(১)

গদ্দাফির লিবিয়া-হিরক রাজার দেশে

যেদিন লিবিয়াতে গণবিদ্রোহ শুরু হল, 15 ই ফেব্রুয়ারী। সবে টিউনিশিয়া এবং মিশরে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। প্রায় সেই দিনই লিখতে যাচ্ছিলাম, এবার আরব বসন্ত লিবিয়াতে। সাদ্দাম হুসেনের পর মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকার আরেকটা সব থেকে বড় নর-জানোয়ারের পতন আসন্ন।

তবে পতন এত সহজে আসল না। গদ্দাফি এবং তার পরিবার গত চল্লিশ বছরে লিবিয়ার সম্পদ এবং বাণিজ্য কব্জা করে বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। শুধু তাই না, লিবিয়ার লোকজন বিদ্রোহ করতে পারে এই আশঙ্কাতে তার পরিবার আফ্রিকান, পাকিস্তানী বাংলাদেশীদের নিয়ে এক বিরাট প্রাইভেট আর্মিও পুষত। ফলত ফেব্রুয়ারী মাসে লিবিয়ান সেনা বাহিনী যখন বিদ্রোহীদের ওপর গুলি চালাতে অসম্মত হয়, তখন এই সব ভারাটে সৈন্য দিয়েই নিজের দেশের লোক মেরেছে গদ্দাফি। ফলে গৃহযুদ্ধ ছিল আসন্ন, এবং সেই যুদ্ধে ন্যাটো যখন বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ায় তখন গদ্দাফির পতন ছিল সময়ের অপেক্ষা। তৈল সমৃদ্ধ একটা দেশ-যাদের জিডিপি বেশ বেশী-কিন্ত সেখানে চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি প্রায় সব ধ্বংস হয়েছে গদ্দাফি শাসনে।

যদিও অনেকেই সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে দেখাবে উত্তর আফ্রিকাতে শিক্ষা এবং জিডিপিতে লিবিয়া এগিয়ে, কিন্ত এটা ভুললে চলবে না, উত্তর আফ্রিকাতে মাথাপিছু তেলের সম্পদ লিবিয়াতেই সব থেকে বেশী। সুতরাং তেলের টাকার সদ্বাব্যবহার করলে, লিবিয়ার অবস্থা হওয়া উচিত ইউরোপের দেশগুলির সমগোত্র।

গদ্দাফি বিরোধিতা ছিল আইনত নিশিদ্ধ এবং মৃত্যুদন্ড ছিল তার সাজা!

হ্যা লিবিয়া ছিল সেই হিরক রাজার দেশ-যেখানে ইংরেজি এবং ফ্রেঞ্চ পড়ানো হত না সরকারি স্কুলে। বিদেশীদের সাথে কথা বলার জন্যে প্রশাসনের অনুমতি লাগত। সরকারি টিভি এবং নিউজপেপার ছারা অন্য কিছুর অনুমতি ছিল না লিবিয়াতে।
তবে গদ্দাফি একটা ছোট্ট ভুল করেছিলেন। স্যোশাল মিডিয়ার যুগে মেইন স্ট্রিমে সেন্সর করে কিছু হয় না। ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে লিবিয়ানরা অনেকদিন থেকেই সংঘবদ্ধ হচ্ছিলেন।

গদ্দাফির হাতে অনেক সময় ছিল তৈল সম্পদ ব্যবহার করে লিবিয়ার ২০% বেকারত্বকে কমানো। চিকিৎসা, শিক্ষা কৃষির উন্নতি করা।

কিছুটা বুঝেছিলেন গদ্দাফি-উন্নয়নের কিছু কাজ শুরু করেছিলেন। বন্ধুবর সাদ্দাম হুসেনের মৃত্যুর পর, ওর মাথায় ঢুকেছিল, আমেরিকা আর বৃটেনকে হাতে রাখতেই পারলেই, মারে কে! ফলে আমেরিকাকে প্রায় আড়াই বিলিয়ান ডলারের ঘুঁষ আর বৃটেনকে দেড় বিলিয়ান ডলার খাইয়ে, আমেরিকা এবং বৃটেনকে হাত করে ফেলেছিলেন গদ্দাফি। আমেরিকা তার ওপর থেকে সন্ত্রাসবাদি তকমা তুলে নিয়েছিল। বৃটেন ও তাই। চিরকাল আমেরিকা বিরোধিতা করার পরে, যখন দেখলেন আর উপায় নেই, ঠিক টাকা দিয়ে ওয়াশিংটনের সাথে মাখো মাখো একটা সম্পর্ক তৈরী করে ফেলেছিলেন গদ্দাফি।

কিন্ত বিধি বাম! আরব বসন্তের জোয়ারে আমেরিকাও বাধ্য হল তার বিরুদ্ধে যেতে। বিশেষত প্যান এম বম্বিং এ যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের পরিবার ওবামা প্রশাসনের ওপর নিরন্তর চাপ রেখেছিল গদ্দাফিকে হটানোর জন্যে। নইলে গদ্দাফি বাম হাতে আমেরিকাকে আরো পাঁচ বিলিয়ান ডলার দিতে রাজি ছিলেন ন্যাটোকে তুলে নেওয়ার জন্যে!

(২)
বিশ্বের সফলতম এবং বৃহত্তম গিরগিটীর জীবনী

গদ্দাফি চরিত্র নিয়ে লিখতে বসলে দস্তভয়েস্কিও হাত তুলে দিতেন। আমি অনেকদিন ধরেই ওর জীবনী পড়ছিলাম। সত্যিই এই চরিত্র বিশ্বইতিহাসে ইউনিক।

এই লোকটা একাধারে চূড়ান্ত রকমের ইসলামিক মৌলবাদি যে প্রকাশ্যে সর্বত্র বলে বেড়াত ইসলাম হচ্ছে একমাত্র ধর্ম এবং খ্রীষ্ঠান ধর্ম “ডাইল্যুটেড” -অন্যদিকে যখন ইসলামি মৌলবাদিরা আশির দশকে
তাকে হত্যার চেষ্টা শুরু করে-তখন থেকে পালটি খেয়ে এই লোকটাই হয়ে গেল ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধি। তার আগে পর্যন্ত সে নিজে ছিল ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের সব থেকে বড় টাকা জোগানদার!

আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিয়ার সাথে তার সম্পর্ক অদ্ভুত। সিয়া এত সাহায্য আর কারুর কাছ থেকে পায় নি! তাই আজ যখন কিছু কিছু বাম বাঙালী তাকে আমেরিকান সম্রাজ্যবাদ বিরোধি এক চরিত্র বলে হিরো বানানোর চেষ্টা করছে-তাদের দুটো তথ্য জানা উচিতঃ

এক -১৯৮০ থেকে প্যান এম বোম্বিং- সিয়া আফ্রিকা এবং ইউরোপের প্রচুর রাষ্ট্রনেতা এবং জার্নালিস্টদের হত্যা করেছে গদ্দাফির ঘাতক বাহিনী কাজে লাগিয়ে। গদ্দাফির অন্যতম বড় সমর্থক ছিল আমেরিকা। দীর্ঘদিন।
কেন গদ্দাফি-আমেরিকার সম্পর্ক ভেঙে শত্রুতা শুরু হল-সেটা লম্বা কাহিনী।

দুই-১৯৮৪ সালে তাকে খুন করার জন্যে বৃটিশ ইন্টালিজেন্সের ছক ও ভেস্তে দেয় সিয়া! কারন? কারন লিবিয়ার টাকা খাটত অনেক কমিনিউস্ট “বিপ্লবী” পার্টিতে। ব্রাজিল থেকে অস্ট্রেলিয়া-অনেক জায়গাতে কমিনিউস্ট আন্দোলনে টাকা ঢালতেন গদ্দাফি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এগুলো গদ্দাফি করত সিয়ার নির্দেশে। কারন ওইসব পার্টিগুলিতে লিবিয়ান ইন্টালিজেন্সির মাথাগুলি ঢুকে যেত। আর খবর পাচার হয়ে যেত সিয়ার কাছে।

যাইহোক, রঙ বদলাতে এমন ওস্তাদ সার্কাসের খেলোয়ার বিশ্বে আর আসে নি।
গদ্দাফি শুরু করছিল প্যান আরব স্যোশালিজম প্রতিষ্ঠার জন্যে। সে খেলা জমলো না-আরব নেশন তৈরী হল না। তখন সে শুরু করল, প্যান আফ্রিকান জাতিয়তাবাদ। সেখানে অবশ্য গদ্দাফির কিছু সাফল্য আছে।

আরো মজার ব্যাপার হল, চাদ আক্রমন করে লিবিয়া যখন খুব একটা সুবিধা করতে পারল না-রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে গদ্দাফি তাদের ত্রাতা হিসাবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। তাদের জন্য ঘরবারি বানানো থেকে অনেক কিছুই দিতে চেয়েছিলেন যাতে তার প্যান আফ্রিকান নেতার ইমেজে চোট না লাগে।

১৯৭০-১৯৮০, এক নাগাড়ে তিনি টাকা দিয়েছেন বিশ্বের অনেক মুসলিম সন্ত্রাসবাদি সংস্থাকে। আবার যখন নিজের দেশের ইসলামিক মৌলবাদিরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, হঠাৎ করে পাশ্চাত্যের কাছে নিজের ইমেজ বানালেন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে।

মোদ্দা কথা রং বদল করার ব্যপারে গদ্দাফি ছিলেন অদ্বিতীয়। ফলে যে আমেরিকা তার প্রাসাদ বম্বিং করেছিল এবং লিবিয়ার ওপর নিশেধাজ্ঞা আনে-শেষে বিরাট টাকার বিনিময়ে, তাদের সাথেই ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করেছেন। আবার একদম শেষের দিকে যখন তার মনে হয়েছে গণতন্ত্রকে বেশীদিন টুটি চিপে রাখা যাবে না-তখন ২০০৯ সালে তিনি ঘোষণা দেন কিছু কিছু মন্ত্রীর জন্যে নির্বাচন হবে! যদিও তা কোনদিনই হয় নি।
মোটামুটি হাওয়া মোরগ ছিলেন গদ্দাফি-ঠিক ঠাক সময়ে রং বদলাতে তার জুরি মেলা ভার।

গদ্দাফি এবং তার পরিবারের নিষ্ঠুরতা বা লালসা নিয়ে শব্দ খরচ করে লাভ নেই। তবে গিরগিটির শেষ রং টা নিয়ে না লিখে পারছি না।

গদ্দাফির দেশে অবৈধ সঙ্গমের শাস্তি হচ্ছে শরিয়া আইন অনুযায়ী ৫ বছরের জেল আর বেত্রাঘাত। আর এই গদ্দাফিই বিদেশে ভ্রুমন কালে বিদেশীনী সাংবাদিকদের সাথে শোয়ার ব্যপারটা রুটিন করে ফেলেছিলেন। তার ফর্মুলা ছিল সিম্পল-যদি আমার ইন্টারভিউ চাও, আমার সাথে শুতে হবে! শরিয়া আইন অবশ্যই তার জন্যে চলবে না। কারন এই সব সাংবাদিকদের সাথে শোয়ার ব্যপারটা তার কাছে এক সময় এমন প্রেস্টিজের ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়, বিদেশ সফর শেষে ফিরে এসে উনি গুনতেন এবার কজন হল এবং সেটা নিয়ে তার তাবুতে টোস্টিং ও হত!

যাইহোক হুগো শ্যাভেজ এবং ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন গদ্দাফির সমর্থক! কারন গদ্দাফি আমেরিকার বিরুদ্ধে এক সময় সন্ত্রাসের চেষ্টা করেছে। বেশ এক দশক আমেরিকা বিরোধিতা চালিয়েছিলেন গদ্দাফি এবং সাদ্দাম হুসেনের উৎখাতে পর বুঝেছিলেন আমেরিকা বিরোধিতা মানে নিজের কবর খোঁজা। সেই মত টাকা ঢেলে পালটিও খেয়েছেন ঠিক সময়ে। গুগো শ্যাভেজ বা ফিদেলের পিঠ চাপড়ানোতে পিঠ বাঁচবেনা-এটা বুঝতেন গদ্দাফি।

অধিকাংশ বাম বাঙালী এবং ইসলামিস্ট ন্যাটোর বিরুদ্ধে গদ্দাফির সমর্থক ছিল। ইসলামিস্টদের ব্যপারটা
বোধগম্য। তবে বামেদের সমর্থনটা আরেকটা বামপন্থী অগভীরতার ফল। গদ্দাফি লোকটা কে, সেটা জানার কোন চেষ্টাই তারা করে নি।