কুরবানীর সময় সমাগত হলেই মানুষের মধ্যে ধুম পড়ে গরুছাগল কেনার। প্রতিযোগীতা চলে কে কয়টা গরু কোরবানী দেবে, কত বেশী দামের কোরবানী দেবে। মাঝে মধ্যে এটা নিয়ে পত্রিকায়ও কিছু কিছু খবর প্রকাশ করা হয়। বড় বড় করে লেখা হয়- অমুকে অত লক্ষ টাকা দিয়ে একটা কোরবানীর গরু কিনেছে। সাম্প্রতিক বছর সমূহে অবশ্য কোরবানীতে নতুন সংযোজন ঘটেছে। অথবা বলা যায়- বৈচিত্র এসেছে। তা হলো উট কোরবানী করা। উট হলো মরুর দেশের প্রানী। তথা আরব দেশের জন্তু। ইসলামের জন্মও আরব দেশে। তাই পাবলিক মনে এ ধারনা পোষণ করতে পারে যে – উট কোরবানীতে মনে হয় বেশী ছোয়াব। বেশী নাকি কম ছোয়াব তা সঠিক জানা না গেলেও উট কোরবানী দিলে বাড়ীর আশে পাশের লোকজনের মধ্যে যে একটু প্রচার প্রসার হয় তা নিশ্চিত।

কোরবানীর মূল সূত্রপাত একটি ঘটনা থেকে। হযরত ইব্রাহীম কে আল্লাহ পরীক্ষা করার জন্য বলে যে তার সব চাইতে প্রিয় জিনিসটিকে যেন সে কোরবানী দেয়। তার কাছে মনে হয়েছিল তার সন্তান ইসমাইল হলো সব চাইতে প্রিয়। তাই সে ইসমাইলকে আল্লাহর নামে কোরবানী দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ও কোরবানী দেয়। আল্লাহর কি অসীম কুদরত- কোরবানীর পর দেখা যায় ইসমাইল কোরবানী না হয়ে তার স্থলে পড়ে রয়েছে এক দুম্বা (মতান্তরে ভেড়া)। এ ঘটনা থেকেই কুরবানীর সূত্রপাত। মুসলমানরা এ ঘটনা উপলক্ষ্যে প্রতি বছর এ দিনে কুরবানী দেয় অর্থাৎ পশু জবাই দেয়।

কুরানে কুরবানী সম্পর্কে আছে-

মাংস বা রক্ত কোনটাই আল্লাহর কাছে পৌছায় না, পৌছায় তোমার মনের পবিত্র ইচ্ছা। ২২: ৩৭

এর অর্থ আল্লাহ কুরবানীর জন্য মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করেছেন। তবে তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন কুরবানী করার সময় যে পবিত্র ইচ্ছা কুরবানী দাতার মনে জাগ্রত হয় শুধুমাত্র সেটাই আল্লাহর সকাশে যায়। কিন্তু বিষয়টা আসলে কি তাই ?

এ বিষয়ে বাংলার সক্রেটিস আরজ আলী মাতুব্বর বেশ দারুন কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন- আল্লাহ ইব্রাহীমের কাছে তার সবচাইতে প্রিয় বস্তুর উৎসর্গের আদেশ দিয়েছিলেন। ইব্রাহীমের কাছে সবচাইতে প্রিয় বস্তু তার ছেলে ইব্রাহীম না হয়ে তার নিজ প্রান কেন হলো না। কথাটায় বেশ যুক্তি আছে আর অর্থবহ। আসলেই তো , মানুষ সবচাইতে বেশী ভালবাসে তার নিজকে, তার পর পূত্র, কন্যা, স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই বোন ইত্যাদি। সে অর্থে- নবী ইব্রাহীম কেন নিজেকে কুরবানী না দিয়ে তার ছেলেকে কুরবানী দিলেন এটা যথেষ্ট প্রশ্ন সাপেক্ষ। অনেকে যুক্তি দেয়- ইসমাইল ছিল ইব্রাহীমের বৃদ্ধ বয়েসের পূত্র্ আর তাই তাকেই ইব্রাহীম নিজের চাইতে ভাল বাসতেন। যুক্তি হিসাবে এটা ঠিক শক্ত মনে হয় না। ইব্রাহীম অবশ্যই তার ছেলেকে ভাল বাসতেন কিন্তু তার নিজেকে ভালবাসতেন সবচাইতে বেশী আর সেটাই মানুষের স্বভাব।

আরজ আলী মাতুব্বরের আরও একটা বেশ কৌতুহলীদ্দপক প্রশ্ন। তা হলো -আল্লাহ ইব্রাহীমকে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানী করতে আদেশ দিয়েছিলেন স্বপ্নে, বাস্তবে নয়। মনোবিজ্ঞান, জ্যোতিশাস্ত্র, ধর্ম সহ সকল শাস্ত্র বলে স্বপ্ন হলো রূপক বিশেষ। আর ইব্রাহীমের বেলায় সে রূপকটির অর্থ ছিল তিনি আল্লাহ কে কতটা ভালবাসেন তা পরীক্ষা করা। তিনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছিলেন। পরীক্ষাটা ছিল শুধুমাত্র ইব্রাহীমের জন্য। তা যদি হয় তাহলে তার পদাংক অনুসরন করে বর্তমানে যারা কোরবানীর নামে নির্মম ও নৃশংসভাবে পশু জবাই করে তারা আল্লাহকে এর মাধ্যমে কি ধরনের ভালবাসা দেখায় ? এতে কি আদৌ আল্লাহর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়? বিশেষ করে সে পশুটা যদি হয় কোরবানীর আগের দিন হাট থেকে কেনা ?

আব্রাহামিক ধর্ম বলতে আমরা ইহুদী, খৃষ্টিয়ানিটী ও ইসলামকে বুঝি যাদের মূল উৎস হযরত ইব্রাহীম বা আব্রাহাম। ইব্রাহীমের কোরবানী যদি সার্বজনীন হতো তাহলে সর্বপ্রথমেই ইহুদীদের এর অনুসরন করার কথা। বাইবেলের পুরাতন নিয়মে আমরা দেখি মাঝে মাঝে মুসা নবী বা অন্যান্য নবী তার অনুসারীদের নিয়ে পশু কোরবানী বা বলি দিচ্ছেন কিন্তু সেটা বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে, যেমন- কোন রাজ্য জয় করার পর, অথবা কোন দুর্দিনের সময় দুর্দশা থেকে রক্ষা পেতে। কিন্তু তারা চান্দ্র মাসের সেই নির্দিষ্ট দিনে কোরবানী করে না। অর্থাৎ ইব্রাহীমের বিষয়টা তারা একান্তভাবেই ব্যাক্তিগত হিসাবে বিবেচনা করে রেখেছে। এর পরে যীশু খৃষ্টের মাধ্যমে খৃষ্ট ধর্মের আবির্ভাব। তারাও কোন ইব্রাহীমের পদাংক অনুসরন করে বছরের নির্দিষ্ট দিনে কোরবানী উদযাপন করে না। অথচ এর পরের ধর্ম ইসলামে এসে সেই কোরবানীটাকে একটা প্রথা হিসাবে মোহাম্মদ চালু করে দিলেন যা ইব্রাহীম থেকে উদ্ভুত হলেও স্বয়ং ইব্রাহীম নিজেই কিন্তু পরবর্তীতে আর প্রথা হিসাবে সেটা পালন করে যান নি বা তা পালন করার জন্য বলে যান নি। যে কারনেই তার অনুসারী ইহুদীরা এটা প্রথা হিসাবে প্রতি বছর পালন করত না। খৃষ্টানরাও পালন করে নি।তাই আরজ আলী মাতব্বরের প্রশ্ন- তাহলে কোরবানীর ধর্মীয় ভিত্তি বা বৈধতা কি ?

আরও মজার কথা যেটা আরজ আলী মাতুব্বর বলেছেন তা হলো – আল্লাহ ইব্রাহীমকে পরীক্ষা করতে গিয়ে শুধু নিজের সবচাইতে প্রিয় জিনিসের কোরবানী দিতেই বলেন নি, তাকে ভীষণ অগ্নি কুন্ডে পতিত হয়েও ইমানী পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তাহলে মানুষ কেন কোরবানী প্রথা পালনের মত নিজেদেরকে অগ্নি কুন্ডে নিক্ষেপ করে তাদের ইমানী পরীক্ষা দেয় না প্রতি বছর প্রথা হিসাবে ? তা ছাড়া, ইব্রাহীম তার সবচাইতে প্রিয় বস্তু তার পূত্রকে কোরবানী দিয়ে আল্লার প্রতি তার ভালবাসার পরিচয় দিয়েছিলেন , কিন্তু বর্তমানে যারা কোরবানী দেয় তাদের কাছে সব চাইতে প্রিয় বস্তু কি হাট থেকে কিনে আনা পশু? তবে সব চাইতে মজার কথা যেটা বলেছেন তা হলো – কোরবানীতে পশুটির হয় আত্মত্যাগ আর কোরবানী দাতার হয় সামান্য স্বার্থ ত্যাগ। কারন পশুটি নিজেই কোরবানী হয়ে আত্মত্যাগ করে, যেখানে কোরবানী দাতার সামান্য কিছু অর্থ খরচ হয় মাত্র। খরচের একটা বড় অংশ উসুল হয়ে যায় কারন কোরবানী দাতা পশুটির মাংশ মজা করে উপভোগ করে। তাও আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে অর্থ আসে অবৈধ পন্থায়। এ ধরনের আত্মত্যাগে পশুটি বেহেস্তে যাবে কিনা সে প্রশ্নই আরজ আলী মাতুব্বর রেখেছেন। সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো – সৎ বা অসৎ যে পন্থায়ই অর্থ উপার্জন করে পশু ক্রয় করা হোক না কেন , তাদের আত্মত্যগে তারা কোথায় যাবে এ ব্যপারে কোন ব্যখ্যা কোথাও নেই। কিন্তু ব্যখ্যা থাকাটা জরুরী। তবে বেহেস্তে গবাদি পশুদের কোন স্থান আছে কি না তা কিন্তু কোথাও উল্লেখ নেই।

এখন আরজ আলীর মত আমারও প্রশ্ন কুরবানীর মত একটা নিষ্ঠূর নির্মম হত্যাকান্ড দ্বারা কিভাবে আল্লাহ সন্তুষ্ট হতে পারেন। কুরবান শব্দটি হলো পারস্য শব্দ আর কুরবানী হলো উর্দু শব্দ। আরবী শব্দ হলো উধিয়া যার অর্থ হলো রক্ত উৎসর্গ। তার মানে উধিয়া তথা কুরবানী হলো আল্লাহকে সন্তুষ্টির জন্য জন্তু কে জবাই করা। এখন একটা পশুকে নির্মম নিষ্ঠুর ভাবে জবাই করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয় আর তা দেখে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন বিষয়টা অদ্ভুত লাগে শুনতে। শুধু মুসলমানরাই নয়, হিন্দুরাও তাদের মা কালী/ মনসা বা ঐ ধরনের দেবতা বা দেবীদের নামে পাঠা বলি দেয় আর তাতে নাকি দেবতা বা দেবী সন্তুষ্ট হয়। প্রাচীন সভ্যতা বিশেষ করে আমরা মিশরীয় সভ্যতায় নরবলি দিত। মায়া এজটেক সভ্যতায়ও দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে নরবলি দিত। ভারতে কাপালিক সম্প্রদায় বলে একটা সম্প্রদায় ছিল এক সময় তারা তাদের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে তাদের দেবী ভৈরবীর সামনে নরবলি দিত বলে শোনা যায়। বঙ্কিম চন্দ্রের কপালকুন্ডলা নামক উপন্যাস থেকে আমরা এ কাহিনী জানতে পারি। মুসলমানদের কুরবানীর প্রথা মূলত: নর বলি বা জবাই থেকেই আগত। কারন ইব্রাহিম তো তার পূত্র ইসমাইলকে জবাই করার জন্যই তার গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। আর তিনি মনে করেছিলেন তাতেই আল্লাহ যার পর নাই খুশী হবেন। ভাগ্যক্রমে ইসমাইল জবাই না হয়ে হয়েছিল এক দুম্বা বা ভেড়া। সে সূত্রে বর্তমানে মুসলমানরা পশু জবাই করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নামে। এখন যদি ইসমাইলই জবাই হয়ে যেত তাহলে কি এখন মুসলমানেরা তাদের পূত্র সন্তানকে জবাই করে কুরবানী করত আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে ? মনে হয় এ ভাবে আল্লাহ কে সন্তুষ্ট করার জন্য কাউকে তখন খুজে পাওয়া যেত না। তবে দু একজনকে হয়ত বা পাওয়া যেত যারা তার পূত্র সন্তানকে জবাই করত। যেমন- কয় বছর আগে খবরে পড়েছিলাম বাংলাদেশের কোন এক জায়গায় এক লোক তার শিশু পূত্রকে জবাই করে কোরবানি পালন করেছিল। তাকে পরে উন্মাদ বলে সাব্যাস্ত করা হয়েছিল ও যতদুর মনে পড়ে তাকে ধরে কারাগার বা পাগলা গারদে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টি কোন থেকে সে কি সত্যিই উন্মাদ ছিল? মোটেও না। কারন তার কাছে কুরবানীর অর্থ ছিল আল্লাহকে সব চাইতে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করতে হবে। তার কাছে সবচাইতে প্রিয় জিনিস ছিল তার পূত্র সন্তান যাকে সে কুরবানী দিয়েছিল। গরু ছাগলের হাট থেকে কিনে আনা পশু তার কাছে কোন প্রিয় জিনিস ছিল না। তাই আল্লাহর তো বরং বেশী খুশী হওয়া উচিৎ অন্তত: কুরবানীর মূল নিহিত অর্থ অনুযায়ী। আমাদের অবশ্য জানার উপায় নেই যে আল্লাহ কতটা খুশী হয়েছিলেন , এটা জানতে কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। এখন আমরা কল্পনা করি , বর্তমান যুগে হযরত ইব্রাহীম আগমন করলেন আর স্বপ্নে আল্লাহর আদেশ পেয়ে তিনি তার পূত্র ইসমাইলকে কোরবানী দিলেন। তাহলে কি গতি হবে তার কপালে ? নিশ্চিত ভাবে তাকেও উন্মাদ ভাবা হবে ও ধরে পাগলা গারদ বা শ্রীঘরে পাঠানো হবে। নিজেকে নবী বলে দাবী করলে পার পাওয়া যাবে না। তো একই ঘটনা তিনি প্রায় তিন হাজার বছর আগে করেছিলেন বলে কথিত আছে। তাহলে আজকের দিনে যেটা উন্মাদনার লক্ষন , তিন হাজার বছর আগের সময় হলেও সেটাও তো সেই উন্মাদনার পর্যায়ে পড়ে। আজকের দিনে যেটা খারাপ কাজ তা হাজার লক্ষ কোটি বছর আগেও খারাপ কাজ ছিল আর পরেও খারাপ থাকবে। হাজার বছর আগে হয়ত মানুষ তাকে খারাপ কাজ বলে বিবেচনা করত না, কিন্তু তাই বলে তা ভাল কাজ হয়ে যাবে না। বিশেষ করে নবীদের ব্যপারে তো মোটেই তাকে অবহেলা করা যাবে না। কারন তারা যা করতেন , বলতেন, আচরন করতেন তাই তার অনুসারীরা অনুসরন করত। আর তাদের আচার আচরন কথা বার্তা ছিল স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত। সুতরাং তারা এমন কাজ করতে পারেন না যা হাজার বছর পরে সমালোচনার যোগ্য হতে পারে। যাহোক, সেই উন্মাদনাকে পরম পবিত্র কাজ মনে করে এখনো কিছু লোক তা অনুসরন করে যাচ্ছে আর নির্মম নিষ্ঠূর ভাবে পশু জবাই করছে। তাহলে যারা এ প্রথা অনুসরন করছে তারাও কি একই শ্রেনী তথা উন্মাদের পর্যায় ভুক্ত নয়?

কেন পশু জবাইকে নির্মম বা নিষ্ঠূর বলা হচ্ছে? কারন হলো পশুকে তিনটা পোচে জবাই করতে হবে। তো একটা জন্তুকে যখন পর পর তিনটা পোচ দেয়া হবে ধারালো ছুরি দিয়ে নিশ্চয়ই পশুটি খুব আরাম পাবে না , বরং ফিনকি দিয়ে যখন রক্ত বেরোতে থাকবে তখন সে প্রচন্ড কষ্ট পাবে। প্রচন্ড কষ্ট যে সে পাচ্ছে তা কিন্তু বোঝা যায় পশুটা ছট ফট করা দেখে। কষ্ট না পেলে নিশ্চয়ই ওরকম মরন পন ছট ফট করত না। তবে তারা যাতে বেশী ছট ফট না করতে পারে এজন্য গরুর চার পা কে বেশ শক্ত করে বাধা হয়। হিন্দুরা বরং আমার কাছে মনে হয় বেশ ভাল কাজ করে। এক কোপে মামলা শেষ । পশু কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার দেহ থেকে ধড় আলাদা হয়ে যায়। যেহেতু তার মাথা আলাদা হয়ে যায় সেহেতু পশুটার দেহ যতই ছট ফট করুক তাতে তার কোন কষ্ট বোধ হয় না কারন কষ্ট বোধের কাজটাই তো করে মাথা বা মস্তিষ্ক। কিন্তু জবাই করার সময়ে ঠিক তার উল্টোটি ঘটে। তিন পোচ দিয়ে তো জবাই করা হয় তার পর তার স্পাইনাল কর্ড না কেটে মাথাটা দেহের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয় যার অর্থ তার নার্ভ সিস্টেম পুরোই ক্রিয়াশীল থাকে। যে কারনে পশুটা দীর্ঘক্ষন কষ্ট পায়। ঠিক একারনেই আমার কাছে বিষয়টাকে নির্মম মনে হয়। তবে এ ধরনের নির্মম হত্যাকান্ডের সমর্থনে পন্ডিতদের যুক্তি দিতে বিন্দু মাত্র বিলম্ব হয় না। যেমন টিভির এক অনুষ্ঠানে দেখলাম জাকির নায়েক এ ব্যপারে খুব বিজ্ঞের সাথে যুক্তি প্রদর্শন করছে। তার বক্তব্য হলো- খুব ধারালো ছুরি দিয়ে যেহেতু পোচ দেয়া হয় তাই পশু ব্যথা পায় না। কিন্তু যতই ধারালো হোক, পর পর তিনটা পোচ দিলে ব্যথা পাবে না এটা একমাত্র আহাম্মক ছাড়া আর কে বলবে ? কিন্তু সেটাও ব্যথা পাওয়ার মূল কারন না। আমরা জানি ধারালো কিছু দিয়ে কোথাও কেটে গেলে প্রথমে আমরা টের পাই না। কিছু পরে টের পাই। পশুর ক্ষেত্রেও ঠিক সেরকম ঘটতে পারে ধরে নিলাম । কিন্তু স্পাইনাল কর্ড না কাটাতে তার নার্ভ সিস্টেম যে পুরোটাই ক্রিয়াশীল থাকে আর তাতে যে প্রচন্ড যন্ত্রনা পেতে থাকে পশুটা এর বিরুদ্ধে যু্ক্তিটা কি ? কিন্তু এ ক্ষেত্রেও জাকির মিয়ার যুক্তির অভাব নেই। তার বক্তব্য তখন আর পশুটার যন্ত্রনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। অর্থাৎ যন্ত্রনা তখন তার কাছে মূল বিষয় হয় না।তার বক্তব্য হলো যেহেতু নার্ভ সিস্টেম সক্রিয় থাকে তাই হৃৎপিন্ড চালু থাকে দীর্ঘক্ষন, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে পশুটার দেহ থেকে রক্ত বের হয়ে যেতে পারে যে রক্তে নাকি বিপুল পরিমান রোগ জীবানু ইত্যাদি থাকে আর তার ফলে যে মাংস পাওয়া যায় তা হলো স্বাস্থসম্মত। কি চমৎকার যুক্তি! তার মানে দাড়াচ্ছে কোরবানীটা হলো প্রকারান্তরে স্বাস্থসম্মত মাংস পাওয়ার উপায় মাত্র, ঐসব আল্লার উদ্দেশ্যে উৎসর্গের ব্যপারটা এখানে নামকা ওয়াস্তে বা বোগাস। কিন্তু আসলেই কি জাকির মিয়ার বক্তব্য ঠিক? মানুষ মাংস খায় মুলত দুটি কারনে। এক – প্রোটিন ও দুই-রক্তের অতি প্রয়োজনীয় আয়রন পাওয়ার জন্য। যে কারনে ডাক্তাররা রক্তশূন্যতার রুগীকে লাল মাংস খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। লাল মাংসের মধ্যে রক্ত জমে থাকে পেশীতে।পশুটির রক্তে থাকে প্রচুর পরিমান আয়রন। এখন যদি অধিকাংশ রক্ত পশুটির দেহ থেকে বের হয়ে যায় তাহলে তা দিয়ে আয়রনের চাহিদা মিটবে না। আর পশুর মাংস মানুষ বন্য জন্তুর মত কাঁচা খায় না যে মাংসের ভিতরে যে রক্ত থেকে যাবে তা খেলে মানুষ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়বে। মাংসের সাথে পশুর শরীরের রক্ত যে কত জরুরী তা বোঝা যায় বন্য হিংস্র জন্তুর খাওয়ার অভ্যাস থেকে। বাঘ বা সিংহ যখন কোন একটা পশু শিকার করে , প্রথমেই সে চেটে চেটে রক্ত খায়। তা খায় কারন তা নিজের শরীরের রক্তের জন্য ভীষণ জরুরী। আফ্রিকার জঙ্গলে যে সব আদিম প্রজাতির মানুষ এখনও পশু শিকার করে খায় তারা শিকার করা পশুর রক্ত হাত দিয়ে আজলা করে প্রথমেই পান করে। জাকির মিয়া আর একটি যুক্তি দেখাল তা হলো মাংসে রক্ত থাকলে তা দীর্ঘদিন সংরক্ষন করে রাখা যায় না। কথাটা হয়ত ঠিক , কিন্তু মানুষ কুরবানী করে কি দীর্ঘদিন তার মাংস রেখে খাওয়ার জন্য, নাকি তা ফকির মিসকিনদেরকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য? মোট মাংসের তিন ভাগের একভাগ কোরবানীদাতা রাখতে পারে। যদি বড় ধরনের গরু হয় তাতেও হয়ত বা অনেক মাংস রয়ে যেতে পারে। কিন্তু তা হলেও মাংস সংরক্ষনের তো এখন সু ব্যবস্থা আছে , যেমন ডিপ ফ্রিজ। আর যখন এ ব্যবস্থা ছিল না তখন তো রক্তশূন্য মাংসও কয়েক ঘন্টার বেশী রাখা যেতে না। মানুষ তখন মাংস খেত বেশ কয় দিন আগুনে জ্বাল দিয়ে। সুতরাং জাকির মিয়ার যুক্তি কাজে লাগতে পারে সেই হযরত ইব্রাহীমের কালে বা চৌদ্দ শ বছর আগের আরবদের যুগে যখন ডিপ ফ্রিজ ছিল না। বর্তমান কালের জন্য নয়।

মানুষ তার আমিষ ও আয়রনের প্রয়োজনে মাংস খাবে এটাই স্বাভাবিক। আর সেটা দরকারও। কিন্তু মানুষ তো হলো সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাকলুকাত। সে কেন একটা পশুকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে হত্যা করে তার মাংস খাবে । মানুষ তো বন জঙ্গলের হিংস্র পশু নয়। তার আচরন তো হিংস্র পশুর মত হতে পারে না। আর সেটাই যদি হয় তাহলে তার সাথে আর হিংস্র পশুর সাথে কি তফাৎ থাকল ? তাও আবার সেটাকে কিছু লোক ধর্মীয় প্রথা হিসাবে পালন করবে কোন রকম যুক্তি সঙ্গত কারন ছাড়া ? এভাবে পশুকে নৃশংস ভাবে হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে মানুষকে যেন হিংস্র পশু করে রাখারই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বহন করে। এদিক দিয়ে হিন্দুরা আরেক কাঠি সরেস। তারা বিশেষ কিছু পুজায় এক সাথে শত শত হাজার হাজার পাঠা বলি দেয়। রক্তের বন্যা বয়ে যায় পুজার স্থানের আশপাশ । যারা সেখানে যায় তাদের শরীর হয়ে যায় রক্তে মাখা মাখি। বড় বিভৎস লাগে দেখতে। কিন্তু যারা এ কাজটা করে তাদের কাছে এটা কোন ব্যপার না, একটা পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূন্য অর্জনের উপায়। এটা যে একটা প্রচন্ড নির্মম নিষ্ঠূর হত্যাযজ্ঞ তা তারা একবারও ভাবে না। তবে ভারতের সব যায়গাতে এ প্রথা নেই। শুধুমাত্র পশ্চিম বঙ্গেই এর আধিক্য। তার মানে অধিকাংশ হিন্দু এ পশু বলি প্রথা পালন করে না। তাই সব হিন্দুকে এর জন্য দায়ী বা দোষী করা চলে না। পক্ষান্তরে প্রায় সব মুসলমান সামর্থ থাকলে সে কুরবানী দিবে সুন্না পালন করার নামে।

কিছু লোক যখন প্রকাশ্যে বার বার পোচ দিয়ে পশু জবাই করবে বা বড় রাম দা হাতে নিয়ে এক কোপে পশুর মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দেয় তখন তা মানুষের মনে একটা প্রভাব বিস্তার করে। কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া বাকী মানুষ এটাকে একটা অতি পবিত্র কাজ বলে মনে করে আর একই সাথে এ ধরনের হত্যাকে খুব সাধারন মানের ঘটনা হিসাবে ধরে নেয়। ছোট ছোট শিশুরা দেখে কেমন ভাবে ছুরি দিয়ে গরু ছাগল জবাই করা হচ্ছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে বেরুচ্ছে। এর ফলে এরা এক ধরনের বিকৃত মানসিকার শিকার হয়। সেটা হলো- হত্যা জখম এসবকে এরা আর অতটা খারাপ কাজ ভাবতে শেখে না। মনে করতে শেখে সাধারন ঘটনা। এমন কি তারা যখন বড় হয় তখন নিজেরাও সময়ে এসব কাজ করতে পিছ পা হয় না। বিষয়টা আসলেই যে তাই তা বোঝা যায় দেশে মাত্রা ছাড়া খুন খারাবির ঘটনায়। মাঝে মাঝে এমনও দেখা যায় – স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা তাদের সহপাঠিদের খুন করছে অবলীলায় অকাতরে। খুন করার এ ধরনের মানসিকতা তারা সর্বপ্রথম অর্জন করে কুরবানীর নামে এ ধরনের প্রকাশ্য পশু হত্যা থেকে। অবশ্য এটাই একমাত্র কারন নয়। বর্তমানে টিভিতে যে অসংখ্য চ্যনেল আছে তাতে যেসব ফিল্ম দেখা যায় তার অধিকাংশই ভর্তি থাকে খুন জখম যৌনতা ইত্যাদিতে যা থেকেও মানুষ এ মানসিকতা অর্জন করে। যারা পশু জবাই করে বা বলি দেয় তাদের কাছে এটা একটা ক্রীড়া ছাড়া আর কিছু নয়। ফল হয় ভয়াবহ। পরবর্তীতে ধর্মের নামে বা অন্য যে কোন নামে মানুষ জবাই করতে বা বলি দিতে তাদের হাত কাপে না । ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠির লোকজনরা যে অকাতরে মানুষ খুন করতে পারে , তার মূল এখানেই নিহিত। পশু হত্যা করা আর মানুষ হত্যা করা দুটোকেই সমান মনে করে। এসব কুরবানী বা বলি প্রথা থেকে তারা হাত পাকায়। তখন খুন খারাবিটা তাদের কাছে একটা ক্রীড়া মনে হয়। যে ক্রীড়ায় তারা মনে করে আল্লাহ বা দেব/দেবীকে সন্তুষ্ট করা যাবে ।

ইহুদী ও খৃষ্টানরা কুরবানীর প্রথা পালন না করলেও মুসলমানরা কেন এটা চালু করল এটার কারন খুজে বের করা কঠিন কিছু নয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে , কুরবানীর প্রচলন মোহাম্মদ মদিনায় যাওয়ার আগে করেন নি। সেই নবী মোহাম্মদের আমলে মদিনার অধিকাংশ লোক ছিল হত দরিদ্র। তারা সব সময় ভাল খাবার পেত না। অতি গরীব লোক জন নিয়মিত মাংস খেতে পেত না। মুহাম্মদ মদিনায় আসার পর যখন মদিনাবাসীরা তার অনুসারী হয়ে গেল তখন মোহাম্মদের মনে হলো মদিনার এসব হত দরিদ্র লোকদেরকে কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া দরকার। তা না হলে তারা তার অনুসারী থাকবে কেন? তাই কোরবানীর নামে পশু জবাই দেয়ার একটা প্রথা চালু করা জরুরী হয়ে পড়ল যাতে এ উপলক্ষে মদিনার গরীব দু:খীরা ভাল মতো মাংস খেতে পারে। উছিলা হিসাবে ইব্রাহীমের কাহিনী তো আছেই , তাই কোন অসুবিধা নেই। মক্কাতে থাকতে তিনি ঈদ-উল-আজহা যাতে পশু কোরবানী দেয়া হয় তা কখনো উদযাপন করেন নি। কারন মক্কার লোকরা অতটা হত দরিদ্র ছিল না। আর তাই তারা দান খয়রাতের মাংস খাওয়ার জন্য লালায়িত ছিল না। তার নবুয়তের পর দশ দশটি বছর মক্কাতে কাটানোর পরও ,অন্য অনেক কিছুর চেষ্টা মোহাম্মদ মক্কায় করেছেন, কিন্তু কুরবানী করার চিন্তা কখনো করেন নি। সত্যিই যদি কুরবানী পালন করানোর ইচ্ছা আল্লাহর থাকত তাহলে মক্কাতেই সে জন্য নীচের আয়াত নাজিল করতে পারতেন , কিন্তু তা তিনি করেন নি। কারন মক্কায় কোরবানীর মাংস খাওয়ার লোভ দেখিয়ে নিজ দলে ভেড়ানোর মত পরিবেশ ছিল না।

তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও ওমরা পরিপূর্নভাবে পালন কর। যদি তোমরা বাধা প্রাপ্ত হও তাহলে কোরবানীর জন্য যা কিছু সহজলভ্য তাই তোমাদের ওপর ধার্য্য। আর তোমরা ততক্ষন পর্যন্ত মাথা মুন্ডন করবে না যতক্ষন পর্যন্ত তোমাদের কোরবানী যথাস্থানে পৌছবে। যারা তোমাদের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়বে বা মাথায় যদি কোন তাহলে তার পরিবর্তে রোজা করবে বা খয়রাত দেবে কিংবা কোরবানী দেবে। আর তোমাদের মধ্যে যারা হজ্জ ও ওমরা একই সাথে পালন করতে চাও তাহলে যা কিছু সহজলভ্য তা দিয়ে কোরবানী করাই তার ওপর কর্তব্য। বস্তুত যারা কোরবানীর পশু পাবে না তারা হজ্জের দিনগুলোতে রোজা রাখবে তিনটি আর সাতটি ফিরে যাবার পর। এভাবে দশটি রোজা পূর্ন হয়ে যাবে। ০২: ১৯৬

আয়াতটি মদিনায় অবতীর্ণ আর এটাই হলো কুরবানীর সূচনার প্রথম আল্লাহর বানী। আয়াতটিতে সূক্ষ্মভাবে গরিব ও ধনী উভয়ের জন্য সুবিধা আছে। যারা ধনী তারা কোরবানী দেবে । যদি কোন অনিবার্য কারন ঘটে যাতে কোরবানী দেয়া যাবে না তাহলে দান খয়রাত করবে আর যারা গরীব পশু জোগাড় করতে পারবে না তাদের জন্য রোজা রাখলেই চলবে। ধনীদের কুরবানী করতে উৎসাহ দেয়ার জন্য মোহাম্মদ দারুন লোভও দেখিয়েছেন। যেমন-

হযরত জাইদ বিন আকরাম হতে বর্নিত-নবীর সাহাবীরা তার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন- হে রসুল, কোরবানী কি ? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের পথ। তারা আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন- কিন্তু তাতে আমাদের কি লাভ ? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- প্রতিটি লোমের জন্য তোমাদের পুরস্কার আছে। তারা জিজ্ঞেস করলেন- উলের জন্য ? তিনি বললেন- প্রতিটি লোমের (কুরবানীর পশুর গায়ের) জন্য তোমাদের জন্য পুরস্কার আছে । -আহমেদ, ইবনে মাজা

কুরবানী করা পশুর প্রতিটি লোমের জন্য আল্লাহ কুরবানী দাতাকে পুরস্কৃত করবেন। তাহলে তার ধনী সাহাবীরা কুরবানী দেবে না কেন ? এর ফলে ধনীরা পশু কুরবানী দিতে বেশী উৎসাহী হবে, বেশী করে পশু কুরবানী দেবে, আর গরীব ফকির মিশকিন বেশী বেশী গোস্ত খেতে পারবে। সুতরাং ধনী ও গরীব দু দলেরই লাভ ও দুদলই খুশী। মানুষকে সম্মোহিত করার এর চাইতে ভাল রাস্তা আর আছে ?

কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন বা সমস্যা উত্থাপিত হতে পারে। তা হলো যারা গরীব ও কুরবানী দেয়ার সামর্থ নেই তাদেরকে বলা হয়েছে রোজা রাখতে আর তা হলে তারা কুরবানী দাতাদের সমান পুরস্কার পাবে। এখন সব পশুর সাইজ এক নয় তাই তাদের গায়ে লোমের সংখ্যারও বিরাট তফাত আছে। ছাগল বা ভেড়ার চাইতে গরুর গায়ে লোম বেশী, আবার গরুর চাইতে উটের গায়ে লোম বেশী। এছাড়াও কেউ একটি, কেউ একাধিক পশু কুরবানী দিয়ে থাকে। তার মানে যে একটি ছাগল কুরবানী দিবে তার চাইতে যে একটা উট বা গরু কুরবানী দিবে সে বেশী পুরস্কার পাবে। আবার যারা বহুসংখ্যক পশু কুরবানী দিবে তারা আরও বেশী পুরস্কার পাবে। এতে করে যারা কুরবানী দিতে সমর্থ হলো তাদের পুরস্কারের পরিমান হিসাব করা সম্ভব। কিন্তু যারা গরীব কুরবানী দিতে পারল না , শুধুমাত্র আল্লাহর বিধান মত নির্ধারিত দিন সমূহের জন্য রোজা রাখল, তাদের পুরস্কার কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে ? তারা কি একটা ছাগল নাকি একটা গরু নাকি একটা উটের লোমের সংখ্যার সমান পুরস্কার পাবে তা কিন্তু কোথাও পরিস্কার করে বলা হয়নি। তবে আমি জানি ইসলামী পন্ডিতদের কাছে এর উত্তর খুবই সোজা। আমার মনে হয় অধিকাংশ মুসলমানেরও এর উত্তর জানা আছে। আর তা হলো – এর উত্তর একমাত্র আল্লাহ মালিকই জানেন। সব কিছু জানার ক্ষমতা বা অধিকার মানুষের নাই। সমস্যার এখানেই শেষ নয়। কোরানে বলা হয়েছে- মাংস বা রক্ত কোনটাই আল্লাহর কাছে পৌছায় না, পৌছায় তোমার মনের পবিত্র ইচ্ছা। ২২: ৩৭ , তার মানে মনের পবিত্র ইচ্ছাই কুরবানীর অন্তর্নিহিত বিষয়। সে ক্ষেত্রে – যে বেশী ধনী ( ধরা যাক সৎ পথেই ধনী হয়েছে) সে কয়েক ডজন গরু একত্রে কুরবানী দিল, আর যে সাধারন মানের মধ্যবিত্ত সে মাত্র একটি ছোট ছাগল কোরবানী দিল এবং আরও ধরা যাক – দুজনেরই মনের পবিত্র ইচ্ছা সমান তাহলে পুরস্কার কে বেশী পাবে ? বিধি মোতাবেক ধনী ব্যাক্তিটির পাওয়ার কথা। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে আল্লাহ একজনকে গরীব আর একজন কে ধনী করে দুনিয়াতে পাঠালেন কেন ? বলা হয়- যাদেরকে গরীব ঘরে জন্ম গ্রহন করানো হয় তাদেরকে আল্লাহ পরীক্ষা করেন। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে আল্লাহর এহেন পরীক্ষার কারনে কেউ বেশী সংখ্যক পশু কুরবানী দিয়ে বেশী পুরস্কার নিয়ে নিচ্ছে আর কেউ বা একটা গরুর সাত ভাগের এক ভাগ অংশীদার হয়ে কুরবানী দিয়ে অতি সামান্য পুরস্কার পাচ্ছে। এটা তো ন্যয় বিচারের উদাহরন হলো না। অথচ আল্লাহ পরম ন্যয় বিচারক। আমি জানি এ সমস্যারও সমাধান হলো- আল্লাহই ভাল জানেন এর সমাধান কি হবে।

সাহল বিন বক্কর বর্নিত- আমি আনাস থেকে শুনেছি – নবী সাতটা উট নিজের হাতে জবাই করেছিলেন। ঈদ উল আজহার দিনে তিনি দুইটা ভেড়া জবাই করেছিলেন যারা ছিল দুই শিং ওয়ালা এবং যাদের গায়ের রং ছিল সাদা ও কাল। সহী বুখারী, বই- ২, ভলূম-২৬, হাদিস-৭৭০

উপরের হাদিস থেকে দেখা যাচ্ছে- আল্লাহর নবী মোহাম্মদ নিজে স্বহস্তে পশু জবাই করতেন। তার মানে প্রানী হত্যা করতে তার হাত কাঁপত না। হয়ত তিনি যখন পশুটির গলায় ছুরির প্রথম পোচ দিতেন আর তাতে পশুটি ছট ফট করতে থাকলে তিনি উল্লাসিত হয়ে উঠতেন এই ভেবে যে আল্লাহর নামে জবাই করাতে পশুটি আনন্দে ছট ফট করছে। কারন একটু পরেই তার রুহ বেহেস্তে দাখিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ মোহাম্মদ নিজে নির্মম নিষ্ঠুর আচরন করে তা তার অনুসারীদেরকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তার নিষ্ঠূর আচরনের বড় দলিল উপরোক্ত হাদিস। তিনি নিজ হাতে পর পর সাত সাতটি উট জবাই করেছেন প্রকাশ্যে সবার সামনে। একমাত্র পেশাদার কসাই ছাড়া এ ধরনের কাজ আর কে করতে পারে ?

কোরবানী করারও নিয়ম আছে। তা হলো সরাসরি পশুটির চোখের দিকে তাকিয়ে ছুরিতে পোচ দিতে হবে। কি দারুন বিধান! তার মানে যখন পশুটি মরন যন্ত্রনায় ছট ফট করতে থাকবে, তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে থাকবে, তখন তা তারিয়ে তারিয়ে দেখে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠতে হবে এই ভেবে যে আল্লাহ এহেন কাজের জন্য অপরিসীম খুশী হয়ে পড়েছেন। আরও বিধান আছে। কুরবানী যথার্থ হতে হলে বাড়ীতে পোষা সবচাইতে প্রিয় পশুটাকে জবাই করাই উত্তম। গ্রামে অনেকেই আছে যাদের বাড়ীতে হয়ত একটা গরু বা ছাগল আছে যেটার প্রতি একটু বেশী ভালবাসা বা মায়া পড়ে গেছে। অনেকেই শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের মহেশ নামক গরুটির কথা জানেন। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে এখনও এরকম বহু মহেশের দেখা পাওয়া যাবে। এখন এ ধরনের অতি আদরের পশুটাকে জবাই করা হলো উত্তম কুরবানী কারন তখন সত্যি সত্যি একটা প্রিয় জিনিসকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হচ্ছে। এখন যে ব্যাক্তি তার বাড়ীতে পোষা অতি আদরের পশুটিকে জবাই করতে যাবে, তার তো হাত কেঁপে যাবে ছুরি চালাতে। অতি আদরের পোষা প্রানীটির গলায় ছুরি চালাতে গেলে তো এরকম হওয়াই স্বাভাবিক। তাহলে কিন্তু সাবধান, কুরবানী হবে না । হযরত ইব্রাহীম এর হাত কি কেঁপে গেছিল তার প্রানের চাইতে প্রিয় পূত্র ইসমাইলের গলায় ছুরি চালনা সময় ? আর কুরবানীর মূল ভাব তো সেখানেই। শুধু জবাই করলেই হবে না। পরে সে প্রিয় পশুটির মাংস খেতে হবে মজা করে। তবেই সে না কুরবানীর সত্যিকার মাহাত্ম। অর্থাৎ সোজা ভাষায় পোষা কি অপোষা, পশুর প্রতি কোন মায়া দয়া করা যাবে না , হতে হবে সীমারের মত নৃসংশ, নির্মম। হৃদয়ে থাকবে না কোন মায়া দয়া । আর এটারই ব্যবহারিক প্রয়োগ হলো কুরবানী। এ প্রয়োগিক বিদ্যা অন্যত্র কাজে লাগবে আর তারই প্রস্তুতি এটা। কোথায় কাজে লাগবে ? জিহাদের সময়। নিজের জান মাল দিয়ে জিহাদে যেতে হবে। তখন অমুসলিম যত আছে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমনাত্মক যুদ্ধ করতে হবে, সে যুদ্ধের সময় অমুসলিমদের প্রতি কোন মায়া দয়া দেখানো চলবে না, হত্যা করতে হবে তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই প্রচন্ড নৃশংসতায়। আর তারই সুন্দর ও পারফেক্ট রিহার্সাল হলো কুরবানী। তাই কুরবানীর ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হলো- পরে যখন জিহাদের নামে বা ধর্মের নামে নিরীহ মানুষের গলায় ছুরি চালাতে হবে বা বুকে গুলি চালাতে হবে বা বোমা মারতে হবে তখন যেন মনের মধ্যে সামান্যতম দ্বিধা দ্বন্দ্ব বা কোমলতা প্রকাশ না পায়। কারন সামান্যতম দ্বিধা বা কোমলতা প্রকাশ পেলে তাতে আল্লাহ রুষ্ট হতে পারেন যে ! তাহলে আর জান্নাতে যাওয়া যাবে না । হৃদয় ও মনে নির্মম ও নিষ্ঠূর হওয়াই হলো কুরবানীর আসল শিক্ষা। কোরবানী দাতা যেমন নির্মম নিষ্ঠূর হবে, সমাজের সবাইকে সেরকম নির্মম নিষ্ঠূর করে গড়ে তুলতে হবে আর সেকারনেই কোরবানীর নামে প্রানীকে প্রচন্ড যন্ত্রনা দায়ক হত্যার অনুষ্ঠান করতে হবে প্রকাশ্য স্থানে, সবার সামনে যেন সবাই তা দেখে ও এ থেকে নির্মম নিষ্ঠূর হওয়ার শিক্ষা লাভ করে। কারন মদিনায় হিজরতকারী মোহাম্মদের তখন দরকার ছিল একটা নির্মম নিষ্ঠূর বাহিনী যাদের দিয়ে তিনি মক্কা দখল করে তথাকার সর্বে সর্বা হবেন। নির্মম নিষ্ঠুর বাহিনী গঠন করার স্বার্থেই তার এ প্রথার প্রচলন যা গোটা মুসলিম সমাজ ভ্রান্তভাবে গত চোদ্দশ বছর ধরে পালন করে আসছে। অথচ এর এখন নতুন ব্যাখ্যা করে বলা হচ্ছে এটা নাকি মানুষের মনের হিংসা, লোভ ইত্যাদিকে জয় করার একটা পাথেয়। কিন্তু আসলেই কি মানুষ এভাবে প্রচন্ড কষ্ট দিয়ে প্রকাশ্যে প্রানী হত্যা করে হিংসা , লোভ ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেতে পারে ? নাকি হয় তার উল্টো টা ? রক্ত ক্ষরন ঘটিয়ে মানুষ তো আরও রক্ত লোলুপ হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।