এই লেখাটি একটি হালকা লেখা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনর্থক দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক স্নায়ুর উপর যে চাপ ফেলেছিল তার থেকে বেরিয়ে আসার একটি প্রচেষ্টা এটি। এখানে যে মতামত দিয়েছি তা আমার একান্তই ব্যক্তিগত। এর সাথে সবার মতামত মিলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দ্বিমত পোষণের স্বাধীনতা সবারই রয়েছে।


লেখাটির পরিকল্পনা করেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। কিন্তু লেখা হয়ে উঠে নি। কিছুদিন আগে মহীনের ঘোড়াগুলি নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। ওই পোস্টের পরে সামান্য একটু অপরাধবোধে ভুগেছিলাম আমি। ব্যান্ড সংগীতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিম বঙ্গ এখনো শিশু। অথচ বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে কোলকাতার একটা ব্যান্ড নিয়েই আমি প্রথম লেখা লিখেছি মুক্তমনায়। এটা বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের প্রতি একটু অবিচারই মনে হয়েছিল আমার কাছে। ফলে, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে মাকসুদকে নিয়ে একটা কিছু লিখবো। কারণ, তিনি আমার অত্যন্ত পছন্দের একজন শিল্পী। নিয়মিতই তাঁর গান শোনা হয় আমার।


এই লেখার বিষয়বস্তুর সাথে শিরোনামের কোনো সম্পর্ক নেই। না থাকারই কথা। শুরুতে এর শিরোনাম ভিন্নতর ছিল। হুট করেই শিরোনামটিকে পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি যুক্তিহীন কোনো এক কারণে। সবসময় যে যুক্তিপূর্ণ কাজ করতে হবে এমনতো কোনো কথা নেই। তাই না? অথবা কে জানে যুক্তিহীনতার মধ্যেই হয়তো সংগোপনে সুপ্ত অবস্থায় শুয়ে থাকে সুনিপুন কোনো শক্তিমত্ত যুক্তি।


নব্বই সালের ঘটনা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। পড়াশোনা করছি বললে অবশ্য পড়ালেখাকে অপমান করা হয়। ছাত্র হিসাবে নাম আছে এটুকুই শুধু। ইচ্ছা হলে ক্লাসে যাই, ইচ্ছা না হলে যাই না। আর বেশিরভাগ সময়েই কী কারণে যেন আমার ইচ্ছা না হওয়াটাই বেশি ঘটতো। ক্লাস না করার এই স্বাধীনতা বাংলাদেশে মোটামুটি সবাই পায় কলেজ জীবনে। আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল উল্টোটা। নটরডেম কলেছে পড়েছি। এখানে ফাঁকি দেওয়াটা পৃথিবীর দুরুহতম কাজগুলোর মধ্যে একটা ছিল। স্কুল ফাঁকি দিয়েছি মাস্টার মশাইদের পশু পেটানোর মত করে নিয়মিত পেটানোকে হজম করেই। কিন্তু কলেজে ওই সব মারপিট টারপিটের বালাই ছিল না। এর বদলে কলেজ থেকে বিদায় করে দেবার চল ছিল। পড়াশোনা করি আর না করি, কলেজ থেকে বিতাড়িত হতে হবে, সেটাকে কোনোভাবে মেনে নেবার মত মানসিকতা আমার ছিল না। ফলে, বাধ্য হয়েই ক্লাস করতে হতো তখন।  কলেজ জীবনে বাধ্যতামূলক ক্লাস করতে করতে ক্লাসের উপরে যে ঘেন্না তৈরি হয়েছিল, সুযোগ পেয়ে সুদে আসলে তার পুরোটা মিটিয়ে নিচ্ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে।

ক্লাস বাদ দিয়ে টিএসসির আশেপাশ দিয়েই ঘুরঘুর করি অকারণে। টিএসসিই তখন আমার কাছে তীর্থস্থান। স্বল্প দৈর্ঘের ছবি দেখি, আবৃত্তির অনুষ্ঠান দেখি, মারামারি কাটাকাটি দেখি আর মাঝে মাঝে হাভাতের মত হা করে তাকিয়ে থেকে হরেকপদের মিষ্টিমিষ্টি মেয়ে দেখি। এই বস্তুও তখন আমার কাছে নতুন বিস্ময়। স্কুল এবং কলেজ জীবনে পৃথিবীতে যে পুরুষ ছাড়া অন্য প্রজাতিরও মানুষ আছে বিপুল পরিমাণে জানাই ছিল না সেকথা। সংখ্যার প্রাচুর্যে সুন্দরী বাছাই করাই সমস্যা হতো। এতসব ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে আসল কাজটাও ঠিকমত চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আন্নার সাথে চুটিয়ে প্রেম চলছে তখন আমার। চালচুলোহীন চ্যাংড়া একটা ছেলে। নিজেরই থাকার জায়গা নেই, অথচ সংসার সাজানোর সুখস্বপ্ন দেখাচ্ছিলাম তাকে। কী দেখে যে সে আমার প্রেমে পড়েছিল তা অবশ্য এখনও জানি না। হাবাগোবা ধরনের একটা হাবিজাবি  মানুষ ছিলাম আমি। প্রেমের ক্ষেত্রে শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও যে একটু বোকা কিসিমের হয় সেটা তাকে দেখেই বুঝেছি তখন। এখন অবশ্য চালাক হয়ে গেছে। আমার সব কথাই যে ফাঁকিবাজি ছিল বুঝে গিয়েছে এতদিনে। সেকারণেই এখন রাতদিন কপাল চাপড়ায় বাচ্চা বয়সে করা ভুলের অনুশোচনায়।

যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠান খুব জাকজমকের সাথে করা হতো। বাংলাদেশের মিউজিক ব্যান্ডগুলোর তখন স্বর্ণযুগ। ছাত্র সংসদের অভিষেকে প্রধান কোনো ব্যান্ড না এলে সেই অভিষেক জমতোই না। হঠাৎ করেই শুনলাম যে রোকেয়া হল ছাত্র সংসদের অভিষেক হবে এবং সেখানে ফিডব্যাক আসবে। ফিডব্যাক তখন সেরা ব্যান্ড। একের পর এক জনপ্রিয় গান তৈরি করছে তারা। সেই সব গান ছেলেপেলেদের মুখে মুখে ফিরতো। রোকেয়া হলে দেখেই আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি। কারণ রোকেয়া হল ছিল মোগল হারেমের মত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঢাকা। পুরুষের সেখানে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু, সেই নিষিদ্ধ জায়গাতেও যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠলাম আমি। ফিডব্যাকের গান শোনার জন্য নয়। অন্য কারণে। আন্না থাকতো বাসায়। ফিডব্যাকের গান শোনার জন্য সুড়সুড় করে হলে চলে এসেছে সে সেদিন বন্ধুদের সাথে। ওর কারণেই মেয়েদের হলে ঢোকার জন্য মরিয়া আমি। ছাত্রদল করা (ছোটোখাটো ক্যাডার ছিল সে) আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্বপনকে বললাম সেকথা। সে বলে, কোনো সমস্যা নাই। চিন্তা করিস না। জোৎস্না আপারে কইলেই ঢোকা যাইবো। জোৎস্না আপা তখন রোকেয়া হল ছাত্র সংসদের জিএস। অল্পবিস্তর চেনাশোনা আমার সাথেও আছে। এই জোৎস্না আপার প্রেমিক ছিলেন বেলাল ভাই। বেলাল ভাই খুবই সাদাসিধে বন্ধুবৎসল ভালমানুষ ধরনের লোক ছিলেন। কিন্তু তাঁর এক বিচিত্র সমস্যা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরশাদের নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের একমাত্র নেতা এবং কর্মী ছিলেন তিনি। জাতীয় পার্টির বিভিন্ন প্রোগ্রামে, ছাত্রব্রিগেড এর মত আর্থিক লাভবান প্রকল্পে ছাত্রদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যেতেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরশাদ তখন সবচেয়ে ঘৃণিত প্রাণী। তার সমর্থনে একটা ভালো কথা কেউ বললেই সে লোকের হালুয়া টাইট করে দেয়া হতো। অথচ বেলাল ভাই নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের সক্রিয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর গায়ে সামান্যতমও টোকা পড়ে নি কখনো। জোৎস্না আপার প্রেমিক হিসাবে ছাত্রদলের ক্যাডারটা তাঁকে দুলাভাইয়ের মত সম্মান করতো। অন্য সংগঠনে বন্ধু থাকলে এই সৌজন্যতা সেই সময় পাওয়া যেত। আমি ছাত্র লীগার হবার পরেও স্বপন এবং আরো কয়েকজন বন্ধুর কারণে ছাত্রদলের শক্তিশালী ঘাটি বলে পরিচিত সূর্যসেন হলে অবাধে ঘোরাফেরা করেছি।  এই বেলাল ভাইয়ের ছোটো ভাই ছিল আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ছোটো ভাইয়ের বন্ধুর সুবাদে আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন তিনি।

রোকেয়া হলের অভিষেক অনুষ্ঠানে ঢোকার জন্য আমরা গিয়ে ধরলাম বেলাল ভাইকে। কোনো অজুহাত টজুহাত না দেখিয়েই তিনি বললেন যে, দাঁড়াও জোৎস্নাকে বলে ইনভাইটেশন কার্ডের ব্যবস্থা করছি। জোৎস্না আপার সাথে আলাপ করে এসে বেলাল ভাই আমাদের দুঃসংবাদ জানালেন। সব ইনভাইটেশন কার্ডই বিলিবন্টন হয়ে গিয়েছে। শুনে আমারতো মাথায় হাত। আমার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছেন বেলাল ভাই। বললেন যে, চিন্তা কইরো না। অন্য ব্যবস্থা হইছে। গেটে জোৎস্না আর রানু, শানু থাকবো। অন্য অতিথিদের সাথে তোমরাও ঢুকে পড়বা। ওরা  ভান করবে যে তোমাদের কাছে কার্ড আছে। এখানে বলে নেই রানু, শানু  জোৎস্না আপার ছোটো দুই বোন। বড় বোনের মত তারাও সক্রিয়ভাবে ছাত্রদলের রাজনীতি করে। হল সংসদের কী কী পোস্টে যেন তারাও নির্বাচিত হয়েছে। এতদিন পরে সেগুলো মনে নেই আমার। এই দুই বোনের সাথে আমারও পরিচয় ছিল, কিন্তু খুব বেশি কথা হয় নি কখনো। শান্তশিষ্ট মেয়ে ছিল তারা।

সন্ধ্যার দিকে রোকেয়া হলের গেটে গিয়ে ভিড় করেছি আমরা। হল সংসদের মেয়েরা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গেটে। আমন্ত্রণ পত্র পরীক্ষা করে করে ঢুকতে দিচ্ছে অতিথিদের। প্রবল ধাক্কাধাক্কি চলছে। বিশৃঙ্খল অবস্থা। এর মধ্যে কোন ফাঁকে দেখি স্বপন সুড়ুৎ ঢুকে পড়েছে হলের ভিতরে। ধাক্কাধাক্কির গুঁতোয় আমি ছিটকে পড়েছি একপাশে। শত শত ছেলে হলের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে মেয়েরা দারোয়ানদের নির্দেশ দিয়েছে গেট বন্ধ করে দিতে। গেটের বাইরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কিছুক্ষণ পরে দেখি বড় গেটের লাগোয়া ছোট্ট গেট দিয়ে হলের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে রানু এবং শানু। ইতি উতি করে কাকে যেন খুঁজছে। আমাকে দেখেই হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে যায় দু বোনের মুখ। দুজনের মাঝখানে আমকে দাঁড় করিয়ে, শত শত উন্মত্ত ছাত্রের মাঝখান দিয়ে রাজকীয়ভাবে আমাকে নিয়ে হলে ঢুকে পড়ে তারা। পরে জেনেছিলাম যে এই দুই বোন কোন এক বিচিত্র কারণে আমাকে খুব পছন্দ করতো। হলের মধ্যে স্বপনের সাথে আমাকে না দেখে তারা বের হয়ে এসেছিল আমাকে ভিতরে নেওয়ার জন্য।

কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের ক্যাডার পুলিশ বাহিনীর অত্যাচারের ইউটিউব ভিডিও দেখছিলাম। বিনএনপির চিফ হুইপকে পিটিয়ে প্রায় লাশ বানিয়ে ছেড়েছে রাস্তার গুন্ডাদের মত আচরণ করা পুলিশ অফিসারেরা। সেই ভিডিওর এক পর্যায়ে দেখি সাদামাটা চেহারার বিএনপির এক মহিলা সংসদ সদস্য তীব্র ভাষায় পুলিশের এই পাশবিক আচরণের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছেন। টেলপে নাম ভেসে উঠেছে রেহানা আক্তার রানু।

রাজনৈতিক নেতাদের দীর্ঘ বক্তৃতার পরে তুমুল করতালির এবং মেয়েদের তীক্ষ্ণ চিৎকারের মধ্য দিয়ে মঞ্চে উঠে আসে ফিডব্যাক। সেই প্রথম আমার মাকসুদকে চাক্ষুস দেখা। সুঠাম দেহের শ্যামল বর্ণের এক পরিপূর্ণ যুবক। শুরুতেই জানিয়ে দিলেন যে, মাত্র গতরাতেই তাঁরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে সড়কপথে ঢাকা ফিরেছেন। পর্যান্ত বিশ্রাম পান নি। ফলে, কতখানি আনন্দ দিতে পারবেন দর্শকদের সে বিষয়ে সেন্দেহ আছে। আমরা যেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখি। ওইটুকু যে কথার কথা ছিল সেটা বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগে নি আমাদের। শুরু হলো মঞ্চ কাঁপিয়ে মাকসুদের নর্দনকুর্তন। সেই সাথে তাঁর ভরাট, বলিষ্ঠ এবং অননুকরণীয় কণ্ঠের গান। ফিডব্যাক তখন তাদের স্বর্ণসময় পার করছে। অসংখ্য জনপ্রিয় নতুন গান তৈরি করেছে তাঁরা। মেলা, মৌসুমী দুই, মাঝি, জীবনজ্বালা এই সমস্ত গান তখন একেবারে টাটকা, সদ্যজাত সতেজ। দর্শকদের অনুরোধে কোনো গানকে একাধিকবারও গাইতে হচ্ছে মাকসুদকে। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে সব ছেলেমেয়েরা। মেয়েদের কেউ কেউ উদ্দাম নাচ শুরু করে দিয়েছে। সেগুলোকে সামলাতে হাউজ টিউটরদের সেকি প্রানান্তকর প্রচেষ্টা। রাত একটার দিকে হঠাৎ করে অনুষ্ঠান শেষ করে দেয় ফিডব্যাক ক্লান্তির অজুহাত দেখিয়ে। হতাশ মনে সূর্যসেন হলে ফিরে আসি আমরা। সবে মাত্র বিছানায় গিয়েছে, হঠাৎ করে দেখি বিকট শব্দে ড্রাম বেজে উঠেছে। কানে ভেসে আসে মাকসুদের গান। কণ্ঠে চরম বিরক্তি নিয়ে স্বপন আমাকে বলে, “দেখছোস, মাইয়ারা কেমন ফটকাবাজ। আমগোরে বাইর কইরা দিয়া হেরা আবার গান শুনতাছে।“ আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছোট্ট করে শুধু বলি, “হু।“

ফিডব্যাকের গান প্রথম শুনি আমি তিরাশি চুরাশি সালের দিকে। ফিডব্যাকের প্রথম বাংলা ক্যাসেট ছিল ওটা। তবে ওই ক্যাসেটে মাকসুদের কোনো গান ছিল না। বেশিরভাগ গান গেয়েছিলেন রোমেল নামের এক ভদ্রলোক। এই ভদ্রলোককে খুব কম লোকই চেনে। কারণ, বাংলাদেশে ব্যান্ড ক্রেজ জন্ম নেবার আগেই দেশ ছেড়ে আমেরিকাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। যদিও মাকসুদ ফিডব্যাকে যোগ দিয়েছেন ছিয়াত্তর সালে। কিন্তু তখন পর্যন্ত তিনি ছিলেন ফিডব্যাকের ইংরেজি গানের ভোকাল। বাংলায় গান করতেন না তিনি। রোমেলের বিদায়ের পরে অনেকটা বাধ্য হয়েই বাংলা গান শুরু করে তিনি। মাকসুদের ভাষ্য অনুযায়ী আজম খান প্রায়ই নাকি তাঁকে তাগাদা দিতেন এই বলে যে, “এই তুই বাংলা গান গাওয়া শুরু কর”। বাংলা গান গাওয়ার ব্যাপারে মাকসুদের নিজেরই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল। সাতাশি সাল থেকে বাংলা গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। তারপর ইতিহাস। বাংলাদেশের ব্যান্ডের গানের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী তিনি, তাঁর কণ্ঠ থেকেই বেরিয়ে এসেছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় গান। যার কোনো কোনোটি ক্লাসিকের পর্যায়ে চলে যাওয়ার পথে রয়েছে।

বাংলাদেশের সেরা ব্যান্ডগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিরই মঞ্চ পারফরম্যান্স দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেই সুবাদে নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারি যে, স্টেজ পারফরম্যান্সে মাকসুদকে টেক্কা দেবার ক্ষমতা কারো ছিল না। এখনকার এই পঞ্চাশোর্ধ স্থূলকায় মাকসুদকে দেখে আগের মাকসুদকে বিচার করাটা কষ্টকরই। কিন্তু যাঁরা মাকসুদের যুবক বয়সের সোনালি সময়কে কাছে থেকে দেখেছেন তাঁরা যানেন যে কী প্রবল পৌরুষের দাপট নিয়েই না তিনি মঞ্চে দাপাদাপি করতেন।

শুধু মঞ্চ পারফরম্যান্স এর বিচারেই নয়, সামগ্রিকভাবেও জেমস এবং আইউব বাচ্চুকে বাইরে রেখে, আজম খানকে সশ্রদ্ধায় একপাশে সরিয়ে দিয়ে,  মাকসুদই আমার চোখে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের শ্রেষ্ঠতম পুরুষ ।

হুট করেই ছিয়ানব্বই সালে ফিডব্যাক ছেড়ে দেন মাকসুদ। এই ঘটনা সেই সময়ে বিরাট আলোড়ন তুলেছিল। হাজারো গুজবে গুঞ্জরিত হয়েছিল চারপাশ। মাকসুদের চলে যাওয়াতে ফিডব্যাক ডানা ভাঙা পাখির মত মুখ থুবড়ে পড়েছিল মাটিতে। আজকে এত বছর পরেও সেই ভাঙা ডানা আর জোড়া লাগে নি তাঁদের। ফিডব্যাক ছেড়ে মাকসুদেরও ক্ষতি কম হয় নি। তিনি নতুন একটা ব্যান্ড খুলেছিলেন মাকসুদ ও ঢাকা নামে। কিন্তু এই ব্যান্ডটি ফিডব্যাকের ধারেকাছেও যেতে পারে নি। মাকসুদকে হারিয়ে ফিডব্যাক ডানা ভেঙে উড়া ভুলেছে, আর মাকসুদ হাজার চেষ্টা করেও মাকসুদ ও ঢাকার ডানা গজাতে পারেন নি, একে উড়ালপক্ষি বানানোর জন্য। কিছুদিন আগে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাকসুদ তাঁর ফিডব্যাক ছেড়ে চলে আসার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন যে, তিনি যে ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য সম্বলিত গান করতে চান সেটা ফিডব্যাকের কাঠামোর মধ্যে সম্ভব ছিল না। কাজেই, ফিডব্যাকের সাথে আমার ডিভোর্স বা সেপারেশন কিছুই ঘটে নি, বরং বন্ধুসুলভ ভঙ্গিতে করমর্দন করে বিদায় জানিয়ে যাঁর যাঁর পথে চলে গিয়েছি আমরা।

মাকসুদ অনেক জনপ্রিয় গান করেছেন। এর অনেকগুলোই দীর্ঘ সময় ধরে অনাগত দিনের তরুণ প্রজন্মদের মাতাবে। তবে এগুলো তাঁর সেরা পাওনা নয়। তিনি একটা গান গেয়েছেন মেলায় যাইরে বলে। বাংলাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয় এই গান। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই গানটি টিকে থাকবে দীর্ঘ দীর্ঘকাল। বাঙালির একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব নববর্ষ। আগে বৈশাখকে বরণ করার জন্য একমাত্র গান ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসো হে বৈশাখ। এই গানটি অত্যন্ত ধীর লয়ের, উত্তেজনাহীন, নিষ্প্রাণ, গম্ভীর এবং আনন্দহীন একটা গান। বাংলা নববর্ষের গতিময়তার সাথে, থরথর কম্পমানতার সাথে, তীব্র উত্তেজনার সাথে, আনন্দমুখরতা এবং উৎসব উৎফুল্লতার সাথে খুব একটা মানানসই ছিল না এটা। কিন্তু এর কোনো বিকল্প আমাদের হাতে ছিল না। ফলে, নববর্ষে একদল নিষ্প্রাণ গম্ভীর মানুষের কণ্ঠে নিরস এই গান শুনেই নববর্ষকে বরণ করতে হতো আমাদের। এই শুন্যস্থানকে পরিপূর্ণভাবে ভরে দিয়েছে মাকসুদ তাঁর মেলায় যাইরে গানটা দিয়ে। এই গানের দুরন্ত গতি, সপ্রাণতা, তীব্র উত্তেজনা, আনন্দঝংকার নববর্ষের উৎসবে সত্যিকারের প্রাণ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশে এখন নববর্ষ বরণ মাকসুদের এই গান ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কোথাও বনভোজনে গেলে যেমন অবশ্যম্ভাবী হ্যাপির গাওয়া চলো না ঘুরে আসি গাওয়া হবে, তেমনি নববর্ষের অনুষ্ঠানে, উৎসবে মেলায় যাইরে যতিহীন মধু ঝরাবে।

মুক্তমনার একজন সদস্যের মন উজাড় করা ভালবাসা নিয়ে ভালো থাকুন মাকসুদ আপনি।

httpv://www.youtube.com/watch?v=9TZTXRX7_Vo