ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, মহামারি
বাচবেতো ঢাকা

বিখ্যাত ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবি বলেছিলেন, শহরকে কেউ হত্যা করে না। শহর নিজেই আত্মহননে ধ্বংস হয়ে যায়। আমরা মনে রাখি না সিন্ধু সভ্যতার মহেনজোদাড়ো নগরী ছেড়ে মানুষ কেন চলে গিয়েছিল। রোমান নগরী ধ্বংসের একমাত্র কারণ শুধু ভূমিকম্প নয়, লাগামহীন ভোগ ও স্বেচ্ছাচারও বটে। গত ৪০ বছরের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রক্রিয়ার কারণে সেরকম পরিস্থিতির মধ্যে চলে গেছে ঢাকা। সম্প্র্রতি (২০১০ এর ১০ আগস্ট) আধা ঘন্টা পরপর ভূমিকম্পের ধাক্কা বিশষত ঢাকা শহরের মানুষকে ভূমিকম্পের আতঙ্কের মানসিক রোগিতে পরিণত করেছে। ২০০৮ আগস্ট এর পর্যায় ক্রমিক ১৫/১৬ বার ভূমিকম্প সে খবরটিকে স্পষ্টভাবে জানান দিচ্ছে। আর তাহলো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবমান ঢাকা নগরী। এক রাতের বৃষ্টিতে পানির জমার পরিমাণ আর নিয়মিত যানজট বলে দিচ্ছে ঢাকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষাণাবেক্ষণ কত দূর্বল হয়ে পড়েছে! ঢাকা শহরকে মূলত ভুমিকম্প, ভূমিধস এবং ওয়াসার পানি বাহিত ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে মহামারির আশঙ্কা ঘিরে ফেলেছে। গ্যাস ও ওয়াসার লাইনের মধ্যে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তাতে ঢাকা একটা বিস্ফোরকে রূপান্তরিত হয়ে থাকলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।
৪০০ বছর কেটে যাওয়া ঢাকার ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পকরা বুঝতেই পারছেন না, আগামী ৪০০ বছর নয় সামনের দশ বছরের ভবিষ্যদ্বাণী করাও অসম্ভব। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে ভূমিকম্পের চেয়ে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে ঢাকা শহর শুধু ধ্বংসস্তুপ নয় মহামৃত্যুর নগরীতে পরিণত করবে। এই কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০টি ভূমিকম্পে ঝুকিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ঝুকির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনবহুলতা। অতএব দ্রুত বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা না নিলে এক বেদনাদায়ক উপখ্যানে পরিণত হবে ঢাকা। সম্ভবত ভয়াবহ যানজটের অস্থির পরিস্থিতি থেকে বাচার জন্যই মোবাইল ব্যবহার মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছছে। যা আমাদের শরীরবৃত্তীয় চক্রকেই নষ্ট করে দিয়েছে। এক ধরনের মনোবৈকল্যের দিকে নিয়ে গেছে।
সম্প্রতি ৫টি দেশসহ বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩। ভূমিকম্পন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ইন্দো-বার্মা-হিমালয়ান টেকটোনিক প্লেটের সঞ্চলনের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পন বলয়ে আছে।’ আর প্লেটের ফাটলের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এই তিন অঞ্চলে আরও বড় ধরনের ঝুকির মধ্যে পড়ে গেছে। এদিকে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঢাকার অভ্যন্তর ও চারিপাশ দিয়ে যে খালবিল নদীনালা (৩৪ খাল ও ৭ নদী) রক্তনালীর মতো প্রবাহিত হতো তা সমূলে গত ৪০ বছরে একের এক দখল, স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে ভরাট করে চিহ্নমাত্র মুছে ফেলেছে। ঢাকাকে যে রমনা ছায়া শীতলতা দিয়ে ঘিরে রেখেছিল তাকে ছিন্নভিন্ন করে গড়ে উঠেছে নতুন ঢাকা। কোনো নিয়মকানুনকে তোয়াক্কা করে নি কেউ। নানাভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অব্যহত আছে এবং তা ক্রমশ বাড়ছে। যেমন ১৯৯৮ সালে ডিপ টিউবয়েলের সংখ্যা ছিল ২৩৪ টি। বর্তমানে (২০০৭ সালে) তা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪০০তে। ফলে ভূত্বকের নিচে একটি স্তর ফাঁকা হয়ে গেছে। ফলে ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ৬১.১৮ মিটার বা ১৮৬ ফুট নেমে গেছে। বিএডিসি বা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা থেকে জানা গেছে, গত ১১ বছরেই নেমেছে ৩৫ মিটার এবং প্রতি বছরই তা বাড়ছে। গড়ে প্রায় ৩ মিটার বা ৯ ফুট করে নেমে যাচ্ছে। কারণ ঢাকার সমস্ত মাটি কংক্রিটে ঢেকে যাওয়ায় এ আর পানি শোষণ করতে পারে না বা জমিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

এমন কি ১৯৯৮ সালে দেশে যখন বন্যায় ৮৫ শতাংশ অঞ্চল ডুবে গিয়েছিল তখনও ঢাকার পানির স্তর নামা অব্যহত রেখেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অনেক নিুাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে পলিথিন, প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থে। নদীতেও তা ফেলার কারণে নদীর তল প্লাস্টিকের আবরণে ঢেকে গেছে। ফলে পানি শোষণ করার হার কমিয়ে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. এসএম মাকসুদ কামাল তার এক গবেষণায় জানিয়েছেন, ‘নগরীর পশ্চিম পাশে যেসব আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে, সেখানে মাটির পুরুত্ব ২৫ ফুটের বেশি নয়। আবার নগরীর পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নেমে যাওয়ার ফলে ভূমিধসের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ ফলে স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্প বা ভূমিধসেও ঢাকা শহর দেবে যেতে পারে।
ছবি: এই কংক্রিটের জঙ্গল যেকোনো সময় দেবে যেতে পারে

ঢাকা মহানগর ও আশপাশ এলাকার ভূমির গঠন অস্থিতিশীল এবং ভূ-আলোড়নজনিত। মহানগরের পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি অস্থিতিশীল ভূ-তাত্ত্বিক অঞ্চল। উত্তরে সিলেট অববাহিকা বেশ দ্রুত ভূ-অভ্যন্তরে ঢুকে যাচ্ছে। কয়েক দশকে ওই অঞ্চলটি ১১ মিলিমিটারের মতো দেবে গেছে। পশ্চিমে যমুনা উপত্যকা অঞ্চলটি ক্রমেই ধাক্কা দিচ্ছে। দক্ষিণে বৃহত্তর ঢাকা সাম্প্র্রতিক বছরগুলোয় ১.৮২ মিলিলিটার হারে দেবে যাচ্ছে। এসব অস্থিতিশীল ভূ-তাত্ত্বিক অঞ্চলের প্রভাব মহানগরের ওপর গিয়ে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই। আরও ভয়াবহ তথ্য, নগরীর বেশিরভাগ স্থাপনা নরম মাটি বা বর্জ্য পদার্থের ওপর। মূলত এইসব নিুাঞ্চল, জলাশয়, প্যালিও চ্যানেল যে মাটি দিয়ে ভরাট করে নগরায়ন করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে সেই মাটির গুণাগুণ অত্যন্ত খারাপ। মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের কিছু অংশ, কার্জন হলের কিছূ অংশ বাদ দিয়ে, পুরাতন ক্যান্টনমেন্ট, পুরাতন বিমান বন্দর, পূর্ব বাসাবো এবং আরও কিছু খন্ডিত অংশ বাদে ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে মূলত এইসব নিুাঞ্চল, জলাশয়, প্যালিও চ্যানেল ভরাট করার মাধ্যমে। ভুমিকম্প হলে লালমাটির তুলনায় পলিমাটি ও জলাশয় ও নিুাঞ্চলের মাটিতে অবস্থিত যেকোন অবকাঠামো ধসে পড়বে তাড়াতাড়ি। এ শহরের অবকাঠামো যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্প হলে উদ্ধার কাজ অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর সেই ধরনের দক্ষ মানবশক্তি ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট এর ব্যবস্থা একদম এখানে নেই। একটা বিল্ডিং ধ্বসে পড়লে, আগুণ লেগে গেলে, লঞ্চ ডুবে গেলেও তা উদ্ধারে দিনে পর দিন লাগে। সম্প্রতি ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরির কথা সরকার বলছেন। যে গতিতে এগোচ্ছে তা কাজে লাগার আগেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে ওয়াসা ও স্যুয়ারেজের লাইন জড়াজড়ি করে গিয়েছে। স্যূয়ারেজ বা পয়প্রণালী ও ওয়াসার পানির লাইনে বিভিন্ন জায়গায় লিকেজ বা ছিদ্র থাকার কারণে মানুষের পরিত্যাগ করা মলমূত্রের সঙ্গে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি প্রতিটি বাসাবাড়ীতে মাঝে মধ্যে ঢুকে পড়ছে। বর্তমানে আমরা যে মাছগুলো খাই সেগুলোর বেশিরভাগের পেটে থাকে নীলাভ সবুজ শৈবাল। আর এই শৈবালে থাকে কনিফার্ম নামের ব্যাকটেরিয়া। মাঝে মাঝে যে তাপদাহ শুরু হয় তাতে এই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় এবং প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এরফলে কখনো কখনো কলেরা, রক্ত আমশা, পেটের পীড়াবাহিত রোগ – যেমন ডাইরিয়া, হেপাটাইটিস ‘এ’, টাইফেড জীবাণু এবং ভাইরাসের কারণে জন্ডিস মারাত্মভাবে মানবজীবনে ওপর আঘাত হানে। পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে যে, এ বছর কলেরা, ডায়রিয়ার হার সর্বোচ্চ বেশি। আমরা কি সব ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে জানি? এছাড়াও ঢাকা শহরে এখন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বসবাস করে। আর ৬৫ লাখ লোক এখানে কাজকর্ম সেরে আবার ফিরে যায়। পয়-প্রণালী নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে মাত্র ২০ লাখ মানুষের। তাহলে বাকী অংশ যায় কোথায়? এ সমস্ত তথ্য ইঙ্গিত দেয় যেকোনো সময় অসনাক্তকরণ ভাইরাস, ব্যকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে, ঘটিয়ে দিতে পারে মহামারির আকারে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন। ফলে আমাদের থেকে বের হওয়া বর্জ্য আর ওয়াশার লাইনগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ বিভৎসমৃত্যুর এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দাড়িয়ে থাকবে প্রাণহীন সুউচ্চ ভবনগুলো।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের মতে, ডাওকি ফল্টে ভূ-কম্পনের পর অতিবাহিত হয়েছে ১১২ বছর, মধুপুর ফল্টে ১২৪ বছর এবং টেকনাফ সাবডাক ফল্টে ২৪৭ বছর। একই জায়গা আবার একটি বড় ধরনের ভুমিকম্প হতে সময় লাগে গড় হিসেবে ১০০ থেকে ৫০০ বছর। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের ভূমিকম্পের দ্বার প্রান্তে। বিখ্যাত হাইড্রোলজিস্ট ড. কাজী মতিনের মতে, অত্যন্ত দেরিতে হলেও অপ্রতুল ভূমিকম্পন ডাটা ও মাটির গুণাগুণ বিবেচনা করে সরকার ১৯৯৭ সালে প্রস্তাবিত বিল্ডিং কোড বিধিমালা আইন পাশ করে ২০০৬ সালে। কিন্তু ভূমিকম্পন ডাটা ও প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে পরবর্তিতে এই বিধিমালা প্রয়োগ করা হয়নি। ভারত প্লেট এবং দেশের পশ্চিম-দক্ষিণ সীমান্ত ঘেষে গেছে বার্মা প্লেটের মাঝে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশেষ করে রাজধানী শহর ঢাকা অত্যন্ত ঝুকির মধ্যে আছে। ফলে রিখটার স্কেলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্পনে (মডিফায়েড মারকারি স্কেলে) হবে ৮-১২ ঢাকা শহরকে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করার জন্য যথেষ্ট।
ঢাকা শহরে যে অবকাঠামোর ওপর দাড়িয়ে আছে তাতে সহসাই পরিবর্তন ঘটানো প্রায় অসম্ভব। অতএব শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন সেক্টরগুলোকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপন না করলে কোনোভাবেই ৪০/৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।
তথ্যসূত্র: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ঐতিহাসিক অৎহড়ষফ ঞড়ুববহনর বলেছিলেন ঈরারষরুধঃরড়হ ফরব ভৎড়স ংঁপরবফ ঘড়ঃ নু সঁৎফবৎ
ডিসকাশর প্রজেক্ট