এটা ছিল শাহানার প্রথম বিদেশভ্রমণ। শাহানা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। তার নিজের স্কুল আর নিউইয়র্কে তাদের একটি পার্টনার স্কুলের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত একটি স্টুডেন্ট-এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের সূত্রে শাহানার এ ভ্রমণ। প্রতি গ্রীষ্মে তাদের স্কুল থেকে নির্বাচিত হয়ে একজন ছাত্র বা ছাত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায়। সেখানে তাদের পার্টনার স্কুলের একজন শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে সপ্তাহচারেক তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এর বিপরীতে সে-বছরের শীত-মৌসুমেই ওই স্টুডেন্ট-এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে একজন আমেরিকান ছাত্র বা ছাত্রীও বাংলাদেশ ভ্রমণের সুযোগ পায়।
আমেরিকার লেখক পল অস্টার (Paul Auster) লিখিত “সাহিত্যে উত্তরাআধুনিকতার প্রভাব” নামক আর্টিকেলের উপর শাহানার একটি অনবদ্য লেখার সুবাদে ওকে সেবার আমেরিকায় ভ্রমণের জন্য নির্বাচন করা হয়। অস্টার রচিত সবগুলো বই পড়ার পর নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্ক দেখার জন্য তার তর সইছিল না, কারণ এ সেই পার্ক যেখানে অস্টার রচিত মার্কো নামের একটি কাল্পনিক চরিত্র বাসাভাড়া না দিতে পারায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
যাত্রাপথে দুবাইগামী ফ্লাইট ই.কে. ৫৮৩ বিমানের জানালার সিটে বসে শাহানা। আকাশ থেকে ইট-কনক্রিটের জঙ্গলে ভরা ঢাকা শহরটা দেখতে-দেখতে সে আনমনা হয়ে উঠে। যেন-বা সে দেখতে পায় সেন্ট্রাল পার্কের একটি বেঞ্চে মার্কো ঠিক তার পাশটিতেই বসে আছে। হাতে ধরা খবরের কাগজ থেকে চোখ উঠিয়ে মার্কো বলে উঠে, “জানো, এ কাগজটা এক বৃদ্ধা ফেলে গেছেন। তিনি প্রত্যেকদিন এখানে আসেন আর চলে যাওয়ার সময় কাগজটা বেঞ্চেই ফেলে রেখে যান। আর এভাবেই সারা পৃথিবীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটে।’’
‘প্লিজ, ফাসেন ইয়োর সিটবেল্ট। আমরা আর আধঘন্টা পরই দুবাই এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে যাচ্ছি।’ ঘোষণা শুনে শাহানা সম্বিত ফিরে পায়। মার্কোর সঙ্গে তার কাল্পনিক আলাপটা ছিল দীর্ঘ। লন্ডনগামী ফ্লাইটে ওঠার আগে এখানে তার বারো-ঘন্টার যাত্রাবিরতি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে যাত্রা শুরুর পঁয়ত্রিশ ঘন্টা পর জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে অবতরণ করল সে। দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তিতে বিমানে একসময় ঘুমিয়ে না পড়লে শাহানা দেখতে পেত ম্যানহাটনের স্কাইলাইন, আর তার মাঝখানে মার্কোর সেই সবুজ আশ্রয়।
ভীষণ একটা ভয় নিয়ে শাহানা জেগে উঠল, এক অচেনা শহরে অপরিচিত কিছু মানুষের সঙ্গে দিন কাটানোর ভয়। বাস্তবতা মেনে নিয়ে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করল সে। তাকে শক্ত হতে হবে, আর স্বপ্নের দেশের কিছু দারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হবে- এমনটাই সংকল্প করল শাহানা।
মিস্টার ও মিসেস গ্রিন তাঁদের পনের বছরের মেয়ে ক্ল্যারিসাসহ এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিলেন। সমবয়সী নীলনয়না স্বর্ণকেশী ক্ল্যারিসাকে দেখে শাহানার বেশ পছন্দ হল। আগামী চার সপ্তাহের এই ভ্রমণে যার সঙ্গে একটা সম্ভাব্য বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার কথা ভাবল সে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, শাহানার প্রত্যাশা আর বাস্তবতা এক ছিল না। সে দেখতে পেল তার প্রতি গ্রিন-পরিবারের আচরণ শুধুমাত্র সহানুভূতিহীনই নয়, তার প্রত্যাশা ও অনুভূতির সঙ্গে একেবারেই বিপরীত। শাহানার গন্ডি শুধু স্কুল আর বাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল। নিউইয়র্ক শহরের অবশ্য-দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে তাকে কখনও-ই নিয়ে যাওয়া হল না। গ্রিন-পরিবারের বাসায় তাকে একটি অন্ধকার ঘরে মেঝেতে ম্যাট্রেস পেতে ঘুমাতে হত। তাকে একা-একা খেতে হত। বাইরে খেতে গেলে, পয়সা বাঁচানোর জন্য শাহানাকে কখনও-ই ওরা সঙ্গে নিত না। তাছাড়া ওদের সন্দেহ ছিল এটাই যে, আমেরিকান রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে কীভাবে আচরণ করতে হয় তা বাংলাদেশ থেকে আসা বাচ্চা মেয়েটি নিশ্চয়ই জানে না।
কিছুটা বাংলাদেশি উচ্চারণ-ধারার মিশেলে শাহানা যদিও খুব সাবলীল ইংরেজি বলতে পারত- ক্ল্যারিসার পরিবার পারতপক্ষে তার সঙ্গে কথা বলত না। স্কুল আর সহপাঠীদের সাহচর্য থেকে নতুন-নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করত শাহানা। সেগুলো গ্রিন-পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইলেও ওরা উপেক্ষা করত। শাহানা এতে ভীষণ অপমানিত বোধ করতে লাগল, আর তাই আমেরিকায় আসার সিদ্ধান্তটা তার মধ্যে তিক্ততার জন্ম দিল।
এভাবেই সময় বয়ে গেল। এমন একটা বিগ এ্যাপেল দেশে আসার নিদারুণ যন্ত্রণা ও হতাশা নিয়েই পার হল চারটি সপ্তাহ। ঢাকায় প্রিয় পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য শাহানা উদগ্রীব হয়ে উঠল। বিত্তশালী গ্রিন-পরিবারের অবজ্ঞা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের চেয়ে নিজের কম-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যবিত্ত পরিবারটেই তার কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।
কিন্তু গ্রিনরা তাদের সঙ্গে আরও কিছুদিন থাকতে শাহানাকে বাধ্য করল। বাসায় একটি বড় পার্টির আয়োজন হয়েছিল। এ জন্য শাহানার সাহায্য তাদের দরকার ছিল। শাহানা পার্টি আয়োজনে ওদের সাহায্য করায় ওরা কিছুটা অর্থ সাশ্রয় করতে পারল। এ ব্যাপারে পরিবারটি একটি স্বার্থপর ব্যাখ্যাও দাঁড় করাল: কেন তারা বাংলাদেশ থেকে আসা একটি হতশ্রী শিশুর জন্য শুধু-শুধু পয়সা খরচ করবে? আমেরিকার মতো একটি দেশ ভ্রমণ করতে পেরে শাহানা কি যথেষ্ট ভাগ্যবান নয়!
অবশেষে সেন্ট্রাল পার্ক না দেখেই শাহানা তার প্রিয় বাবা-মা-ভাইবোনের কাছে ফিরে এল। আমেরিকায় তিক্ত ভ্রমণের স্মৃতি তার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করল। তারই সমবয়সী গৃহপরিচারিকা জরিনা এসেছে বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। ওর দুরবস্থা নিয়ে ভাবতে লাগল সে। গ্রিন-পরিবার তার সঙ্গে যেমন আচরণ করেছে, শাহানার পরিবার এর চেয়েও খারাপ ব্যবহার করে জরিনার সঙ্গে। শাহানার মা পান থেকে চুন খসলেই জরিনাকে বকাঝকা করেন। সে খুব ভোর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে। আর তাদের বেচে যাওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে জরাজীর্ণ কাঁথা রান্নাঘরের মেঝেতে বিছিয়ে তার উপর ঘুমাতে যায়। শাহানার পরিবার তার সঙ্গে এমন আচরণ করে যেন-বা সে রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের চেয়ে কিছুটা উন্নত প্রাণি- তবে মানুষ প্রজাতির নয়!
শাহানা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে এটা একটা বিশাল অবিচার। শাহানা জানে যে বাংলাদেশের কোনো এক জায়গায় জরিনারও একটি পরিবার আছে, যারা হতদরিদ্র, কিন্তু ভালাবাসা আর মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে তাদের সন্তানকে। জরিনাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে তার পরিবারের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা বলে। শাহানা অনুমান করতে পারে যে ওর নিজের আমেরিকা-ভ্রমণের মতো জরিনাও তার নিজের গ্রাম, প্রিয় পরিবার আর বন্ধুদের ছেড়ে ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে ঢাকার মতো বড় একটি শহরে এসেছে। কিন্তু দিনের পর দিন ক্লান্তিকর একঘেঁয়ে বাসার কাজ করার বিনিময়ে শাহানার পরিবারের কাছ থেকে সে কী পাচ্ছে? পাচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য সামান্য খাবার আর তার হতদরিদ্র পরিবারকে পাঠানোর জন্য নগণ্য কিছু টাকা। এটাই কি যথেষ্ট?
প্রথ্যেক মানুষের আছে সমান অধিকার।সবার উপরে আছে অন্যের কাছ থেকে মানবিক ও সম্মানজনক আচরণ পাওয়ার অধিকার। অথচ জরিনা সব অধিকার থেকেই বঞ্চিত। রুদ্ধ হয়ে আছে তার গতিশীলতা ও স্বাধীনতা। শাহানাদের পবিারের স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে জরিনার শ্রমশক্তি, বঞ্চিত হচ্ছে তার শিক্ষাগ্রহণের মৌলিক অধিকার। শাহানার পরিবার জরিনাকে বঞ্চিত করছে তার সুন্দর শৈশব থেকে। দারিদ্রতার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মলিন হয়েছে জরিনার জীবন। থাকা-খাওয়া-পরার যে সামান্য সুযোগ সে পাচ্ছে- সেগুলো তাকে বাধ্য করছে অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ার। এ সামাজিক রোগের কোনো না-কোনো প্রতিকার কি দরকার নয়?
ডিসক্লেইমারঃ এই গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক, কিন্তু এর অভিমুখগুলো বাংলাদেশের আনুমানিক ৪,২১,০০০ গৃহ শিশু শ্রমিকদের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ ( এবং সারা বিশ্বে এমন অসংখ্য মানুষের জন্যও)।
ডক্টর হাসনা বেগম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক।
রেইনার এবার্ট যুক্তরাষ্ট্রের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে পিএইচডি রত এবং বাংলাদেশ লিবারেল ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
ভাষান্তরঃ সেলিম তাহের।
আপনার এই গল্পটি পরে সমাজের দরিদ্র মানুষের প্রতি একধরনের সহানুভূতি তৈরী হল। এমনকি আমাদের কাজের মেয়েটাকে একটু সহমর্মীতা জানাতেও ইচ্ছা হল। এবং এজন্য নিজেকে মহানুভব বলেও বোধ হল। এই আত্ম তৃপ্তির তুলনা নেই!
Hey Rainer, liked the story. I agree with your point.
পরবর্তীতে ইংরেজি মন্তব্য প্রকাশ করা হবে না।
-মুক্তমনা মডারেটর
বাস্তব সত্যের মুখোমুখি করানো কাল্পনিক কাহিনীটি অসম্ভব ভালো লাগলো। দুর্বলের প্রতি সবলের আধিপত্য বিস্তার শাশ্বত। শাহানা গৃহপরিচারিকা হিসেবে আমেরিকা যায় নি কিন্তু মর্যাদা পেয়েছিল গৃহপরিচারিকার, শাহানার বাসার কাজের মেয়ে বিধায় কাজের মেয়ের মর্যাদা পেয়েছে। দুইটার প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
আসলে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা গেলেও শ্রেণিহীন সমাজ কখনো প্রতিষ্ঠা হবে না।
গল্পের লেখকের জন্য থাকলো শুভকামনা।
আপনার অনেক লেখা (এলজিবিটি রাইটস সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সহ বিভিন্ন লেখা ) আমি ইতিপূর্বে বিডিনিউজে পড়েছি। রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে পিএইচডি করছেন জেনে খুব ভাল লাগল। নিঃসন্দেহে মুক্তমনাকে আপনি দার্শনিক আলোচনার জন্য তীর্থক্ষেত্র হিসেবে পাবেন। আলোচনায় সমালোচনায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক মুক্তমনা।
মুক্তমনায় লেখালিখিতে আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ।
আমার একটি প্রশ্ন। আপনি কি বাংলা পড়তে এবং লিখতে পারেন? আপনার অন্যন্য জায়গায় লেখা থেকে আমার যতদূর মনে হচ্ছে আপনি দেশের বাইরে জন্মেছেন, এবং বাইরে পড়াশুনা করেছেন। আপনি বাংলাদেশ সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে উঠলেন কিভাবে এবং কখন?