গল্পের পিছনের গল্প

আট নয় বছর আগের কথা। আমি তখন থাকি উইন্ডজর নামের একটা ছোট্ট শহরে। এটা ক্যানাডার সর্ব দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত। সীমান্ত শহর। নীল জলের ডেট্রয়েট নদীর তীরে অবস্থিত। এই নদীই আলাদা করে রেখেছে এখানে ক্যানাডাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

উইন্ডজর মূলত ডেট্রয়েটের উপর নির্ভরশীল একটা শহর। শুধু শিল্পের ক্ষেত্রে নয়, ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যও ঊইন্ডজর নির্ভর করতো আমেরিকান এই শহরের। সে কারণেই বিনোদনের নানান উপকরণ গড়ে উঠেছে এখানে। ক্যাসিনো, নৈশক্লাব, পানশালা, এডাল্ট এন্টারতেইনমেন্ট এগুলোর কোনো অভাব নেই উইন্ডজরে। সপ্তাহান্তের রাতে এর ডাউনটাউনের চেহারাই বদলে যেতো। তখন আমেরিকান ডলার ক্যানাডিয়ান ডলারে চেয়ে দেড়গুণ শক্তিশালী। আমেরিকান একজন লোক পকেটে করে এক ডলার নিয়ে ক্যানাডায় ঢোকার সাথে সাথে তা দেড় ডলারে পরিণত হয়ে যেতো। ফলে, প্রচুর পরিমাণে আমেরিকান সীমান্ত অতিক্রম করে চলে আসতো এই পারে। এ ছাড়া এলকোহল কেনার বয়সেরও একটা পার্থক্য ছিল। আমেরিকায় ঊনিশ না হলে কেউ এলকোহল কিনতে পারতো না। অন্যদিকে ক্যানাডায় এই বয়সসীমা ছিল আঠারো। বিপুল সংখ্যক আঠারো বছরের আমেরিকান কিশোর দিয়ে ভরে যেতো উইন্ডজর উইকএন্ডে। এলকোহল ছাড়া অন্য সব আকর্ষণতো ছিলই।

এই শহরে আমার আগমন অবশ্য বিনোদনের উদ্দেশ্যে ছিল না। গরীব মানুষ আমি। পেটেই ভাত জোটে না, তার আবার বিনোদন। পড়াশোনা করতে এসেছিলাম আমি। না, উইন্ডজরে নয়। ডেটরয়েটে। গরীবের ঘোড়ারোগ বলে একটা কথা আছে। আমার সেই ঘোড়ারোগ হয়েছিল সেই সময়ে। ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডজর বাদ দিয়ে, ডেট্রয়েটের ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ তে ভর্তি হয়ে যাই আমি। এমনিতেই ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডজরের তুলনায় ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটির খরচ ছিল দ্বিগুণের বেশি। তার উপরে এমবিএ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচবহুল প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমার খরচ আরো বেশি ছিল। প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে এপার ওপার করতে টানেলে বা ব্রিজে পয়সা গুনতে হতো আমাকে।

তো এই ব্যয়ভার বহন করার জন্য শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নেমে গেলাম আমি। ঢাকাইয়া সিনেমার নায়কদের মত ঠেলাগাড়ি ঠেলা থেকে শুরু করে কোদাল হাতে মাটি কাটার কাজ বা শক্ত হাতুড়ি দিয়ে জন হেনরির মত পাথরভাঙার কাজ কোনোটাই বাদ গেলো না। আমার বাসাটা খুব বাজে একটা জায়গায় ছিল। ওখান থেকে হাঁটার দূরত্বে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। পাবলিক ট্রানজিটও ছিল অনিয়মিত। আমাদের মাত্র একটা ভাঙাচোরা গাড়ি থাকার কারণে আন্নার পক্ষে কাজ করা সম্ভব ছিল না। যাই হোক ঢাকাইয়া সিনেমার নায়ক আমি, বউ কাজ করলে হিরোইজম কি আর থাকে? সে কারণে একাই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলাম সংসারতরী।

এই ঠেলাঠেলির সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়েই এই গল্প। অবশ্য গল্পটার কতটুকু সত্যি আর কতটুকু কল্পনা, সেটা বলবো না আমি। পাঠককে এই দোলাচলে রাখবো আমি ইচ্ছে করেই।  🙂

এই গল্পটা লিখে মুক্তমনায় পোস্ট দেবার পরে বেশ ভালো রকমের বিপদে পড়েছিলাম আমি। আন্না প্রায়ই গোপনে গোপনে মুক্তমনা পড়ে। আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করাই মূল উদ্দেশ্য। এই গল্প পড়েতো সে অগ্নিশর্মা। বলে যে, এই গল্প মোছো মুক্তমনা থেকে। তুমি যে এত খারাপ লোক এতদিনে টের পাই নাই আমি। বললাম যে, ‘কী হয়েছে?’ ‘কী হয়েছে মানে। এই সব কী সব আজেবাজে কথা লিখছো তুমি। হয় গল্প মোছো, না হয় এগুলো মোছো।‘ চিৎকার চেচামেচি করে বলে সে। যতই ওকে বোঝাই যে, এগুলো মুছলে গল্পের আর কিছু থাকবে না। সে কিছুতেই বোঝে না। খালি বলে যে, ‘তোমার মুখ থেকে এই সব খারাপ কথা বের হলো কেমনে?’ ‘আরে যন্ত্রণা, এগুলো তো আমি বলি নাই। গল্পের চরিত্র বলেছে। গল্পের চরিত্র তো কত কিছুই বলতে পারে।‘ আমি বলি। ‘তুমি নিশ্চয়ই এইসব খারাপ কথা মনে মনে ভাবো। তা না হলে এগুলো লিখবা কী করে?’ মাথা চাপড়ে বিলাপ করে সে। ‘হায় আল্লাহ! এ কোন বদমায়েশ লোকের সাথে এতদিন আমি সংসার করেছি না বুঝে।

এখন অবশ্য আর বদমায়েশ না, তার পুরোপুরি ধারণা জন্মে গেছে যে, আমি ক্রিমিনাল টাইপের একটা লোক। মুখোশ পরে সমাজে বসবাস করছি। তা না হলে আমার প্রায় সব গল্পের চরিত্রই কেন ভয়ানক সব ক্রিমিনাল লোকজন হবে? এদের কেউ রাজনৈতিক গুন্ডা, সভ্যের ভান করে থাকে। কেউ স্বার্থের লোভে গোপন প্রেমিকাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় উঁচু টাওয়ার থেকে। কেউ প্রেমিকার জন্মদিনের উপহার চুরি করতে গিয়ে হাসিমুখে মানুষ খুন করে বসে। কেউ বা ভয়াবহ সাইকোপ্যাথ। ভুল করে সামান্য একটু পয়সা কম ফেরত দেওয়ার অপরাধে চেইন দিয়ে গলা পেচিয়ে হত্যা করে ফেলে কাউন্টারের মেয়েটাকে। কেউ বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে একজন শিং ওয়ালা লোককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় পাহাড়ের নীচে। কেউ বা ছুরি ধরে জিম্মি করে রাখে অসহায় একজন ব্যাংক ডাকাতকে। এমন লোক নিজে ক্রিমিন্যাল না হয়ে যায় কী করে?

যাক গে, আমার ক্রিমিন্যালগিরির কথা বাদ দিন। এখন কথা হচ্ছে যে, এই পুরোনো গল্প আবার পোস্ট করা কেন?

আগে মুক্তমনার ওয়েবসাইটে যে সব লেখা ছিল, সেগুলো এখনকার পাঠকেরা পাঠ করতে পারেন না। স্বপন মাঝি নামের এক ভদ্রলোক নতুন মুক্তমনায় এসেছেন। নতুন মানুষ যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই মুক্তমনা নিয়ে তাঁর উৎসাহটা একটু বেশিই। নয়া মুসলমানতো, তাই গরুর গোস্ত বেশি বেশি খান। এই ভদ্রলোক কোনো এক বিচিত্র কারণে আমার লেখার ভক্ত (সত্যি মিথ্যা জানি না, তিনি বলেছেন এই কথা।) কোথা থেকে যেন জেনেছেন যে, আমি নিশাচর প্রাণী। মাঝে মাঝেই তাই রাত-বিরেতে ফোন করেন তিনি। ফোন করে আমার লেখার প্রতি তাঁর উচ্ছ্বাস, উদ্দাম ভালোবাসার কথা জানান। আমি অবশ্য খুব একটা গলি না তাতে। তিনি যখন প্রবল আবেগে এগুলো বলে যেতে থাকেন, আমি তখন আস্তে করে কান থেকে রিসিভারটা দূরে সরিয়ে রাখি।

প্রশংসা খাই না, এমন মহাপুরুষ আমি নই। তবে, এই উচ্ছ্বাসের পিছনের কারণগুলো কী কী হতে পারে সেটা অনুমান করতে পারি বলেই আমার এই নিরুত্তেজনা। আদিল মাহমুদ নামের এক ভণ্ড নবী আছেন। তিনি যখন গাঁজায় দম দেন, তখনই ধমাধম আয়াত নাজিল করতে থাকেন আমাকে সুসাহিত্যিক ইত্যাদি সুবচনে ভূষিত করে। সুসাহিত্যিক তো দূরের কথা নিজেকে সাহিত্যিক বলেই মনে করি না আমি। যাঁরা দেওয়ান গাজীর কিসসা নাটক দেখেছেন, তাঁরা এই রোগটা সম্পর্কে সম্যক অভিহিত আছেন। স্বপন মাঝির ক্ষেত্রেও আমার একই ধারণা। তিনি আমাকে যখন ফোন দেন, তখন নাম না জানা কোনো তরলের প্রভাবে তাঁর মনটা খুবই সরল অবস্থায় থাকে। সে কারণেই এতো উচ্ছ্বাস। সরলই থাক আর গরলই থাক, এই ভদ্রলোক কয়েকদিন ধরে জ্বালিয়ে মারছেন আমার পুরোনো লেখাগুলো পাওয়ার জন্য। একটা দুটো লিংক দিয়েছিও তাঁকে। তাতে খুশি নন তিনি। আমাকে বলেছেন পুরোনো লেখাগুলো রিপোস্ট দিতে। জনস্বার্থে।  🙂

তাঁর সেই অনুরোধেই এই রিপোস্ট। পাঠক যদি বিরক্ত হয়ে কাউকে কড়া পিটুনি দিতে চান, স্বপন মাঝিকে দিয়েন। তিনিই প্রাপ্য এই পিটুনির। আমি এর মধ্যে নেই।

আরেকটা কথা বলে যাই। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার নায়ক অমিত রায় বলেছিল যে, কবি মাত্রের পাঁচ বছর কবিতা লেখা উচিত। এর বেশি নয়। তা না হলে নিজের লেখা থেকেই নকল করা শুরু করে। ব্লগারদের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। পাঁচ বছর পরেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো উচিত তাঁদের। তা না হলে এরকমই হবে। রিপোস্টে রিপোস্টে ভরে যাবে এই ভূবন।

এই গল্পটা যখন শুরুতে পোস্ট করেছিলাম মুক্তমনায় কয়েক বছর আগে, আমার বাংলা ভাষায় দীনতার কারণে এর শিরোনামটা তখন ভুল ছিল। শিরোনাম দিয়েছিলাম নাচনেওয়ালী। কিন্তু এই শব্দটা অভিধানে নেই। আসল শব্দটা হবে নাচ-ওয়ালি বা নাচওয়ালি। এবার সেটা সংশোধন করে দিলাম।

:line:

দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ী চালাচ্ছে রাসেল।

মেজাজ ভয়াবহ রকমের খারাপ। মেজাজটাকে স্বাভাবিকে আনতে মনে মনে এক থেকে একশ’ পর্যন্ত গোনা শুরু করেছে সে। কোথায় যেন পড়েছিল প্রচণ্ড রাগ হলে মনে মনে সংখ্যা গুনলে নাকি রাগ কমে যায়। পঁচাত্তর পর্যন্ত গুনে ফেলেছে তবু রাগ কমছে না। কমছে না দেখেই আরো রাগ বেড়ে যাচ্ছে তার। অন্য কোন সময় হলে অবশ্য এতো ঝামেলা করতে হতো না। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে দুনিয়ার যত খারাপ খারাপ গালি আছে সেগুলোর তুবড়ি ছুটিয়ে রাগ মিটিয়ে নিতো। মনে মনে অবশ্য রাজ্যের গালাগালি করছে, কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। শব্দ করে গালি দিতে না পারলে গালির কার্যকারিতাও থাকে না মনে হয়। এখন সেটা করা যাচ্ছে না বলেই যত সমস্যা।

সমস্যাটার উৎস হচ্ছে তার পিছনের সিটে বসা স্বল্পবসনা স্বর্ণকেশী সুন্দরী নাচওয়ালিটি। ন্যাংটো নাচের ক্লাব লেপার্ড এর সামনে থেকে আধা ন্যাংটো এই ছুকড়িকে তুলেছে রাসেল। যাবে আরেক ন্যাংটো ক্লাব চিতায়। বেশবাস দেখেই বোঝা যাচ্ছে লেপার্ডের নাচানাচি শেষ করে চিতায় উদোম হয়ে নাচতে যাচ্ছে। তাতে অবশ্য রাসেলের মেজাজ খারাপ হওয়ার কিছু নেই। দুনিয়ার সব খারাপ কাজের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে হবে এমন কোন দিব্যি তাকে কেউ দেয়নি। কে কোথায় ন্যাংটো হয়ে নাচছে তাতে তার কিছুই যায় আসে না। নিজের সমস্যা নিয়েই অস্থির হয়ে আছে সে। অন্যের কায়-কারবার দেখার সময় কোথায়।

ছুকড়ি যখন গাড়ীতে উঠেছে তখনই ভুর ভুর করে মদের গন্ধ পেয়েছে রাসেল। সেটাও কোন সমস্যা নয়। মাঝে মাঝে রাতে যখন ট্যাক্সি চালায় তখন বেহেড মাতালদেরকেও যাত্রী হিসাবে নেওয়ার অভিজ্ঞতা তার আছে। তেমন বড় ধরনের কোন সমস্যাতেই সে কখনো পড়েনি। একবার এক মাতাল অবশ্য টাকা না দিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু পরের দিন ওই বাড়িতে যেয়ে বলতেই আগের রাতের সেই মাতাল লোকটাই বার বার ক্ষমা চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে দিয়েছিল রাসেলকে। আরেকবার এক মাতাল বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিল সারা গাড়ি। কার ওয়াশে নিয়ে পরিষ্কার করতে গাঁটের অনেকগুলো টাকাই খরচ হয়ে গিয়েছিল রাসেলের। সেই সব সমস্যার তুলনায় এই ছুকরিতো কিছুই করছে না।

গাড়িতে উঠার পর থেকেই অসম্ভব বাজে ব্যবহার করা শুরু করেছিল মেয়েটা। আর সেটাই রাসেলের মেজাজ খারাপের মূল কারণ। রাসেলের সম্ভাষণের বিপরীতে খিটখিটে মেজাজে চিতায় যেতে আদেশ দেওয়া থেকে এর সূত্রপাত। কোন কারণে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ছিল নটি সুন্দরীর। ‘হারি আপ, হারি আপ’ বলে অনবরত চিৎকার করছিল সে। অফিস ছুটির সময় বলে রাস্তায় অসম্ভব ভিড়। দক্ষ হাতে এ লেন ও লেন করে ট্যাক্সিটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল রাসেল। তার মধ্য দিয়ে পেছন থেকে তারস্বরে চেঁচিয়েছে মেয়েটা।

‘’ইউ ফাকিং ইডিয়ট, মুভ ফাস্টার। শিট!! আই এ্যাম গোনা বি লেট। ডোন্ট ইউ নো হাউ টু ড্রাইভ? হু গেভ ইউ দ্য ফাকিং লাইসেন্স’।’

‘’তোর বাপে দিছে, মাগি’। রাসেল মনে মনে বলে। মুখে অবশ্য বলে, ‘আই এ্যাম ট্রাইং মাই বেস্ট, ম্যাম। টু মেনি ট্রাফিক্স টুডে। প্লিজ, হ্যাভ পেশেন্স’।’

ট্রাফিক সিগন্যাল হলুদ হয়ে আসতেই ট্যাক্সিটাকে এক ইন্টার-সেকশনে থামিয়েছিল রাসেল। আর পায় কে? নাচওয়ালির মুখে যেন খই ফুটতে শুরু করেছিল। ‘’হোয়াট আর ইউ ডুয়িং, এ্যাসহোল? হোয়াই দ্য হেল ইউ স্টপড? হোয়াই ডিডন’ট ইউ রান দ্য ইয়েলো লাইট? ফাকিং থিফ। ইউ ওয়ান্ট টু স্টিল মাই ফাকিং মানি’।’

‘’তোর গতর বেচা টাকা চুরি করার কোন ইচ্ছাই আমার নাই। ওই টাকায় আমি থুথু দেই। তোর টাকা তুই মশলা মাখাইয়া খা গিয়া’।’ মনে মনে বিচ্ছিরি একটা গালি দিয়ে বলেছিল রাসেল। বাইরে অবশ্য পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখে নর্তকীর গালি হজম করেছিল সে। কাস্টমার গালি দিলেও হাসিমুখে তা হজম করতে হবে এটাই এই দেশের নিয়ম।

যে শালারা এই দেশে কাস্টমারদের ঈশ্বরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে তাদের চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ে রাসেল। সামারের সময় অনেক বাঙালিদের ফ্যান বা এয়ারকুলার কিনে কয়েক মাস ব্যবহার করে ওয়ালমার্টে ফেরত দিতে দেখেছে রাসেল। স্যার স্যার বলে ওই সব ছ্যাঁচড়দের পুরো টাকা ফেরত দিয়ে দেয় ওয়ালমার্টের গর্দভগুলা। নিজের অদৃষ্টকেও গাল দিতে ছাড়ে না রাসেল। কোন দুঃখে যে ক্যানাডায় এসেছিল। এই মড়ার দেশে কেউ আসে। পড়ার খরচ যোগানোর জন্য হেন কোন কাজ নেই যা সে করেনি। ভয়ংকর ঠাণ্ডার মধ্যে ফুল সার্ভিস গ্যাস স্টেশনের এটেনডান্টের কাজ করেছে সে। ক্যানাডিয়ান টায়ারের সামনে দাঁড়িয়ে সারাদিন ধরে হট-ডগ বেঁচেছে একসময়। মেক্সিকান শ্রমিকদের সাথে দিনের পর দিন লেমিংটনের টমাটো ক্ষেতে কাজ করারও অভিজ্ঞতা আছে তার। ভাগ্য ভাল ক্যাব লাইসেন্স করেছিল। এক বাঙালি ক্যাব ড্রাইভার সপ্তাহে দুই দিন তার গাড়ি রাসেলকে চালাতে দেয়।

ট্রাফিক সিগন্যালের গালিগালাজের পর থেকেই কী কারণে যেন চুপ মেরে গেছে মেয়েটা। রাসেল রিয়ার ভিউ মিররে দেখার চেষ্টা করে তাকে। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে স্বর্ণকেশী। মুখের একপাশটা শুধু দেখতে পায় রাসেল। ডিম্বাকৃতির অপূর্ব সুন্দর একটা মুখ। এক মাথা ঢেউ খেলানো সোনালি চুল আছড়ে পড়ে আছে সুগঠিত নগ্ন কাঁধে। সুডৌল স্তন-দ্বয়ের অর্ধেকটাই উদ্ধত ভঙ্গিতে উন্মুক্ত। গাড়ির দুলুনির সাথে তির তির করে কাঁপছে সে দুটো। মনে হচ্ছে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে এক জোড়া অবাধ্য পায়রাকে। সুযোগ পেলেই বাঁধন কেটে ডানা মেলে উড়াল দেবে আকাশে। অন্য সময় হলে হয়তো রাসেল তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতো এই অসাধারণ সৌন্দর্যকে। কিন্তু মেজাজ গরমের কারণে এখন আর তা হচ্ছে না। এরকম একটা সুন্দরী মেয়ের মুখ দিয়ে এরকম বিচ্ছিরি সব গালিগালাজ কী করে বের হয়, তাই নিয়ে বরং গবেষণা শুরু করে দেয় সে।

চিতার সামনে আসতেই ইচ্ছে করেই সজোরে ব্রেক করে রাসেল। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে আকাশের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নেয় মেয়েটা। সাপের মত হিস হিস করে গালি দেয় রাসেলকে, ‘’ফাক ইউ’’।

‘’বাসায় আসিস, হারামজাদী। তখন দেখবো কে কারে কী করে’।’ থমথমে মুখে মনে মনে পালটা উত্তর দেয় রাসেল।

মিটারে সাড়ে চৌদ্দ ডলার ভাড়া উঠেছে। পার্সের ভিতর থেকে একটা বিশ ডলারের নোট বের করে দলা পাকিয়ে সিটের উপর দিয়ে রাসেলের কোলে ছুড়ে দেয় মেয়েটা। কাটা কাটা স্বরে বলে ‘কিপ দ্য চেঞ্জ’। তারপর পেভমেন্টে নেমে দড়াম করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয় সে।

‘’তোর চেঞ্জের আমি নিকুচি করি, বেশ্যা মাগি’।’ মনে মনে কঠিন প্রতিজ্ঞা করে রাসেল। একদিন লেপার্ড বা চিতায় যেয়ে এই নাচওয়ালির নাচ দেখবে সে। উলঙ্গ হয়ে ছুকড়িটা যখন তার টেবিলের সামনে আসবে তখন সে তার বিশেষ অঙ্গে বিশ ডলারের একটা নোট গুঁজে দিয়ে উদার স্বরে বলবে, ‘কিপ ইট’।

এখন গলা ছেড়ে গালি দিলে আর শুনবে না এই ভরসায় ঘাড় ঘুরিয়ে রাসেল তার জানা সবচেয়ে কুৎসিত খিস্তিটা দিতে গিয়ে মাঝপথেই থমকে গেলো। কোনো এক আশ্চর্য উপায়ে মেয়েটা যেন জানতো রাসেল কী করবে। ঠিক একই সময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সেও তাকিয়েছে রাসেলের দিকে। মেয়েটার চোখে চোখ আটকে যায় রাসেলের। সাগরের মতো ঘন নীল দুটো মায়াময় ডাগর চোখে গভীর বিষাদ।

এতো বিষণ্ণ চোখ মানুষের হয় কি করে? দৃষ্টি নামিয়ে নেয় রাসেল।

রাসেলের দিকে পিছন ফেরে মেয়েটা। তারপর মাথা নিচু করে পা টেনে টেনে এগিয়ে যেতে থাকে চিতার দিকে।