সাতটা বাজতে না বাজতেই স্কুলের আঙ্গিনায় পা রাখলেন মনির হোসেন। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় মনির স্যার। পলাশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। স্কুলের দপ্তরী সবেমাত্র রুমগুলোর তালা খুলছে। তারপর মনির স্যারের কাছে এসে সময় জেনে ঠিক সোয়া সাতটায় সতর্ক সংকেত বাজাবে আর সাড়ে সাতটায় স্কুল বসার ঘন্টা। মনির স্যার কমন রুমে এসে ঢুকলেন। নিজের রুটিনটা আবার যাচাই করে নিলেন। প্রথম ঘন্টায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে অংক। তারপর প্রথম শ্রেণীতে বাংলা। তৃতীয় ঘন্টায় আবার দ্বিতীয় শ্রেণীতে বাংলা। এরপর আধা ঘন্টা বিরতি। বিরতির পর আবার শুরু হবে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস। এভাবে চলবে বেলা তিনটা পর্যন্ত। চারটা থেকে মনির স্যারের বিশেষ ক্লাস। বন্ধ স্কুল ঘরের বারান্দায় যতক্ষণ আলো থাকে ততক্ষণ তিনি পড়ান। যে যে ছাত্র যে যে বিষয়ে দুর্বল তাদের আলাদা আলাদা করে পাঠদান করেন। তারপর বাড়ি ফিরে যান। স্কুলে আরো যে চারজন শিক্ষক আছেন তাঁরা মনির স্যারকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করেন। নামও দিয়েছেন একটা –পাগলের পাঠশালা। কিন্তু তাঁর ওসব গায়ে লাগে না। কারণ তাঁর জীবনে কী কষ্ট লুকিয়ে আছে সে কথাতো তারা জানে না।

সর্তক ঘন্টা বাজার একটু আগে বারান্দায় এসে দাঁড়ান মনির। একজন দুজন করে ছেলে মেয়ে মাত্র আসতে শুরু করেছে। দুএকজন এখনও ঘুম চোখে থাকায় টলমল পা ফেলছে। কেউ কেউ চোখ ডলছে। সকালের সূর্যের আলো ওদের ছোট্টমুখগুলোতে পড়ে আরোও মায়াবী দেখাচ্ছে বাচ্চাগুলোকে। এবার আকাশের দিকে তাকালেন। আশ্বিনের শুরুতে শরতের আকাশ উজ্জ্বল নীল হয়ে আছে। দূরে রাস্তার দিকে তাকালেন। সারি বেঁধে দলে দলে ছেলে-মেয়ে আসতে শুরু করেছে। আর দুচার মিনিটের মধ্যে ওদের কলকাকলীতে মুখর হয়ে উঠবে শূন্য প্রাঙ্গন। গেল কদিনের বৃষ্টির পর কাল আর আজ রোদ পেয়ে স্কুলে উপস্থিতির সংখ্যা বাড়ছে।

হেডস্যার এসে গেছেন। অন্য শিক্ষকেরাও। সবাই মিলে প্রাতঃকালীন সমাবেশের আয়োজনে ব্যস্ত হলেন। মনির ভাঁজ করা জাতীয় পতাকাটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে মাঠে নেমে এলেন। তাঁর মাথার ভেতর গুনগুন করতে লাগল জাতীয় সঙ্গীতের একটি লাইন-ওমা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে—

মনির হোসেন এ স্কুলে যোগ দিয়েছেন প্রায় চারবছর। পলাশপুর গ্রামের পাশে আলমডাঙায় তাঁর বাড়ি। কিশোর বয়স থেকে তার ভেতরে একটাই প্রতিজ্ঞা দৃঢ় ছিল-একদিন শিক্ষক হবেন। গৃহের ,সমাজের অন্ধকার দূর করবেন। তাইতো বিএ পাশ করার পর বন্ধুরা যখন চাকরির সন্ধানে ছুটোছুটি করছিল তখন তিনি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। বন্ধুরা বলেছিল, মনির তোর যা রেজাল্ট কষ্টেসৃষ্টে এম এ টা পাশ করে বিসিএস দিলে নির্ঘাত সরকারী অফিসার হয়ে যাবি। কেন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হয়ে জীবনটা নষ্ট করবি। কিন্তু মনির তাদের কথা শোনেনি। তারা তো জানে না মনের ভিতরে একটা দগদগে ঘা তাকে এ পথে আসতে তাড়িত করেছে। চোখ বুঁজলে এখনও স্পষ্ট দেখতে পান মনির এরকমই একটি আশ্বিনের সকাল। শরতের আলোকছটায় উজ্জ্বল চারদিক। কিন্তু আলমডাঙার মনির হোসেনদের ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। দিনের আলো প্রবেশ করার মত পর্যাপ্ত জানালা দরজা নেই। মাটির দেয়াল ঘেরা সেই ঘরটাতে দিনের বেলায়ও হঠাৎ ঢুকলে কোথায় কী আছে বুঝে উঠতে কষ্ট হয়। অন্ধকারটা চোখে সয়ে এলে তারপর আস্তে আস্তে জিনিসপত্রের আকার-আকৃতি আর অবস্থান বোঝা যায়। সেই ঘর থেকে আশ্বিনের সে উজ্জ্বল সকালে স্কুলের পথে বেরিয়েছিল মনির। বাবা অনেক ভোরে মাঠে চলে গেছেন। ঘরে মা আর জ্বরে আক্রান্ত ছোটভাই আমীর।

সাত-আটদিন থেকে জ্বর ছিল আমীরের। এলাকার পল্লী চিকিৎসক থেকে ওষুধ এনে খাওয়ানো হচ্ছিল। পল্লী চিকিৎসকই বলেছিল রক্তটা একবার পরীক্ষা করিয়ে নিতে। তাহলে ধরা পড়বে টাইফয়েড না ম্যালেরিয়া। কিন্তু পরীক্ষা করাতে উপজেলা হাসপাতালে যাওয়ার মত টাকাপয়সা বাবার হাতে ছিল না। তবু ডাক্তার যে ওষুধ দিচ্ছিল সেটাই খাওয়ানো হচ্ছিল। কিন্তু সেদিন ওষুধ খাওয়ানোর সময় মা ভুল করে ভাইয়ের মুখে তুলে দিয়েছিলেন কীটনাশক। আবছা অন্ধকার ঘরে নিরক্ষর মা তার বুঝতে পারে নি কোনটা ওষুধের শিশি আর কোনটা বিষের। খবর পেয়ে বাবা,মনির এবং আরো সবাই যখন ছুটে এসেছে তখন ভাই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। উঠোনে গোসল দেবার সময় তার বিষ জর্জর নীলচে মুখের স্মৃতি এখনও মনিরের বুকটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। ভাইয়ের মৃত্যু শোকে তার স্মৃতি ভাবতে ভাবতে ভাবতেই একদিন যেন আলোর দেখা পায় কিশোর মনির। মা যদি পড়তে জানত তাহলে তো এমন হতো না। তাহলে এ অন্ধকার থেকে মুক্তির উপায় কী? শিক্ষা, মনের গহীনে খুঁজে পাওয়া সে আলো নিয়েই পলাশপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আজকের শিক্ষক মনির হোসেনের পথ চলা শুরু সেদিন থেকে।

কী মনির সাহেব ক্লাসে যাবেন না? সহকর্মী শিক্ষক অভিজিতের ডাকে খেয়াল হল মনিরের। ঘড়ির দিকে তাকালেন। পাঁচ মিনিট লেট! এমন তো কখনও হয়না। আজ আশ্বিনের সকাল সেই পুরনো স্মৃতি জাগিয়ে দিয়ে তাকে কী সব ভুলিয়ে দিল! তাড়াতাড়ি চক-ডাস্টার আর বই-খাতা নিয়ে ক্লাসের দিকে দ্রুত পা চালালেন মনির।

বেশ কিছুদিন থেকে মনির লক্ষ্য করছেন স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি কমে এসেছ। বিশেষ করে সকালের শিফট-এ বাচ্চাদের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে কম। দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্লাসে ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করেন-স্কুলে আসোনা কেন? ওরা চুপ করে থাকে। বুঝতে পারেন সবাইকে একসাথে প্রশ্ন করলে কেউ উত্তর দেবে না। তাই একজন একজন করে জিজ্ঞেস করেন– মায়মুনা নিয়মিত স্কুলে আসছনা কেন? স্যার না বলেছি ঝড়-বৃষ্টি-রোদ যাই হোক না কেন তোমরা স্কুল বাদ দেবে না।

মায়মুনা মেয়েটি বেশ চটপটে-স্যার আব্বায় বাড়িতে না থাকলে আম্মায় আসতে দেয় না।
-কেন ?
-আব্বায় থাকলে স্কুলে পৌঁছাইয়া দিয়া যায়। আবার আইসা নিয়া যায়। আম্মা একলা দিতে চায় না। ভয় পায়।
-কিসের ভয়রে! এই সকাল বেলা কিসের ভয়?
-স্যার আপনি দ্যাখেন নাই নতুন গোডাউনের বড় বড় টেরাকগুলান এইখান দিয়া যায়। এই চিকন রাস্তায় টেরাক চললে আমাগো হাঁটার জায়গা থাকে না।
-হ্যাঁ তাইতো। এ বিষয়টা এতদিন মাথায় আসে নি কেন মনিরের। সম্প্রতি এখানে এক শিল্পপতির মালের গুদাম হয়েছে সেই মাল আনা-নেয়া করতে স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে প্রায়ই ট্রাক চলাচল করে। অল্প কদিনে রাস্তাটা খানাখন্দে ভরে গেছে। কিন্তু এটা যে ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়ের ভয়ের কারণ হতে পারে সেটা একবারও মাথায় আসেনি।

বিষয়টা ভাবিত করে মনির হোসেনকে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবতে থাকেন কি করা যায়। হঠাৎ আবছা অন্ধকারে একটা গর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সোজা হয়ে দাঁড়ান মনির। আর তক্ষুণি সাঁ করে চলে যাওয়া ট্রাকটা তাঁকে আতঙ্কিত করে তোলে। আর একটু হলেই তো চাকার তলায় যাচ্ছিলেন। নাহ্‌, এর একটা বিহিত করতে হবে ।

পরদিন টিফিন পিরিয়ডে হেডস্যারের কাছে কথাটা পাড়েন – স্যার, স্কুলের সামনের এই সরু রাস্তা দিয়ে ট্রাক চলাচলতো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
-তার জন্য আমি কী করতে পারি? রাস্তাটাতো স্কুলের সম্পত্তি নয়।
-না, তা যে নয় আমিও জানি। কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিপদের কথা আমারাতো উপজেলা প্রশাসনকে জানাতে পারি।
-বাদ দাও তো মনির। কেন অযথা ঝামেলায় জড়াচ্ছ। সবার উপর মাস্টারি করতে যেয়ে নিজের বিপদ ডেকো না। যাও যাও ক্লাশে যাও।
-তবু স্যার একটা কিছুতো করা দরকার। অন্ততপক্ষে প্রশাসনকে আপনি একটা দরখাস্ত লিখে বিষয়টা জানান।
হেডস্যার বিরক্ত হয়ে ধমকে ওঠেন –পাগলামী করোনা মনির। যাও, এখন যাও তো। আমার ম্যালা কাজ আছে।

কিন্তু মনির হতাশ হন না। ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি যান। অভিভাবকদের বোঝাতে চেষ্টা করেন। এই সরু রাস্তায় যখন তখন ভারী যান চলাচল বিপদজনক। যারা চালায় তারা কোন কিছুর পরোয়া করে না। এতে করে যে কোন সময় একটা শিশুর অমূল্য জীবন হারিয়ে যেতে পারে। না তারা সাড়া দেয় না। গরিব মানুষ তারা। কেউ চাষী, কেউ জেলে, কেউবা সামান্য দোকানদার প্রতিবাদ করার শক্তি বা সামর্থ্য কোনটাই নেই। আর গোডাউনটা যার তিনি এলাকার প্রভাবশালী মানুষ। মাত্র কয়েক বছরে তিনি এত বেশি টাকার মালিক হয়েছেন যে একসময় যারা তার বন্ধুস্থানীয় ছিল তারাও তার দিকে চোখ তুলে কথা কয় না। মনির তবুও তাদেরকে বোঝাতে চান – আমরা সবাই এক হয়ে বাধা দিলে উনি একা কি করবেন? দেখছেন অল্প কদিনে রাস্তাটা কেমন খানা-খন্দে ভরে গেছে। আসেন বাধা দিই আমরা।

না কেউ আসে না। ওদের সবার কাজ আছে। একদিন ছুটি নিয়ে উপজেলায় যান মনির। নির্বাহী অফিসারের কাছে আবেদন জানান।
-হেডমাস্টার বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কোন দরখাস্ত এনেছেন – জানতে চান নির্বাহী অফিসার।
-জ্বী না স্যার।
-তাহলে আমি কী করতে পারি? মুখের কথায় তো কাজ হবে না। তাছাড়া যার বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ তিনি কতবড়ো মানুষ জানেন।
-বড়ো মানুষ! টাকা হলেই মানুষ রাতারাতি বড়ো মানুষ হয়ে যায়? মনিরের ধন্দ লাগে। তিনিতো জানেন বড়ো মানুষ হতে গেলে সাধনা করতে হয়। একটা অশিক্ষিত, স্বার্থপর লোক শুধু কিছু টাকার মালিক হলেই বড়ো মানুষ হয়ে যায়! আশ্চর্য!
-কী স্যার বসে আছেন কেন? এবার উঠুন। আমার অনেক কাজ আছে।
হতাশ মনির হোসেন ধীর পায়ে বেরিয়ে আসেন।

বর্ষা এসেছে। স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনির হোসেন মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। এবারের বাদলায় ছেলে-মেয়ের উপস্থিতি আরও কমে গেছে। অথচ শিক্ষা নিয়ে তাঁর কত স্বপ্ন ছিল। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা। বুকের ধনকে বিষ খাইয়ে আজ এতগুলো বছর তাঁর মা অর্ধউন্মাদ হয়ে বেঁচে আছেন। মনিরের নিজের ভিতরেও ভাই হারানোর তুষের আগুন। সেজন্য স্কুলের ছাত্রীগুলোকে অনেক বেশি যত্ন আর আদর দিয়ে পড়ান যাতে তাদের আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু এবারের বর্ষায় রাস্তাটা এত ভেঙে গেছে যে হাঁটাই দায়। অথচ ট্রাক চলাচল বন্ধ হয়নি। যিনি গুদামের মালিক তিনিতো এলাকায় আসেন না। এলে একবার তার কাছেই যেতেন মনির। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত একটা বুদ্ধি খেলে যায় মনির হোসেনের মাথায়। আচ্ছা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্ররা যখন বিকেলে পড়তে আসে তখন তাদের নিয়ে পাশ থেকে কিছু মাটি তুলে রাস্তাটা ভরাট করলে তো কিছুটা সমাধান হয়। তারপর একটা লা্লপতাকা পুতেঁ দিলে এখান দিয়ে আর ট্রাক চলবে না।

এতটা আশা করেননি মনির। বাড়ি থেকে কোদাল-ঝুড়ি নিয়ে এসে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ছেলেরা রাস্তার গর্তগুলো বুঁজে দিল। মেয়েরা প্রথম একটু মন খারাপ করে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু স্যার যখন বললেন মুগুর দিয়ে গর্তের মাটিগুলো সমান করে দাও তখন ওরাও আর পিছিয়ে থাকল না। তারপর সবাই মিলে হৈ হৈ রৈ রৈ করে একটা খুঁটিতে পতাকাটা বেধেঁ স্কুলের সামনের রাস্তায় পুঁতে দিল। কাজটা শেষ হতে মনির গেয়ে উঠলেন – আমরা করব জয়। স্যারের শেখানো এ গানটা হাতে তালি দিতে দিতে ওরা সবাই গেয়ে উঠল। আনন্দে ভাসতে ভাসতে মনির বাড়ি ফিরলেন। তাঁর শিক্ষা কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছে।

সকালে স্কুলের পথে আসতেই দেখলেন রাস্তা পূর্ববৎ। ট্রাকের মোটা চাকার দাগ গর্তের নরম মাটিতে বসে গর্তগুলো আবার জেগে উঠেছে। আর টুকরো টুকরো খুঁটিতে লাল পতাকার চিহ্নও নেই। চোখ দুটো জ্বলে উঠল তাঁর। ক্রোধে-প্রতিজ্ঞায় হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এল। বিড়বিড় করে উঠলেন- তোমাদের প্রতিরোধ করবই। স্কুলে এসে ছেলে মেয়েদেরও মন খারাপ। নিজের কষ্ট ভুলে ওদের সান্তনা দিলেন তিনি। হেডস্যার তার রুমে ডেকে নিলেন- কেন এত পাগলামী কর মনির বলোতো। মাস্টারদের এসব মানায়?
-ক্ষমা করবেন স্যার। এটা পাগলামী নয় এটা আমাদের অধিকার। এ রাস্তা ট্রাক চলার জন্য নয়।
হেডস্যার রেগে গেলেন।
– তোমার যা খুশি কর কিন্তু মনে রেখো, তুমি গোখরো সাপ নিয়ে খেলছ। তিস্তা গ্রুপের মালিক তোমার মত শত শত স্কুলমাস্টারের পরোয়া করেন না।
-দেখা যাক স্যার।

সারারাত একটা চিন্তাই দপদপ করতে থাকে মাথার ভেতর। এ অন্যায়কে রুখতে হবে। শিশুদের রক্ষা করতে হবে। স্কুলে না এলে ওরা যে আলোর পথ থেকে দূরে সরে যাবে। কচি কচি মুখগুলো যেন মিছিল করে মনিরের চোখের সামনে। যেন বলে- স্যার, এভাবে আমরা হারিয়ে যেতে আসিনি। অথচ দানবের মত ট্রাকগুলোর ভয়ে আমরা স্কুলে আসতে পারি না।

একটা খুঁটিতে লালকাপড় জড়িয়ে স্কুলের পথে রওয়ানা হন মনির। এখনও পুরোপুরি সকাল হয়নি। তার আগেই যাবেন খুঁটিটা পুঁততে হবে…………………..।

সারাটা স্কুল জুড়ে হৈ চৈ কান্নাকাটি। চারপাশের মানুষ ছুটে আসছে পলাশপুর, আলমডাঙা, কয়রাগঞ্জের মানুষ। মনিরস্যারকে ট্রাকচাপা দিয়েছে খুনি ট্রাকচালক। তাঁর থেঁতলানো শরীরটা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে আর হাতের মুঁঠিতে শক্ত করে ধরা লাল পতাকার খুঁটিটা।

পিঁপড়ের মত সারিবদ্ধ হয়ে মানুষ আসছে। ছুটে আসছেন মহিলারা। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় তারা মূহ্যমান। তাদের সন্তানদের ভালবাসার মানুষটি যে আজ চলে গেল। ওদের মুখে স্যারের কথা শুনে কখন যেন তাদেরও আপনজন হয়ে উঠেছেন মনিরস্যার। থানার ওসি আসেন, আসে্ন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। জনতাকে শান্ত করতে পারেন না তারা।
” আমাদের দাবি এ রাস্তায় ট্রাক চলতে পারবে না। প্রয়োজনে আমরা প্রতিদিন একজন করে মরব”।

পরদিন সকালে দেখা গেল রাস্তাজুড়ে অজস্র লাল পতাকা। তিস্তা গ্রুপের গোডাউন ঘিরে আছে অসংখ্য মানুষ। তারা এখান থেকে আর কোন ট্রাক বের হতে দেবে না।