মেয়েটি একেবারে মৃত্যুর দোরগোড়ায় থেকে ফিরে আসলো। যমদূতের সাথে কি হাড্ডাহাড্ডি লড়ায়টা না করল সে! বাইরে থেকে দেখেই সবাই আৎতে উঠেছে, ভেতরের খবর আন্দাজ করতে পেরে কেউ কেউ বলেছে- এ সাক্ষাৎ ভগবানের কাজ! হিন্দুপাড়ায় বাড়ি কি না! পরাজয় ঘটলো যমদূতের অথচ মুখ ভার তার স্বামীর। বঙ্গ মিয়ার। জগতের সমস্ত মেঘ তার মুখে এসে জড় হয়েছে। জগতের এত এত মানষের মরণ হয়, আর শ্যালার মরণ এসি আমার উঠুনের ছুমুতে এসি আটকি গেল! যার পেটে ভাত নেই, অসুখ হলি চিকিৎসা নেই তার হয় না মরণ আর যার মরণের কোনো হেতুই নেই, শয়ে শয়ে বাঁচলিও যার বাঁচার খেদ মিটবি না সে কেমন টপ করি মরি গেল! আল্লার এ এক আজব বিচার। ও পাড়ার চেয়ারম্যানের ডাঙর হয়ে ওঠা মেয়েটার আকস্মিক মৃত্যুর কথা স্মরণ করে ভাবে বঙ্গ। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। বঙ্গ বিলের ধারে বাবলা গাছের তলে গায়ের জামাটা আসন করে বসে আছে। বিলের পানিতে পানকৌড়ির জলকেলি দেখার লোক সে না। সকাল থেকে তার চোখ ওদিকটাই যায়ওনি। সে আছে আপন ধ্যানে। ওখানে বসে থাকাটা একটা ঘটনা মাত্র। ভাবতে ভাবতে কখন যে সে এখানটাই বসেছে তা সে নিজেও জানে না। সামনে যে এক নদী পানি তাকে নকল করে গালে হাত দিয়ে ভাবনার ভান করছে তাতে তার নজর কোথায়!
বঙ্গের জীবনে কেউ বাঁচেনি বেশিদিন। দাদা-দাদী, নানা-নানীর মুখ সে দেখেনি। দাদা-দাদী মারা গেছে জন্মের আগেই। নানা-নানীর দেশ ওপারে। বঙ্গ বড় হওয়ার পর মরলেও তাদের মুখ দর্শন তার কপালে জোটে নি। বাড়ির বাছুরটার সাথে সাথে সে নিজেও যখন হালের উপযুক্ত হচ্ছিল তখনই গেল আববা। মা গেল তারও আগে- ওপারে না, ও-পাড়ার গেদু ব্যাপারীর সাথে পাশের গাঁয়ে। এই হল বঙ্গের জীবনবৃত্তান্ত। বললে আরও বলা যায় কিন্তু সে বড় একঘেয়ে। এক ঘেয়ে জীবনটা থেকে মুক্তি হব হব করেও হল না। বঙ্গর কী আর সাধে মন খারাপ! সে ভেবেছিল জীবনটাতে এইবার একটা ঘটনা ঘটবে। যে ঘটনার জন্যে পাঁচরকম মানুষ পাঁচটা কথা বলবে। একহারা জীবনটা দোহারা হবে। কত বড় বড় বাড়িতে তার নামে কথা উঠবে। হোক দোষ তবুও বঙ্গ নামে যে কেউ একজন এই সমাজে আছে তা তো জানবে সকলে! বঙ্গও যে কিছু ঘটাতে পারে সেটা জানাতে পারা তো আর কম কথা নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হলো কই? বঙ্গ চাইলেও এখন আর পারবে না। বৌর মৃত্যুর সম্ভাবনা শেষ, তার মানে তার সে সম্ভাবনারও সমাপ্তি ঘটল। এ তাদের দুজনারই জানা। কত স্বপ্ন এঁটেছিল দুজনে মিলে তার কি আর অত হিশেব আছে! এইবার গঞ্জে রথের মেলা বসলে আস্ত একটা খাট কিনে আনতো, বড় লোকদের বাড়ির মতো ডিজাইন করা খাট। দুজনেই টাকা গুছিয়েছিল বাড়িতে কটা ইট গাঁথবে বলে। মেয়ে হলে নাম রাখবে বৈশাখী, ছেলে হলে বাদল- হলে কি সে তো পেটে আছেই! এখন শুধু ঠিকঠাক মতো বউটা মরলেই হয়।
বঙ্গ যখন শুনেছে তার বউ আর মরবে না- কালু ডাক্তার বেহুদ্দার মতো জং পড়া দাঁত বের করে ভিড় ঠেলে যখন জানান দিয়েছে সে কথা- কই বঙ্গ? ভগবান তোর ডাক শুনিছে রে! এ-যাত্রা তোর বউ সাক্ষাৎ ভগবানের কাছ থেকি জীবন ছিনি নি এসিছে।- বঙ্গ তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভেবেছে- আল্লাহ, জীবনে এই একটা প্রার্থনাই তো দু’জন মিলি করিলাম! একজনকে বাঁচি একুন তিন-জুনাকেই মারলি তো? তিনজন মানে সাথে মাঠ-পাড়ার মকলেছের বৌ আর আনবর্ন শিশুটা। মকলেছ পাঁচ বছর হল আরব দেশে।
ভাল লেগেছে, মোজাফফর ভাই। আপনি নিশ্চয়ই নরেন্দ্রনাথের ‘রস’ গল্পটি পড়েছেন। আপনার গল্পটি সেই বিখ্যাত গল্পটির কথাই মনে করিয়ে দিল।
আপনার এই গল্পের কাহিনিকেও ছাড়িয়ে গেছে আপনার সরস ভাষা আর কথন ভঙ্গি। তবে শেষ লাইনে এটা কি হলঃ
আনবর্ন এই গল্পের ভাষার সাথে গেল কি??
যাইহোক, গল্প লেখা চলুক অবিরল। ভাল থাকুন। বড়দিনের শুভেচ্ছা!
@কাজি মামুন,
হুম, আনবর্ন পাঠ কটূ।
@মোজাফফর হোসেন ,
এ শব্দটা পরিবর্তন করে দেওয়া যায় না? আর
ভাল উপমা।
গল্প লেখা অব্যাহত থাকুক আর ১২১৩ তে একটা একক গল্পের বই চাই।
@গীতা দাস, দিদি ১৩তে একটা একক গল্পের বই আসছে। আশা করি মেলায় হাতে তুলে দিতে পারবো। ধন্যবাদ দিদি।
@কাজি মামুন,আমারও লিখতে লিখতে মনে হল যে এটা ঠিক গেলো না। নিশ্চয় শব্দটা পাল্টে নেবো। ধন্যবাদ মামুন ভাই।
সকলের জ্ঞাত সমাজের এক সর্বব্যাপী নিন্দনীয় ঘটনা চমৎকার লেখনীর কারণে অসাধারণ সুখপাঠ্য হয়েছে 🙂
(Y)
@সংবাদিকা, ধন্যবাদ ।
ভালো।
@ভাস্কর, ধন্যবাদ ।