দেশে ঘুরে এলাম প্রায় দশ বছর পর। আড্ডাবাজ বন্ধু-বান্ধবদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। অনেকে বিয়ে করে আরো বেশী ব্যস্ত। দেখে আসা ওয়ান-টুতে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরাই তখন হর্তাকর্তা। ভাবছিলাম তাদেরকেই চেলা-চামুণ্ডা বানিয়ে ফেলবো। সে আশায়ও গুঁড়েবালি। সামনে সবার এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা। তখন টেস্ট পরীক্ষা চলছিল। শেষ পর্যন্ত দু-চারজনকে পাওয়া গেল- নাই মামার চেয়ে কানামামা হিসাবে।
অনেককে দেখলাম সারাক্ষণ মুখের সামনে বই গুঁজে বসে আছে।
– কিরে এত কি পড়িছ? সারাবছর কিছু পড়িছ নাই নাকি? সিলেবাস নাই? কিছু প্রশ্নের উত্তর নোট দেখে মুখস্ত করলেই তো হয়ে যায়…
– নাহ্‌, তুমি জানো না যে এখন আর মুখস্তের দিন নাই। চিন্তা-ভাবনা করে নিজেরে মত করে…
– সারাক্ষণ তো দেখি বই নিয়েই আছিস; চিন্তা করিস কখন?
– হে হে…

শুনে কিন্তু ভালোই লাগল। দেশের বাইরে এসে কলেজে গিয়ে যখন বোম মারলেও নিজের থেকে এক লাইন বের হচ্ছে না, তখন কিন্তু নিজের দুর্বলতা ঢাকতে প্রথমে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছিলাম। তো দেশেও মুখস্তের দিন শেষ হচ্ছে দেখে ভাবলাম- এবার তাহলে উচ্চ শিক্ষার জন্য আর বিদেশে যেতে হবে না। বিদেশে আমি নিজে এই মুখস্ত বিদ্যা আর নিজ থেকে লেখা- সাধারণ ভাবে দেখলে এছাড়া আর তেমন কোনো বড় পার্থক্য দেখি না। তারপর দেশে যদি মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করা যায়- তার চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে!

এরপর মাথায় এলো- বিজ্ঞানটা সূত্র-তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। তো এটা সব জায়গায় একই হবে। অন্যান্য সৃষ্টিশীল লেখা না হয় নিজের থেকে লেখা হলো; ধর্ম শিক্ষার ব্যাপারে কি হবে? এখানে কি বিচার-বিশ্লেষণের ব্যবস্থা থাকবে, নাকি সেই মুখস্ত বিদ্যা? ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে যদি এই শিক্ষা-ব্যবস্থায় চিন্তাশীল শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তাহলে তাদের প্রথাগত ধর্মীয় চিন্তাভাবনায় কোনো পরিবর্তন আসতে বাধ্য। ধর্মকারীরা তখন কি করবে?

এরপর ভাবনাটা একটু পিছন থেকে শুরু হলো- আমাদের দেশে যাদেরকে অশিক্ষিত বলে গন্য করা হয়, তারা কিভাবে অন্য ভাষায় বর্ণিত ধর্মীয় বিধিবিধান অনুসরণ করেন? এই “অশিক্ষিত” লোকেরাও নামাজ পড়েন; শ্লোক আওড়ান। এটা কিভাবে সম্ভব। বিদেশী ভাষা- উচ্চারণবিধি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।

এবার ধরলাম এই অশিক্ষিত লোকজনের মধ্যে মুক্তচিন্তার প্রভাব পড়েনি। শুধু বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ধর্মাচারণ করা সম্ভব হলে শুধু এদের দিয়েই সেটা সম্ভব। এত প্রশ্নাতীত ভাবে ধর্ম পালন করেও এদের অবস্থাই সবচেয়ে করুণ- ধর্মের কি নির্মম পরিহাস! আর তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা এদের উপরই নিজেদের সুবিধামত ধর্মের কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে।

পরিবর্তন আসতে হয়তো আরো অনেক দিন লাগবে। তবুও শিক্ষাক্ষেত্রে মুখস্ত বিদ্যার জায়গায় সৃষ্টিশীলতাকে প্রাধান্য দেয়া শুরু হয়েছে- এটাই হয়তো একদিন আমাদের দেশে সামগ্রিক ভাবে একটা ‘মাইলফলক’ হিসাবে বিবেচিত হবে। তবে জানতে ইচ্ছে করছে- কোথায়ও অন্ধ-বিশ্বাসীদের মনে কি ‘হায় হায়’ রব ওঠেনি, নাকি তাদের বুঝতে এখনো সময় লাগছে!