বাংলাদেশে আসার পর বইমেলায় ঢুঁ মারছি প্রায় প্রতিদিনই। বাংলাদেশে থাকাকালীন সময় ঠিক এরকমভাবে প্রতিদিনই বিকেল হলেই বইমেলার দিকে দৌড় লাগাতাম। প্রতিদিনই কখনো দু একটি বই কিনে বগলদাবা করে, কখনো বা ঘ্রাণ শুঁকেই ফিরতে হত ঘরে। বাসায় ফিরে আবার বাবা মার কাছে বায়না করতাম পরের দিন আরো দুটো একটি বই কেনার। খুব একটা সচ্ছল সংসার ছিলো না আমার বাবা মার। কিন্তু কোনদিন কোন কার্পণ্য ছিলো না বই মেলায় যাওয়ার কিংবা বই কেনার ব্যাপারে। খেয়ে হোক, না খেয়ে হোক, আমরা দু ভাই চাইলে বই তারা ঠিকই তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে।

বইমেলার সাথে এই আত্মার সম্পর্কটায় ছেদ পড়ল আমি যখন সিঙ্গাপুর চলে গেলাম ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে। এর পর সিঙ্গাপুরের পাঠ চুকিয়ে আমেরিকায়। বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকাকালীন সময়ে বহুবারই আমার দেশে যাওয়া পড়েছে, কিন্তু কখনোই বইমেলার মাসটিতে নয়। ফেব্রুয়ারির সময়টাতেই কোত্থেকে যেন ঘাড়ের উপর এসে ভর করে যত রাজ্যের ঝুট ঝামেলা। অফিসে কাজ করলেও মন পরে থাকে বই মেলায়, সেই কাঙ্ক্ষিত বাংলা একাডেমীর বই মেলায়। দেখি সাড়া মাস জুড়ে পোলাপান কত মজা মারে, রায়হান আবীরের মত জনপ্রিয় লেখকেরা দাঁত কেলিয়ে অটোগ্রাফ বিলায়, লিটল ম্যাগ চত্বরে আড্ডা মারে, পোজ দিয়ে ছবি তুলে, সেগুলো আবার আপলোড করে ফেসবুক কিংবা ব্লগে। আর আমি উদাস নয়নে সেই ছবিগুলোর দিকে তাকয়ে থাকি।

এই বছর হঠাৎ করেই ঠিক করে ফেললাম মরি আর বাঁচি – মেলায় যাচ্ছি। গেলাম। প্রায় ২২ ঘণ্টার উড়াল যাত্রার ক্লান্তি নিয়ে দেশে নামলাম ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ। মহাখালী ফার্মগেটের জ্যাম ট্যাম টপকে বাসায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে একেবারে দুপুর। আর বিকেলের মধ্যেই সব ক্লান্তি ফান্তি ভুলে বইমেলায়। তারপর থেকে প্রতিদিনই বহু মানুষের সাথেই দেখা হচ্ছে। অনেক মুক্তমনা বন্ধু যাদের কেবল ইন্টারনেটের মাধ্যমেই চিনতাম, তাদের সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হল। এই সৌভাগ্যের ব্যাপারটা গত কয়েকদিন ধরেই হচ্ছে। রায়হানের এর এর সাথে তো আগে থেকেই চেনা-জানা-পরিচয়-দেখা হয়েছিলো, তাই তারে বেশি পুছি নাই 🙂 । কিন্তু আমি না পুঁছলেও এই ছেলেটা আমারে তার বাইকে করে প্রতিদিন বাসায় পৌঁছিয়ে দেবার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। বিকেল পাঁচটা বাজলেই রায়হানের ফোন – অভিদা, আপনে কই?
আমি মেলায়।

উক্কে আমি আসতেসি।
আবার যাওয়ার সময় হইলেও সেই একই ব্যাপার।
আপনে কই?
আমি লিটল ম্যাগ চত্বরের সামনে।
উক্কে আমি আসতেসি বাইক নিয়া। আপনে থাইকেন।

রায়হান এখনো আগের মতই জনপ্রিয়!

মেলার প্রথম দিনই পেয়েছিলাম লীন আর মিথুনের এর দেখা।

আসতে না আসতেই দেখা পেয়েছিলাম মিথুন আর লীনের

এর পর একে একে শফিউল জয়, অবর্ণন রাইমস, দিগন্ত বাহার, শাফায়েত সায়কা, সাইফুল, নিলীম আহসান, অনন্যা, টেকি সাফি সহ অনেকের সাথেই। টেকি সাফির সাথে দেখা হবার দিনটি বর্ণনা করে একটি ব্লগও লিখে ফেলেছিলেন, যেটা অনেকেই এর মধ্যে পড়ে ফেলেছেন নিশ্চয়।

মুক্তমনা বেয়াদপ গ্রুপ

দেশে আসার এক দু’দিন পরেই খুব চমৎকার কিছু লোকের সাথে দেখা হয়েছে। এর মধ্যে অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শূন্য বইয়ের লেখক অধ্যাপক মীজান রহমানের সাথে দেখা হওয়াটা আমার জন্য সব সময়েই খুব আনন্দের। এই নিভৃতচারী এবং আকাশ ছোঁয়া জ্ঞানের অধিকারী আশি বছরের চিরতরুণ মুক্তমনা ভদ্রলোক এক অজ্ঞাত কারণে আমার লেখা আর কাজকর্ম অসম্ভব পছন্দ করেন। তার নতুন বই শূন্যতেও আমার সম্বন্ধে একগাদা প্রশংসা করেছেন। লিখেছেন, আধুনিক গণিত এবং বিজ্ঞানের উপর আমার যে দখল তার ধারের কাছে নাকি তিনি কখনোই যেতে পারবেন না! অথচ আমি জানি ব্যাপারটা আসলে পুরো উলটো। মীজান ভাইয়ের কাছ থেকে আমি শিখি কিভাবে অহঙ্কার বাদ দিয়ে পথ চলতে হয় প্রতিটি মুহূর্তেই, শিখি জীবনে বড় হতে হলে ছোট হওয়ার সাধনাটাই করতে হবে সবার আগে।

মীজান ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়া আমার জন্য সবসময়ই খুব আনন্দের

আসিফ মহীউদ্দিনের সাথে দেখা হওয়াটা আমার জন্য খুবই স্পেশাল। এই সদা হাস্যময় ছেলেটাকে দেখলে কে বুঝবে যে কী বারুদ লুকিয়ে আছে তার লেখায় – যে বারুদের বিস্ফোরণে প্রতিদিনই ভস্ম হয় যাবতীয় ছাগু পাগু কাগু…

এই সদা হাস্যময় ছেলেটাকে দেখলে কে বুঝবে যে কী বারুদ লুকিয়ে আছে তার লেখায়!

আর মেলায় এসেছি বলেই পাওয়া গেল পৃথ্বীর (পৃথিবী) দেখা!

দেখা হল ফারসীম ভাইয়ের (উনাকে ভাই বললে বরাবরই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে তিনি আমার জুনিয়র, কিন্তু জ্ঞান এবং পরিচিতিতে তিনি সিনিয়র বলেই তাকে ভাই ডাকা প্রথম থেকেই) সাথেও। পুরো নাম ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। ভদ্রলোকের কথা আগে অনেক শুনেছিলাম। কিন্তু কথা বলে বুঝলাম একেবারে মাটির মানুষ। বুয়েটের শিক্ষকতা করছেন দশ বছর ধরে, বিজ্ঞান লেখক হিসেবে দেশে দারুণ পরিচিত। অথচ লেখক সুলভ কিংবা শিক্ষকসুলভ কোন ভনিতা নেই। ফারসীম ভাই পরে আমাকে নিয়ে কফি খেলেন, তার প্রকাশিত অনেকগুলো বই উপহার দিসেবে দিলেন। সত্যই অসামান্য একজন মানুষের সাথে পরিচিত হলাম। এরপর যতদিন গেছে ফারসীম ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়েছে। মেলায় এসেই তিনি আমার খোঁজ করেন। আমিও তাই। দুই জন মিলে শুদ্ধস্বরের পেছনে তথ্যকেন্দ্রের সিঁড়িতে বসে বসে দুই বিজ্ঞান লেখক মিলে মহাবিশ্বের সকল রহস্যের কিনারা করে ফেলি 🙂

ফারসীম ভাইয়ের সাথে সিঁড়িতে বসে আড্ডা

এর মধ্যে একদিন আহমাদ মাঝহার আর লুৎফর রহমান রিটন ভাইয়ের সাথেও দেখা হয়ে গেল। রিটন ভাই ফাজলামো করে বললেন, ফারসীম ভাইকে নাকি এক শ্যামলা বর্ণের সুন্দরী ছাত্রী নিয়ে প্রায়ই মেলায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। পরে বেরিয়ে গেল তিনি ফারসীম ভাইয়ের স্ত্রী, যিনি নিজেও একজন সুলেখিকা! মেলায় তার প্রথম বই বেরিয়েছে, অন্য আরেক প্রকাশক এর মধ্যেই তার কাছে ধর্ণা দেয়া শুরু করেছে।

ফারসীম ভাই, মাঝহার ভাই, রিটন ভাই

দেখা হল পৃথ্বীর সাথে, দেখা হল ডিস্কাশন প্রোজেক্টের বিখ্যাত বক্তা আসিফের সাথেও। এর পর আরেকদিন তার স্ত্রী খালেদা ইয়াসমিন ইতি সহ তার পরিবারের সাথেও।

এর মধ্যে একদিন ছিলো বিজ্ঞান লেখকদের আড্ডা; যেখানে ছিলেন নতুন প্রজন্মের উজ্জ্বল বিজ্ঞান তারকারা – আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, আসিফ, রায়হান, সায়েদা লামীম আহাদ সহ আরো অনেকে। কালের কণ্ঠের ফটোসাংবাদিক হাওয়া হয়ে যাওয়ায় অগত্যা আমার ক্যামেরা দিয়েই কাজ চালাতে হল। আলোচনার শেষে নবীন সু-লেখিকা সায়েদা লামীম আহাদ তার একটি অটোগ্রাফ সহ বই (সবার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা – ফারসীম ভাইয়ের সাথে লেখা) আমাকে উপহার দিয়ে কৃতজ্ঞ করেছেন।

বিজ্ঞান লেখকদের আড্ডা

গীতাদির সাথে দেখা হওয়াটা অনেকদিন ধরেই পাওনা ছিলো। সেটা হয়ে গেল এবারে। দেখা হয়ে গেলো নিটোলের সাথেও। এর আগে দেখা হয়েছিলো আফরোজা আপার সাথে, আমাদের শাশ্বতিকীর সম্পাদক মোজাফফরের সাথেও।

মোজাফফর, আফরোজা আপা আর গীতাদি

গীতাদি এবং নিটোলের সাথে

মণিকা রশিদের কবিতার বই- ‘জলমগ্ন’-এর উদ্বোধন ছিলো গতকাল। তার বই কেনার সময় তিনি আমাকে অটোগ্রাফ দিয়ে ধন্য করলেন। মণিকা শুধু কবিই নন, সেই সাথে আবার একজন গুনি কণ্ঠশিল্পীও। তার গানের সিডিও বেরুচ্ছে এই ফেব্রুয়ারিতেই। দেখা হল সুরঞ্জনার সাথে। লিটল ম্যাগ চত্বরে প্রতিদিনই দেখা হয় নজরুলের সাথে। দেখা হয় সবজান্তা খেঁকশিয়াল, সায়কা – এই সচল গ্রুপের লোকজনের সাথেও।

বেরুলো মণিকার কবিতার বই জলমগ্ন

ব্লাডি সিভিলিয়ন ঢাকার বাইরে থেকে ট্রেনে চেপে চলে এসেছেন মেলায় বহু সমস্যা অতিক্রম করে, কেবল আমারই সাথে দেখা করার জন্য। একটা দিন ছিলেন মেলায়, এর পরদিনই ভাগলেন সাথে নিয়ে গেলেন কয়েক কপি ডয়েলের মস্তক। আমার জন্য রেখে গেলেন অমূল্য কিছু স্মৃতি। অটোগ্রাফ দিলেন অদিতি কবির। আলেক্সান্দর বেলিয়ায়েভের ‘প্রফেসর ডয়েলের মস্তক’ অনুবাদ করে মেলায় নিয়ে এসেছেন বইটি খুব কম সময়ের মধ্যেই। ছোটবেলায় খেয়াকে  চিনতাম, অভীক আর সেতুর বোন হিসেবে। আজ সে ‘এনলিস্টেড অথর’। ছেলেবেলার মেলা থেকে কীভাবে আর কতভাবে বদলে গিয়েছে সবকিছু! পলাপাইন বড় হয়া গ্যাসে!

অদিতি কবির  মানে খেয়া অটোগ্রাফ দিচ্ছেন

আজ এক ফাঁকে দেখা হয়ে গেল কবি মাহবুব লীলেন-এর সাথেও। শারমিন আর তসবিহর সাথেও দেখা হয়েছিল বইমেলায় আসার পরে।

মহাকবি লীলেন আর রায়হান

আর ছিলেন আমাদের রণদীপম বসু, যিনি ক্যমেরা হাতে সবার ছবি তুলে যান, অথচ তার ছবি তুলে না কেউ –

রণদীপম দা, এইটা কিসের বোতল খালি করলেন?

জানি অনেকের নামই বাদ পড়ে গেছে, যাদের সাথে দেখা হয়েছে। আমি যখন ছোটবেলায় বই মেলায় যেতাম, তখন দূর থেকে লেখকদের দেখতাম।  আজ  কেমন যেন অন্যরকম লাগলো সব।  আজ বাংলাদেশের বইমেলায় ঘুরে আমি বুঝি আমাদের মুক্তমনাদের বইপত্রগুলোর কী বিশাল চাহিদা তৈরি হয়েছে, কত পাঠক বইগুলোর জন্য ব্যাকুল, কেউ কেউ আমাকে পেয়ে আপ্লুত! এ আমার জন্য বিশাল সম্মানের, গর্বের। মাঝে মাঝেই ভাবি এত কিছুর যোগ্য আমি ছিলাম না, এখনো নই। পাঠকদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসার ঋণ কখনোই শুধবার নয়। কিছু কিছু ঋণ শুধবার চেষ্টাই বোধ হয় বোকামি।

আর আজকের মেলা ভাঙ্গার ঠিক আগে স্টলে হাজির হলো আমার এ বছরের (২০১২) নতুন বই – ভালবাসা কারে কয়। কালকে বইমেলায় যারা যাবেন তারা সংগ্রহ করে নিতে পারেন বইটি।

অবশেষে  বইমেলার স্টলে দেখা পাওয়া গেলো ‘ভালবাসা কারে কয়’ এর

বইটি নিয়ে একটি কথা বলা দরকার। বইটির পেছনে অনেকেরই অবদান ছিলো। অনেক পরে আমি ধরতে পেরেছি, যে ফারসীম ভাইয়ের সাথে আমি প্রতিদিনই চুটিয়ে আড্ডা মারছি, তিনিই আসলে বইটির প্রুফ রিডিং করে বইটিকে পরিবেশন-যোগ্য করে তুলেছিলেন। উনি প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন নিজের নামটি উহ্য রাখতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি আমার চোখ ফাঁকি দিতে :)। খুব ইচ্ছে ছিলো বইটি তার হাতে তুলে দিয়ে বইটির বউনি করতে, কিন্তু ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা’ গেলে মানে বই আসিবার পূর্বেই ফারসীম ভাই মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়িয়া গেলে আমি আর কী করতে পারি! অবশ্য রাত নয়টায় বই এলে তো আমার কপালকে দোষ দেয়া ছাড়া আর কিছুই করণীয় থাকে না!

যা হোক, বইটির প্রথম ক্রেতা অবধারিত ভাবে ছিল রায়হান। এর পরপরই স্টিফেন হকিং-এর গ্র্যাণ্ড ডিজাইনের অনুবাদ-খ্যাত তানভীরুল যিনি গতকালই সিঙ্গাপুর থেকে বই মেলায় এসে পৌঁছেছেন, আর ছিলো অবর্ণন রাইমস সহ আরো কয়েকজন …

সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ, যারা বইটির এই নধর গোপাল চেহারা দেখবার জন্যই কেবল মেলার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। 🙂