বিজ্ঞানের জগতে হাজারো তত্ত্ব-অনুকল্পের মধ্যে গুটিকয়েক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মাত্র আমাদের জীবন-জগৎ-দর্শনকে তীব্র ঝাঁকুনি দিতে পেরেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস কর্তৃক ব্যাখ্যাকৃত ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’। চার্লস ডারউইনের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী এবং তাঁর রচিত তুমুল জনপ্রিয় বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থের দেড়শ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে ‘ডারউইনঃ একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’ শীর্ষক স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়।

অনেক চড়াই উৎরাই পেরোনোর পর গত অমর একুশে বইমেলায় অবসর প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় ‘ডারউইনঃ একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’ বইটি। ২৩৯ পৃষ্ঠার বইটির মুদ্রিত মূল্য ৩০০ টাকা। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন লেখকের ১৪ টি প্রবন্ধ নিয়ে সংকলিত বইটি অনন্ত বিজয় দাশ কর্তৃক সম্পাদিত। বইমেলায় প্রকাশিত সামান্য সংখ্যক বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে বইটির গুরুত্ব পাঠকরা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন।
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলাদেশে জৈববিবর্তন চর্চার পথিকৃৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক ড. ম. আখতারুজ্জামানকে। বইয়ের প্রচ্ছদটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এবং অর্থবোধক। একটি ডিএনএর একপাশে ডারউইনের মূর্তি এবং অন্যপাশে ফাঁকা রেখে বোঝানো হয়েছে জীববিজ্ঞানে ডারউইন না এলে কতটা ফাঁক রয়ে যেত। হয়েছে সম্পাদক বইটির ভূমিকা শুরু করেছেন বিজ্ঞানপত্রিকা Skeptic এর সম্পাদক ড. মাইকেল শারমারের উদ্ধৃতি দিয়ে :

Darwin matters because evolution matters. Evolution matters because science matters. Science matters because it is the preeminent story of our age, an epic saga about who we are, where we came from, and where we are going.

এরপর তিনি লিখেছেন পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিস্কারের মাধ্যমে যেমন আমাদের বিজ্ঞানীরা আমাদের এগিয়ে নিচ্ছেন ঠিক তার বিপরীতে যথাযথ বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানশিক্ষার অভাবেন আমাদের নতুন প্রজন্ম ততটাই পিছিয়ে যাচ্ছে। জৈববিবর্তন শিক্ষার গুরুত্ব এর ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পাদক ভূমিকায় তুলে ধরেছেন। চার্লস ডারউইনের জন্মের দুইশ’ বছর এবং ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থের দেড়শ’ বছর পর ডারউইন এবং বিবর্তনবাদের প্রাসঙ্গিকতা বিজ্ঞানে কতটুকু প্রভাব ফেলছে তাই নিয়েই মূলত বইটি রচিত হয়েছে।

বইয়ের প্রথম প্রবন্ধটি ‘চার্লস ডারউইনের জৈববিবর্তন তত্ত্বের উদ্ভব ও প্রভাব’ লিখেছেন অধ্যাপক ড. আলী আসগর। জৈববিবর্তনের ইতিহাস নিয়েই মূলত প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির উপর ডারউইনের গবেষণার একটি চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। বিগল জাহাজে ভ্রমণের আগে ও পরে ডারউইনের ব্যাক্তিত্বে যে এক বড় ধরণের পরিবর্তন চলে এসেছিল তা আমরা এই লেখাটি হতে দেখতে পাই। লেখক লিখেছেন,

“বিগল অভিযান শুরুর সময় ডারউইনকে মূল্যায়ন করা হয়েছে একজন অলস বুদ্ধিগতভাবে বিশৃঙ্খল যুবকরূপে। কিন্তু দীর্ঘ অভিযান শেষে ডারউইন যখন ফিরে এলো তখন সে একজন সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক ও গবেষক”।

এই প্রবন্ধের ভাষা অবশ্য বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ। তাই হয়তো অনেক পাঠকের কাছে পড়তে কিছুটা কঠিন লাগতে পারে।

এরপরের ‘ডারউইনের বিবর্তনভিত্তিক জীবনবৃক্ষ’ প্রবন্ধটির রচয়িতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এ. এম. হারুন অর রশিদ। লেখক লেখাটি শুরু করেছেন তার লন্ডনের বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সমাধিস্থল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি দর্শনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে। যেখানে আইজ্যাক নিউটন, জন হার্শেল, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, মাইকেল ফ্যারাডের সাথে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন চার্লস রবার্ট ডারউইন। এই প্রবন্ধটির দু’টি অংশ। প্রথমটি জৈববিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে, দ্বিতীয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ, আরো বেশি জটিল প্রজাতির জীবনবৃক্ষ নিয়ে। এই অংশটি পাঠকদের মনে কিছু প্রশ্ন সৃষ্টি করে। আগ্রহের খোরাকও জোগায়। এতদিন ধরে আমরা অনেকেই জীবনবৃক্ষকে উল্লম্ব হিসেবে জেনে এসেছি, কিন্তু জীববিজ্ঞানের একদম আধুনিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, জীবনবৃক্ষ ঠিক একদম উলম্ব নয়, কিংবা একদম গাছের মত নয়। বরং জীবনবৃক্ষের ধারণায় এখন আনুভূমিকরূপ দেখা যাচ্ছে এবং এটি জালের মত বিস্তৃত।। হয়তো সবশ্রেণীর পাঠকের কথা বিবেচনায় রেখে লেখা হয়নি। বরং জীববিজ্ঞানে যাদের স্নাতক পর্যায়ের জ্ঞান রয়েছে তাদের কাছে এটি সুখপাঠ্য হবে নিঃসন্দেহে।

এরপরের প্রবন্ধটি বাংলাদেশের প্রখ্যাত নিসর্গবিদ এবং সুপরিচিত বিজ্ঞানলেখক দ্বিজেন শর্মার লেখা ‘ডেভিলস চ্যাপলিন’। লেখক এই নামকরণের কারণ প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থ প্রকাশের আগেই সম্ভাব্য বিতর্ক অনুধাবন করে ডারউইন নিজেকে ‘ডেভিল’স চ্যাপলিন’ বা ‘শয়তানের সঙ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এই প্রবন্ধেও ‘ডেভিলস চ্যাপলিন’ বলতে ডারউইনকেই বোঝানো হয়েছে। তবে যেহেতু রিচার্ড ডকিন্সের ওই নামে একটি বই রয়েছে, তাই অনেক পাঠক হয়তো ভাবতে পারেন, এটি রিচার্ড ডকিন্সের ওই বইয়ের কোনো অনুবাদ। আসলে তা নয়। এই লেখাটি মৌলিক একটি লেখা। ডারউইনের জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই লেখায় বর্ণনা করা হয়েছে। ডারউইনিজম নিয়ে মার্ক্স ও এঙ্গেলসের আলোচনাও এখানে উঠে এসেছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ হল ডারউইনবাদের বিভিন্ন বিচ্যুতির (যেমন নিওডারউইনিজম, সোশ্যাল ডারউইনিজম ইত্যাদি) উপর আলোচনা।

এরপরের প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাখহরি সরকার ‘পাঠ্যক্রমে জৈববিবর্তনবিদ্যা পুনঃসংযোজনের যৌক্তিকতা’ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন ডারউইনের তত্ত্বের পরিসর। লেখকের ভাষায়

“জৈববিবর্তনের অন্তর্ভুক্ত বিষয় সুবিশাল। বিবর্তনের ধারনা কেবলমাত্র প্রাণীকুল বা মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জীবজগতের প্রতিটি উপাদানের মধ্যেই বিবর্তন সংগঠিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র অণুজীব থেকে শুরু করে সকল স্তরের জীবের মধ্যে বিবর্তন ক্রিয়াশীল”।

বিবর্তনের চিত্র যে জীবজগতের বাইরে জড়জগতেও দেখতে পাওয়া যায় তাও তিনি দেখান। বিবর্তনের সাক্ষ্য-প্রমাণাদি, বংশগতিবিদ্যা ও আণবিক জীববিজ্ঞানের ভূমিকা এবং কৃষিকার্যে বিবর্তনের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করেন।

পরবর্তী প্রবন্ধটি হল, ‘জৈববিবর্তন-বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি’। লিখেছেন মুক্তমনার খ্যাতিমান বিজ্ঞান লেখক বন্যা আহমেদ। তিনি শুরু করেছেন কোপার্নিকাসকে দিয়ে, শেষ করেছেন স্টিফেন জে. গোল্ডের উক্তির মাধ্যমে। এর মাঝেই তিনি তুলে ধরেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে জৈববিবর্তন সম্পর্কে ধারণা। তিনি লিখেছেন,

“জীববিজ্ঞানে যতই নতুন নতুন আবিষ্কার হয়েছে ততই নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে জৈববিবর্তনের যথার্থতা। ফসিলবিদ্যা থেকে শুরু করে আণবিক জীববিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জিনেটিক্স, জিনোমিক্স, ইভোলিউশনারি ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজির মতো বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক শাখাগুলো থেকে পাওয়া সাক্ষ্যগুলো জৈববিবর্তন তত্ত্বকে আজ অত্যন্ত শক্ত খুঁটির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে”।

দেড়শ’ বছর আগে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থের প্রকাশকালের সময় থেকে এই একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জনসাধারণের মধ্যে এই বিবর্তন বিষয়ে কতটুকু সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে সেটা আমরা দেখতে পাই।

এরপর আমরা বিবর্তনের উপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সুপাঠ্য প্রবন্ধ পাই যার শিরোনাম, ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব কি ভেঙে পড়েছে’। লেখক ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ, ডা. মাহবুবুর রহমান। প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় হল, ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিজ প্রকাশের গত দেড়শ বছর পর আজকের সময়ে এসে বিজ্ঞান মহলে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? ডারউইনের সমসাময়িক বিবর্তনবিরোধীদের থেকেই আলোচনা শুরু হয়। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম টমসন (লর্ড কেলভিন) বিবর্তনের বিরোধিতা করতে গিয়ে কি রকম হাস্যকর সব কাজ করে বসেছিলেন তা আমরা দেখতে পাই। ডারউইনের জীবদ্দশায় অন্তর্বর্তী ফসিল খুব একটা পাওয়া যায় নি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর বিভিন্ন ফসিল রেকর্ড মিসিং লিঙ্ক পূর্ণ করতে সহায়তা করেছে। প্রবন্ধটিকে অলংকৃত করেছে ইডার (Darwinius masillae) ফসিল নিয়ে আলোচনা। যে প্রাণীটির মধ্যে একইসাথে লিমার এবং এপের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। লেখক ডেভিড এটেনবরোর প্রামাণ্যচিত্র ‘Charles Darwin & the Tree of Life’ এবং জেরেমি টমাস পরিচালিত ডারউইনের জীবনীভিত্তিক চলচিত্র ‘Creation’ এর রিভিউও লিখেছেন। যা পড়তে গেলে পাঠকদের একঘেয়েমি দূর হয়ে যাবে এবং এক পর্যায়ে পাঠকদের মনে হবে তিনি কোন কাঠখোট্টা, নীরস বিজ্ঞানের গ্রন্থ নয়, বরং টান টান উত্তেজনা নিয়ে রোমাঞ্চোপন্যাস বা কোন ফিল্ম ম্যাগাজিন পড়ছেন। লেখক ক্রিয়েশন চলচিত্রটির তীব্র সমালোচনা করেছেন। এখানে ডারউইনের ব্যাক্তিত্বকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয় নি বলে তার ব্যাখ্যাও প্রদান করেন।

‘অরিজিন অব স্পিসিজ- মানবজাতির জন্য আলোর ঝলক’ শিরোনামে পরের প্রবন্ধটি লিখেছেন পেশাদার বিজ্ঞান বক্তা আসিফ। ডারউইনের বইয়ের উপর আলোচনা নিয়েই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থের বিভিন্ন আনুসঙ্গিক বিষয়ের বর্ণনা দেয়া হয়। লেখকের ভাষায়,

“ডারউইন তার প্রজাতির উৎপত্তি বইটির মাধ্যমে জীববিজ্ঞানে সফলভাবে বেকনীয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেন এবং জীববিদ্যাকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে উন্নীত করেন”।

তবে এই প্রবন্ধে পুরোপুরি গ্রন্থ পর্যালোচনা করা হয়নি। প্রবন্ধটির উপসংহার চমৎকারভাবে টানা হয়েছে বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্স এবং বিজ্ঞানী টমাস হাক্সলির বহুল আলোচিত বিতর্কটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদানের মাধ্যমে।

পরবর্তী প্রবন্ধ ‘জৈববিবর্তন তত্ত্ব এত প্রয়োজনীয় কেন’ লিখেছেন ডা. মনিরুল ইসলাম। জৈববিবর্তনের ব্যপক পরিসরে ব্যবহারিক প্রয়োগ তিনি উদাহরণের পর উদাহরণের পর তুলে ধরে অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় তুলে ধরেছেন। কৃষিতে, কৃষি-প্রযুক্তিতে, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জৈবপ্রযুক্তি ইত্যাদির যথাযথ প্রয়োগ যে জৈববিবর্তন না বুঝে করা সম্ভব নয় ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। শেষে এসে লিখেছেন,

“জৈববিবর্তনের জ্ঞান আমাদের জীব, জীবজগৎ এবং জৈবনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সুযোগ দেয় এবং এসব ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ সব সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করে”।

এরপরের প্রবন্ধে ‘জৈববিবর্তন তত্ত্বের আলোকে চিকিৎসাবিজ্ঞান’ এর উপর আলোচনা করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বিরঞ্জন রায়। রোগের নিদানের ঐতিহাসিক সমীক্ষা, এতে জৈববিবর্তন তত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি এই আলোচনায় উঠে আসে। ব্যাক্টেরিয়া-ভাইরাসের সাথে অ্যান্টিবায়োটিকের যুদ্ধের পিছনেও কিভাবে জৈববিবর্তন কাজ করে তার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। রোগ ও উপসর্গের পার্থক্য, মানসিক রোগের প্রকারভেদ নিয়েও আলোচনা করা হয়। শেষে জানানো হয়,

‘জৈববিবর্তন তত্ত্ব চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা ক্ষেত্রে যেমন আলো দিচ্ছে, তেমনি একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কাঠামো যোগাচ্ছে; যাতে চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসাবে আমরা দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞও হয়ে উঠি’।

দশম প্রবন্ধটি লিখেছেন আমাদের পরিচিত, মুক্তমনা ব্লগের এ্যাডমিন অভিজিৎ রায়, ‘বোয়িং ৭৪৭’ শিরোনামে। আকর্ষণীয় এই প্রবন্ধটিতে লেখক, বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেডরিক হয়েলের কথিত ‘জাঙ্কইয়ার্ড থেকে বোয়িং ৭৪৭’ ফ্যালাসি এবং এ নিয়ে সৃষ্টিবাদীদের লাফালাফির অযৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। তিনি তুলে ধরেছেন অজৈবজনি প্রক্রিয়া কখনো এক ধাপে ঘটে না, বরং বিভিন্ন ছোট ছোট ধাপের মাধ্যমে সম্পন্য হয়। যার সাথে জাঙ্কইয়ার্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অংশবিশেষ হতে বোয়িং ৭৪৭ তৈরি হওয়ার তুলনা করার কোন যৌক্তিকতা নেই। তিনি আরও লিখেছেন,

“গাণিতিক সিমুলেশনের সবগুলোই আমাদের খুব পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে নন-র্যা ন্ডম প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে জটিল জীবজগতের উদ্ভব ঘটতে পারে, কোন ধরণের ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই। মূলত অধ্যাপক হয়েল ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়াটি ঠিকমতো বোঝেননি বলেই তিনি জটিল জীবজগতের উদ্ভবকে কেবল চান্স দিয়ে পরিমাপ করতে চেয়েছিলেন এবং একে বোয়িং ৭৪৭ এর উপমার সাথে তুলনা করেছিলেন”।

শেষে রিচার্ড ডকিন্সের উদ্ধৃতি দিয়ে ঈশ্বরকেই ‘হয়েলের আল্টিমেট বোয়িং ৭৪৭’ বলে অভিহিত করে হাস্যরসের মাধ্যমে লেখক উপসংহার টেনেছেন।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজি বিভাগের শিক্ষক এবং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান লেখক কার্ল ঝিমার এর ‘চোখের বিবর্তন যেভাবে হল’ প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন সিদ্ধার্থ কুমার ধর। ব্যাক্তিগতভাবে আমি এই প্রবন্ধটিকে বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ বলে মনে করি। সৃষ্টিবাদীরা অনেক আগে থেকে থেকে প্রায় সময়ই বিবর্তনের বিরুদ্ধের যুক্তি হিসেবে দাবি করে, ‘চোখের মত এমন নিখুঁত ও একটি জটিল অঙ্গ কখনো প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আসতে পারে না। অবশ্যই এর পিছনে কোন অতি বুদ্ধিমান সত্ত্বার হাত রয়েছে’। এই প্রবন্ধে আমরা দেখতে পাই প্রাণীদের বিভিন্ন অঙ্গের মত চোখগুলোও স্বতন্ত্রভাবে বিবর্তিত হয়েছে। আরো দেখতে পাই,

“কিছু মেরুদণ্ডী প্রাণীর চোখ এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যার ফলে তারা অতিবেগুনি রশ্মি দেখতে সক্ষম। কিছু মাছের ক্ষেত্রে দ্বৈত লেন্সের উদ্ভব হয় যার ফলে তারা একইসাথে পানির উপরিতলের (surface) ওপরে এবং নিচে দেখতে সক্ষম হয়”।

তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত এই প্রবন্ধ থেকেই আমরা আমাদের আধুনিক গোলাকার চোখের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি।

এরপরের প্রবন্ধটি বিষ্ণুপদ সেনের অনুদিত প্রথিতযশা বংশগতিবিদ থিওডোসিয়াস ডবঝানস্কির ‘জৈববিবর্তনের বোধ ব্যতীত জীববিজ্ঞানে কোন কিছুই অর্থবোধক নয়’। এই উক্তিটি জীববিজ্ঞানে তথা জৈববিবর্তনের ক্ষেত্রে বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশেরও বেশ কিছু লেখক এই উক্তিটি তাদের লেখায় ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এদেশে বাংলাভাষায় এত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রবন্ধটি আগে কখনো অনুদিত হয় নি। প্রবন্ধটিতে আলোচনা করা হয়েছে জীবনের প্রাণ-রাসায়নিক সর্বজনীনতা, ডিএনএ’র গঠন ইত্যাদি নিয়ে। তুলনামূলক ভ্রুণবিদ্যা, শারীরস্থান বিদ্যার দিক থেকেও জৈববিবর্তনের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে। অনুবাদটিও বেশ প্রাণবন্ত এবং সহজপাঠ্য হয়েছে।

আমেরিকার সাউথইস্টার্ন লুসিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বারবারা ফরেস্টের ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও লক্ষ্যঃ একটি অবস্থানপত্র’ শিরোনামের প্রবন্ধটি যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন সিদ্ধার্থ কুমার ধর এবং অভীক দাস। দীর্ঘ এই প্রবন্ধে লেখকের গবেষণায় উঠে এসেছে আমেরিকায় বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া সৃষ্টিবাদী আন্দোলনের চিত্র। ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশনিস্টরাই যে এখন তাদের ভোল পালটে আইডির আড়ালে ওল্ড আর্থ ক্রিয়েশনিজম প্রচার করছে তা বোঝা যায়। শক্ত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এরা চেষ্টা চালাচ্ছে বিজ্ঞানের ক্লাসরুমে ধর্মশিক্ষা প্রবেশ করানোর। বিজ্ঞানী ও ক্রিয়েশনিস্টদের মধ্যকার বিভিন্ন মামলার বর্ননাও এখানে দেয়া হয়েছে। এই প্রবন্ধটি পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য নাও হতে পারে। কারণ এটি লেখকের গবেষণাপত্র। একারণে এটি সাধারণ পাঠকের পাঠোপযোগী করে লেখা হয় নি। আমরা অনুবাদকরাও এই প্রবন্ধটির বঙ্গানুবাদ করতে গিয়ে যথেষ্ট সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি।

সর্বশেষ প্রবন্ধ ‘জৈববিবর্তন, ডারউইন এবং ঈশ্বর বিশ্বাস’ লিখেছেন বইটির সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশ। অপারিন, হ্যালডেনের দেখানো জীবনের উদ্ভব থেকে শুরু করে আজকের সৃষ্টিবাদীদের আন্দোলনের কথা এখানে এসেছে। এখানে শুধু ক্রিশ্চিয়ান ক্রিয়েশনিজমই নয় ইসলামি ক্রিয়েশনিজম, হিন্দু ক্রিয়েশনিজমের কথাও আলোচিত হয়েছে। খ্রিস্টান ক্রিয়েশনিজম নিয়ে আমরা সবাই মোটামুটি জানি। গ্যালআপ জরিপ সংস্থা ছাড়াও পশ্চিমা বিশ্বের প্রচুর সংস্থা খ্রিস্টান ক্রিয়েশনিজম নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের উপর ক্রিয়েশনিজম বা জৈববিবর্তনের উপর তাদের আস্থা কতটুকু, এ বিষয়ে পরিচালিত জরিপ নিয়ে অনেকেই অবহিত নন। এমন কী, মুসলিম বিশ্বে ক্রিয়েশনিজমের রকমফের, জৈববিবর্তন নিয়ে শিক্ষিত জনসাধারণের ধারণা. আস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। আমেরিকার হার্ভাড এবং কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ সহায়তায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে (পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, তুরস্ক ইত্যাদি) ইসলামি ক্রিয়েশনিজম এবং জৈববিবর্তন নিয়ে পাবলিক রেসপন্স, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির উপর টানা তিন বছর ধরে পরিচালিত গবেষণার রেজাল্ট প্রকাশ করা হয় ২০০৯ সালের ৩০-৩১ মার্চ। খ্রিস্টান ক্রিয়েশনিজমের সাথে ইসলামি ক্রিয়েশনিজমের তেমন পার্থক্য না থাকলেও, গবেষণার ফলাফল বেশ চমৎকার এবং আগ্রহোদ্দীপক। এছাড়া এই প্রবন্ধে ডারউইন এবং মার্ক্সের কথিত চিঠি আদান প্রদানের ব্যাপারেও বিভ্রান্তি দূর করা হয়েছে। সাথে জৈববিবর্তন সম্পর্কে সাধারণ জনগণের অবোধগম্যতার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে দীর্ঘ যুক্তিসহকারে। তবে লেখকের এই দীর্ঘ প্রবন্ধে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান নিয়ে টেকনিকাল আলোচনার চাইতে বিজ্ঞানের দর্শন এবং বিজ্ঞানের জনবোধগম্যতা নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে।
বইটি সম্পর্কে একবাক্যে বলা যায় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের, বিশেষ করে ডারউইন এবং জৈববিবর্তনের উপর এমন সমৃদ্ধ বই খুব কমই প্রকাশিত হয়েছে।