[ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আমার ইউনিকোডে কিছু সমস্যা হবার কারণে বেশ কিছু শব্দ ভেঙ্গে যেতে পারে এবং বানানে কিছু ভুল থেকে যেতে পারে…]
প্রথমে ভেবেছিলাম লেখাটিতে কোন কমেন্ট করবো না। কারণ এই বিষয়গুলো নতুন কিছু না। আবার আমি যে মন্তব্য করবো সেটাও হয়ত নতুন কিছু হবে না। এটা নিয়ে আগেই অনেকে লিখেছেন এবং বেশির ভাগ মানুষই তা আমলে আনেন নি। কারণ, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা যার ভালো লাগে, সে রবীন্দ্রনাথকে ঐ গান এবং ঐ কবিতার মধ্য দিয়েই আবিষ্কার করতে চায়। রবীন্দ্রনাথ কেমন মানুষ ছিলেন, বিয়ে কয়টা করেছেন, সুদ খেতেন কি-না – এসব গবেষকদের বিষয়। রবীন্দ্রনাথের গান ভাল কিনা মন্দ তা নির্ণয় করার জন্য তা্ঁর ব্যক্তি জীবন প্রয়োজন হয় না। তবে এটা যে জানার প্রয়োজন নেই সে কথা আমি বলছি না। একটা মানুষ আমার আদর্শ হতে পারে কিনা সেটা নির্ণয় করার জন্য এটা অতীব জরুরী। এই প্রবন্ধটা সেই প্রয়াস থেকে দেখতে গেলে বলতে হয় এখানে মানুষ রবীন্দ্রনাথের শুধু নেগেটিভ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং, সম্পূর্ণ আলোচনা না এটি।

এই লেখায় নতুন কথা আমি প্রায় একটিও পাইনি বলা যায়। ফরহাদ মাযহার এ নিয়ে লিখে বেশ আলোচিত ও পরিচিত হয়েছেন। আর এখানে তো আহমদ শরীফ এবং নীরদ চৌধুরীর প্রবন্ধ তুলেই দেওয়া হয়েছে। ঐগুলো আমি আগেই পড়েছিলাম। বোঝা যাচ্ছে, লেখকরা এই বইগুলো পড়েছেন এবং অতি গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। তা্ঁদের উচিত আরও সময় নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পড়ে ও জেনে এ ধরনের লেখায় হাত দেওয়া। এবং নতুন কিছু বলার না থাকলে লেখার প্রয়োজন কি? তবে হ্যা্ঁ, এই ধরনের লেখা লিখে যে তাড়াতাড়ি পরিচিত হওয়া যায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রবীন্দ্রনাথকে অন্যের গান চুরির যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে, তা সাহিত্যে ও শিল্পে নতুন কিছু না। এটাকে চুরি বলা সঙ্গত নয় বলে আমি মনে করি। কারণ সাহিত্য মানেই তো কপি করা, সেটা জীবনকে হতে পারে, প্রকৃতিকে হতে পারে। গল্পের চরিত্রগুলো তো সমাজ থেকেই নেয়া। তার মানে কি এটা নকল? সাহিত্য তো বিজ্ঞান না যে গবেষণা করে নতুন কিছু আবিষ্কার করা যাবে। শেক্সপিয়র-এর ৩৭ টা নাটকের মধ্যে ৩৬ টাই বিভিন্ন জায়গা থেকে গল্প নিয়ে লেখা। তাতে কি শেক্সপিয়র ছোট হয়ে গিয়েছেন? এটা এক ধরনের অনুবাদও বটে। এবং সাহিত্য তো অনুবাদ ছাড়া আর কিছু না। লেখকরা কখনও জীবনকে অনুবাদ করেন কখনও একটি ধারাকে অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথ সেটা করে আরও ভালো করেছেন। তার মানে তিনি একজন ভালো অনুবাদকও ছিলেন। আমরা তার মধ্যে দিয়ে অনেক কিছু পেয়েছি। এজন্য বরং তা্ঁকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আর একটি কথা আছে, nothing is new under the sun, সে অর্থে, আলোচকদ্বয় শ্রদ্ধেয় ফরিদ আহমেদ এবং অভিজিৎ যে কথাগুলো লিখেছেন তা মৌলিক নয়। তা্রা যে বিবর্তন নিয়ে লেখেন তা তো এক ধরনের অনুবাদই, চুরি করা বলতে আমি নারাজ।

আর, রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষদের জন্য কতটুকু করতে পেরেছেন জানি না, তবে চেষ্টা করেছিলেন। যে চেষ্টা খুব কম মানুষই করেছেন। চেষ্টা করেছিলেন বলেই, ইংল্যান্ড ও কলকাতার আয়েশী জীবন ছেড়ে কুষ্টিয়ার ভড় গ্রামে বাস করেছেন। শিলাইদহ অঞ্চলে আমার বাড়ি, আমি জানি সেখানে বাস করা কত কঠিন। আমাদের অনেকেই সেখানে একটি দিনও যাপন করতে পারবেন কি-না সন্দেহ আছে। এখন যদি কেউ বলেন, রবীন্দ্রনাথ টাকা কামানোর জন্য সেথানে ছিলেন, আমাদেরকেও পর্যাপ্ত টাকা দিলে পরিবার নিয়ে থাকতে পারবো, তাহলে ভিন্ন কথা। রবীন্দ্রনাথ কিছু করতে চেয়েছেন বলেই তো ঐ চাষা মানুষদের সাথে থেকেছেন। কাদা-মাটি আর মশা-মাছিতে ভরা অঞ্চলে স্বপ্নের বীজ বপন করেছেন। উনার কি কলকাতা থাকলে ভাতের অভাব হতো। তিনি সাহিত্যিক ছিলেন, সাহিত্যিক তো আরো ছিলেন, ও আছেন। তার কি দরকার ছিল ঐ কৃষি উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার, পল্লী উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করার? কি প্রয়োজন ছিল, ব্যাংক খুলে নোবেল থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ বিলিয়ে দেওয়ার? কি দরকার ছিল স্কুল প্রতিষ্ঠা করার? ছেলেকে ও জামাইকে এতো দামি দামি বিষয় থাকতে কৃষি নিয়ে পড়াশুনার জন্য বিলেতে পাঠানোর? আমরা পারবো আমাদের সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিবিএ না পড়িয়ে কৃষি বিষয়ে পড়ানোর কথা ভাবতে? আদৌ ভাবছি কি আমরা? তার মত গ্রাম-উন্নয়নের চিন্তা কি অন্য কেউ করেছেন? তিনি কলকাতার হিন্দু পাড়ার মানুষ, তা্ঁর কি দরকার ছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমান পাড়ার মানুষদের নিয়ে এতো সব ভাবনা করার?? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, গ্রামগুলো মরে গেছে, তিনি গ্রামগুলোকে বাচাতে চেষ্টা করেছেন। গ্রাম্য মেলার আয়োজন করা তার সেই প্রচেষ্টার্‌ই অংশ মাত্র। তিনি যখন স্ত্রী হারিয়েছিলেন তখনও তা্ঁর বয়স ছিল দ্বিতীয় বিবাহ করার মত। চাইলেই কয়েকটি বিবাহ করে আয়েশ করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেন নি। নাকি এখানেও না করার পেছনে তার কোনও কু-মতলব ছিল? স্ত্রী, কন্যা, ছেলে হারিয়েও তিনি সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে গেছেন। এর জন্য কি আমরা বলবো যে তিনি তা্ঁর স্ত্রী, সন্তানদের ভালোবাসতেন না ?

আবুল আহসান চৌধুরীর কয়েকটা মন্তব্য শাশ্বতিকীর প্রকাশিতব্য রবীন্দ্র সংখ্যা থেকে এখানে উঠিয়ে দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি—
[]একজন মুসলমান প্রজা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন এই রকম যে আমাদের অনেক মহামানুষকেই আমরা দেখিনি কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে দেখলে তেমন মনে হয়। এইরকম একটা মন্তব্য করেছিলেন আর কি। বিষয়টি একটু বিতর্কিত হতে পারে। তিনি সবেচেয়ে বড় যে কথাটি বলেছিলেন- আমি সাহাদের হাত থেকে শেখদের রক্ষা করার জন্য এসেছি জমিদারি দায়িত্বে।
[]মুসলিম লেখকদের তিনি যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন, যেভাবে তাঁদের সমাদর করেছেন, যেভাবে তাঁদের তুলে ধরেছেন, তাঁদের বিখ্যাত হওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছেন তা আর কেউ করেননি। সেই সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সময়ে আরও যারা বিখ্যাত অমুসলিম লেখক ছিলেন তাঁরা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন অথবা বিদ্বেষ পোষণ করেছেন।
[]সেই হাছন রাজার গান রবীন্দ্রনাথের হাতে যখন পড়লো তখন তিনি এতটাই মুগ্ধ হলেন যে তিনি ভারতীয় দর্শন মহাসমাবেশের অধিবেশনে যে ভাষণ দিলেন তাতে হাছন রাজার গানের কথা উল্লেখ করলেন। আবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন হিবার্ট লেকচার দিলেন ‘The religion of man’ নামে সেখানেও তিনি হাছন রাজার গানের উল্লেখ করলেন ‘‘মম অাঁখি হইতে পয়দা আসমান ও জমিন’’ এই গানটি রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথ ভারী চমৎকার-দার্শনিক ব্যাখ্যা করেছেন।
[] তিনি লালনের গান সংগ্রহ করেছেন। লালনের গান তিনি প্রকাশ করেছেন। ‘হারামনি’ বলে একটি বিভাগ প্রবর্তিত হল ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়, সেখানে তিনি গগণ হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ এই গানটি ছাপলেন একে একে লালনের কুড়িটি গান তিনি প্রকাশ করেছিলেন চার কিসিত্মতে। লালনের গানের দুটি খাতা তিনি ছেউড়িয়া থেকে সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেটি এখন বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে সংগৃহিত আছে।

আমার একটি প্রশ্নের চমতকার ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তার কিছু অংশ এখানে তুলে দেওয়া হল-
••মোজাফ্ফর : তিনি তাঁর মেয়ের বাল্য বিবাহ দিচ্ছেন। আবার তাঁর পরিবারে বিধবা ছিল, তিনি তাদের বিয়ের ব্যাপারে অনুৎসাহ প্রকাশ করছেন। এটা একধরনের স্ববিরোধীতা হয়ে গেল না ?
•আবুল আহসান চৌধুরী : মহৎ মানুষ এবং মহৎ শিল্পীর ভিতরেই স্ববিরোধীতা থাকে। তুমি বাইরের দিকে তাকাও- টলসত্ময়-এর লেখায় আমরা রাশিয়ার জীবনের অমত্মরঙ্গ চিত্র খুঁজে পাই, তাঁর লেখা প্রগতিশীলতার দিকে আলো নিক্ষেপ করে। টলসত্ময় সম্পর্কে খুব চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন লেলিন, যে যাজকতন্ত্রের ও সমাজতন্ত্রের প্রতি একটা মোহ বা দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও টলসত্ময় রাশিয়ার মহান সমত্মান। এই রকম একটা কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের স্ববিরোধীতার কথা অনেক আছে। তুমি তো কেবল একটা বললে যে রবীন্দ্রনাথ নারীর বিকাশের কথা বলে বেড়ালেও তাঁর মেয়েদের কাউকে তিনি লেখাপড়া শেখাননি। পাশাপাশি তাঁর ভাইয়ের মেয়েরা রীতিমত বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ যেটা আসে, তিনি এত নারী মুক্তির কথা বলেছেন অথচ তিনি নিজে বাল্য বিবাহ করেছেন। সেটি অনুমোদন করা যায় এই কারণে যে সেই সময়টা ছিল উনিশ শতক। কিন্তু সমাজ যখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে সেই সময়ে এসে তিনি সবকটি মেয়ের বাল্য বিবাহ দিয়েছেন। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি জীবনে অনেক স্ববিরোধীতা ছিল। সেগুলো আমরা কখনই বড় করে দেখবো না। কিন্তু এও আমরা চাইবো না যে রবীন্দ্র স্ত্ততিকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে যা দেখে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বিব্রত হোন। অতিস্ত্ততি সবসময় ভুল পথে নিয়ে চলে বা বিতর্কিত করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ কখনো কখনো এর শিকার হয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর শামিত্মনিকেতনে তাঁকে যে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়, সেখানে তাঁর বক্তব্য শুনে সকলে ক্ষুব্ধ হয়ে না খেয়ে কলকাতায় ফিরে যান। এই ব্যাপারগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে তিনি কখনো কখনো অসহিষ্ণু হয়েছিলেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ অনেক আঘাত পেয়েছেন বাঙালী সমাজের কাছ থেকে যে কারণে তারা যখন সম্মান দিতে যাচ্ছেন তখন তাঁর ভিতরে একটা প্রতিক্রিয়া জেগেছে। কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়াটা শোভন ছিল না। যাই হোক, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাথে প্রথম দিকে তাঁর সম্পর্ক খুব মধুর ছিল কিন্তু পরে নানা কারণে এই সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়ে পড়লো যে (তার দায়ভার দ্বিজন্দ্রেলাল রায়েরই বেশি) তিনি কোন কোন লেখায় রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে এমন মমত্মব্য করলেন যে, যেমন, ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালেনা, বেলা হলো মোর লাজে..’ ডি.এল.রায় এই গানটি সম্পর্কে মমত্মব্য বললেন যে এটি একটি লাম্পট্যগীতি। তারপরে একেবারে শেষ জীবনে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নগ্নভাবে আক্রমন করে ‘আনন্দ বিদায়’ লিখলেন, সেটি যখন মঞ্চস্থ হচ্ছিলো দর্শকরা তখন তা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই ডি.এল.রায় যখন অল্প বয়সে মারা গেলেন(১৯১৩) তখন কৃষ্ণনগরে একটা শোক সভার আয়োজন করা হয়। কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় যিনি সে কালের নামকরা রাজনীতিবিদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বন্ধু হেমমত্ম কুমার সরকারের শিষ্য ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লেখেন শোক অনুষ্ঠানে পাঠ করার জন্য বা স্মরণিকায় ছাপা হয় এইরকম মমত্মব্য চেয়ে। তো রবীন্দ্রনাথ নাকি এই রকম জবাব দিয়েছিলেন, যে সারা জীবন ধরে আমাকে অবমাননার ভেতর ফেলেছেন, আমাকে অপমান করেছেন তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার মত উদারতা আমার নেই। এতে অনেকে ক্ষুব্ধ হোন এবং বিজয়লাল ক্ষুব্ধ হয়ে এ কথা বলেন যে যদি তিনি কোন লেখা না পাঠান তাহলে এটিই ছেপে দেবেন। পরে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ কয়েক ছত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন। ভাবতে হবে যে রবীন্দ্রনাথও একজন মানুষ। তিনি ডি.এল. রায়ের কাছ থেকে যে আঘাত পেয়েছিলেন সেই আঘাত সহ্য করে তাঁর সম্পর্কে ভালো কথা বলা ভারী কঠিন। তবে প্রত্যাশাতো রবীন্দ্রনাথের কাছে একটু বেশিই থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ যা, তা আমাদের বলা উচিৎ বা তুলে ধরা উচিৎ। ভাল-মন্দ মিলিয়ে মানুষ। আমরা রবীন্দ্রনাথকে মানুষ হিসেবে দেখতে চাই।

আমার মনে হয় এটুকুই যথেষ্ট। আমি চাইলে রবীন্দ্রনাথের ভালো কর্মের উদাহরণ, তার সপক্ষের যুক্তি ও অন্যদের মন্তব্য দিয়ে পুরো মুক্তমনা ভরে দিতে পারি। কিন্তু সেটা করে আমি পাঠকদের ধৈর্য ও সময় নষ্ট করছি না।

আলোচ্য প্রবেন্ধ বলা হয়েছে, রবীন্দ্রসাহিত্যে সাধারণ মানুষের কথা আসেনি। আমি তো বলবো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জুড়েই মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের কথা। প্রায় প্রতিটা গল্প-উপন্যাস ধরে ধরে সেটা দেখিয়ে দেওয়া যায়। আর তা্ঁর গান শুনে কেউ যদি সুখ পায়, তাহলে দোষের কি। এমনিতে আমাদের বাঙালিদের অনেক দু:খ, অনেক কষ্ট, অনেক হাহাকার, রবীন্দ্রনাথের গান যদি তাদের এই বেহাল দশাকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখতে পারে, জীবনের স্বাদ এনে দেয় তাহলে তো দোষের কিছু দেখি না। তা্ঁর গান ভালোলাগাটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। যার ভালো লাগে না, সে শুনবে না—ব্যাস, চুটে গেল ঝামেলা। তবে এটা ঠিক, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অনেক কথা হয়েছে, কিন্তু তাতে তার জনপ্রিয়তার কোন হেরফের হয়নি। আজ তা্ঁর জন্মের ১৫০ বছর পার হয়ে গেলেও কিন্তু তা্ঁর জনপ্রিয়তার কোন হেরফের হয়নি। এখনও তা্ঁর বই সব থেকে বেশি বিক্রি হয়। প্রশ্ন তোলা হয়েছে তা্ঁর স্থায়িত্ব নিয়ে। হোমার, ভার্জিল কি মরে গেছেন? ‘বেউল্ফ’ তো আমরা এখনো পড়ি। রবীন্দ্রনাথ থাকবেন কি না, এটা সময়ের ওপর ছেড়ে দিলে ভালো হয়্ না?

এই লেখাটি নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যে সমালোচনা সেটা আরেকবার- বার বার, বাজিয়ে দেখা যেতেই পারে, এতে আমি দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু এই লেখাটি পড়লে, ভাষার টন দেখেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথকে ছোট করে দেখাটাই এই লেখার উদ্দেশ্য। মনে হচ্ছে লেখাটি তাদের উপর ক্ষোভ থেকে লেখা যারা রবীন্দ্রনাথকে শুধুমাত্র ভগবান হিসেবে মনে করেন। যেহেতু মুক্তমনায় গড বা আল্লাহর বিরুদ্ধে লেখা হয়, তাই রবীন্দ্রনাথকে গড বানালে তা্ঁর বিরুদ্ধেও মুক্তমনায় মাতামাতি শুরু হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। যদি তাই হয়, এই মাতামাতিকে আমি দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু গড এর জায়গায় রবীন্দ্রনাথকে কেউ বসান নি। তা্ঁর কাছে কেউ স্বর্গ লাভের জন্য প্রার্থনা করে না। তা্ঁর নামে কোনও মাজার প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। আমি দেখেছি, লালনের মাজারে মানুষ গডকে পেতে যায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে সবাই যায় রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্বকে অনুধাবন করতে। তার গান গেয়ে পূজা করা হয়, কিন্তু সেই পূজা অন্য ভগবানকে উদ্দেশ্য করে। রবীন্দ্রনাথ কারও ঈশ্বর নয়, একথা জোর দিয়েই বলা যায়। তবে হ্যা্ঁ, তা্ঁকে মহামানব মনে করেন অনেকেই। তিনি তো সাধারণ মানুষ নন। সব মানুষ যদি একই কাতার ভুক্ত না হয়, তাহলে তা্ঁকে মহামানব বলা যেতেই পারে। মহামানব বলা মানে তো আর মানবিক অবস্থা থেকে তা্ঁর নাম খারিজ করে দেওয়া নই? তিনি মানুষ কিন্তু মহান, ব্যাপারটা এই রকম। তাই যদি হয়, তাহলে এই লেখাটির অর্থ কি, মানে নতুন করে এর কি এমন গুরুত্ব তৈরি হলো? যারা রবীন্দ্রনাথের মানবিক দোষগুলো সম্পর্কে অবগত হয়ে তা্ঁর সৃষ্টিকর্মকে ছুড়ে ফেলে দিবে, তা্ঁদের জন্য আমার করুণা হয়।
এই লেখাটি শুধুই রবীন্দ্রনাথের নেগেটিভিটি নিয়ে লেখা। এ জাতিয় লেখা মুক্তমনায় একেবারে বেমানান বলে আমি মনে করি। যদি তা্ঁর ভালো দিকগুলোও অনুসন্ধান করার চেষ্টা করা হতো তাহলে এটি নিয়ে আর কোন কথা বলার থাকতো না। রবীন্দ্রনাথের ভালো দিকগুলো এই লেখায় আলোকপাত করা হয়নি। ইভেন লেখাটি পড়তে পড়তে একবারও মনে হয়নি যে রবীন্দ্রনাথের ভালো কোনও দিক থাকতে পারে।

লেখাটি পড়লে বোঝা যায়– রবীন্দ্রনাথ ভালো লিখতেন, তবে নকল কিংবা চুরি করে। তিনি গান লিখতেন অন্যের সুর নকল করে। তিনি শিলাইদহর মত বিশুদ্ধ গ্রামে গিয়েছিলেন কৃষকদের যতটা সম্ভব হাতিয়ে নিতে। তিনি অনেক লিখেছেন কারণ তিনি দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন। তিনি লেখালেখি করেছেন কারণ তাকে ভাত নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। এই মানুষের আবার ভালো দিক থাকতে পারে???

আলোচকরা বলেছেন, “একদল যেমন ভক্তিরসে ভরপুর হয়ে তাকে পূজা করে ছাড়ছে, অন্য দল তেমনি তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার বর্ষণ করে চলেছে, মূলত: সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে” এখন প্রশ্ন হচ্ছে তা্ঁরা কোন দলে? অন্তত এই প্রবন্ধ দিয়ে নিরপেক্ষ বা মাঝামাঝি পর্যায়ে দাবি করা সম্ভব না। তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চাই, একজন শিল্পীকে তা্ঁর শিল্প দিয়েই বিচার করা হোক। আমরা যেহেতু প্রতিটা মানুষই ভুলে ভরা। সুতরাং অন্যের ভুল নিয়ে এতো মাতামাতি করার কোনও প্রয়োজন দেখি না, আর মানুষটি মৃত হলে তো আর কোনও প্রশ্নই আসে না। আর একটা মানুষকে পূজা করা তো আমি গণ্ড মূর্খের কাজ বলে মনে করি।

আলোচকরা বলছেন- […] …যেখানে কবি সাহিত্যিকদের বেশিরভাগেরই প্রতিষ্ঠা আসে জীবনের প্রথম চল্লিশ বছরের মধ্যে, তারপর তাদের মোটামুটি বন্ধ্যাত্ব নেমে আসে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু লিখে গিয়েছেন অকাতরে। শুধু লিখে গিয়েছেন বললে ভুল হবে, উৎকর্ষের দিক দিয়ে বরং শেষের লেখাগুলো ছাড়িয়ে গিয়াছে আগের রবীন্দ্রনাথকে। এ বিষয়ে নীরদ চৌধুরী লিখেছেন: ওয়ার্ডসওয়ার্থ, টেনিসন, ব্রাউনিং কেহই পরবর্তী জীবনে আগের রচনার তুলনায় উৎকৃষ্টতর কবিতা লেখেন নাই- ইহাদের কবিকীর্তি চল্লিশ বতসরের আগে রচিত কাব্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।” তার মানে তা্ঁরা বোঝাতে চাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে দুই নাম্বারি করে চালিয়ে গেছেন, নইলে তা্ঁরও ওয়ার্ডসওয়ার্থ, টেনিসন, ব্রাউনিং-এর দশা হতো। এক্ষেত্রেও তা্ঁরা নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মন্ত্র পাঠ করেছেন। (আমি আগেই বলেছি, নীরদচন্দ্র চৌধুরীর অনেক কথা প্রামাণ্য হিসেবে ধরা যাবে না, কারণ সেগুলোর কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। কথাটা শঙ্খ ঘোষের) কিন্তু তা্ঁরা বিজ্ঞান মনষ্কা মানুষ হওয়া স্বত্বেও নীরদচন্দ্র্রের কুসংস্কারকে কেন প্রাধান্য দিলেন তা বোঝা বেশ কষ্ট সাধ্য। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বিশ বছরের আগেই লেখালেখি করে নাম কামিয়েছেন, অনুবাদ করেছেন শেক্সপিয়র। সুতরাং তিনি যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, টেনিসন, ব্রাউনিং নন, তা নিশ্চয় বলা যায়?

‘তার দীর্ঘায়ু তাকে এ সুযোগ-সৌভাগ্য দিয়েছে।” এবং‌ ‌ ‘সচ্ছল পরিবারে জন্ম হওয়ার কারেণ তাকে জীবিকা নিয়ে তেমন করে ভাবতে হয়িন কখনো। ফলে আমৃত্যু তিনি সার্বক্ষণিক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অফুরান সময় পেয়েছেন।”– এ কথা বার বার বলে তা্ঁর সমস্ত সৃষ্টিকর্মকে হেয় করার একটা প্রচেষ্টা এই লেখাটিতে করা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের গানকে নতুন ভাবে পরিবেশনের পক্ষে এখানে বলা হয়েছে। আমি তার বিরোধিতা করছি না। তবে শ্রোতারা যদি সত্যিই তা চান, তাহলে নিয়ম করে তা ঠেকাতে পারবে না কেউ। আমার মনে হয় শ্রোতারা এখনো সেটা চাইতে শুরু করেনি।

আসলেই কি তাই?ফরিদ আহমেদ এবং অভিজিৎ–কে অনুরোধ করে বলবো, নীরদচন্দ্র, আহমদ শরীফ, ও ফরহাদ মাযহারের মত মানুষের লেখাগুলো মগজ থেকে বের করে একটু মুক্তচিন্তা করে দেখার জন্য। রবীন্দ্রনাথের জীবনী ও সাহিত্যকর্মগুলোকে আরও একবার পড়ে নিজ মেধায় গবেষণা করার জন্য, আমার মনে হয় তিনি রবীন্দ্রনাথের এতো এতো পটজিটিভ দিক পাবেন যে তা লিখতে গেলে মুক্তমনার ধার্য ক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে। তখন রবীন্দ্রনাথের মানুষ হিসেবে যে সীমাবদ্ধতা আছে তা তা্ঁরা এতো গুরুত্ব দিয়ে আমলে আনবেন না। এটা আমার বিশ্বাস আর কি। নির্ভর করছে গ্রহীতার ওপর। ফুলে যতই মধু থাক না কেন ভ্রমর সেখান থেকে বিষই নেবে, আর মৌমাছি মধু। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে আমরা চাই দুই যায়গা থেকেই ফুলকে বিশ্লেষণ করতে।

আমি রবীন্দ্র মৌলবাদ নই, কিন্তু তা্ঁর ভুলগুলো গ্রহণ করেও আমি তা্ঁকে মহামানব বলে স্বীকার করি, মানে সাধারণ মানুষ নন বলে মান্য করি। আলোচ্য প্রবন্ধটি পড়ে তার কোনও হেরফের হয়নি। আর তা্ঁকে নবী বা ভগবানের আসনে বসানোর প্রশ্ন তখনই আসে যখন আমি এই দুটোকে বিশ্বাস করবো। সুতরাং এ প্রশ্ন আমার ক্ষেত্রে বাতিল বলে ধরে নিচ্ছি। তবে তা্ঁকে বাঙালির ভগবান বা নবী (ভিন্ন অর্থে) হিসেবে মনে করাকে আমি অন্যায় মনে করি না।

তবে হ্যা্ঁ, আমি ফরিদ আহমেদ এবং অভিজিৎ- কে ধন্যবাদ জানাই যে তা্ঁরা আমাদের সাহিত্য নিয়েও ভাবছেন। একজন শিক্ষিত মানুষের তা্ঁর দেশের বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, কৃষি, সমাজ ব্যবস্থাসহ আরো আরো অনেক বিষয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার দরকার আছে। এটা হলেই আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে impersonal হওয়াটা খুব জরুরি। আর রবীন্দ্রনাথ বা্ঁচবেন কি মরবেন সেটা বরং আমরা সময়ের উপরেই ছেড়ে দিই। মাতামাতি তো আর কম হলো না, আসুন আমরা অন্যদের নিয়েও ভাবি।

কেউ মনে করতে পারেন, মুক্তমনায় বসে মুক্তমনার এডমিনদের লেখা নিয়ে আমি সমালোচনা করছি। আমার মত পুঁচকে ইঁদুরের সাহস তো কম না ?!? কিন্তু এটা “মুক্তমনা”। এখানে সবই সম্ভব। আশা করি, মুক্তমনায় রবীন্দ্রনাথের মত নিচু মানসিকতার এমন কেউ নেই যার লেখার সমালোচনা করলে ক্ষেপে যাবেন এবং স্বনামে কিংবা ছদ্মনামে তার প্রতিবাদ করবেন !!
সুতরাং আমি নির্ভয়ে থাকতে পারি?