কিছুদিন আগেও বাংলা ব্লগগুলো বীরাঙ্গনা সম্পর্কিত চলচ্চিত্র(অন্তত পরিচালিকা রুবাইয়াত হোসেন তো তাই দাবি করেছিলেন) মেহেরজান ইস্যুতে সরগরম ছিল। আমার পর্যবেক্ষণে, ব্লগারদের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মেহেরজানকে ডিফেন্ড করে ফারুক ওয়াসিফ সহ সমমনাদের লেখা কয়েকটা উত্তরাধুনিক রচনা। তাঁদের বদৌলতে “ডিসকোর্স”, “ন্যারেটিভ”, “কাউন্টার-ন্যারেটিভ” এর মত উত্তরাধুনিকদের প্রিয় কিছু শব্দ এখন হাস্যরসের উৎসে রুপান্তরিত হয়েছে। মেহেরজান নিয়ে বাদানুবাদ অনুসরণ করার সময় আমার বারংবার রিচার্ড ডকিন্সের “ডিজরোবিং পোস্টমডার্নিজম” প্রবন্ধটার কথা মনে হচ্ছিল। ভাবলাম লেখাটা ভাবানুবাদ করে ফেললে মন্দ হয় না। পৃথিবীতে সবসময়ই কিছু মানুষ ছিল যারা বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্টকে নিছক এক “বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গী” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পায়তারা করত- আগে করত মোল্লারা আর এখন করে একাডেমিক ভেক ধরে থাকা কিছু পন্ডিত। তাঁদের কাছে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা বলে কিছু নেই, দুনিয়াতে সব কিছুই আপেক্ষিক। রিচার্ড ডকিন্স সমাজবিজ্ঞানী না হলেও তিনি একজন বিজ্ঞানী, আর সমাজবিজ্ঞানীরা যখন বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্টের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে টানাহেচড়া করেন, তখন একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর এর একটা মোক্ষম জবাব দেওয়াটাই স্বাভাবিক। বলে রাখা ভাল যে ডকিন্সের এই প্রবন্ধটি আসলে এলান সোকাল এবং Jean Bricmont এর “Intellectual Impostures” বইটির রিভিউ।
:line:
মনে করুন আপনি একজন ভন্ড, আপনার বলার মত কিছু না থাকলেও আপনি শিক্ষায়তনে প্রতিষ্ঠিত হতে চান, আপনি একগাদা শ্রদ্ধাশীল শিষ্য দ্বারা সর্বক্ষণ বেষ্টিত থাকতে চান, আপনি চান সমগ্র বিশ্বের ছাত্রসমাজ আপনার বইয়ের পাতাগুলো পরম শ্রদ্ধার সাথে মার্কার দিয়ে আন্ডারলাইন করে পড়বে। আপনার লেখনরীতি তাহলে কিরকম হওয়া উচিত? অবশ্যই সাবলীল নয়, যত পরিস্কার করে লিখবেন ততই আপনার অন্তঃসার-শূণ্যতা প্রকাশ পাবে। এরকম কিছু একটা প্রসব করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন,
“We can clearly see that there is no bi-univocal correspondence between linear signifying links or archi-writing, depending on the author, and this multireferential, multi-dimensional machinic catalysis. The symmetry of scale, the transversality, the pathic non-discursive character of their expansion: all these dimensions remove us from the logic of the excluded middle and reinforce us in our dismissal of the ontological binarism we criticised previously.”
Felix Guattari একজন ফরাসী মনোবিশ্লেষক। এলান সোকাল ও ব্রিকমন্ট তাঁদের বইয়ে যেসকল কেতাদুরস্ত বুদ্ধিজীবিদের নগ্ন করেছেন, ইনিও তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এলান সোকালের ভাষায়, Guattari একই ধারায় বৈজ্ঞানিক, অপবৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক বিভাষা মিলিয়ে একটি সুস্বাদু, কিন্তু পুষ্টিবিহীন খিচুড়ী তৈরী করেছেন। মরহুম Gilles Deleuze ও খিচুরী রান্নায় একই মেধা প্রদর্শন করেছেন,
“In the first place, singularities-events correspond to heterogeneous series which are organized into a system which is neither stable nor unstable, but rather ‘metastable’, endowed with a potential energy wherein the differences between series are distributed … In the second place, singularities possess a process of auto-unification, always mobile and displaced to the extent that a paradoxical element traverses the series and makes them resonate, enveloping the corresponding singular points in a single aleatory point and all the emissions, all dice throws, in a single cast.”
স্যার পিটার মেদাওয়ার এসব দেখেই মন্তব্য করেছিলেন যে একালে রচনাশৈলীর গুরুত্ব যেন সবচেয়ে বেশি। এই রচনাশৈলীই আধুনিক চিন্তাভাবনাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। মেদাওয়ার আরও বলেন,
“সাবলীলতার বিরুদ্ধে আমি এক নীরব তৎপরতার উদাহরণ দিতে পারি। টাইমস লিটারেরী সাপ্লিমেন্টে স্ট্রাকচারালিজমের উপর এক লেখক মন্তব্য করেছেন যে যেসব চিন্তাভাবনা বিভ্রান্ত, সেসব চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় হল ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট লেখনরীতি ব্যবহার করা। কি অদ্ভুত কথা! যুদ্ধকালীন অক্সফোর্ডের এক প্ররক্ষকের(warden) কথা মনে পড়ে গেল- বিমানহামলার সময় সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে শত্রুবাহিনীর বিমান আমাদের খুজে না পায়, তবে চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় আমরা খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলাম না। আমাদের প্ররক্ষক তখন আমাদের কালো চশমা পড়ে বসে থাকার উপদেশ দিলেন। প্ররক্ষক সাহেব অবশ্য রসিকতা করছিলেন, তবে উপরের লেখকসাহেব মোটেই রসিকতা করেননি।”
মেদাওয়ারের এই উক্তিটি ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর “প্লুটো’স রিপাবলিক” গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। তখনকার “নীরব তৎপরতা” এখন সরব হয়ে গিয়েছে।
Deleuze এবং Guattari মিলে অনেক বই লিখেছেন। প্রখ্যাত মিশেল ফুকো সেগুলোকে বলেছেন, “among the greatest of the great…Some day, perhaps, the century will be Deleuzian”। এ প্রসঙ্গে সোকাল এবং Bricmont বলেন, “এই লেখাগুলোতে প্রচুর ব্যাকরণগত ক্রুটি ও অপ্রয়োজনীয় বাক্য রয়েছে। আমরা সেরকম কিছু বাক্য পাদটীকায় আলোচনা করেছি, বাকিটা নাহয় পাঠকরাই বুঝে নিবেন”। কিন্তু পাঠকদের জন্য এই কাজটা কঠিন। আমাদের মনোজগতে নিঃসন্দেহে অনেক ভাবনা রয়েছে যা কোনমতেই বোধগম্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আবার এমন ভাষাও আছে ভাবনার অনুপস্থিতিকে ঢাকার জন্য যেগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বোধ্য করা হয়েছে। কিন্তু আমরা পার্থক্যটা বুঝব কিভাবে? এমনকি হতে পারে যে মহারাজ আসলেই ন্যাংটা হয়ে হাটছেন নাকি তা বোঝার জন্য আমাদের অভিজ্ঞ চোখ লাগবে? আমরা কিভাবে বুঝব যে এই কেতাদুরস্ত এবং প্রভাবশালী ফরাসী “দর্শন” আসলেই উপর দিয়ে ফিটফাট কিন্তু ভেতর দিয়ে সদরঘাট?
সোকাল এবং ব্রিকমন্ট দু’জনই পদার্থবিদ। তাঁরা তাঁদের সমালোচনা সেসব বইতেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন যেগুলোতে পদার্থবিজ্ঞান আর গণিতের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে তাঁরা যা বলেন, তা জেনেশুনেই বলেন। Lacan এর উপর তাঁরা খুব গুরুত্ব আরোপ করেছেন, এই ভদ্রলোক আমেরিকান এবং ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক অনুষদগুলোতে বিশেষ জনপ্রিয় কিনা। তাঁর এই জনপ্রিয়তার পেছনে একটা কারণ হতে পারে যে তাঁর লেখা পড়লে মনে হয় তিনি গণিত ভাল বোঝেন:
“Lacan গণিতের থিওরী অব কমপ্যাক্টনেসের কিছু কীওয়ার্ড ব্যবহার করলেও তিনি সেগুলোর মূল অর্থকে পরোয়া না করে সেগুলোকে উল্টাপালটাভাবে ব্যবহার করেন। তিনি “কমপ্যাক্টনেস” এর যে সংজ্ঞা দিয়েছেন সেটি শুধু ভুল না, একদম অর্থহীন প্রলাপ।”
এরপর সোকাল এবং ব্রিকমন্ট Lacan এর গাণিতিক যুক্তির একটি উদাহরণ দেন,
“Thus, by calculating that signification according to the algebraic method used here, namely:
এই ধাচের যুক্তির অসারতা বোঝার জন্য গণিতবিদ হওয়া লাগে না। সাহিত্যিক আল্ডোস হাক্সলির একটা চরিত্রের কথা মনে পড়ে যিনি ১কে ০ দিয়ে ভাগ করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব “প্রমাণ” করেছিলেন, কারণ এককে শূণ্য দিয়ে ভাগ করলে অসীমতা পাওয়া যায়! Lacan এর পর পুংলিঙ্গ নিয়ে একটা মজার সিদ্ধান্ত নেন,
“The erectile organ is equivalent to the V-1 of the signification produced above, of the jouissance that it restores by the coefficient of its statement to the function of lack of signifier (-1) ”
সোকাল আর ব্রিকমন্টের গাণিতিক দক্ষতার সাহায্য ছাড়াই বলে দেওয়া যায় যে এই ব্যক্তি একজন জালিয়াত। তবে তাঁকে বেনেফিট অব ডাউট দেওয়া যেতে পারে- তিনি কি বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়ে কথা বলার সময়ে সৎ থাকেন? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যেই দার্শনিক শিশ্নকে -1 এর বর্গমূলের সাথে তুলনা করতে পারেন, সেই দার্শনিক সব ক্ষেত্রেই তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। যে বিষয়ে আমি কিছু জানি না, সেই বিষয়ে তাঁর মতামত আমি ভুলেও গ্রহণ করব না।
সোকাল এবং ব্রিকমন্ট এরপর একজন নারীবাদি “দার্শনিক” এর জন্য পুরো একটা অধ্যায় নিয়োজিত করেছেন- Luce Irigaray। এক কুখ্যাত নারীবাদি সান্ড্রা হারডিং তাঁর “দ্যা সায়েন্স কুয়েশ্চেন ইন ফেমিনিজম” গ্রন্থে নিউটনের সুবিখ্যাত ফিলোসফিয়া ন্যাচারালেস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা গ্রন্থকে “ধর্ষণ ম্যানুয়াল” এর সাথে তুলনা করেছিলেন। Luce একই ধারায় আইন্সটাইনের E=mc2 এর মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্য খুজে পেয়েছেন,
“it privileges the speed of light over other speeds that are vitally necessary to us”
“privilege” শব্দটাকে আমি হাইলাইট করেছি, কারণ আমি জানতে পেরেছি যে উত্তরাধুনিক বৃত্তে এই শব্দটা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। Luce তরল গতিবিদ্যাকেও(fluid mechanics) ছাড় দেননি। আপনি খেয়াল না করলেও Luce খেয়াল করেছেন যে তরলকে তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। “পুরুষবাদী পদার্থবিজ্ঞান” তরলের থেকে শক্ত, সমর্থ বস্তুকে বেশি “privilege” দেয়। Luce জটিল ভাষা ব্যবহার করে আমাদের সবাইকে বোকা বানিয়েছিলেন, তাঁর আমেরিকান ব্যাখ্যাকারী ক্যাথেরিন হেইলস সহজ ভাষা ব্যবহার করে থলের বেড়াল বের করে দিয়েছেন। প্রথমবারের মত আমরা মহারাজের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলাম- মহারাজ আসলে ন্যাংটা:
“কঠিন বস্তুকে তরল গতিবিদ্যার উপর privilege দেওয়ার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ আছে, বিজ্ঞান তরলের উত্তাল প্রবাহ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো যে কারণে সমাধান করতে পারছে না তা হল যে পুরুষতান্ত্রিক বিজ্ঞান তারল্যকে নারীত্বের সাথে মিলিয়ে ফেলে। পুরুষের যেখানে বহিঃসৃত ও অনমনীয় যৌনাঙ্গ রয়েছে, সেখানে নারীর রয়েছে ঋতুস্রাব আর যোনিজ তরলের নির্গমনের জন্য একটি রন্ধ্র…… এভাবে দেখলে এটা খুব বিস্ময়কর ঠেকে না যে বিজ্ঞান এখনও তরলের উত্তালতার কোন সফল মডেল দাঁড়া করাতে পারেনি। এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না, কারণ বিজ্ঞান তরলকে নারীত্বের মতই এমনভাবে উত্থাপন করেছে যে এটি নারীত্বের মতই অপ্রয়োজনীয়রকম রহস্যময়।”
আবারও বলছি, এরকম যুক্তির অসারতা অবলোকন করার জন্য পদার্থবিদ হওয়া লাগে না। পদার্থবিদ সোকাল আর ব্রিকমন্ট বলেন যে সমস্যার মূল কারণ হল- তরলের উত্তালতা সম্পর্কিত Navier আর স্টোক্সের সমীকরণের সমাধানটা বেশ কঠিন।
সোকাল আর ব্রিকমন্ট এরকম আরও অনেক জালিয়াতি তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে আছে পদার্থবিদ্যার আপেক্ষিতার তত্ত্ব(relativity) আর দর্শনের আপেক্ষিতাবাদ(relativism) নিয়ে Bruno Latour এর বিভ্রান্তি, লিওটার্ডের “উত্তরাধুনিক বিজ্ঞান”, গোডেলের উপপাদ্য, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর chaos theory এর অপব্যবহার ইত্যাদি। Jean Baudrillard হলেন অন্যতম ফরাসী দার্শনিক যিনি chaos theory ব্যবহার করে পাঠকদের পট্টি মারতে পছন্দ করেন। বৈজ্ঞানিক ভাষায় লেখা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে একটা অর্থহীন বাক্যের উদাহরণ দেখুন,
“Perhaps history itself has to be regarded as a chaotic formation, in which acceleration puts an end to linearity and the turbulence created by acceleration deflects history definitively from its end, just as such turbulence distances effects from their causes.”
Baudrillard এর মত এরকম আরও অনেকেই বিজ্ঞানের অর্থপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে অর্থহীন বাক্য রচনা করে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। এই বাক্যে বৈজ্ঞানিক শব্দগুলোকে আপনি যদি স্রেফ রুপক হিসেবে দেখতে চান, তবুও প্রশ্ন থেকে যায় যে লেখকের “জ্ঞান” জাহির করা ছাড়া এই শব্দগুলোর আর কি কি উদ্দেশ্য আছে বা থাকতে পারে? Baudrillard এর রচনা থেকে এসব জগাখিচুরী বাদ দিলে আর কিছু বাকি থাকে কিন তা নিয়ে সংশয়ী হওয়াই যায়।
উত্তরাধুনিকরা না দাবি করেন যে দুনিয়াতে কোন কিছুরই অর্থ নেই, সবকিছুই উদ্দেশ্যহীন, কোন আদর্শেরই আলাদা মর্যাদা নেই? উত্তরাধুনিকরা তো দাবি করেন যে তাঁরা পাঠকদের সাথে খেলা করেন। কিন্তু কেউ যখন উলটো তাঁদের সাথে খেলা করেন তখন তাঁরা ক্ষেপে যান কেন? এলান সোকাল আর Jean Bricmont এর যে বইটা(Intellectual Impostures) নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম, এই বইটা রচনার পেছনে একটা মজার ইতিহাস আছে।
১৯৯৬ সালে সোকাল Social Text নামক একটি আমেরিকান সাময়িকীতে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন- ‘Transgressing the Boundaries: towards a transformative hermeneutics of quantum gravity’। পুরো গবেষণাপত্রটিই ছিল শিশুর বচনের মত অর্থহীন, উত্তরাধুনিকতা নিয়ে একটি রম্য। পল গ্রস আর নরম্যান লেভিটের Higher Superstition: the academic left and its quarrels with science বইটি দ্বারা সোকাল ভালমতই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি বইটা পড়ে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি, পরে বইতে উদ্ধৃত উত্তরাধুনিক সাহিত্য নিজে যাচাই করে নিয়ে তিনি বুঝতে পারেন যে পল আর নরম্যান মোটেই বাড়িয়ে বলেননি। তিনি কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। গ্যারি কামিয়া বলেন,
“যিনি মানবিক বিভাগগুলোর পরিভাষা সমৃদ্ধ অস্পষ্ট সাহিত্য পড়েছেন, তিনি আশা করতেই পারেন যে একদিন কোন ধূর্ত স্কলার উত্তরাধুনিকদের পছন্দের কিছু শব্দ (‘hermeneutics’, ‘transgressive’, ‘Lacanian’, ‘hegemony’ ইত্যাদি) ব্যবহার করে একটা জাল গবেষণাপত্র রচনা করে কোন সম্মানিত মানবিক সাময়িকী পেশ করবেন এবং সেই সাময়িকী আবার সেটি প্রকাশও করবেন। সোকালের জাল গবেষণাটি ঠিক একই কাজ করেছিল। তিনি গুনাহগারদের(শ্বেতাঙ্গ, “বাস্তব জগত”, ইত্যাদি) পিন্ডি চটকিয়েছেন এবং পুণ্যবানদের(নারী, ভাববাদী উন্মাদনা, ইত্যাদি) গুণকীর্তন করেছেন। Social Text এর সম্পাদকমন্ডলীর অবস্থা নিশ্চয়ই এখন সেই ট্রোজানদের মত হয়েছে যারা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পেরেছিলেন যে কাঠের ঘোড়াটাকে শহরের ভেতরে ঢোকানো উচিত হয়নি।”
সোকালের গবেষণা মনে হয় Social Text এর সম্পাদকদের বিমোহিত করেছিল। একজন পদার্থবিদ “পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট হেজিমনি” আর “বাস্তব জগত” এর মত ফালতু ধ্যান-ধারণার সমালোচনা করছেন, একজন উত্তরাধুনিকের কাছে এর চেয়ে আকর্ষণীয় আর কি হতে পারে? তাঁরা জানতেন না যে সোকাল তাঁর গবেষণাপত্র একগাদা ভুল তথ্য দিয়ে ঠেসে রেখেছিলেন, পদার্থবিদ্যায় স্নাতক যেকোন শিক্ষার্থীই সেই ভুলগুলো ধরতে পারতেন। সাময়িকীর সম্পাদক এন্ড্রু রস এবং অন্যান্যরা তাঁদের আদর্শের সাথে গবেষণাটির সামঞ্জস্যতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাছাড়া সোকাল বুদ্ধিমানের মত তাঁদের কর্মগুলোকেও তাঁর গবেষণাপত্রে উদ্ধৃত করেছিলেন। এরকম অসাধারণ সম্পাদনা প্রতিভার জন্য এন্ড্রু রসরা ১৯৯৬ সালের সাহিত্যে ইগনোবেল পুরস্কারটা (নোবেল পুরস্কারের প্যারোডি) বাগিয়ে নিয়েছিলেন।
এরকমভাবে অপদস্থ হওয়ার পরও, এবং নারীবাদের ভেক ধরে থাকা সত্ত্বেও, পাঠকদের এটা জানা দরকার যে সম্পাদনা পরিষদের এই সদস্যরা কিন্তু একাডেমিক অঙ্গনে বেশ বিখ্যাত পুরুষ। ইংরেজি অনুষদ সম্পর্কে এন্ড্রু রস বলেন, “ইংরেজি অনুষদ বন্ধ হওয়াতে আমি খুশিই হয়েছি। আমার তো সাহিত্য ভাল লাগেই না, তার উপর ইংরেজি অনুষদ সাহিত্যপ্রেমী দিয়ে ভর্তি!”। তথাকথিত “সায়েন্স স্টাডিজ” এর উপর তাঁর একটি বই তিনি এভাবে শুরু করেছেন, “এই বইটি আমি সেসব বিজ্ঞান শিক্ষকদের উৎসর্গ করছি যাঁদেরকে আমি কখনওই পাইনি। তাঁরা ছিলেন না বলেই আমি এই বইটি লিখতে পেরেছি”। “কালচারাল স্টাডিজ” আর “সায়েন্স স্টাডিজ” নিয়ে পড়ে থাকা তাঁর সহোদরর কোন তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানের পাগলাটে গবেষক নন, তাঁদের অনেকেই আমেরিকার শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্যুর্ড অধ্যাপকের পদগুলো জবরদখল করে বসে আছেন। এঁদের মত একাডেমিকরা বিভিন্ন এপয়েন্টমেন্ট কমিটিতে বসে তরুণ ও আন্তরিক একাডেমিকদের মাথার উপর ছড়ি ঘুড়ান। আমি জানি- কারণ এরকম অনেকেই আমার কাছে দুঃখ করেছেন, চাকুরী হারানোর ভয়ে তাঁরা এঁদের বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারছেন না। তাঁদের কাছে এলান সোকাল একজন নায়কের মতই। যদিও খুব অপ্রাসঙ্গিক, তবুও পাঠককে জানিয়ে দিচ্ছি যে এলান সোকাল নিজে কিন্তু এসব উত্তরাধুনিকদের মতই বামপন্থী!
সোকাল পরে অন্য এক সাময়িকীতে নিজেই নিজের ব্যঙ্গাত্মক “গবেষণাপত্র”টি বিশ্লেষণ করেন। তিনি নিজেই তাঁর গবেষণাপত্রটির সত্য-মিথ্যা-আধা সত্য দাবিগুলো তুলে ধরেন এবং মন্তব্য করেন যে কিছু কিছু বাক্য “বাক্যরীতির দিক দিয়ে নিখুঁত হলেও ভাবের দিক দিয়ে একদমই অর্থহীন”। মেলবোর্নের কম্পিউটার বিজ্ঞানী এন্ড্রু বুলহক একটি “পোষ্টমডার্নিজম জেনারেটর” তৈরী করেছেন, যেখানে কয়েকটি ক্লিকের সাহায্যেই আপনি সেকেন্ডের মধ্যে ব্যকরণগতভাবে শুদ্ধ কিন্তু ভাবগতভাবে অর্থহীন গবেষণাপত্রের গর্বিত রচয়িতা হতে পারবেন। আমি এইমাত্র গিয়ে একটি ৬০০০ শব্দের গবেষণাপত্র প্রসব করে এসেছি- ‘Capitalist theory and the subtextual paradigm of context’। লেখক হিসেবে দেখাচ্ছে- ‘David I. L. Werther and Rudolf du Garbandier of the Department of English, Cambridge University। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেখে মজা পেলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়ই জাঁক দেরিদাকে সম্মানজন ডিগ্রী দেওয়ার জন্য যোগ্য মনে করেছিল। আমার গবেষণাপত্রটি থেকে একটি নমুনা দেখুন,
“If one examines capitalist theory, one is faced with a choice: either reject neotextual materialism or conclude that society has objective value. If dialectic desituationism holds, we have to choose between Habermasian discourse and the subtextual paradigm of context. It could be said that the subject is contextualised into a textual nationalism that includes truth as a reality. In a sense, the premise of the subtextual paradigm of context states that reality comes from the collective unconscious.”
আপনিও চেষ্টা করে দেখতে পারেন। Social Text এর সম্পাদকমন্ডলীর কাছে জমা দিতে ভুলবেন না যেন!
অবশেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়- মানবিক বিভাগগুলোকে এসব ছদ্ম-একাডেমিকদের হাত থেকে বাঁচানোর উপায় কি? আশার কথা হল, সোকাল এবং ব্রিকমন্ট ইতিমধ্যেই গ্রস এবং লেভিটের সাথে হাত মিলিয়ে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে উদ্যত হয়েছেন। আমরা কেবল আশা করতে পারি যে অন্যরাও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন।
মূল- Postmodernism Disrobed, A Devil’s Chaplain, Richard Dawkins, অনলাইনে পাবেন এখানে।
এলান সোকালের ছদ্ম-গবেষণাপত্রটি- এখানে।
আজ প্রথম মুক্তমনায় প্রবেশ করলাম এবং উপলব্ধি করলাম এটি বদ্ধ উম্মাদদের ব্লগ, যার উদ্দেশ্য হলো বিজ্ঞানের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বা অবদানহীন ব্যর্থ বিজ্ঞানীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিজ্ঞানের বারোটা বাজিয়ে দেয়া। চালিয়ে যান।
@রফিক মাহমুদ,
ঠিক বলেছেন। আপনার মত সুস্থ মাথার মানুষ এখানে না আসাই ভাল হবে! আপনার জন্য অনেক পোস্টমডার্ন সুস্থ সাইট আছে।
“International Relations Theory” course-এ পোস্টমডার্নিজম পড়তে গিয়ে না বুঝলাম আগা, না পাছা। তবে খোমেনি যখন মিশল ফুকো-র মত জাদ্রেল পোস্টমডার্নিস্ট-এর হিরো হন, তখন এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের কথা-বার্তা এমন দুবোধ্য কেন। বলার ভাষা দুবোধ্য নয়া হলে খোমেনিকে কিভাবে হিরো বানাবেন?
গুরুত্বপূর্ণ এ লেখাটির ফরম্যাট একটু ঠিক ঠাক করে দেয়া হল।
উত্তরাধুনিকদের দেখলেই আমি ভয় পাই। তাদের কথায় না থাকে অর্থ, না থাকে কোন গন্তব্য। জবরজং ভাষা ব্যবহার করে অর্থহীন কিছু পরিবেশন করাটাই এদের কাজ। এলেন সোকাল এদের আসলেই নাঙ্গা করে দিয়েছিলেন। ডকিন্সের এই প্রবন্ধটা দারুণ। নেচারে প্রকাশিত হয়েছিল, ১৯৯৮ সালে।
এলেন সোকালের এই ঘটনার পর অনেকেই মজা করতে সায়েন্টিফিক পেপার জেনারেটর বানিয়েছেন। আমার সবচেয়ে মজা লেগেছে এম আইটি সাইটের এটি –
SCIgen – An Automatic CS Paper Generator
অথারের নাম হিসেবে আপনার দিয়ে ক্লিক করুন – দেখবেন কি সহজে পোস্টমডার্ন গবেষণাপত্র লেখা যায়। :))
অনুবাদ করার জন্য (F)
পইড়া আমার এই কাম করতে মন চাইছে :-Y
ভালই লাগল পড়ে। কিন্তু আমার কাছে শিরোনামটা কনফিউজিং লেগেছে। আমি নিজে পোস্টমর্ডানিজমের কিছুই বুঝিনা, ভেবেছিলাম এখানে ডিটেইলস কিছু পাব। কিন্তু এখানে তো কিছু মানুষের ঠগবাজি তুলে ধরা হয়েছে, এক ধরণের লেখার স্টাইলের সমালোচনা করা হয়েছে। পোস্ট মর্ডানিজম নিয়ে তো তেমন কোন আলোচনা নেই।
@লীনা রহমান,
খুব সম্ভবতা এটা অনুবাদ তাই এমন হয়েছে। তবে সেরকম আলোচনা পড়ার আশা লিঙ্কে ক্লিক করেছিলাম যদিও।
@লীনা রহমান, উপরে রুপম ভাইও একই কথা বলেছেন, আসলেই প্রবন্ধে উত্তরাধুনিক তত্ত্ব নিয়ে কিছু আলোচনার দরকার ছিল। ডকিন্স এখানে ধরেই নিয়েছেন পাঠক উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে কিছু না কিছু জানেন।
উত্তরাধুনিকতা মূলত একটি দর্শন যা দাবি করে যে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা বা সত্য বলে কিছু নেই-বাস্তবতা সিঙ্গুলার না, প্লুরাল। আরেকভাবে বলতে গেলে, বাস্তবতা হল সামাজিক নির্মাণ। একেক সমাজের বাস্তবতা একেকরকম। উত্তরাধুনিকতা বাস্তবতাকে ভাষা, ক্ষমতা ইত্যাদির মাধ্যমে উত্থাপন করার চেষ্টা করে। একটা উদাহরণ তো আপনার উদ্ধৃত অংশের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছেন, Luce এর মত নারীবাদি একটা বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাকে লৈঙ্গিক রাজনীতির ভাষায় উত্থাপন করছেন। বস্তুত, বিজ্ঞানীরা যেখানে কোন ফেনোমেননের ব্যাখ্যা দাঁড়া করায়, উত্তরাধুনিকরা সেখানে representation দাঁড়া করায়। এডওয়ার্ড সাঈদের “ওরিয়েন্টালিজম” সহ অন্য সব সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কর্মও রিপ্রেজেন্টেশন নিয়ে কাজ করে। সাঈদ তাঁর “ওরিয়েন্টালিজম” গ্রন্থে পশ্চিমারা কিভাবে প্রাচ্যকে বর্বর ও প্রায় অমানুষ হিসেবে উত্থাপন করে তাদের সেই ইন্টারপ্রিটেশনের উপর ভিত্তি করে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী কর্মকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে, সেটা নিয়েই আলোচনা করেছিলেন। সাঈদকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হয়, কারণ রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আসলেই অনেক কিছু উপস্থাপনার উপর নির্ভর করে। কিন্তু প্রকৃতি জগত নিয়ে কাজ করতে গেলে স্রেফ উপস্থাপনা দিয়ে এগুনো যাবে না, কিছু শক্ত মডেল দাঁড়া করিয়ে সেগুলোকে যাচাই করে নিতে হবে। উত্তরাধুনিকরা মূলত এখানেই ভুলটা করেন।
খুব ভালো একটা কাজ করেছেন এইসকল তথাকথিত সমাজবৈজ্ঞানী বিরিঞ্চিবাবাদের বিরুদ্ধে লেখা গ্রেইট রিচার্ড ডকিন্সের এই অসাধারণ প্রবন্ধটি অনুবাদ করে। এরা আবার বলে স্কলারও- আমার মাথায় একটা বাড়ি দেন কেউ! গ্রেইট রিচার্ড ফাইনম্যানকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে তার অভিমত সম্পর্কে। ফাইনম্যানের অভিমত আমি ভিডিও লিঙ্ক করছি যদিও, কিন্তু তার ইভিমতের কিছু অংশ বঙ্গানুবাদ করার লোভ সামলানো আমার পক্ষে কঠিন।
httpv://www.youtube.com/watch?v=IaO69CF5mbY
সোকাল এফেয়ারের কালবৈশাখ যে এইসকল তথাকথিত সমাজবৈজ্ঞানী বিরিঞ্চিবাবাদের লুঙ্গি টেকনাফ থেকে খুলে নিয়ে উড়িয়ে তেতুলিয়াতে ফেলেছে, এইটা অনুধাবন করার মতো মানসিক ভারসাম্যের অধিকারীও কি তারা নয়, আমার মনে প্রশ্ন জাগে!
রিচার্ড ডকিন্সের এই ভিডিওটাতে নারীবাদী বিরিঞ্চিবাবাদের দুঃসাহস দেখুন।
httpv://www.youtube.com/watch?v=IzNwjfbVt-U
“অপ্রেসিভ, সেক্সিস্ট, ইম্পেরিয়ালিস্ট, ক্যাপিটালিস্ট সায়েন্টিফিক মেথড” -একজন নারীবাদী সমাজবৈজ্ঞানী!!! 😀 😀 😀
বৈজ্ঞানীটি ইচ্ছাকৃতভাবে প্ররোচনা দিয়ে দিয়ে মানুষের মুখ থেকে মিসজিনিস্টিক কথা বের করে আনা ছাড়া আর কোন মহত উদ্দেশ্য কি সাধন করছে?
পোষ্টমর্ডানিজম বলতে কি বোঝায় আর কি বোঝায় না, সেটাই আজ পর্যন্ত কেও ঠিক করে বলতে পারল না। যার অস্তিত্বই নেই তাকে নাঙ্গা করা যায় না কি? তুমি ত একটা ভুতকে নাঙ্গা করে বসে আছ :lotpot:
তবে ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভংগী এবং পোষ্টমডার্নিজমকে গোলালে চলবে না।
@বিপ্লব পাল,
ভূত কী জিনিশ? :hahahee:
এইসব ভেক-পন্ডিতদের ধরিয়ে দেওয়া এবং প্যাঁদানি-প্রমান উপস্থাপনার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বাংলা ভাষাতে এই সব লেখাগুলোর জন্য অনেকেই চাতকের মত বসে থাকে। আমি তাদেরই একজন। অনুবাদ উপস্থাপন এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কার্যকর বলেই আমার ধারনা।
ঘুমাতে যাবার আগে একটা রসালো খাদ্যের স্বাদ নিলাম। দারুন লাগলো। পরিবেশনের জন্য বিশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
😀
(Y)
অনেক ধন্যবাদ পৃথিবী অনুবাদটির জন্য।
(Y) লেখাটা অনুবাদ করে বেশ ভালো কাজ করেছেন। এটা বাংলায় থাকা দরকার ছিলো।
প্রবন্ধের নাম পোস্টমডার্নিজম ডিসরোবড হলেও এখানে পোস্টমডার্নিস্টদেরই কেবল দিগম্বর করা হয়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে পোস্টমডার্নিস্ট বলে স্বীকৃতদের ক্রিটিকাল থিংকিংয়ের দৈন্যতার উপস্থিতি নির্ণয় করা গেছে। তবে লেখাটা কি উত্তরাধুনিকতা নামক প্রপঞ্চের উৎকৃষ্ট সমালোচনা? সেটা কিন্তু নয়। লেখাটার উদ্দেশ্যও হয়তো ব্যক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকা। মূল বইটিতে দর্শনটাকেও সমালোচনা করা গেছে কিনা আমি জানি না, পড়ি নি। তবে রিচার্ড ডকিন্স কিন্তু উত্তরাধুনিকতাবাদী বলে পরিচিতদের তুলোধুনো করে উত্তরাধুনিকতাবাদ নামক দর্শনকে দিগম্বর করার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন শিরোনামে। সে তুলনায় সোকালের লেখার শিরোনামে দেখা যাচ্ছে উত্তরাধুনিকতাবাদী বুদ্ধিজীবীদের কথা বলা। এখন একটা দর্শনের চর্চাকারীর দুর্বলতা উদ্ধার আর ওই দর্শনটার দুর্বলতা উদ্ধার এক কিনা সেটা ভাবার বিষয়।
যেমন রিচার্ড ডকিন্স এখানে উত্তরাধুনকতাবাদীদের তুলোধুনো করতে গিয়ে বলছেন
মূল ইংরেজিটাও দিচ্ছি কারণ অনুবাদের ভাবটা ডকিন্সের লেখার চেয়ে কিছুটা দূরে সরে গেছে বলে মনে হচ্ছে
অর্থাৎ যারা দাবী করেন যে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা বলে কিছু নেই এবং ফলত লেখায় তারা পাঠকের সাথে যে খেলাধুলা করেন তা অন্য যেকোন লেখার চেয়ে কম বা বেশি মর্যাদাপূর্ণ নয়, তারাই আবার যখন তাদের বিরুদ্ধে কোন লেখার মাধ্যমে আহত হন, তখন ক্ষেপে যান কেনো? এটা কি খুব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি? এটা তো অবাক হবার বিষয় না মোটেই! ক্ষেপে গিয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে যে বিচ্যুতি, সেটা মানুষের আচরণের একটি স্বাভাবিক ধর্ম – রৌরবের থেকে ধার করি – পরস্পরবিরোধিতাই হচ্ছে সাধারণ, তার অভাবটাই অসাধারণ। এতে অবস্থানকারীর বিচ্যুতি ঘটে, অবস্থানের না, নাকি? রিচার্ড ডকিন্স কিন্তু অবস্থানকারীর বিচ্যুতির দিকেই এই অংশে ইঙ্গিত করছেন, কিন্তু শিরোনামের অস্পষ্টতার কারণে বক্তব্যটা এমন একটা চেহারা পাচ্ছে যে – অতএব উত্তরাধুনিকতাবাদের যে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতাহীনতা, এটাও একটা ধাপ্পা। আপনার অনুবাদটাও বোধ করি একই কারণে ওই দিকেই সরে গেছে। চর্চাকারীর সাথে দর্শনটাও মনে হচ্ছে উড়ে যাচ্ছে আপনার অনুবাদে, যদিও ক্রিটিকালি সেই সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। এবং একই কারণে আপনার নিজস্ব ভূমিকাতেও আপনি নির্দিষ্ট নন যে লেখায় আপনি কাকে দিগম্বর করছেন – দর্শনকে নাকি চর্চাকারীকে।
এখানে সরাসরি বক্তব্যটার বাইরে প্রচ্ছন্ন বক্তব্যটা হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অস্তিত্ব আছে যে সেটা জানা আছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? উত্তরাধুনিকতাবাদের কথা বাদ দিলাম, দর্শনটার এই যে দাবী, সেটা কি উত্তরাধুনিকতাবাদের একার এবং সেটা কি বাতিল করার মতো যথেষ্ট আলোচনা লেখায় আছে? নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অনস্তিত্বের দাবী অনেক পুরনো এবং অমীমাংসিত। অনেকক্ষেত্রে এই সমস্যার সমাধান কথাটাই oxymoron ঠেকে। এই বিষয়গুলোকে আরও ক্রিটিক্যালি দেখা প্রয়োজন।
@রূপম (ধ্রুব),
১) দর্শন আর দার্শনিককে মনে হয় আলাদা করে দেখাটা ঠিক হবে না। দর্শন তো দার্শনিকেরই মস্তিস্কপ্রসূত। পপারীয় দর্শনের সমালোচনা করতে গেলে আপনাকে পপারকে টেনে আনতেই হবে। বস্তুত, পপারের কোন উল্লেখ না করে আপনি পপারীয় দর্শনের সমালোচনা করবেন কেমনে? দর্শন আর দার্শনিকের এই একাত্মতাকে assume করে নিয়েই ডকিন্স প্রবন্ধটি রচনা করেছেন। সোকালের বইয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না, যেহেতু ওটি আমার পড়া হয়নি।
২) নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতাকে অনেক আগে থেকেই চ্যালেঞ্জ করে আসা হয়েছে সত্য, কিন্তু সেই প্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিক অনুকল্পগুলোর(উত্তরাধুনিক দর্শন ছাড়া আর কোন দর্শন নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছে বলে আমার জানা নেই) ভবিষ্যদ্বানীগুলো কি কি? সেই ভবিষ্যদ্বানীগুলো কি ফলে গিয়েছে? সেগুলোর কি আদৌ কোন ভবিষ্যবাচ্যতা বা প্রেডিকটাবিলিটি আছে?
অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক অনুকল্পগুলোর কিন্তু কোন না কোন পরিস্কার ভবিষ্যদ্বানী আছে এবং যেসব ভবিষ্যদ্বানীগুলো সত্য হচ্ছে, সেটা আমাদের সবার জন্যই সত্য হচ্ছে। এমন না যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে একটা তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বানী সত্য হলে আমাদের সংস্কৃতিতে সেটি মিথ্যা হবে, আমার তো মনে হচ্ছে এই ফ্যাক্টটাই ইঙ্গিত করছে যে আমরা সবাই একই বাস্তবতায় বসবাস করছি। আমরা যখন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে ব্যবহার করে প্রযুক্তি সৃষ্টি করছি, আমরা তখন একই সাথে ওই তত্ত্বের সার্থকতার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছি। কালচারাল রিলেটিভিজম নিয়ে ডকিন্স রিভার আউট অব ইডেনে একটি মন্তব্য করেছিলেন,
ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে যে বিজ্ঞান একটা অভিন্ন বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে যেখানে কালচারাল স্টাডিজ বা উত্তরাধুনিক গোত্র একটা সংস্কৃতিভিত্তিক বাস্তবতার দাবি করে(উচ্চমার্গীয় anthropocentrism, কি বলেন :)) )। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছে, তবে কালচারাল এবং সায়েন্স স্টাডিজ গোত্রগুলোর ব্যাপারে একই কথা বলা যাবে না।
@পৃথিবী,
প্রথমত এটা পরিষ্কার করি যে পোস্টমডার্নিজমে আমার বিশেষ অনুরাগ নেই। ব্যাপারটা ভালোমতো বোঝারও অবশেষ আছে। যাই হোক, লেখাটার সমালোচনা করছি কারণ সেটাই সামনে আছে। পোস্টমডার্নিজম পক্ষে/নিয়ে একটা লেখা আসলে সেটার সমালোচনায় অকঠোর পাবেন না। 🙂
১) পপারের দর্শনকে সমালোচনা করতে গেলে পপারকে উদ্ধৃত করতে হবে, ঠিক। কিন্তু আপনি বলুন, এই প্রবন্ধ কি কোন ধরনের গঠনমূলক সমালোচনা আছে বিশেষ কারও দার্শনিক ক্লেইমের? আছে ঠগদের ঠগবাজী উন্মোচন। সেটা দিয়ে তো একটা দার্শনিক প্রপঞ্চকে দিগম্বর করা যায় না। বিশেষ করে এ কারণে যে সেই প্রপঞ্চের মুখ্য প্রবক্তাদের প্রসঙ্গই যখন না আসে। পোস্টমডার্নিজমকে ঘিরে যে ঠগবাজী, বাচাল কালচার তৈরি হয়েছে, এই প্রবন্ধ তারই সমালোচনা, পোস্টমডার্নিজমের গঠনমূলক সমালোচনা মোটেও না। পোস্টমডার্নিজমের মূল দর্শনগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা নেই। এটা আরও নির্দিষ্ট হওয়া দরকার ছিল। আপনি এই মন্তব্যে ১ এ যা বললেন, তাতে আবারও মনে হলো যে প্রবন্ধে পোস্টমডার্নিজম নিজেই দিগম্বর হয়ে গেছে, যদিও তেমন কোনও আলামত দেখতে পাচ্ছি না। এটা যে পোস্টমডার্নিজম প্রপঞ্চ কেন্দ্রিক ঠগবাজী একাডেমিক কালচারের মুখোশ উন্মোচনের বেশি কিছু নয়। এমনকি পপার যদি একটা কথা ভুল বলে থাকেন, তাতে কিন্তু পপারের আরেকটা কথা ভুল হিসেবে দেখাকে সম্ভব করে তুলে না। পপারের অনেক দাবীই এখন গাণিতিকভাবে দুর্বল হিসেবে নির্ণীত করা গেছে, তাতে তার বক্তব্যকে গুরুত্বের সাথে দেখা বন্ধ হয় না।
@রূপম (ধ্রুব),
এলান সোকাল এঁদের ঠগবাজি উন্মোচন করার পরই মূলত এদের ক্রেডিবিলিটি কিছুটা কমে এসেছে, আগে কিন্তু এঁরা নমস্য ছিলেন।
তবে আপনার পয়েন্টটা এবার ধরতে পেরেছি। ডকিন্সের এই নিবন্ধটা যেহেতু একটা বুক রিভিউ ছিল, তাই চাইলেও তিনি উত্তরাধুনিক দর্শনের তাত্ত্বিক সমালোচনা করতে পারতেন না(তাছাড়া এটা তাঁর গবেষণার বিষয়ও না)। উত্তরাধুনিকতার উপর কয়েকটা বই পেয়েছি, আগামীতে এই দর্শনের প্লাস-মাইনাস নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে।
@পৃথিবী,
ঠিক!
বইয়ের নামগুলা যদি বলতেন!
@রূপম (ধ্রুব),
1) The Flight From Science and Reason- Annals of the New York Academy of Sciences
2) The Illusions of Postmodernism- Terry Eagleton
3) House Built on Sand :Exposing Postmodernist Myths About Science- Koertge, Noretta (Editor), Professor of the History and Philosophy of Science, Indiana University
ব্যালেন্স করার জন্য দেরিদার Of Grammotologyটাও রেখেছি।
এমনিতে বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদের উপর কয়েকটা বই আমার সংগ্রহে আছে-
1) Evidence, Explanation and Realism :Essays in Philosophy of Science- Peter Achinstein
2) Scientific Realism:How science tracks truth- Stathis Psillos
সবগুলো বই এখানে পাবেন।
@পৃথিবী,
অসাম! রিলেটিভিজম নিয়ে কিছু পারলে লেইখেন। অব্জেক্টিভ রিয়েলিটি আছে – এটা একটা মস্ত ক্লেইম। এটার দাবীদারকেই মস্ত প্রমাণ দিতে হবে। বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের পূর্বাভাসক্ষম প্রকল্প প্রদান করলেও অব্জেক্টিভ রিয়েলিটি নিয়ে বক্তব্য রাখতে পারে বলে এখনো নিশ্চিত না। এটা অনেকটা অ্যাসাম্পশানের অংশ। যেমন আরেকটা অ্যাসাম্পশান হচ্ছে গিয়ে পর্যবেক্ষণে রেগুলারিটি থাকবেই। অ্যাসাম্পশান না বলে সাইন্টিফিক অপ্টিমিজমও বলা চলে। এগুলো সরাসরি বিজ্ঞানের যাচাইয়ের বিষয় না, কারণ এগুলোর সত্যাসত্য ছাড়াও বিজ্ঞান কাজ করে।
@রূপম (ধ্রুব),
উঁ। আমার কিন্তু মনে হয় আলোচনাটা উত্তরাধুনকিতার সীমাবদ্ধতাকে বেশ ভালভাবেই তুলে ধরেছে, শুধু তার কিছু কিছু চর্চাকারীর নয়। Lacan বা Deleuze প্রভৃতিকে তো আর উত্তরাধুনিকতার প্রান্তীয় চর্চাকারী বলা যায় না, কাজেই তাঁদের কাজ কর্মের আলোচনা উত্তরাধুনিকতার মূল ধারারই আলোচনা। উত্তরাধুনিকতার যেহেতু কোন কোরান-হাদিস নেই, তাই এর কেন্দ্রীয় চর্চাকারীদের আচরণ কেই উত্তরাধুনিকতার সংজ্ঞা বলে ধরে নিলে খুব অন্যায় হয় কি?
তার চেয়েও মৌলিক ব্যাপার হল: উত্তরাধুনিকদের যে কাজকর্ম গুলি তুলে ধরা হয়েছে, তাকে বানানো ডেটা বা ভুল প্রমাণ চালানো অসৎ বিজ্ঞানীর সাথে তুলনীয় মনে হয় নি, বরং তাঁদের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির অবধারিত ফল বলে মনে হয়েছে। যেমন…
এটিকে আপনি একটি মানবিক বিচ্যুতি হিসেবে দেখছেন। মানবিক বিচ্যুতি নয়, তা আমি বলছি না, কিন্তু দার্শনিক সমস্যাও আছে। বিজ্ঞানের যখন সমালোচনা করছে উত্তরাধুনিকতা, তখন তাদের বক্তব্যটা এমন:
নৈর্বক্তিকতা বলে কিছু নেই, বিজ্ঞান (এবং সবকিছুই) বিশেষ সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফসল, কাজেই একে text হিসেবে দেখে পুঁজিবাদ/পুরুষতন্ত্রের একটি অঙ্গ হিসেবে আলোচনা করা উচিত ইত্যাদি।
সমস্যাটি হল, তাঁরা নিজেরা আবার পুঁজিবাদ/পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা করার সময় ভীষণ serious। মুখে যতই অনৈর্বক্তিকতার কথা বলুন না কেন, তাঁদের একটি রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে। বস্তুত “কোন কিছুই নৈর্ব্যক্তিক নয়” এটিকে এঁরা মুদগরের মত ব্যবহার করেন যখন “বিপক্ষ”-এর তলার মাটি সরিয়ে তাকে ভড়কে দেয়ার প্রয়োজন হয়, এর বেশি কিছু নয়। এখানে যে মৌলিক ভাবের ঘরে ফাঁকি রয়েছে, এখান থেকেই সমালোচনা সহ্য করতে না পারার সমস্যাটি তৈরি হয়েছে।
@রৌরব,
দর্শনকে চর্চাকারীর আচরণ হিসেবে দেখতে দেখলে উত্তরাধুনিকরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন! আমি অবশ্য ক্ল্যাসিসিস্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা দর্শনকে দেখতে চাচ্ছি। দর্শনটার যে মূল টেনেটগুলো, সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা এসেছে কিনা? সেই টেনেটগুলোকে রিফিউট করা গেছে কিনা?
আপনার শেষ প্যারায় আরও নির্দিষ্ট হলো যে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অনস্তিত্বের দাবীকে ব্যবহার করে যে উত্তরাধুনিক ছদ্ম-একাডেমিক চর্চা, সেটার জারিজুরি ফাঁস হয়েছে। এটুকু হওয়াকে কি আপনি উত্তরাধুনিকতাবাদের দিগম্বর হওয়া বা এর সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখছেন? উত্তরাধুনিকতাবাদের সমালোচনা বলতে আমি আশা করবো উত্তরাধুনিকতাবাদের মূল টেনেটগুলো নিয়ে ক্রিটিক্যাল আলোচনা। (পৃথিবী সেই আশা দেখিয়েছেন এবং সেটা করা গেলে একটা মাইলফলক কাজ হবে নিঃসন্দেহে!) নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অনস্তিত্বের ব্যাপারে রিচার্ড ডকিন্স বা সোকালের বক্তব্য কি? নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অনস্তিত্বও কি দিগম্বর হলো? বা এই একটি মাত্র বিষয়কে বাদই দিলাম। উত্তরাধুনিকতাবাদের মূল ঠিক কী কী টেনেট রিফিউটেড হয়েছে? আগামীতে কেউ যদি পোস্টমডার্নিজমের মূল টেনেটগুলো নিয়ে আলোচনা তুলেন, তখন যখন বলা হবে যে ডকিন্স আর তো আগেই পোস্টমডার্নিজমকে দিগম্বর করে রেখেছেন, তখন কি মানা যাবে? সেটা মানতে হলে এই লেখার বাইরে পোস্টমডার্নিজমের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বায়াস পোষণ করতে হবে। সেটা ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি না। পরবর্তীতে উত্তরাধুনিকতাবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই প্রবন্ধটার ন্যায্যভাবে ঠিক কী কী ব্যবহার সম্ভব সেটা চিন্তা করুন। সেটা করতে গিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি, এই প্রবন্ধ চর্চাকারীকে যতোটা ক্যারাক্টার সার্টিফিকেট দিতে পারছে, উত্তরাধুনিকতাবাদের মূল টেনেটগুলো নিয়ে বোঝাপড়ার আলোচনায় সে তুলনায় খুব সামান্যই সাহায্য করছে।
@রূপম (ধ্রুব),
ডকিন্সের সমালোচনা যে সম্পূর্ণ নয়, সেটা ঠিকই। মেনে নিয়েই বলছি, এই সমালোচনার মধ্যে উত্তরাধুনিকতাবাদের মূল সমস্যার একটি আভাস মেলে। আপনি (নাকি পৃথিবী?) বলেছেন যে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অনস্তিত্ব নতুন বিষয় নয়। তাহলে ওটা উত্তরাধুনিকতার অবদান নয়, উত্তরাধুনিক হচ্ছে বিভিন্ন প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তার ফলিত ব্যবহার।
নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অস্তিত্ব আছে কিনা, এটাকে একটা জবাবহীন প্রশ্ন হিসেবে দেখা এক জিনিস, কিন্তু সেখানে উত্তরাধুনিকেরা থেমে নেই। নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অস্তিত্ব নেই, এটা ধরে নিলে যাবতীয় আলোচনা অর্থহীন হয়ে পড়ে। উত্তরাধুনিকতা এই সমস্যাকে মেনে নিয়ে চুপ করে গেলে কথা ছিলনা। কিন্তু “অন্য”-এর ফ্রেমওয়ার্কের কোন নৈর্ব্যক্তিক অর্থ নেই, কিন্তু কোন এক বিস্ময়কর ক্ষমতাবলে পুরুষতন্ত্র কি সাম্রাজ্যবাদের ব্যাপারে “আমার” সমালোচনাটা অর্থপূর্ণ রয়ে যাচ্ছে, উত্তরাধুনিকতার এই দ্বিচারিতা ব্যক্তিবিশেষের অসততা নয়। ওই প্রজেক্ট থেকে এছাড়া কিছু প্রত্যাশাই করা যায় না, কারণ তাঁরা নিজেদেরকে ওই hand টিই deal করেছেন।
ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি, একটি sensibility হিসেবে উত্তরাধুনিকতা আমার একেবারে না-পছন্দ নয়। উত্তর-ঔপনিবেশকবাদের গবেষণার মধ্যেও কিছু ভাল জিনিস দেখেছি।
@রৌরব,
উত্তরাধুনিকতার বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলো আরও সীমিত হলো আপনার জবাবে। এটাই কাম্য। যতই ভালোভাবে সীমাগুলো জানা যাবে, ততই নির্দিষ্ট হবে দুর্বলতাগুলো। ‘পোস্টমডার্নিজম ডিসরোব্ড’ বলার মতো ঢালাওভাবে পরাস্ত করে ফেললাম ফেললাম পরিস্থিতি দেখানোটা একেবারেই এন্টি-ক্রিটিক্যাল থিংকিং। এসবে অনেক অনেক ইমানদারের জন্ম হতে দেখেছি। ডকিন্স বলেছেন ওরা ন্যাঙটা, ব্যস খেল খতম। সেই স্টান্টের কিছু দায় তখন ডকিন্সকে দিলেও দোষ হয় না। আরেক ধরনের বিপক্ষতা আছে যে একটাকে রিফিউট করার জন্য ঢালাওভাবে পুরো ডিসিপ্লিনকেই রিফিউট করা। যেমন উত্তরাধুনিকতাবাদকে রিফিউট করার জন্যে পুরো সোশ্যাল সাইন্সকেই যখন পরাস্ত করা লাগে, তখন সেই রিজনিং নিয়ে আপনি কতোটা ব্যস্ত হবেন?
ব্যক্তিগতভাবে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অনস্তিত্ব নাই হয়ে গেলে আমার চেয়ে বেশি খুশি অল্প মানুষই হবেন। কিন্তু অনেকে এর উত্তরের নিশ্চয়তাকে অনিবার্য হিসেবে দেখে। যদিও সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।
একটা প্রশ্ন হলো যে তারা নিজেদের সমালোচনাটা ‘অর্থপূর্ণ’ রয়ে যাবার দাবী কতোটা করছেন। আর সমালোচনা করতে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অনস্তিত্ব হয়ে কেনো তাদের আসতে হচ্ছে।
@রূপম (ধ্রুব),
এই প্রশ্নটার ব্যাপারে আমার বক্তব্য ঠিক দিতে চাই নি, কারণ সেটা আলোচনাটাকে অন্য দিকে নিয়ে যাবে। তারপরও….
১. নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতাটা কি?
২. ”নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা” যাই হোক, এটা না থাকার implication যদি হয় কোন কিছু সম্বন্ধে কিছুই বলতে না পারা, তাহলে এটি কি খুব ভাল একটি কাঠামো?
@রৌরব,
এ সংক্রান্ত বক্তব্য oxymoron (বাংলা কী) না হয়ে পারে না। যারা নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার অস্তিত্বকে ভিত্তি করে কিছু দাবী করে, তাদের বিপক্ষে ‘নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা নেই’কে একটি ন্যায্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়। নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা কী তারপরেও যদি বুঝতে হয়, তখন এর আগে হয়তো দরকার বাস্তবতা বলতে কী বোঝায়, সেটার বিচার। এসব আলাপ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা আপনি আঁচ করতে পারছেন নিশ্চয়ই। এই প্রিয় মুক্তমনাতেই অভিজিৎ ভাইয়ের নানা পোস্টে অযাচিতভাবে বহুবার এই বিষয়ে তর্কাতর্কি করে গেছি, উনি মাইন্ড করেন নি :)। এই তর্কের একমাত্র উপযোগিতা আমি দেখি নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা আছে ধরে নিয়ে যেসব দাবী খাড়া হয়, তাদেরকে শান্ত করতে।
এখন এটা থাকুক না থাকুক, পর্যবেক্ষণকে যেসব বৈজ্ঞানিক প্রকল্প পূর্বাভাসক্ষমভাবে লিপিবদ্ধ করলো, সেগুলোর জ্ঞানগত মর্যাদা কমার কোন কারণ দেখি না। এমনকি বাস্তবতা নৈর্ব্যক্তিক না হলেও তার কিছু আসে যায় বলে কিন্তু পাবেন না। মানে এটার ইমপ্লিকেশান হলো কোন কিছু সম্বন্ধে কিছুই বলতে না পারা, সেভাবে আমি দেখছি না। ব্যক্তিক অবাস্তবতা নিয়েই না হয় প্রকল্প দিলাম। সে যদি কারও কাজে লাগে, কম কীসে?
সেখানে বাস্তবতাকে বাড়তি নৈর্ব্যক্তিক ধরে নেয়াটা বিজ্ঞানের কোন চিন্তার বস্তু কিন্তু না। অর্থাৎ এই ধরে নেয়া অধিবিদ্যক। এই দাবী বা বিপরীত দাবী উভয়ই যাচাই-অযোগ্য, বা বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত নয়। সেক্ষেত্রে সাইন্টিফিক রিয়েলিজমের বক্তব্য কিন্তু আর সাইন্টিফিক থাকে না, মেটাফিজিক্যাল হয়ে যায়। সেটার রিঅ্যাকশান হলো নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। সাইন্টিফিক রিয়েলিস্টদের দমাতে এটা ব্যবহৃত হয় কথাটা শুনলে মনে হয় এটা একটা ধাপ্পা। কিন্তু এটা দিয়ে লোকে দমে কেনো, সেটা বিচার করলে দেখবেন দুইপক্ষের স্ট্যাটাস সমপর্যায়ের। আমার অধিবিদ্যা বনাম বিজ্ঞান লেখাটায় বলেছিলামঃ
বেশ র্যডিক্যাল কথাবার্তা বলেছিলাম। আশা করেছিলাম এসব বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা আসবে। বিশেষ করে যখন মেটাফিজিক্যাল কথাবার্তার সমালোচনা কোনো না কোনো মেটা লেভেলে করা সবসময়ই সম্ভব থাকে। কিন্তু সমালোচনা তখন আসে নি। সে তুলনায় এখন মুক্তমনায় অনেক সমালোচনা হয় (কুরান-হাদিসের লেখাগুলো বাদে), এটা অনেক গর্বের বিষয়। গুগল মেরে দেখলাম আমার এই পজিশানকে অনেকে ইন্সট্রুমেন্টালিস্ট হিসেবে নির্ণয় করতে পারে। তবে কোন নামের সাথে কোলাকুলি করার বিপরীতেই আমি থাকতে চাই। ইন্সট্রুমেন্টালিস্টরা রিয়েলিস্ট আর এন্টি-রিয়েলিস্টদের সাথে উল্লম্বভাবে অবস্থান করে। কিন্তু এসব দর্শন নিয়ে ধানাইপানাইকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না।
@রূপম (ধ্রুব),
একটু হাল্কা কথা কইঃ
যা কিছু বলার থাকতে পারে, তা বলা যায় বিজ্ঞান আর গণিতে। যা কিছু বলার মতো কোনো কথা না, সেগুলা বলার জন্য আছে দর্শন। ফলে বিজ্ঞানের নাম করে যখন দার্শনিক বক্তব্য রাখা হয়, তাকে যে সচরাচর আরেকটা অর্থহীন দার্শনিক বক্তব্যই গছিয়ে দেয়া হয়, সে আর অবাকের কী? 😉
@রূপম (ধ্রুব),
😀
@রূপম (ধ্রুব),
(Y)
অর্থাৎ ইন্সট্রুমেন্টালিস্টরা দাঁড়িয়ে, আর ইন্সট্রুমেন্টালিস্টদের ঘায়ে রিয়েলিস্ট/এন্টি-রিয়েলিস্টরা শুয়ে? 😉
:lotpot:
@রৌরব,
ফেয়ারনেসের জন্যে আমি অবশ্য সব্বাইরে ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কল্পনা করেছি। এদের সবাইরে ধারণ করা তলের উপর আমি সোজা খঁাড়াইয়া, কইতে পারেন! 🙂
@রৌরব,
এই লেখার সার্থকতা হিসেবে আরেকটা ব্যাপার কি নির্দিষ্ট করে আমরা বলতে পারি যে বিজ্ঞান নিয়ে শোনার মতো ক্রিটিক্যাল িকছু উত্তরাধুনিকতাবাদীরা এখনো বলতে পারে নি? অন্তত অধিকাংশই না শোনার মতই?
@রূপম (ধ্রুব),
সেটা নিশ্চয়ই একটা। অন্য আরেকটি চিহ্নিত করব। জারগনের আড়ালে বক্তব্যের দীনতা লুকিয়ে রাখা প্রায় সব একাডেমিক ক্ষেত্রেই একটি সমস্যা (শুধু উত্তর-আধুনিকতা নয়)। এর বিরুদ্ধেও একটি সফল অভিযানের উদাহরণ এটি।
@রূপম (ধ্রুব), (Y)
পড়ার পুরোটা সময় 😀 😀 করে হাসছিলাম, বিশেষত
পড়ে হা হা প গে কে ধ। দুর্দান্ত! অনুবাদও ভাল লেগেছে (Y)
রিচার্ড ডকিন্সের লেখা ‘দিগম্বর উত্তরাধুনিকতা’ বা Postmodernism disrobed আমার পড়া প্রিয় একটা প্রবন্ধ । পদার্থবিদ এলান সোকালের ফরাসী সংস্করণ ‘Impostures Intellectuelles’ বা Fashionable Nonsense: Postmodern Intellectuals’ Abuse of Science এর রিভিউ হিসেবে এটা লেখা হলেও ভন্ড দার্শনিকদের এখানে কম তুলাধুনা করা হয় নি। :))
আপনাকে ধন্যবাদ এই লেখাটা বাংলায় অনুবাদ করে মুক্তমনায় নিয়ে আসার জন্য। অনেক পাঠকই ইংরেজীতে এবং বিদেশী ভাষায় দুর্বল হওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ন লেখা পড়া থেকে বঞ্চিত হয় এবং এ ধরনের উদ্যোগ তাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করবে। এই লেখাটা এবং সোকালের লেখা মূল বইটা বিজ্ঞানমনাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে আমি মনি করি।
অনুবাদ মান নিয়ে কিছু বললাম না কারন সময়ের সাথে অনুবাদ দক্ষতা এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। এ লেখাটা যে সাহস করে অনুবাদ করে মুক্তমনায় দিয়েছেন , এতেই আমি খুশী। পারলে সোকালের Fashionable Nonsense অনুবাদে হাত দিতে পারেন । (@)
@সংশপ্তক, ডকিন্সের লেখা অনুবাদ করতে ভয় লাগে। আমি মূলত ইংরেজি বই পড়ি, কিন্তু পপুলার সায়েন্সের ফিল্ডে তাঁর মত সাবলীল ভাষায় খুব কম লেখককেই লিখতে দেখেছি। ডকিন্সের লেখা অনুবাদ করতে গেলে মনে হয় তাঁর প্রতি অনাচার করা হচ্ছে। এই প্রবন্ধটা অনেকদিন ধরেই অনুবাদের কথা ভাবছিলাম, এবার একটা বড় ছুটি পাওয়াতে একটানে করে ফেললাম।
সোকালের বইটা অনেক খুজেছি, একটা সাইটে ফরাসী সংস্করণটা পেলেও কোথাও ইংরেজিটা পাইনি। আইটিউন্স স্টোর থেকে টাকা দিয়ে কিনতেও রাজি ছিলাম, কিন্তু সেখানেও পেলাম না। তবে এসব উত্তরাধুনিকদের নিয়ে কাজ করা একাডেমিকদের কতগুলো প্রবন্ধ সংকলন পেয়েছি, সেগুলো পড়ে পরে ব্লগে অনুবাদ করে দিব।
@পৃথিবী,
দেখি আপনার জন্য বইটার ইংরেজী ভার্সনটা যোগাড় করা যায় কি না। আমি নিজে অবশ্য ফরাসী ভার্সনটাই পড়েছি।
@সংশপ্তক,
Fashionable Nonsense টাই কী Intellectual Impostures না? 😕
@সাইফুল ইসলাম, একই বই, খুব সম্ভবত আমেরিকা আর ব্রিটেনের সংস্করণের আলাদা নাম।
@সাইফুল ইসলাম,
ঠিক । শুধু ভিন্ন ISBN কোড এবং কিছু বাড়তি অংশ। 🙂