নিউরণের গল্পর পরবর্তী অংশ

নিউরণের গঠন নিয়ে অনেক হৈচৈ করলাম, এইবার একটু দেখি, স্নায়ুকোষ কিভাবে কাজ করে, কিভাবে তথ্য পরিবহন করে, তার কার্যনীতিটা কেমন?

আগেই বলেছি, মানব দেহের ভিতরে যা কিছুই হয়, তা মূলত কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া। কিংবা একটি অনুর অথবা আয়নের দেহের ভিতরে একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় যাওয়া। সুতরাং নিউরণের কার্যক্রমেও যে অনু পরমাণু বা আয়নের একটা জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়াই হবে, সে নতুন কিছু নয়।

কোষের ভিতরে এবং বাইরে আছে তরল পদার্থ এবং তাতে ভেসে বেড়ায় কিছু আয়ন, প্রোটিন ইত্যাদি। ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করা যেতে, খাবার লবন এবং অন্যান্য ধরণের কিছু লবণ, কিছু অদ্রবণীয় পদার্থকে যথেষ্ট পরিমাণ পানির মধ্যে ভালোভাবে মিশ্রিত করে খুব ছোট ছোট ফুটো বিশিষ্ট কোন পর্দার মাধ্যমে একটি পাত্রে বিশুদ্ধ পানি থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। পর্দাটি সেক্ষেত্রে কোষ পর্দার মত কাজ করবে, তবে শর্ত হল, পর্দাটি হতে হবে সেমি পারমিয়েবল বা সিলেকটিভলি পারমিয়েবল। তাহলে সেমি পারমিয়েবল পর্দার বাধা অতিক্রম করে আয়ন এবং অন্যান্য পদার্থগুলো উচ্চ ঘনত্বের তরল থেকে বিশুদ্ধ তরলের দিকে যেতে চেষ্টা করবে। কোন আয়নকে যেতে দেবে, আর কোন আয়নকে যেতে দেবে না, তা নির্ভর করবে, মধ্যস্থ পর্দাটি কখন কোন আয়ন বা পদার্থের জন্য কতটুকু অতিক্রম যোগ্য, তার উপর। এইভাবে কিছু আয়ন থাকে কোষের ভিতরের তরলে আর কিছু আয়ন কোষের বাইরের তরলে। আর এই দুই তরলকে আলাদা করে রাখে সেল মেমব্রেন বা কোষ পর্দা নামের একটি সেমি-পারমিয়েবল পর্দা, যা সিলেকটিভলি পারমিয়েবলও বটে। যার মধ্য দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট অনু যেতে পারে, আর কিছু অনু যেতে পারে না। অর্থাৎ, কিছু রাসায়নিক দ্রব্যকে সে সময় মত যেতে দেবে, আবার সময় মত যেতে দেয় না।

কোষের বহিস্থ এবং অন্তস্থ তরলে আয়নের ঘনত্ব ভিন্ন আর তার পরিপ্রেক্ষিতে, তাদের বৈদ্যুতিক বিভব বা ইলেক্ট্রিক পটেনশিয়াল ভিন্ন তাদের মাঝে যে বাধা তৈরী করে রেখেছে, তা শিথিল করে দিলে এদের মধ্যে উভয় কারণে প্রবাহের সৃষ্ট হবে। যেদিকে পটাসিয়াম আয়নের ঘনত্ব বেশী, সেদিক থেকে K+ নিম্ন ঘনত্বের তরলে যাবার প্রবনতা দেখা যাবে, আবার যেদিকে ধনাত্মক চার্জের পরিমাণ বেশী সেদিক থেকে ঋণাত্মক চার্জের আধিক্য বিশিষ্ট তরলের দিকে ধনাত্মক চার্জের যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাবে। এই দুই বিপরীতমুখী প্রবাহের একটা সাম্যবস্থার কারণে স্থিতিশীল অবস্থায় সাধারণত কোষের বহিস্থ এবং অন্তস্থ তরলের নির্দিষ্ট বৈদ্যুতিক বিভব পার্থক্য পাওয়া যায়, যাকে বলে রেস্টিং পটেনশিয়াল বা রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়াল।

ছবিঃ রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়াল

স্থিতিশীল অবস্থায়, কোষের অন্তস্থ তরলে বহিস্থ তরলের তুলনায় ঋণাত্মকতা দেখা যায়। ধরে নেয়া হয়, বহিস্থ তরলের বিভব সর্বদা শুণ্য(০) ভোল্ট যার সাপেক্ষে অন্তস্থ তরলের ধনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জের আধিক্য হলে অন্তস্থ তরলকে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জে চার্জিত বিবেচনা করা হয়। সাধারণত, স্থিতিশীল অবস্থায় অন্তস্থ তরলের রেস্টিং মেমব্রেন পটেশিয়াল -৭০ মিলিভোল্ট। নিউরণের রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়াল -৪০ মিলিভোল্ট থেকে -৭৫ মিলিভোল্ট পর্যন্ত দেখা যায়।

কোষের বহিঃস্থ তরলে সাধারণত, সোডিয়াম আয়ন, ক্লোরাইড আয়ন আর কোষের অন্তস্থ তরলে পটাসিয়াম আয়ন, ফসফেট যৌগ আর কিছু অদ্রবণীয় অণু, বিশেষ করে প্রোটিন অণুর ঘনত্ব বেশী পাওয়া যায়। একটা সাধারণ নার্ভ সেলের বহিস্থ তরলে, সোডিয়াম আয়ন, ক্লোরাইড আয়ন আর পটাসিয়াম আয়নের ঘনত্ব যথাক্রমে ১৫০, ১১০, ৫ মি.মোল/লিটার যেখানে অন্তস্থ তরলে এদের ঘনত্ব যথাক্রমে ১৫, ১০, ১৫০ মি.মোল/লিটার। চার্জিত আয়নের ঘনত্বের এই ভিন্নতাই কোষের ভিতরে এবং বাইরে বৈদ্যুতিক বিভব পার্থক্য তৈরী করে। কিভাবে বিভিন্ন আয়নের ঘনত্বের পার্থক্য কোষ পর্দায় বৈদ্যুতিক বিভ পার্থক্য সৃষ্টি করে, তা বোঝার চেষ্টা করি একটু। কোষদেহের বহিস্থ তরলে সোডিয়াম আয়নের ঘনত্ব বেশী অন্তস্থ তরলের তুলনায়, তাই সোডিয়াম আয়নের অন্তস্থ তরলের দিকে যাবার প্রবণতা আছে। কিন্তু কোষ পর্দা, স্থিতিশীল অবস্থায় সোডিয়াম আয়নের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে অতিক্রমযোগ্য নয়, বলতে গেলে স্থিতিশীল অবস্থায় কোষ পর্দায় সোডিয়াম আয়নের অতিক্রমযোগ্যতা খুব নগণ্য, ধরা যেতে পারে, প্রায় শুণ্যের কোঠায়। অপরদিকে কোষ পর্দা, স্থিতিশীল অবস্থাতে পটাশিয়াম আয়নের জন্য সোডিয়াম আয়নের চেয়ে বেশী অতিক্রমযোগ্য। এবং অন্তস্থ তরলে পটাসিয়াম আয়নের ঘনত্বও বহিস্থ তরলের চেয়ে বেশী। তাই পটাসিয়াম আয়ন কোষের ভিতর থেকে বাইরের দিকে যেতে চায়, যতক্ষণ না উভয় তরলের পটাসিয়াম আয়নের ঘনত্ব সমান হয়। কিন্তু যখনই পটাসিয়াম আয়ন কোষের অন্তস্থ তরল ছেড়ে বহিস্থ তরলের দিকে যাচ্ছে, তখনই কোষের বাইরে ধনাত্মক আয়নের আধিক্য বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং কিছু ধনাত্মক পটাসিয়াম আয়ন চাইবে এইবার অন্তস্থ তরলে প্রবেশ করে কোষ পর্দার উভয় দিকে আয়নিক সাম্যাবস্থা রক্ষা করতে। এইভাবে কোষ ঝিল্লি দিয়ে অনবরত পটাসিয়াম আয়নের আদান প্রদানের বিপরীতমুখী প্রবাহ চলতে থাকে। যে মেমব্রেন পটেনশিয়ালে এই দুই বিপরীত মুখী প্রবাহের মান সমান হয়ে যায়, সেই পটেশিয়ালকে বলে রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়াল। স্থিতিশীল অবস্থায় যেহেতু সোডিয়াম আয়নের জন্য কোষপর্দার অতিক্রমযোগ্যতা পটাসিয়ামের চেয়ে অনেক অনেক কম থাকে, তাই এই রেস্টিং পটেনশিয়াল সৃষ্টির জন্য কোষীয় তরলে উপস্থিত পটাসিয়ামই মূলত দায়ী। ঋণাত্মক আয়নগুলো, যেমন ক্লোরাইড আয়ন উভয় দিকের তরলে অবস্থিত ধনাত্মক আয়ন দ্বারা অনেকটাই নিস্ক্রিয় হয়ে থাকে, তাই রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়ালে ঋণাত্মক আয়নের ভূমিকাকেও নগণ্য ধরা যায়।

অর্থাৎ রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়ালের মান নির্ধারিত হয় দুইটি বিষয়ের উপরে, ১/ অন্তস্থ এবং বহিস্থ তরলের আয়নের ঘনত্ব, ২/ সেল মেমব্রেন বা কোষ পর্দা কোন ধরণের আয়নের জন্য কতটা অনুপ্রবেশযোগ্য (permeable)।

মেমব্রেন ট্রান্সপোর্টঃ এইযে এতো কথা বলছি অতিক্রমযোগ্যতা বা পারমিয়াবিলিটি নিয়ে, এই ব্যাপারে একটু ধারণা পরিষ্কার করে নিই। কোষীয় জীববিজ্ঞানে, মেমব্রেন ট্রান্সপোর্ট শব্দটি কতগুলো নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়াকে বুঝায় যার মাধ্যমে কোষ পর্দা দিয়ে বিভিন্ন পদার্থের আদান প্রদান চলে। এই কোষ পর্দার বিন্যাসটাও ইন্টারেস্টিং! কোষ পর্দার ভিতরের দিকে থাকে লিপিড জাতীয় পদার্থের লেয়ার, যা জল বা আয়নিক যৌগ গুলোকে তার মধ্য দিয়ে অবাধে চলতে দেয় না। এই স্তরটি হাইড্রোফোবিক, যা পোলার যৌগগুলোকে বিকর্ষণ করে। এই স্তরকে মাঝে রেখে এর উভয় পাশে হাইড্রোফিলিক পদার্থের স্তর দেখা যায়, যা আবার পোলার যৌগকে আকর্ষন করে। মাঝে লিপিডের স্তরবিশিষ্ট উভয়দিকে হাইড্রোফিলিক পদার্থের তৈরী এই কোষপর্দাটি হল লিপিড বাইলেয়ার। কোষ পর্দার গঠন এমন, যে এটি পোলার বা অপোলার যৌগ কারোর জন্যই সহজে অতিক্রম যোগ্য না, যদি কোষপর্দায় বিশেষ ধরণের পদার্থের জন্য বিশেষ ধরণের ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা না করা হয়। ধরে নিন, সামনে একটা নদী আছে, নদীর এপার থেকে ওপারে যেতে ব্রিজের ব্যবস্থা করতে হবে, বা নৌকার সরণাপন্ন হতে হবে।

ছবিঃ লিপিড বাইলেয়ার কোষপর্দা

কোষ পর্দায় মোটামুটি কয়েক ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা বা ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম আছে। নিউরণের কার্যনীতি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ব্যাখ্যা করছি।
১. প্যাসিভ ডিফিউসন বা ফ্যাসিলিটেড ডিফিউসন অফ আয়নঃ এই প্রক্রিয়ায় কোষ পর্দার বাধা অতিক্রম করে আয়নগুলো কোষের ভিতরে- বাহিরে যাওয়া আসা করতে পারে। এই আয়ন ট্রান্সপোর্ট নির্ভর করে, মূলত, আয়ন ঘনত্ব এবং বৈদ্যুতিক বিভব পার্থক্যের উপর। এইক্ষেত্রে যখন বাইরে পরিবেশে কোন পরিবর্তন আসায় কোষপর্দায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তখন পর্দায় উপস্থিত কিছু প্রোটিনের আকারগত পরিবর্তন হয়, এই প্রোটিনগুলো জলীয় কণা পূর্ন একধরণের চ্যানেল তৈরী করে যার মধ্য দিয়ে সহজেই আয়ন চলাচল করতে পারে। বাইরে থেকে লিগ্যান্ড নামের একটা মলিকুলার সিগ্যনাল আসতে পারে, যা প্রোটিনের গঠনে আয়ন চলাচলের উপযোগী পরিবর্তন আনতে পারে। অথবা একটা মেক্যানিকাল সিগন্যাল, যেমন শব্দ এসে কানের পর্দাকে আঘাত করে, যার ফলে কানের ভিতরে অবস্থির সংবেদনশীল হেয়ার সেলে কম্পন সৃষ্টি হতে পারে, যা হয়ত শেষ অব্দি আয়ন পরিবহনকারী প্রোটিনের গঠনে ভূমিকা রাখে। কিছু আয়ন চ্যানেল আছে, যারা একটা নির্দিস্টি ভোল্টেজ পেলেই আয়ন পরিবহনের জন্য রাস্তা করে দেয়।

অর্থাৎ স্থিতিশীল অবস্থায়, লিপিড বাইলেয়ার মেমব্রেন অধিকাংশ আয়ন বা পোলার যৌগের জন্য অনতিক্রমযোগ্য, কিন্তু যখন একটি নির্দিষ্ট পরিবর্তন বাইরের পরিবেশে আসে, তখন কিছু বিশেষ ধরণের কোষ ঐ পরিবর্তনের কারণে মেমব্রেনে উপস্থিত প্রোটিন চ্যানেলগুলো খুলে দেয়, যার ফলশ্রুতিতে আয়ন মেমব্রেনকে অতিক্রম করতে পারে। তবে এইরকম আয়ন চলাচলের জন্য চ্যানেলগুলো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য খোলা থাকে না, একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। এই ধরণের আয়ন চ্যানেলগুলোর জন্য কোষীয় শক্তি ব্য্যের প্রয়োজন হয় না।

২. অ্যাকটিভ ট্রান্সপোর্টঃ এই ধরণের ট্রান্সপোর্ট কোষের জন্য কিছুটা স্বভাব বিরুদ্ধ। অনেকটা স্বাভাবিক ভাবে যে ট্রান্সপোর্ট হবার কথা ছিল না, তাই ঘটে, কোষীয় শক্তি ব্যয়ের ফলে। নিউরণের কাজের জন্য অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ অ্যাক্টিভ ট্রান্সপোর্টের নাম সোডিয়াম-পটাসিয়াম পাম্প। যখন কোষের ভিতরে বাইরে থেকে স্টিমুলেশন যাবার কারণে আয়ন চ্যানেল দিয়ে অনেক সোডিয়াম আয়ন ঢুকে যায়, আর সেই তুলনায় কম পটাসিয়াম আয়ন কোষের বাইরে আসার কারণে কোষের ভিতরের বৈদ্যুতিক বিভব বাইরের তুলনা বেশী ধনাত্মক হয়ে যায়, তখন সোডিয়াম পটাসিয়াম পাম্প চালু হয়। এই পাম্প প্রত্যেক বারে কোষের ভিতর থেকে তিনটি সোডিয়াম আয়ন বের করে দেয় আর দুটি পটাসিয়াম আয়ন বাইরে থেকে ভিতরে নিয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে কোষের ভিতরে ধনাত্মন চার্জের সংখ্যা কমতে থাকে এবং ক্রমাগত কোষের ভিতরের বৈদ্যুতিক বিভব রেস্টিং পটেনশিয়ালের দিকে ধাবিত হয়। এইখানে লক্ষ্যনীয়, সোডিয়াম পটাসিয়াম পাম্প সোডিয়াম আয়নকে নিম্ন ঘনত্বের তরল থেকে উচ্চ ঘনত্বের তরলের দিকে নিয়ে আসে, পটাসিয়ামের ক্ষেত্রেও একই কথায় প্রজোয্য। অর্থাৎ স্বাভাবিক ভাবে যা হবার কথা ছিল না, পাম্প দিয়ে জোর করে তাই ঘটানো হয়েছে, আর এর জন্য কোষকে শক্তি ব্যয় করতে হয়। ATP অনু ADP তে পরিণত হয়ে সোডিয়াম পটাসিয়াম পাম্পকে এই বাড়তি শক্তিটা যোগান দেয়।

কিভাবে তথ্য প্রবাহিত হয়?
রেস্টিং পটেনশিয়াল থেকে খুব সামান্য সময়ের জন্য যখন মেমব্রেন পটেনসিয়ালে পার্থক্য আসে, তা ইলেক্ট্রিক সিগ্যনাল তৈরী করে, যার মাধ্যমে নার্ভাস সিটেম তথ্য পরিবহন করে। এই ইলেক্ট্রিক সিগ্যনাল দুইভাবে তৈরী হয়, গ্রেডেড পটেনশিয়াল এবং অ্যাকশন পটেনশিয়াল আকারে।

গ্রেডেড পটেনশিয়ালঃ মেমব্রেন পটেনসিয়ালে পরিবর্তন যখন অপেক্ষাকৃত সল্প এলাকাজুড়ে সঙ্ঘটিত হয়, তখন তাকে গ্রেডেড পটেনসিয়াল বলে, যা সাধারণত, উৎসের ১-২ মিলিমিটারের মধ্যের নিঃশেষ হয়ে যায়। বিশেষ অঞ্চলের কোষে, বিশেষ ধরনের স্টিমুলাসের কারণ যখন কোষের পরিবেশে পরিবর্তন আসে, তখন যে গ্রেডেড পটেনশিয়াল তৈরী হয়, পথিমধ্যে তার মান ক্রমাগত কমতে থাকে এবং একসময় তা নিশেঃষ হয়ে যায়। কাজের ধরন অনুসারে, গ্রেডেড পটেনশিয়ালকে রিসেপটোর পটেনশিয়াল, সিন্যাপটিক পটেনসিয়াল, পেসমেকার পটেনসিয়াল নাম দেয়া হয়।

যখন কোন মেম্ব্রেনে স্টিমুলাস জনিত পরিবর্তন আসে, তখন সেখানে খুব দ্রুত বিভিন্ন ধরনের চার্জের আদান প্রদান হয়, যার ফলাফল হিসেবে, কোষের আভ্যন্তরীন পরিবেশের বিভব পরিবর্তন হয়, যা সৃস্টি করে গ্রেডেড পটেনশিয়াল। স্টিমুলাস বা কোষদেহে উত্তেজনা সৃস্টিকারী ঘটনার উপর নির্ভর করে কোষের আভ্যন্তরীন বিভব আরো ঋণাত্মক হতে পারে বা এর ঋণাত্মকতা হ্রাস পেতে পারে। বিভবের পরিবর্তন যেভাবেই ঘটুক না কেন, গ্রেডেড পটেনিশিয়ালের ক্ষেত্রে কোষের প্রবণতা থাকবে আগের বিভবে বা রেস্টিং পটেনশিয়ালে ফিরে যাওয়ার। বিভবের পরিবর্তন যত বেশী হয়, সেল মেমব্রেন বরাবর বিদ্যুত প্রবাহ তত বেশী হয়।

খুব সহজ করে বলতে গেলে গ্রেডেড পটেনশিয়ালে একটা ইলেক্ট্রিক তারের মধ্য দিয়ে যেভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, নিউরণে উত্তেজনার কারণে মেমব্রেন পটেনশিয়ালে পরিবর্তন আসলে মেমব্রেন বরাবর সেইভাবেই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবার কথা। কিন্তু কোষ পর্দায় যে ফুটো আছে, তার কারনে ইলেক্ট্রিক পটেনশিয়াল রেস্টিং পটেনশিয়াল থেকে পরিবর্তিত হবার পর সেইখানে স্থির হয়ে থাকেনা, অনেকটা, ইলেক্ট্রিক তারে যদি অপরিবাহী পদার্থের আবরণ না থাকে, তাহলে ইলেক্ট্রিক তার থেকে আশেপাশে বিদ্যুৎ পরিবহনের সূযোগ পাওয়া মাত্র বিদ্যুৎ সেই দিকে প্রবাহিত হয়ে যাবে, যেভাবে হাতে ধরা তারের গায়ে ফুটা থাকলে আপনি হাতে শক খাবেন, অথবা পানির পাইপের মধ্যিপথে একটা ছোট্ট ফুটো করে দিলে সেই ফুটো দিয়ে খুব চিকন ধারায় পানি বের হতে শুরু করবে, সেইভাবে মেমব্রেনের চোরা পথ দিয়ে (আয়ন চ্যানেল) আয়ন বেরিয়ে বিভবের মান পরিবর্তন করে দেয়। কোষ পর্দাকে বিদ্যুতের তারের মত কল্পনা করলে, কোষ পর্দা বরাবর যে বিদ্যুৎ প্রবাহ, তাতে অন্তস্থ এবং বহিস্থ তরলে আলাদা আলাদা ভাবে উচ্চ চার্জ ঘনত্বের স্থান থেকে নিম্ন চার্জ ঘনত্বের দিকে চার্জ প্রবাহিত হয়। কিন্তু দুরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্তস্থ তরল থেকে বহিস্থ তরল এবং বহিস্থ তরল থেকে অন্তস্থ তরলে চার্জ আসায় সেল মেমব্রেন বরাবর বৈদ্যুতিক বিভবের মান হ্রাস পায় তথা বিদ্যুৎ প্রবাহের মান কমতে থাকে, এবং এইভাবে একসময় মেমব্রেন পটেনসিয়াল রেস্টিং পটেনসিয়ালে ফিরে আসে যা স্থিতি অবস্থা নির্দেশ করে।

যেহেতু দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে ইলেক্ট্রিক সিগ্যনালের মান কমাগত হ্রাস পায় তাই কোষের এই বিভব পরিবর্তনকে বলে গ্রেডেড পটেনশিয়াল। এর মাধ্যমে কেবল স্বল্প দূরত্বে তথ্য সঞ্চালন সম্ভব হয়, কিছু কিছু নিউরণের ক্ষেত্রে গ্রেডেড পটেনশিয়ালই তথ্য সঞ্চালনের একমাত্র উপায়, যদিও বেশী দূরত্বে তথ্য সঞ্চালন সৃষ্টি করা বা মস্তিষ্কের কাজের মাঝে সমন্বয় সাধন করার জন্য গ্রেডেড পটেনশিয়ালের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

অ্যাকশন পটেনশিয়ালঃ
অ্যাকশন পটেনশিয়াল গ্রেডেড পটেনশিয়াল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্নায়ুতন্ত্রে তথ্য সঞ্চালন থেকে শুরু করে সমস্ত স্নায়বিক কর্মকান্ডের প্রাণভোমরা এই অ্যাকশন পটেনশিয়াল। চিন্তা করে দেখুন, আপনার হাত গরম কোন বস্তুকে ছূঁইয়ে ফেলার সাথে সাথেই আপনি জেনে যান, উত্তপ্ত কিছু ধরে ফেলেছেন, দ্রূত হাত সরিয়ে ফেলতে হবে আপনাকে। কতটা দ্রুত আপনার স্নায়ুতন্ত্র তথা আপনি তথ্যটি পেয়ে যাচ্ছেন এবং এর প্রেক্ষিতে কি করতে হবে, তাও জেনে যাচ্ছেন। তথ্য পাওয়া এবং সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সময়কালের বিস্তৃতির সল্পতার কথা ভাবলে অবাক হতে হয় বৈকি! এইরকম করে সব স্নায়বিক কাজের জন্যই দায়ী মূলত অ্যাকশন পটেনশিয়াল এবং এর প্রবাহিত হবার বেগ। মানুষের স্নায়ু, মাংশপেশী, কিছু এন্ডোক্রাইন, ইমিউন সেল, রিপ্রডাকটিভ সেল যা অ্যাকশন পটেনশিয়াল সৃষ্টি করতে সক্ষম, তাদের বলে এক্সাইটেবল সেল আর তাদের অ্যাকশন পটেনশিয়াল সৃষ্টি করার ক্ষমতাকে বলে এক্সাইটেবিলিটি। মানবদেহের সব কোষেরই গ্রেডেড পটেনশিয়াল তৈরী করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু কেবল মাত্র এক্সাইটেবল সেলের মেমব্রেনই অ্যাকশন পটেনশিয়াল পরিবহন করতে পারে।
রেস্টিং মেমব্রেন পটেনসিয়াল, গ্রেডেড পটেশিয়াল পার করে আমাদের মোটামুটি ধারণা হয়েছে, কিভাবে কোষে আয়নিক অবস্থা বিরাজ করে, আর কিভাবে পরিবর্তন হতে পারে এই অবস্থার।

অ্যাকশন পটেনশিয়ালের বেশ কটি ধাপ আছে।
১/ডিপোলারাইজেশন বা রেস্টিং পটেনশিয়াল থেকে বিভব বেড়ে যাওয়া।
২/ রিপোলারাইজেশন, পুনরায় রেস্টিং পটেনশিয়ালে বিভব ফিরিয়ে আনা।
৩/ হাইপারপোলারাইজেশন, রেস্টিং পটেনশিয়াল থেকে বিভব আরো কমে যাওয়া।
৪/ আফটার হাইপারপোলারাইজেশন, কমে যাওয়া বিভব আবার রেস্টিং পটেনশিয়ালে ফিরিয়ে আনা।
এই ধাপগুলো বুঝতে এতক্ষণ আমরা যা পড়েছি সব কিছু এক এক করে আসবে।

ছবিঃ অ্যাকশন পটেনশিয়ালের খুঁটিনাটি

শুরুতে পড়েছিলাম রেস্টিং পটেনশিয়াল, এখন ধরে নিলাম, কোন একটি নিউরণের রেস্টিং পটেনশিয়াল, -৭০ মিলিভোল্ট। এইবার বাইরে থেকে স্টিমুলেশন আসার কারণে কোষীয় তরলে কিছু উত্তেজনার সৃষ্টি হয় যা রূপ নেয় গ্রেডেড পটেনশিয়ালে। এই গ্রেডেড পটেনশিয়াল কয়েক মিলিমিটারের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে অথবা কয়েকটি গ্রেডেড পটেনশিয়াল সম্মিলিতভাবে মেমব্রেন পটেনশিয়ালকে পৌঁছে দিতে পারে অ্যাকশন পটেনশিয়ালে রূপ নেয়ার থ্রেসোল্ড পটেনশিয়ালে। সাধারণত রেস্টিং পটেনশিয়াল থেকে থ্রেসোল্ড পটেনশিয়াল ১৫ মিলিভোল্ট বা তারচেয়ে কিছু বেশী হয়। অর্থাৎ রেস্টিং পটেনশিয়াল যদি -৭০ মিলিভোল্ট হয় তাহলে থ্রেসোল্ড পটেনশিয়াল হবে -৫৫ বা -৫০ মিলিভোল্ট। এক বা একাধিক গ্রেডেড পটেনশিয়াল যদি রেস্টিং অবস্থা থেকে ১৫ বা ২০ মিলিভোল্টের মত বিভবের পরিবর্তন আনতে না পারে কোষীয় তরলে, তাহলে, অ্যাকশন পটেনশিয়াল তৈরী হবে না, গ্রেডেড পটেনশিয়ালের মৃত্যু ঘটবে। অ্যাকশন পটেনশিয়াল তৈরী হবে কেবল এবং কেবল মাত্র থ্রেসোল্ড পটেনশিয়াল তৈরী হলে। একে বলে নিউরণের তথ্য সঞ্চালনের “All or None” নীতি। হয় তথ্য সঞ্চালিত হবে নতুবা হবে না। কোন মধ্যবর্তী অবস্থা সম্ভব নয়।

যখন বাইরে থেকে কোষে স্টিমুলেশন আসে, তার প্রভাবে কোষ পর্দার লিগ্যান্ড গেটেড অথবা ভোল্টেজ গেটেড আয়ন চ্যানেল খুলতে শুর করে, ফলে অধিক পরিমাণ সোডিয়াম আয়ন কোষীয় তরলে ঢুকে এবং এর বিভব বাড়াতে শুরু করে, এইভাবে একবার যখন থ্রেসোল্ড পটেনশিয়াল অর্জিত হয়ে যায়, তখন আর কোষের বিভব স্টিমুলেশনের উপর নির্ভর করে না। থ্রেসোল্ড পটেনশিয়ালে আসা মাত্রই বহু সংখ্যক সোডিয়াম আয়ন চ্যানেল খুলে যায় আর কোষের বিভব খুব দ্রুত অনেক বেড়ে যায়। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কোষীয় বিভব এর সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌছে যায়। সাধারণত অ্যাকশন পটেনশিয়ালের কারণে সর্বোচ্চ মেমব্রেন পটেনশিয়াল প্রায় +৪০ মিলিভোল্টের কাছাকাছি হয়। প্রত্যেকটা কোষের সর্বোচ্চ মেমব্রেন পটেনশিয়াল নির্দিষ্ট, এর চেয়ে বেশী পটেনশিয়াল কোষে সৃষ্টি হয় না। তার কারণ কোষ পর্দায় সোডিয়াম চ্যানেলের সংখ্যা সীমিত। এই অবস্থায় পৌছানোর পর সোডিয়াম আয়ন চ্যানেলগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হতে শুরু করে, আর তখনি, সোডিয়াম পটাসিয়াম পাম্প চালু হয়, ফলে, কোষের ভিতর থেকে সোডিয়াম বাইরে যেতে থাকে আর পটাসিয়াম ভিতরে যেতে শুরু করে। যেহেতু অধিক পরিমাণ সোডিয়াম বেরিয়ে যাচ্ছে, আর কম পটাশিয়াম ভিতরে ঢুকছে, তাই ক্রমাগত কোষের ভিতরের পটেনশিয়াল কমতে শুরু করে, রেস্টিং পটেনশিয়ালের দিকে ধাবিত হয়। রেস্টিং পটেনশিয়ালে পৌছে গেলে সোডিয়াম পটাসিয়াম পাম্প বন্ধ হয়ে যায়। এইখানেই অ্যাকশন পটেনশিয়ালের একটি সিগ্যনাল শেষ হতে পারতো। কিন্তু এতোক্ষণ আমরা যে পটাশিয়াম চ্যানেলকে তেমন পাত্তা দিচ্ছিলাম না, সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে।

ছবিঃ সোডিয়াম এবং পটাশিয়ামের পারমিয়েবলিটি কার্ভ

পটাসিয়াম আয়নের পারমিয়াবিলিটি কার্ভ বলে, যে স্টিমুলেশনের কারণে সোডিয়াম চ্যানেল গুলো খুলে গেছে, সেই একই স্টিমুলেশনের কারণে পটাশিয়াম চ্যানেলগুলোও খুলে গেছে, যদিও ডিপোলারাইজেশন রা রিপোলারাইজেশন পর্যায়ে সোডিয়ামের পারমিয়াবিলিটিত তুলনায় পটাসিয়ামের ভূমিকা নগন্যই বলা চলে। কিন্তু রিপোলারাইজেশন পর্যায়ের পর যেখানে সোডিয়াম চ্যানেল এবং সোডিয়াম পটাশিয়াম পাম্প উভই বন্ধ হয়ে গেছে, তখনও পটাসিয়াম চ্যানেল খোলা, ফলে কোষের ভিতর থেকে বাইরের দিকে তখনও পটাশিয়াম আয়ন বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে, মেমব্রেন পটেনসিয়াল রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়ালের চেয়েও কমে গেছে। মেমব্রেন পটেনশিয়াল রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়ালের নিচে নেমে যাওয়াকে বলে হাইপার পোলারাইজেশন। একসময় পটাসিয়াম আয়ন চ্যানেল আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় আবার খুব সামান্য কিছু সোডিইয়াম চ্যানেলও আস্তে আস্তে খুলে যায়, তার ফলে হাইপার পোলারাইজেইশন পর্যায় থেকে মেমব্রেন পটেনশিয়াল রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়ালে ফিরে আসে। এইভাবে একবার রেস্টিং মেমব্রেন পটেনসিয়াল থেকে যাত্রা শুরু করে আবার সম্পূর্নভাবে রেস্টিং পটেনশিয়ালে ফিরে আসা পর্যন্ত যে ইলেক্ট্রিকাল সিগ্যনাল সৃষ্টি হয়, তাই একটি সম্পূর্ণ অ্যাকশন পটেনশিয়াল। এর মাধ্যমে নিউরণ স্টিমুলেশনের ধরণ, প্রকৃতি, তীব্রতা, সময় ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় তথ্যাদি কেন্দ্রী স্নায়ু তন্ত্রে প্রেরণ করে বা প্রাপত তথ্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।

————————————–
References:

1. Vander, Sherman, Luciano, Human Physiology, 8th edition, 2001

2. Guyton and Hall, Textbook of Medical Physiology, 12th Edition, 2011

3. Wikipedia.