ঝির ঝির বৃষ্টি! ঝিম ধরানো বৃষ্টি! ঝি ঝি পোকার মতই একটানা অবিরাম বেজে চলেছে তার জলতান!

ছাতা নেই। তাই শরীরে ছাতিকেই সামলাতে হয় ক্ষুদে ক্ষুদে জলকণাদের! খরার দিন এ জায়গাটিতে রিকশার বান ডাকলেও আজকের প্লাবনে তাদের টিকিটিরও দেখা নেই! চাতক পাখির মত চেয়ে থেকেও কোন রিকশার চেহারা মিলছে না। এমন নয় যে, একটি সিএনজিতে উঠে পড়বে! রিকশার দূরত্বে কোন সিএনজি যায়? শুকনো দিন হলে না হয় হাঁটা যেত! কিন্তু ছাতিবিহীন বৃষ্টি মাথায় করে উদোম যাত্রার দিন আর আছে? নিজের অজান্তেই বয়স গুনতে শুরু করে দীপ! কিন্তু সংখ্যাটা দীপ্যমান হতেই গোনা থামিয়ে দেয়, কেমন এক চাপা আতঙ্ক গ্রাস করে দীপকে! সে নিশ্চিত, ঐ বলহ্রাসকারক সংখ্যাটা সারাদিন তাড়া করে ফিরবে তাকে!

অনেক খুঁজে পেতে অবশেষে একখনি রিকশা পাওয়া গেল! জানে, আজ রিকশাওয়ালারা গলা কাটা ভাড়া হাঁকবে! তাই আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল, ভাড়া নিয়ে কোন বাদানুবাদে যাবে না। গন্তব্যে যেতে রাজী হলেই সটান উঠে পড়বে! তবু নিতান্তই অভ্যাসবশে ভাড়ার কথা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল দীপের, ‘কত?’ ‘তিরিশ টাকায় গেলে উঠেন’ – শুনে দীপের তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা! সে কি ভুল শুনলো? শুকনো দিনেই তো তিরিশ টাকায় রাজী হতে চায় না, কমসে কম দশ-পনেরটা রিকশার সাথে বেদম দরদাম করতে হয়; আর আজ বৃষ্টির দিনের ভাড়া তিরিশ টাকা? তাও দাম নির্ধারণ হয়েছে রিকশাওয়ালার সৌজন্যে! সাপ্লাই সাইড ইকোনোমি থেকে! দীপ নিশ্চিত, ব্যাটা এ এলাকায় নতুন, না হয় একটা জাতবলদ!

যাহোক আর ভেবেচিন্তে কাজ নেই, এক লাফে রিকশায় উঠে পড়ে দীপ! জল-জ্যামের মাঝে রিকশাটি যেভাবে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল, তাতে ভুল ভাঙ্গে দীপের! নাহ, ব্যাটা আর যাই হোক, আনাড়ি নয়! তাছাড়া এলাকায় নতুনই বা বলা যায় কি করে? যেভাবে মেইন রোডের জ্যাম এড়িয়ে, অলি-গলির ফাঁক-ফোকর দিয়ে রিকশাটাকে বের করে আনল, তা কোন অপরিচিত রিকশাওয়ালার কম্ম নয়!

বৃষ্টি থেমে এসেছে কিছুটা! রিকশাটাও থামল! এখান থেকে আর দুটি রাস্তা পেরুলেই দীপের বাসা। এবং সে পথটুকু হেঁটে যাওয়ার কোন বিকল্প পথ নেই! কিন্তু মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যেয়ে দীপের চক্ষু চড়কগাছ! তিরিশটা টাকাও নেই! হাব-জাব করে রাখা খুচরা নোটগুলো কুড়িয়ে-কাড়িয়ে রিকশাওয়ালার হাতে দিয়ে বলল, ‘দেখ তো কত আছে?’ মনে মনে প্রার্থনা করছে, ভাড়ার অংকের সাথে যেন মিলে যায়!

কিন্তু বিধি বাম! বেরসিক রিকশাওয়ালা গুনে জানাল, সর্বসাকুল্যে তিন কম তিরিশ টাকা আছে, মানে ২৭ টাকা! নিজের উপর চরম রাগ ধরল দীপের! আগেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল! পকেটে অবশ্য ১০০০ টাকার বড় দুটো নোট আছে! কিন্তু তা ভাঙ্গাবে কি করে? একে তো বড় নোট! তার উপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত রয়েছে বৃষ্টি! এ অবস্থায় কারো দায় ঠেকেনি তা ভাঙ্গিয়ে দেয়ার!

সুতরাং, কিছু কিনতে হবে ভাংতি টাকা যোগাড় করতে হলে! কিন্তু কি কেনা যেতে পারে, তা অনেক ভেবেও স্থির করতে পারল না দীপ! এমনিতে কেনার জিনিসের অন্ত থাকে না মানুষের, কিন্তু যখন রিকশাওয়ালার জন্য টাকা ভাঙ্গানোর উদ্দেশ্য কিছু কেনার চিন্তা করতে হয়, তখন কেনার মত কিছু সত্যই পাওয়া যায় না!

‘স্যার, লাগবো না,যান গা’- রিকশাওয়ালার কথায় দীপের হুশ ফিরে! এই রিকশাওয়ালাটিকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে! অন্য কেউ হলে এত কমে আসত না, এমনকি ভাড়ার এক পয়সা কম নিতে রাজী হতো না। বরং দেরী করিয়ে দেয়ার জন্য হয়ত কিছু লম্বা-চওড়া কথাই শুনিয়ে দিত!
”না, না, দাঁড়াও, আমি তোমাকে ভাঙ্গিয়ে দিচ্ছি, আমার কাছে বড় নোট আছে!”-দীপ রিকশাওয়ালাকে লক্ষ্য করে বলে।
”কইতেছি না স্যার, লাগবো না,, তিন টাকার লাইগা কিছু হইবো না, আপ্নে যান তো”-এই বলে রিকশাওয়ালা অনেকটা জোর করেই নামিয়ে দেয় দীপকে!

দীপ আফসোস করতে থাকে! নিজের বেখেয়ালের জন্য বেচারা গরীব রিকশাওয়ালার পুরো ভাড়াটা দিতে পারল না! হোক না তিনটে টাকা! কিন্তু ঐ গরীব লোকটির কাছে তিন টাকার একটা মূল্য আছে! এদিকে সামনের সড়কে মহাব্যস্ততা! অনেক চেষ্টা করেও পার হওয়া যাচ্ছে না। একটার পর একটা ভারী যান আসছে, যাচ্ছে! হঠাৎ কি মনে করে পেছনে তাকাল দীপ! তাকাতেই বেচারা রিকশাওয়ালাকে চোখে পড়ল! সে এখনো নতুন কোন প্যাসেঞ্জার পায়নি!

হঠাৎই দীপের মাথায় ঝোঁক চাপে! ঐ তো সামান্য দূরেই দেখা যাচ্ছে একটা ঔষধের দোকান! দীপের মাঝে মধ্যেই কন্সটিপেশনের প্রবলেম হয়! সিদ্ধান্ত নিল, একটা এভোলাক কিনে ফেলবে আপৎকালিন সময়ের জন্য!
দেরি না করে দীপ দৌড় দিল দোকানটির দিকে! সংকীর্ণ রাস্তার জল-কাদা-যান এড়িয়ে অবশেষে পৌঁছতে পারল সেখানে। কিন্তু এই বৃষ্টিতেও ওখানে খদ্দেরের অভাব নেই। ঔষধের দোকানের খদ্দেরের অবশ্য ঝড়-বৃষ্টি-প্লাবন মানার কথাও না! কিন্তু ভিড় দেখে দীপের হার্টবিট বেড়ে যায়! যে রিকশাওয়ালার জন্য এখানে আসা, তাকে যদি না পাওয়া যায়! সে যদি ততক্ষণে নতুন প্যাসেঞ্জার জুটিয়ে ফেলে!

অবশেষে তিনজন খদ্দের বিদায় নিলে, দীপের অর্ডার শোনার সময় হয় বিক্রেতার। ঔষধের দাম দেয়ার সময় দশ টাকার কিছু খুচরা নোট দেয়ার জন্য বিক্রেতাকে বলে দিল দীপ! কিন্তু বিক্রেতার খুচরা খোঁজার সময় আবার টেনশান ভর করে দীপের মাঝে, হার্টবিট দ্রুততর হতে থাকে! অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে নির্বিকার মুখে বিক্রেতা ঘোষনা করল, তার কাছে সর্বনিম্ন ৫০ টাকার খুচরা নোট রয়েছে! ওহ! আজকের দিনটা কি মোটেই ভাল যাব না? সামান্য ভাংতিও পর্যন্ত মিলছে না!

নিরুপায় দীপ ঐ টাকা নিয়েই পড়িমরি করে ছুটে রিকশাস্থলের দিকে! ভিতরে তীব্র টেনশান হচ্ছে! যদি তাকে না পাওয়া যায়! যদি ইতিমধ্যে চলে গিয়ে থাকে! কিন্তু না, দীপের সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রিকশাওয়ালা তার জায়গামতই অবস্থান করছিল। দেরী না করে পঞ্চাশ টাকার নোটটা রিকশাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে ধরে, ’বাকী টাকা ফেরত দাও’।

‘স্যার, আপ্নে তো আজব মানুষ, আবার টাকা নিয়া আইছেন!’- এই বলে টাকা ফেরত দিতে গিয়ে এবার রিকশাওয়ালা পড়ল খুচরার বিপাকে! সে দীপের কাছে পায় তিন টাকা, কিন্তু তাকে ফেরত দিতে হবে ৪৭ টাকা! অথচ দীপের আগের দেয়া ২৭ টাকার সাথে তার কাছে খুচরা আছে আর ১৫ টাকা, মানে ৪২ টাকা! দীপ বলল, ‘ঠিক আছে, ৪২ টাকাই দাও!’

রিকশাটি ইতিমধ্যে চলে গেছে। দীপ তখনো দাড়িয়ে আছে রাস্তা পার হবে বলে! আগের মতই রাস্তায় ভয়াবহ গাড়ির চাপ, কোন সুযোগ দিচ্ছে না দুপাশের দু’পেয়েদের রাস্তা অতিক্রম করার! কিন্তু দীপ তেমন বিরক্ত হচ্ছে না! বৃষ্টি শেষের হিমেল বাতাস শিহরনের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে গায়ে!

অদ্ভুত এক ভাল লাগা কাজ করছে দীপের মধ্যে! রিকশওয়ালাকে কম টাকা নিয়ে বিদায় নিতে হয়নি, উল্টো সেই তাকে অতিরিক্ত ৫টা টাকা দিয়ে দিয়েছে! তৃপ্তির ঢেকুর তোলে দীপ! মানুষের মহত্বের এক নতুন পাঠ লাভ করেছে সে আজ! একজন গরীব খেটে-খাওয়া রিকশাওয়ালা! অথচ কি অসাধারণ মানবিক গুণাবলী! হৃদয়টা কি বিশাল! এই লোকগুলোর জন্য যদি কিছু করা যেত! যদি তাদের ভাগ্য উন্নয়নে কিছু করতে পারত সে!

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই অন্তরটা খচ করে উঠে দীপের! কি মারাত্মক আহাম্মকি করেছে সে? আহাম্মকির চেয়ে ইতরামি বলাই ভাল! রিকশাওয়ালাকে আস্ত ৫০ টাকার নোটটা দিয়ে দিলেই তো হত! সে আবার ছোটলোকের মত তার কাছে আগে দেয়া টাকা ফেরত চেয়েছে! হঠাৎই স্বস্তির অনুভূতিটুকু কেড়ে নেয় অস্থিরতা, প্রথমে নিজের উপরই চরম বিরক্তি, পরে বিরক্তি থেকে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয় দীপ!

এর ভিতরই এক সময় কিছু চার’পেয়ের বদান্যতায় রাস্তা পার হতে পারে দীপ! হেঁটে হেঁটে অপর প্রান্তের ফুটপাতে উঠে পড়ে সে। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই পড়ে যায় নতুন এক বিপাকে! ফুটপাতের একটা জায়গায় বাক্স-পেটরা গোছাচ্ছে অস্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়া এক হকার! সে ফুটপাতের পুরো প্রস্থ জুড়েই অবস্থান করছিল, শুধু বামদিকে সামান্য কয়েক ইঞ্চি চিপা জায়গা রেখে! হকারটিকে বিরক্ত না করে রাস্তায় যে নেমে যাবে, তারও উপায় নেই! সেখানে ওয়াসার মস্ত মস্ত কীর্তি, বড় বড় খাদ, জল-কাদার বড় বড় ডোবা!

অগত্যা দীপ হকারটিকে একটু সরে দাঁড়াতে বলে। হকারটির তড়িৎ জবাব, ‘’বাম পাশ দিয়া যান!’’ বাম পাশ মানে ঐ কয়েক ইঞ্চির চিপা! সেইখানে পুরো শরীরটা কি করে ঢোকাবে ভেবে পায় না দীপ, তবু কথা বাড়ায় না। অভিজ্ঞতা বলে, এসব ক্ষেত্রে তর্ক করে কোন লাভ হয় না, বরং গোলযোগ বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে! আর তাছাড়া এই বিশাল শহরের এই এক চিলতে ফুটপাত হকারটি তার নিজের জায়গীর বলেই জানে, আর তা ভোগও করে অনেকটা জমিদারি স্টাইলে! সরকার মাঝে মাঝে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করতে চায় বটে, কিন্তু রাজস্ব হারানোর ভয়ে আবার নিজেই পিছিয়ে যায়!

উপান্তর না দেখে দীপ হকারের কথামত চিপার গহিনে শরীরটাকে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করে! কিন্তু শরীর সামান্য গলিয়ে দিতেই প্যাচ প্যাচ পচা কাদায় পা আটকে যায় দীপের!

পরে অনেক কষ্টে পা’টাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে দীপ ঐ হকারটির প্রতি বিনীত অনূর্ধ্ব পুর্নব্যক্ত করে, দয়া করে জায়গীরটা একটু ছেড়ে দাঁড়ানোর জন্য! এবার কিন্তু হকার আর মুখ ফুটে কোন কথা বলার প্রয়োজন মনে করে না, বরং নির্বিকার, নিরুত্তাপ চিত্তে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে থাকে! লোকটা হয়ত ভাবছে, দীপকে পথ ছাড়লে, আরও অনেককেই এভাবেই ছেড়ে দিতে হবে! তখন তার আর পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়ি ফেরা হবে না! এই বৃষ্টির মাঝে সেই ঝুঁকি নিতে লোকটি একটুও রাজী নয়!

অন্য অনেকে হলে হয়ত হকারটির উপর চড়াও হত! সেক্ষেত্রে নিশ্চিত একটা সিনেমা তৈরি হত, আর তা দেখার জন্য লোকারণ্য হত চারপাশ, এমনকি এই ঝড়বৃষ্টির দিনেও! দীপ সিনেমা প্রচুর দেখলেও নিজেকে সিনেমার চরিত্ররূপে কখনো দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করে না! তাই সে আর ঘাঁটাতে গেল না হকারটিকে, বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুটপাতদারের আস্তানা গোটানোর প্রতীক্ষা করতে লাগল!

আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে! ফোটাগুলো ক্রমেই ছোট থেকে বড় হচ্ছে! এদিকে দীপ ঐ কয়েক প্রস্থ জমিদারিটি কিছুক্ষণ আগে পেরুতে সক্ষম হয়েছে। তবে তার জন্য পাকা দশ মিনিট ঠায় দাড়িয়ে থাকতে হয়েছে! কিন্তু ফুটপাত-দারের হাত থেকে মুক্তি মিললেও প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে। বরং বুকটাতে কে যেন একটা ভারি পাথর বেঁধে রেখেছে!

ঝির ঝির বৃষ্টি! ওয়াসার তৈরি খাদগুলো জল-কাদায় টইটুম্বুর হয়ে উঠছে! দীপের চোখ-মুখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে! পানির তোড়ে এমনকি ভাল করে পথও দেখতেও পাচ্ছে না! দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ! সামান্য পথ পেরুলেই বাসা! অথচ আশেপাশের সবকিছুই অচেনা লাগছে দীপের! কেমন যেন এক রহস্যপুরীর মত লাগছে সবকিছু!

নির্ঘাত দৃষ্টিভ্রম! প্রাণপণে হাঁটতে থাকে দীপ! যেকোন অঘটন ঘটনার আগেই বাড়ি পৌঁছুতে হবে!