স্মরণীয় ঘটনা
মোকছেদ আলী

প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যাহা মানুষের মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত তাহার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হইয়া থাকে। কখনই মুছিয়া যায় না। এই সব ঘটনার মধ্যে কিছু থাকে আনন্দঘন, আবার কিছু থাকে বিষাদপূর্ণ। কখনও কখনও কথাপ্রসঙ্গে ঐসব ঘটনার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া প্রকাশক আনন্দলাভ করে। শ্রোতাগণও বক্তার বর্ণনা গভীর মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করিয়া বিস্ময়ে অভিভূত হয়। হাস্যরসের অবতারণা হইলে হাসিতে ফাটিয়া পড়ে। আবার বিয়োগান্তক ঘটনা হইলে শ্রোতার চোখের পাতা ভিজিয়া যায়। আবার এমন কতকগুলি ঘটনাও থাকে, যাহা রীতিমত লজ্জাকর, কখনই প্রকাশ করা যায় না। করিলে শ্রোতার মান-সম্মান গুরুতররূপে বিনষ্ট হয়। বক্তার উপর শ্রোতার শ্রদ্ধাবোধ হারাইয়া যায়। আবার এমন কিছু ঘটনা থাকে, যাহা ব্যক্ত করিলে বক্তার জীবনেরও নিরাপত্তা থাকিবে না। এই সব ঘটনাগুলির সবই হয় অপরাধমূলক।

আস্তিক লোকেদের বিশ্বাস- প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে ঘটনার সব সংবাদ যিনি রাখেন, তিনি আলেমুল গায়েব আল্লাহপাক। যাঁহার দর্শন হইতে কোন কিছুই লুকাইবার নাই, কেবলমাত্র কল্পনার খেয়ালে বিবেকবান মানুষ তাঁহারই কাছে অনুতপ্ত হইয়া, প্রকাশ করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর ভবিষ্যৎ জীবনে এইরূপ ঘটনার যেন অবতারণা না হয়, তাহার জন্য কায়মনোবাক্যে আর্জি পেশ করে।

আর দশজন মানুষের ন্যায় আমারও ব্যক্তিগত জীবনে সুখ-দুঃখের, হাসি-কান্নার ঘটনা স্মৃতিপটে অক্ষয় অমর হইয়া আছে। তাহারই কয়েকটি ঘটনার কথা লিখিব।

১ম ঘটনা: কান্টা মোল্লা।

ঘটনাটি বাল্যকালের। আমার বয়স নয় দশ বৎসর হইবে। বৈশাখ মাস। আমে আঁটি হইয়াছে। সকালবেলা। ঠান্ডা বাতাস বহিতেছে। আমি উঠিয়া আমাদের আম গাছের তলায় বাদুরে খাওয়া আম কুড়াইতেছি। আমাদের আম গাছ হইতে বিঘা চারিক দূরে ধানের জমির উপর অনেক লোক। সকলের হাতেই লাঠি। কারো হাতে ফালা। প্রায় সকল লোককেই চিনি। সহসা তাহারা চীৎকার দিয়া লাঠি দিয়া মারামারি করিতে লাগিল। মার মার শব্দ হইতে লাগিল। সেই শব্দ শুনিয়া আমার মা বাড়ীর ভিতর হইতে ছুটিয়া আসিয়া আমার কাছে দাঁড়াইল। আমি আম কুড়ানো বাদ দিয়া সেই মারামারির দৃশ্য দেখিতে লাগিলাম। আমার মা ভীত হইয়া আল্লাহ আল্লাহ করিতে লাগিল।

জসিম উদ্দীন আর কসিম উদ্দীন দুই ভাই পিছনে হটিতেছে, আবার ফালার আছারি দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া একজন লোককে আঘাত করিতে যাইতেছে। অন্যদলের আরেকজন লাঠির বাড়ি দিয়া ফালা সরাইয়া দিল। লাঠিতে লাঠিতে বাইড়াবাড়ি করিতেছে। সেকি ভীষণ দৃশ্য!

মন্ডলপাড়া হইতে অনেক লোক লাঠি সোটা হাতে করিয়া মার মার চিৎকার করিতে করিতে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে ছুটিয়া চলিল।

আমার মা সেই দৃশ্য দেখিয়া ভীত বিহ্বল কণ্ঠে কহিল, ইঃরে আল্লা! মন্ডলদের ছুটিয়া আসা দেখিয়া বিপক্ষ পার্টির সবাই যে যেদিকে পারিল, প্রাণভয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া পালাইতে লাগিল। পশ্চিম পাড়ার কান্টা মোল্লা নামক একজন লোক, হাতে বাঁশের লাঠি, দৌঁড়াইয়া আমাদের বাড়ির দিকে আসিতেছিল।

আমাদের পাড়ার দিক হইতে জসিমুদ্দিনের বড় ছেলে মতিয়ার, যেমনি জোয়ান, তেমনি দুর্ধষ্য; একখানা ফালা লইয়া কান্টা মোল্লার দিকে ছুটিয়া চলিল। মতিয়ারকে দেখিয়া কান্টা মোল্লা ঘুরিয়া দক্ষিণ দিকে দৌঁড়াইতে লাগিল। কান্টা মোল্লার খালি গা। ধুতির আঁচল দিয়া কোমড় কষিয়া বাধা। গা ঘামিয়া তলবল করিতেছে। আমি আর মা যুদ্ধক্ষেত্র হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া, মতিয়ার কান্টা মোল্লাকে ধাওয়াা করিতেছে, সেই দিকে চাহিয়া দেখিতেছি।

মতিয়ার দীর্ঘাকৃতি বলিষ্ঠ যুবক ব্যক্তি। কান্টা মোল্লা খাটো লোক। বয়স হইয়াছে। চুল দাড়ি কিছু কিছু পাকিয়াছে।

বলিষ্ঠ কুকুর যেমন তাড়া করিয়া প্রাণভয়ে পলায়নরত দূর্বল কুকুরটির সন্নিকটবর্তী হয়, দূর্বল কুকুরটি তখন আত্মরক্ষার জন্য খেঁকি দিয়া ঘুরিয়া দাঁড়ায়, মতিয়ার কান্টা মোল্লার নিকটবর্তী হইলে, কান্টা মোল্লা লাঠি দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া মতিয়ারের দিকে ঘুরিয়া দাঁড়াইল। কান্টা মোল্লা মতিয়ারকে লাঠির আঘাত হানিবার অগ্রেই মতিয়ার তাহার ফালা খুব সজোরে কান্টা মোল্লার পেটে ঢুকাইয়া দিল। তীব্র একটি আর্ত চীৎকার দিয়া কান্টা মোল্লা মাটিতে পড়িয়া গেল। তাহা দেখিয়া আমার মা চীৎকার দিয়া বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল। কান্টা মোল্লার পেট হইতে ফালা টান দিয়া বাহির করিয়া লইয়া মতিয়ার তাহার নিজ বাড়ির দিকে দৌঁড়াতে লাগিল। কান্টা মোল্লার পেট হইতে গলগল করিয়া রক্ত বাহির হইতে লাগিল। আমি রক্ত দেখিয়া দৌড়াইয়া বাড়ির ভিতর গেলাম। মা ছুটিয়া আসিয়া আমাকে তাহার বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরিল। আমি মায়ের বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া কাঁপিতে লাগিলাম।

কান্টা মোল্লার সেই আর্তচীৎকার, ঠাস করিয়া মাটিতে পড়িয়া যাওয়া, তাহার পেট হইতে গলগল করিয়া রক্ত বাহির হওয়ার দৃশ্যটি কোনদিন ভুলিতে পারি নাই। আজও মনের মুকুরে উজ্জ্বল হইয়া আছে।

তারপর ঘটনার পরিণতি যাহা শুনিয়াছি: পাঁচ বিঘা জমির দখল লইয়া হারান মালিথাদের সঙ্গে জসিম মণ্ডলদের মামলা হয়। দীর্ঘদিন মোকাদ্দমা চলে। কোন ফয়সালা হয় না। তবে জমির দখল হারান মালিথাদেরই ছিল।

জসিম মণ্ডলরা পরাক্রমশালী লোক। তাহারা মারামারি করিয়া জমির দখল লইবার সিদ্ধান্ত লইল। হারান মালিথারাও কম যায় না। তাহাদের দখলে জমি, তাহারাও দখল বজায় রাখিবার জন্য দলবল লইয়া জমিতে হাজির। জসিম মণ্ডলও দলবল লইয়া হাজির। ভীষণ মারামারি। পাইট খাটা গরীব মানুষ কান্টা মোল্লা। টাকার লোভে হারান মালথাদের পক্ষে লাঠিয়াল সাজিয়া ছিল, কিছুটা বাহাদুরি পাওয়ার জন্যও।

তখন ব্রিটিশ আমল। কড়া শাসন। বৃটিশ সাম্রাজ্যের কোন প্রজা নিহত হইলে সরকার হত্যাকারীকে খুঁজিয়া ধরিয়া ন্যায় বিচার করিয়া দোষী ব্যক্তিকে আইনের ধারা মতে উচিত শাস্তি দিত।

কান্টা মোল্লার নিহত হইবার খবর পড়াময় রাষ্ট্র হইলে, ভয়ে পাড়ার লোক গৃহত্যাগ করিয়া পলায়ন করিল। আমরাও দুই মাইল দূরে নানার বাড়ি চলিয়া গেলাম।

দুপুরে পুলিশ আসিয়া লাশ লইয়া গেল। মতিয়ার আত্মগোপন করিল। পুলিশ জসিম উদ্দীন ও কসিম উদ্দীনকে গ্রেফতার করিয়া লইয়া গেল। বিচারে ২ ভাইয়ের ৮ বৎসর করিয়া জেল হইল। কিন্তু একটি বিষয় আজো আমার বোধগম্য হয় নাই- বিষয়টি, পরদিন নানী বাড়ি হইতে আসিয়া দেখি সেই যুদ্ধক্ষেত্র জমিটার উপর একটি বাড়ি। চারিদিকে কলাগাছ দিয়ে ঘেরা। কৌতুহল নিবারণের জন্য দৌড়াইয়া সেই বাড়িতে গেলাম। ভিটায় ৪ খানা ধলা টিনের ঘর। একটি গোয়ালঘর ছোনের। গোয়ালে চাড়ি। চাড়িতে গরুর খাবার জাব। একটি গাই, সেই জাব খাইতেছে। বাড়ির ভিতর গেলাম, উঠান সমতল। ঘরে চৌকি, খ্যাঁতা বালিশ আসবাবপত্র সব। মতিয়ারের মা ঘরের বারান্দায় বসিয়া কুলায় চাউল ঝাড়িতেছে। আমাকে দেখিয়া কহিল, মোকছেদ আইছিস? বয়। মতিয়ারের মা পাড়াপ্রতিবেশী কি দূর সম্পর্কের বোন হয়, সেটা সঠিক জানি না। তবে মতিয়ারের মাকে বুবু ও আব্বাকে দুলাভাই বলিয়া ডাকি। মতিয়ার, মিনহাজ, বয়সে আমার বড়, অনেক বড়। তাই ওদের ভাগ্নের পরিবর্তে মামা বলিয়া ডাকি। যাহোক মতিয়ারের ছোট ভাই মজম আলী আমার খেলার দোসর। গতকালের এতবড় বিরাট ঘটনার বিষয় লইয়া আমিও কিছু বলিলাম না। বুবুও কিছু বলিল না। আমি চলিয়া আসার সময় শুধু কহিল, “চাচীক আসতে কইস।” আমি নানা বাড়ি গিয়া মায়ের কাছে মজম আলীদের নতুন বাড়ির কথা খুব ঘটা করিয়া বলিলাম। অবশেষে মাকে কহিলাম, “বুবু তোমাক্ যাতি কয়ছে।”

আট বৎসর পর, তখন আমি কৈশর ছাড়াইয়া যৌবনের সিড়িতে এক পা দুই পা করিয়া আরোহণ করিতেছি। সেই সময় মতিয়ারের আব্বা ও চাচা জেল হইতে বাড়ি আসিল। খবর শুনিয়া দেখিতে গেলাম। মতিয়ারের আব্বাকে যেন চিনিতেই পারি না। মুখে দাড়ি ভর্তি। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী, সাদা লুঙ্গী পড়নে, মাথায় গোল টুপি। রীতিমত মৌলবী সাহেব। আমাকে দেখিয়া কহিল, “মোকছেদ নাকিরে?” কহিলাম, “জ্বী।” “তুই তো বেশ ডাঙ্গর হইছিস, পড়াশুনা করছিস তো?” “পড়াশুনা বাদ দিয়া এখন দুলাভাইয়ের দোকানে দোকানদারী করি।” “বেশ ভালো।” তিনি প্রফুল্লচিত্তে শব্দ দুইটি উচ্চারণ করিলেন। জসিম উদ্দীন জেলখানা হইতে একেবারে পাকা মৌলবী হইয়া ফিরিয়াছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, পাড়ায় মিলাদ পড়ায়।

বছর খানেক পর, হারান মালিথা মামলায় জমির দখলের রায় পাইল। জসিম উদ্দীন ঐ বাড়ি ভাঙ্গিয়া আমাদের বাড়ির সামনে নতুন বাড়ি করিল। আমরা একঘর পরশি পাইলাম।

কান্টা মোল্লার সেই আর্তচীৎকার, ঠাস করিয়া মাটিতে পড়িয়া যাওয়া, তাহার পেট হইতে গলগল করিয়া রক্ত বাহির হওয়ার দৃশ্যটি কোনদিন ভুলিতে পারি নাই। আজও মনের মুকুরে উজ্জ্বল হইয়া আছে।

২য় ঘটনা: বাহার।

বাহার। নামের সঙ্গে তাহার চেহারার সঙ্গতি আছে। সুঠাম দেহ। অমিত স্বাস্থ্যের অধিকারী। গাত্রবর্ণ কাঁচা হলুদের মতই। যেন কাঁচা সোনা। মাথায় কোকড়ানো বাবড়ী চুল। মহিলাদের ন্যায় মাথায় সোজা করিয়া সিথি। লাঠি খেলায় পাকা ওস্তাদ। মহররমের সময় লাঠি খেলার দল গঠন করে। সে হয় দলের সর্দার। তাহার খেলার কৌশল, বন বন করিয়া লাঠি ঘোড়ানোর দৃশ্য দেখিয়া অনেক বালক মনে মনে কামনা করিত, ‘আমি যদি বাহারের মত লাঠিয়াল হইতে পারিতাম।’

ধনাঢ্য পিতার একমাত্র পুত্র। বাহারের আর সহোদর ভাইবোন নাই। তবে গুটি কয়েক চাচাতো ভাই বোন আছে। এক বাড়ির ভিতরই বসত করে। বহিবাটির দক্ষিণ কোণে একটি মসজিদ আছে। বাহারের পিতা সোনউল্লা পরামানিক নিজেই আজান দেয়।

ছাতিয়ানী গ্রামের হুজুর আলীর একমাত্র সুন্দরী কন্যার সহিত বাহারের বিবাহ হয়। বড়ইয়ের মৌসুমে, স্কুল ছুটি হইলে, স্কুল হইতে ফেরার পথে বাহারদের বড়ই গাছে উঠিয়া পাকা পাকা বড়ই পারিতাম। তাহা দেখিয়া বাহারের স্ত্রী আসিয়া ধমক দিত, “নাম্ গাছ থেকে নাম্। আস্তে আসে নাম্। পড়ে হাত পা ভাঙ্গিস না।” তাহার ধমকে আমরা গাছ হইতে নামিতাম। তখন বাহারের স্ত্রী লম্বা একটি কোটা লইয়া নিজ হাতে বড়ই পাড়িয়া দিতো। তিনি কোটার মাথায় কল বাধিয়া পাকা পাকা বড়ইয়ের ডালে লগার কল বাধাইয়া জোরে জোরে ঝাঁকি দিত। তাহার দুই হাতের কাঁচের চুড়ি তখন ঝুম ঝুম করিয়া বাজিত। ঝুম ঝুম করিয়া পাকা পাকা লাল বড়ই মাটিতে পড়িত। পড়িয়া বড়ইগুলি লাফ দিয়া একটু দূরে সরিয়া যাইত। আমরা হুটাপাটা করিয়া সেই বড়ই কুড়াইতাম। আমাদের হুটাপাটা দেখিয়া বাহারের স্ত্রী হাসিয়া লুটোপুটি খাইত। আমরা অনুরোধ করিতাম, “চাচী, ঐ ডালটায় আরেকটা ঝাঁকি দাও।” আমাদের আবদারে সে লগা বাধাইয়া জোরে জোরে ঝাকি দিত, এবার কিছু কাঁচা বড়ই পড়িত। তাহা দেখিয়া তিনি বলিতেন, “আর পাকা নাই, কাল আসিস।” আমরা পকেট ভরিয়া বড়ই লইয়া খুব খুশি মনে চলিয়া যাইতাম। কোন কোন দিন বাহারের পিতা, আমরা তাহাকে দাদা বলিয়া ডাকিতাম। পুত্রবধুর কোটা দিয়া বড়ই পাড়া দেখিয়া কহিত, “মা, এরা কি তোমার ছাত্র না পুত্র।” শ্বশুড়ের মুখে ছাত্র না পুত্র কথা শুনিয়া খিল খিল করিয়া হাসিত। বাহারের স্ত্রী লেখাপড়া জানিত।

এই সুখী দম্পতির একটি পুত্র সন্তান হয়। পুত্রটি পিতা মাতার ন্যায়ই সুন্দর এবং স্বাস্থ্যবান। পুত্রটির বয়স যখন দুই বৎসর, তখন বাহারের জ্বর হয়। গ্রামের লক্ষী ডাক্তার চিকিৎসা করে। চার পাঁচদিন পর দুপুর বেলায় বাহার বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া, রান্না ঘরের সামনে উঠানে পাতা আখা পা দিয়া লাত্থি দিয়া গুড়াইয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিল। তারপর রান্না ঘর হইতে পানি ভর্তি কলসী আনিয়া সেই ভাঙ্গা আখার ভিতর সব পানি ঢালিয়া দিয়া খালি কলসিটি উঠানে খুব জোরে আছাড় দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিল। বাহারের স্ত্রী কলসী ভাঙ্গার শব্দ শুনিয়া ঘর হইতে ছেলে কোলে করিয়া উঠানে আসিল। কলসী ও আখার দুরাবস্থা দেখিয়া স্বামীকে কহিল, তুমি কি পাগল হইয়াছ। কলসী ও আখা ভাঙ্গিলা ক্যান?

যে কোনদিন স্ত্রীকে তুমি আমি ছাড়া তুই তুকারি বাক্য কহে নাই, সে এখন স্ত্রীর কথার জবাব না দিয়া কহিল, “তুই শিগগীর এই চুলায় ভাত রান্না করিয়া দে, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। বলিয়াই সে স্ত্রীর হাত তার বলিষ্ঠ বাহুর হাত দিয়া জোরে চাপিয়া ধরিয়া টানিয়া তাহার নিজ ঘরে লইয়া গেল। স্ত্রী তখন চীৎকার দিয়া তাহার শ্বাশুড়ী ও চাচী শ্বাশুড়ীকে ডাকিতে লাগিল। বাহার স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়া চৌকির উপর ফেলিয়া দিয়া তড়িৎ গতিতে দরজায় খিল আটিয়া দিল। বাহারের স্ত্রী উঠিয়া ছেলেটিকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

বাহার ঘরের বেড়ার বাতায় রাখা কাটারি লইয়া স্ত্রীকে এলোপাথারি কোপাইতে লাগিল। স্ত্রীর গগণ বিদারী আর্ত চীৎকারে, শ্বাশুড়ী ও প্রতিবেশী লোকজন ছুটিয়া আসিল। কোপের আঘাতে স্ত্রী মাটিতে পড়িয়া অজ্ঞান হইয়া গেল। প্রতিবেশী লোকেরা লাথি দিয়া দরজা ভাঙ্গিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়া এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখিয়া হতভম্ব হইল।

ছেলেটির কোথাও কোপের আঘাত লাগে নাই। খোলা দরজা দিয়া বাহার ছুটিয়া পালাইল। সকলে তখন বাহারের স্ত্রীকে জ্ঞান ফিরাইবার চেষ্টা করিল। একজন উর্ধশ্বাসে দৌড়িয়া লক্ষী ডাক্তারের বাড়ি গেল। তাজা রক্তে ঘরের মেঝে ভাসিয়া গেছে।

লক্ষী ডাক্তার আসিয়াই রক্তক্ষরণ বন্ধের ব্যবস্থা করিল। এই ঘটনার কথা মুহুর্তে গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া গেল। নারী পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই বাহারের বাড়ীর দিকে ছুটিল। লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল। ডাক্তারের নির্দেশে অতিদ্রুত বাহারের স্ত্রীকে এক মাইল দূরে শহরের হাসপাতালে পাঠান হইল।

বাহারের এক চাচাত বোন, নাম খাতুন। বয়স ২৪/২৫ হবে। মাথায় ছিট থাকায় বিবাহ হয় নাই। বাহারের ন্যায়ই অমিত স্বাস্থ্যের অধিকারিণী। সে জনতাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “দ্যাহোগা, বাহার ভাই জব হইয়াছে, গাবতলায় শুইয়া আছে।” এতক্ষণ সবাই বাহারের স্ত্রীকে লইয়া ব্যস্ত ছিলো। বাহার কোথায় গেছে সে হদিস কেহ করে নাই। খাতুন কথায় সকলেই চমকিয়া উঠিল। বাহারদের বাড়ীর পশ্চিমধারে অনেকগুলি বাঁশের ঝাড়। বাঁশ ঝাড়ের মাঝখানে একটা মাইঠ্যাল। মাইঠ্যালের উত্তর পাড়ে একটা প্রকাণ্ড গাবগাছ। জরুরী প্রয়োজন না হইলে ঐ গাবতলায় বড় একটা কেহ যায় না। খাতুনের কথায় সকলেই দৌড়িয়া গাবতলায় আসিল।

কি অমানুষিক মর্মান্তিক দৃশ্য। দৃশ্য দেখিয়া সকলেই শিহরিয়া উঠিল। বাহারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়গণ, বুক ফাটাইয়া ক্রন্দন করিতে লাগিল। অনাত্মীয়গণেরও চোখের পাতা ভিজিয়া গেল। গণ্ড বাহিয়া অশ্রু ঝড়িতে লাগিল।

গাবগাছের প্রায় গোড়ার নিকটে মাটিতে গামছা বিছানো। সেই গামছার উপর বাহার চীৎ হইয়া শুইয়া; পরণে ধুতি খুব কষিয়া পরা। খালি গা। ডান হাতের মুঠিতে একটি ধারালো বটির ন্যারাজী শক্ত করিয়া ধরা। নিথর পড়িয়া আছে। হুলকম কাটিয়া ফাঁক হইয়া ফিনকি দিয়া রক্তে তাহার বুক ভাসিয়া গেছে। প্রচুর রক্তে তাহার বুক ভাসিয়া গেছে। প্রচুর রক্ত গড়াইয়া মাইঠ্যালে পাড়ির ঢালুতে গড়াইয়া পড়িয়া জমাট বাধিয়া গেছে। চক্ষু দুইটি নির্মিলিত। বাম হাতখানা উত্তরের দিকে সটান হইয়া আছে।

বাতাসের আগেই এই হৃদয় বিদারক খবর শহর ও পার্শ্ববর্তী ৫/৬ গ্রামে ছড়াইয়া পড়িল। এই মর্মান্তিক ঘটনা দেখার জন্য হইল্যা হাল ছাড়িল, জাইল্যা জাল ছাড়িয়া আর পোয়াতী ছাওয়াল ছাড়িয়া বাহারের বাড়ির দিকে ছুটিল। বারুনির মেলা কিম্বা প্রসিদ্ধ হাটে যে পরিমাণ লোক সমাগম হয়, আজ বাহারদের পাড়ায় যেন তাহার চেয়েও বেশি লোক জমিয়াছে। থানায় খবর গেল। দারোগা পুলিশ আসিল। দারোগা সাহেব বাহারের মাতা পিতার জবানবন্দী গ্রহণ করিয়া ডাইরীতে লিপিবদ্ধ করিলেন। বাহারের পিতামাতা জবানবন্দীতে কহিলেন, শত্র“তা বশে কেহ তাহাদের পুত্রকে হত্যা করে নাই। জ্বরে মস্তিস্ক বিকৃতি হইয়া সে নিজেই এইরূপ ঘটনা ঘটাইয়াছে।

অতঃপর বাহারের মৃতদেহ শহরের মর্গে পাঠানো হইল। দারোগা সাহেব হাসপাতালে গিয়া বাহারের স্ত্রীর জবানবন্দীতেও ঐ একই ধরনের কথা লিখিলেন, “জ্বরে বিকারগ্রস্ত হইয়া সে এইরূপ নৃশংস কাণ্ড করিয়াছে। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকিয়া বাহারের স্ত্রী সুস্থ হইয়াছিল।

তারপর হইতে আমাদের এলাকায়, সাংসারিক কারণে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হইলে, স্বামী ক্রোধভরে স্ত্রীকে শাসাইত, ‘শা-আলী তোকে বাহার জবাই করিব।’

বাহারের এই মর্মান্তিক দৃশ্যটি আজো হৃদয়পটে উজ্জ্বল হইয়া আছে।

——————–
মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলতা গ্রামে জন্ম।