সাইবার ফটোগ্রাফি

নাসিম মাহমু

 

সাইবার ফটোগ্রাফি, এটা আবার কী!

ফটোগ্রাফির প্রতি আমার বরাবরই ভীষন ঝোঁক ছিল, এখনও আছে তবে ফটোগ্রাফার হয়ে যাওটা সূদুর পরাহত তাই যখন মানুষ কম্পিউটারের সম্পর্ক বিষয়ক বিজ্ঞানীদের মহা সম্মেলনে যোগ দিতে আমেরিকার সানডিয়াগো গেলাম, তখন একটা সাধারন ক্যমেরা কিনে ফেললাম সস্তায় পেয়ে গেলাম বলে হাতে একদম সময় ছিলনা, তাই দোকানে ঢুকে সনির একটা ক্যমেরা দেখিয়ে বললাম, এটার মত দেখতে সবচেয়ে লেটেস্ট ক্যামেরাটা দিনআমি ছিলাম শেষ ক্রেতা, তা্ বাছাই করার সুযোগ ছিলনা পরের দিন সকালে ফ্লাইট, তাই ওটা হাতে নিয়ে দেখার প্রথম সুযোগ হল, প্রায় দুদিন পড় ছবি তুলতে গিয়ে বিস্মিত, ক্যামেরাও দেখি মানুষের মত হয়ে গেছে সে বুঝতে পারে কখন ছবির সাবজেক্ট হাসছে, কখন হাসছে না ইউরোপীয় ভঙ্গী নকল করে, আমাদের আর বলতে হচ্ছে না, “say cheese” শৈশবের একটা কথা মনে পরে গেল, ঢাকা এসেছি মামার বাড়ী বেড়াতে ছবি তোলা হচ্ছে, সবাই ছবি তোলার সময় বলছে,”say cheese” আমি বুঝতে পারছিলাম না, সবাইই কেন এটা করছে শিশু মনের আমি ভাবে নিলাম এটা মনে হয় ছবি তোলার দোয়া! যাই হোক এই ছবি তোলার দোয়া পড়ে আর এখন ছবি তোলার দরকার নাই, হাসি দেখলে ক্যামেরা নিজেই ছবি তুলে রাখবে গোচরে, অগোচরে প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে! জীবনের সত্যিকারের সুখগুলো বাঁধা থাক ছবিতে

পূরনো দিন গুলোতে আমাদের জীবনে ছবি তোলা হত কালে ভদ্রে শৈশবে একবার ছোট মামা ঢাকা থেকে বেরাতে এলেন, সাথে একটা সাধারন ক্যামেরা ভিউ ফাইন্ডারে দেখে সুইচ চাপলেই হল প্রতিটি  ছবি তোলার পর, হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবি টানতে হবে, পরের ছবিটা তোলার আগে তিনি আসার পরে প্রতিবেশীর হাঁসের বাচ্চার ছবি তুলে নিলেন পাঁচটি হাঁসের ছানা, একপাত্রে খাচ্ছে, গোল হ্য়ে ফুলের মত লাগছে দেখতে বহু বছর পরে সে ছবিটা দেখে অবাক হয়েছি, মুগ্ধতা এখনও কাটেনি আমার দেশের আনাচে কানাচে এত ভীষন সুন্দর কত শত কিছু রয়েছে! এত সুন্দর তার ছবি! কী অসহ্য সুন্দর কিন্তু এগুলো কিভাবে ধরে রাখা যায়? একটা ক্যামেরা যদি থাকত! সবার যদি একটা করে থাকত, তাহলে আরও ভাল হত! সবাই তার দেখা জগতটার সুন্দর আর সত্যের ছবি গুলো তুলে রাখতে পারত

সময়ের সাথে সে সুযোগও এল ক্যামেরা সস্তা হতে আরও সস্তা হল এখন মোবাইল ফোন দিয়ে এত দারুন মানের ছবি তোলা যায় যে, কথা বলা বা মেসেজ পাঠানোকে বলা যায় বাড়তি পাওনা ক্যামেরা এসেছে কত শত রকম, নানা ধরনের, নানা দামের সবার হাতে হাতে শোভা পাচ্ছে ক্যমেরা ডিম ফুঁটে বাচ্চা বের হয়েই বলবে, “আমার মোবাইল লাগবে, ক্যামেরা ওয়ালা!” আর ঘরের কোনা পার হয়েই বলবে, “আমার একটা এস, এল, আর ক্যামেরা লাগবে, ডিজিটাললাগার কী শেষ আছে! মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে।। এর আগে কালেভদ্রে দুএক জনকে পাওয়া যেত যাদের এস, এল, আর ক্যামেরা ছিলএস, এল, আর ক্যামেরাতে একটা প্রীজম থাকে, যার মধ্যদিয়ে আলো আসার কারনে ফিল্ম বা সেন্সরে যে আলো পরবে, সেই আলোই একটা পেন্টাপ্রীজমের মাধ্যমে সিধা হয়ে ভিউ ফাইন্ডারে পরে; তাই ছবিটা যেমন উঠবে, ফটোগ্রাফার ঠিক তাই দেখতে পাচ্ছে।। এস, এল, আর ক্যামেরা ডিজিটাল হওয়াতে আর মানুষের  ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় অনেকেই এখন এর দিকে ঝুকতে পারছে! আরেকটি বড় কারন, ডিজিটাল ক্যমেরাতে ফিল্ম লাগছে না খরচ অনেকটা এক কালীন! সুযোগে একটা বড় গ্রুপের মানুষের পক্ষে প্রফেশনাল হওয়াটা সহয হলো

আগেকার দিনে যারা পেশায় শিল্পী ছিলেন, রং তুলিতে যারা ইহ জগতে বিশ্ব ব্রক্ষ্মন্ডের তাবত সৌন্দর্য আঁকতেন, তাদেরই এক রুপ এই ফটোগ্রাফার যারা সত্যিই সৌন্দর্যই একেছেন অবিরত, তাদেরই এক রূপ হাতে তুলে নিলেন ক্যামেরা এটাই মাধ্যমের বিবর্তন আর কিছু নয় শৈল্পিক মনের কোন কমতি ঘটেনি, ঘটার কথাও তো নয়! কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন: করুন লজ্জাজনক! এখন ক্যমেরা হাতে পাওয়া অনেকেরই নেই শিল্পবোধ নেই ব্যক্তিত্ত্ব, নেই নান্দনিকতা বোধ এমন কঠোর কথা কিভাবে বলছি? একে একে বলছি

দেশের অগুনতি মানুষের হাতে রয়েছে অগুনতি ক্যামেরা হাতে নিয়েই শুরু হল ছবি তোলা ছবি তুলতে গিয়ে স্বাভাবিক কারনেই সবাই খোঁজ খবর নিচ্ছেন কিভাবে ছবি তুলতে হয়, অ্যাপার্চার কি, সাটার কি, ইত্যাদি সেই সাথে হয়তবড় ভাইদেরকাছ থেকেও কেউ কেউ কিছু তালিম নিচ্ছে শিখছে সাবজেক্ট কি, কি ভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে, কি করে দারূন সব ছবি তুলতে হবে, গড়তে হবে নতুন শিল্পকর্ম তাদের একটি বিড়াট অংশ বেছে নিচ্ছে সেই সব সাবজেক্ট যা কিনা আমাদের সংস্কৃতি, শিল্প আত্মা, কৃষ্টি কালচার কিছুই ধারন করে নাএকটি ধানের শীশের উপর, একটি শিশির বিন্দু চেয়ে তাদের লেন্স যেন ক্ষুধার্ত হয়ে থাকে, রাস্তার ধারের বুভুক্ষ ভীখারির কপালের ভাঁজের ঘাম তোলার জন্য না, আমি রাস্তার ধারের বুভুক্ষ ভীখারির জীবনকে লেন্স দিয়ে দেখার বিপক্ষে নই লেখার শুরুতেই বলেছি, সত্য তুলে ধরতে হবে, এবং তা আমাদেরকেই করতে হবে তবে আমাদের জাতীয় জীবনে কী শুধুই দু:, দূর্দশা, ক্ষুধা, হতাশা, বন্যা নিমজ্জিত, পানি বেষ্টিত কুড়েঘর! কেন এই অবস্থা? কেন শুধু এই দৃশ্যই সবার লেন্সে ধরা পরছে? কেনই বা সচেতন যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে এই এলজাম দিচ্ছে? কেন এই আচরনটিই এখনকার তথাকথিত আধুনিক ফটোগ্রাফারদের সংখ্যা গরিষ্ঠরাই বারংবার করছে? এটাকি ইচ্ছাকৃত? না কি এটা অজ্ঞতাপ্রশূত?

এর গুঢ় কারন লুকিয়ে য়েছে অনেক গভীরে আটকে য়েছে দীর্ঘ এক অজানা অশুভ চক্রে পশ্চিমা দেশের ছবিয়ালরা আমাদের দেশে গিয়ে যখন জীবনের এক ভিন্ন চিত্র নিজ চোখে দেখল স্বভাবতই তারা সেই ছবি গুলো তুলল, আলোচিত হল আন্তর্জাতিক ভাবে তাদের মিডিয়াতো এটাই দেখাতে চায়, দেখতে চায় দারিদ্র; তাদের জনগনকে দেখাতে চায় পৃথিবীর অন্যদেশ থেকে কত সুখে আছে তারাপশ্চিমা দেশের সুখের চিত্রই কিন্তু সাইবার জগতে ছড়িয়ে আছে! কারন তারা নিজের দেশের মন্দ দেখলেও জানে, সেটা নিয়ে ফায়দা উঠানোর কোন সুযোগ তাদের নাই তাই আমাদের মধ্যে যারা তথাকথিত ভাল ছবি তুলি তারা মুলত পশ্চিমা পুরষ্কারের নোংরা লোভ সামলাতে পারি না ওদের মন যুগিয়েই যেন ছবি তুলে যাচ্ছি সমস্যার শুরুটা ছোট হলেও এর এক মোটামুটি আকৃতির আলোচনাও দীর্ঘ হবে পেছনে রয়েছে সামাজিক মনস্তাত্তিক কারন পশ্চিমা প্রিতী স্বকীয়তার তীব্র অভাব শিক্ষাগত বা সামাজিক কারনে বৃহৎ পার্সপেকটিভে কোন কিছুই দেখতে না পারা কারন যাই হোক, ফলাফল ভয়াবহ, এবং প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদী এক দঙ্গল ছবিয়াল একত্রিত হয়েছে, প্রদর্শনীও করছে নতুন মুখরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে শুরু হচ্ছে প্রাথমিক চক্র চক্র ক্রমশ বড় হচ্ছে যারা অপেশাদার, যারা কোন প্রতিযোগীতায় যাচ্ছে না, তারাও ফেসবুক আর নানা ব্লগের কল্যানে দেখছে ভাল ছবি, “শিখছেকিভাবে যাহির করতে হবে, শুরু হল আরেকটি দল, তারাই সরল মনে এখন এই চক্র চালিয়ে নিবে এই ওয়েব . এর যুগে যেখানে, ব্যাবহারকারী নিজেই কন্টেন্ট প্রস্তুত করছে, সেখানে এর ফলাফল ভয়াবহ! আমাদের হাতে ছড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার ক্যামেরা, ব্যাগে, গলায় ঝোলানো, হাতে, প্যান্টের পকেটে, মোবাইলে, সর্বত্র, সবাই ছবি তুলছে ছবি উঠছে ফেসবুকে পরছে কমেন্ট আপনার দেশি, বিদেশি সব বন্ধু দেখছে বিদেশিরা খুশি হচ্ছে, এটাইতো তারা দেখতে চায়! আর দেশী বন্ধুরা দেখছে, শিখছে ছবি তোলার তরিকা! শিখছে হাততালী পাওয়ার সহয রাস্তা, অগোচরেই তৈরি হচ্ছে আরেক ছবিয়াল, তৈরি হচ্ছে আরেক পশ্চিমা লেন্সে দেশকে দেখার দেশি ছবিয়াল!

সাইবার জগতে বাংলাদেশ যুক্ত কোন শব্দ দিয়ে এই লেখাটি পড়ার সময়ই একটি অনুসন্ধান শুরু করুন ভয়াবহ দিকটি তৎক্ষনাৎ চোখে পড়বে আই,পি ভেদে ভিন্ন চিত্র দেখলেও যে বিষয়টি সাধারন ভাবেই চোখে পড়বে, তাহল দৈন্যতা, দুর্দশা, হতাশা, অন্যায়, অশ্লীলতা, ইত্যাদি এর দীর্ঘ তালিকা গুগল সার্চ এর সাথে সাথে, বিভিন্ন ছবি তোলা বিষয়ক সাইটেও এর খুব ব্যতিক্রম নেই এর থেকে উত্তরনের উপায় কি? একদিনে এর থেকে বের হওয়া যেমন যাবে না, আবার প্রতিনিয়তই এই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে সেই সাথে নতুন নতুন স্বদেশি বিদেশি দর্শক যেমন যুক্ত হচ্ছে, তেমন তৈরি হচ্ছে নতুন ছবিয়াল তাই আমাদরকের আশু পদক্ষেপ নিতে হবে, এখন থেকেই প্রচার করতে হবে যারা জেগে ঘুমিয়ে আছে তাদের চোখ খুলে দিতে হবে, তাদের আহবান করতে হবে এই অভিসপ্ত অশুভ চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যারা নতুন তাদেরকেও বুঝতে হবে, পশ্চিমাদের দেখা চোখ নয়, মনের শুদ্ধ চোখ দিয়ে দেখতে হবে বাংলাদেশকে, দেখতে হবে সৌন্দর্যকেও

আনো সাথে তোমারও মন্দিরা,

চন্ঞল নৃত্যেরও বাজিবে ছন্দে সে

বাজিবে কংকন, বাজিবে কিংকিনি

ঝংকারিবে মন্দিরও রুন রুন

এসো শ্যামলও সুন্দরও…” – রবি ঠাকুর

 

[সম্পাদনা: এস. সুলতানা]