্লাবিত মেঘনার নিঃসীম প্রান্ত অতিক্রম করছিল। আমরা যাচ্ছিলাম পূর্ণ সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণে। সময়টা ছিল ১৯৯৫ সাল। কী প্রবল উত্তেজনা আর স্বপ্ন আমাদের ঘিরে রেখেছিল! ঠিক এরকম সময় শীতের মন্থর বেগ আমাকে নিয়ে গেল পুরনো এক দিনের কাছে।

এই ঘাটের কাছে ছিল এক অসম্পূর্ণ কাঠের ব্রিজ। এর প্রান্তে এসে ১৯-২০ বছর বয়সী কয়েকজন কিশোর প্রায় দাঁড়াত। বয়ে যাওয়া নদীকে দেখত। সন্ধ্যার মৃদুমন্দ বাতাসে তারা স্বপ্নগুলোর কথা বলত। নিজেদের ভাসাত মহাজাগতিক ভবিষ্যতের পথে। বলত, জ্ঞানের জন্য, মানবিকতার জন্য তাদের জীবনকে ব্যয় করবে। তারা হতে চেয়েছিল গ্রহান্তরের কৃষক। কিন্তু তারা তা হতে পারেনি। তারা দাঁড়িয়েছিল জীবনের বাঁকে। অনাদিকাল ধরে চলে আসা বিবর্তনের আমোঘ নিয়ম তাদেরও ছাড়েনি। জীবনের ঋণ শোধার জন্য যে যার জগতে চলে গেছে!

নদী পার হয়ে ওপারে গেলাম। আবার গন্তব্যের উদ্দেশে পথ চলা শুরু হলো। এক পাশে ইস্পাহানী, অন্যপাশে জার্দিন জুট মিলের ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে। কী চমৎকার ছিল ওসব জায়গা! পুরনো বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলে আবাসভূমির নামে কংক্রিটের সমাধি তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। জার্দিনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাড়ির মতো খাল, যা আমার চলার পথেরও সমান্তরাল, অবলোহিত জীবনের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একবার জার্দিনের সামনে উন্মুক্ত নদীর তীরে পয়েন কেয়ারের গণিত নিয়ে অনেক সময় কাটিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ইউক্লিডিয় থেকে অক্লিডিয় জ্যামিতির উত্তরণের সর্পিল পথ; বোলাই_ লভেচভস্কি আর রিম্যানের সেই মর্মান্তিক সংগ্রামের কথা। জ্যামিতিক বক্রতায় জগতটাকে বুঝতে চেয়েছিলাম। অনুভব করেছিলাম সময়ের বাঁককে। ভেবেছিলাম মহাজাগতিক রহস্যের ধুম্রজালকে ভেদ করতে পারব। সেসব অনেকদিন আগের কথা।

ফিরে আসার সময় এই চাঁদের আলোয় সবকিছু মায়াবী লাগছিল। ভাবছিলাম সিন্দাবাদের অভিযান আর হারকিউলিসের সংগ্রামের দিনগুলোর কথা। সিন্দাবাদ! পারস্যের গল্পকথার সেই নাবিক। পূর্ব আর পশ্চিম সাগরকে তোলপাড় করে ঘুরে বেড়িয়েছিল। মুখোমুখি হয়েছিল উপকথার দানবীয় সব চরিত্রের। এ অভিযান আর অভিজ্ঞতা তাকে প্রাচুর্য এনে দিয়েছিল; কিন্তু মানবীয় বোধের সন্ধান কি পেয়েছিল, নিসা?

উপকথার হারকিউলিস দেবতা হয়েও মানুষের পক্ষে কেন অবস্থান নিয়েছিল? বারবার ক্রোধ-উন্মত্ততা তার জীবনকে বিপর্যয়ের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। ভুল আর প্রায়শ্চিত্তের মধ্যে তার জীবন কেটেছিল। কত নিঃসঙ্গ ছিল মানবিক এই দেবতা, ঘুরে বেড়িয়েছিল পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে, সমুদ্র থেকে মহাসমুদ্রর পানে। মানবিক পথের রেখা ধরেই খুঁজেছিল জীবনকে। জীবন মানেই মৃত্যু। সেই পলায়নপর মৃত্যুর দিকে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের পূর্ণতা পেতে। নিসা, মহাবৃত্তীয় যুগের স্বপ্ন কি তারা দেখেছিল?
এখন বিকেল। হঠাৎ করে জুলভার্নের নটিলাস আর চিরকালের অভিযাত্রী নিমোকে খুব কাছের মনে হলো। মানবিক পথের প্রান্তর খুঁজতে একা হয়েছিল নিমো। কী উত্তাল সমুদ্র! পৌরাণিকতায় প্লাবিত মেঘনার উচ্ছ্বাস ভেসে আসছে। আচ্ছা নিসা, তুমি আমাকে বলো আমার ভাবনা এবং নক্ষত্রের মতো স্থিরতা সভ্যতার আলো হাতে আগামী পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়। সত্যিই কি তাই?

রচনা কাল : ১৯৯৯ সাল

আসিফ
ডিসকাশন প্রজেক্ট