(আগের পর্বের পর…)

৪.০ : ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলির মধ্যে নানান পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এদের মধ্যে কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এরকম কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-
.
(০১) দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা। এটি ভারতীয় দর্শনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভারতীয় দর্শনের ক্রমবিকাশের ধারাকে অনুসরণ করলে দেখা যায় ভারতীয় দার্শনিকরা পরস্পর পরস্পরের দার্শনিক মতবাদের ব্যাখ্যা ও সমালোচনা করেন এবং একে অপরকে ভালোভাবে জানতে আগ্রহী হন। ফলে প্রতিটি দর্শন সম্প্রদায় নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করার আগে সর্বপ্রথম বিরোধী পক্ষের মতবাদটি ব্যক্ত ও ব্যাখ্যা করেছেন। একে বলা হয় পূর্বপক্ষ। এরপর যুক্তির সাহায্যে পূর্বপক্ষকে সমালোচনা ও খণ্ডন করা হয়েছে। একে বলা হয় উত্তরপক্ষ বা সিদ্ধান্ত।
এভাবেই পারস্পরিক ব্যাখ্যা ও সমালোচনার মাধ্যমে ভারতবর্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন-চিন্তার উদ্ভব হয়েছে। আর তাই আমরা ভারতীয় দর্শনের একটি বিশেষ মতবাদ জানতে গিয়ে অন্যান্য মতবাদগুলিরও পরিচয় পেয়ে যাই। যেমন, ন্যায় দর্শনের কোন মূলগ্রন্থ অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমাদের চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধ, সাংখ্য, মীমাংসা প্রভৃতি দর্শনেরও বক্তব্য জানার সুযোগ হয়।
.
(০২) ভারতীয় মতে দার্শনিক জ্ঞান হলো সনাতন ও সর্বজনীন। তাই চিন্তা বা মননের এমন কোন বিষয় নেই যা ভারতীয় দর্শনে আলোচিত হয়নি। এই জ্ঞান যে কেবলমাত্র বুদ্ধিকেই তৃপ্ত করে তাই নয়, আমাদের সমগ্র সত্তার প্রকৃত তাৎপর্য ও মূল্যবোধকে জাগ্রত করে এক উচ্চতর চেতনায় উন্নীত করে। এই চেতনা হোক মানবিক কিংবা আধ্যাত্মিক, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়েই ভারতীয় ঋষি বা দার্শনিকরা দর্শনের তত্ত্বজ্ঞানকে জীবনের উপলব্ধি ও আচরণে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন।
.
(০৩) ভারতীয় দর্শনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সংশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি। পাশ্চাত্য দর্শনে যেমন দেখা যায় বিভিন্ন দার্শনিক দর্শনের সমস্যাগুলি পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ তত্ত্ববিদ্যা, জ্ঞানবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা, সৌন্দর্যবিদ্যা, মনোবিদ্যা প্রভৃতি বিভিন্ন শাখার সমস্যাগুলি স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতীয় দর্শন এক সর্বব্যাপক শাস্ত্র। এখানে বিভিন্ন শাখার সমস্যাগুলি পৃথকভাবে আলোচনা না হয়ে বরং পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে সামগ্রিকভাবে বিকাশ লাভ করেছে।
.
(০৪) ভারতীয় মতে দর্শন কেবলমাত্র তত্ত্বের আলোচনা নয়। দর্শনচর্চার মূল উদ্দেশ্য হলো দূরদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে কিভাবে জীবনকে পরিচালিত করলে জীবনের পরমার্থ লাভ করা যায়, তা জানা। মোটকথা, মানবজীবনের পরম উদ্দেশ্য বা পুরুষার্থ সিদ্ধির জন্যই ভারতবর্ষে দর্শনচর্চার উদ্ভব। আবার যেহেতু জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্যা এবং তর্কশাস্ত্র সম্বন্ধেও তাত্ত্বিক আলোচনার সমৃদ্ধি ভারতীয় দর্শনে কম নয়, তাই বলা যায়, তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয়দিক থেকেই ভারতীয় দর্শন অতীব বৈচিত্র্যপূর্ণ।
.
(০৫) একমাত্র জড়বাদী চার্বাক ছাড়া অন্যান্য ভারতীয় দর্শনগুলি এক কথায় আধ্যাত্মিক মনোভাবাপন্ন অর্থাৎ জড়বাদের সম্পূর্ণ বিরোধী মতবাদ। এই মতাবলম্বীরা ঈশ্বর, আত্মা, মোক্ষ প্রভৃতি অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। যদিও ওই বিষয়গুলির স্বরূপ সম্পর্কে আধ্যাত্মবাদীদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।
.
(০৬) চার্বাক ছাড়া অন্যান্য ভারতীয় দর্শনে চতুর্বিধ পুরুষার্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। মানুষের সাধারণ যা কামনা তাকে ভারতীয় দার্শনিকরা চার ভাগে ভাগ করেছেন- ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ। চার্বাক ছাড়া বাকি সব দর্শন সম্প্রদায় মোক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলে গ্রহণ করেছে। তাদের মতে মোক্ষলাভই জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। তাই এ সমস্ত দর্শনকে মোক্ষশাস্ত্র বলা হয়ে থাকে। এই মোক্ষকেই মুক্তি, কৈবল্য, অপবর্গ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। মুক্তির অর্থ হলো দুঃখের আত্যন্তিক বা চরম নিবৃত্তি। এই মুক্তিকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে- জীবন্মুক্তি এবং বিদেহ মুক্তি।
.
(০৭) চার্বাক ছাড়া আর সব আস্তিক দর্শনে স্বীকার করা হয় যে সমগ্র জগৎ এক নৈতিক নিয়মের দ্বারা পরিচালিত। ঋগ্বেদে এই নিয়মকে বলা হয়েছে ঋত। ঋত বলতে প্রাকৃতিক ও নৈতিক উভয় প্রকার নিয়ম শৃঙ্খলাকে বোঝাতো। এই ঋতের ধারণাই পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন নামে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। মীমাংসা দর্শনে একে বলা হয়েছে অপূর্ব। অপূর্ব হলো এমন এক নৈতিক নিয়ম যার দ্বারা এই আশ্বাস পাওয়া যায় যে, বর্তমানে অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞের ফল আমরা ভবিষ্যতে ভোগ করতে পারবো। আবার ন্যায় বৈশেষিক দর্শনে এই নিয়মকে বলা হয় অদৃষ্ট। এই অদৃষ্ট আত্মাতে অদৃশ্যভাবে থাকে এবং যথাসময়ে জীবের কৃতকর্মের ফলাফল দান করে।

বিভিন্ন দর্শনের এই মতবাদই ভারতীয় দর্শনে সাধারণভাবে কর্মবাদ নামে পরিচিত। কর্মবাদ অনুসারে আমাদের কৃতকর্মের ফল আমাদেরকে ভোগ করতেই হবে। পুণ্য কর্মের ফল সুখভোগ এবং পাপ কর্মের ফল দুঃখভোগ। কর্ম দুই প্রকার- অনারব্ধ কর্ম অর্থাৎ, যা এখনও ফল দিতে আরম্ভ করেনি এবং প্রারব্ধ কর্ম অর্থাৎ, যে কর্ম তার ফল দিতে আরম্ভ করেছে। আর এই কর্মবাদের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতীয় জন্মান্তরবাদ। কর্ম এবং কর্মফলের ভোগ- এই দুয়ের মধ্যে রয়েছে কার্য-কারণ সম্বন্ধ। কৃতকর্মের ফল যদি এক জীবনে শেষ না হয় তবে জীবকে নতুন জন্ম পরিগ্রহ করে তার কর্মফল ভোগ করার জন্য এই সংসারে আসতে হয়। এই মতবাদকেই বলা হয় জন্মান্তরবাদ। এভাবে এক কাল্পনিক শাশ্বত নৈতিক নিয়মের উপর ভারতীয় কর্মবাদ এবং জন্মান্তরবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়।

.
(০৮) চার্বাক ব্যতীত অন্যান্য ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের অন্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ভোগ এবং ত্যাগের মধ্যে অদ্ভুতভাবে সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে চতুরাশ্রম প্রথা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। চতুরাশ্রম হলো মানবজীবনের অন্বিষ্ট অনুযায়ী জীবনকালকে চারটি কর্ম-কালে বিভক্ত করে প্রয়োজনীয় সাধনকর্মে নিয়োজিত হবার যথোপযুক্ত নির্দেশনা। এই চারটি আশ্রম হলো- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস। ব্রহ্মচর্যের ধর্ম হলো পরবর্তী জীবনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিপাঠ হিসেবে যথাযথ শিক্ষাগ্রহণ, গার্হস্থ্যের ধর্ম সংসার-কর্মে নিয়োজিত হওয়া, বানপ্রস্থ হলো সমাজসংসার ত্যাগ করে অনাসক্ত জীবনযাপন এবং সন্ন্যাস হলো জীবন ও জগতের প্রতি সম্পূর্ণ মোহমায়া মুক্ত হয়ে মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে একান্ত নির্জনবাসে অতীব কষ্টসহিষ্ণু এক উচ্চতর সাধনচর্চায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। ভোগ না হলে কখনোই ত্যাগ ধর্মে মানুষ দীক্ষিত হতে পারে না বলে চতুরাশ্রম প্রথায় ভোগবাদী গার্হস্থ্য জীবনের প্রতি সমান গুরুত্ব দেয়ার পরই সমাজসংসার ত্যাগ করে বানপ্রস্থে অনাসক্ত জীবনের কথা বলা হয়েছে। ভোগ ও ত্যাগের প্রতি একইভাবে এই গুরুত্ব প্রদান ভারতীয় দর্শনের এক অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য।
.
(০৯) কেবল চার্বাক ছাড়া বাদবাকি ভারতীয় দর্শনে মনে করা হয় অবিদ্যা বা অজ্ঞতাই হলো সকল দুঃখের কারণ। তাদের মতে মানুষ দুঃখ পায় কারণ সে তার আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানে না। আত্মার সংকীর্ণ চেতনা থেকে উদ্ভূত হয় মানুষের ঘৃণা ও আসক্তি। প্রিয়বিয়োগ ও অপ্রিয়-সংযোগ দুঃখ যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করলে প্রিয় ও অপ্রিয়ের পার্থক্য দূরীভূত হয় এবং সব মানুষই এক পরম সত্তার প্রকাশ বলে মানুষ জানতে পারে। সুতরাং তখন দুঃখও দূরীভুত হয়। অনাত্মবাদী বৌদ্ধদর্শনে এই আত্মার স্থলে প্রতীত্য-সমুৎপাদ নীতিকে প্রযুক্ত করা হয়েছে।
.
(১০) ভারতীয় দর্শনের একটি মজার বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তিনিষ্ঠ চার্বাক ছাড়া বাকি দর্শনগুলিতে যুক্তি ও বিশ্বাসের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। আস্তিক দর্শনগুলোতে তাই বৈদিক প্রাধান্য স্বীকার করেই বেদবাক্যের উপলব্ধির জন্য শ্রবণ, মনন এবং নিদিধ্যাসনের কথা বলা হয়েছে। প্রথমে শোনা (শ্রবণ), তারপর যুক্তির দ্বারা বিচার (মনন) এবং অবশেষে উপলব্ধি বা ধ্যান (নিদিধ্যাসন)- এটিই হলো তত্ত্বসাক্ষাৎকারের ক্রম। ভারতীয় দর্শনের আলোচনা পদ্ধতি মূলত সূক্ষ্ম যুক্তিতর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত।
.
বস্তুত ভারতীয় দর্শন এমনই এক সর্বব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দর্শন যে, কোন একটি বিশেষ মন্তব্যের দ্বারা এর সবদিক বোঝানো সম্ভব নয়। এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দিকই রয়েছে। জ্ঞানবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা প্রভৃতির চুলচেরা আলোচনায় যুক্তি-তর্কের উৎকর্ষে খুবই সম্মানজনক উচ্চতায় আসীন হলেও শেষপর্যন্ত ধর্মীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধিই ভারতীয় দর্শনের মূল লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। কেবল চার্বাক দর্শনই এই ধারাটির তীব্র বিরোধিতাপূর্ণ অবস্থানে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে একমাত্র ব্যতিক্রমী প্রাচীন জড়বাদী দর্শন হিসেবে গৌরবজনক ভূমিকায় নিজেকে বহমান রেখেছে।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন সম্প্রদায়] [*] [পরের পর্ব: ভারতীয় সাহিত্যে চার্বাক]