নিজের কাজ করা আর অন্যে কাজ করার ভেতরে বেশ বড় একটা পার্থক্য আছে- একথা বোঝে পিটার লেভী। তারপরেও করি করি করেও করা হয়নি নিজের মঞ্চ- নিজের থিয়েটার বানিয়ে আলাদা ভাবে মনের মতন ব্যাবসা করা। এর পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারনটা কাজ করে- তাহলো এই ডন-ভিউ থিয়েটারের মালিকের আকর্ষনীয় ব্যাবহার। এমন একটা লোকের সাথে কাজ করতে ভাল লাগে লেভীর- বলা যায় খুবই ভাল লাগে। একসাথে থেকে সে কাজ উপভোগ করেও অনেক বেশী। লেভীইতো এই প্রাতিষ্ঠানের প্রাণ। কৌতুকাভিনয়ের এই মঞ্চের সুই থেকে হাতি সবকিছু তাকে নিজ হাতে তদারক করতে হয়, ব্যাবস্থাপনাও ধরতে গেলে তারই হাতে। পয়সাকড়ির ব্যাপারে মালিক এডমন্ডের হাত খোলা। লেভী বলেছে শুনলেই হলো, যেখানে যা লাগে খরচ করতে কখনও দ্বিধা করে না এডমন্ড। তাই আর নিজের আলাদা থিয়েটারের ব্যাবসা করতে তেমন উৎসাহ পায়নি লেডী ভেতর থেকে। অনেক সময় ভেবেছে সে- এই তো বেশ আছি, খামোখা ব্যাস্ততা বাড়িয়ে লাভ কি? তাছাড়া এই উত্তর আমেরিকায় যে কজন সফল কমেডিয়ান আছে সেওতো তাদের একজন। তার এই অবস্থানে আসার পেছনে কিছুনা কিছু অবদান তো এই থিয়েটারের আছে, তা অস্বীকার তো করা যায় না। অনেক অর্থ-সম্পদ তার এই মধ্যবয়সী জীবনে এসেছে। অর্থ বিত্ত তার জীবনে এসেছে প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশী একথা সত্য, কিন্তু তারপরেও ভক্তদের কাছ থেকে ভক্তি-শ্রদ্ধা, আর সম্মান প্রাপ্তির ব্যাপারে তার কোথায় যেন একটু সন্দেহ রয়েছে, একটু খাদ রয়ে গেছে।
মাঝে মাঝে আসল সত্যটা বেরিয়ে আসতে চায়, লুকিয়ে রাখা যায় না কোন ভাবে। অনেকতো দেখা হলো। দুই এক বছরের ব্যাপার তো না, কম করে হলেও দশ বছর ধরে এই শিল্পে কাজ করছে লেভী। কোন কিছু পর্যববেক্ষন করে তা থেকে সিদ্ধান্তে আসার ক্ষমতা তার আগের থেকে অনেক বেড়েছে, বিশেষ করে এই সব শিল্পের ব্যাপারে। সেই সব অভিজ্ঞতার আলোতে মনে হয়েছে তার, মানুষ কৌতুক শিল্পিদের শ্রদ্ধা করে ঠিকই, তবে অন্যভাবে- ঠিক নায়কদের যেখানে স্থান দেয় সে স্থানটা তারা কখনই পায় না, যত ভাল কুশলী অভিনেতাই হোক। হাজার হাজার ভক্ত তার এখন। যখন তখন বাইরে বের হওয়াটাও বিরাট ঝামেলার ব্যাপার- ক্ষ্যতির বিড়ম্বনা যাকে বলে। তারপরেও ভক্তের চোখ দেখলে সব বুঝতে পারে, দেখতে পারে লেভী- দেখতে পারে সেখানে লুকান করুনা- ভাড়ামীর জন্য দয়া। নিখাদ সম্মানের ছায়া খুজে পাওয়া যায় না শেখানে। যারা মুটামুটি শিল্প বোঝে- শিক্ষিতজনেরা, তারা চোখের ভেতরে মজাটাকে লুকিয়ে রেখে তার সাথে অভিনয় করে যায়। বড্ড অসহ্য লাগে সেসব। অশিক্ষিত লোকের ব্যাপারটা আলাদা। তাদের শরীরে, চোখে মুখে উপহাসটা প্রকাশ হয়ে পেয়ে যায়। তারা ঢাকাঢাকি করে না- করতেও জানে না। এসব নিয়ে আর ভাবতে ভাল লাগে না লেভীর। কি আর করা! এটাই হয়তো তার নিয়তি। এখন মাঝে মাঝে নায়ক হতে মন চায় তার- আগেও হতো। একবার রূপালী পর্দায় অভিনয় করে নায়ক হবার সাধও মিটেছিল দিলের। ছবিটা দুটো পুরস্কার জিতেছিল এবং তার একটা পেয়েছিল সে নায়কের ছরিত্রে অভিনয়ের জন্য নয়- শ্রেষ্ট কমেডিয়ান হিসাবে। সেসব ইতিহাস তাকে এখনও সমানে খোচায়, বিব্রত করে। নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে, কমেডিয়ান হিসেবে পুরস্কার জিতে আনার দু:খটা এখনও ভুলতে পারে না লেভী। ইচ্ছে করলেই এসব ভাবনা দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না সে- একান্ত নিস্কর্ম মূহুর্তগুলো দখল করে নেয় তারা গায়ের জোরে। কমেডিয়ান আর খল নায়কেরা সব সময় ভক্তদের কাছ থেকে অন্য ধরনের সাড়া পায়, যা তাদের আসন একেবারে আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়। কোনভাবে নায়কের জায়গটা দখল করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয় না। লেভীরও হয়তো এ জীবনে নায়কের সম্মানটুকু আর পাওয়া হবে না।
শো-শুরু হতে এখনও ঘন্টা দুয়েক বাকী। এক এক করে এত আগেই দর্শক আসা শুরু হয়ে গেছে। রাত আটটার শো ঠিক রাত আটটায়ই শুরু হবে এবং শুরুটা হবে লেভীকে দিয়েই। তাই লেভী তার বড় অফিস ঘরটার ভেতরে বসে আগাগোড়া পুরো পাঠটা ঝালাই করে নিচ্ছে। তার কাজের ভেতরে কেউ ছিদ্র খুাজে পাক, এই সুযোগ সে কখনও দেয়নি, দেবেও না কাউকে। এখনও অনেক সময় বাকী। ঘন্টা খানেক আগে মেকআপে গেলে চলবে। সব ঠিক আছে। শেলফ থেকে একটা বই নিয়ে ইজি চেয়ারে গাটা এলিয়ে দেয় লেভী। হঠাৎ করে প্যান্টের পকেটে রাখা ব্ল্যাকবেরীটা শব্দ করে তিনটা সংকেত দিলো। কেউ লিখিত বার্তা পাঠিয়েছে -এস এম এস- আধুনিক প্রযুক্তির ধাক্কা। পাকেট থেকে জিনিসটা বের করে দুএকটা বোতাম টিপতেই বার্তটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো পরিষ্কার অক্ষরে শব্দে। মাথার তালু, হাত-পা ঘামছে লেভীর- শরীরটা কেমন অন্য রকম লাগছে। ইজি চেয়ার ছেড়ে কিছু সময় পায়চারী করলো সে, তারপর একটা সাধারন চেয়ারে গিয়ে বসলো মাথাটা নীচু করে। জার্জি চাচা বার্তা পাঠিয়েছেন। লেভীর মায়ের মৃত্যু সংবাদ বয়ে এনেছে সে বার্তা। কালো শোকের খবর। আগামীকাল বিকাল চারটায় মৃতের সৎকার। খবর পাওয়া মাত্র সে যেন রওনা হয়। অভিনয়ের সব- একেবারে সবটাই ভুলে গেল লেভী। কি করবে এখন সে? আর কিছু সময় বাদে তাকে শো শুরু করতে হবে। শত শত মানুষ অপেক্ষা করছে, শুধু তার জন্য অপেক্ষা করছে একথা সে ভাল করেই জানে। কিন্তু কিভাবে সে অভিনয় করবে? মঞ্চে গিয়ে কি করবে সে? তার মুডইতো শেষ হয়ে গেছে। যা করবার এখনই করতে হবে। প্রায় দৌড়ে গিয়ে মালিক এডমন্ডের দরজায় টোকা দেয় লেভী।
-এডমন্ড, আমি মঞ্চে উঠতে পারবো না।
হাপাচ্ছে একটু একটু লেভী। তা দেখে ম্যানেজার তাকে চেয়ারে টেনে বসায়। শো শুরু হতে আর কয়েক মিনিট মাত্র আছে, এই সময় লেভীর মুখে এমন অদ্ভুত কথা শুনে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে যায় এডমন্ডের।
-বস, লেভী এখানে বস। তোমাকে বেশ অন্যরকম লাগছে। কি হয়েছে কি, বলতো!
-এই দেখ আমার ফোনে খবর এসেছে। আমার মা আর নেই। আমাকে যেতে হবে, বিমান ধরতে হবে। আমি কিভাবে মঞ্চে উঠবো। আমার তো মুডই নেই।
লেভীর কন্ঠে অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। তাকে এমন অবস্থায় আগে কখনও দেখেনি এডমন্ড।
-লেভী একটু স্থীর হয়ে বসো এখানে। এই মুহুর্তে তোমাকে শান্তনা দেবার মত কোন ভাষা আমার নেই। তুমি কিছু সময় শান্ত হয়ে বসো, দেখি কি করা যায়।
লেভীকে কোনভাবে আশাহত করা যাবেনা। তার এখন ভয়াবহ সময়। এমন একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়লে এডমন্ড একেবারে দিশে হারিয়ে ফেলতো, লেভী তাও স্থীর হয়ে বসে আছে। কি করা যায় ভেবে কোন কুল কিনারা করতে পারেনা এডমন্ড।
– আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। একটা চেষ্টা করে দেখতে পার।
– কি বুদ্ধি। বল তাড়া তাড়ি, এডমন্ড।
লেভীর কন্ঠে বিষন্ন ব্যাকুলতা- হাত পা কাঁপছে বেশ। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে, সেখান থেকে শব্দগুলো ঠিকমত বেরুতে চাইছেনা। এই অল্প সময়ের টানা পড়েনে শরীরটা বেশ পানি শূন্য হয়ে পড়েছে।
– ঠিক সময়মত তুমি একবার মঞ্চে ওঠো। আরে, উঠে দেখই না কি হয়। তারপর আস্তে আস্তে তোমার ব্যাপারটা খুলে বলো। আাগমী সপ্তাহে তোমার শোটা তুমি ফিরে এসে মঞ্চায়ন করছ ফ্রি- ঘোষানা দিয়ো দাও- দেখবে, আমার ধারনা দর্শকরা শুনবে। তবে আমার মঞ্চে যাওয়া একদম ঠিক হবে না। ওখানে পেলে দর্শক আমার উপর চড়াও হতে পারে। এ ব্যাপারে আমার অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর না।
বিরাটাকায় মঞ্চের সবগুলো বাতি একে একে জ্বলে উঠলো। সেই সাথে করতালিতে ফেটে পড়লো দর্শক। আজকে চলছে একই শো-এর পঞ্চম রাত। দর্শক বটে- কমেডি শো তারা পাগলের মত গেলে। হাততালি আর গলাছাড়া চিৎকার শুরু হলো লেভীকে দেখে- তার মঞ্চে আরোহনের জন্য। জনতার উল্লাশ এক সময় কমে এলো। হাত উঠিয়ে লেভী সবাইকে থামতে অনুরোধ করলো। মাইক্রোফোন এখন তার হাতে। সে যা বলবে, তাই শুনতে হবে জনতার।
– দেখুন দর্শক, একটা কথা বলি, মন দিয়ে শুনুন এবং তারপর বিচার বিবেচনা করুন। এই মাত্র খবর পেলাম আমার মা, মানে আমার প্রানপ্রিয় জননী আর নেই। তাকে শেষ বারের মত দেখতে হলে আমাকে এখুনি রওনা হতে হবে। আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি——-।
হাততালি আর স্বতঃস্ফুর্ত চিৎকারে ঘরটা বুঝি ধ্বসে পড়বে। থামার কোন লক্ষন নেই। লেভীর মুখে আরও অনেক কথা আটকে আছে। দর্শক থামিয়ে দিয়েছে তাকে, তাদের আনন্দ প্রকাশের জন্য। কেউ কেউ আবার গলা ফাটিয়ে বলছে- অ ভিনয় ভাল হয়েছে- চলুক, চলুক- একেবারে ব্যতিক্রমী। দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখে শুনে ভাবনায় ভ্রু কুচকে গেল লেভীর- এত দেখছি বিরাট সমস্যায় পড়া গেল। সে অভিনয় কখন করলো?
-দেখেন, দর্শক ভাই-বোনেরা, আপনাদের যেমন বাবা মা আছে, আমারও ঠিক তেমনি পরিবার পরিজন আছে। তারাও মরনশীল, তারাও কোন না কোন সময় মারা যেতে পারে। এটাই সত্য। ঠিক তেমনি আমার মাতৃবিয়োগের কথাই আমি এতক্ষন—-।
আবার থামতে হয় লেভীকে, করতালির ধাক্কায়। মনে মনে ভাবে সে, এরা তাকে ভাবলো কি! নাহ, এসব আর ভাল লাগে না। আজকের শোটা পরের সপ্তাহে করা হবে- এই জরুরী ঘোষনাটাও তো এখনও দেয়া হলো না। মহা বিপদে পড়া গেল যে। এরা একেবারে নাছোড়বান্দা।
এই ভাবে দুইবার তিনবার চেষ্টা চালালো লেভী জনতাকে আসল বিষয়টা বোঝাবার। তার সবচেষ্টা মাঠে মারা গেল। পরিস্কার বুঝলো সে, মঞ্চে দাড়িয়ে যা কিছু সে বলেছে সবকিছুকে জনতা কমেডি শো’র অংশ হিসাবে নিয়েছে। যাক যা হয়েছে ভালই হয়েছে। ঘন্টাখানেক সময় এভাবে নির্বোধ ভাড়ামীতে কেটে গেছে তার। কি আর করবে, মাইক্রোফোনটা যথাস্থানে রেখে অবশেষে হাত উঠিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো লেভী। আজকে মঞ্চে উঠার ইচ্ছা, শক্তি কোনটাই ছিল না তার। তার পরেও চড়তে হলো মঞ্চে। কপালের ফের, কি আর করা। নীচে নেমে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে- হায়রে ভাড়, তোর জীবনের বড় বিয়োগান্তক বাস্তবতাও শেষে মস্ত কমেডী শো হয়ে গেল!
কতদিন বাড়ীতে যায়না লেভী? কতদিন সে মাকে দেখে না? অঙ্গুলে গুনে দেখে- প্রায় চার বছর পর আজকে যাচ্ছে মাকে দেখতে। আজকেই শেষ দেখা। এরপরে আর তাকে এত কষ্ট করে গ্রামে গিয়ে মাকে দেখতে হবে না। খামার বাড়ীর পুরোন আস্তাবলের কারুময় বাহারী খুটির সাথে মিশে থাকা পির্তৃপুরুষদের পরিচয় খুজতে আর তাকে কষ্ট করে অতদূর না গেলেও চলবে। আরো বহু কীর্তি-ঐতিহ্য দর্শনেও তার আর কোন কাজ নেই। মা যখন নেই মাসীকে দেখতে গিয়ে কি লাভ? মনের ভেতরে একটা চাপা বেদনা বোধ গুমরে গুমরে উঠে। বহু কষ্টে চোখের উষ্ণ স্রোতটকে আটকে রাখে। নিজের কাজ আর ব্যস্ততার দিকে একবার বাকা দৃষ্টি ছুড়ে মারে সে সহসা। রাগ হয়, একটা অপরাধ বোধে অন্তরটা জ্বালা করে। মায়ের উপর কিঞ্চিত অভিমানও হয়। কতবার বলেছে লেভী মাকে তার কাছে এসে থাকতে। শহরে কত উন্নত চিকিৎসা সেবা। কি আছে ঐ গায়ের খামার বাড়ীতে? অন্তত: বড় কোন শহরে থাকতে পারতো তার মা। তাহলে হয়তো, এই দুর্ঘটনা ঘটতো না। ছেলের কোন কথাই কানে নেয়নি বৃদ্ধা মা। মায়ের ঐ এককথা- এই পাগল ছেলে কিভাবে বুঝবে- কি আছে এই খামার বাড়ীতে? এখানে সবকিছুর সাথে মিশে আছে তার স্বামীর স্মৃতি। এখানে আছে তার শশুর-শাশুড়ী বাবা-মার স্মৃতির সাথে মিশে থাকা ঘর, বাড়ী, উঠোন। এখানে আছে তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন। অনেক করেও মাকে শহরে আনতে পারেনি লেভী। মনে পড়ে তার, শেষ যে কথাটা মা তাকে কঠিন কঠিন শব্দে- “তোর ইচ্ছে হয় শহরে গিয়ে ভাড়ামী করগে। আমারেও ভাড় বানাতে চাস নাকি? এই খামার বাড়ীই আমার স্বর্গ”। শাসনের সেসব শব্দমালা কোন ভাবে সে কি শুনতে পাবে আর? একটা অদৃশ্য সুতোর টান তাকে নির্মম ভাবে খুচিয়ে জ্বালিয়ে মারে অবিরাম, সেই সাথে পথচলা আর স্মৃতির ভারে ক্লান্তি বেড়ে চলে লেভীর।
দীর্ঘ্য সময়ের বিমান, আর বাস যাত্রা শেষ হলো এক সময়। দুপুর গড়িয়ে গেছে সামান্য। শোকে আর ভ্রমনে অবষন্ন লেভী। পিঠের উপরে ছোট্র একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে গুটি গুটি পায়ে গাঁয়ের বাড়ীর উঠোনে এসে প্রবেশ করলো সে, চারিদিকে তাকালো কেমন এক অচেনা দৃষ্টিতে। চোখের সামনে অপ্রত্যাশিত কোন দৃশ্য দেখে বিস্মিত হলো লেভী- চমকালো সে কি এক অমুল্য প্রাপ্তির শিহরণে। দেখলো সে- উঠোনে পা ছড়িয়ে ইজি চেয়ারে গাঁ এলিয়ে বসে রয়েছেন মা। অবিশ্বাস্য! আর তার পাশে আরেকটা চেয়ারে বসে আছেন তার চাচা, জার্জি। হতবাক লেভীর কন্ঠ থেকে আনন্দ আর বিস্ময়ের মিলিত ধ্বনী বেরিয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে। প্রায় দৌড়ে এসে মায়ের হাত ধরে সে।
– মা, তুমি বেঁচে আছ? আর চাচা, এই গুলো কি?
– কেন? আমি বেঁচে থাকাতে তুই খুশি হোসনি?
-কি যে বলো মা, খুশি হবো না কেন? অবশ্যই খুশি হয়ছি।
-কিন্তু মা, এইসব মরার কথা বলে এমন করলে কেন?
– মরার কথা না বললে কি তুই আসতিস? গুনে গুনে বলতো কতদিন বুড়ো মাকে দেখতে আসিস না? এটা এক ধরনের অপরাধ, বুঝলি? মৃত্যু সংবাদ দিয়ে তোর সাথে একটু মজা করলাম। ভাড়দের সাথে সবাই মজা করে। আমি তোর ভক্ত তো, তাই এমন করলাম।
কথাগুলো বলে খিল খিল করে হাসতে থাকেন মা।
-শেষমেষ তুমিও আমার সাথে মজা করলে, মা? সবার মত তুমিও?
মুখটা বেশ একটু গম্ভীর হয়ে যায় লেভীর । মা তার তখনও সমানে হেসে চলেছেন। সেদিকে ভাবনাহীন তাকিয়ে আছে লেভী। হঠাৎ করে মায়ের চোখের ভেতরে একটু খুব পরিচিত উপহাস আবিষ্কার করে ফেলে সে। এই করুনা-উপহাস তার হাজার হাজার ভক্তের চোখের ঝলকানীতে পাওয়া যায়, কিন্তু তাদের মুখে থাকে স্তুতি। লেভী আশা করেছিল, অন্ততঃ তার মায়ের চোখে এই চোরা উপহাস কোনদিনই দেখবে না সে। কিন্তু তাকে দেখতে হলো তাই, কারন মা এখন তার একজন ভক্ত। মা তখনও হাসছেন ক্লান্তিহীন।
মায়ের হাতখানা খপ করে ধরে ফেলে তার ছেলে। মনে মনে ভাবে ছেলে- অনেক কিছু হারিয়ে ফেলতে চলেছে সে। মায়ের উপর ছোট ছোট দায়িত্বগুলোই সে সমাধা করতে পারেনি কাজের ছুতোয়। সময় তাই প্রতিশোধ নিয়েছে- মাকে নিয়ে ফেলেছে ভক্তের কাতারে। এখনও সময় আছে, ইচ্ছে করলেই সে সবকিছু ফিরে পেতে পারে আবার। ছেলে তার মায়ের চোখের উপর চোখ রেখে বলে, “মা, তোমার ভক্ত হয়ে কাজ নেই। তুমি মা হয়েই থাকো, তাতেই আমার চলবে। এখন থেকে আমি তোমার খামার বাড়ীতেই থেকে যাব, তোমারই কাছে”। লেভীর কথা শুনে মা, জার্জি চাচা সহ সমস্ত খামার-বাড়ীটা হো হো শব্দে হেসে উঠে- দীর্ঘ্য নিখাদ হাসি।
আপনার এ গল্পটির মত বেশ কয়েকটি গল্পের আবহ বিদেশে। ভালই তো ফুটিয়ে তুলেন সে আবহ।ভাড়দের এবং অভিনয় শিল্পীদের জীবনের বাস্তবতা ফুটে উঠেছে, তবে লেভিকে অভিনয় ছাড়িয়ে সারলেন।
@গীতা দাস,
হাজার বরণ গাভীরে তার একই বরণ দুধ—-বাহিরটা আলাদা হলেও ভিতরটা একই। কাজেই কোন অসুবিধে নেই, শুধু বাইরের খোশাটা বদলে দিলেই হলো। আর তাছাড়া প্রায় সতের বছরের বৈদেশ (খাটি দেশ প্রেমিকের চিহ্ন না এটা) থাকার অভিজ্ঞতা তো আছেই। ধন্যবাদ সময় করে গল্প পড়ার জন্যে।
কঠিন বাস্তবতা। আসলে আমরা সাধারণ মানুষেরাই সাধারণ ভাবে অসাধারণ জীবন উপভোগ করি , যা নিজেরাই টের পাই না।
@অরণ্য,
প্রকৃতি এমনই। অসীম প্রজ্ঞা লীন থাকে তার ভিতরে। আমরা সাধারন ভাবে খুব পরিচিত জিনিস ভেবে তার ভিতর দিয়ে চলাফেরা করি। আপনি খুব সুন্দর একটা জিনিস পয়েন্ট আউট করেছেন। অনেক ধন্যবাদ।
(F) (F) (Y)
@অসীম,
পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।