আমার এক খুব ছোটবেলাকার বন্ধু আছে । নাম আয়েশা । বায়ো টেকনোলজির ছাত্রী । আমার মানসিকতা সম্পর্কে ও পুরোপুরি অবহিত সেই ছোটবেলা থেকেই। আর ওর মানসিকতাও বহুলাংশে আমার মতোই । আমরা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এক ক্লাস ,এক সেকশনে পড়েছি । কলেজেও একসাথে পড়েছি যদিও ডিপার্টমেন্ট ছিল আলাদা । কখনো আমরা একসাথে স্কুল এ দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি আব্বু দের ইসলামি নিষেধ অমান্য করে, তো কখনো শুধুমাত্র তাদের রাগানোর জন্য সরস্বতী পুজোয় কলেজে গিয়ে অঞ্জলি দিয়েছি । বাড়ি ফিরে মার, বকা খেয়েও বেয়াদপি কমেনি । ধর্ম নিয়ে কতই না মজা করেছি । ও বলতো “আরবী লেখা দেখলে কি মনে হয় বলতো ? মনে হয় , কালিতে ডুবিয়ে গোটা চারেক পিঁপড়ে কে সাদা কাগজে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ।” সেই দিন গুলো এখন খুব মিস করি ।
যাইহোক , আগের বছর ওর বিয়ে হয়েছে এক মাদ্রাসার টিচার এর সাথে । এবার কোরবানি তে বেশ কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছিল । আমায় অনেক গল্প শোনালো । দুজনে একসাথে কাল আইস ক্রিম ও খেলাম । সেই আগে যেখানে যেখানে ঘুরে বেড়াতাম ওই জায়গা গুলোতে ছবি তুললাম একসাথে ।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ও হঠাৎ বলল, “ অনেক তো হল । এবার একটু বিয়ে টিয়ের কথা ভাব !”
বুঝলাম , আব্বু বলতে বলেছে । আমি একটু মজা করেই বললাম, “জানিস তো , আমার মত নাস্তিক কে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না । একে উচ্চ শিক্ষিত, তার উপর নাস্তিক… এমন মেয়ে কখনো কেউ পছন্দ করে নাকি?” ।
ও বলল , “এবার ছাড় তোর পাগলামি ! এবার একটু আল্লাহ কে মান । তিনি পরম করুণাময় । সব তার ইচ্ছাতেই হয় । তোর ও বিয়ে ঠিক হবে ।”
আমি অবাক ! আমার বন্ধু তো এরকম ছিল না ! কি হল ওর ? ভাবিনি ও কখনো এরকম কথাও বলতে পারে । কিন্তু এখানেই শেষ নয় । এর পর আরও অবাক করে ও আমায় এক নাগাড়ে সে বলতে শুরু করল—- “এই যে মানুষ দেখছিস ! তোর বিজ্ঞান কি বলেছিল কখনো যে, সব মানুষ কেই একদিন মরতে হবে ? নবী সাঃ কতদিন আগে বলেছিলেন বলতো ! শুধু কি তাই ? তার পর কি হবে তাও বলেছেন । এই যে হলিউডের সিনেমা ২০১২ , সব তো কোরানের কথা । জানিস তেঞ্জিং নোরগে চাঁদে গিয়ে আযান শুনতে পেয়েছিলেন ! (আবেগের বশে হয়ে যাওয়া ভুল!)। জানিস মাইকেল জাক্সন থেকে জোলি পর্যন্ত সবাই আজ ইসলাম গ্রহণ করেছে । আরো, তুই মুসলিম ঘরে জন্মেছিস এটা তোর ভাগ্য ! আর তুই ইসলাম কেই অস্বীকার করছিস !!”
বলতে বলতে ওর ফরসা গাল আর কানের লতি লাল হয়ে যাচ্ছিল । আমি হতবাক । এই মেয়ে বায়ো টেকনোলজি তে এম এস সি ! কি করে এমন কথা বলতে পারলো ! দর্শন আর তুলনামূলক ধর্মের ছাত্রী হয়ে আমিই এসব বলি না , আর ও নিজেই কিনা বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে… ! আমি বললাম, “এসব কি বলছিস তুই ! তুই না বায়ো টেকনোলজির ছাত্রী !”
এবার আরও অবাক হওয়ার পালা । ও বললো ,“এইসব দুনিয়াদারির পড়াশুনা আখিরতে কাজে লাগে না রে ! এসবের মধ্যে কেবল মিথ্যা আর আপেক্ষিক কথা আছে । চরম কথা বলা আছে কোরআনে । এই সব ভুলে যা । শিক্ষার অহংকার ভাল নয় । এবার আল্লাহ কে মেনে নে । তার অগোচরে কিছুই নেই । ”
আমি অবাক হয়ে গেলাম । কোনও কথা বললাম না । শুধু ভাবলাম, এত বছরের শিক্ষাটা ও একটা আরবি মাস্টার এর কথায় এইভাবে জলে দিয়ে দিলো । তার যুক্তি কিনা এই সব মিথ্যা স্টেটমেন্ট ! না ,আমি ওকে আর ওর মিথ্যা ধারনা গুলো শোধরাতে চাইনি । বুঝলাম ও এখন এতটাই বিভ্রান্তি তে আছে যে ও আমার সাথে বন্ধুত্ব টাও নিমেষেই ত্যাগ করতে পারে । হয়ত ওকে আমার কম্পিউটার এর সামনে এনে ওর ভুল গুলো ভাঙ্গাতে পারতাম । কিন্তু তাতে ওর বর যদি ওকে আর এইবাড়ি আসতে না দেয় বা আমার সাথে মেলামেশা করতে বারণ করে— এই ভেবে চুপ রইলাম । ভাবলাম, ইসলামের কি মাহাত্ম্য ! ( ২৯ শে নভেম্বর,২০১১ )
আমি এই রকম অনেক অনেক দেখেছি।আসলে এদের নাস্তিকতার যেমন কোনো যুক্তি ছিলোনা, তেমন আস্তিকতারও কোনোও যুক্তি নেই। আমার এক বন্ধুকে দেখেছি এক সময় কত গুছিয়ে বোঝাত যে, ঈশ্বর অন্যকিছু নয় মানুষের কল্পনামাত্র।আর আজ দেখি সে অত্যন্ত ভক্তিভরে পুজো করে , না দায় সারা করে নয়, প্রতিটি আচার নিষ্ঠাসহ পালন করে।আমি তার এই দ্বিচারিতায় অবাক হয়ে তাকে নিয়ে একদিন বসলাম। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি করেন না ? উনি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেন উনি নাস্তিক, কিন্তু পুজো আচ্চা এসব সামাজিক ক্রিয়া , এগুলো করলে সমাজে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।
আমি অনেক রকম ভাবে বুঝলাম উনি আসলে ছিলেন সংশয়বাদী, যার উত্তরণ আশা করেছিলাম, সামাজিক সুবিধার প্রলোভনে উনি আজ আস্তিক। যদিও আমার কাছে বলেন উনি নাস্তিক। আপনার বন্ধুটিও তাই ।বিয়ে থা’র পরে আর মুক্ত চিন্তার পতাকা বহন করতে চান না, তাতে অসুবিধা অনেক। তার থেকে স্বামী সেবা করে বেহেস্ত পাওয়া অনেক সহজ।(জানিনা বেহেস্তে গিয়ে মেয়েরা কি সুখে থকবে, ওখানে তো ছেলেদেরই পোয়া বারো।) আর মাদ্রাসার টিচার মানেই কিন্তু সবাই আস্তিক নয়। আমি হাতিয়াড়া হাই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলাম, আমার আরেক বন্ধু খায়রুলও ওখানকার টিচার ছিলো। ও মুর্শিদাবাদের ছেলে, একবার তো নাড়িদের (আসলে নারিদের নিয়ে, উচ্চারণটা ওইরকম করছিলো মাওলানা সাহেবের অনুকরণ করে।)একটা দারুণ বক্তৃতাও করেছিলো।আর একটা কথা ,চবায়ো টেকনোলজির কাউকে বিশেষ করে চিহ্নিত করতে হয়না, অনেক অনেক বিজ্ঞানের লোকও দেখি জামার ভিতরে তাবিজ-মাদুলি নিয়ে দিব্বি বসবাস করছে সুখে ও শান্তিতে(!)।
শৈশবে হয়ত আপনার ইসলাম সম্পর্কে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেশিরভাগ নাস্তিক, যারা পরবর্তিতে আস্তিক হয়না, তাদের মধ্যে শৈশবের অভিজ্ঞতাটাই কাজে দেয়। উপমহাদেশে ইসলাম কে যতভাবে “পরিবর্ধন, পরিমার্জন” করা হয়েছে, তা আর কথাও হয়নি। যে যা খুশি তাই বলে, ইসলামের নামে চালিয়ে দেয়! জানে যে এখানে ধরার কেউ নেই। আর শুধু ইসলাম কেন, ডাক্তারি, গবেষণা, অর্থনীতি, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়েও এখানে নৈরাজ্য চলে।
আস্তিক হওয়ার চেয়ে নাস্তিক হওয়াটা অনেক কঠিন। শুধু মাত্র বিশ্বাসে আস্তিক্য সহজ। তারপরে আসে নাস্তিক্য– কিছু জ্ঞান এর সনন্বয়ে। সবকিছু জেনে বুঝে ভালমত চিন্তা করলে আবার আস্তিক্য তে ফেরত আসতে হয়। গভীর জ্ঞানে নাস্তিক্য যুক্তিগ্রাহ্য নয়, মধ্যম জ্ঞানে যুক্তিগ্রাহ্য।
ইসলাম ধর্ম হিসেবে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হলেও, বর্তমান বিশ্বে এর পালনকারীরা সবচেয়ে দুর্বল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইসলামকে এরা না জেনেই পালন করে।দ্বিতীয়ত, শক্তিশালী ধর্ম হওয়ার কারণেই অন্যান্য সব ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে বেশ সতর্ক। তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অবস্থা দাড়িয়েছে এই যে, মুসলিমরা নিজেদের মূল কেই ভয় পায়। ১০ বছর আগেও দাড়ি-টুপি ওয়ালাদের কে মানুষ সম্মান করত, এখন জামাত আর বাংলা ভাইদের বদৌলতে দাড়ি-টুপি ওয়ালাদেরকে দেখলে আমার নিজেরই মনে হয় ‘জঙ্গি’।
ক্ষুদ্র সত্তা বলেছেন….
সহমত।
একটা কথা বলি। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেয়েরাই বিয়ের পর স্বামীর কথামত চলাকেই নিজের ধর্ম মনে করে। স্বামী নাস্তিক হলে হয়ত প্রচণ্ড ধার্মিক মেয়েও এক সময় যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করা শুরু করে। কিংবা স্বামীর সাথে তাল মেলানোর জন্য হয়তো না বুঝেই স্বামীকে সমর্থন দেয়। আর ধর্মের ব্যাপারটা তো জন্ম থেকেই শুরু, ধর্মের শেকল ছিঁড়ে বের হওয়া অনেক কঠিন। সেক্ষেত্রে নাস্তিক বা সংশয়বাদী কোন মেয়ে যদি গোঁড়া ধার্মিক কাউকে বিয়ে করে, তাহলে এই ঘটনা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, বিরোধিতা করলে স্বামীর অত্যাচার, শ্বশুর বাড়ির লোকজনের অত্যাচার, প্রতিবেশীদের অত্যাচার, সমাজের অত্যাচার সবকিছু জেঁকে বসে। শারীরিক, মানসিক সব ধরনের অত্যাচারই তো হয়। এমনিতেই অত্যাচারের সীমা নেই, তার উপর নাস্তিক হলে তো নিতান্ত ভাল মানুষও সকলের কাছে সাক্ষাত শয়তান হয়ে যায়।
আমার বান্ধবী বায়োটেকনলজির ছাত্রী… সে একই সাথে আদম-হাওয়া ও বিবর্তন ২টাই বিশ্বাস করে… কিভাবে সম্ভব মাথায় ঢুকে না!!!
পড়লাম এবং ভালো লাগলো। গল্পটা বাস্তব এবং সত্য। এখানে সত্যি বলতে কি ইসলামের না যতটা মাহাত্ম জৈবিক চাহিদা পূরণের মাহাত্ম আরও বেশি। মূলত অধিকাংশ মানুষই বিয়ের পর এই কারণে চেঞ্জ হয়ে যায়।এটা আমার অভিজ্ঞতা।
@অগ্নি, কিন্তু আমাকে জেনেও আমার কাছে ভণ্ডামি করার প্রয়োজন কি ?
অাসলে বেশিরভাগ মানুষই একটা সীমার বাইরে ভাবতে পারেনা!মুক্তমনা হওয়া সহজ ব্যাপার না।অামার পরিচিত অনেক বিজ্ঞানের প্রফেসরকে পর্যন্ত বলতে শুনেছি,”কিছু তো একটা শক্তি অবশ্যই অাছে!”
মহসিনা খাতুন,
আপনার বন্ধুটির মতো আমারো অনেক বন্ধু আছে। আমার কিছু বাড়তি বন্ধুও(?) আছে, ওরা নিধার্মীক থেকে ধার্মীক বা এ দুয়ের মাঝামাঝি কোন পর্যায়ে এসেছে। এরা আর কিছু না করলেও শুক্রবারের নামাজ কখনো বাদ দেয় না। সদলবলে মসজিদে যায়। কিন্তু বাকী যা করে তার মধ্যে অন্যতম হলো, সত্যকে অস্বীকার করা, সুযোগ মতো কারো বিরুদ্ধে মিথ্যে স্বাক্ষী দেওয়া, নিজে কোন কাজ বা কথা দিয়ে পরে তা অস্বীকার করা, কখনো কখনো প্রতারণা বা ব্ল্যাকমেইল করা। কমিউনিটির কেউ যদি সাফল্য পায় বা পেতে চেষ্টা করে, তবে তাকে সদলবলে হেনস্থা করা বা দমিয়ে রাখা। আর এর সবই হলো প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা বা খুবই সাধারন স্বার্থগত কারণে। এরা সবাই উচ্চশিক্ষিত! ভাবুনতো ব্যাপারখানা! ধর্ম এদের কতোটা ঐক্য আর বিলাস দিয়েছে!
নাহ্ বিয়েটা মনে হয় আপনার আর হচ্ছে না…হুম।
বোঝা গেল আমাদের দেশের মেয়েদের স্বাধীন চিন্তার কোন অপুশন নেই… স্বাধীন মেয়েরও স্বামীর কথামতো চলতে হয়, মগজ ধোলাই হতে হয়!
প্রথম যৌবনে একটু নাস্তিকতার ঘ্রাণ নিয়ে পরে ঘরের ছেলে মেয়েরা আবার ঘরেই ফিরে যাওয়ার ঘটনা হরহামেশাই দেখা যায়। এক সময় কট্টর বাম রাজনীতি করা অনেক ছেলেদের দেখেছি কট্টর ধার্মীকে রূপ নিতে। শুধু আপনার বন্ধুটির বেলায় এমনটি ঘটেছে এটা ভেবে নেয়ার কোন কারণ নেই।
বিশ্বাসের প্রাচীর ডিঙানো মোটেই সহজ নয়।
@রাজেশ তালুকদার, ঠিক বলেছেন । তবে আমি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবই ।