প্রবন্ধ ও গবেষণায় সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০০৭ সনের বাংলা একাডেমী পুরষ্কারপ্রাপ্ত লেখক যতীন সরকারের জন্ম নেত্রকোনা জেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে। লেখকের প্রথম বই ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’। ২০০৫ সালে তাঁর ‘পাকিসত্মানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’-এর জন্য তিনি ‘প্রথম আলো’ পুরষ্কার পান। চল্লিশ বছরেরও অধিক কাল অধ্যাপনার সাথে যুক্ত থাকার পর বর্তামানে তিনি নেত্রকোনায় অবসর জীবন-যাপন করছেন।

মোজাফফর : স্যার, এই সময়ে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে কেমন বোধ করছেন ?

যতীন সরকার : খুব যে ভালো বোধ করছি তা না, কিন্তু আমি তো এরকমই…।

মোজাফফর : বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক জনাব শামসুজ্জামান খান তাঁর একটি বইতে বলেছেন-
‘অধ্যাপক যতীন সরকার আমাদের কালের এক তুখোড় পণ্ডিত, তীক্ষ্ণ মেধা ও উদ্ভাবনাময় সৃজনী শক্তির অধিকারী লেখক ও চিন্তাবিদ এবং আকর্ষণীয় বক্তা। আমার বিবেচনায় আমাদের প্রজন্মের তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তক ও সমাজ-সংস্কৃতির ভাষ্যকার।’
এ মন্তব্য সম্পর্কে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

যতীন সরকার : শোনো, এই যে মন্তব্য, এটা হচ্ছে আমার বন্ধুর মন্তব্য। শামসুজ্জামান খান আমার বন্ধু, কাজেই এইটা হচ্ছে বন্ধুকৃত্য। এখান থেকে বস্ত্তগত সত্তা আহরণ সম্ভব হবে না। এই সম্পর্কে মন্তব্য না করাই উচিত বলে আমি মনে করছি।

মোজাফফর : আমাদের লোকসংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধশালী? লোকসংস্কৃতির চর্চা ও চর্যা একটা জাতির জন্য কেন এবং কতখানি প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

যতীন সরকার : পৃথিবীর সমস্ত মানুষের এই যে লোকসংস্কৃতি, সেই দেশের উপযোগী সংস্কৃতি এটা। আমাদের দেশের লোকসংস্কৃতি তো অবশ্যই সমৃদ্ধিশালী এবং অসামান্য সমৃদ্ধিশালী। লোকসংস্কৃতি হচ্ছে একটা জাতির প্রকৃত সংস্কৃতি। সমস্ত সংস্কৃতির উৎস মূলই হচ্ছে লোকসাধারণ বা মানুষ। কাজেই তাই যদি হয়, তাহলে লোকসংস্কৃতির বাইরে অন্য সংস্কৃতির কথা বলা তো অর্থহীন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত সংস্কৃতির উৎসমূল যেহেতু লোকসংস্কৃতি সেহেতু লোকসংস্কৃতি চর্চার গুরুত্বের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

মোজাফফর: আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির একজন বিদগ্ধ ভাষ্যকার হিসাবে গতানুগতিক ব্যাখ্যার বাইরে, ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে এমন কিছু বলুন যাতে করে জাতি হিসাবে আমরা লোকায়তে আস্থাশীল হতে পারি।

যতীন সরকার : শোনো, এই যে আমার নামের আগে বিদগ্ধ-টিদগ্ধ লাগাচ্ছো তা মোটেও ঠিক না। একটা কথা আমি বলি লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে, অনেকে আবার লোকসংস্কৃতি বলতে রাজি না, ফোকলোর শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে চায়, সেই ফোকলোর সম্পর্কে আমাদের দেশে যে আলোচনা হচ্ছে সেই আলোচনা একেবারে ঊনবিংশ শতাব্দি থেকে হয়ে আসছে এবং তার মধ্যে অনেকেরই অবদান আছে – এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইদানিং লোকসংস্কৃতি বা ফোকলোরের আলোচনায় পাশ্চাত্য প্রভাব অত্যন্ত বেশি, প্রভাবটা যে একেবারে খারাপ সে কথা আমি বলি না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক দুনিয়া, পাশ্চাত্যের সমস্ত সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে একটা পক্ষপাতিত্ব বা খন্ডত্ব বিদ্যমান। কাজেই আমি মনে করি, প্রকৃত প্রস্তাবে সংস্কৃতি বিষয়ক যে কোন বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে যে দৃষ্টিভঙ্গিটা অবলম্বন করা উচিৎ সেটাকে অবশ্যই হতে হবে দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এখন সেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ঠিক কী রকম আলোচনা করা উচিৎ এবং সঙ্গত বলে আমার ধারণা, সেইরকম আলোচনা আমাদের দেশে খুব কমই হচ্ছে বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে ঐ আমেরিকান ফোকলোরবিদদের চিন্তা-চর্চার প্রচলন অনেক বেশি এবং সেই ধারা ধরেই আমাদের ফোকলোরবিদ যারা আছেন তাঁরা আলোচনা করতে চান। এ পর্যন্ত ফোকলোর নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে আমার বন্ধু শামসুজ্জামান খান-এর আলোচনা যথেষ্ট পরিমাণ সমৃদ্ধ এবং তার মধ্যে অনেক নতুন কিছু আমরা খুঁজে পাই – এটা বন্ধুকৃত্য নয় কিন্তু। তারপরও বলি, আমার কথা জানতে চেয়েছ যেহেতু, তথাগত আলোচনা বা বিশ্লেষণের বাইরে যদি দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদের ভিত্তিতে লোকসংস্কৃতি তথা ফোকলোর আলোচনা করতে হয় তাহলে আমি বলবো, বৃটিশ দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদের বিশ্লেষক Christopher Caudwell-এর Illusion and Reality বইটিকে আমাদের দেশের ফোকলোরবিদরা ফোকলোর আলোচনার উৎস হিসাবে কোনমতেই বিবেচনা করেন না। কিন্তু আমার তো মনে হয় এই বইটিতে ক্রিস্টোফার কডওয়েল কবিতার উৎপত্তি সম্পর্কে যে সমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন তার মধ্যেই আমরা ফোকলোর আলোচনার প্রকৃত দিশা পেয়ে যেতে পারি এবং তাঁকে অনুসরণ করেই পরবর্তী কালে জর্জ টমসন যে আলোচনা করেছেন সেইগুলি আমাদের ফোকলোর আলোচনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে আমি মনে করি। কাজেই আমাদের যারা ফোকলোরবিদ আছেন তাঁদের এই দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলেও আমার ধারণা। বাঙালির মধ্যে যারা ফোকলোরবিদ হিসাবে খ্যাত তাঁদের বাইরে প্রকৃত ফোকলোরবিদ হিসাবে আমি বলব দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায়ের কথা। দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায়-এর ‘লোকায়ত দর্শন’ বইটির প্রথমেই জর্জ টমসনের সঙ্গে তিনি যে আলোচনা করেছেন সে কথাগুলি বিবৃত করেছেন, এবং জর্জ টমসনের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই বলা যেতে পারে লোকায়ত দর্শনকে নতুন দৃষ্টিতে তিনি দেখতে পেয়েছেন। কাজেই এই ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থটিতে অভিব্যক্ত এবং তারপরে আরো অন্যান্য বইয়ের মধ্যে দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায় যে আলোচনাগুলি করেছেন সেগুলি আমাদের ফোকলোর আলোচনার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে যদি যথার্থ অর্থেই ফোকলোরের বিশ্লেষণ করতে হয়, তাহলে ক্রিস্টোফার কডওয়েল, জর্জ টমসন এবং দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায়-এর আলোচনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

মোজাফফর : ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’ নামে একখানি মূল্যবান বই লিখেছেন আপনি। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী শোষণ, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদ ইত্যাদি বিভেদসৃষ্টিকারী মানবতাবিরোধী পরিস্থিতি মোকাবেলায় লোকায়ত জীবন দর্শন কিংবা লোকধর্মের ভূমিকা সম্পর্কে সংক্ষেপে বলুন ।

যতীন সরকার : অবশ্যই লোকয়ত জীবনদর্শন বা লোকধর্মের জোরালো ভূমিকা আছে। যেমন অন্যতম প্রধান লোকধর্ম সম্প্রদায় বাউলরাই জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাম্প্রদায়িক ধর্মের ভেদ-বিভেদের বিরুদ্ধে, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতি। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সুবিধাভোগী শ্রেণীর ভাবাদর্শের প্রচারকরা সামাজিক বৈষম্যের ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন ধর্ম ও ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে, কিংবা নিম্নবর্গের মানুষের ইহলোকের বঞ্চনাজনিত দুঃখকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছেন পরলোকের অনন্ত সুখের আশ্বাস দিয়ে। প্রাকৃতজনের প্রতিনিধি বাউলরা এ ধরনের গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে প্রতিবামুখর হয়ে উঠেছেন।

মোজাফফর : একজন রাজনীতি সচেতন লেখক এবং সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করুন :

যতীন সরকার : বর্তমান যে রাজনীতি, এটার অবশ্যই অনেক ইতিবাচক দিক যেমন আছে তেমন নেতিবাচক দিকও আছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে, আমরা সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র গড়ে তুলেছি এবং সেই রাষ্ট্রটির জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই। কাজেই সেই সংবিধানটি আমাদের সামনে একটি উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মত। সেটিকে লক্ষ্য করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বর্তমানে দেখা গেছে, স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই আমাদের স্বাধীনতার অর্জনকে কেড়ে নিয়ে গেছে লুটেরা, ধনিকরা। এখন এই দেশটিতে লুটেরা, ধনিকদেরই প্রাধান্য। এই লুটেরা, ধনিকরা আজ এই দলে, কাল ঐ দলে থেকে আমাদের শাসন করে যাচ্ছে। এই অবস্থানটির অবশ্যই প্রতিষেধক প্রয়োজন এবং সেইটির জন্যই আমাদের জনগণের মধ্যে আরও নতুন চেতনা, জঙ্গী চেতনা জাগ্রত হয়ে উঠবে, তারা এই দেশটিকে নতুন রাষ্ট্র পত্তনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবে বলে আমি মনে করি। কিন্তু বর্তমানে ঠিক যেমনটা আমরা আছি এই অবস্থার উত্তরণ না ঘটলে কোন মতেই আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা আশাবাদী হতে পারি না।

মোজাফফর : দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন আপনি। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও নতুন শিক্ষানীতিকে কীভবে দেখছেন ?

যতীন সরকার : একটা জিনিস আমি বুঝি, শিক্ষানীতিকে সমাজনীতি থেকে, সমাজব্যবস্থা থেকে আলাদা করে চিন্তা করা যায় না। একটা শিক্ষানীতিকে পরিপূর্ণভাবে, যথার্থরূপে, সকল মানুষের উপযোগী করার জন্য কোনো কমিটি-কমিশনের কার্য না, যদি না সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাটার পরিবর্তন ঘটে। কাজেই সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আমাদের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এর আগ পর্যন্ত এই শিক্ষানীতি সেই শিক্ষানীতি- এগুলো জোড়াতালি ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমরা তো জোড়াতালির অবসান চাই। আমরা চাই, একটা যথার্থ নতুন সমাজতান্ত্রিক দেশ। সেটি করার জন্য এই সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের নতুন শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠার পথ অবারিত হবে- এই আমি মনে করি।

মোজাফফর : মার্কসবাদের ভবিষ্যৎ কি? একজন মার্কসবাদী লেখক এবং চিন্তক হিসেবে আপনি কী মনে করেন বাঙালীর সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কোন পূনর্জাগরণ ঘটবে ভবিষ্যতে?

যতীন সরকার : এই মার্কসবাদ শব্দটা অনেকেই ব্যবহার করে, আমিও করি, কিন্তু মার্কসবাদ শব্দটা খুব খন্ডিত বলে আমি মনে করি। মার্কসবাদ বলতে বোঝায় মার্কস যা বললেন তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা। আমি মনে করি, মার্কসবাদের মূল দর্শন হচ্ছে ‘ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ’ বা historical dialectical materialism। আমি এই দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ শব্দটাই মার্কসবাদের বদলে ব্যবহার করতে চাই। এই দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদের দৃষ্টিকোন থেকেই সমস্ত কিছু অবলোকন করতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা হচ্ছে যথার্থ বিজ্ঞান সম্মত দৃষ্টিভঙ্গি। কাজেই সেই বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণ করলে আমরা অবশ্যই বুঝতে পারবো, যাকে তুমি বলছো মার্কসবাদের ভবিষ্যৎ, সেই মার্কসবাদের ভবিষ্যৎ তো আছেই, এটা ছাড়া আর কোনো গতি নাই, এটি হতেই হবে এবং এটি করার জন্য আমাদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। এই সংঘবদ্ধতার মধ্য দিয়েই আমাদের যে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে তখনই মার্কসবাদের ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই ব্যপারে আমি অনেক আশাবাদী।

মোজাফফর : সাইকোলজিক্যালি মানুষ হচ্ছে অস্থির প্রকৃতির, এবং স্বভাবগত ভাবেই ক্ষমতা লোভী ও সুবিধাবাদী। মোদ্দাকথা, মানুষ হচ্ছে পাশবিক ও মানবিক চেতনার সমন্বয়, এই সমন্বয় থেকে absolute good কি করে আনা সম্ভব?

যতীন সরকার : তোমার মানুষ সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গী সেটাকে আমি ভুল বলে মনে করি। আমি দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুসরণ করি। এই দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদী মনোবিজ্ঞান যেটা গড়ে উঠেছে সেকেনো এবং পাবলোবের হাত ধরে, সেই মনোবিজ্ঞান, তুমি যে মানুষের চরিত্র সম্পর্কে বলছো সেটাকে ভুল প্রমাণিত করে। মানুষ পাশবিক নয় তবে মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে হয়; সেই মানুষ হয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া সেটিই হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদী মনোবিজ্ঞানের বিষয়। তুমি যে কথাগুলো বললে সেটা হচ্ছে ফ্রয়েডীও বা নয়া ফ্রয়েডীও মনোবিজ্ঞানীদের অনুসরণে। দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদি মনোবিজ্ঞান ফ্রয়েডীও বা নয়া ফ্রয়েডীও কোনো মনোবিজ্ঞানকে সঠিক মনোবিজ্ঞান বলে মনে করে না। এবং এর বিপরীতে আছে আচরণবাদি বা behaviorism এই মনোবিজ্ঞানকেও কোনভাবে দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদি বা পাবলোবীও মনোবিজ্ঞান অনুমোদন করে না। অথচ এই পাবলোবীয় মনোবিজ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগ আমাদের দেশে বা আমাদের সমাজে নাই। এই সমগ্র উপমহাদেশে কিংবা যদি বলি সমগ্র এশিয়া মহাদেশে এই বিষয় সম্পর্কে যথার্থ বিশ্লেষণ বা আলোচনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘মানব মন’ বলে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা বের করেছিলেন। তিনি পাবলো পরিচিতি নিয়ে চারখন্ডের একটি বই লিখেছিলেন এবং তাঁর ‘বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যৎ’ নামে দুই খন্ডের একটি বই আছে, এছাড়াও আরো আরো লেখা আছে সেগুলি পড়লে মানুষের মনোজগতের যথার্থ রূপ জানা যায়, এই রূপ আমাদের মানুষ সম্পর্কে হতাশ হতে শেখায় না।

মোজাফফর : আমরা জানি, বই পড়তে কোন ক্লান্তি নেই আপনার। সকল বিষয়বস্ত্তর বই থাকে আপনার পাঠ তালিকায়। বই পড়াকে, একজন পাঠক ও একজন লেখক, এই দুই জায়গা থেকে কিভাবে দেখেন?

যতীন সরকার : বই আমি পড়ে এসেছি ছোটবেলা থেকেই। তবে আমি মোটেও মেধাবী নই। খুবই স্বল্প মেধার অধিকারী একজন মানুষ। কাজেই একজন প্রতিভাহীন, অত্যন্ত স্বল্পমেধার মানুষ হিসাবে আমি যে বই নিরলসভাবে পাঠ করে এসেছি, সেই বই থেকে যে যথার্থ জ্ঞান আমি আহরণ করতে পেরেছি এবং লেখক হিসাবে তার প্রকাশ ঘটাতে পেরেছি সেটা আমি মনে করি না। তবে ভবিষ্যতের প্রতি আমি অত্যন্ত আস্থাশীল। আমাদের নতুন লেখকরা যথার্থ পাঠক হয়ে নতুনভাবে চিন্তা করবেন এবং তাদের প্রতিভা আছে, সেই প্রতিভার পরিচয় তারা দেবেন। আমি আবারো বলছি, ভবিষ্যতের প্রতি আমি আস্থাশীল।

মোজাফফর : বর্তমান সময়ে আমরা দেখছি- money determines everything, সময়ের এই স্রোতে সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা কতখানি ?

যতীন সরকার : এই প্রশ্নের উত্তর অতি সংক্ষেপে দেওয়া যায় না। তবে সংক্ষেপে আমি এটুকু বলতে পারি, অর্থ যে সমাজের প্রধান বিষয় সেই সমাজের পরিবর্তন ঘটালে হবে না, সেই সমাজকে উৎখাত করতে হবে। সেই সমাজকে উৎখাত করার জন্যই আমাদের সাহিত্যকে নিয়োজিত করতে হবে। সাহিত্য বা শিল্পের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ (arts for arts sake) সেটাকে তো আমি বিশ্বাস করিই না, সেটাকে আমি ঘৃণা করি। মানুষের উত্তরণের জন্যই সাহিত্য হতে হবে, শিল্প হতে হবে – এটা আমি মনে করি। এবং এর বাইরে যারা নিজেদেরকে শিল্পী বলেন, সাহিত্যিক বলেন, তাদেরকে আমি মোটেও শিল্পী-সাহিত্যিক বলে মনে করি না।

মোজাফফর : বাংলাদেশের বর্তমান প্রবন্ধসাহিত্য প্রকৃতপক্ষে কতটুকু মননশীল ও মুক্তবুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে করেন?

যতীন সরকার : এই প্রশ্নের জবাব আমি খুব সংক্ষেপে দেবো- সবকিছু যে একেবারে সুন্দর হয়ে যাবে সেটা হতে পারে না। পৃথিবীতে অনেক জিনিস তৈরি হয় তার মধ্যে অনেক আগাছাও থাকে। কিন্তু আগাছাগুলি বড় কথা নয়, তার মধ্যে সত্যিকারের যে ফলবন্ত গাছ আছে সেটার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। কাজেই আমাদের প্রবন্ধসাহিত্যে হয়ত অনেক আগাছা জন্মেছে কিন্তু আগাছাটা বড় কথা নয়। আমি শুধু প্রবন্ধসাহিত্য কেন, সব ধরনের সাহিত্য নিয়ে বেশ আশাবাদী।

মোজাফফর : বর্তমানে বাংলাদেশে শিল্পসাহিত্যে এক দল অন্যদলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়, গালিগালাজ করে। শিল্প ও সাহিত্যে এই দলাদলিকে আপনি কিভাবে দেখেন ?

যতীন সরকার : দলাদলি সব সময় থাকে। দলাদলির মধ্য থেকেই, মানে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বলে, ‘বাদে বাদে গায়তে তত্ত্ববোধ’। বাদ এবং প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই প্রকৃত তত্ত্ব বা সত্য গর্জে ওঠে। কাজেই দলাদলি দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দলাদলির মধ্য থেকেই তো প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসে- বরাবরই এসেছে, এখনো আসছে, আগামীতেও আসবে।

মোজাফফর : বাংলাদেশে লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করা কি সম্ভব? লেখালেখিকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তাকে আপনি কিভাবে দেখেন ?

যতীন সরকার : যারা প্রকাশকদের আনুকূল্য লাভ করেন, কেন করেন, কারণ তাদের বই যেভাবে লেখেন সেগুলি লাখ লাখ কপি বিক্রি হয় কিন্তু এই কাজটি সকলের জন্য করা সম্ভব নয়। নয় বলেই যারা সত্যি সত্যি সঠিক সাহিত্য সৃষ্টি করতে চান, মননশীলতার প্রকাশ ঘটাতে চান, তাদের পক্ষে বর্তমান অবস্থায় লেখালেখির মধ্য দিয়ে জীবিকা অর্জন করা অসম্ভব।

মোজাফফর : আবার ফোকলোর বিষয়ে ফিরে আসছি, দেশে একমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ আছে। আপনি কি মনে করেন আরো বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল-কলেজ পর্যায়েও ফোকলোর বিষয়ে পঠন-পাঠন হওয়া দরকার?

যতীন সরকার : অবশ্যই। ফোকলোর সম্পর্কে যথাযথ চিন্তা চেতনা সকলের মধ্যে পরিব্যপ্ত করে দেওয়ার জন্য সর্বত্র ফোকলোর চিন্তার বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণাগুলি পরিচিত করতে হবে। এবং এর জন্য সর্বত্রই ফোকলোরের আধুনিক দৃষ্টিকোন থেকে বা সমাজ পরিবর্তনের দৃষ্টিকোন থেকে সেটাকে পাঠ্য করতে হবে।

মোজাফফর : ফোকলোর বিষয়ে কোনো বই লেখার পরিকল্পনা আছে কি ?

যতীন সরকার : আমি বর্তমানে অত্যন্ত অসুস্থ। আমার বয়স পঁচাত্তর চলছে। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি এবং ডাক্তার যে রকম বলছে, পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। এখন কিছুই লেখাপড়া করতে পারি না। কাজেই নতুন করে কোন বই-পত্র লেখা সম্ভব না। ফোকলোর সম্পর্কে আমার যে সমস্ত কথা বলার মোটামুটি আমি আমার বিভিন্ন প্রবন্ধে বলে ফেলেছি। আমি যেহেতু দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদে বিশ্বাস করি, আমি মনে করি সবকিছুর যেমন বিকাশ আছে তেমন ক্ষয়ও আছে। এবং এই ক্ষয়টাও সত্য। এখন আমি মনে করি না আমার জীবন খুব একটা বিকশিত পর্যায়ে আছে যে এ সময়ে নতুন কিছু করতে পারবো।

মোজাফফর : মানুষ হিসাবে নিজের কাজের মূল্যায়ন করতে হলে কীভাবে করবেন।

যতীন সরকার : কোনো মূল্যায়ন নেই। আমি যে কাজ করেছি সেই কাজ খুবই অকিঞ্চিৎকর। প্রায় কিছুই আমি করতে পারি নাই। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি- এই পর্যন্তই। কিন্তু নিজের কাজ সম্পর্কে নিজেই আমি সন্তুষ্ট নই।

মোজাফফর : স্যার, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। দীর্ঘ কর্মময় ও সুস্থ জীবনের অধিকারী হোন।

সোজন্য : শাশ্বতিকীর লোকসংখ্যা।