Reality গ্রান্ড ডিজাইন বইটির প্রথম পাতায়, হকিং দর্শন শাস্ত্রকে মৃত ঘোষনা করে, লেখা শুরু করেছেন। কারন হিসাবে উনি বলেছেন দার্শনিকরা বিজ্ঞানের নব আবিস্কার এবং তত্ত্বের সাথে আর পাল্লা দিতে পারছেন না। পরে বিশ্ববিখ্যাত কিছু দার্শনিক গালাগাল দেওয়া শুরু করলে, উনি বোধ হয় একটি বিবৃতি দেন উনাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উনি বলতে চেয়েছিলেন, দর্শন শাস্ত্রে বিজ্ঞানের আরো ব্যাপক প্রয়োগ হওয়া উচিত। যদিও কোথায় উনি এটা বলেছেন, সেটা গুগল করে পেলাম না।

যাই হোক কেও দর্শন শাস্ত্রকে মৃত ঘোষনা করলে, দর্শনের ইতিহাস নিয়ে অবগত যে কেও হেঁসে ফেলবেন। কারন দর্শনকে মৃত ঘোষনা করার ইতিহাস ৩০০০ বছরের পুরানো এবং ধারাবাহিক। তাই দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক পল থ্যাগাড, হকিং এর উক্তি শুনে প্রথমেই মন্তব্য করেন ঃ

But those who ignore philosophy are condemned to repeat it. And those who disparage philosophy are usually slaves of some defunct philosopher.

দর্শনকে মৃত ঘোষনা করার ইতিহাস এত দীর্ঘ ( যা গ্রীকদের আমল থেকে শুরু হয়েছে) -যে “দর্শন মৃত” সেটাও দর্শনের একটি বিশেষ শাখা হওয়ার যোগ্যতা রাখে বলে বিট্রান্ড রাশেল মন্তব্য করেছিলেন। “দর্শন মৃত” র ইতিহাস নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার নেই -যারা “দর্শনকে মেরে ফেলার” এই তিন হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে জানতে চান-এই লেখাটা পড়তে পারেন।

http://www.earlham.edu/~peters/writing/endphilo.htm

আমরা স্টিফেন হকিং এর কথায় ফিরে আসি। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী সন্দেহ নেই। কিন্ত দর্শন নিয়ে তিনি যে কটি কথা বলেছেন, সেগুলি ঠিক কি এবং তাই নিয়ে দর্শন শাস্ত্রের লোকেরা কি ভাবে এটাও জানা দরকার। জানা দরকার, ঠিক ৩০০ বছর আগে বিখ্যাত দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্টের ভুলেরই তিনি পুনরাবৃত্তি করেছেন।

হকিং এর দর্শন নিয়ে বক্তব্যের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক প্রবন্ধ লিখেছেন-আমি এর মধ্যে থেকে সব থেকে ভাল যেটি মনে হয়েছে-সেটির ওপর ভিত্তি করেই লেখাটি লিখছি। তাই তার রেফারেন্সও আগে দিয়ে রাখিঃ

http://www.psychologytoday.com/blog/hot-thought/201011/is-philosophy-dead

এবার বিচার শুরু করা যাক। প্রথমে অধ্যাপক পল থ্যাগাডের (http://en.wikipedia.org/wiki/Paul_Thagard)
সমালোচনাটির ভাবানুবাদ করি। বঙ্গানুবাদ করলে দর্শনের অনেক টার্মের জন্যে অনেকেই বুঝবে না। তারপরে নিজের বিশ্লেষনে আসব।

******************
স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্ড ম্লোডিনোর বাস্তবতা নিয়ে অনুকল্পগুলি নিম্নরূপঃ
.
ক) ” বাস্তবতা” তত্ত্ব নিরেপেক্ষ হতে পারে না

খ) একটি মডেলকে “বাস্তবতার” ভাল মডেল বলা যাবে
যদি তা

১) সুন্দর হয়
২) যদি এম্পিরিক্যাল ফিটিং প্যারামিটার কম থাকে
৩) পরীক্ষালদ্ধ সব রেজাল্টের সাথে মিলে যায়
৪) পরীক্ষাগারের রেজাক্ট ভবিষ্যতবানী করতে পারে বা টেস্টেবিলিটির ক্রাইটেরিয়া মানে

গ) একটি ভাল মডেল একটি নিজস্ব “নিরেপেক্ষ” বাস্তবতা

ক) মানা যায় যদি আমরা মেনে নেই-তত্ত্বর ভিত্তি ধারনা।
খ) বিজ্ঞানের দর্শন-নতুন কিছুর বলার নেই।
গ) এই অনুকল্পটি আপত্তিকর। কারন মডেল যে বাস্তবতাকে ধরে, তা সর্বদা আংশিক এবং আপেক্ষিক। তবে এটাকেও আমরা জ্ঞান এবং বাস্তবতার জন্যে একটি দার্শনিক অনুকল্প হিসাবে ধরতে পারি।

এরপর হকিং তার এই দার্শনিক অনুকল্পটিকে বৈজ্ঞানিক উপসংহার হিসাবে চালিয়ে দিলেন। ( ভুলের শুরু এখান থেকেই) ।
তার সিদ্ধান্ত গুলি আদৌ বৈজ্ঞানিক না দার্শনিক?

হকিং এর বক্তব্যগুলি বিশ্লেষন করা যাকঃ

D. “The universe does not have just a single existence or history, but rather every possible version of the universe exists simultaneously.”
( এই মহাবিশ্বের কোন একক অস্তিত্ব নেই-বা একক ইতিহাস নেই। অসংখ্য মহাবিশ্ব একসাথে আছে।)

E. “The universe itself has no single history, nor even an independent existence.”
( এই মহাবিশ্বের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই- নেই কোন একক ইতিহাস)

F. “We now have a candidate for the ultimate theory of everything, if indeed one exists, called M-theory.”
( এম তত্ত্ব থিওরী এভ্রিথিং এর যোগ্য দাবীদার)

G. “M-theory predicts that a great many universes were created out of nothing”
( এম তত্ত্ব শুন্য থেকে বহুবিশ্বের উৎপত্তির ভবিষ্যতবাণী দেয়)
H. “The universe, according to quantum physics, has no single past, or history.”
( কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী মহাবিশ্বের কোন একক অতীত বা ইতিহাস নেই)
I. “The universe doesn’t have just a single history, but every possible history, each with its own probability.”
( মহাবিশ্বের প্রতিটি ইতিহাসেরই কিছু না কিছু সম্ভাবনা আছে।)

হকিং এর দাবী- যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রচুর প্রমান পাওয়া গেছে, সেহেতু উপোরক্ত উপসংহারগুলি সত্য।
কিন্ত এখানে একটা ভুল হল। হকিং এর দাবীগুলি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি বিশেষ ব্যাখ্যা মেনে-এবং মনে রাখতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অসংখ্য ব্যাখ্যা আছে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্য ব্যাখ্যা ধরে এগোলে বহুবিশ্ব নিয়ে সিদ্ধান্তগুলি আলাদা হবে। এবং এম তত্ত্ব টেস্টেবেলিটি মানে না। অর্থাৎ সেটিকে ভাল মডেল আমরা বলতে পারি না ( (খ) এর ৪ দেখুন-ভাল মডেল হতে গেলে কি হতে হয়)। সুতরাং মহাবিশ্ব নিয়ে হকিংসের সিদ্ধান্তগুলি যত না বৈজ্ঞানিক, তার থেকে অনেক বেশী “দার্শনিক”।

তাহলে আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে বিজ্ঞান এবং দর্শনের সীমারেখা এবং সম্পর্ক কি ভাবে নির্নীত হবে।

এই ব্যাপারে দর্শনের দুটি ভাগ।

একটি হচ্ছে ন্যাচারালিস্টিক দর্শন। এরিস্টটল, লকে, মিলস, হিউম, ডিউ, কুইন থেকে সব বিজ্ঞানের দার্শনিক এই পর্যায় ভুক্ত। এখানে মূল বক্তব্য হচ্ছে-প্রকৃতি, জ্ঞান, বাস্তবতা, নৈতিকতা এবং ব্যাখ্যার ভিত্তি হবে বিজ্ঞানের তত্ত্ব এবং পর্যবেক্ষন। অর্থাৎ হকিংস যা দাবী করেছেন, তা নতুন কিছু না-সেটি ন্যাচারিলিস্টিক দর্শনের মধ্যে পরে। কিন্ত এখানে দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের পার্থক্য হচ্ছে বিজ্ঞানের সীমানা “কি হচ্ছে” এবং “কেন হচ্ছে” তার মধ্যে বাঁধা। দর্শন তার বাইরে গিয়েও কি হওয়া উচিত সেই প্রশ্ন করে। যেমন ” জীবনের উদ্দেশ্য কি”,
“ঈশ্বর থাকা উচি্ত না অনুচিত” -ইত্যাদি প্রশ্নের উৎপত্তি দর্শন থেকে। কিন্ত এর উত্তর বিজ্ঞান দিয়ে দিতে হবে। এটা হচ্ছে ন্যাচারালিস্টদের বক্তব্য।

এন্টি-ন্যাচারালিস্টরা এই বক্তব্য মানেন না। তাদের বক্তব্য দর্শন এবং বিজ্ঞান এক না, কারন দর্শনে জ্ঞানের ভিত্তি হতে পারে অনেক কিছু, যা বিজ্ঞানের সীমানাতে পড়ে না-

শুধু যুক্তি ( যেমন ভারতীয় দর্শনের একটি উপপাদ্যঃ মহাবিশ্ব অনন্ত কিন্ত মানুষ সীমাবদ্ধ-সুতরাং অনন্ত মহাবিশ্বকে সম্পূর্ন ভাবে কোনদিন জানা সম্ভব না)

ভাষা এবং যুক্তি ( দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন একটি উদাহরন। যেমন “দর্শন মৃত” শুধু এই দুই শব্দের অসংখ্য মানে হতে পারে। )

অভিজ্ঞতা বাইরেও যে সত্য আছে সেখানে চর্চা করা ( যেমন সব ধর্মীয় দর্শন এই ক্যাটেগরীতে পড়ে। অর্থাৎ ঈশ্বর কি, তার স্বরূপ কি, ঈশ্বর আছেন না নেই-…)

প্রয়োজন ( বা প্রয়োজন এবং যুক্তি) -যেমন ধরুন ঐশ্বরীয় দর্শনের প্রয়োজনীয়তা আছে না নেই? আত্মহত্যার প্রয়োজন আছে না নেই? জীবনের কোন অর্থ আছে না নেই?

অথবা শুধু ধারনা-বহুবিশ্ব বা মাল্টিভার্স বা প্যারালাল ইউনিভার্স এর ভাল উদাহরন। এগুলোর খুব দুর্বল মডেল-দার্শনিক চিন্তা বেশী। সুতরাং এগুলোকে বিজ্ঞান বলা যাবে না-বিজ্ঞানের ডিমার্কেশন অনুযায়ী। কিন্ত টেস্টেবিলিটির ফলে যখন আস্তে আস্তে এগুলি ভাল মডেল হতে থাকবে, ধারনাগুলি দর্শন থেকে বিজ্ঞানের সীমানাতে ঢুকে যাবে।

হকিং বাস্তবতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই ত বলে দিলেন-কিন্ত কোন “জ্ঞানের” ভিত্তিতে বললেন? সেই জ্ঞান বৈজ্ঞানিক না দার্শনিক? আমরা দেখলাম সেই জ্ঞান অনেক বেশী দার্শনিক, যত না বৈজ্ঞানিক।

হকিং এর “মডেল” নির্ভর বাস্তবতা দর্শন শাস্ত্রে ৩০০ বছরের পুরানো। বাস্তবতা যে “মন” নির্ভর-এই ধারনা প্রথম আনেন ইম্যানুয়েল কান্ট। হকিং তার জেলি ফিসের যে উদাহরন দিয়েছেন বাস্তবতা কে বোঝাতে-যে বাস্তবতা অভিজ্ঞতা নির্ভর-সেটি প্রথম বলে যান ইম্যানুয়েল কান্ট। প্রায় ৩০০ বছর আগে।

কিন্ত আমরা বিজ্ঞান থেকে কি জানি? মানুষের মনের উদ্ভব অতিনবীন ঘটনা। এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব মানুষের জন্মের অনেক আগে থেকেই ছিল। মডেল টা এম থিওরী না এন থিওরী, তার ওপর নির্ভর করে এই মহাবিশ্বগুলি চলছে না। তত্ত্ব উন্নত হতেই থাকবে, বদলাবে, বাতিল হবে। সুতরাং এই মহাবিশ্বের একটি স্বাধীন অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। সেই জন্যে দর্শন শাস্ত্রে বাস্তবতার অনেক ভাগ আছে । কান্টিয়ান বাস্তবতা বা হকিং যে বাস্তবতার কথা বলেছেন, সেটাকে বলে ফেনোমেনোলজিক্যাল বাস্তবতা। এর বাইরেও দর্শন শাস্ত্রে আরো ৩০ রকমের বাস্তবতা আছে। এবং বাস্তবতার সাথে মন এবং মহাবিশ্বের জটিল সম্পর্কের সমস্যাটি বিজ্ঞানের সীমানাতে পড়ে না।

মার্ক টুইন মারা গেছেন বলে একবার মিথ্যে রটেছিল। উনি সেটা শুনে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুসংবাদটি বড় বেশী রকমের অতিরঞ্জন।

*****************************************************
প্রবন্ধটি লেখার আমার কোন দরকার ছিল না। বাস্তবতা বা রিয়ালিজম নিয়ে সামান্য জ্ঞান থাকলে বা একটু ওয়াকি ঘাঁটলেই বোঝা যেত হকিং এর দর্শন নিয়ে পড়াশোনা মারাত্মক রকমের কম এবং তিনি চাকা পুনরাবিস্কার করেছেন মাত্র। আমি সেটা মুক্তমনাতে লিখতেই, বিশিষ্ট কিছু সববোদ্ধার দল গালাগাল দেওয়া শুরু করল। আরেকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক দাবী করলেন দর্শনের আলোচনাতে নাকি আজকাল বিজ্ঞানীদেরই ডাকা হয়! অবশ্য ভারতে যেকোন লোকের কাছে তার গুরুদেব হচ্ছে সব থেকে বড় দার্শনিক। অনেক হিন্দু বাঙালি বিশ্বাস করে বিবেকানন্দ বা রামকৃষ্ণর মতন দার্শনিক আর কোনদিন জন্মায় নি। আবার অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথের মতন বড় দার্শনিক জন্মায় নি। আরেক বিশিষ্ট বোদ্ধা, দর্শন এবং ধর্মকে এক করে বোঝাতে চাইল বিজ্ঞান যেভাবে ধর্মের শেষ ঘোষনা করেছে, সেই ভাবে দর্শনের শেষ ঘোষনা করবে!

যাইহোক এস্ট্রলজার এবং এস্ট্রনমার যেমন এক না -তেমন ধর্মীয় গুরুদেব বা বিজ্ঞানী বা রবীন্দ্রনাথ -এদের সাথে প্রথাগত শিক্ষিত দার্শনিকদের পার্থক্যটা ততটাই।

আসলে সমস্যা হয়েছে এই, আমাদের দেশে একদম শেষের বেঞ্চের অগা-মগা ছেলেরা দর্শন, ইতিহাস এই সব পড়তে যায়। আমাদের ধারনা জন্মেছে দর্শন হচ্ছে একদম সোজা ব্যাপার-কারন লাস্ট বেঞ্চাররা পড়ে এবং পাশ ও করে! বাস্তব হচ্ছে আমি যত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তার মধ্যে সর্বাধিক কঠিন এবং গভীর হচ্ছে দর্শন। এটি এমন একটি বিষয় যা পড়ে বোঝা যায় না-প্রশ্ন এবং দন্দ্ব তৈরী করে বুঝতে হয়। এবং তারপরেও অধিকাংশ প্রশ্ন এবং দন্দ্ব অমীমাংসিত থাকে। এবং সেটাই দর্শনের আসল শক্তি।