ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার সরল পাঠ-১
ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার সরল পাঠ-২

আমাদের মূল আলোচনা বাংলাদেশের ধর্মীয় শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা হলেও কিছুটা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও যেতে হবে বিশ্লেষনের প্রয়োযনে, কারন এই প্রবনতা বা সমস্যা যেটাই বলা হোক সেটার প্রকৃত কারন বুঝতে গেলে বিচ্ছিন্ন ভাবে বাংলাদেশ আলোচনা করা যথেষ্ট নয়। মূল সমস্যাটা যেহেতু ইসলাম ভিত্তিক তাই আলোচনা সেদিকেই সীমিত থাকছে।

পাকিস্তানের উদাহরন দিয়ে প্রথম পর্ব লেখা শুরু করেছিলাম (সেখানে সূত্র আছে), তাদের জন্য বস্তুত করুনা ছাড়া আর আমার তেমন কোন অনুভূতি হয় না। সৌদী সরকারসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু রাষ্ট্র ও নানান সংগঠন আমাদের দেশসহ বিশ্বময় অনেক দেশেই ইসলাম প্রচারে বহু অর্থ ব্যায় করে, এর আওতা শুধু নির্দোষ ধর্মপ্রচারেই সীমিত থাকে না। জংগী জেহাদি শিক্ষা বিস্তারের কড়া অভিযোগও অনেক সময় আসে। আরব দেশের ধর্মভিত্তিক আজগুবি কালাকানুন, বিচার ব্যাবস্থা নিয়ে সমালোচনা বা ব্যাংগ বিদ্রুপ মিডিয়াতে প্রকাশ হলে ইসলাম প্রিয় ব্যাক্তিরা আরব দেশ মানেই ইসলাম না জাতীয় কথাবার্তা বললেও এটা এড়াবার উপায় নেই যে নবীজির জন্মভূমি হবার কারনেই হোক কি সাম্প্রতিক কালের পেট্রোডলারের গুনেই হোক, ইসলামী জগতে আরব দেশের বিশিষ্ট অবস্থান আছে, ধর্মীয় বিষয়ে তাদের অনুকরনের ধারা বিরাজমান আছে। তাই আরব দেশের নিজেদের সিলেবাসে কি আছে সেটা দেখা দরকার। আমাদের দেশেও আরব দেশের প্রভাবেই ধর্মশিক্ষার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষয় সমূহ জোর দেবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মাধ্যমিকে ধর্মশিক্ষা ঐচ্ছিক থেকে আবশ্যিক করার দূর্বুদ্ধি ছিল এরশাদের, সে নিজে ছিল আরব সরকারের অতি পেয়ারার লোক, তেমনি ছিল তার ধর্মমন্ত্রী রাজাকার সর্দার মাওলানা মান্নান। যদিও মূল কারন অর্থাৎ ধর্মীয় মৌলিক বিশ্বাসের প্রভাব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

সৌদী আরবের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ছাপানো ধর্মশিক্ষাতেও অপ্রত্যাশিত তেমন কিছু নেই। সেই ধর্মের নামে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঘৃনা বিদ্বেষ ছড়ানো, হিংসাত্মক জেহাদি শিক্ষায় ছেলেপুলেকে উদ্ধুদ্ধ করার পুরনো গল্প। এই লিঙ্কে
তাদের দেশের বেশ কিছু নমুনা পাওয়া যাবে। ৯১১ এর ঘটনা না ঘটলে হয়ত বহিঃবিশ্ব এসব নিয়ে মাথা ঘাটাতো না, শখ করে কেউ বিষের থলি নিজের উদরে পুরতে থাকলে কার অত দায় পড়ে সে বিষের থলি ধরে টানাটানি করার? মুশকিল হল মার্কিনীরা ৯১১ এর ঘটনায় প্রবল নাড়া খায় এবং কি কারনে বিশেষ কিছু দেশের লোকে গনহারে হেট ক্রাইমে লিপ্ত হতে পারে তা নিয়ে নানান এনালাইসিস করে। এর ফলে বন্ধু প্রতীম সৌদী সরকারকে অনুরোধ করে এসব ঘৃনা বিদ্বেষ ছড়ানো অংশ ধর্মশিক্ষা থেকে বাদ দিতে। আরব সরকার নিজেরাও মূল অভিযোগ স্বীকার করে, কারন ঘৃনা বিদ্বেষের মাত্রা এতই প্রকাশ্য এবং প্রবল ছিল যে অস্বীকারের কোন উপায় ছিল না। আরব দেশে এই ঘৃনাবাদ বপনের কাজটি শুরু হয় তাদের প্রথম শ্রেনী থেকেই, সেখানে সরাসরি শেখানো হয় যাবতীয় অবিশ্বাসীদের ঘৃনা করার, তাদের মধ্যে শুধু খৃষ্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক, নাস্তিকই নয়, এমনকি সুফি, শিয়া ও ওয়াহাবী ছাড়া অন্য তরিকার সুন্নী মুসলমানদের ঘৃনা করারও শিক্ষা দেওয়া হয়। ধাপে ধাপে চলে ধর্মশিক্ষার নামে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃনা বিদ্বেষের বীজ বপন ও চাষাবাদের কাজ; ……বিধর্মীরা সকলে এক যোগে ইসলাম ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে (আমাদের বইতেও একই তত্ত্বই আছে), তাদের সাথে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ, এমনকি সম্ভাষন জানানোও নিষিদ্ধ……অবশেষে তাদের দ্বাদশ শ্রেনীতে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলাম কায়েম করা যে তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব এ চুড়ান্ত জেহাদি শিক্ষা দেওয়া হয়। সোজা কথায় একদিকে মুসলমান (তাও আবার ওয়াহাবি ধারার সুন্নী মুসলমান), অপরদিকে বাদবাকি বিধর্মী; বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদ করে ইসলাম কায়েম করার মধ্য দিয়েই জগতের যাবতীয় অন্যায় অনাচার বিলুপ্ত হবে এই হল সরল সমীকরন।

সৌদী সরকার সংশোধনের ওয়াদা করে এবং ২০০৫ সালের মার্চ মাসে দাবী করে যে তারা সফল ভাবে সব হেটফুল অংশ সরিয়ে ফেলেছে। মুশকিল হল কার্যত দেখা যায় যে তেমন কিছুই আসলে পরিবর্তন করেনি। মার্কিনীরা সম্ভবত সমস্যার মূল বা এ সংস্কৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা ছিল না বলেই আশা করতে পেরেছিল যে আরব সরকার রাতারাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে আসা এসব ঘৃনা বিদ্বেষের বীজ দূর করে ফেলতে পারবে। নিজের দেশের সিলেবাসে পড়ায় তো পড়ায়, আমাদের তেমন কিছু করার নেই, সেসব পাঠ করে তাদের ভবিষ্যত নাগরিকরা অপর সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চীমকে ঘৃনা করার শিক্ষা পাবে, কেউ কেউ এর ভিত্তিতে বিশ্বরাজনীতির নানান হিসেবে জেহাদি বোমাবাজ হবে। এটুকুতেও সমস্যার শেষ নয়। আরব সমমনা হাবিবিরা এত অল্পে সন্তুষ্ট নন, ওনারা নিজ সিলেবাস সংশোধন করা তো দূরের কথা, উদ্যোগী হয়েছেন এসব ঘৃনা বিদ্বেষ ছড়ানো (অনেকের কাছে অবশ্য ঈমানী বিদ্যা) বিদ্যা কিভাবে আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ডের মত বিধর্মী দেশে রফতানী করা যায় সে প্রকল্পে। তেলের পয়সার গুনে ও পশ্চীমের খোলা জানালার সুযোগ নিয়ে প্রাথমিক কাজ অনেক আগেই শুরু করেছিলেন, বহু বছর ধরেই ওনাদের অর্থায়নে পশ্চীমের নানান দেশে গড় উঠেছে নানান ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের সিলেবাস বই পুস্তব আরব সরকার পাঠান, এমনকি কিছু শিক্ষকও ওনারাই পাঠান।

আগে এসব নিয়ে পশ্চীমে কেউ তেমন গা করত না, ৯১১ এর পর থেকে মিডিয়া এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে, যেমন ২০০২ সালের আমেরিকার একটি খবর এটি। আমেরিকায় ২০০৮ সালে উত্তর ভার্জিনিয়ায় সৌদী সরকারের সরাসরি পরিচালনায় পরিচালিত ISA (Islamic Saudi Academy) স্কুলের বইতেও বেশ কিছু পরধর্ম ও জাতি বিদ্বেষের উপাদান পাওয়া যায়। এ বিদ্যালয়ের দুয়েকজন শিক্ষক আল কায়েদার সাথে সংযুক্তির কারনে অতীতে জেলও খেটেছেন। ISA স্কুলের বক্তব্যও সৌদী সরকারের মতই, তারা বারংবার প্রতিশ্রুতি দেয় সংশোধনের, তেমন কিছু আদতে করে না।

যুক্তরাজ্যেও একই অভিযোগ মাঝে মাঝেই ওঠে সৌদী সরকার নিয়ন্ত্রিত কিছু বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের ব্যাপারে। সেখানে বিধর্মীরা শূকর ও বানরের বংশধর, চিরকাল দোজখে পুড়বে এ জাতীয় অমূল্য ঈমানী শিক্ষার পাশাপাশি চুরির কোরানিক শাস্তি হিসেবে হাত পা কোন যায়গা থেকে কতখানি কর্তন করতে হবে, সমকামিদের হত্যা করতে হবে সেসব শিক্ষাও বাচ্চাদের সচিত্র দেওয়া হয়, যা সরাসরি সেদেশের প্রচলিত আইনী ব্যাবস্থার বিরোধী। এসব স্কুল ওয়ালাদের অজুহাতও ধর্মগ্রন্থের বানীর মতই চিরন্তন; তাদের পাঠক্রমে সমস্যাপূর্ন কিছুই নেই, আপত্তিকর বিষয় সমূহ ‘আউট অফ কন্টেক্সট’।

ব্রিটেনে এ জাতীয় কিছু স্কুলের ওপর (শুধু মাত্র সৌদী নিয়ন্ত্রিত নয়) রিপোর্টিং হয়েছে। এর জবাবেও কিছু চাতূরীর আশ্রয় নেবার আলামত আছে। একই মসজিদ কমিটি যারা স্কুল চালায় তারা ফতোয়া হিসেবে বিধর্মী বিদ্বেষী বার্তা প্রচার করে (যেমন সংগীত হল ইসলাম ধ্বংসের জন্য বিধর্মীদের চক্রান্ত), যদিও জিজ্ঞাসা করা হলে স্কুলের সাথে সম্পর্ক অস্বীকার করে। ডবল ষ্ট্যান্ডার্ড এখানেও লক্ষনীয়, কট্টর মোল্লা রিয়াদ উল হকের (এমন বহু কট্টর ধর্মগুরুউ পশ্চীমের উদার ধর্মীয় নীতির ছত্রছায়ায় বহাল তবিয়তে আছে, গত লেখায় ব্রিটেনের আরেকজন সেলিব্রিটি মোল্লার তত্ত্ব বলেছিলাম) ভাষ্য গ্রহনযোগ্য নয় বলে দাবী করা, আবার তাকেই ‘ইন্সপায়রিং স্পীকার’ বলে স্কুলে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যুক্তরাজ্যের সৌদী দূতাবাসও নিজেদের সরকারের ছাপানো বই এর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই বলে দাবী করে। এসবের ফলে নুতন জেনারেশনে তৈরী হবে ভয়াবহ বিভাজনের যার ফল কারো জন্যই ভাল হবে না। অন্য ধর্মের কট্টর লোকেরাও বসে থাকবে না, তারা এসবের সুযোগ নেবে, যেমন একটি ইভানজেলিক্যাল স্কুলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক দেওয়ার আলামত পাওয়া গেছে।

কানাডার টরন্টোতে সম্প্রতি এক বড় মাদ্রাসার পাঠক্রমে ইহুদী বিদ্বেষ মূলক শিক্ষার ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে, মাদ্রাসার পারমিট সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অবশ্য ক্ষমা চেয়েছে, তাদের ওয়েব থেকে এ অংশ সরিয়ে ফেলেছে। এ পাঠক্রম ইরান সরকারের পাঠানো বলে অভিযোগ আছে যাতে অবাক হবার মত তেমন কিছু নেই। গত বছরও অটোয়া স্কুল বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত ফার্সী ভাষা শিক্ষার পাঠক্রমে ব্যাবহৃত ইরানী বইতে ইহুদীদের বানরের সাথে তূলনা করা হয়েছে অভিযোগ ওঠার পর স্কুল বোর্ড নীরবে সরিয়ে ফেলে।

বলাই বাহুল্য যে পশ্চীমা দেশগুলিতে ইসলাম ধর্ম শিক্ষার নামে প্রায়ই সমজাতীয় অভিযোগ অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই ওঠে (ওপরে প্যানারোমা ভিডিওতে আছে), কখনো বা সতর্কীকরন করা সত্ত্বেও আপত্তিকর অংশের প্রচার চালানো বন্ধ না করলে স্বাভাবিক কারনেই প্রতিষ্ঠান বন্ধই করে দেওয়া হয়। আমি সেসবের তালিকা যোগ করে অযথা লম্বা করছি না। সরকারী পর্যায় থেকে সরাসরি আসা ঘৃনা বিদ্বেষ ছড়ানো কারিকুলাম মোটেও হালকা ভাবে নেওয়া যায় না। বেসরকারী পর্যায়ে তাও হয়ত বলা যায় যে ‘অশিক্ষিত’ দুয়েকজন মোল্লা আলেম ‘ভুল’ ইসলাম শেখাচ্ছে। সনাতন মুসলমান মানস যেহেতু বিধর্মী বিশ্বাসের প্রতি ধর্মগতভাবেই শ্রদ্ধাশীল থাকার বদলে ধর্মীয় সূত্রে বিপরীত শিক্ষাই পায় তাই তাদের কাছে সম্ভবত এসব ঘৃনা বিদ্বেষ ছড়ানো শিক্ষায় আপত্তিকর কিছু লাগে না। অভিযোগটা কিছুটা গুরুতর শোনালেও সত্যতা অস্বীকার করা যায় না, নইলে আমাদের দেশের কথাই চিন্তা করেন, বহাল তবিয়তে কিভাবে মাধ্যমিক পর্যায়ে অন্তত ১৬ বছর ধরে বিনা প্রতিবাদে সরাসরি অপর ধর্ম বিশ্বাস ও বিশ্বাসীদের প্রতি ঘৃনা বিদ্বেষের পাঠাদান দেওয়া হচ্ছে (প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য)? যেসব মুসলমান বিবেকের তাড়নায় এসব পছন্দ করেন না তারাও সামাজিক নানান চাপের ভয়ে মুখ বুঁজে সয়ে যান, সর্বোপরি ধর্মবিদ্বেষী হিসেবে আল্লাহর লানতের ভয় তো থেকেই যায় কারন সামান্য অগ্রসর হলে দেখা যায় যে এসবের মূল সূত্র হিসেবে সরাসরি হাদীস কোরানই ব্যাবহার করা হচ্ছে (যেমন সৌদী পাঠক্রম, আমাদের দেশের পাঠক্রম)। ধর্মের নামে যাইই শিক্ষা দেওয়া হোক তার সরাসরি প্রতিবাদ অন্তত আমাদের মত সংস্কৃতিতে খুব সহজ নয়। পশ্চীমেও বসবাসকারি মুসলমান মনন এই ট্রেন্ডের বাইরে খুব একটা নয়।

কথা হল আমাদের বা আরব সংস্কৃতিতে যা স্বাভাবিক তা পশ্চীমের লোকে কেন সহজ ভাবে নেবে? তাদের দেশে যদি শেখানো হয় যে তারা বানর শূকরজাত, কিংবা তাদের মত অমুসলমানেরা অনন্তকাল দোজখে পুড়বে, অমূক জাতি মহাষড়যন্ত্রকারী, তমূকের ধর্মগ্রন্থ বাতিল, কেউ চির অভিশপ্ত জাতি তবে তারা এসব মহতী শিক্ষা শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতার ছত্রছায়ায় চলতে দেবে? শুধু যে কিছু বিদ্যালয়ের কোর্সে এসব শিক্ষা দেওয়া হয় তা কিন্তু নয়, মসজিদের খোতবায় নানান ধরনের ধর্মীয় সমাবেশেও এজাতীয় লেকচার কম বেশী খুবই সাধারন। আমি নিজেও একাধিক মসজিদে এ জাতীয় কথাবার্তা শুনেছি। সরাসরি জাতি বা ধর্ম বিদ্বেষ ছড়ালে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে বলে অনেকে বিশেষ করে ৯১১ এর পর থেকে সতর্ক হয়েছেন। এসব আপাতত আলোচনার বাইরে থাক।

বাংলাদেশে কেউ ইহুদী শিক্ষালয় বা হিন্দু টোল খুলে বসে সেখানে যদি পড়ায় যে মুসলমানরা শূকর হনুমান থেকে বিবর্তিত সবচেয়ে কুচক্রী জাতি, বোধ বুদ্ধিহীন চতুষ্পদ প্রানী, তারা অন্ততকাল দোজখে রোষ্ট হবে, মুসলমানদের সাথে আমাদের আজীবন যুদ্ধ করে যেতে হবে তবে বাংলাদেশী মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া কোন ভাষায় হবে? ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে হাসিমুখে মেনে নিবে নাকি ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগার কঠোর অভিযোগ করবে? এসব শিক্ষা ডিফেন্ড করে যদি কেউ চেঁচায় যে পাকিস্তানে মুসলমানেরা বিধর্মীদের নির্যাতন করছে, ইরান থেকে বিধর্মীদের অত্যাচার করে তাড়িয়েছে তাই এসব শিক্ষার দরকার আছে তবে সে যুক্তি কেমন শোনাবে? স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের জাতিগত ঘৃনা বিদ্বেষ ছড়ানো বিদ্যা শুধু ধর্মানুভূতির ব্যাপারেই নয়, আধুনিক সভ্য সমাজের মৌলিক নীতিমালা পরিপন্থী। নিজেদের ধর্মীয় জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ এবং অপরকে নিকৃষ্ট ঘোষনা করার সাথে হিটলারের নাজিবাদের তত্ত্বীয় পার্থক্য কতটা?

আমি গত পর্বে ইসলামী জগতে ব্যাপক সমাদৃত ইবনে কাথিরের তাফসির কিংবা মারেফুল কোরান থেকে অতি সামান্য কিছু অংশ মাত্র কোট করেছি। কি পরিমান জাতি বিদ্বেষী ধ্যান ধারনা, নির্দেশনা এসব জনপ্রিয় ঈমানী কিতাবের অজস্র যায়গায় আছে তার তালিকা নির্ধারন করতে গেলে বহু সময় লাগবে। এসবের একটি মাত্র লাইনের জন্যও নিঃসন্দেহে এসব ঈমানী পুস্তক পশ্চীমা দেশে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হতে পারে, আমাদের মত দেশে নাহয় জাতি বিদ্বেষী ধ্যান ধারনার প্রচার নিষিদ্ধ করাও অনেকের ধর্মানুভূতিতে লেগে যাবে। পশ্চীমা দেশে এখনো ধর্মশিক্ষালয়ের হেটফুল লেসনের লেজ সেভাবে খোঁজ করা শুরু হয়নি, এখনো মনে হয় তাদের ধারনা যে কিছু লোকে রাজনৈতিক বা নিতান্তই ব্যাক্তিগত ভুল ধারনার বশতঃ এসব ছড়াচ্ছে যাদের সাথে মূলধারার ইসলামের তেমন সম্পর্ক নাই, ধর্মীয় বিধিবিধান যেহেতু চুড়ান্তভাবে ইন্টারপ্রেটেশনের ওপরই নির্ভর করে, আক্ষরিকভাবে নয়। তবে রোগ আরো ব্যাপক মাত্রায় ছড়ালে নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতে আরো গভীরে খোঁজ করা হবে। অজস্র হেটফুল অংশ বিশিষ্ট এসব তাফসির জাতীয় কেতাব নিষিদ্ধ করার কথা উঠবে। তখন এক শ্রেনীর ইসলাম প্রেমী দাবীদারদের গতবাধা কথাও শোনা যাবে; সবই ইসলাম ধ্বংসের চক্রান্ত…পশ্চীমে প্রতিদিন হাজার হাজার কাফের নাছারার ইসলাম গ্রহন তারা সহ্য করতে পারছে না……।

আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলিতে ঠিক কি বিষয়ে কি শিক্ষা দেওয়া হয় তা বিদেশে বসে আমার পক্ষে বার করা সম্ভব নয়। সাধারন স্কুলের ধর্ম বইতেই যেই নমুনা দেখেছি তাতে কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে, বিশেষ করে সরকারী নিয়ন্ত্রনহীন কওমী মাদ্রাসাগুলিতে কি পাঠ দেওয়া হচ্ছে তা খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়, এ নিয়ে সামনের পর্বে হয়ত কিছুটা আলোকপাত করব। এখানে সেখানে বিচ্ছিন্ন ভাবে শুনেছি যে মাদ্রাসা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে এসব তাফসির, নানান বড় বড় আলেম বুজুর্গের তত্ত্ব খুবই গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়, কোরান, হাদীস, নানান তাফসির এসবের ভিত্তিতে নানান প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয় ইসলামী আইন বা ফিকাহ শাস্ত্র। কাজেই এসব নানান হেটফুল ব্যাখ্যা সমন্বনিত তাফসির নির্বিষ, কেবল ইতিহাসের অংশ এভাবেও চিন্তা করার উপায় নেই।

ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্র কেমন হতে পারে তার দুটি নমুনা দেখা যেতে পারে। অবশ্যই আমি দাবী করছি না যে ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্র মানেই এই্সব জিনিসে পরিপূর্ন হতেই হবে। ব্যাক্তি বিশেষে কট্টর নিয়ম কানুন অবশ্যই ভ্যারি করতে পারে। আমেরিকা ইউরোপে বসা ফিকাহবিদরা নিশ্চয়ই আরবের ফিকাহবিদদের মত লিখবে না, এইটুকু জ্ঞান অন্তত ওনাদের আছে আশা করা যায়। যা গুরুত্বপূর্ন বোঝার তা হল যে কট্টর, প্রাচীনপন্থী, জাতি বিদ্বেষী ধ্যান ধারনা সমূহ কেবল ইতিহাসের পাতাতেই স্রেফ রেকর্ড আকারে সীমাবদ্ধ নেই, সেসবের ভিত্তিতে ইসলামী আইন আকারে রীতিমত কোডিফাই করে সাড়ম্বরে ও প্রকাশ্যে প্রচারনা চলছে।

প্রথম বাংলা বইটির নাম “কুরান ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকাহ”। দ্বিতীয় খন্ডের জিহাদ অধ্যায় দেখুন (পৃষ্ঠা ৭৮৫-৭৮৬)। কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ; “ইসলামে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হল কুফরি ও শিরকের অপসারন করা…যাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌছে নাই তার সংগে যুদ্ধ দাওয়াতের পরেই হবে…আল্লাহ তায়া’লা বনি আদমকে একমাত্র তারই এবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। অতএব, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র যারা বিরোধীতা করে এবং কুফরির উপরেই অটল থাকে তাকেই হত্যা করা জায়েজ।“ কি নিদারুন সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ন কানুন না? যারা কুফরি করে অর্থাৎ এক আল্লাহ বা ইসলামে বিশ্বাসী নয় তাদের আগে ইসলাম গ্রহনের দাওয়াত দিতে হবে, সে দাওয়াত তারা প্রত্যাখান করলেই ব্যাস, তাদেরকে ইসলামী আইনানুসারে হত্যা করা ঈমান্দার ভাইদের জন্য জায়েয। এই ধ্যান ধারনা (তাও আবার আইনী আকারে) প্রচারকে জাতিগত বিদ্বেষ ও সন্ত্রাসের সরাসরি ইন্ধন বলা যাবে না কোন যুক্তিতে? কেবল মাত্র লাদেন বা শায়খ রহমান গোছের কেউ এক হাতে এসব খোদাই আইন আর আরেক হাতে বোমা বন্দুক নিয়ে তেড়ে এলে তবেই সন্ত্রাসের দলিল বলা যাবে, তার আগে নয়? এই অমূল্য কিতাবটি কোরানের আলো ও ইসলাম হাউজ নামের অন্তত দুটি অথেন্টিক ইসলামী সাইট বিনামূল্যে বিতরন করে অশেষ নেকি হাসিল করছে। আজকাল নাকি ইসলাম বিদ্বেষীরা বেশ কিছু ভূয়া সাইট বানিয়ে (ইসরাইল ভিত্তিক) ইসলামের নামে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে, এই দুটি সাইট অন্তত ভূয়া তালিকায় আছে বলে এখনো জানা যায়নি। কোরানের আলো সাইটে ইবনে কাথিরের সম্পুর্ন বংগানুবাদও আছে।

দ্বিতীয় ফিকাহ শাস্ত্রের বইটির নাম A Summary of Islamic Jurisprudence I ; লেখক ড: সালিহ আল ফাওজান। আগের বাংলা বইটির লেখকের তেমন পরিচিত খুঁজে পাইনি। উইকি ঘেঁটে এই ভদ্রলোক সম্পর্কে যা জেনেছি তাতে তাঁর ইসলামী জ্ঞানে সংশয় প্রকাশের কিছু আমি অন্তত পাইনি। আরবের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শরিয়া আইনে পড়াশুনার পর উনি মাষ্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রে, ইসলামী জ্ঞান জগতের প্রেষ্টিজিয়াস আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত আলেমদের অধীনে উনি পড়শুনা করেছেন। ইসলামী জ্ঞানের স্বীকৃতি স্বরূপ আরব দেশের সর্বোচ্ছ শরিয়া গবেষনা, ফতোয়া কমিটির উনি একজন স্থায়ী সদস্য। ইসলামী জ্ঞান বিষয়ক মাষ্টার্স, ডক্টরেট ডিগ্রী উনি সুপারভাইজ করেন, রেডিওতে প্রশ্নোত্তরের জবাব দেন। ফিকাহ শাস্ত্রে এমন সুগভীর তত্ত্বীয় জ্ঞান বাঘা বাঘা ডিজিটাল আলেম বা আমাদের ব্লগ মুফতিদেরও আছে কিনা সন্দেহ। এই বিশিষ্ট আলেম ও ইসলামী আইনবিদ জিহাদের গুরুত্ব বোঝাতে একে ইসলামের ষষ্ঠ খুটি হিসেবে বর্ননা করেছেন। উনি এ বই এর ৪৭৪/৪৭৫ পাতায় ইসলামে জিহাদের কিছু ‘noble objectives’ বর্ননা করেছেন। প্রথম noble objectiveই হল “To rid people of the worship of taghuts (false objectives of worship) and idols, and to lead them to worship Allah, Alone, associating no partner with Him সাথে অকাট্য রেফারেন্স হিসেবে কোরানের এক আয়াত (সুরা আনফালঃ৩৯) কোট করেছেনঃ “And fight them until there is no fitnah and [until] the religion [i.e. worship], all of it, is for Allah…”। এরপর আরেক noble objective হল “To humiliate the disbelievers take revenge on them, and weaken their power, for Allah, Exalted be He, Says (সুরা তওবার ১৪-১৫ আয়াত রেফারেন্স) (“Fight them; Allah will punish them by your hands and will disgrace them and give you victory….। এই বইটির নাম গুগল সার্চ দিয়ে দেখুন কত সাইটে এর রমরমা প্রচারনা চলছে, আমাদের বাংলা ইসলাম হাউজও আছে। এসব খোদাই আইন সম্পর্কে কি বলা যেতে পারে?

দেশের কিছু অঞ্চলের মাদ্রাসায় ধর্মশিক্ষার আড়ালে যে জংগীবাদি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে এ অভিযোগ ‘৯০ দশকের গোড়ার দিক থেকেই শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনরা করে আসছেন, প্রতিক্রিয়াও অপ্রত্যাশীত ছিল না, ‘সবই ইসলাম বিদ্বেষীদের চক্রান্ত’। ২০০২ সালে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলির জোট ক্ষমতায় আসার পর ফার ঈষ্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে “বাংলাদেশঃ এ কোকুন অফ টেরর” নামের এক কলাম ছাপা হয়, প্রতিক্রিয়াও চরম দেখা যায়। পত্রিকা ও কলামিষ্ট বার্টিল লিন্টনারের ১৪ গোষ্ঠি উদ্ধার করে দেশের তৌহিদী জনতা, কারন দেশের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা, মামলাও হয়। এরপর এসব আশংকা সত্য প্রমান করে হরকতুল জিহাদ জাতীয় দলের আবির্ভাব, একের পর এক জেহাদী বোমা হামলা, বাংলা বাহিনীর উত্থানে পুরো দেশে থরহরিকম্প, বোমার শব্দের চেয়েও আরো জোরে রব ওঠা ইসলাম শান্তির ধর্ম…। যাই হোক, হুজি, বাংলা বাহিনী অন্তত একটি উপকার করে গেছে বলতে হয়। তাদের কল্যানে অন্তত মসজিদ মাদ্রাসায় যে নির্দোষ ধর্মশিক্ষার আড়ালেও জংগীবাদি কার্যক্রম হতে পারে সেটা অবশেষে লোকের চেতনায় কিছুটা হলেও প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। সেটাও মনে হয় সম্ভব হয়েছে এটা আবিষ্কার করার পর যে জেহাদী বোমায় কেবল কাফের নাছারাই মারা পড়ে না, নিরীহ মুসলমানকেও জেহাদের আগুন ছাড়ে না। কিছু মাদ্রাসায় রেইড হয়, বেশ কিছু জেহাদী বই পুস্তক, অডিও ভিডিও ধরা আটক করা হয়। পরিসংখ্যানগত হিসেবে জেহাদী কার্যক্রমে লিপ্ত মাদ্রাসার সংখ্যা নগন্য, এটা পূঁজি করে ইসলাম প্রিয় দাবীদাররা মাদ্রাসা বা ইসলামী শিক্ষার সাথে সন্ত্রাসের সম্পর্ক হতে পারে না বলে জোর গলায় দাবী করেন।

আমি জানি না আমাদের দেশে জেহাদী মাল মশলা বলে যা আটক করা হয় সেগুলির ষ্ট্যান্ডার্ড কি, মানে ঠিক কি ধরনের উপকরন থাকলে সেগুলিকে বে-আইনী কিংবা ক্ষতিকর শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ আটক করেন? পত্রপত্রিকায় কিছু ছবি দেখেছি ‘জাগো মুসলমান’ জাতীয় টাইটেলের চাঁদ তারা ব্যাকগ্রাউন্ডে মেশিনগান হাতে লাদেনের ছবি জাতীয় কিছু বই পুস্তক, টেপ, ভিডিও। শুধু জিহাদ কিংবা জিহাদী শব্দ পেলেই নিশ্চয়ই একশন নেওয়া হয় না, কারন পবিত্র কোরান শরীফেও জিহাদকে অশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেশ কিছু আয়াত আছে, যার ব্যাখ্যা হয়তবা আক্রমনাত্মক জেহাদ নাও হতে পারে। কোরান শরীফ নিশ্চয়ই বাজেয়াপ্ত করা হয় না, যদিও সরকারের এসব ধরপাকড়ের পর কিছু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় দেখেছি যে ‘তাহলে সরকার কোরান শরীফও নিষিদ্ধ করুক’! সরকারের আসলেই উচিত বুদ্ধিবৃত্তিক জেহাদী উপকরন বলতে ঠিক কি বোঝায় সেটার গাইড লাইন নির্ধারন করা। এটা নিশ্চিত যে আমাদের বা পশ্চীমা সরকারগুলিও এখনো ইবনে কাথির কিংবা মারেফুল কোরান জাতীয় বইপুস্তক ‘জেহাদী’ শ্রেনী বিবেচনা করছে না যেখানে আমাদের সরকার নিজেই মারেফুল কোরানের প্রকাশক বলা চলে। চরম জাতি বিদ্বেষী তত্ত্ব প্রচারকারী ইবনে কাথিরের তাফসির, মারেফুল কোরান, ওপরের দুই ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্র (এমন কত আছে কে জানে) জাতীয় বই পুস্তক নিষিদ্ধ, নিদেনপক্ষে সংশোধিত করার দাবী করা যাবে না কোন যুক্তিতে? জাত তুলে সরাসরি গালিগালাজ, বোধ বুদ্ধিহীন চতুষ্পদ প্রানীর সাথে তূলনা, খোদাই নিয়মের নামে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বিধর্মী জাতির ওপর হামলার ইন্ধন, হেয় করার নির্দেশনা, এমনকি সম্পূর্ন বিনা উষ্কানিতে হত্যার নিয়ামাবলী সম্বলিত বই পুস্তক নিষিদ্ধ/সংশোধনের দাবী অনেকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানবে তাই? এই ধরনের ধর্মানুভূতির গর্বিত অধিকারীরা হিটলারের সমতূল্য নাকি মানসিক প্রতিবন্ধী তা আলোচনার মত সময় আমার আপাতত নেই।

অনুভূতি ফুতি বাদ দিলেও আইনী দিক থেকেও এসব প্রচারনা বে-আইনী মনে করার যুক্তিসংগত কারন আছে। বাংলাদেশ আরব দেশ নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮/২৯ নং ধারানুযায়ী ধর্মীয় ও যে কোন ধরনের জাতিগত বিভাজন, পক্ষপাতিত্ব নিষিদ্ধ করা হয়েছে, পেনাল কোডের ২৯৫-২৯৮ ধারা অনুযায়ী এসব শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুধু তাই নয়, জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো জাতিসঙ্ঘের universal declaration of human rights (UDHR) এর চেতনা বিরোধী, বাংলাদেশ সেই ’৭৯ সালেই জাতিসংঘের Racial Discrimination Elimination সনদও স্বাক্ষর করেছে। এই কমিটিকে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নের তাদের অবদানের নিয়মিত রিপোর্ট পাঠায়। এসব সনদের আওতায় যে কোন ধরনের জাতিগত বিদ্বেষমূলক নীতি, বিভাজন করা যায় না। একদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলে জোর গলায় দাবী করা, আরেক দিকে বিধর্মীদের প্রতি চরম বিদ্বেষমূলক উষ্কানিমূলক উপকরন পাঠ্য পুস্তকে পাঠ দেওয়া, সরকারী উদ্যোগে ছাপানোর মধ্যে বড় ধরনের হিপোক্রেসী আছে। আরব দেশ অন্তত নীতিতে পরিষ্কার, তারা যেহেতু ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদে কড়াভাবে বিশ্বাস করে (তাদের ভাষায় জাতিসঙ্ঘ নীতি ইসলাম সম্মত নয়) সেহেতু তারা জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করেনি। তারা এবং সমমনা ওআইসি ভুক্ত দেশগুলি শরিয়া ভিত্তিক Cairo Declaration on Human Rights in Islam (CDHRI) স্বাক্ষর করেছে।

আজকাল দেখি অনেকেই মুক্তমনা, আমার ব্লগ, সচলায়তন, সামু এ জাতীয় কিছু ব্লগ ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ প্রচারনার দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষনার দাবী করছেন। ভাল কথা, দেশের আইন ভংগ করা হলে নিষিদ্ধ হতেই পারে। কথা হল যে সে একই বিচারে যেসব সাইট জাতি বিদ্বেষী, এমনকি বিনা উষ্কানিতে অপর জাতির নিরীহ মানুষ হত্যার বিধান প্রচার করার পুস্তক পুস্তিকা প্রকাশ করতে পারে তাদের কেন নিষিদ্ধ করা হবে না? ওয়েব সাইট বাদ দেই, সরকারী প্রতিষ্ঠান ইসলামি ফাউন্ডেশন নিজেই কি জাতি বিদ্বেষী প্রচারনা প্রকাশ করে আসছে না? তাদের বিচার কে করবে? নাকি ষ্ট্যান্ডার্ডটা এখানেও যথারীতি ডবল? ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্ম, এবং অমুসলমানদের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছে প্রচার করা যাবে কিন্তু ইসলাম বিষয়ক ন্যূনতম সমালোচনাও সহ্য করা হবে না? মুক্তমনা, আমু, সামু এসব ব্লগে কেউ কাউকে জাতিগতভাবে শত্রু ঘোষনা কিংবা হত্যা করা জায়েয জাতীয় ঘোষনা দিয়েছে বলে এখনো শুনিনি।

আশা করি সমস্যাটার স্বরুপ মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে। ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার কুশিক্ষা কেবল আমাদের দেশেরই ধর্মশিক্ষা বইতে একেবারে অনাহুতের মত উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। এ রোগ হয়ত গ্লোবাল না হলেও আন্তর্জাতিক বলাটা মোটেও ভুল হবে না, আর হঠাত করে দুয়েকজন অশিক্ষিত মোল্লা আলেম নিজ থেকে এসব বার করেছে এভাবেও ব্যাখ্যা করার কোন উপায় নেই। অন্যান্য আরো কিছু মুসলমান প্রধান দেশেও এ জাতীয় সাম্প্রদায়িক শিক্ষার আলামত আছে। এসব শিক্ষার মূল হিসেবে সরাসরি কোরান হাদীস ছাড়াও শত শত, হাজার বছর ধরে ব্যাবহৃত নানান সহি ধর্মীয় সূত্রই ব্যাবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ, সময় ও স্থান দুই হিসেবেই এসবের প্রচার কোনভাবেই ব্যাতিক্রম বলা যায় না। সামনের পর্বে এসব সাম্প্রদায়িক শিক্ষার সামগ্রিক কুফল কেমন তা আলোচনা করব।