হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকা আতিকের নিথর দেহটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন নারগিস। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। মাঝে মাঝে হঠাৎ কেঁপে উঠে আবার স্থির হয়ে যায়। এতেই বোঝা যায় এখনো বেঁচে আছে মানুষটা। গত দু’মাস থেকে এভাবেই আছে। আরো কতদিন থাকবে কে জানে। কতদিন এভাবে তাকেও হাসপাতালে একটি জীবম্মৃত মানুষের পাশে বন্দী জীবন কাটাতে হবে তা কেউ জানে না। মাঝে মাঝে নারগিসের মনে হয় আল্লাহও বোধহয় ভুলে গেছেন এই মানুষটার কথা। নইলে ছয় ছয়টি বছর পঙ্গু শয্যাশায়ী এই মানুষটির পাশে অহোরাত্র সময় কাটিয়ে গত দু’মাস কোমায় থাকা এরই সাথে তাকেও হাসপাতালে কাটাতে হচ্ছে দিনের প্রায় ২০/২২ ঘন্টা। মাঝে একবার বাসায় যান ঘর সংসারের তদারকি করে আবার তার জন্য খাবার তৈরি করে কাজের মেয়েটিকে সবকিছু বুঝিয়ে ফিরে আসেন এই চৌকুঠুরীতে। এই সময়টুকু কোনদিন মেয়ে, কোনদিন ননদ, কোনদিন জা বা পরিবারের অন্য কেউ এসে থাকেন। মেয়েও শ্বশুর বাড়িতে থাকে। চাকরি করে তাই খুব ঘন ঘন আসতে পারে না। ছেলে আসে সন্ধ্যের পর। অফিস থেকে প্রায়ই সরাসরি চলে আসে। সেই সময়টাই একটু ভাল কাটে। আর যেদিন সন্ধ্যায় মেয়ে-জামাই আর ছেলে আসে সেদিন যেন শয্যাগত নিথর মানুষটির কথা ভুলে যান। সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মনে রাখতে ইচ্ছে করে না। আসলে যে কথাটা নারগিস কাউকে বলতে পারেন না সেটা হচ্ছে তিনি প্রহর গুণছেন। মুক্তির প্রহর। এই প্রায় নিথর দেহটা একসময় স্থির হয়ে যাবে তারপর আসবে সেই কাঙ্খিত মুক্তি। যে মুক্তির জন্য গত আটাশটি বছর নারগিস শুধু পাখা ঝাপটেছেন খাঁচার পাখির মত। কিন্তু আটাশ বছর আগে যে শিকল তার পায়ে পরিয়ে এই খাঁচায় তাকে বন্দী করা হয়েছিল তা জীবনের দাবিতে দিনে দিনে আরো কঠিন হয়ে তার শরীরে দাগ বসিয়েছে। তৈরি করেছে গোপন ক্ষত আর সে ক্ষত থেকে রক্ত ঝরেছে দিন রাত অবিরাম। কিন্তু নারগিস ছাড়া আর কেউ তা দেখেনি। তিনিও দেখতে দেননি। কারণ দেখলে তাঁর জীবনতো শেষ হতো সাথে সাথে তাঁর সন্তানদের জীবনও হয়তো অন্ধকারে ডুবে যেত। না, নারগিস তা চান নি। এই একটা জায়গাতে তিনি একই সঙ্গে অসম্ভব দুর্বল এবং সবল।

হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ করে উঠল আতিক। নারগিস কাছে এগিয়ে গেলেন। মুখটা বিকৃত করে মাথাটা এদিক ওদিক নাড়াতে চেষ্টা করছে। মুখে কফ্‌ জমে গেছে। আস্তে করে মাস্কটা ওপরে তুলে টিস্যু পেপার দিয়ে মুখের এক পাশে গড়িয়ে পড়া লালা মুছে দিলেন। তারপর আরেকটা টিস্যু নিয়ে মুখের ভেতরটা পরিষ্কার করে মাস্কটা লাগিয়ে দিলেন। তারপর বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে এসে নিজের বিছানায় বসলেন। বালিশের নিচে থেকে ঘড়িটা বের করে সময় দেখলেন। এখনো এক ঘন্টার ওপরে সময় আছে খাবার দেবার। বাসা থেকে এসে দেড়টার দিকে খাবার দিয়েছেন টিউবে। তার মানে সাড়ে তিনটার দিকে দিতে হবে। এখন বাজে দুটো বিশ। বিছানায় কাত হলেন। ছেলে আসতে একেক দিন আটটাও বেজে যায়। তার মানে আরো পাঁচ ছ’ঘন্টার মতো। এর মাঝে একটু ঘুমিয়ে নিলে হয়। কিন্তু ঘুম আসে না। কতকাল আগে সেই ষোল সতের বছর বয়সে বেঁহুশ হয়ে ঘুমাতেন। মায়ের বকুনি শুনতে হত – “লেখাপড়া বাদ দিয়ে শুধু ঘুম আর ঘুম। ঘরের কাজেও একটু হাত লাগায় না। মানুষের ঘরে এরকম মেয়ে থাকলে মায়ের কতো শান্তি”। বলতেন ঠিকই কিন্তু কাজ করতে গেলে দিতেন না। বলতেন – “কেমন ঘরে পড়ো, কত কাজ করতে হয় কে জানে। ভাল মানুষের হাতে পড়লেতো ভাগ্য। আর যদি মন্দ” – পুরোটা শেষ না করেই জিভ কাটতেন – “কী অলক্ষুণে কথা বলছি”। মায়ের কথা শুনে নারগিস আর নাফিসা পিঠেপিঠি দু’বোন হেসে গড়িয়ে পড়তেন একজন আরেকজনের ওপর। অথচ এই মা-ই হঠাৎ দু’মাস জন্ডিসে ভুগে মরে গেলেন। এত দ্রুত ঘটে গেল ব্যাপারটা নারগিসরা তিন ভাইবোন যেন একটা উড়ন্ত বিমান থেকে পড়ে মরতে মরতে সাগরে পড়ে বেঁচে যাওয়া। নারগিস তখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে আর নাফিসা ক্লাস নাইনে। একমাত্র ভাইটি যে ছিল মায়ের চোখের মণি সে তখনো প্রাইমারির চৌকাঠ ডিঙোয় নি। এরকম অবস্থায় যা হয় – আত্মীয় স্বজনের পরামর্শে বাবা প্রথমে নারগিসের বিয়ে দিলেন তাঁরই ব্যবসায়ী বন্ধুপুত্রের সঙ্গে। সপ্তদশী নারগিসের সৌন্দর্য আতিকের পরিবারের মন প্রথম দেখাতেই কেড়ে নিয়েছিল। নারগিস অনেক কেঁদেছিল। বড়ফুফুকে ধরে বাবাকে বোঝাতে চেয়েছিল অন্তত বিএ-টা পাশ করতে চায় সে। কিন্তু বাবা দু-দুটো সোমত্ত মেয়ে ঘরে রেখে অফিসে যেতে স্বস্তি বোধ করছিলেন না। তাই এক রকম তড়িঘড়িই নারগিসের বিয়েটা হয়ে গেল এবং বিয়ের পরই বোঝা গেল বাবার আসল উদ্দেশ্য। সংসার দেখার লোক নেই, নাফিসা অনভিজ্ঞ আর ছোট্ট টুটুল একেবারেই শিশু তাই তাকে দেখার জন্যেও একজন লাগে সুতরাং নারগিসকে বিয়ে দেবার ছ’মাসের মধ্যে বাবা নিজেও বিয়ে করলেন তাঁরই এক দূর সম্পর্কের মামাত বোনকে।

দরজায় নক করার শব্দ হল। সম্বিত ফিরে পেলেন নারগিস। হায়, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন তিনি! উঠে বসলেন। আবার ঘড়িটা বের করলেন- তিন টা দশ। তার মানে নার্স এসেছে ওষুধ দিতে। টিউবের তরল খাবারের সঙ্গে ওষুধও মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। গায়ের কাপড়টা ঠিক করে দরজাটা খুলে দিলেন। নার্স ভেতরে ঢুকল। হাসিমুখে তাকাল নারগিসের দিকে। জিজ্ঞেস করল- “এখন কেমন আছেন আঙ্কেল?”
“ওই আগের মতই”। গতানুগতিক প্রশ্ন-উত্তর। শিফ্‌ট চেঞ্জ হয়েছে। এ বেলার ডিউটিতে এসে জানতে চাচ্ছে। “ওনার সাথে সাথে আপনারও অনেক কষ্ট হচ্ছে। অনেক দিন হাসপাতালে” – বলতে বলতে নার্স কাগজে মোড়া ওষুধগুলো নারগিসের হাতে দিল। তারপর রোগীর পায়ের কাছে রাখা চার্টটা দেখল। মাথার কাছে এসে অসাড় ডান হাতটা তুলে কিছুক্ষণ দেখল। চোখ দুটো খোলার চেষ্টা করল কিন্তু ভেতরের সামান্য একটা রেখা ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। তারপর নারগিসের দিকে ফিরে বললো “দু’ঘন্টা পর খাবার দিতে হবে আন্টি। ওনার শরীরটা কিন্তু বেশ ঠান্ডা মনে হচ্ছে আজকে। আমি ডিউটি ডাক্তারকে বলব একবার এসে দেখে যেতে”।

নার্স দরজায় শব্দ না করে বেরিয়ে গেল। নারগিস খাবার তৈরিতে মন দিলেন। প্রথম প্রথম টিউবে খাবার দিতে ভয় লাগত, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। খাবার এবং ওষুধ দিয়ে মগ-বাটি ধুয়ে এসে বসলেন বিছানায়। কিছুক্ষণ বসে আবার উঠে গেলেন বিছানায় শোয়া মানুষটির কাছে। সতের বছর থেকে শুরু করে এই সাতচল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত যার সঙ্গে ঘর করেছেন তাকে চেয়ে চেয়ে দেখলেন। বিয়ের প্রথম রাতেই যাকে মদ খেতে দেখে ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এর আগে কখনো কাউকে মদ খেতে দেখেন নি। ড্রয়ার থেকে বোতল বের করতে দেখে প্রথম বাসরের ভয় লজ্জা ভুলে উৎকন্ঠিত স্বরে প্রশ্ন করেছিলেন- “ওগুলো কী?”
“তেমন কিছু না। এই একটু ড্রিংকস আর কি। খেলে আমাদের খেলাটা জমবে ভাল”
কথাটা শুনে ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠেছিল নারগিসের। ছি ছি জীবনের প্রথম পরিচয় মুহূর্তে এরকম কথা! মনে হয়েছিল এত সাজসজ্জা এত আয়োজন ফুলে ফুলে সাজানো ফুলশয্যা সব মিথ্যে। তারপর এক সময় সত্যি সত্যি লোকটা তার দেহটা নিয়ে খেলা শুরু করেছিল আর অসহায় আত্মসমর্পনে অসহ্য যন্ত্রণায় বার বার কেঁপে উঠেছিলেন তিনি। একটা মত্ত হাতির মত তাঁর কোমল কৌমার্যকে ছিন্নভিন্ন করেছিল লোকটা। আর বিধাতার এমনই পরিহাস সে রাতেই গর্ভধারণ করেছিলেন নারগিস।

তারপর প্রতিদিনের সংসার করতে গিয়ে নারগিস বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর ব্যবসায়ী শ্বশুর কেন একজন সাধারণ চাকরিজীবীর কন্যাকে পুত্রবধূ করে এনেছিলেন। আতিক মোটেও ঘরমুখী ছিল না। বিয়ের মাস-দুয়েকের মধ্যে নারগিস যখন নিজের ভেতরে সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করেছে তখনো আতিক প্রায় প্রায়ই দু-চারদিনের জন্য উধাও হয়ে যেত। একবার তো প্রায় বারো দিন কোন পাত্তা নেই। শাশুড়ি গোপনে কান্নাকাটি করতেন। আতিকের ভাই বোনেরা নারগিসকে দেখলেই সরে পড়ত। এমন অবস্থায় শ্বশুর তাকে কুমিল্লা থেকে ধরে এনেছিলেন। পরে নারগিস জেনেছেন এক বিদেশে থাকা বন্ধুর বউয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা। কিন্তু এত কিছুর পরও লোকটা এতটুকু লজ্জা পায় নি। বাবার সঙ্গে এমন ভাবে ঘরে ফিরেছিল যেন এরকমটাই স্বাভাবিক। নারগিসের মনে পড়ে ফিরে আসার পর সে রাতে অনেক রাত পর্যন্ত নিজেদের ঘরের দিকে যেতে চান নি। শেষে শাশুড়ির গোপন কাকুতি-মিনতিতে বাধ্য হয়ে ঘরে ঢুকেছিলেন।
“কেমন আছ? আমি নাকি বাবা হতে যাচ্ছি?”
নারগিস কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে তাকিয়েছিলেন। লোকটার নির্লজ্জতায় তাঁর নিজেরই লজ্জা পাচ্ছিল। এই লোকটা তাঁর স্বামী! তাঁর নিজের সন্তানের পিতা!
“কি কথা বলছ না যে। তুমি দেখছি বেশ ফলবতী। এত তাড়াতাড়ি কনসিভ করে ফেললে। এ ক’দিনে দেখি আরো সুন্দর হয়েছ। এসো একটূ কাছে এসো না। কি লক্ষ্মী বউ আমার” – বলতে বলতে নারগিসের দিকে হাত বাড়িয়ে সেদিনও এগিয়ে এসেছিল লোকটা। নারগিস দু’হাতে ধাক্কা দিতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে তারই গায়ের ওপর পড়লেন। সাঁড়াশীর মত সবল দুটো হাত আবারো টেনে নিল পাশবিক নির্মমতায়।

এভাবেই তো কেটে যাচ্ছিল জীবন। শ্বশুর-শাশুড়ী দেবর-ননদ যত্ন করেছে আর যার যত্ন করার কথা সে শুধু ভোগই করেছে তাকে। অনভিজ্ঞ নারগিস কেবলই ভাবতেন বিয়ে মানে কি এই! তাহলে জীবন নিয়ে মানুষ এত স্বপ্ন দেখে কেন? কেন সেই কিশোরী বয়সেও বাসর রাতের অবুঝ স্বপ্নে ব্যাকুল হতেন? একেক সময় মরে যেতে ইচ্ছে করত। আবার তক্ষুণি কৌতূহল হত যে আসছে সে কেমন হবে? তাঁর সন্তান। কিন্তু এ সন্তান কি শুধু তাঁর!

বাবা আসতেন মাঝে মাঝে। আসত নাফিসা আর টুটুল। নারগিস আশ্চর্য হয়ে দেখতেন তখন লোকটার ভিন্ন চেহারা। টুটুলকে নাফিসাকে জামা-কাপড় দেয়া, বাবাকে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেয়া এমন কি নারগিসকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া এসবে কোন খামতি ছিল না। শুধু শাশুড়ী বাবার বাড়িতে যাবার সময় বার বার বলতেন, “বৌমা তোমার বাপের বাড়িতে আতিকের দোষের কথা বলো না। আমাদের প্রথম ছেলে তো। একটু বেশি আদরে ও একটূ এরকম হয়ে গেছে। ছেলে পিলে হলে ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া তোমার ঘরে সৎ মা। স্বামীকে ছোট করে কোন বউই বড় হতে পারে না”।

হ্যাঁ , তাই তো। ঘরে সৎমা। মা থাকলে না হয় মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বলতেন। হয়তো মায়ের কাছে থেকে যেতে চাইতেন। এখন কাকে বলবেন? নাফিসাকে বললে কষ্ট পাবে। আর টুটুলতো ছোট মানুষ। বাবা! বাবাকে বলে কী হবে? বাবা কি খোঁজ নিয়েছিলেন তাঁর এই বন্ধু পুত্রটির স্বভাব চরিত্র কেমন? বড় ব্যবসায়ী, শিক্ষিত ছেলে এই তো যথেষ্ট। আসলে নারগিস তখন বুঝতে পেরেছেন তাকে বিয়ে দিয়ে বাবা আসলে নিজে বিয়ে করার রাস্তাটা প্রশস্ত করতে চেয়েছেন। নইলে বিশ বছরের মত যার সঙ্গে ঘর করলেন তাকে ভুলতে দু’বছরও লাগল না। তবু যেতেন। আতিকই নিয়ে যেত। টুটুল আর নাফিসাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুত। এটা সেটা কিনে দিত। নিজের অসুখী জীবনে ভাই-বোনের প্রতি আতিকের আন্তরিকতা দেখে কিছুটা হলেও ভাল লাগত। কিন্তু তখনো নারগিস জানেন না দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্যে।

বাচ্চা হওয়ার সময় এগিয়ে এলে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছিলেন সিজার করতে হবে। ননদের এম-এ পরীক্ষা, শাশুড়ী প্রেশারের রোগী। ওদিকে নাফিসা তখন এস-এস-সি পরীক্ষা দিয়ে বাসায় বসে আছে। শাশুড়ী বললেন, “বোনটাকে কাছে এনে রাখো। ভাল লাগবে। তাছাড়া নীরার যখন পরীক্ষা তখন দরকার হলে ও তোমার সঙ্গে যে ক’দিন হাসপাতালে থাকতে হয় থাকবে”।
বাবাকে কথাটা বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। “ওর মা যখন নেই তখন নাফিসাকে তো থাকতেই হবে। টুটুলের জন্য ওদের মায়ের পক্ষেতো হসপিটালে থাকা সম্ভব হবে না”। আতিকই একদিন গিয়ে নাফিসাকে নিয়ে এসেছিল। বোনের কাছে থাকতে পেরে নাফিসাও খুশি। কতদিন পর দু’বোন এক সাথে। তাছাড়া আতিক প্রায়ই এখানে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যায়। নাফিসার খুব ভাল লাগে দুলাভাইকে। প্রায়ই অফিস থেকে এসে বলে, “আরে তোমার আপা না হয় পেট বাঁধিয়ে ঘরে বসে আছে। তুমি কেন থাকবে। চলো আমরা ঘুরে আসি”। নাফিসা বোনের অনুমতি চাইতো। কিন্তু নারগিসের একদম ইচ্ছে করতো না যেতে দিতে। অথচ আতিক পাত্তাও দিত না। তার মা-কে ডেকে বলত – “মা, নাফিসাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। বেচারী সারাদিন ঘরে বসে থাকে। পরীক্ষা দিয়ে বেড়াতে এসেছে”। এরপর নারগিসের আর বলার কিছু থাকত না। রাতে ওরা যখন ফিরে আসত নাফিসার হাতে অনেক উপহার যা বাবার সংসারে ওরা কোনদিন কম্পনাও করে নি।

তারপর খোকন হল। ছেলে হয়েছে শুনে প্রথমে ভয়ে সিঁটকে গিয়েছিলেন নারগিস। “তবে কি আরেকটি আতিকের জন্ম দিলাম! আরেকজন পুরুষ যে অনেক নারীকে কষ্ট দেবে!” পরমুহূর্তেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, “না এ সন্তান আমার। একে আমি মানুষ করব”। নবজাতক সন্তানের দিকে তাকিয়ে সব দুঃখ ভুলে গিয়েছিল সেই মুহূর্তের জন্য। শ্বশুর বাড়িতেও আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল পুত্র সন্তানের জন্মে। হাসপাতালে দশদিন থাকতে হয়েছিল নারগিসকে। দু-একদিন বাদ দিয়ে নাফিসাই তার সাথে থাকত। বাসায় আসার ক’দিন পর শাশুড়িই বলেছিলেন, “বৌমা, তোমার বোনকে পাঠিয়ে দাও”। কথাটা শুনে অপমানে গা জ্বলে উঠেছিল নারগিসের। “এ যেন বাঁদীর বাচ্চা। যখন দরকার হল আনলাম, দরকার শেষ হলেই পাঠিয়ে দিলাম”। আতিককে দিয়ে সেদিনই নাফিসাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় নাফিসার সে কি কান্না! নারগিস ধমকে দিয়েছিলেন – “ওরা বড়লোক দেখে তোর বুঝি এখানে থাকতেই ভাল লাগছে?”

নাফিসা চলে যাবার দু’মাস পর হঠাৎ একদিন নতুন মাকে নিয়ে বাবা এসে হাজির। বাবার মুখ অন্ধকার। বয়স যেন এ কিছুদিনে অনেক বছর বেড়ে গেছে। নারগিস বাবাকে বার বার বলছিল – “বাবা, টুটুল আর নাফিসাকে নিয়ে এলে না কেন?” বাবা কোন উত্তর দেন নি। কথার ফাঁকে নতুন মা নাতিকে দেখার ছল করে নারগিসের ঘরে এসেছিলেন। তারপর দিয়েছিলেন সেই দুঃসংবাদ যা শোনার চেয়ে মৃত্যুও অনেক সহনীয় মনে হয়েছিল নারগিসের। নাফিসা অন্তঃস্বত্তা। আর সে স্বীকার করেছে আতিকই- “মা!” চিৎকার করে উঠেছিলেন নারগিস। “তোমরা এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাও। আর কোনদিন এখানে এসো না। আমি নাফিসার মুখ দেখতে চাই না” – বলতে বলতে বিছানায় মুখ ঢেকে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার গলা দিয়ে অদ্ভুত এক স্বর বেরোচ্ছিল। নতুন মা দু’একবার ডেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছিলেন নারগিস। তারপর যখন জ্ঞান ফিরেছে তাকিয়ে দেখেছেন অন্যদের সঙ্গে বাবাও দাঁড়িয়ে আছে তাঁকে ঘিরে। নারগিস সবাইকে সরিয়ে দিয়ে বাবাকে বলেছিল – “আর কোন দিন এ বাড়িতে এসো না। আমি মরে গেছি। তুমিই আমাকে আর নাফিসাকে মেরে ফেলেছ। আমি আর কোনদিন তোমাদের মুখ দেখতে চাইব না। তোমরাও চেয়ো না” – বলে দেয়ালের দিকে ফিরে ছেলেকে খুঁজছিলেন। বাবা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেই যে গিয়েছিলেন আর আসেন নি। না আর কেউ কখনো ও বাড়ি থেকে আসে নি। নারগিসও যান নি।

তারপর এতগুলো বছর কেটে গেছে। ছেলের পর মেয়ে এসেছে। ততোদিনে সংসারের দায়িত্ব অনেকটা বুঝে নিয়েছেন। কিন্তু আতিকের উচ্ছৃঙ্খলতায় বাঁধ দিতে পারেন নি। শুধু নিজের স্বাধীনতায় একটা কাজই করেছিলেন। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর কাউকে না জানিয়ে লাইগেশান করিয়েছিলেন। আর সন্তান চান নি। তাই আতিকের পাশবিকতায় পিষ্ট হতে হতেও এক ধরনের স্বস্তি পেতেন। যে স্বস্তির কথা তার আপন কেউ জানে না। মনে পড়ে ছেলে-মেয়ে দুটো একটু বড় হওয়ার পর আতিক একদিন প্রশ্ন করেছিল – “আমার ফলবতী বৃক্ষটা হঠাৎ বন্ধ্যা হয়ে গেল কেন? তোমার পেটে দেখি বাচ্চা আসে না। পিল টিল খাও নাকি?” একটা ফুলদানী পরিষ্কার করছিলেন নারগিস। ইচ্ছে হচ্ছিল ওটাই লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারতে- যাক মাথাটা ফেটে, না হয় চোখটা অন্ধ হয়ে। কিন্তু কিছুই করেন নি। চুপচাপ সয়ে গেছেন শুধু ছেলে-মেয়ে দুটোর দিকে চেয়ে। মা হারিয়ে তিনি নিজে তো বুঝেছেন পৃথিবীতে মা কতটুকু। তাই সন্তানদের আগলে রাখতে চেয়েছেন। কখনো কখনো এমনও হয়েছে জোর করে তাকে দখল করার চরম মুহূর্তে মনে হয়েছে লোকটার অন্ডকোষদুটো টিপে দিলেই তো সব শান্তি। কিন্তু তাও করেন নি। শুধু রাতের পর রাত একটা নারী খাদকের দেহের নিচে পিষ্ট হয়েছেন আর মুক্তি কামনা করেছেন। হায় মুক্তি। তিরিশ বছর আগে সেই যে একটা শিকলে তাকে বাঁধা হলো সেই শিকলের টানে এই দানব রূপী মানুষটার মৃত্যুশয্যায়ও প্রচন্ড ঘৃণা বুকে নিয়ে তাকে সেবা করতে হচ্ছে।

আবারো ঘড় ঘড় শব্দে অবচেতন থেকে চেতনে ফিরে আসেন নারগিস। পাশে গিয়ে মুখ নিচু করে পর্যবেক্ষণ করেন। আজ একটু বেশিই শব্দ হচ্ছে। বুকে হাত দিলেন – কেমন যেন ঠান্ডা। তাড়াতাড়ি শরীরে নিচের দিকটা দেখার জন্য হাত চালালেন। পাথরের মত শরীরটা স্লেটের মত ঠান্ডা। নারগিসের সারা শরীরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। তবে কি সময়ের ঘন্টাধ্বনি আগত। মানুষটা এবার সত্যি সত্যি তাকে মুক্তি দেবে। হায় কতদিন এই মুক্তির প্রত্যাশায় ছিলেন। কতদিন লোকটা বাইরে যাওয়ার সময় মনে হত আর যদি ফিরে না আসত। কিন্তু তার প্রত্যাশাকে মিথ্যে করে দিয়ে প্রতিদিনই সে ঘরে ফিরেছে। তারপর ছ’বছর আগে একদিন অফিস থেকে হঠাৎ করেই ফোন এল – তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। শুনে সেদিনও এক ধরণের স্বস্তি পেয়েছিলেন নারগিস। কিন্তু ছেলে মেয়ের মুখ চেয়ে সংসারে আসন হারাবার ভয়ে আর লোক লজ্জার ভয়ে সবার আগে তাকেই ছুটে যেতে হয়েছে হাসপাতালে। সেই থেকে ছ’টা বছর অপছন্দের এই লোকটিকে সেবা করতে করতে নারগিস ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে গেছেন। আর গত ছ’মাস তো এই হাসপাতালের কেবিনে এক রকম বন্দী। “হায় আল্লাহ, আমার এ জীবন আর কত বোঝা বইবে। এ তোমার কেমন বিচার!” – মনে মনে স্রষ্টার কাছে অনুযোগ জানাতে জানাতে মানুষটার শরীর ঢেকে দিলেন। ডাক্তার বলেছেন ঠান্ডা লাগলে নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারে। নিজের বিছানায় এসে ঘড়ি দেখলেন। আবার খাবার দেয়ার সময় হয়েছে।

খাবার বানানোর সময় ছেলে এসে ঘরে ঢুকল। ছেলেকে দেখে হাসলেন নারগিস – “অফিস থেকে এসেছিস?”
“হ্যাঁ মা”
“দুপুরে খেয়েছিস?”
“হ্যাঁ। আজ কেমন আছে বাবা?”
“দ্যাখতো, বেশি ভাল মনে হচ্ছে না। শরীরটা অন্য দিনের চেয়ে বেশি ঠান্ডা মনে হচ্ছে”
ছেলে তানিম উঠে এসে বাবার পায়ের পাতায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে তাপ অনুভব করতে চাইল। নারগিস খাবার তৈরি করে এক হাতে নাকের নলটা খুলে অন্য হাতে ফিডিং কাপে খাবারটা নলে ঢালতে লাগলেন। কিছুটা ঢালার পরই টের পেলেন খাবারটা ভিতরে ঢুকছে না। হাতটা কেঁপে উঠল নারগিসের। ছেলেকে ডাকলেন – “তানিম, নার্সকে ডেকে আনতো। খাবার ঢুকছে না কেন?” তানিম তাড়াতাড়ি নার্সকে ডাকতে গেল।

নারগিস ভাল করে তাকালেন আতিকের মুখের দিকে। একবার কি নড়ে উঠল? বোঝা গেল না। নার্স এসে তাড়াতাড়ি হাত দেখল – “পাল্‌স তো নেই”। বুকে হাত দিল। তারপর মা ও ছেলের দিকে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে ছুটে গেল বাইরে। নারগিস তেমনি এক হাতে নল আর অন্য হাতে ফিডিং কাপ ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন বজ্রাহত মানুষের মত। ডাক্তার এসে তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর স্টেথোটা কান থেকে নামিয়ে নার্সকে ইঙ্গিত দিলেন নারগিসের হাত থেকে ফিডিং কাপটা নিয়ে নিতে। তানিমের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন – “আপনার কী হন?”
“বাবা”
“আপনার মাকে সরিয়ে নিন। আমি দুঃখিত” বলতে বলতে ডাক্তার নাকের নলটা সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তানিম মোবাইলে বোনকে ফোন করতে করতে কেঁদে উঠল – “বিনু, বিনু, হ্যাঁ, বাবা বাবা”।

আধঘন্টার মধ্যে আত্মীয় স্বজনরা হাসপাতালে এসে জড় হল। আতিকের ভাই বোনেরা কান্নাকাটি করছে। কাঁদছে নারগিস আর আতিকের সন্তানেরা – তানিম, বিনু। শুধু যে সিটটায় শুয়ে বসে এতদিন রোগী পাহারা দিয়েছেন সে সিটে একঠাঁই নির্বাক বসে আছেন নারগিস। তিনি বুঝতে পারছেন না এ মৃত্যু তার জন্য সুখের না দুঃখের। এত আকাঙ্খিত মুক্তি এলো অথচ তার আনন্দ হচ্ছে না। ছেলে-মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরল মাকে। “মা, তুমি এমন পাথর হয়ে আছো কেন মা? আমাদের দেখ। মা, মাগো”।

নারগিস ছেলে-মেয়ের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললেন, “তোদের টুটুল মামাকে খবর দে। আমি কতদিন তাকে দেখি না”। তানিম আর বিনু বুঝতে পারে না – মা কি পাগল হয়ে গেল? এসব কী বলছে? মায়ের চোখের দৃষ্টি এমন কেন? মা কি পাগল হয়ে গেছে?