ঝির ঝির বৃষ্টি! ঝিম ধরানো বৃষ্টি! ঝি ঝি পোকার মতই একটানা অবিরাম বেজে চলেছে তার জলতান!
ছাতা নেই। তাই শরীরে ছাতিকেই সামলাতে হয় ক্ষুদে ক্ষুদে জলকণাদের! খরার দিন এ জায়গাটিতে রিকশার বান ডাকলেও আজকের প্লাবনে তাদের টিকিটিরও দেখা নেই! চাতক পাখির মত চেয়ে থেকেও কোন রিকশার চেহারা মিলছে না। এমন নয় যে, একটি সিএনজিতে উঠে পড়বে! রিকশার দূরত্বে কোন সিএনজি যায়? শুকনো দিন হলে না হয় হাঁটা যেত! কিন্তু ছাতিবিহীন বৃষ্টি মাথায় করে উদোম যাত্রার দিন আর আছে? নিজের অজান্তেই বয়স গুনতে শুরু করে দীপ! কিন্তু সংখ্যাটা দীপ্যমান হতেই গোনা থামিয়ে দেয়, কেমন এক চাপা আতঙ্ক গ্রাস করে দীপকে! সে নিশ্চিত, ঐ বলহ্রাসকারক সংখ্যাটা সারাদিন তাড়া করে ফিরবে তাকে!
অনেক খুঁজে পেতে অবশেষে একখনি রিকশা পাওয়া গেল! জানে, আজ রিকশাওয়ালারা গলা কাটা ভাড়া হাঁকবে! তাই আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল, ভাড়া নিয়ে কোন বাদানুবাদে যাবে না। গন্তব্যে যেতে রাজী হলেই সটান উঠে পড়বে! তবু নিতান্তই অভ্যাসবশে ভাড়ার কথা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল দীপের, ‘কত?’ ‘তিরিশ টাকায় গেলে উঠেন’ – শুনে দীপের তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা! সে কি ভুল শুনলো? শুকনো দিনেই তো তিরিশ টাকায় রাজী হতে চায় না, কমসে কম দশ-পনেরটা রিকশার সাথে বেদম দরদাম করতে হয়; আর আজ বৃষ্টির দিনের ভাড়া তিরিশ টাকা? তাও দাম নির্ধারণ হয়েছে রিকশাওয়ালার সৌজন্যে! সাপ্লাই সাইড ইকোনোমি থেকে! দীপ নিশ্চিত, ব্যাটা এ এলাকায় নতুন, না হয় একটা জাতবলদ!
যাহোক আর ভেবেচিন্তে কাজ নেই, এক লাফে রিকশায় উঠে পড়ে দীপ! জল-জ্যামের মাঝে রিকশাটি যেভাবে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল, তাতে ভুল ভাঙ্গে দীপের! নাহ, ব্যাটা আর যাই হোক, আনাড়ি নয়! তাছাড়া এলাকায় নতুনই বা বলা যায় কি করে? যেভাবে মেইন রোডের জ্যাম এড়িয়ে, অলি-গলির ফাঁক-ফোকর দিয়ে রিকশাটাকে বের করে আনল, তা কোন অপরিচিত রিকশাওয়ালার কম্ম নয়!
বৃষ্টি থেমে এসেছে কিছুটা! রিকশাটাও থামল! এখান থেকে আর দুটি রাস্তা পেরুলেই দীপের বাসা। এবং সে পথটুকু হেঁটে যাওয়ার কোন বিকল্প পথ নেই! কিন্তু মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যেয়ে দীপের চক্ষু চড়কগাছ! তিরিশটা টাকাও নেই! হাব-জাব করে রাখা খুচরা নোটগুলো কুড়িয়ে-কাড়িয়ে রিকশাওয়ালার হাতে দিয়ে বলল, ‘দেখ তো কত আছে?’ মনে মনে প্রার্থনা করছে, ভাড়ার অংকের সাথে যেন মিলে যায়!
কিন্তু বিধি বাম! বেরসিক রিকশাওয়ালা গুনে জানাল, সর্বসাকুল্যে তিন কম তিরিশ টাকা আছে, মানে ২৭ টাকা! নিজের উপর চরম রাগ ধরল দীপের! আগেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল! পকেটে অবশ্য ১০০০ টাকার বড় দুটো নোট আছে! কিন্তু তা ভাঙ্গাবে কি করে? একে তো বড় নোট! তার উপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত রয়েছে বৃষ্টি! এ অবস্থায় কারো দায় ঠেকেনি তা ভাঙ্গিয়ে দেয়ার!
সুতরাং, কিছু কিনতে হবে ভাংতি টাকা যোগাড় করতে হলে! কিন্তু কি কেনা যেতে পারে, তা অনেক ভেবেও স্থির করতে পারল না দীপ! এমনিতে কেনার জিনিসের অন্ত থাকে না মানুষের, কিন্তু যখন রিকশাওয়ালার জন্য টাকা ভাঙ্গানোর উদ্দেশ্য কিছু কেনার চিন্তা করতে হয়, তখন কেনার মত কিছু সত্যই পাওয়া যায় না!
‘স্যার, লাগবো না,যান গা’- রিকশাওয়ালার কথায় দীপের হুশ ফিরে! এই রিকশাওয়ালাটিকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে! অন্য কেউ হলে এত কমে আসত না, এমনকি ভাড়ার এক পয়সা কম নিতে রাজী হতো না। বরং দেরী করিয়ে দেয়ার জন্য হয়ত কিছু লম্বা-চওড়া কথাই শুনিয়ে দিত!
”না, না, দাঁড়াও, আমি তোমাকে ভাঙ্গিয়ে দিচ্ছি, আমার কাছে বড় নোট আছে!”-দীপ রিকশাওয়ালাকে লক্ষ্য করে বলে।
”কইতেছি না স্যার, লাগবো না,, তিন টাকার লাইগা কিছু হইবো না, আপ্নে যান তো”-এই বলে রিকশাওয়ালা অনেকটা জোর করেই নামিয়ে দেয় দীপকে!
দীপ আফসোস করতে থাকে! নিজের বেখেয়ালের জন্য বেচারা গরীব রিকশাওয়ালার পুরো ভাড়াটা দিতে পারল না! হোক না তিনটে টাকা! কিন্তু ঐ গরীব লোকটির কাছে তিন টাকার একটা মূল্য আছে! এদিকে সামনের সড়কে মহাব্যস্ততা! অনেক চেষ্টা করেও পার হওয়া যাচ্ছে না। একটার পর একটা ভারী যান আসছে, যাচ্ছে! হঠাৎ কি মনে করে পেছনে তাকাল দীপ! তাকাতেই বেচারা রিকশাওয়ালাকে চোখে পড়ল! সে এখনো নতুন কোন প্যাসেঞ্জার পায়নি!
হঠাৎই দীপের মাথায় ঝোঁক চাপে! ঐ তো সামান্য দূরেই দেখা যাচ্ছে একটা ঔষধের দোকান! দীপের মাঝে মধ্যেই কন্সটিপেশনের প্রবলেম হয়! সিদ্ধান্ত নিল, একটা এভোলাক কিনে ফেলবে আপৎকালিন সময়ের জন্য!
দেরি না করে দীপ দৌড় দিল দোকানটির দিকে! সংকীর্ণ রাস্তার জল-কাদা-যান এড়িয়ে অবশেষে পৌঁছতে পারল সেখানে। কিন্তু এই বৃষ্টিতেও ওখানে খদ্দেরের অভাব নেই। ঔষধের দোকানের খদ্দেরের অবশ্য ঝড়-বৃষ্টি-প্লাবন মানার কথাও না! কিন্তু ভিড় দেখে দীপের হার্টবিট বেড়ে যায়! যে রিকশাওয়ালার জন্য এখানে আসা, তাকে যদি না পাওয়া যায়! সে যদি ততক্ষণে নতুন প্যাসেঞ্জার জুটিয়ে ফেলে!
অবশেষে তিনজন খদ্দের বিদায় নিলে, দীপের অর্ডার শোনার সময় হয় বিক্রেতার। ঔষধের দাম দেয়ার সময় দশ টাকার কিছু খুচরা নোট দেয়ার জন্য বিক্রেতাকে বলে দিল দীপ! কিন্তু বিক্রেতার খুচরা খোঁজার সময় আবার টেনশান ভর করে দীপের মাঝে, হার্টবিট দ্রুততর হতে থাকে! অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে নির্বিকার মুখে বিক্রেতা ঘোষনা করল, তার কাছে সর্বনিম্ন ৫০ টাকার খুচরা নোট রয়েছে! ওহ! আজকের দিনটা কি মোটেই ভাল যাব না? সামান্য ভাংতিও পর্যন্ত মিলছে না!
নিরুপায় দীপ ঐ টাকা নিয়েই পড়িমরি করে ছুটে রিকশাস্থলের দিকে! ভিতরে তীব্র টেনশান হচ্ছে! যদি তাকে না পাওয়া যায়! যদি ইতিমধ্যে চলে গিয়ে থাকে! কিন্তু না, দীপের সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রিকশাওয়ালা তার জায়গামতই অবস্থান করছিল। দেরী না করে পঞ্চাশ টাকার নোটটা রিকশাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে ধরে, ’বাকী টাকা ফেরত দাও’।
‘স্যার, আপ্নে তো আজব মানুষ, আবার টাকা নিয়া আইছেন!’- এই বলে টাকা ফেরত দিতে গিয়ে এবার রিকশাওয়ালা পড়ল খুচরার বিপাকে! সে দীপের কাছে পায় তিন টাকা, কিন্তু তাকে ফেরত দিতে হবে ৪৭ টাকা! অথচ দীপের আগের দেয়া ২৭ টাকার সাথে তার কাছে খুচরা আছে আর ১৫ টাকা, মানে ৪২ টাকা! দীপ বলল, ‘ঠিক আছে, ৪২ টাকাই দাও!’
রিকশাটি ইতিমধ্যে চলে গেছে। দীপ তখনো দাড়িয়ে আছে রাস্তা পার হবে বলে! আগের মতই রাস্তায় ভয়াবহ গাড়ির চাপ, কোন সুযোগ দিচ্ছে না দুপাশের দু’পেয়েদের রাস্তা অতিক্রম করার! কিন্তু দীপ তেমন বিরক্ত হচ্ছে না! বৃষ্টি শেষের হিমেল বাতাস শিহরনের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে গায়ে!
অদ্ভুত এক ভাল লাগা কাজ করছে দীপের মধ্যে! রিকশওয়ালাকে কম টাকা নিয়ে বিদায় নিতে হয়নি, উল্টো সেই তাকে অতিরিক্ত ৫টা টাকা দিয়ে দিয়েছে! তৃপ্তির ঢেকুর তোলে দীপ! মানুষের মহত্বের এক নতুন পাঠ লাভ করেছে সে আজ! একজন গরীব খেটে-খাওয়া রিকশাওয়ালা! অথচ কি অসাধারণ মানবিক গুণাবলী! হৃদয়টা কি বিশাল! এই লোকগুলোর জন্য যদি কিছু করা যেত! যদি তাদের ভাগ্য উন্নয়নে কিছু করতে পারত সে!
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই অন্তরটা খচ করে উঠে দীপের! কি মারাত্মক আহাম্মকি করেছে সে? আহাম্মকির চেয়ে ইতরামি বলাই ভাল! রিকশাওয়ালাকে আস্ত ৫০ টাকার নোটটা দিয়ে দিলেই তো হত! সে আবার ছোটলোকের মত তার কাছে আগে দেয়া টাকা ফেরত চেয়েছে! হঠাৎই স্বস্তির অনুভূতিটুকু কেড়ে নেয় অস্থিরতা, প্রথমে নিজের উপরই চরম বিরক্তি, পরে বিরক্তি থেকে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয় দীপ!
এর ভিতরই এক সময় কিছু চার’পেয়ের বদান্যতায় রাস্তা পার হতে পারে দীপ! হেঁটে হেঁটে অপর প্রান্তের ফুটপাতে উঠে পড়ে সে। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই পড়ে যায় নতুন এক বিপাকে! ফুটপাতের একটা জায়গায় বাক্স-পেটরা গোছাচ্ছে অস্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়া এক হকার! সে ফুটপাতের পুরো প্রস্থ জুড়েই অবস্থান করছিল, শুধু বামদিকে সামান্য কয়েক ইঞ্চি চিপা জায়গা রেখে! হকারটিকে বিরক্ত না করে রাস্তায় যে নেমে যাবে, তারও উপায় নেই! সেখানে ওয়াসার মস্ত মস্ত কীর্তি, বড় বড় খাদ, জল-কাদার বড় বড় ডোবা!
অগত্যা দীপ হকারটিকে একটু সরে দাঁড়াতে বলে। হকারটির তড়িৎ জবাব, ‘’বাম পাশ দিয়া যান!’’ বাম পাশ মানে ঐ কয়েক ইঞ্চির চিপা! সেইখানে পুরো শরীরটা কি করে ঢোকাবে ভেবে পায় না দীপ, তবু কথা বাড়ায় না। অভিজ্ঞতা বলে, এসব ক্ষেত্রে তর্ক করে কোন লাভ হয় না, বরং গোলযোগ বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে! আর তাছাড়া এই বিশাল শহরের এই এক চিলতে ফুটপাত হকারটি তার নিজের জায়গীর বলেই জানে, আর তা ভোগও করে অনেকটা জমিদারি স্টাইলে! সরকার মাঝে মাঝে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করতে চায় বটে, কিন্তু রাজস্ব হারানোর ভয়ে আবার নিজেই পিছিয়ে যায়!
উপান্তর না দেখে দীপ হকারের কথামত চিপার গহিনে শরীরটাকে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করে! কিন্তু শরীর সামান্য গলিয়ে দিতেই প্যাচ প্যাচ পচা কাদায় পা আটকে যায় দীপের!
পরে অনেক কষ্টে পা’টাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে দীপ ঐ হকারটির প্রতি বিনীত অনূর্ধ্ব পুর্নব্যক্ত করে, দয়া করে জায়গীরটা একটু ছেড়ে দাঁড়ানোর জন্য! এবার কিন্তু হকার আর মুখ ফুটে কোন কথা বলার প্রয়োজন মনে করে না, বরং নির্বিকার, নিরুত্তাপ চিত্তে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে থাকে! লোকটা হয়ত ভাবছে, দীপকে পথ ছাড়লে, আরও অনেককেই এভাবেই ছেড়ে দিতে হবে! তখন তার আর পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়ি ফেরা হবে না! এই বৃষ্টির মাঝে সেই ঝুঁকি নিতে লোকটি একটুও রাজী নয়!
অন্য অনেকে হলে হয়ত হকারটির উপর চড়াও হত! সেক্ষেত্রে নিশ্চিত একটা সিনেমা তৈরি হত, আর তা দেখার জন্য লোকারণ্য হত চারপাশ, এমনকি এই ঝড়বৃষ্টির দিনেও! দীপ সিনেমা প্রচুর দেখলেও নিজেকে সিনেমার চরিত্ররূপে কখনো দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করে না! তাই সে আর ঘাঁটাতে গেল না হকারটিকে, বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুটপাতদারের আস্তানা গোটানোর প্রতীক্ষা করতে লাগল!
আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে! ফোটাগুলো ক্রমেই ছোট থেকে বড় হচ্ছে! এদিকে দীপ ঐ কয়েক প্রস্থ জমিদারিটি কিছুক্ষণ আগে পেরুতে সক্ষম হয়েছে। তবে তার জন্য পাকা দশ মিনিট ঠায় দাড়িয়ে থাকতে হয়েছে! কিন্তু ফুটপাত-দারের হাত থেকে মুক্তি মিললেও প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে। বরং বুকটাতে কে যেন একটা ভারি পাথর বেঁধে রেখেছে!
ঝির ঝির বৃষ্টি! ওয়াসার তৈরি খাদগুলো জল-কাদায় টইটুম্বুর হয়ে উঠছে! দীপের চোখ-মুখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে! পানির তোড়ে এমনকি ভাল করে পথও দেখতেও পাচ্ছে না! দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ! সামান্য পথ পেরুলেই বাসা! অথচ আশেপাশের সবকিছুই অচেনা লাগছে দীপের! কেমন যেন এক রহস্যপুরীর মত লাগছে সবকিছু!
নির্ঘাত দৃষ্টিভ্রম! প্রাণপণে হাঁটতে থাকে দীপ! যেকোন অঘটন ঘটনার আগেই বাড়ি পৌঁছুতে হবে!
ঢাকা শহরের দারিদ্রপীড়িত এইসব রিকসাওয়ালাদের কাছে বিরক্তিকর ব্যবহার, বেশী ভাড়া চাওয়া… এমন ঘটনা অনেক দেখেছি, কিন্তু এর ব্যতিক্রমটাও একেবারে কম দেখিনি আমি। আপনার লেখা গল্পটা তাই খুব চেনা একটা ছবি মনে হয়েছিল আমার কাছে, সেইসাথে সুন্দর। আমি যখন কলেজে পড়তাম, আমাদের পাড়ার এক রিকশাওয়ালা, রোজ সকালে আমার কলেজ যাবার সময় বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো, আমি কোনদিন খেয়াল করিনি, আমি যে রোজ একই রিকশায় করে কলেজে যাই। একদিন যখন তিনি বলেছিলেন কই যাইবেন জানি আমি, আপ্নে উঠেন। আমি অবাক হয়ে সেদিন প্রথম জেনেছিলাম, দীর্ঘদিন ধরে আমি এক রিকশায় যাই। হতে পারে আমি কনফার্ম কাস্টমার ছিলাম, কিন্তু ঐ সকালবেলা আমি ছাড়াও অনেক যাত্রী তার পাওয়ার কথা ছিল। কোনদিন তাকে দেখিনি বেশী ভাড়া চাইতে আমার কাছে। আরেকবার, যেদিন আমার এইচএসসির রেজাল্ট হয়, রেজাল্ট দেখে আমি খুশিতে আম্মুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। একটু পর যে রিকশয়ায় উঠেছিলাম, সেই রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করেছিল, ভালা রেজাল্ট করছেন তাই না? বড় হন আপনে। তার পর বলতে লাগলো, তার ছেলেকে বড় করার কথা। আমি অবাক হয়ে শুনলাম, তিনি তার ছেলেকে রিকশা চালিয়ে পড়াচ্ছেন ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলে। এইরকম অনেক গল্প আমি দেখেছি, আপনি যেমন গল্পটা লিখেছেন, এমন মানুষও দেখেছি।
ভালো লেগেছে আপনার গল্প। 🙂
@নীল রোদ্দুর,
কিছুদিন আগে এক ব্লগবিতর্কে শুনতে হয়েছিল, নিম্নবিত্ত অভাবি মানুষের মানবিকতা থাকতে নেই, বা থাকলেও তার একটা লিমিট আছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, মানবিকতা খুব স্বভাবজাত একটি বিষয়, এখানে নিম্নবিত্ত-উচ্চবিত্ত ব্যাপারটি তেমন গুরুত্বপূর্ন নয়। নিম্নবিত্ত মানুষও অসাধারন মানবিকবোধের পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারে (গল্পের বা আপনার বর্নিত রিকশাওয়ালা), আবার অমানবিকও হতে পারে (যেমন, গল্পের হকার), যাকে আমি ‘মনবিক’ বলতে চেয়েছি। আর এই মানবিক বা মনবিক আচরন- দুটোই খুব স্বভাবজাত বা সহজাত, রিকশাওয়ালা বা হকারের দৃষ্টিকোন থেকে! এখানে যুক্তি-তত্ত্ব খোঁজ করতে গেলে তল খুঁজে নাও পাওয়া যেতে পারে! অন্যদিকে দেখুন দীপকে, টিপিকাল মধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ, চিরকেলের দোদুল্যমনতা যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত! রিকশাওয়ালার অস্বাভাবাবিক মানবিকতা তার ভিতরে অসম্ভব টানাপড়েন তৈরি করে, পাল্টা মানবিকতা প্রদর্শনের তাড়নায় ভুগতে থাকে! অন্যদিকে, হকারের আচরনও তার ভিতর চরম প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, সমানভাবে দগ্ধ হয় সে, ভিন্নধরনের এক টানাপড়েনে!
আপনার অসাধারণ মন্তব্য আমাকে আরও ভাল লিখতে উৎসাহিত করবে! অনেক অনেক ধন্যবাদ!
খুব সাধারণ ঘটনা নিয়ে লিখে ভালো কাজ করেছেন।গতিশীল লেখা।
দীপ কিন্তু ভাংতি নেই আবিস্কারের সময়টাতেই অতি সামান্য একটু ভাবনা খরচ করে রিক্সাওয়ালাকে খুশী করতে পারতো। একটু এগিয়ে ফার্মেসি থেকে টাকা ভাঙ্গিয়ে, নিজ দোরগোড়ায় ফিরে বকশিস সহ ভালো কাজটা করতে পারতো। করেনি; বোঝাই যাচ্ছে; অভ্যেস নেই। দীপ আপোষকামী, নির্বিবাদী, আত্নকেন্দ্রিক, খামোখা টাইপ আরো অনেকের মতই। ভালো মন নিয়ে ভালো কাজটি করতে হলে ওটি বার বার করতে হয়। অন্যদিকে, রিক্সাওয়ালাই আসল ভালো মানুষ। ভালো কাজগুলো অনায়াসে করেছে। রিক্সাওয়ালার কাছ থেকেই শেখার আছে, দীপের কাছ থেকে নয়। 🙂
@কাজী রহমান,
একদম সত্যি কথা! দীপের বেড়ে উঠা টিপিকাল মধ্যবিত্ত পরিবারে, দোদুল্যমানতা যেখানে আবশ্যিক এক অনুষঙ্গ! দীপদের কোন সুনির্দিষ্ট চরিত্র নেই, আছে শুধু টানাপোড়েন! দীপের মানবিকতার গল্প নয় এটা, বরং রিকশাওয়ালার স্বভাবজাত মানবিকতা দীপের ভিতর যে মানবিকতার টানাপোড়েন তৈরি করে, সেই গল্পই দেখানোর ইচ্ছা ছিল, রহমান ভাই! পাশাপাশি হকারেরও স্বভাবজাত অমানবিকতাও তাকে চরমভাবে হতাশ করে, তৈরি করে ভিন্নধর্মী আরেক টানাপোড়েন! গল্পে অনেক কিছু লিখতে চাই, কিন্তু যে আকর্ষনীয় ভাষার জোরে গল্প আকর্ষনীয় হয়ে উঠে, তা রপ্ত করতে এখনো বহুদূর যেতে হবে! আপনার আশির্বাদ এভাবে বর্ষিত হতে থাকলে একদিন হয়ত রপ্ত করতে পারব!
লেখাটা ভাল লেগেছে তাই এক দমে পড়ে ফেললাম। আমার মনে হয় এধরনের মানবিক-অমানবিক ঘটনা সবার জীবনেই প্রতিনিয়ত কম-বেশি ঘটছে। কারো কাছ থেকে একটু ভাল ব্যবহার যেমন মানসিক উৎকর্ষতার চরম রসবোধে ভরিয়ে দেয়, তেমন কারো খারাপ আচারনে এই চেনা মানুষগুলোকে অচেনা মনে হয়, সুন্দর পৃথিবীটাকে মনে হয় একটা নোংরা ডাস্টবিন, নিজেকে কীটপতঙ্গ থেকেও হীন মনে হয়। শুধু এই বোধটুকু অনুভব করে আমার চারপাশে প্রতিদিন দেখা হওয়া চেনা অচেনা মানুষগুলোর সাথে একটু ভাল ব্যবহার, একটু ভাল আচরণ, একটু মানবতার হাত বাড়িয়ে দেই তাহলে হয়তো আমাদের চারপাশের পৃথিবীটাই পাল্টে যাবে, হয়তো অন্ধকারে পতিত হওয়া একটা মুখ আলোর দিকে ধাবিত হবে অথবা একটা আলোকিত শিখা অন্ধকারে হারিয়ে যাবেনা। সবশেষে ভূপেন হাজারিকার শতাব্দী সেরা বাংলা গানের অন্তরাটুকু মনে পড়ে গেল-
@জিল্লুর রহমান,
গল্পটির সারমর্ম! স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এত সুন্দর করে আমিও প্রকাশ করতে পারতাম না!
অথচ এই বোধ কারো কারো কাছে নিতান্তই অন্যায় বোধ বলে প্রতীয়মান হতে পারে!!! তাদের কাছে, দরিদ্রদের জন্য মানবিকতা একটা বিলাসিতা! আর এই অর্বাচীন ব্লগারের জন্য এমন বোধ প্রকাশ করা, মানবিকতাকে বিক্রি করে খাওয়ারই শামিল! দরিদ্র মানুষের নাকি মানবিকতা নিয়ে ভাবার সময় নেই, দায় নেই! কিন্তু আমি দেখেছি, একটা লোক-ভর্তি লোকাল বাসের প্যাসেঞ্জারদের একটি নন স্টপেজে বাস থামাবার জন্য ড্রাইভারকে চাপ দিতে, উদ্দেশ্য- বৃষ্টিতে ভেজা কিছু লোককে বাসে তুলে নেয়া, যারা ঐ বাসে উঠতে চাইছিল!
এই গল্পটি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই নেয়া, যদিও ভাষার দৌর্বল্যে ভাল লেখা হয়ে উঠতে পারেনি তেমন! তবে যে বার্তাটি দেয়ার ইচ্ছে ছিল, তা আপনার মন্তব্যে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে! একজন খেটে খাওয়া রিকশাওয়ালা, গলদঘর্ম হয়ে যাকে প্রায়শই মহাজনের রিকশা টেনে যেতে হয়ে, তারও মানবিকতা আছে, যা মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি দীপকে মানবিকতার অসম্ভব টানাপড়েনে ফেলে! পাশাপাশি, রয়েছে ফুটপাত দখলকারী হকার, যার দখলি মনোবৃত্তি তার আচরণেও প্রভাব ফেলে, মানবিকতার দায় থেকে তাকে রেহাই দেয় অনেক ব্লগারের থিউরিকে সত্য প্রমাণ করে!
আপনার এমন বিশ্লেষণী মন্তব্য আমার জন্য বিরাট প্রাপ্তি! আপনার উদ্ধৃত গানটি আমার সব সময়ের প্রিয় একটি গান! ভাল থাকবেন!
অসাধারন একটা খণ্ড চিত্র দেখলাম জীবনের। খুব ভাল লেগেছে।
কেমন জানি একটা উদাসীনতা কাজ করছে। (O)
@অনিরুদ্ধ দে পিয়াস,
অনেক ধন্যবাদ, ভাইয়া! সম্প্রতি এক ব্লগ বিতর্কে ধারণা দেয়া হয়েছিল, দরিদ্র মানুষের মানবিকতা থাকতে নেই, মানবিক হওয়ার কোন দায় নেই তাদের! কিন্তু আমি দেখেছি, অনেক ধনী লোকের বিশাল ঘর-বাড়িতে জায়গা হয় না যে ঘরহারা লোকটির, সেই কিন্তু আশ্রয় পায় একজন নিম্নবিত্ত মানুষের আটোসাটো ঘরে, সেখানে গাদাগাদি করে থাকতে হয় বটে, কিনু দরিদ্র আশ্রয়দাতা ও আশ্রিতের তাতে কোন সমস্যাই হয় না।
ভাল থাকবেন! (F)
দীপ আর রিকশাচালকের মধ্যকার গল্পটি ভাল লেগেছে। ইস পৃথিবীর সব মানুষ যদি এমন হত!কিন্তু বাস্তবতা ত বিপরীত। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই অন্যকে ঠকিয়ে সুখ পায়।
তিন কম তিরিশ টাকা হবেনা!
@তামান্না ঝুমু,
ভুলটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ! ঠিক করে দিচ্ছি!
পৃথিবীর সব লোক এমন হলে গল্প লিখতুম কি করে, আপু? 🙂
আপনাদের অন্তহীণ উৎসাহ সত্বেও ভাল লিখতে পারছি না! ভাষাটা কিছুতেই আকর্ষনীয় করতে পারছি না! আমি অনেক গল্প পড়েছি, বিখ্যাত লেখকদের, বিখ্যাত ব্লগারদের! তাই জানি, ভাষার মাধুর্্য কি করে একটা লেখাটা অসামান্য করতে পারে!
ভাল থাকবেন, আপু! (F)
পড়লাম। জীবন বোধের সমীকরণ কখনো কখনো জটিল অবয়ব হয়েই দেখা দেয়।
@তাপসদা,
ছাইপাশ যাই লিখি না কেন, আপনি পাশে এসে দাঁড়ান! জানি আপনি থাকতেন এমনকি অন্য কোথাও ছাপা হলে! আমি আবেগাপ্লুত! তাই আর কিছু বলতে পারছি না! লেখাটায় বোধের দ্বন্দ্ব তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি বাস্তব ঘটনার আলোকে। লেখার গঠন মোটেই ভাল হয়নি, কিন্তু তারপরও আপনার উৎসাহ এখানেও উপস্থিত!
ভাল থাকবেন, তাপসদা! আর আপনাকে মুক্তমনায় নিয়মিত চাই! পাঠকের দাবী!