মহাবৃত্তীয় সভ্যতার সন্ধানে

শরীরের ভেতর মনের বাস। মন ও শরীরের দ্বন্দ্ব তবু টের পাই কমবেশি সবাই। এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমরা মাঝে মাঝে উদাসীন হই কখনও। কিন্তু এ ভাবনা থেকে এটা লেখা না। তবে এ লেখাটার কারণেই সম্প্রতি মুক্তমনায় পোস্ট করা ‌গ্যালাক্টিক আলোয় লেখাটা লিখতে পেরেছিলাম। এটা চিঠির আকারে লেখা। এক ধরনের ব্যাক্তিগত পরিভ্রমণও হয়তো।

তু
এখন রাত ২টা। পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমস্থল থেকে মেঘনার দিকে ছুটে চলেছি। গুমগুম শব্দ। যাওয়ার পথে দ্বীপের মতো মনে হলো চাঁদপুরকে। টিম টিম আলো জ্বলছে। কী নিঃসঙ্গতা ঘিরে আছে জায়গাটিতে। এ জায়গায় কংক্রিটের সৈকত দেখেছিলাম এবং অপর পাড়কে মনে হয়েছিল উপকথার জগৎ আর আয়োনীয়দের স্বপ্নের ঠিকানা; যেখানে থেলিস, পিথাগোরাস, ডেমোক্রিটাস আর এমপিডক্লেসরা থাকতেন। এরই মাঝখান দিয়ে অন্ধকার চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছি আরও সামনে, কোনো এক ঠিকানার পথে। বাতাসের ঝাপটা, মাথার ওপর দূর নাক্ষত্রিক আলোক পথ, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি লাখো তারার ব্যাপ্তি নিয়ে ছড়িয়ে আছে। যেন গ্যালাক্টিক নম্র আলো ঘিরে আছে আমাদের। তু, এখানেই তো তুমি থাকতে, তাই না?

এক গল্পের জগৎ ধীরে ধীরে তৈরি হলো, যেন ইতিহাসের সরলরেখা এলোমেলো করে দেওয়া এক সময়_ ফিউডাল সোসাইটিকে পাশ কাটিয়ে আসার ফলে ভারতবর্ষের দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক অবক্ষয়ের কথা। আমার সঙ্গের মানুষটির এ বিষয়ে উপলব্ধি অনেক গভীর। খুব বেশি মানুষ তাকে চেনে বলে বোধ হয়। কিন্তু যারা তাকে চেনে তারা বোঝে, তিনি সভ্যতার পথিক, সমাজতত্ত্বে তার বসবাস, সমাজ বিবর্তনের পর্যবেক্ষক। তার চোখের সামনেই ঘটেছে ‘৪৭-এর দেশভাগ, ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আর সমাজতন্ত্রের পতন। কীভাবে ঘটনাগুলো সময়কে পরিবর্তন করে, সমাজকে এগিয়ে দেয়, আবার সভ্যতাকে দুমড়ে-মুচড়ে শতাব্দীর অস্থিরতায় নিয়ে যায়_ তা তিনি দেখেছেন। প্রবল বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, আর জাহাজের গুমগুম কেমন ঘোরের মধ্যে নিয়ে গেছে, মনে হচ্ছে আমরা চলেছি দূর কোনো নক্ষত্রের পথে, এক মহাবৃত্তীয় সভ্যতার সন্ধানে।

বেশ আগের কথা। নিজের রুমের ভেতরই সারাদিন কাটিয়ে দিতাম। দিনের পর দিন আবদ্ধ থাকার পর বের হলে যেন পুরো পৃথিবীটাই কবিতার মতো ধরা দিত। দুপুরের রোদে অথবা বিকেলে নম্র আলোয় রাস্তার আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে দেখতাম ব্যাষ্টি মানুষের হেঁটে যাওয়ার ছবি, কীভাবে ধীরে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে তারা মিলিয়ে যায়। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, দেখছ কী সুন্দরভাবে মানুষরা হেঁটে যাচ্ছে সেই কেনিয়ার ওমা নদীর তীর থেকে – যেখানে মানুষের প্রথম পদচিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। এভাবে হেঁটেছে লক্ষ বছর ধরে।

দুপুরের রোদ আর মৃদুমন্দ বাতাসে যেন ভূমধ্যসাগরীয় দুপুর হাজির হতো। এ রকম কত দীর্ঘপথ মানুষ হেঁটেছে সময়ের পথ ধরে – ঈজিয়ান সাগরের উপকূল, মিসরের নীলনদ আর ভারতের শিপ্রানদীর তীর হয়ে মেঘনার অববাহিকায়। এগুলো ভাবলে এক ধরনের আচ্ছন্নতা ঘিরে রাখে। সেই ঘোরে আমি শীতলক্ষ্যা থেকে মেঘনা হয়ে পৌরাণিকতার পথে খুঁজেছি নিজের কৈশোরকে, জিজ্ঞেস করেছি – এই হেঁটে যাওয়া পথের শেষ কোথায় তু? ৪০ হাজার প্রজন্মের স্বপ্ন নিয়ে বহমান বাতাস কখনও ৩৫ হাজার বছর আগের গুহা মানবদের কাছে থমকে দাঁড়িয়েছে, কখনও আয়োনিদের সঙ্গে মেসোপটেমিয়ার পথে হেঁটেছে, আলেক্সান্দ্রিয়ার রোদেলা দুপুরে নিমগ্ন হয়ে পৃথিবীকে দেখছে, আনমনে ভেবেছে কালিদাসের উজ্জীয়নী হয়ে খারিজম পর্যন্ত। হয়তো পেৌছে যাবে নক্ষত্র হয়ে গ্যালাক্টিক কেন্দ্র পর্যন্ত – ৩০ হাজার আলোকবর্ষ। তবুও কি মনের নাগাল পাবে? শরীর আর মনের দ্বন্দ্ব ঘুচবে? শরীর থেকে মন দীর্ঘ এক পথ, শত হাজার আলোকবর্ষের চেয়েও দীর্ঘ। অথচ একদিন শরীরই মনের জন্ম দিয়েছিল।

কোনো এক সন্ধ্যায় গাড়িতে বসে ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরের যানজট ঠেলে আমরা এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই রুশ সংকলন ‘রূপের ডালি খেলা’র এক মানবিক পৃথিবীর গল্পে প্রবেশ করলাম। সেই সরলতার পথ ধরে ধর্ম ও বিজ্ঞানের জটিল দ্বন্দ্বে খানিক থমকে দাঁড়ালাম। আবার পথচলা, দুপুরের পথ – তুরাগের তীর ঘেঁষে এলোমেলো হেঁটে যাওয়ার এক পথ। উচ্ছলতা আর প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা তুমি। কিন্তু তোরাব নদীর ক্ষয়িষ্ণুতা সময় নদীকে যেন দ্বিধা-বিভক্ত করে ফেলল। আমি দেখতে পেলাম, ভারতবর্ষের বিভক্ত হওয়া এবং সামাজিক অবক্ষয়ের সর্পিল রূপকে।

রাতে পথ চেনার জন্যই মানুষ নক্ষত্রের দিকে তাকায় আর নিজের অস্তিত্ব খোঁজে। পার্কে বসে বলা চাঁদপুরের মোহনায় ডাকাতিয়া নদীর গল্প, সন্ধ্যা তারার আলোয় ঘুরে বেড়ানো, নৌকা চালানো কিশোরীর নাক্ষত্রিক আলোয় পথ চেনার অনুভূতি, কিসের সন্ধান দেয়? মন ও শরীরের একীভূত হওয়ার কোনো সন্ধান?
আর্থার সি ক্লার্ক তার ‘স্পেস ওডেসি’তে এক নাক্ষত্রিক সভ্যতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘জ্ঞান তাদের ক্ষমতাবান করেছিল, ক্ষমতা তাদের উৎসাহ জুগিয়েছিল নক্ষত্র অভিযানে। বেড়িয়ে পড়েছিল তারা ভিন্ন নক্ষত্রের উদ্দেশে। সেই শ্রান্তিহীন অভিযাত্রায় প্রাণের সন্ধানও পেয়েছিল অনেক গ্রহ-নক্ষত্রে। তারা লক্ষ্য করেছিল কীভাবে সময়, পরিবেশ প্রাণের ওপর ক্রিয়াশীল হয়। কোথাও কোথাও মিলেছিল ভবিষ্যতে বিকশিত হওয়ার বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গীকার। তারা গ্যালাক্সির সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছিল; কিন্তু মনের চেয়ে অধিক মূল্যবান কিছু খুঁজে পেল না। … মনই শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি – এ বিশ্বাসে উপনীত হয়েছিল। তারা যেখানেই এর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখেছিল, সেখানেই এর আগমনকে উৎসাহিত করেছিল। তারা পরিণত হয়েছিল নক্ষত্রভূমির নক্ষত্র কৃষকে।’

তু, ছেলেবেলায় একাকী পথচলার সময় একজনকে আমি দেখতাম হাঁটতে। চাওড়া কাঁধ, ঋজু দেহ। নাম জা-ভালজা। ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল উপন্যাসে’র মূল চরিত্র। এক টুকরো রুটি তাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল, খেটেছিল ২০ বছর জেল। বারবার জেল আর পালানোর মধ্যে কেটেছিল তার জীবন। সেই ভ্রমণ কি তাকে মনের সন্ধান দিয়েছিল?
কৈশোরে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলের উজ্জ্বলতায় একবার পেঁৗছে গিয়েছিলাম ওমা নদীর পাড়ে। অনুভব করেছিলাম, ৩৮ লাখ বছরের হেঁটে আসা কিশোরের শব্দ। কত নিশ্চিত, ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে মহাবৃত্তীয় সভ্যতার পথে, শুনতে পাচ্ছ তু?

রচনাকাল- ২০০৭ সাল রাত দুটো