shame

কড়া রোদে মসৃণ রাস্তা যেন চমকাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে কোনো রকমে রোদ থেকে নিজকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে একবার ব্যাগ উঁচু করে ধরি, আবার মাথায় ওড়না পেঁচাই। রোদ থেকে নিজকে বাঁচাতে পারছিনা কিছুতেই।

সামনে তাকিয়ে দেখি ও পাশের ফুটপাথে কৃষ্ণচূড়া গাছের অজস্র ফুল কার্পেটের মত ছেয়ে রয়েছে ধানমন্ডির ফুটপাথে। আর সেই সু-নিবিড় শান্ত শীতল জায়গার এককোণে এক মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। কাপড় ঠিক রাখার দিকে কেমন তার এক নিরাসক্ত ভাব। রুখু চুল, মুখখানা বড্ড শুকনো। এমন পথে ঘাটে কত দেখি আমরা আসলে এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনা। নিজকে কেমন অপরাধী মনে হল। মুখ ঘুরিয়ে আমার গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম। ড্রাইভারকে বলে দিলাম বিকেলে যেন নিতে আসে। আজ বান্ধবীর বাড়িতে নেমন্তন্ন। তেমন উপলক্ষ নয়। এমন হর-হামেশা হয় আমাদের। বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাই, আবার নিতে আসি। বান্ধবীরাও যায়। মাঝে মধ্যে আমাদের এমন মিলনমেলা ঘটে।

বেসমেণ্ট এ পা দিতেই দেখি এক পাজেরো হুশ করে এলো। গাড়ির ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টায় তাকিয়ে দেখি শান্তা।

নেমে পড়ল গাড়ি থেকে, সাথে ওর মেয়ে।
যথারীতি হাল্কা নাস্তা পর্ব শেষ হল। সাথে মজাদার লেবুর শরবত।

বাঁধন অনেক কথা বলে চলেছে। বিষয় তার স্বামী,সন্তানের সমস্যা, টাকা এবং অবশ্যই গয়নাগাটি। এসব আলোচনায় আমি একদম আনাড়ি। নিজের আনাড়িপনা ঢাকতেই বোধ করি ব্যালকনিতে দাড়ালাম।

এর মাঝে এক অদ্ভূত অনুভবে তাকিয়ে দেখি শান্তার ১২ বছরের মেয়েটি। বিষন্ন মুখে বিরস বদনে বসে আছে।
ওর বসে থাকার ভঙ্গিটা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগল। সাধারণত এই বয়সি মেয়েরা থাকবে হাসি খুশিতে ভরা উচ্ছল, প্রাণবন্ত।

ওর পাশের চেয়ারে বসে বললাম,
-মা-মনি এমন চুপ-চাপ কেন? তিতিরের সাথে যাও গল্প কর, খেলো-

তিতির হচ্ছে আমরা যে বাড়িতে অতিথি সেই বাড়ির মেয়ে। প্রায় সমবয়সি। ও শান্তভাবে মাথা নাড়ল। যার অর্থ ও একা থাকতে চায়।

ঘরে এসে দেখি খুব গল্প চলছে। কে কার আগে কথা বলবে তাই নিয়ে হৈ হল্লা।

আমি শান্তাকে এককোণে ডেকে বললাম,
– তোর মেয়ে এমন চুপ-চাপ একা থাকে। আর তুই দেখিস না? ও কী এমনই না কি?
শান্তা বলে- কী করি বল, কেউ নেই বাড়িতে তাই এনেছি, আসলে ও এমন ছিলনা- এই বলে চুপ হয়ে গেল।
-কেনো? আমি জিজ্ঞেস করি।
-ও একা থাকতে ইদানিং পছন্দ করে।
-কিন্তু এই স্বভাবটা স্বাভাবিক লাগছে না আমার কাছে। আমি বলি।
কি ভেবে আর কথা বাড়ালাম না। ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমার মাথা ঘামান ঠিক নয়। কিন্তু, ইতিমধ্যে মেয়েটার সাথে মার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠল। লক্ষ্য করলাম হাসলে ওর গালে মিষ্টি একটা টোল পড়ে।
খাওয়া-দাওয়ার পরে চা পর্ব। এরপরে সেদিনের মত বিদায় নিলাম যার যার মত। বিদায়ের সময় টুকটুকি’কে (শান্তার মেয়ে) বললাম,
-কথা দাও আমার বাড়িতে আসবে?
মাথা নাড়ল। হ্যাঁ বা না কিছুই বুঝলাম না। কৃষ্ণচূড়ার গালিচা বিছানো রাস্তা দিয়ে আসার সময় মনে হল
কৃষ্ণচূড়া এতো লাল হয় কেন?

child abuse

এর মাঝে অনেকদিন কেটে গেছে। অনেকদিন শান্তা,বাঁধন, রিতা কারো সাথে যোগাযোগ নাই। স্কুল বন্ধ।
এক পড়ন্ত বিকেলে শান্তা এলো। সাথে তার অসম্ভব সুন্দর টোল পড়া গালের মেয়েটি।
ও আমাকে বলল,
-টুকটুকি আমাকে জোর করে নিয়ে এলো, বলল আন্টির বাড়ি যাবে-
বিস্মিত হলাম। কেননা সেদিন টুকটুকি কথা বলতে চাইছিলনা। আমাকে তার হঠাৎ কী করে মনে পড়ল? আনন্দিত হয়ে ওদের বসালাম।
চায়ের সাথে ঘরে বানানো ছোলা মটর, পেয়াজু ইত্যাদি সাথে দিলাম। টুকটুকিকে দেখি এক মনে বই পড়ছে। শান্তা কিছুক্ষণের জন্য মার্কেটে গেল টুকটুকি’কে রেখে।
আমি মেয়েটার সাথে এটা-সেটা কথা বলে হাসাতে চাইলাম। ওর ম্লান মুখের হাসি দেখে মন কেমন করে উঠল। বললাম,
-মা আমার সাথে মন খুলে কথা বলবে? মা কী বকেছে? নাকি অন্য কিছু? আসলে অন্যকিছু বলতে আমি এমনি বলেছি।

হঠাৎ লক্ষ্য করি ও কেমন ভয় ভয় চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমি যতোই অভয় দেই ততই ভয়ার্ত চেহারায় এ দিক ওদিক তাকাচ্ছে। চিন্তিত হয়ে গেলাম। আমার জন্য কি এমন করছে? ভেবে পেলাম না।
ইতিমধ্যে শান্তা এলো। ওকে পাশের ঘরে নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করে যা শুনলাম, তাতে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
ও যা জানালো তার সারমর্ম হচ্ছে পাঁচ বছর বয়সে আপন খালু তাকে ধর্ষণ করে (জানিনা ধর্ষণ কথাটা এখানে প্রযোজ্য কি না) ।

এই মেয়েটি তারপর থেকে এখনও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। পুরুষ দেখলেই ভয় পায়। অসংলগ্ন ব্যবহার, পড়াশোনায় মন নেই। অবিশ্বাস আর আতংকে মেয়েটি আজ এমন অবস্থানে পৌঁছেছে যার কোনো সুরাহা শান্তা পাচ্ছে না। এখন মা ক্লান্ত মেয়েকে নিয়ে।

সন্ধার পর শান্তা ক্লান্ত ভঙ্গীতে মেয়েকে নিয়ে চলে গেল। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। কিছু না করতে পারার অক্ষমতা আমাকে এক বিশাল অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল।

শান্তার কাছে জেনেছি নানান সমস্যায় পড়তে পারে এই কারণে শান্তা বা তার স্বামী কিছুই করতে পারেনি। তাদের মাঝেও অপরাধবোধ কাজ করে অনবরত। পারিবারিক ভাবে কিছু একটা করতে চেয়েছিল, তাও পারেনি।

অথচ সেই খালুর আজ পর্যন্ত না হয়েছে কোনো বিচার না শাস্তি। উপরন্তু ধমকিয়ে বলেছে বেশী বাড়াবাড়ি করলে জানে মেরে ফেলবে। আরো কারণ আছে, তা হচ্ছে সমাজ, ধর্ম, মানুষের কানাকানি।

এইভাবেই হয়তো টুকটকির জীবনের এতো বড় ঘটনা চাপা পড়ে যাবে। একথাও সত্য অনেকেই ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়, বা লুকিয়ে রাখে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় এমন খবর অহরহ দেখছি।

তাই বলতে চাই পাঠক হয়তো বলবেন এ আমি নতুন কী বলছি। আসলেই তাই। পাঠক বলবেন
-আবার আমি চর্বিত চর্বন খাওয়াচ্ছি। আসলেই সত্য।
যে দেশে মেয়েরা হিমালয়ের চূড়ায় আরোহণ করে বিশ্বকে চিনিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ নামে এক বিশাল
সম্ভবনাময় দেশকে, বিশ্ব জানছে বাংলাদেশ ও পিছিয়ে নেই। যে দেশে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া ব্যক্তি আছেন, সে দেশেই কতো টুকটুকির জীবন অচিরেই ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে।

আমি এমন কোনো বিশেষজ্ঞ নই। কেবল একটা সত্য ঘটনা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাইলাম। পরিসংখ্যান দিলাম না- যে গড়ে প্রতিদিন কতো শিশু ধর্ষণ নামক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। আমি কোনো গবেষকও নই, কেবল জানালাম আমার মনের অভিব্যক্তিটুকু।