লিখেছেনঃ ভজন সরকার
এই লেখাটা প্রকাশ হইতেও পারে আবার ,নাও হইতে পারে। যদি কোন পত্রিকার সম্পাদক না ছাপেন, আমি তাকে চৌদ্দ শিকের ভেতরে ঢুকাবো না। কারণ, আমি লেইখ্যা মালকড়ি পাই না, ভবিষ্যতে মালকড়ি পাবার তেমন কোন হলুদ বাতিও দেখি না, যা পরে সবুজ হইবো। কিন্তু যারা পত্রিকা সম্পাদনা করেন, সেটা ই-ই হোক আর ঈ-ই হোক, নিদেনপক্ষে ক্ষীণ আশা হয়তো আছে, এটা নিজের পায়ে একদিন দাঁড়াইবো। তাই নিজের পত্রিকার ইজ্জতের কথা ভেবো এটা না ছাপানোরই কথা। তাই বলছিলাম যে, আমার যা অযোগ্যতা সেটা গুণের জন্যে না হইলেও তরিকার জন্য অবশ্যই।
তবে আমার এই লেখাটা কিন্তু গুরুত্বে ও ভারিত্বে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভয় করছিলাম, এটা ছাপার মুখ দেখবো কিনা! কারণ পৃথিবীতে যেটা যত বেশী মূল্যবান, তার মূল্য তত কম। এই যেমন দেশ থ্যাইকা বাইর হওনের সময় কিংবা ঢুকনের সময়ের কথাই ধরেন। যারা দেশ থেকে টাকা পাচার কইরা আমেরিকা-কানাডায় বাড়ি বানায় কিংবা পোলাপান পড়ায়, তারা ভি আই পি। আর যারা মাথার ঘাম পায়ে ফালাইয়া বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়, পারলে দুই টাকার দারোয়ানও তাদের হাইকোর্ট দেখায়। কাষ্টমস, ইমিগ্রেশনের কথা তো বাদই দিলাম। আমার এই কথাটা কিন্তু অতি মূল্যবান, অথচ এর কোন মূল্য আছে কি? তাই বলছিলাম আমার এই মুল্যবান লেখাটা যদি আলোর মুখ দেখে তবে আপনারাও দেখবেন, না হইলে শুধু সম্পাদক দেখবো। এবং তিনিই মনে মনে এর অপরিসীম আবেদনের কথা বুঝতে পারবেন।
তয় আপনেরা প্রশ্ন করতে পারেন, যে লেখা ছাপানোর আশা-ভরসা এক্কেবারে নাই, সে বেগার লেখা লেইখ্যাই বা আপনের এবং পাঠকের সময় নষ্ট করণের কী কারণ? কারণ একটা আছে। সেই কারণটারই এখন বিমলচন্দ্রিকা করে নেই। কথাটা হইবো গৌড়চন্দ্রিকা। কিন্তু আমাদের গৌড় ছোট বেলাতেই হিন্দুস্থানে পগার পার হইয়া গেল। গৌড়ের বান্ধবী চন্দ্রিকার জন্যে থাকলো তার কাকাতো ভাই বিমল। সেই থ্যাইকা আমরা গৌড়চন্দ্রিকাকে বিমলচন্দ্রিকা বলি।
সে বিমলচন্দ্রিকার কথা বলতে গেলে আমাদের বিল্লালের কথা বলতেই হয়। বিল্লাল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ওরফে বুয়েটের শহীদ স্মৃতি হলের তিন নম্বর ব্লকের ৩৩১০ নম্বর রুমে আমার আরেক তালপাতার সেপাই বন্ধু লম্বু মাহবুবের রুমমেট। আমাদের এক বছরের জুনিয়র। তার কয়েক রুম পরেই থাকতো আজকের বিখ্যাত লেখক আনিসুল হক ওরফে মিটুন। মিটুনের কথা বইল্যা আরেক বিপদে পড়লাম কিনা কে জানে! মিটুন যদি এই গল্পটা তার গদ্য-কার্টুনে আগেই ব্যবহার করে থাকে তবে আমার মহা সর্বনাশ !
যা হোক , বিল্লাল মেকা অথ্যাৎ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ছাত্র । মেকা তেমন কঠিন না হইলেও কিছু কাউঠ্যা মাষ্টারের জন্য ছাত্রদের কাছে যম সমতুল্য ভয়াবহ। তাই প্রতি সেমিষ্টার পরীক্ষার সময় নিয়ম করে কিছু ছাত্রের মাথার লোহা লক্কর আউলাইয়া যায় । আমাদের বিল্লালের সেই রোগ। দ্বিতীয় পরীক্ষার আগের রাতে বিল্লাল আর রুমে ফিরে নাই অনেক রাত অবধি। লম্বুদের বুদ্ধি সব সময় একটু কম হয়। যদিও জিরাফের আই কিউ টেষ্ট কেউ করছে বইল্যা আমার জানা নাই । আমাদের লম্বু মাহবুব তাই বিল্লালের এই রোগ আগে আঁচ করতে পারে নাই। ফলে রাত দশটার পরে আমরা সবাই গরু খোঁজা শুরু করলাম বিল্লালের তালাশে। বুয়েটের পরীক্ষার সময় মাথা ঠান্ডা করার একটা উপায়- রোকেয়া হল, সামছুন্নাহার হলের ভগ্নিগণকে দেখিয়া দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো । বিল্লালের খোঁজে সেই দিকেই রওনা হওয়া গেল। তখনও এস এম হলের গেইট বরাবর বুয়েটের ভেতর দিয়া একটা রাস্তা ছিল। পরে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওরফে ঢাবির সূর্যসন্তানদের উৎপাতে সেটা বন্ধ করা হইছে। যাহোক আমাদের বিল্লাল সেই গেইটের সামনে দাঁড়াইয়া রইছে। কারণ, জিজ্ঞাস করতেই বলল, ‘ সন্ধ্যার সময় দেখি এই গেইট টা একদম ফাঁকা পইড়্যা রইছে। বুয়েটের ছাত্র হইয়া বুয়েটকে এই রকম অরক্ষিতভাবে রাখি কি কইরা, আপনেরাই কন ? সেই জন্যে গেইট পাহারা দিতাছি।’
এই লেখাটার প্লট যখন আমার মাথায় আসে, আমি তখন আমেরিকা-কানাডার এক ব্যস্ততম বাংলাদেশী ভাই-বেরাদারদের এলাকায় ১৯৯০ সালের অর্থ্যাৎ বিশ বছরের ঝক্কি-রদ্দি আমেরিকান গাড়ি চালাইয়া যাইতেছিলাম। জায়গাটা জ্যাকসন হাইটসও হইতে পারে, আবার ড্যানফোর্থও হইতে পারে! ঠিক মনে নাই। যা হোক, বাংলাদেশী হালাল গ্রোসারীর সামনেই আট-দশজন মানুষের লাইন। হাতে ব্যানার। আমাদের নেত্রীর কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে। নেত্রী তোমার ভয় নাই, আমরা তোমায় ছাড়ি নাই। অর্ধেক বাংলায়, অর্ধেক ইংরেজীতে লেখা। আমি পাশেই গাড়ি থামাইয়া বিল্লালরে খুঁজতে লাগলাম। জানি বিল্লাল এই নর্থ আমেরিকাতেই আছে। আড়াই দশক পরে বিল্লালের মুখটা ঠিক মনে করতে পারলাম না। কিন্তু এদের মধ্যেই যে বিল্লাল আছে সেটা ঠিকই ঠাউর করা গেল। তা না হইলে আমেরিকা-কানাডায় বইস্যা বাংলাদেশের নেতা নেত্রীদের রক্ষা বিল্লাল ছাড়া আর কে করবো ? অরক্ষিত বাংলাদেশ রক্ষার ভার তো প্রবাসী বিল্লালদের হাতেই !
(2)
ঢাকা শহরের প্রথম শ্রেণীর পত্রিকার প্রথম পাতার সিকি পৃষ্ঠা জুড়ে বিজ্ঞপ্তি। সুসংবাদ, কানাডায় বাংলাদেশ থেকে কৃষক আমদানি। দীর্ঘদিন কানাডায় বসবাসকারী কৃষিকাজসহ সকল কাজে পারদর্শী একমাত্র বাংলাদেশী এজেন্ট। কানাডায় পাড়ি দেবার আগে হাতে-কলমে কানাডার কৃষিকাজের নমুনা অভিজ্ঞতা শেখানো হবে।’ এই সংবাদটা পইড়্যা আমার এক বন্ধুর তো মাথা খারাপ হবার জোগাড়। দশ টাকা মিনিটে ঢাকা থেকে ফোন, ‘ বন্ধু, মাজেজাটা ক তো শুনি।’
আমি এর মাথামুণ্ডু কিছুই জানি না। বাংলাদেশের কোন এক মন্ত্রী নাকি কোন খেয়ালে এই কথা কইছে। তার পর থ্যাইকা দালাল চক্রের ঘুম হারাম। এমনি পারলে কানাডার রাজধানী অটোয়ার পার্লামেন্ট ভবনে কিংবা প্রধানমন্ত্রী ষ্টিফেন হারপারের ডেপুটি বানাইয়া পাবলিক লইয়া আসে কিছু কিছু আদম। তারপর আবার মন্ত্রীর এই কথা। নাচুনী বুড়ির নাচন থামায় সেটা কার সাধ্যি এখন? আমার বন্ধুও মহা উৎসাহী। এর পেছনের কারণ, আর্থিক না হলেও সামাজিক তো বটেই। কানাডা না গেলে নাকি মান-সম্মান আর বাঁচানো যাচ্ছে না। পিতৃকুলের কাছে না হইলেও শ্বশুরকুলের কাছে তো অবশ্যই! আমার এই বন্ধুটির অবস্থা আবার লেজে-গোবরে। গ্রামের পোলা বিয়া করছে টাউনে। তাও আবার বৌয়ের চৌদ্দগুষ্ঠি নাকি থাকে কানাডা আর আমেরিকায়? শ্বশুর বাবাজি বিয়ের আগে বায়োডাটা দেখছিলেন ঠিকই কিন্তু পোলা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ওরফে বুয়েটে পড়লেও একটু যে লাল পিঁয়াজের দোষ আছে সেটা পরীক্ষা করেন নাই। কিংবা করলেও ভাবছেন , একটু আধটু দোষ যৌবনে থাকেই। একটু মার্ক্সবাদী হওয়া, শ্রেণী সংগ্রামের নামে একটু আধটু মহিলা কমরেডগণের সাথে পিটিস-পিটিস তেমন দোষের কিছু না। তা ছাড়া নিজের মেয়েও কি বৃষ্টিধোয়া তুলসী পাতা? আসলে আমার বন্ধুটি যে, মহা ঘাউড়া সেটা শ্বশুর বাবাজি ভুল করছিলেন তখন। অন্তত আমার সাথে দেখা হইলে আমি সেটা বইল্যা দিতাম । সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্লাসনস্তে পৃথিবীব্যাপি গ্লাস নষ্ট হইয়া, ভাইঙ্গা চুইড়্যা খান খান হইয়া গেছে কিন্ত আমার বন্ধুটি দুর্যোধনের ধনুক উঁচাইয়া অপেক্ষায় আছে, আবার একদিন আইবো। আমরা করবো জয় একদিন, নিশ্চয়!!!
সে যাই হোক, বন্ধুর বৌয়ের কথা বার্তায় আত্মীয়-স্বজনের কানাডা থাকার ফুটানি। তারপর যোগ হইছে, টেলিভিশন চ্যানেলের মহা যন্ত্রণা। আশির দশকে নায়ক-নায়িকার বাবা মা ইন্ডিয়া যাইতো কামে -অকামে। বিমান বন্দরের রানওয়েতে আনোয়ার হোসেন যে সেই একখান ভিডিও ধারণ করছিলেন, সেইটা দেখাইয়া বিমানের ভোঁ দৌঁড়। একই চিত্র! বিমান না উড়লে কি হইবো, টেলিভিশনে বিমানের বলাকারা ঠিকই উড়াল মারতো প্রায় রাতেই প্রসংগে অপ্রসংগে। তার কিছুদিন পর আসলো ব্যাঙ্কক – সিংগাপুর যাওনের হিড়িক। নায়িকা নায়ককে ফালাইয়া বাবা-মার সাথে ব্যাঙ্কক -সিংগাপুর চইল্যা গেলো ফুরুৎ কইরা।
এখন নাকি শুরু হইছে কানাডা। সবাই খালি কানাডা যায়। সবাই কানাডা থাকে। কদবানুর সাথে হিরামনের নায়ক কুদ্দুস প্রেম করছে। কদবানুর বাপের পছন্দ না। কদবানুর বিয়া ঠিক হইলো। পোলা কানাডা থাকে। কিংবা নায়কের খালা কানাডা থাকে, তাই বিয়া পিছাইয়া গেছে। দেখা গেলো নায়িকার চাচা টরন্টোতে নায়কের খালার বাসায় ড্যানফোর্থের কাবাব হাউজ থেকে কাবাব লইয়া উপস্থিত।
এইটা যদি মাঝে মাঝে কানাডা- আমেরিকা ঘুইরা যাওয়া আমার নাট্যকার বন্ধু আনিসুল হক মারতো, তবেও কথা আছিল। কানাডা বানান তো দুরে থাক, কানাডা উচ্চারণ করতেও যে নাট্যকার বত্রিশ বার হোঁচট খায়, কানাডা নর্থ আমেরিকায় না, এন্টার্টিকায় সেটাও যারা জানে না, তাদের নাটকেও নায়ক সি এন টাউয়ারের উপরে উঠ্যা লেক ওন্টারিও দেইখ্যা প্রশান্ত মহাসাগর বইল্যা চিক্কুর মারে আর গান গায়। এই হইলো আজকের কানাডা বিষয়ক টেলিভিশন প্যাকেজ নাটকের প্যাকেট। আর আমার বন্ধুটির ঝামেলার সূত্রপাতও সেখানেই।
বন্ধুটির বৌ যখন এক দশকেও বন্ধুকে একপাও নড়াতে পারে নাই তার অবস্থান থ্যাইকা। কৃষক আমদানির কথা শুইন্যা এইবার কই মাছের তেলেই কই মাছ ভাজার ফন্দি আঁটছে। ‘সারাজীবন কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনের নামে মইরা গ্যালা কিন্তু নিজে লোক লজ্জার ভয়ে কৃষক হইলা না। এইবার চলো কানাডা গিয়া কৃষক হও । লোকেও দেখবো না, টাকাও ভাল, আদর্শও ঠিক থাকবো।’ আমার বন্ধুটি আর না করতে পারে নাই। অর্ধাঙ্গীনির যুক্তির কাছে পুরাটাই হার মানতে হইছে। শেষে আমারে ফোন করছে মাজেজা জানার জন্যে।
আমার বন্ধুর আকুল জিজ্ঞাসা,‘ বন্ধ, কৃষিকাজ তো আমার দ্বারা হইবো না, সেটা জানি। আর কি কিছু হইতে পারমু।’আমি বললাম,‘ সে ব্যাপারে তোমারে আমি এক শত ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, তুমি অনেক কিছুই হইতে পারবা। এই ধর আমার কথাই, আমি যেমন লেখক হইছি। আরও অনেকে অনেক কিছুই হইছে। সকলের কথা এক সিটিংয়ে বলা যাবে না বন্ধু। সে সম্ভাবনার কথা অন্য দিন কওন যাইবো।’
টেলিফোনের ওপারে বন্ধুর বুকে পুলিশের মৃদু লাঠি চার্জের মত মৃদু আশার সঞ্চার হইছে বইলা মনে হইলো। ‘তুই কেমন আছিস , বন্ধু ।’আমি বললাম ,‘ ভাল আছি । শরীর চর্চার মধ্যে আছি। দৌঁড়ের মধ্যে আছি ।’বন্ধু আবার খানিকটা ঝাপসা দেখলো মনে হইলো । আমি বললাম ,‘ আর মিনিট খানিক বাকী আছে আমার টেলিফোন কার্ডে। এর ফাঁকে তোকে একটা গল্প বলি ,তবেই কাদাপানির মত সব স্বচ্ছ মনে হইবো ।’
একজন টরন্টোর রাস্তায় হাঁটতেছিলো। হঠাৎ দেখে একটা সাইন বোর্ড। ভেতরে আসুন, বিশ টাকায় বিশ পাউন্ড ওজন কমান। মেদ ভূঁড়ির যন্ত্রণায় অস্থির লোকটা কিছুটা আশার আলো দেখলো। বিশ টাকা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখে, মহা সুন্দরী এক রমণী উত্তেজক পোশাকে দাঁড়িয়ে। কাছে এসে বললো,‘ আমি সামনে দৌঁড়াবো, যদি তুমি আমাকে ধরতে পার তবে আমরা দুজন একত্রে থাকবো। ’ নর্থ আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ রমনীদের কাছে পেতে কার না আশা জাগে? কিন্তু দুর্ভাগ্য, সুন্দরী এত দ্রুত দৌঁড়ায় যে, লোকটার পক্ষে আর তাকে ধরা সম্ভব হলো না। কিন্তু নিরাশ হলো না। পর পর দুই সপ্তাহ সকাল সন্ধ্যে দৌঁড় প্রাকটিস করে আবার গেলো সেইখানে । এই বার ধরবেই। কিন্তু না। এই বার বিরাটাকায় এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক তাকে বললো,‘ তুমি আমার সামনে দৌঁড়াবে আমি যদি তোমাকে ধরতে পারি তবে তুমি আর আমি একত্রে থাকবো।’ ইজ্জতের ভয়ে লোকটা আবার দৌঁড় শুরু করলো। টেলিফোনের ওপারে আমার বন্ধুটি মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার কথা শুনছে। আমি বললাম,‘ যখন কানাডায় আসি তখন সামনে সোনার হরিণ ছিল। ধরবো বলেই দৌঁড়াচ্ছিলাম। এখানে এসেও সেই দৌঁড়ের মধ্যেই আছি। এখন আর সামনে তেমন স্বপ্ন নাই। তবুও দৌঁড়েই আছি পেছনের দু:স্বপ্নের ভয়ে, ইজ্জতের ভয়ে।’
সস্তা টেলিফোন কার্ডের সময় শেষ। টেলিফোন লাইনটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো হঠাৎ।
(3)
আবারও আমার সেই বন্ধুটির টেলিফোন, কানাডায় তার ভাগ্যে কি আছে তা জানার জন্যে অতি উৎসাহী। ব্যাকুল বন্ধুর আকুল জিজ্ঞাসা,‘‘ তুই না সেদিন বললি আমি অনেক কিছুই হইতে পারবো। সে সম্বন্ধে কিছু বল না শুনি ?’’আমার এই মহাঘাউরা বন্ধুটি যে কিনা সুক্ষ্ণ যুক্তির নিক্তিতে পরখ করে তবেই সব কিছু বিশ্বাস করতো একদিন , সে আমার এই ব্যঙ্গোক্তিটিকে বিশ্বাস করছে দেইখ্যা আমি এক তীব্র দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বললাম ,‘ পারবি বন্ধু, সবই হইতে পারবি। এই দেখ না আমি লেখক হইছি। অনেকে কবি হইছে । আর আমার মত অনেকেই বছরে এক হালি করে বই ছাপাইয়া ফেলতাছে। আর তোর শ্বশুর বাড়ি যখন সংবাদপত্র অফিসের আশে পাশে, তখন সাংবাদিকতার বাতাস একটু হইলেও গায়ে লাগছে। ওই বাতাসটারে সুগন্ধি মাখাইয়া নিয়া আসবি। এখানে এসেই সাংবাদিক না হইলে, পত্রিকার সম্পাদক হইয়া যাবি।’’
আমার মহাযুক্তিবাদী বন্ধুটি ‘ধ্যুৎ তাই কি হয় ’ বললেও মনে হইলো কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখলো। কণ্ঠে একটা গদগদ ভাব নিয়া কইলো,‘ তুই না এক সময় কইছোস যে, তুই ই- ম্যাগাজিনে লিখস। ওইটা আবার কি?’
’‘ ই-ই হউক, আর ঈ-ই হোক, সেইট্যা তোর বড় বিষয় না। বিষয়টা হইলো তুই কি হইছোস সেইটা।’, আমি কইলাম।
দরিদ্র মানুষের পক্ষে আজীবন লড়ে যাওয়া আমার বন্ধুটি নিজে দরিদ্র হওয়ার ভয়ে মহা ভাবনায় পড়ছে বুঝতে পারলাম।
বললাম,‘ তুই তো পেটের চিন্তা করতাছিস, পেট চালাইবো মামু। মামু বাড়ি থাকবি। খাওন পড়ন সব পাবি। হাতে অফুরন্ত অবসর। খালি প্রতিভা বিকাশে ব্যস্ত থাকবি। আর বৌয়ের কথা চিন্তা করণের কোন দরকার নাই। আত্মীয় স্বজন যখন আছে পর-নিন্দা পরচর্চা কইরা সময় মহা আমুদে কেটে যাব। আর ভাবীর তো একটু গানবাজনার অভ্যেসও ছিলো। উনার জন্যে কানাডা তো অতি উর্ব্বর ভূমি। গান গাইতে গাইতে কাহিল হইবো কিন্তু শ্রোতারা কইবো‘ওয়ান মোর’ । আর বছর বছর দেশে গিয়া একখানা সিডি বাইর করতে পারবো। ফলটা কি দাঁড়াইলো? প্রবাস জীবনের এক বছরের মধ্যেই সৃষ্টিশীলতায় জ্বলজ্বলে এক তারকা দম্পতি।
’’আজীবন রাজনীতি করা আমার বন্ধুটির নিজের এইসব সম্ভাবনার কথা খুউব একটা মনে ধরলো বইল্যা ঠাউওর করা গেল না। আড়ে ঠাড়ে খালি রাজনীতির কথা জিগায়। আমি কইলাম,‘ কানাডার রাজনীতিতে নিজে কতটুকু সুবিধে করতে পারবি সেটা বলা মুস্কিল। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির ‘দাদাভাই’ না হইলেও‘ মিয়াভাই‘ হইতে পারবি সেটা এক শত ভাগ নিশ্চিত।’
’বন্ধুটির পায়ের তলায় একটু কাঁদামাটি পড়ছে বইল্যা মনে হইলো এইবার। খরগোশের মত কান খাড়া কইরা আমার কথা শুনছে। আমি বললাম,‘ তুই তো গাঁয়ের পোলা। বটতলায় যখন কেউ চুল কাটতে বসে, আশে পাশে যে রকম বিজ্ঞ মানুষের ভিড় সেই রকম এখানেও কোন দাওয়াতে কিংবা সমাবেশে যাবি, দেখবি আশে পাশে কত রাজনৈতিক পন্ডিত। বাংলাদেশে হেনো রাজনীতি নাই যে তেনারা করেন নাই। আর হেনো নেতা নাই তেনাদের সাথে খাতির নাই। মনে মনে ভাববি প্রধানমন্ত্রী এই ‘জিনিস’টারে কেনো এতদিন চেনেন নাই, সেই ব্যাপারে তীব্র আফসোস! শুধু একজন হইলে কথা আছিল। এই রকম গন্ডায় গন্ডায়,ডজনে ডজনে পাবি। আর সে তুলনায় তুই তো আসল জিনিস। লেঃজেঃ হোঃমোঃ এরশাদের ঠোলায় তোরে চিনছে, আর এই সব প্রবাসী রাজনীতিবিদেরা তো নস্যি। আমার কেনো জানি মনে হয়, তোর জন্যে এই মাঠটা এখনো খালি পইড়্যা আছে, বন্ধু। কত দিন থাকে সেইটাই কথা। সময় নষ্ট করণ ঠিক হইবো না!’
’বন্ধুটি ‘ইউরেকা ’ বইল্যা প্রকাশ্যে চিৎকার না দিলেও মনে মনে বঙ্কিম উল্লাসে পুলকিত হইছে এইটা সহজেই বোঝন গেলো। আমি তার দ্বিধার ঘরে আরেকটা পেরেক ঠোকার জন্যে বললাম,‘ আরেকটা সম্ভাবনা ছিলো আজ থেকে দশ বছর আগে,আমি যখন আসি তখন । তখন ভাবছিলাম, লোক বাড়বো,সমস্যা বাড়বো,হতাশাও বাড়বো। লোক জন অদৃষ্টে-অদৃশ্যে বিশ্বাসী হইয়া ধর্মকর্ম আকড়াইয়া ধরবো। ফলে ধর্মস্থান বাড়বো হু হু কইরা। তারপর ধর বাঙ্গালী যখন, নানা কুতুবের আগমন,দলাদলি, কলহ বিবাদ তো আছেই। ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও গজাইয়া যাইবো গন্ডায় গন্ডায়। তাই এই লাইনে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল সেইটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু এখন সেই শূন্য স্থানটা পূরণ হইয়া গেছে মনে হয়। আর জীবনের শেষ চিকিৎসার মত শেষ উপদেশ একটা আছে ,সেইটাও বইল্যা ফেলি। আজকেও সময় বেশী নাই। দৌঁড়ের সময় হইয়া গ্যাছে এখনি কাজে যাইতে হইবো।
’বন্ধুটি একটু ধান্ধায় পড়ছে মনে হইলো কাজে যাইতে হইবো শুনে। আমি কইলাম,‘ এখানে সবাই কাজে যায়। ছাত্রজীবনে আকাশ ভাই অর্থ্যাৎ কমরেড অধ্যাপক এম,এম, আকাশের শ্রেনীতত্ত্ব ক্লাশের কথা মনে নাই? কানাডা আইস্যা ভাববি, তখন থিউরি ক্লাশ করছিলাম আর এখন সেইটার প্র্যাকটিক্যাল করতাছি। সেটা মনে না থাকলেও কোন ক্ষতি নাই। মাধ্যমিক পরীক্ষায় শ্রমের মর্যাদা রচনা মুখস্থ কইরা পাশ করছিলি কিন্তু সেইটার ব্যবহারিক পরীক্ষা বাকী ছিলো মনে কইরা কাজ চালাইয়া যাবি।’
এইবার বন্ধুটির ঘাউরামির পুরানো রোগ আবার দেখা দিলো বইল্যা মনে হইলো। হঠাৎ টেলিফোনের ওপার থেকে হতাশা আর ক্ষোভ মিশিয়ে খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষায় বইল্যা উঠলো,‘ এইবার বুজছি। বৌয়ের ইজ্জত বাঁচাইতে গিয়া নিজের ইজ্জত খোয়াইতে হইবো। খ্যাতা পুড়ি তোর কানাডায় যাওয়া। হ্যালায় যুদ্ধেই যামু না।’
টেলিফোন লাইনটা কেটে গিয়ে এক বিরক্তিকর একঘেয়ে শব্দ শ্রবনেন্দ্রিয় বেয়ে হৃদয়ের গভীরে ঢুকে গেলো। তার সাথে যোগ হলো চারদিকের ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। এক ফালি মেঘ কোথা থেকে যেন নেমে আসলো আমার দুই চোখে। এক ফোঁটা জল গাল বেয়ে মুখে পরতেই এক নোনতা বিস্বাদে ছুঁয়ে গেলো মন। এটা কী কান্না না, বৃষ্টি ? সেটাও বোঝা গেলো না। কারণ, আমি এখন বিভূঁই বিদেশে যুদ্ধরত এক সৈনিক। আমার তো ফেরার আর কোন পথ নেই। সময় নেই চোখের জল ফেলবারও। এখন সময় শুধু সামনে যাওয়ার!
ভাল ভাল। চালিয়ে যান দাদা। অনেকদিন পরে একটু মন খুলে একা একা হাসলাম। :rose2:
ধন্যবাদ সবাইকে| এবার থেকে নিয়মিত হবার চেস্টা করবো| লেগে দেখে দেখি কতদিন লগে থাকা যায়?
@ভজন সরকার,
মুক্তমনায় আপনার লেখা আগে পড়েছি। ভালো লেগেছিল। আবার লিখছেন দেখে আনন্দিত হলাম। ভাল থাকুন।
@ইরতিশাদ,
মুক্তমনায় কিছুদিন না লিখলও মুক্তমনা পড়তাম প্রায় নিয়মিতই|তাই আপনার প্রত্যেকটি লেখাই পড়ছি এবং ভাল লেগেছে|ভাল থাকবেন আপনিও|
ব্লগে স্বাগতম দাদা। পুরোনো দিনের মত আবারো জমুক মেলা।
বেশ সাবলীল লেখা।লেখার মাঝে প্রবাস জীবনের কষ্টগুলো টের পেলাম।
অনেকেরই এই অবস্থা হয়
অনেক দিন পর দেখলাম আপনাকে। আপনার লেখার ভঙ্গীটা বরাবরের মতই চমৎকার লাগলো। প্রবাস জীবনের অতি পরিচিত একটা বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সূক্ষ্ম সারকাজমের মধ্য দিয়ে।
কানাডায় কৃষক হয়ে আসা প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমার বাবা প্রায়ই কানাডার মাইলের পর মাইল পড়ে থাকা জমি দেখে হা-হুতাশ করে বলতো, আহারে এদের কত জমি এমনি এমনি পড়ে আছে, আর আমাদের দেশের মানুষ চাষের জন্য জমিই পায় না … 🙂 ।
বিভক্তির সাতকাহন খ্যাত ভজন সরকার তো আপনি?
মুক্ত -মনার পাঠক হিসেবে আমার টিকে যাওয়ার পেছনে তখনকার কয়েকটি লেখা এবং কয়েকজন লেখকের অবদান ছিল। এর মধ্যে বিভক্তির সাতকাহন একটি।
স্বাগতম প্রত্যাবর্তনের জন্য।আশা করি এবারের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হবে।
ভাল লেগেছে আপনার লেখাটি। বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। রসের আবরণে দুঃখবোধের ছোঁয়া।