প্রচলিত ধর্ম আর জাত-পাতে আমার অরুচি বা অনীহা অনেকদিনের; সেই হবু হবু করেও না হওয়া প্রথম প্রেমে ধরা খাওয়ার পর থেকেই। স্কুল-কলেজে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যেও দেখেছি জাত-পাত নিয়ে নাক উঁচু মনোভাব। অনেক সময় তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গও চলে আসত। তবুও নিজেকে বড় বলে মনে করার মনোভাব ঘুচে না সে যতই শিক্ষা-দীক্ষায় শিক্ষিত-দীক্ষিত হোক না কেন। আবার অনেকে আসল কথা জেনেও মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে মিথ্যে অহংকারের বোঝা বয়ে নিজের কাছেই নিজের মাথাটা নিচু করে চলেন। অন্যকে ছোটো করতে গিয়ে নিজেকেই ছোটো করেন নিজের ইতিহাস বৃত্তান্ত না জানার কারণে।

কলেজে ইতিহাস পাঠ্য ছিলো না। স্কুলে ছিল। বরাবরই তারিখ-সন ভুল করতাম। সুতরাং নাম্বারও কম পাওয়াতে ইতিহাসের প্রতি একটা বিরাগ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। মজা পেতে শুরু করলাম যখন কলেজের শেষের দিকে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসগুলো হাতে আসতে আরম্ভ করলো। সেই শুরু।

শুরু হলো হাজারো প্রশ্নের অনুসন্ধান। হাতে পেতে শুরু করলাম অনেক রেফারেন্স। সাথে যোগ হলো উইকি। (উইকি নির্ভুল নয়, কিন্তু যখন রেফারেন্স সহ তথ্য হাজির করে তখন জেনে নিতে সমস্যা হয় না।) অনেকদিন ধরে শুরু করেছিলাম নীহাররঞ্জন রায়ের “বাঙালীর ইতিহাস – আদিপর্ব”। ঘুরে ফিরে বর্ণ বিন্যাস আর শ্রেণী বিন্যাসেই মনটা বেশী ছুটে যায়। মৌলিক রচনা নয়, বিভিন্ন উপাদান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তার বিশ্লেষণ। ঘুরে ফিরে আসে বাঙালীদের বর্ণ-উপবর্ণ-শ্রেণী-জাত-পাত-বংশ পরিচয়। সেখানে থেকে আমার কিছু নেয়া নোট–

বর্ণপ্রথাগুলো ভারতীয় সমাজ বিন্যাসের ভিত্তি। গড়ে উঠছিল মানুষের কর্ম অনুসারে। কিন্তু কালক্রমে অনেকেই অন্যকে শোষণ বা ঘৃণা করার একটা উপলক্ষ তৈরী করে নিয়েছেন।

ভারতে একমাত্র বাঙালীরাই সবচে বড় সংকর বা মিশ্র জাত। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শুদ্র – এই চতুর্বর্ণের কথা সবাই জানি। বাঙালীদের মধ্য আগে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ছিল না। আবার বাঙলার তথাকথির ‘ছত্রিশ জাত’ যা ভারতের আর কোথাও নাই। মাছ-মাংস খাওয়া ব্রাহ্মণও বাঙালা ছাড়া ভারতের আর কোথাও খুব বেশী নাই। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বাঙলার আদিপর্বের এই বর্ণ বিন্যাসের পরচয় মেলে।

বর্তমান বর্ণ ব্যবস্থার সূত্রপাতের পরিচয় পাওয়া যায় বল্লাল সেনের আমলে রচিত বল্লাল-চরিত গ্রন্থে। কাহিনী সংক্ষেপে এরকম–

অন্য রাজার সাথে যুদ্ধ করার জন্য বল্লাল সেন দেশের এক ধনী বনিকের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার করেন। যুদ্ধে বার বার হেরে গেলে আরো টাকা চান। কিন্তু বনিক এবার শর্ত জুড়ে দিলে বল্লাল সেন রাগ হয়ে বনিকদের টাকা-পয়সা লুট করে অত্যাচার করেন। পরে কোনো এক অনুষ্ঠানে রাজা সবাইকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলে তারা “সৎশুদ্র” (সৎশুদ্র/অসৎশুদ্রের ব্যাপারটা পরে বলছি) রাজার সাথে এক আসনে বসে খেতে অস্বীকার করেন। রাজা তখন এদের একঘরে করে শুদ্রের স্তরে নামিয়ে দেন এবং নিচু সমাজের টাকাওয়ালা অনেককে সৎশুদ্রে উন্নিত করেন। এররকম ভাবেই জাতের প্রমোশন-ডিমোশনের খেলা চলতে থাকে।

ব্রাহ্মণেরা বাঙলার বাইরে থেকে কিভাবে এসেছেন – সেটা নিয়ে দু-চারটে কাহিনী আছে। কিছু এসেছেন ভারতের উত্তর-পশ্চিম থেকে তাড়া খেয়ে। আবার রাজারা দেশের কাজের জন্য কিছু এনেছেন দক্ষিণ ভারত থেকে। বাংলাদেশে কিছু ব্রাহ্মণদের গায়ের রঙ ফর্সা আবার কারো কালো – ব্যাপারটা এ থেকে বোঝা যায়।

বাঙলার বর্ণবিভাগের পরবর্তী ধাপটি হয়েছে শিক্ষা-দীক্ষা-বুদ্ধিতে অগ্রসর এই সব ব্রাহ্মণদের হাতে। বাঙলায় ব্রাহ্মণ বাদে আর যত বর্ণ আছে সবই সংকর বর্ণ, চার বর্ণের যথেচ্ছ পারস্পরিক যৌনমিলনে উৎপন্ন মিশ্রবর্ণ এবং এরা সকলেই শুদ্রবর্ণের অন্তর্গত। একটা চাইনীজকে যত সহজে চেনা যায়, বাঙালীদের চেনা এত সহজ নয়। দেশের বাইরে, আপনি কি বাঙালী – এই প্রশ্নটা যত বেশী শোনা যায় আর কোনো জাতের লোক এটা শোনে কিনা সন্দেহ। এমন ভাবে মিক্সড হয়েছে যে চেনা বড় দায়!বাঙালীদের মধ্য ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের উল্লেখ নাই।

ব্রাহ্মণেরা এই সমস্ত শুদ্র সংকর উপবর্ণগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে সমাজে যার যার স্থান ও কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। বাঙলায় জাত সংখ্যা বলতে আজও আমরা বলি ছত্রিশ জাত। পরে অবশ্য আরো পাঁচটি উপবর্ণ যোগ হয়েছে।

উত্তম-সংকর পর্যায়ের ২০টি উপবর্ণ:

১. করণ – এরা লেখক ও পুস্তককর্মদক্ষ এবং সৎশুদ্র বলে পরিগণিত।
২. অম্বষ্ঠ – এদের বৃত্তি চিকিৎসক ও আয়ুর্বেদচর্চা, বৈদ্য বলে পরিচিত। ঔষধ তৈরী করতে হয় বলে বৃত্তি বৈশ্যের কিন্তু ধর্মকর্মানুষ্ঠানের ব্যাপারে শুদ্র।
৩. উগ্র – বৃত্তি ক্ষত্রিয়ের, ধর্ম যুদ্ধবিদ্যা।
৪. মাগধ – যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক হওয়ায় বৃত্তি হয়েছিল সূত বা চারণের এবং সংবাদবাহীর।
৫. তন্ত্রবায় – তাঁতী।
৬. গান্ধিক বনিক – বৃত্তি গন্ধদ্রব্য বিক্রয়; বর্তমানে গন্ধবনিক।
৭. নাপিত।
৮. গোপ (লেখক)।
৯. কর্মকার (কামার)।
১০. তৈলিক বা তৌলিক – (গুবাক-ব্যবসায়ী)।
১১. কুম্ভকার (কুমোর)।
১২. কাংসকার (কাঁসারী)।
১৩. শাঙ্খিক বা শঙ্খকার (শাঁখারী)।
১৪. দাস – বৃত্তি কৃষিকাজ, চাষী।
১৫. বারজীবী (বারুই) – পানের বরজ ও পান উৎপাদন বৃত্তি।
১৬. মোদক (ময়রা)।
১৭. মালাকার।
১৮. সূত – (বৃত্তি উল্লেখ নাই কিন্তু অনুমান এরা চারণ-গায়ক)।
১৯. রাজপুত্র – (বৃত্তি অনুল্লিখিত; রাজপুত?)
২০. তাম্বলী (তামলী) – পানবিক্রেতা।

মধ্যম-সংকর পর্যায়ে ১২টি উপবর্ণ :

২১. তক্ষণ – খোদাইকর।
২২. রজক – (ধোপা)।
২৩. স্বর্ণকার – (সোনার অলংকার ইত্যাদি প্রস্তুতকারক)।
২৪. সুবর্ণবনিক – সোনা ব্যবসায়ী।
২৫. আভীর (আহীর) – (গোয়ালা, গোরক্ষক)।
২৬. তৈলকার – (তেলী)।
২৭. ধীবর – (মৎস্যব্যবসায়ী)।
২৮. শৌণ্ডিক – (শুঁড়ি)।
২৯. নট – বৃত্তি নাচ, খেলা, বাজি দেখানো।
৩০. শাবাক, শাবক, শারক, শাবার (?) – (বৌদ্ধ শ্রাবকদের বংশধর বলে মনে করা হয়)।
৩১. শেখর (?)
৩২. জালিক (জেলে, জালিয়া)।

অধম-সংকর বা অন্ত্যজ:

এ পর্যায়ে ৯টি উপবর্ণ। এরা বর্ণাশ্রম বহির্ভূত অর্থাত এরা অস্পৃশ্য।

৩৩. মলেগ্রহী (বঙ্গবাসী, সং: মলেগৃহি)।
৩৪. কুড়ব (?)।
৩৫. চণ্ডাল (চাঁড়াল)।
৩৬. বরুড় (বাউড়ী?)
৩৭. তক্ষ (তক্ষণকার?)।
৩৮. চর্মকার (চামার)।
৩৯. ঘট্টজীবী (খেয়াপারাপারের মাঝি)।
৪০. ডোলাবাহী – ডুলি-বেহারা, বর্তমানে দুলিয়া বা দুলে।
৪১. মল্ল (বর্তমানে মালো)।

ম্লেচ্ছ :

এই ৪১টি জাত ছাড়া কিছু দেশী বা ভিনদেশী আদিবাসিদের নাম পাওয়া যায়। যেমন – পুক্‌কশ, পুলিন্দ, খস, থর, কম্বোজ, যবন, সুহ্ম, শবর ইত্যাদি। স্থানীয় বর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে এদের কোনো স্থান ছিল না।

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সমস্ত সংকর বা মিশ্র উপবর্ণগুলিকে সৎ ও অসৎ (উচ্চ ও নিম্ন) এই দুই পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে।

সৎশুদ্র:

১. করণ
২. অম্বষ্ঠ
৩. বৈদ্য
৪. গোপ
৫. নাপিত
৬. ভিল্ল (আদিবাসী কোম; কিভাবে সৎশদ্র পর্যায়ে পরিগণিত হলেন, বলা কঠিন)
৭. মোদক
৮. কুবর
৯. তাম্বুলী
১০. বনিক
১১. মালাকার
১২. কর্মকার
১৩. শঙ্খকার
১৪. কুবিন্দক (তন্তুবায়)
১৫. কুম্ভকার
১৬. কাংসকার
১৭. সূত্রধার
১৮. চিত্রকার (পটুয়া)
১৯. স্বর্ণকার

স্বর্ণকার ও অন্যান্য বনিকরা সোনাচুরির অপরাধে ব্রাহ্মণদের অভিশাপে পতিত হয়ে অসৎশুদ্রে নেমে যান)।
সূত্রধর ও চিত্রকর – এরা কর্তব্যপালনে অবহেলা করায় অপরাধে ব্রাহ্মণদের অভিশাপে পতিত হয়ে অসৎশুদ্রে নেমে যান।

অসৎশদ্র:

স্বর্ণকার, (সুবর্ণ) বনিক, সূত্রধার, চিত্রকার।
২০. অট্টালিকাকার
২১. কোটক (ঘরবাড়ি তৈরীর মিস্ত্রী)
২২. তীবর
২৩. তৈলকার
২৪. লেট
২৫. মল্ল
২৬. চর্মকার
২৭. শুঁড়ি
২৮. পৌণ্ড্রক (পোদ?)
২৯. কসাই
৩০. রাজপুত্র (পরে রাউত?)
৩১. কৈবর্ত (কলিযুগের ধীবর)
৩২. রজক
৩৩. কৌয়ালী
৩৪. গঙ্গাপুত্র (লেট-তীবরের বর্ণ-সংকর সন্তান)
৩৫. যুঙ্গি (যুগী?)
৩৬. আগরী (উগ্র, বর্তমানে আগুরী)

অসৎশদ্রের নিম্নপর্যায়ে যাদের গণনা করা হয়-

ব্যাধ্ম ভড়, কাপালী, কোল (আদিবাসী কোম), কোঞ্চ (কোচ, আদিবাসী কোম), হড্‌ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী), শরাক, ব্যালগ্রাহী, চণ্ডাল ইত্যাদি।

এত জাত-পাতের মধ্যেও লালনের মত মানুষও তার জাত খুঁজে পেলনা, আর আমরা চুনোপুঁটিরা জাত্যাভিমানে আকাশে উইড়া উইড়া হাঁটি।

—————–
আলুব্লগে আগে প্রকাশিত।
—————–

প্রসঙ্গক্রমে শিল্পী নকুল কুমার বিশ্বাসের একটা গানের কথা শেয়ার করছি…

———————–
(কথিত শূদ্রবর্ণের লোকেরা মন্দিরের প্রণামীর বাক্সে হাত দিয়ে টাকা ফেললেও প্রণামীর বাক্স বা মন্দির কোনোটাই অপবিত্র হয় না। এমন কি, সেই টাকায় ঠাকুর-দেবতার নৈবিদ্য কিনলেও পূজা অশুদ্ধ হয় না। কিন্তু কোনো নিম্নবর্ণের ভক্ত যদি পূজারীকে ছুঁয়ে দেয় তখন পূজারীকে আবার স্নান করে অথবা গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ হয়ে তবে পূজায় বসতে হয়। এমনি একটি বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটির উৎপত্তি।)

বর্ণভেদের মর্মবাণী শোনো বলি তথ্য তার
সাহা-কুণ্ডু-ব্রাহ্মণ-মুচি কোন্‌ বর্ণে জন্ম কাহার।

‘বৃ’-ধাতু হইতে সৃষ্টি বর্ণ কথাটিরে ভাই
‘বৃ’ অর্থ বরণ করা শোনো তোমাদের জানাই
যে কর্ম যে বরণ করে
সেজনই সে বর্ণ ধরে
শুদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারে
শাস্ত্রে পাই তা দেখিবার।।

“চাতুরবর্ণং ময়াসৃষ্টং গুণকর্ম বিভাগশঃ”
গীতার পাতায় লেখা আছে খুলে একবার পড়ে এসো
তোমরা গীতার পাতা নাহি পড়ে
পিতার পরিচয়টি ধরে
রক্তের দাবি শক্ত করে
কেউ ধারো না কারো ধার।।

কর্মগুণে বর্ণ পাল্টায় শাস্ত্রের পাতায় দেখতে পাই
ক্ষত্রিয় সে বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণ হয়েছিলো তাই
শূদ্র নাকি ছিলো শুনি
কক্ষিবত্‌ আর ঔলষমুনি
হলো তারা হয়ে গুণী
ব্রাহ্মণ বর্ণে একাকার।।

তবে শুদ্র গুণী হলেও কেনো বৈশ্যতে ঘৃণা করে
দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত হলেও ব্রাহ্মণে নেয় না ঘরে
বর্ণ-জাতি এক করেছে
ওই বেদখানা কে লিখেছে
নকুল বলে আশা আছে
জাতিভেদ জানিবার।।
——————————