আবুল কাশেম

সহিংস জিহাদ হলো ইসলামের প্রাণ, যার বিনা ইসলাম হয়তোবা সপ্তম শতাব্দীতেই মৃত্যুবরণ করতো৷ — এম, এ, খান (জিহাদ, পৃ ৯৫)

এটা খুবই উৎসাহের খবর যে, লেখক এম, এ, খানের আমেরিকা থেকে প্রকাশিত অত্যন্ত প্রসংশিত “Islamic Jihad: A Legacy of Forced Conversion Imperialism and Slavery” বইটি বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে ঢাকায় (ব-দ্বীপ প্রকাশন, কনকর্ড এম্পোরিয়াম, কাটাবন; পৃষ্ঠা ৪৭০; মূল্য ৫০০ টাকা)।

খানের “জিহাদ” বইটি ইসলাম ও জিহাদি সহিংসতার সঠিক কারণ অনুধাবণের জন্য বর্ধনশীল পাঠ্য-তালিকায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বইটি সুস্পষ্ট করে তোলে যে, ইসলাম তার প্রাণে সাম্রাজ্যবাদি ও সহিংস, এবং বর্তমানে চলমান ইসলামি সন্ত্রাস ইসলামের শুরুতে নবি-কর্তৃক সূচিত জিহাদের বহমানতা মাত্র। বইটি এ বার্তা দেয় যে, জিহাদ আজও জীবন্ত ও সক্রিয়, এবং বর্তমান সভ্যতা এর হুমকিকে অগ্রায্য করলে কেবলই নিজস্ব ধ্বংস ডেকে আনবে।

জিহাদ গ্রন্থটি সাতটি প্রধান অধ্যায়ে বিভক্তঃ জিহাদের প্রকৃত অর্থ নিয়ে চলমান বিতর্ক দিয়ে শুরু করে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, নবির জীবনী ও জিহাদের জন্ম নিয়ে পর্যালোচনা এবং ইসলামে ক্রীতদাসত্ব প্রথার আলোচনা দিয়ে বইটির সমাপ্তি। ৪৭০ পৃষ্ঠার এ বইটি ইসলামি ধর্মতত্ব ও ইতিহাসের উপর একটি ব্যাপক ও প্রভাবশীল গবেষণামূলক সাহিত্যকর্ম।

খান আলোকপাত করেছেন ইসলামি জিহাদের নানা বিষয়ের উপরঃ নবি মোহাম্মদের সহিংসতা; ইসলামে ইহুদি, খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি আচরণ; এবং বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ইসলামি সাম্রাজ্যবাদ ও আরব আধিপত্য আরোপ। এখানে আমি বইটির প্রধান বিষয়গুলোর আলোকপাত করব।

ইসলামি সাম্রাজ্যবাদ

বিজিত জনগণের সাংস্কৃতিক ধ্বংসসাধনের উপর খান লিখেছেন:

…মুসলিম বিজয়ীরা একনিষ্ঠভাবে বিধর্মী বিজিতদের সংস্কৃতি ধ্বংসের কাজে লিপ্ত হন – এ বিশ্বাসে যে, ইসলামপূর্ব ‘জাহিলিয়া’ যুগের সমস্ত চিহ্ন বা সাক্ষ্য মুছে ফেলে তদস্থলে ইসলামের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। (পৃ ২০৮)

এটা একটা সাংঘাতিক বক্তব্য যা বলে যে, ইসলামে ধর্মান্তরকৃতরা তাদের আদি সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে ঘৃণা করে; ইসলাম সম্পূর্ণরূপে বিজিত ও ধর্মান্তরিত জনগণের অতীতের সাথে সম্পর্ককে নস্যাৎ করে; এবং এটা ব্যাখ্যা করে: কেন একজন ভারতীয় মুসলিম প্রথমে নিজেকে মুসলিম মনে করে, তারপর ভারতীয় বা অন্য কিছু। বইটি সুস্পষ্ট করে তুলে: কেন একজন সদ্য-ধর্মান্তরিত মুসলিম ইসলামের জন্য নিজ জীবন বিসর্জন দিতে মরিয়া হয়ে উঠে এবং বিস্ফোরকপূর্ণ আত্মঘাতী-কোমরবন্ধ পরে নেয় তারই সম্প্রতি-অতীতের নিস্পাপ সহধর্মীদেরকে গণহারে নিধন করতে। সে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে তার শিকড়, বংশ-পরম্পরা, অতীত ধর্ম ও সম্ভবত তার ভাষা-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। খানের বইটি অবশ্য পঠিতব্য সেসব মুসলিমদের জন্য, যারা তাদের অতীতকে হারিয়েছে।

লেখক বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ইসলামি আক্রমণ চিত্রায়িত করেছেন, যা শুরু হয় নবি মুহাম্মদের দ্বারা ও চলমান থাকে তার মৃত্যুর পর। প্রধাণত মুসলিম ইতিহাসবিদ-লিখিত খাটি ঐতিহাসিক দলিল থেকে সংগৃহিত তথ্যের ভিত্তিতে খান ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, বলকান অঞ্চল, স্পেন, আফ্রিকা ও ইউরোপে ইসলামের আক্রমণ চিত্রিত করেছেন; সেই সাথে বর্ণনা করেছেন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রসার। এসব আক্রমণের বর্ণনা বিস্তারিত ও মনোযোগ আকর্ষণকারী; বহু অজানা তথ্য যুক্ত হয়েছে। এবং বইটি কেবল ইসলামের ইতিহাস নথিবদ্ধ করে নি, বরং বর্তমানকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদদের জন্য বইটি ইসলামি জিহাদের ইতিহাসের জন্য একটি মূল্যবান সূত্র হিসেবে কাজ করবে। মুসলিম পাঠকরা নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতির শিকড় অনুধাবনে বইটিকে পাবেন একটি অনন্য সাহিত্যকর্ম হিসেবে, যা তাদেরকে বুঝাতে সহায়তা করবে তারা কেন বা কীভাবে আজ মুসলিম। গবেষক ও লেখকদের জন্য বইটি হবে মূল্যবান তথ্য ও সূত্রের উৎস।

খান ভারত, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ইসলামি আগ্রাসন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের তুলনা করে দেখিয়েছেন দু’টোই ছিল উপনিবেশবাদি প্রকৃতির – অথচ এসব অঞ্চলের ধর্মান্তরিত মুসলিমরা সেখানে ইসলামের আগমণ বা ইসলামি সাম্রাজ্যবাদকে গৌরবান্বিত করে, যা তাদের পূর্বপুরুষের উপর ইসলামের নিষ্ঠুরতার সাথে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পশ্চিমা শাসন বা সাম্রাজ্যবাদের আগমনকে দেখে দাসত্ব, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও শোষন হিসেবে। লেখক যথার্থ প্রমাণ সহ দেখিয়েছেন যে, পশ্চিমা উপনিবেশীরা ইসলামি দখলদারদের তুলনায় কম দাসত্বের চর্চা ও সহিংসতা করেছে, এবং অনেকক্ষেত্রে বিজিত জনগণের আদি সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ব্যাহত করে নি। খান জোর দিয়ে বলেছেন যে, ইসলাম দখলকৃত ভুখণ্ডে স্বাধীনতা ও মুক্তি এনেছিল – মুসলিমদের এরূপ ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। সত্যটি হলোঃ ইসলাম তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য এনেছিল সাংঘাতিক ক্রীতদাসত্ব, অধীনতা, জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, আদি সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে বিনাশকরণ, অমুসলিমদেরকে জিম্মিকরণ, ধর্মীয় নির্যাতন ও গণহত্যা। পশ্চিমা উপনিবেশীরা এরূপ অপকর্ম করেছে কম ক্ষেত্রে বা কম মাত্রায়।

জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ

খান সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন কীভাবে মুসলিম আগ্রাসীরা রক্তঝরা যুদ্ধ, সন্ত্রাস, লুটতরাজ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে ভারতে অনুপ্রবেশ করে ও অগ্রসর হয়। ইসলামি আগ্রাসীরা সুচিন্তিতভাবে তাদের নাগালের মাঝে আসা যুদ্ধ-বয়সী হিন্দুদেরকে হত্যা করে, তাদের ধর্মীয় মন্দির-সৌধ লুটপাট ও বিধ্বস্ত করে, এবং তাদের নারী-শিশুদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে কব্জা করে। ক্রীতদাসকৃত সেসব হিন্দু শিশুদের অনেককে মুসলিম ধর্মযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদেরই ধর্মগোত্রীয় হিন্দুদেরকে নিধনমূলক জিহাদে অংশ নিতে। মুসলিম যোদ্ধারা সন্তান-প্রশব-বয়সী হিন্দু মেয়েদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধের ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে কব্জা করে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে ধর্ষণ করে। এসব অসহায় হিন্দু নারীদের ইসলাম গ্রহণ বিনা কোনো উপায় থাকে না, এবং তারা এভাবে মুসলিম সন্তানের জন্ম দেয়। এ প্রক্রিয়া ভারতে (ও অন্যত্র) ধর্মীয় জনসংখ্যার বণ্টনকে বিশেষভাবে পরিবর্তিত করে; যেমন খান লিখেছেনঃ

সুতরাং মুসলিমরা ভারতের যেখানেই সার্থকভাবে আক্রমণ করেছে, সেখানেই হিন্দু পুরুষদেরকে গণহারে হত্যা ও তাদের নারী-শিশুদেরকে বন্দি করে হিন্দু জনসংখ্যা সরাসরি হ্রাস করেছে৷ পরোক্ষভাবে, সন্তান উৎপাদনক্ষম নারীদেরকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে হিন্দু পুরুষদেরকে যৌনসঙ্গী থেকে বঞ্চিত করে হিন্দুদের বংশবৃদ্ধিতে অন্তরায় সৃষ্টিও হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস করে৷ যেহেতু হিন্দু পরিবারগুলোর নারীরা পরবর্তিকালে মুসলিম সন্তান জন্মদানের যন্ত্রে পরিণত হয়, সেহেতু গণহারে ক্রীতদাসকরণের চূড়ান্ত ফলাফল দাঁড়ায়: হিন্দু জনসংখ্যার দ্রুত হ্রাস ও মুসলিম জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি৷ আর দ্রুত বর্ধিত এ মুসলিম জনসংখ্যার রক্ষণাবেক্ষণ হতো পরাজিত হিন্দু বা অমুসলিমদেরকে নিষ্পেষিত করা করের মাধ্যমে৷ এটা মূলত সে একই আচরণবিধি, যা নবি মোহাম্মদ বানু কোরাইজা ও খাইবারের ইহুদিদের উপর প্রয়োগ করেছিলেন৷ (পৃ ১২৪)

খান জানান: সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে ইসলামে ধর্মান্তরকরণে এটা ছিল মুসলিম দখলদারদের একটি ইচ্ছাকৃত কৌশল ভারতের ধর্মীয় জনসংখ্যা চিরতরে বদলে দিতে। এ প্রচেষ্টা এতটাই কার্যকর হয়েছিল যে, ভারত আজ দু’টি ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দ্বারা দু’দিক থেকে ঘেরা (অন্যত্র তা আরো বেশী সফলতা পেয়েছে)। যারা আজও পাকিস্তানি-বাংলাদেশী মুসলিমদের শিকড় বা উৎপত্তি সম্বন্ধে ধারনাহীন, খানের বইটি পড়লে বিষয়টি তাদের কাছে স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। সত্যি বলতে খানের বইটি আমাকে আমার হিন্দু শিকড় ও ঐতিহ্যকে খুজতে উদ্বুদ্ধ, এমনকি বাধ্য করেছে, যা বইটি পড়লে অন্যান্য মুসলিমদের ক্ষেত্রে ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস।

ভারতে ইসলামের প্রসার মানবতাবাদি মুসলিম সুফি বা পীরদের দ্বারা ঘটেছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে বলে বহুল জনপ্রিয় ধারণাটিকেও খান ছিন্নভিন্ন করেছেন। অকাট্য ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ দ্বারা তিনি দেখিয়েছেন যে, ওসব তথাকথিত সুফি-পীররা মোটেও শান্তিপ্রিয় ছিলেন না। বরং অনেক বিখ্যাত সুফিরা – যেমন খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি, নিজামুদ্দিন আউলিয়া ও শাহ জালাল – ছিলেন ভয়ংকর জিহাদি, যারা জিহাদি যুদ্ধ, লুটপাট কিংবা জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণে লিপ্ত হয়েছিলেন।

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ইসলামের বিস্তার

খানের বইটি আরেকটি বহুল সমাদৃত ধারণাকে চুরমার করেছে যে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় (মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ থাইল্যাণ্ড ও দক্ষিণ ফিলিপিন) তলোয়ার উচিয়ে ইসলামের কোনো বাহিনী যায় নি; সে অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটায় শান্তিপ্রিয় মুসলিম বণিক-সুফিরা। সুষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে উদ্ধারকৃত তথ্যের মাধ্যমে খান যথার্থভাবে দেখিয়েছেন যে, মুসলিম ব্যাবসায়ীদের মাধ্যমে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ইসলামের গোড়াপত্তন ঘটলেও সেখানে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে মূলত ধোকা, ষড়যন্ত্র, গুপ্ত জিহাদ এবং শেষে জবরদস্তি ও রক্তপাতের মাধ্যমে। এ বিষয়ে ইবনে বতুতার উদ্ধৃতি দিয়ে খান লিখেছেন:

ইবনে বতুতার বর্ণনায় দেখা যায়, সামুদ্রার মতো ক্ষুদ্র নগর-রাজ্যে মুসলিমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের সাথে সাথে আশেপাশের বিধর্মীদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর ও নির্মম জিহাদ শুরু করে দেয়। (পৃ ১৭২)

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ইসলামি রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতের তুলনায় স্বল্প সময়ে জনগণের মাঝে ইসলামের দ্রুত বিস্তৃতি ঘটে। খানের ধারণা: এর পিছনে কাজ করেছে সেখানে প্রয়োগকৃত ‘শাফি আইন’, যা পৌত্তলিক জনগণকে কেবলমাত্র ইসলামগ্রহণ বা মৃত্যুর পথ দেয়। অথচ ভারতে আরোপিত কিছুটা নমনীয় ‘হানাফি আইন’ পৌত্তলকদেরকে জিম্মি প্রজায় উন্নীত করায় তারা প্রাণে বেঁচে যায়; যার ফলে ভারতে ইসলামের প্রসার কম সফল হয়।

মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের প্রতি আচরণ

খান ‘ওমরের চুক্তি’তে ধারণকৃত তেরটি অবমাননাকারী শর্ত উল্লেখ করেছেন, যা আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্রে ইহুদি, খৃষ্টান ও অন্যান্য জিম্মি প্রজাদের উপর আরোপিত হবে। অমুসলিমদের জন্য এ শর্তগুলো অবশ্য-পঠিতব্য এবং যারা মনে করে ইসলাম অমুসলিমদের প্রতি সহনশীল ও দয়াশীল, তাদের জন্য দৃষ্টি উন্মোচনকারী। ‘ওমরের চুক্তি’র বিষয়ে খান লিখেন:

জিম্মিদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কিত ‘ওমরের চুক্তি’টি সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর কোরান ও নবির দৃষ্টান্তের সঙ্গে সমন্বিত৷ অতএব অষ্টম শতাব্দীর বিখ্যাত ‘হানাফী’ আইনশাস্ত্রবিদ আবু ইউসুফ লিখেছেন: ‘ওমরের চুক্তি পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত বৈধ ও চালু থাকবে। (পৃ, ১২৯)

সুতরাং প্রকৃত ইসলামি সমাজে অমুসলিমরা তাদের মানবাধিকার রক্ষার আশা করতে পারে না, ঐতিহাসিকভাবে যা সাধারণত ঘটেছে এবং আজও ঘটছে, যেমন সৌদি আরব এবং তালেবানী আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অংশবিশেষে।

খানের বইটি অদম্য জিহাদিদের আধিপত্যাধীন ভবিষ্যত পৃথিবীর এক শংকাজনক সম্ভাবনা চিত্রিত করে, যখন বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে: যেমন সম্প্রতি-অতিতের খৃষ্টান-প্রধান লেবানন, বেথলেহেম, সারাজেবো ও নাইজেরিয়ায় খৃষ্টান সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে, এবং সেই সাথে ফিলিস্তিন, মিশর, ইরাক ও অন্যান্য মুসলিম-অধ্যুষিত মুসলিম রাষ্ট্র থেকে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে। এটা একটা সাংঘাতিক বিশ্ব-পর্যায়ের সঙ্কটে রূপ নিচ্ছে।

ইসলামি জাতিভেদ

জিহাদ গ্রন্থটি কোরান-হাদিস থেকে অনেক সূত্র উল্লেখ করেছে, যা জাতিভেদ ও বর্ণবাদের প্ররোচনা দেয়, যা আরবরা নবির জীবনকাল থেকে আজ পর্যন্ত চর্চা করে এসেছে। আজও আরব দেশগুলোতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও আফ্রিকা থেকে আগত শ্যামল-কৃষ্ণ বর্ণের মুসলিমদেরকে মানবেতর ও নীচ হিসেবে দেখা হয়; তাদের প্রতি অবজ্ঞা ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, এবং তাদেরকে খুবই অল্প পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। এটা একটা অতি জনপ্রিয় দাবী যে, ইসলাম সমতাবাদি এবং সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের বার্তা প্রচার করে, যার ধারক ও প্রচারক অনেক সুখ্যাত অমুসলিম পণ্ডিতও। এরূপ দাবি বা ধারণা যে কতটা ভিত্তিহীন ও হাস্যকর, খানের বইটিতে উল্লেখিত অকাট্য দৃষ্টান্তগুলো পড়লে সবাই সেটা অনুধাবন করবেন।

ধর্মীয় নির্যাতন

বইটির সবচেয়ে আকর্ষক ও বিস্ময়-সৃষ্টিকারী বিষয়বস্তু আলোচিত হয়েছে ‘ভারতে ইসলামি সাম্রাজ্যবাদ’ ও ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায় দু’টোতে। প্রথমোক্ত অধ্যায়ের একটি অংশঃ

ভারতে মুসলিম দখলদারদের দ্বারা এমন ব্যাপক হারে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংসের মত দৃষ্টান্ত বিজয়ের ইতিহাসে বিরল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক-একটা মন্দির ধ্বংসের পর সেখানে রক্ষিত মূর্তি ভাংচুর ও ধনভাণ্ডার লুটপাট করার পর বিধ্বস্ত মন্দিরের সাজ-সরঞ্জামাদি দিয়ে সে স্থানেই মসজিদ নির্মাণ করা হতো। দিল্লির ‘কোয়াত-উল-ইসলাম’ (ইসলামের শক্তি) মসজিদটি ঐ এলাকার ১৭টি বিধ্বস্ত মন্দিরের সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে নির্মাণ করা হয়। আমির খসরু, সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ও অন্যান্যদের বর্ণনা অনুযায়ী মন্দিরের পুরোহিত ও সন্যাসীদেরকে সাধারণত হত্যা করা হতো৷ (পৃ ২৪৭)

ক্রীতদাসত্বের উপর অধ্যায়টি উন্মোচন করবে জগণ্যতম অমানবিকতার কাহিনী, যার ভুক্তভোগী হয়েছিল ভারত থেকে মধ্য-এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ ও এমনকি আমেরিকার মিলিয়ন-মিলিয়ন মানুষ।

উপসংহারে বলতে হয়: খানের বইটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ, সহজবোধ্য, মনোযোগ আকর্ষক ও প্রত্যয়-জাগরণকারী। বইটি পড়া শুরু করলে পাঠকরা তা শেষ করার স্পৃহা অনুভব করবে। ইসলামের প্রতি উৎসাহী পাঠকদের বইটিকে অগ্রাহ্য করা সঠিক হবে না। বইটি পড়লে সহজবোধ্য হয়ে যাবে: আজ সহিংস জিহাদিরা যা করছে, তা কেন করছে! বিশেষত ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মুসলিম পাঠকরা বইটি পড়লে হতভম্ব হয়ে যাবেন যে, তাদের অমুসলিম পূর্বপুরুষরা কী জগণ্য ও নির্মম বর্বরতা ভোগ করেছে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য-এশিয়া থেকে আগত মুসলিম আগ্রাসকদের হাতে। মুসলিম বিশ্বের অন্যত্র এবং এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার পাঠকরাও তাদের পূর্বপুরুষদের উপর ইসলামের নির্মম প্রভাবের যোগসূত্র খুঁজে পাবেন।

বইটি আজকের মুসলিম-অমুসলিম সকল রাজনৈতিক নেতাদের জন্যও অবশ্য পঠিতব্য, বর্ধনশীল ইসলামি গোড়ামি ও সহিংসতার প্রতি তাদের নিস্পৃহতা ছুড়ে ফেলতে। জিহাদ গ্রন্থটির বক্তব্যকে ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত সমাজতত্ববিধ ও জাতিসংঘের UNRAWA প্রকল্পের শিক্ষা বিষয়ক উপদেশদাতা ডঃ আলি ইসা উসমানের নিম্নোক্ত উক্তির মাধ্যমেঃ

‘ইসলামের বিস্তার ঘটে সামরিক পন্থায়৷ মুসলিমদের মাঝে এ ব্যাপারে কৈফিয়ত দেওয়ার একটা ঝোঁক রয়েছে এবং আমাদের সেটা করা উচিত নয়৷ ইসলামি বিশ্বাসের জন্য তোমাকে অবশ্যই লড়াই করতে হবে – এটা কোরানেরই নির্দেশ। (পৃ ১৭৮)