কাল্পনিক সংস্থা ‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের’ মেজর মাসুদ রানা ওরফে এমআর-৯ কে নিশ্চয় মনে আছে ? সেই মাসুদ রানা যে গোপন মিশন নিয়ে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায় , টানে ‘সবাইকে’ কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না ? কাজী আনোয়ার হোসেনের এই মাসুদ রানা সিরিজের বই অনেকের মত আমিও কিশোর বয়েসে ইস্কুলের পাঠ্য বইয়ের মাঝে লুকিয়ে পড়তাম। পড়ে পড়ে শিহরিত হতাম। ভাবতাম , ‘আহারে ! আমি যদি ‘মাসুদ রানা’ হতে পারতাম ! সোনায় সোহাগা আগুন ঝড়া সুন্দরী সোহানার মত সহকর্মী সাথে নিয়ে রোমাঞ্চকর জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে আমার কচি কিশোর শরীর রাজস্থানের থর মরুভুমির (পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ স্থান) মত উত্তপ্ত হয়ে উঠত ।

“A man who wants to make a profession of goodness in everything is bound to come to ruin among so many who are not good. Hence a prince who wants to keep his authority must learn how not to be good, and use that knowledge, or refrain from using it, as necessity requires.”
নিক্কোলো মাকিয়াভেল্লী , দ্য প্রিন্স ( IL PRINCIPE) , ১৫৩২ খ্রীঃ ।

পাঠকদের অনেকেরই এমন অনুভুতি হয়েছে চোখ বুজে বলে দেয়া যায়। অন্যদিকে , সে সময় পরিচিত জনের মধ্যে অনেকেই কাজ করতেন দেশের প্রধান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স উইংয়ে। সেই অফিসারদের সাথে মাসুদ রানার হুলিয়ার কোন মিলই সে সময় আমি খুঁজে পাইনি এবং এখনও পাইনা , ছয় ফিট উচ্চতা ছাড়া। তারা সবাই ছিলেন সাধারণ বিবাহিত সাংসারিক পুরুষ। তাদের ‘চাচা বলে সম্বোধন করে এটা ওট প্রশ্ন করে বিরক্ত করতাম। তারা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে লেজ গুটিয়ে পালাতেন – বড় হলে সব জানতে পারবে ! বড় হওয়া বলতে আসলে কি বোঝায় তা বয়স চল্লিশ ছোঁয়ার পরও বুঝতে পারিনি । এখনও বুঝি না। তবে, সময় প্রবাহে অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি । সেসব উত্তর খুঁজে পাওয়ার পরে মনে জেগেছে অনেক প্রশ্নও। সেসব প্রশ্নের উত্তর যদিও মাসুদ রানার পাতায় পাতায় কখনও লেখা হয় নি । কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স কি ? ইন্টেলিজেন্সই বা কি ? কেন? কিভাবে ? কোথায় ? কারা ? মাসুদ রানার সাংকেতিক নাম ‘মাইক রোমিও নাইনার’ না লিখে কাজী সাহেব এমআর -৯ কেন লিখলেন- এখন জানি। কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব নিজে পেশাদার গোয়েন্দাগিরি কখনও করেন নি এবং গোয়েন্দাগিরি নিয়ে পড়ালেখা বলতে উনার দৌড় তারই সমগোত্রীয় বিদেশী লেখকদের পেপারব্যাক বই পর্যন্ত যেগুলোর ‘ছায়া’ অবলম্বন (অনুবাদ!) করে তিনি মাসুদ রানা লিখেছেন। সেসব বইয়ে এমআর নাইন তিনি কোথায় পাবেন ? রোমান হরফে M A S U D R A N A লিখলে নয়টি অক্ষর পাওয়া যায় এবং তার সাথে M A S U D – এর M এবং R A N A -র R নিয়ে তৈরী করলেন MR9 ! কি সহজ এবং সেই সাথে বিপজ্জনক ! মাসুদ রানার মত একজন হাই প্রোফাইল গোয়েন্দার আসল নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে বানানো কোডনেম ভাঙার জন্য প্রতিপক্ষ গোয়েন্দা অফিসারের স্কুল পড়য়া সন্তানই যথেষ্ট ! সেটা ছাড়াও কাজী সাহেব না জানলেও ‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের’ মেজর জেনারেল রাহাত খানের মত একজন সিনিয়র অফিসার নিশ্চয় জানবেন যে , সামরিক বাহিনীতে অক্ষর এবং নম্বর ফোনেটিক নিয়মে বলা হয়। অর্থাৎ ,আলফা (A) , ব্রাভো -B , চার্লি- C ……… এবং নাডাজেরো (0) , উনাউন (1), বিসসোটু(2) ……. ।

মাসুদ রানা নিয়ে অনেক বুলি কপ্‌চালাম , এবার বাস্তবের গোয়েন্দাবৃত্তি নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। গোয়েন্দাবৃত্তি শব্দটা ছোট হলেও এর ব্যাপকতা এত বড় যে তা লিখতে হলে হাজার হাজার বইও যথেষ্ট নয় , ব্লগের এই ক্ষুদ্র পরিসর তো দূরের কথা। ভুলে গেলে চলবে না, গোয়েন্দাবৃত্তি পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশাগুলোর একটি। রাষ্ট্র , সমাজ , ব্যক্তি , ব্যবসা-বানিজ্য এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদ মামলার মত বিষয়ে গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয়ে থাকে। আমি এখানে প্রতিটি গোয়েন্দাবৃত্তি বা এসপিওনাজ নিয়ে আলোচনা না করে , বিশেষত আধুনিক রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ‘ইন্টেলিজেন্স’ নিয়ে আলোচনা করব এবং এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো গোয়েন্দাবৃত্তির অন্যান্য ক্ষেত্রের জন্যেও কমবেশী প্রযোজ্য।

ইন্টেলিজেন্স কি ?

আই এস আই এর স্টেশন চীফ গতকাল ঢাকায় কোথায় ছিলেন – এটা জানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ , তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে তিনি আজ কোথায় আছেন এবং আগামীকাল তিনি কোথায় থাকবেন , কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ? তথ্য এবং ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় সমূহ দিয়ে হাজারো তথ্য সংগ্রহ করছি প্রতি মূহুর্তে। আমাদের মস্তিষ্ক সেই তথ্যগুলো এমনভাবে প্রক্রিয়াজাত করছে যাতে সেগুলো আমাদের কাছে অর্থপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক মনে হয়। একটি ইন্টেলিজেন্স সংস্হা প্রতিদিন বিপুল পরিমান তথ্য সংগ্রহ করে। সেই তথ্যসমূহকে প্রথমে যাচাই বাছাই করা হয়। তার পর বিশ্লেষকেরা ( ইন্টেলিজেন্ন্স এনালিস্ট) সেই তথ্য সমূহের ‘শানে নজুল’ বোঝার চেষ্টা করেন। এরপর তারা সেই তথ্য সমূহকে অর্থপূর্ণতা এবং প্রাসঙ্গিকতা দিয়ে এমনভাবে সাজান যাতে করে উপর মহল সেগুলো বুঝতে পারেন এবং যথাপযোগী পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারেন। যে প্রক্রিয়ায় মাঠ পর্যায়ের তথ্যকে অর্থপূর্ণ ‘ইন্টেলিজেন্সে’ পরিনত করা হয় , সে প্রক্রিয়াকে বলা ইন্টেলিজেন্স সাইকল (intelligence cycle) বা গোয়েন্দা চক্র।
সোজা বাংলায় ইন্টেলিজেন্স বলতে এমন সব প্রক্রিয়াজাত তথ্য বোঝায় যা দিয়ে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব । সে পূর্বাভাস যে কোন বিষয়েই হতে পারে যা রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। প্রতিপক্ষ কিংবা বন্ধু রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ সম্পর্কে যত সঠিক পূর্বাভাস দেয়া যাবে , নিজেদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া তত সহজ হবে যাতে করে কোন ঘটনা ঘটলে সেটাকে বিনা মেঘে বজ্রপাত বলে মনে না হয়। ইন্টেলিজেন্সের প্রধান উদ্দেশ্য তাই সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা। একাটি অপারেশনের পরিকল্পনার আগে , অপরেশনের সময় এবং পরবর্তী পর্যায়ে সার্বক্ষণিক একজন কমান্ডারের ( যিনি রাষ্ট্র নায়কও হতে পারেন) কাছে ইন্টেলিজেন্স সময়মত পৌছাতে হবে , তাকে সেই ইন্টেলিজেন্স বুঝতে হবে ( যেহেতু তার চাহিদা অনুসারে ইন্টেলিজেন্স প্রস্তুত করা হয়) , বিশ্বাস করতে হবে এবং এর উপর ভিত্তি করে পদক্ষেপ নিতে হবে। যে কোন অপারেশনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ইন্টেলিজেন্স যার সূত্রপাত ঘটে মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে। ইন্টেলিজেন্সের পর্যালোচনা এবং মুল্যায়ন একটি চলমান ও সার্বক্ষণিক প্রক্রিয়া এবং সেখানে কোন কিছুকেই বেদবাক্য বলে গন্য করা হয় না।

রকমফের
সব পেশার মত ইন্টেলিজেন্স পেশারও পরিভাষা আছে । পৃথিবীর যে কোন দেশেই ইন্টেলিজেন্সকে বেশ কয়েকটি বিভাগে ভাগ করা যায় এবং প্রতিটি বিভাগে বিশেষজ্ঞেরা কাজ করে থাকেন । বিভাগগুলো হচ্ছে, হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স (HUMINT) ,ইমেজারি ইন্টেলিজেন্স (IMINT), সিগন্যালস ইন্টেলিজেন্স (SIGINT), মেজারমেন্ট এন্ড সিগন্যাচার ইন্টেলিজেন্স (MASINT), টেকনিকা ইন্টেলিজেন্স (TECHINT) এবং কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স (CI) । আরও একটি ইন্টেলিজেন্স বিভাগের ইদানিং বেশ উন্মেষ ঘটেছে যাকে বলা হয় ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স (OSINT) । এই পরিভাষাগুলো পৃথিবীর সব দেশে এক।
হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স (HUMINT) বা হিউমিন্ট বলতে নিয়োগকৃত ‘এজেন্টদের’ মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া বোঝায়। IMINT বা ইমিন্ট এক ধরনের ইন্টেলিজন্স যেখানে বিভিন্ন রকমের প্রযুক্তি ব্যবহার করে তোলা চিত্রের সাহায্য নেয়া হয়। এই চিত্রায়নে , সাধারণ ক্যামেরা , লেজার অথবা ইন্ফ্রা- রেড রস্মি , মাল্টি স্পেকট্রাল সেন্সর , রেডার এবং বিমান ব্যবহার করা হয়।

SIGINT বা সিগিন্ট কে আবার কয়েকটি বিভাগে ভাগ করা যায়, communications intelligence (COMINT), electronic intelligence (ELINT) এবং foreign instrumentation signals intelligence (FISINT) । যে কোন রকমের পরিবাহিত সিগন্যালকে সিগিন্ট এর আওতাভুক্ত করা যায়। আপনার লেখা ই-মেইল , ব্লগ, চ্যাট , ফেবু ইত্যাদি সব কিছই সিগিন্ট – এর আওতাভুক্ত এবং এই মূহর্তে ‘কেউ না কেউ’ সেগুলো পড়ছে ! এসব কাজে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা( এন এস এ) , বৃটেনের জি সি এইচ কিউ এবং ভারতের টি আই এ সিদ্ধহস্ত। ঘরবাড়ী , অফিস আদালত থেকে প্রতিদিন যে আবর্জনা ফেলে দেয়া হয় সেই আবর্জনা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয় যার নাম গার্বেজ ইন্টেলিজেন্স (GARBINT) । এখন থেকে গুরুত্বপূর্ন কাগজপত্র সম্পূর্ণ ধ্বংস না করে ফেলে দেবেন না কারণ ছেঁড়া কাগজ জোড়া লাগানো খুবই মামুলী বিষয়। IMINT এবং SIGINT থেকে যেসব উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় , সেসব উপাত্তের অনেক সময় অধিকতর বিশ্লেষনের প্রয়োজন হয়। এই পর্যায়ের গোয়েন্দা তথ্যকে বলা হয় মেজারমেন্ট এন্ড সিগন্যাচার ইন্টেলিজেন্স (MASINT) বা মাসিন্ট। রেডার , স্পেক্ট্রো রেডিওমেট্রিক, ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল , একোস্টিক, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি , তেজষ্ক্রিয় বিকীরণ এবং ভূ-কম্পন সংক্রান্ত উপাত্ত ছাড়াও রাসায়নিক , জৈব এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থ সমূহ মাসিন্টের আওতায় পড়ে।

টেকনিকা ইন্টেলিজেন্স (TECHINT) বা টেকিন্ট বিদেশী রাষ্ট্রের অস্ত্র এবং সামরিক যন্ত্রাদি প্রকৌশলগত বিষয়াদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে থাকে যাতে করে ঐসব অস্ত্র এবং সামরিক যন্ত্রাদি থেকে উদ্ভুত হুমকি সময়মত সামলানো যায়। সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনায় যেসব অন্তর্ঘাতমূলক হামলার কথা শোনা যায় , সে সব খুব সম্ভবত কোন শত্রু রাষ্ট্রের টেকিন্ট ইউনিটের কাজ।

আমাদের মেজর মাসুদ রানা যেহেতু একটা কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সংস্থায় কর্মরত , স্বভাবতই পাঠক কৌতূহলী হবেন যে , কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স (CI) বলতে কি বোঝায়। শত্রু , প্রতিপক্ষ অথবা বন্ধু রাষ্ট্র কিংবা বাইরের যে কেন শক্তির সার্বিক গোয়েন্দা কার্যক্রমের উপর নজর রাখা এবং প্রয়োজনে তাতে বাঁধা প্রদান করাই কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কাজ। এছাড়াও বিদেশী গোয়েন্দা এবং তাদের নিয়োগকৃত ‘এজেন্টদের’ সনাক্ত এবং প্রতিহত করা এই বিভাগের কাজ। রাষ্ট্রের গোপনীয়তা রক্ষা করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে কৌশলে ভুল তথ্য প্রদান করা কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের নিয়মিত কাজের অংশ। প্রয়োজনে ট্যাকটিক্যাল অপারেশন পরিচালনার জন্য বিশেষ বাহিনী বা স্পেশাল অপারেশন ফোর্সেস ( কমান্ডো !) কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়।


যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়

যদিও আমাদের মেজর মাসুদ রানাকে এখানে সেখানে তথ্যের জন্য দৌড় ঝাপ দিতে দেখা যায় , একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসার সাধারনত নিজে সরাসরি শত্রপক্ষের তথ্য সংগ্রহের সাথে জড়িত থাকেন না বললেই চলে। এ কাজের জন্য ‘এজেন্ট’ নিয়োগ করা হয়, যাদের পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করে সরবরাহ করা তাদের ‘অবস্থানগত’ কারনে সম্ভবপর। একটি সংবাদপত্র আগামীকাল কি ধরনের লেখা ছাপাবে এটা জানার জন্য সেই সংবাদপত্রের ভেতরের কাউকে ‘রিক্রুট’ করা হয় । আর সেই সংবাদপত্রের মালিক কিংবা সম্পাদককে যদি রিক্রুট করা যায় , তাহলে তো সোনায় সোহাগা ! যে সব অফিসার এজেন্টদের রিক্রুটমেন্ট এবং ‘হ্যান্ডলিংয়ের’ কাজে নিয়েজিত , তাদের বলা হয় ‘কেইস অফিসার’ । হাজার হাজার মানুষের মধ্য থেকে একেকজন কেইস অফিসার একেক উপায়ে ‘এজেন্ট’ রিক্রুট করে থাকলেও সে সবের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট সবসময়ই বিদ্যমান। তারা সাধারণত মাইস (MICE) মডেল অনুসরণ করে সম্ভাব্য রিক্রটদের এজেন্ট হতে প্ররোচিত করেন । MICE বলতে বোঝায় , Money (অর্থ), Ideology (ভাবাদর্শ), Coercion( বলপ্রয়োগ) এবং Ego (অহং) । ইসরাইলী মোসাদ , ভারতীয় ‘র’ কিংবা পাকিস্তানী আই ,এস, আই অথবা সি আই এ থেকে শুরু করে হালের সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক পর্যন্ত সবাই এই মাইস মডেল অনুসরণ করে এজেন্ট রিক্রুট করে থাকে। ‘কেইস অফিসারদের’ মধ্যে আবার যাদেরকে বিদেশে অবস্থান করতে হয় , তারা সাধারণত বিদেশে অবস্হিত কূটনৈতিক মিশনসমূহের নানারকম পদে নিয়োগ পেয়ে থাকেন এবং তারা ‘কূটনৈতিক অনাক্রমত্য’ বা ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটি ভোগ করে থাকেন। অর্থাৎ , ধরা পড়লেও তাদের বিচার করা যাবে না এবং বড়জোর তাদের সেই দেশ থেকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হিসেবে বহিস্কার করা হতে পারে। বিদেশে অবস্থানরত ইন্টেলিজেন্স অফিসারদের কাউকে কাউকে অন্য যেকোন পেশাগত পরিচয়ে ( শিক্ষক, গবেষক,এনজিও কর্মী ইত্যদি) ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটি ছাড়াই কাজ করতে হয় এবং তারা যদি ধরা পড়েন , সমূহ বিপদ ! যাহোক, কেইস অফিসার সংগ্রহকৃত তথ্য তার স্টেশন প্রধানের মাধ্যমে সদর দফতরে পাঠিয়ে দেন বিশ্লেষণের জন্য এবং এবং ইন্টেলিজেন্স এনালিস্টদের কাজ ঠিক তখনই শুরু হয়।

বিশ্লেষক
যারা সংগ্রহকৃত তথ্যসমূহ যাচাই বাছাই করার পর বিশ্লেষণ করেন তাদের বলা হয় ইন্টেলিজেন্স এনালিস্ট এবং এরা ইন্টেলিজেন্স সাইকল বা গোয়েন্দা চক্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একজন এনালিস্টের হাতেই বাহ্যত অর্থহীন তথ্য অর্থপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এক লক্ষ ই-মেইল কিংবা ৩০০ ঘন্টার টেলিফোন সংলাপ পাশাপাশি রেখে তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করা খুবই দূঃসাধ্য কাজ । আরও দুঃসাধ্য কাজ এসবে মাঝ থেকে অন্তর্নিহিত অর্থ খুজে বের করে পূর্বাভাস দেয়া। একজন এনালিস্টকে এসব কিছুই করতে হয় নিয়মিত। এজন্য যারা এনালিস্ট হন , তাদের ভু-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট , ভাষা , সংস্কৃতি এবং প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক সমূহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতে হয়। এনালিস্টদের হাত ঘুরে অবশেষে তৈরী ইন্টেলিজেন্স উপর মহলে পৌছায় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।

আপদ এবং বিপদ
আন্তর্জাতিক য়ুদ্ধ সংক্রান্ত আইনসমূহে যুদ্ধকালীন সময়ে তথ্যসংগ্রহের গুরুত্ব অনুধাবন করে গোয়েন্দা বৃত্তিকে একটি বৈধ সামরিক কৌশল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যেমন, যুদ্ধকালীন সময়ে একটা মেডিক্যাল এম্বুলেন্সে করে অস্ত্র বহন করা কিংবা রেডক্রসের পোষাকে ছদ্মবেশ ধারণ করা আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইন সমূহে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত। কাউকে গোয়েন্দবৃত্তির অভিযোগে সাজা দিতে হলে সেই ব্যক্তিকে গোয়েন্দাবৃত্তির সময় হাতে নাতে ধরতে হবে । সন্দেহের বশে সাজা দেয়া যাবে না। অন্য দেশে গোয়েন্দাবৃত্তি করতে গিয়ে যদি কাউকে পালাতে হয় , তাহলে স্বদেশে ফেরার পরে তাকে আর গোয়েন্দা বলা হয় না। তবে, অন্যান্য ফৌজদারী অপরাধীরা যেসব গ্রেফতারকালীন এবং গ্রেফতারপরবর্তী আইনগত সুবিধা পেয়ে থাকেন তার সবগুলো একজন গ্রেফতারকৃত গোয়েন্দার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। চতুর্থ জেনিভা কনভেনশন (১৯৪৯) এ বিষয়ে বিধিমালা দিয়েছে। শান্তিকালীন সময়ে অন্য দেশের ওপর গোয়েন্দাবৃত্তি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে । অনেক আন্তর্জাতিক আইন বিশারদ শান্তিকালীন গোয়েন্দা বৃত্তিকে একটা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করেন। এসব কারনে প্রায়ই কূটনৈতিক ঝামেলা এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য বিদেশী সন্দেহভাজন গোয়েন্দাদের গ্রেফতার না করে অপহরণ করা হয় কিংবা ‘আনঅফিসিয়াল’ ব্যবস্থা নেয়া হয়। আপনারা হয়তো খবরের কাগজে পড়বেন যে , একজন ‘নিরীহ’ এনজিও কর্মকর্তাকে ‘কে বা কারা’ অপহরণ করেছে , অথবা ‘ছিনতাইকারীর’ গুলিতে দূতাবাস কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। আমাদের মেজর মাসুদ রানা এতই সুপরিচিত যে তাকে হয়ত অপহরণ করার ঝুঁকিও কেউ নেবে না। নির্দেশ দেয়া হবে , শুট এ্যাট সাইট বা দেখামাত্র গুলি !

শেষ কথা
বাস্তবিক গোয়েন্দাবৃত্তি এমনই একটি খেলা যা দুজনে খেলে ! একজন গোয়েন্দাগিরি করে এবং আরেকজন গোয়েন্দা ধরে। গোয়েন্দা উপন্যাস , চলচ্চিত্র এবং বিগত শীতল যুদ্ধের প্রপাগান্ডা গোয়েন্দাবৃত্তিকে এক ধরনের জনপ্রিয় রঙীন ইমেজ দিয়েছে যার সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে পাওয়া দূস্কর। বাস্তবের গোয়েন্দা এবং গোয়েন্দা পাকড়াওকারীরা নানা রকম পঠভুমি থেকে উঠে আসলেও তাদের মধ্যে ‘একজন মাসুদ রানা’ খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। আমি পাইনি । আপনি যদি তারপরও এমন কাউকে খুঁজে পান , এখানে শেয়ার করতে ভুলবেন না ! সময় নিয়ে পাঠের জন্য ধন্যবাদ। আপনাদের ভাল লাগলে পরবর্তীতে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে।

কয়েকটি দেশের শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা সংস্হা

বাংলাদেশ
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্হা ( এন এস আই)
ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স ( ডি জি এফ আই)
ডাইরেক্টরেট মিলিটারী ইন্টেলিজেন্স (ডি এম আই)

ভারত
রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং (র)
টেকনিক্যাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ( টি আই এ)

পাকিস্তান
ডাইরেক্টরেট অব ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স ( আই এস আই)

চীন
ইন্টারন্যাশনাল লিয়েজো ডিপার্টমেন্ট

জার্মানী
বুনডেস-নাখরিখটেন-ডিন্সট( বি এন ডি)

রুশ প্রজাতন্ত্র
ফেডারেল নিরাপত্তা সংস্থা ( এফ এস বি)

বৃটেন
এম আই -৫
এম আই – ৬
জেনারেল কমিউনিকেশন হেডকোয়ার্টার ( জি সি এইচ কিউ)

ফ্রান্স
দিরেক্তর জেনেরাল দ্য সের্ভিস এক্সতেরিয়র ( ডি জি এস ই)

ইসরাইল
শিন বেথ
মোসাদ

যুক্তরাষ্ট্র
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ( সি আই এ)
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ( ডি আই এ)
জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ( এন এস এ)

তথ্যসূত্র:
১। Gannon, James – Stealing Secrets, Telling Lies: How Spies and Codebreakers Helped Shape the Twentieth Century. Washington, DC: Brassey’s, 2001
২। Herman, Michael – Intelligence Power in Peace and Wa r. Cambridge, UK: Cambridge University Press, 1996
৩। Knightly, Phillip – The Second Oldest Profession: Spies and Spying in the Twentieth Century. New York: Penguin, 1988.
৪। O’Toole, G. T. A. The Encyclopedia of American Intelligence and Espionage. New York: Facts on File, 1988
৫। ইন্টেলিজেন্স এবং কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের ওপর নেইটো (NATO) সশস্ত্র বাহিনীর বিবিধ এবং প্রাসঙ্গিক ফিল্ড ম্যানুয়ালস ও হ্যান্ডবুকস ।